Tuesday, 31 October 2023

'নোনা জল'এর সমীরুদ্দীন

স্কুলের লাস্ট বেঞ্চ অথবা 'ছিন্ন খঞ্জনা'

মালবিকা মিত্র



- হ্যালো, স্যার? আমি আপনার ছাত্র দেবাঞ্জন বলছি। মনে পড়ছে স্যার? 

- মনে করতে চেষ্টা করছি। একজন দেবাঞ্জন ছিল সাদামাটা সুবোধ বালক। সাত চড়েও মুখে রা' ছিল না। বন্ধুরা টিফিন খেয়ে নিলেও কোনওদিন নালিশ করেনি। আর একজন ছিল ভালো ফুটবল প্লেয়ার। আর তৃতীয় জন ছিল সকলের ত্রাস, কি ছাত্র কি শিক্ষক। সব পিরিয়ডে মনিটরের খাতায় নাম উঠত। 

- হ্যাঁ স্যার, আমি সেই তৃতীয় অধম। টিসি চাওয়া দেবাঞ্জন। টিসি পাওয়া ছাত্র দেখেছেন, কিন্তু টিসি চাওয়া এই একজনই। কেমন আছেন স্যার? ফেসবুকে জানলাম, বন্ধুরা বলল, আপনি কোভিড সেকেন্ড ওয়েভে মারাত্মক আক্রান্ত হয়েছিলেন! ঘাবড়াবেন না স্যার, আমরা সব দাবার ঘুঁটি, মারা অত সহজ নয়, একটি আছে অপর একটির জোরে। 

- ৬৩/৬৪ বছর বয়স হল। হার্ট লাং রেনাল সমস্যা। এত কো-মর্বিডিটি সত্ত্বেও যখন আছি- ভালোই আছি। তুই কেমন, কোথায় আছিস? 

- আমি তো স্যার এখন সুইডেনে। 

- সু - ই - ডে - ন! 

শিক্ষক অনিমেষবাবুকে খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি। বর্ষে বর্ষে দলে দলে'র ভীড়ে তাঁর স্মৃতির অ্যালবামে অধিকাংশই নামহীন ছবি। তবুও তারই মধ্যে স্পষ্ট দেবাঞ্জন। ক্লাশ সিক্স থেকে মনে আছে। খুব ডানপিটে ছেলে। টিসি চাওয়ার গল্পটা আগে বলি। 

সব ক্লাশে মনিটরের খাতায় দেবাঞ্জনের নাম উঠত। বেসামাল হয়ে অনিমেষবাবু অবশেষে বললেন- 

- আগামী তিন দিন যদি নাম না ওঠে তো বেঁচে গেলে। উঠলে, কেসটা আমার হাতে থাকবে না। সোজা হেড স্যারের কাছে চলে যাবে। ভয়ঙ্কর শাস্তি হবে তোমার। 

- স্যার, কী শাস্তি? কী শাস্তি? সমস্বরে দেবাঞ্জনের বন্ধুদের উৎসুক দৃষ্টি ও প্রশ্ন। 

হবে নাই বা কেন? সিক্স 'এ' সেকশনে একজনও বাদ যায়নি দেবাঞ্জনের পীড়ন থেকে। সবার আগ্রহ দেবাঞ্জনের শাস্তি নিয়ে। কিন্তু কাকে ভয় দেখাবেন স্যার, সে ছেলে ভয় পেলে তবে তো। 'ভয় কারে কয় নাইকো জানা।'

তিন দিন পর ক্লাশে ঢুকতে না ঢুকতে ছাত্ররা সমস্বরে, 'স্যার, তিন দিনই দেবুর নাম উঠেছে'। অনিমেষবাবু যতটা সম্ভব গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, 'এবার আর আমার হাতে কিছু থাকল না। যা করার হেডস্যার করবেন।' সবার জিজ্ঞাসা কী শাস্তি হতে পারে। 

'হুমম, হয়তো টিসি দিতে পারেন হেডস্যার', স্যারের বিমর্ষ জবাব। এরপরই আসল ত্রাসের শুরু। টিফিনে টিচার্স রুমের বাইরে অপেক্ষমান সে, 'স্যার, হেডস্যারের কাছে নিয়ে চলুন। টিসি দেবেন বলেছিলেন'। এ কাজ ও কাজ দেখিয়ে, পরে যাওয়া যাবে বলে এড়িয়ে গেছেন অনিমেষবাবু। অবশেষে বোঝালেন, 'এই স্কুল না, কোনও স্কুল না, কোথাও তুমি ভর্তি হতে পারবে না। টিসি'র মানে বুঝতে পারছ? ট্রান্সফার সার্টিফিকেট। তুমি বরং হেড স্যারকে লিখে জানাও, 'আর কখনও অন্যায় করব না। এবারের মতো ক্ষমা করে দিন।' কোনওমতে আত্মরক্ষা, নিজেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা। এমন সরল শিশু, শাস্তি সম্পর্কে যার কোনও ধারণাই নেই। তিরস্কারকে পুরস্কার বলে বরণ করতে ব্যস্ত। 'শিকল চরণে তার হয়েছে নূপুর।'

এই সেই দেবাঞ্জন। সুইডেনে কী করছে ও, অনিমেষবাবু হতবাক। ও স্কুল ছাড়ার পরেও বহু বার পথে মুখোমুখি হয়েছে। একমুখ নিষ্পাপ হাসি, নানান কথা; শুধু পড়াশোনা বা এখন কী করছিস, এসব কথা এড়িয়ে যেত। 'ছাড়ুন তো ওসব কথা। ওগুলো জিজ্ঞেস করে ভালো উত্তর পাবার মতো অসংখ্য ছাত্র আছে আমাদের স্কুলে।' দেবাঞ্জনের আলোচ্য বিষয় থাকত কোন স্যার, কোন ছাত্র, কার পেছনে কীভাবে লাগা হত সেই সব দুষ্টুমির কথা। সেই সব স্যারের খোঁজ, আর প্রাণখোলা হাঃ হাঃ হাসি। 'কী করছিস' ওর কাছে অস্বস্তিকর প্রশ্ন। 

সেই দেবাঞ্জনকে আজ প্রশ্ন করলেন অনিমেষবাবু, 'সুইডেনে কী কাজ করছিস?' 

- দেখুন স্যার, আমাদের নামী স্কুলের বেশিরভাগ ছাত্রই ইউরোপ আমেরিকায় থাকে। আমিই বা কেন দেশে থাকি। আমার যোগ্যতা অনুযায়ী একটা কাজের সন্ধানে এ দেশে এসেছি স্যার।

দেবাঞ্জনের কাছে জানা গেল, সুইডেনকে বাছাই করার কারণ হল, প্রথমত, সুইডেনে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (-)২। অর্থাৎ, কাজের তুলনায় শ্রম সরবরাহ কম। ফলে, বেতন ও কাজের সুযোগ বেশি। দ্বিতীয়ত, ও গিয়েছিল ডেনমার্কের ঠিকানায়। ডেনমার্ক আর সুইডেনের মাঝে ১১৮ কিলোমিটার লম্বা একটা প্রণালী আছে, যার নাম Oresund। Ore শব্দের অর্থ সমুদ্র সৈকত, আর Sund শব্দের অর্থ প্রণালী। এই প্রণালীর একদিকে ডেনমার্ক অন্যদিকে সুইডেন। প্রণালীর সবচেয়ে প্রশস্ত অংশটি ২৮ কিলোমিটার, আর সবচেয়ে অপ্রশস্ত সরু অংশটি ৪ কিলোমিটার। দেবাঞ্জনের কথায়, 'অনেকটা স্যার আমাদের ব্যান্ডেল-গরিফার মতো।' প্রায় আট কিলোমিটার একটা সেতু ও টানেল আছে। দেবাঞ্জন ডেনমার্কে নিকটাত্মীয়ের ঠিকানায় গেছে, কিন্তু সুইডেনে একটি হোটেলে কাজ করে, ওখানেই থাকে। 

অনিমেষবাবু শুনেছিলেন, সুইডেনে যখন দীর্ঘায়িত রাত্রি চলে তখন এদিক থেকে যাওয়া মানুষেরা মানাতে পারে না। মানসিক অসুস্থতা দেখা দেয়। শরীরের নানাবিধ ভিটামিন হরমোন এনজাইম একদম ঘেঁটে যায়। এর জন্য পয়সা খরচ করে কৃত্রিম রোদ পোহাতে হয় লাইট রুমে। জন্মের পর যেমন নবজাতককে অনেক সময় রাখা হয় ফটো থেরাপিতে। এর জন্য অনেক ফটো থেরাপি ক্লিনিক আছে সে দেশে। এসবই ওই দেশে পড়াশোনা ও চাকরি করা ছাত্রদের কাছে শোনা। দেবাঞ্জনকে এ কথা বলতেই ও বলল, 'ওসব বড়লোকের বিলাস স্যার। আচ্ছা স্যার, আমাদের দেশে কজন মানুষ কোল্ড ক্রিম, ময়েশ্চারাইজার মাখে শীতকালে? আমাদের দেশে পার্লারে স্পা করতে যায় কজন? সারাদিন হোটেলে কাজ করি। তারপর নিজের রান্না খাওয়া, সুইডিশ ভাষা শেখা। আইনের চোখ এড়িয়ে, চারটে বছর কাটিয়ে, সুইডিশটা ভালো করে শিখলে সিটিজেনশিপ পাওয়া যাবে। সেটাই এখন প্রধান লক্ষ্য।' 

- কী খাওয়াদাওয়া করিস? ওদের ওখানে হোটেলের খাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে গেছিস? 

- না না না, ভাত-সবজি-ডাল সব সেদ্ধ, আর বাটার। সস্তা এবং সহজ পাচ্য সব দেশে। এদের খাওয়ায় অনেক খরচ বেশি। টিফিনে বান রুটির মতো, ওপরে চকলেটের প্রলেপ, সেটাই সস্তা খাবার। আর মাঝে মাঝে ডিম খাই। আমাদের দেশে কার্বোহাইড্রেট প্রধানত আসে ভাত থেকে। এখানে এদের ময়দা আর আলু থেকে। কেজি কেজি আলু কেনে এরা। 

যে ছেলেটা ভালো করে বাংলা, ইংরেজি ক্লাশে মন বসাতে পারত না, সেই ছেলে সুইডিশ শিখছে সিরিয়াসলি। আবার বলছে, ডেনমার্ক তো পাশের বাড়ি। আস্তে আস্তে ডেনিস শিখে নেব। ওটা জানা খুব প্রয়োজন। নাকি, আমাদের হিন্দি জানার মতোই। আবার সাশ্রয়ী হয়েছে। ছেলে এত সিরিয়াস হল কবে। অবাক হয়েছেন অনিমেষবাবু। আরও অবাক ওর বিশ্লেষণ শুনে। বলে কিনা, 'স্যার, স্কুলে ইংরেজিটা শিখতে গিয়ে সব শেখাটাই পন্ড হল, অথচ ইউরোপে এসে দেখি ইংরেজি শিখে কোনও লাভ হয় না। এটা একটা কলোনিয়াল লিগ্যাসি। বৃটিশ প্রভু যে সব দেশ শাসন করেছে শুধুমাত্র সেখানে ইংরেজি ভাষা চলে। আর কোথাও দাম নেই। ফ্রান্স-স্পেন-জার্মানি-সুইডেন-ডেনমার্ক-হল্যান্ড কোত্থাও না। এখন ভাবলে হাসি পায় স্যার, ভাবতাম ইংরেজি না শিখলে জীবন বৃথা।' 

এইসব বলছে, স্কুলে ক্লাশের লাস্ট বেঞ্চের বেয়াড়া ছাত্র। বেড়ালের ডাক, কুকুরের ডাক, শিক্ষকদের মুদ্রাদোষ অনুকরণ, এই করেই স্কুল জীবন সাঙ্গ। তাহলে আজকের জীবনে সার্থক অভিযোজন করার শিক্ষা ও পেল কোথায়? নিশ্চিত ভাবে বিদ্যালয়ে নয়। জীবন থেকে শেখা নাকি আগেও স্কুল জীবনে ওর মধ্যে এই বোধ ছিল, টিচারদের নজরে আসেনি। অনিমেষবাবু এইসব কথা ভাবছিলেন। এখানে খবরের কাগজে পড়ে তিনি ওকে বলেছেন, 'হ্যাঁরে, কাগজে পড়লাম, সুুুইডেনে কোভিডের বাড়াবাড়ি নেই, লকডাউনের বিধিনিষেধের কড়াকড়ি নেই।' 

দেবাঞ্জন শুনে বলল, 'প্রথমত, সাধারণ ভাবে ফ্লু জাতীয় ভাইরাসের প্রকোপ ট্রপিক্যাল কান্ট্রিতে বেশি। সেই বিচারে সুইডেনে প্রকোপ কম হওয়াই স্বাভাবিক স্যার। দ্বিতীয়ত, যে ফিজিক্যাল ডিসট্যান্স বজায় রাখার জন্য লকডাউন, এ দেশে জন ঘনত্ব এতই কম যে ফিজিক্যাল ডিসট্যান্স স্বাভাবিকভাবেই বজায় থাকে।' খুব তাৎক্ষণিক ভাবে এই ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ বুঝিয়ে দিল জীবন সম্পর্কে ওর গভীর বোধের পরিচয়। 

আচ্ছা, স্কুলে থাকতে এই বোধ আমরা কি খুঁজে ছিলাম কখনও? ও কি কোনও আভাস ইঙ্গিত দেয়নি? অনিমেষবাবু স্মৃতি হাতড়াতে থাকেন- ফিরে দেখা, পেছনে, আরও পেছনে। হ্যাঁ, একবার ক্লাশ সেভেনে, হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষার বাংলা খাতায় ও কোনও উত্তর লেখেনি। শুধু একটা রচনা লিখেছিল, 'বিদ্যালয়ে তোমার একটি স্মরণীয় দিন'। মন ঢেলে লিখেছিল। ঘটনা নির্বাচন, তার উপস্থাপনা কৌশল, বাক্যের গঠন, বর্ণনায় বর্তমান ও অতীত বিচরণ, সবই ছিল অভিনব। সপ্তম ক ও খ সেকশনের বাংলা শিক্ষক একত্রে সিদ্ধান্ত করে রচনায় দশের মধ্যে দশ দিয়েছিলেন ওকে। সেদিনই তো দেবাঞ্জন আমাদের নজরে আসা উচিত ছিল। 

একদিন ক্লাশে শাস্তি পেয়ে ক্লাশের বাইরে দেবাঞ্জন। অতঃপর সে পায়ে পায়ে স্কুলের মাঠে, বাগানে। নির্জন দুপুর, দেবাঞ্জন নিরীক্ষণ করছিল বাগানের দুটি পাখি। ঠিক এই সময়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক বাসুদেববাবুর আবির্ভাব। ভয়ঙ্কর গম্ভীর আর রাগী। কিন্তু তিনি দেবাঞ্জনকে বকলেন না। বরং, কেন এখন ক্লাশের বাইরে, কেন ক্লাশ ভালো লাগে না, বাড়ির কথা, নিজের ছাত্র জীবন, এইসব গল্প করলেন। আপাত কাঠিন্যের মধ্যে এমন কোমল স্বভাব ও স্নেহপ্রবণ মানুষকে খুঁজে পেয়ে ওই দিনটাই দেবাঞ্জনের স্মরণীয় দিন হয়ে গেল। দেবাঞ্জনের ওই রচনায় একটা গুরুত্বপূর্ণ কথার উল্লেখ ছিল: দেখছিলাম নির্জন দুপুরে অপূর্ব সুন্দর একজোড়া পাখি। 'এর নাম খঞ্জনা', এএইচএম স্যার বললেন, 'এরা স্ত্রী ও পুরুষ পাখি জোড়ায় জোড়ায় থাকে।' স্যারের কথায় সেদিন স্পষ্ট হয়েছিল, স্বর্গে বেহুলার নৃত্যকে কেন জীবনানন্দ দাশ 'ছিন্ন খঞ্জনার মতো' বলে তুলনা করেছেন পাঠ্য কবিতায়। লখীন্দর বিনা বেহুলা যেন 'ছিন্ন খঞ্জনা'। এক অবিস্মরণীয় দিন। এক প্রকৃতি পাঠ। 

পরীক্ষা হলে এই একটি রচনা মন প্রাণ ঢেলে লিখেছিল দেবাঞ্জন। সেই দিনই ওকে আবিষ্কার করা উচিত ছিল, ভাবলেন অনিমেষবাবু। এমন পরিণত ও সিরিয়াস ছেলে। অনিমেষবাবু ফোনে ওকে বললেন, জার্মানি, হল্যান্ড, সুইডেনে উঁচু উঁচু পদে আমাদের ছাত্ররা আছে। ফোন নম্বর দিয়ে দেব। যোগাযোগ রাখবি, বিদেশ বিভূঁয়ে বিপদে আপদে কখনও কাজে লাগতে পারে। স্যারের সেই কথা শোনার পর ও বলল, স্যার, ওরা পন্ডিত, গবেষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার। আর আমি হলাম মুজতবা আলীর 'নোনা জল' গল্পের সমীরুদ্দীন। ওরাও আমাকে নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়বে, আমারও বিড়ম্বনা বাড়বে। ফোন নম্বর রাখলাম, কিন্তু নেহাত বাধ্য না হলে যোগাযোগ করব না।'

অনিমেষবাবু বিস্মিত। মুজতবা আলী, জীবনানন্দ দাশের ব্যবহার সবই ওর বাংলা সিলেবাস থেকে । 

- জানেন স্যার, পশ্চিমা দেশে ছোট কাজ, বড় কাজে ভেদ নেই, সবাই জানি। কথাটা মিথ্যে নয়। কিন্তু অর্থ ও বিত্তের ভেদাভেদ আছে। ও দেশের একজন অধ্যাপক আর একজন নাপিতের কাজে অসম্মান নেই, শর্ত হল নাপিতকে বিত্তশালী হতে হবে। পূর্ণ পুঁজিবাদী সমাজে বিত্তই কৌলিন্যের মাপকাঠি। 

অনিমেষবাবু দেবাঞ্জনের চিন্তাভাবনার থই পাচ্ছেন না। আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষা যে কতই অপ্রাসঙ্গিক, তা ভেবে তিনি অবাক হচ্ছেন। দেবাঞ্জনের পুরো শিক্ষাই পৃথিবীর পাঠশালায়, জীবন থেকে প্রাপ্ত। আমরা শিক্ষকরা নাকি মানুষ গড়ার কারিগর! লক্ষাধিক টাকার বেতনভোগী!


Sunday, 29 October 2023

অনন্ত যুদ্ধে ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন? (৩)

ধর্মীয় ভাবনায় রাষ্ট্র গঠন আর নয়

সুব্রত হালদার



প্রথম পর্ব:

https://ekakmatra2013.blogspot.com/2023/10/blog-post_27.html

দ্বিতীয় পর্ব:

https://ekakmatra2013.blogspot.com/2023/10/blog-post_28.html


তৃতীয় পর্ব

বর্তমান ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে আমরা দেখব থিওডর হার্জল (অস্ট্রিয়ান ইহুদি, ১৮৬০-১৯০৪) ১৮৯৭'তে প্রতিষ্ঠা করেন 'The World Zionist Organization'। তার এক বছর আগে ১৮৯৬'তে তিনি এ বিষয়ে একটি ইস্তাহার প্রকাশ করেন যাতে একদিকে ইহুদি ঐক্যের আহ্বান, আর অন্যদিকে তাদের 'প্রমিসড ল্যান্ড'এ ফিরে যাবার আবেদন ছিল। বিংশ শতকের প্রথম দিক থেকেই প্রমিসড ল্যান্ডে ইহুদি অভিবাসন বাড়তে শুরু করে। ইতিমধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮), সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব (১৯১৭), অটোমান সাম্রাজ্যের পতন এবং বলকান নীতির অংশ হিসেবে বর্তমান ইজরায়েল ও প্যালেস্টাইন অংশে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের অনুপ্রবেশ ঘটে এবং তারা 'লিগ অব নেশনস'এর ম্যান্ডেট নিয়ে এই এলাকা সামরিক ও রাজনৈতিভাবে দখল নেয়। 

এই বৃটিশ পর্বে ইহুদি অভিবাসন এই এলাকায় প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায়। গড়ে ওঠে General Federation of Labour। ১৯২০'তে General Federation of Labour'এর ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে ওঠে একটি গোপন ইহুদি সামরিক সংগঠন, যার নাম Haganh (হিব্রুতে যার অর্থ: 'Defense')। পরে ১৯২৯ সালে Chaim Weizmann (বৃটিশ ইহুদি) প্রতিষ্ঠা করেন 'Jewish Agency of Israel', যার সদর দফতর করা হয় জেরুজালেম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, Chaim Weizmann ছিলেন লন্ডনে বৃটিশ সরকারের বিশেষ ঘনিষ্ঠ। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়, আবিশ্ব ইহুদি জনগোষ্ঠীর কাছে ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাহায্যের আবেদন জানানো এবং ওই অংশে ইহুদি অভিবাসন ক্রমাগত বাড়ানো হবে। এরপর ১৯৩১'এ গড়ে ওঠে 'Irgun Zvai Leumi' (হিব্রুতে যার মানে: National Military Organization), সংক্ষেপে Itzel, যা নীতির দিক থেকে ছিল সমাজতন্ত্র বিরোধী এবং তীব্রভাবে আরব বিরোধী একটি অতি দক্ষিণপন্থী সশস্ত্র সংগঠন। এদের লক্ষ্য হিসেবে ছিল জর্ডন নদীর দুই পাশকে আরব মুক্ত করে সেখানে ইহুদি জনবসতি স্থাপন এবং এই লক্ষ্য পূরণে প্রয়োজনে সশস্ত্র ক্ষমতার প্রয়োগ।

একদিকে প্যালেস্টাইনে যখন এইরকম ঘটনাক্রম নির্দিষ্ট আকার নিচ্ছিল তখন ইউরোপে নতুন করে যুদ্ধ প্রস্তুতি চলছিল। ১৯৩৩'এ নাৎসিরা জার্মানিতে ক্ষমতা দখল করে। এরপর সেখানে শুরু হয় ইহুদি বিতারণ ও ১৯৩৯-৪৫ দ্বিতীয় যুদ্ধকালীন পর্যায়ে কুখ্যাত ইহুদি হলোকাস্ট। এর মধ্যেই মে ১৯৪২'এ David Ben Gurion নিউ ইয়র্কের বিল্টিমোর হোটেলে একটি ইহুদি জিওনিস্ট সম্মেলনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সমর্থন আদায়ে সক্ষম হন- Unrestricted Jewish Immigration to Palestine, The Creation of a Jewish Army and The Establishment of Palestine as a Jewish Commonwealth। উল্লেখ্য, এই সম্মেলনের পরে জিওনিস্ট ও নন-জিওনিস্ট ইহুদিদের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন হয়ে যায়। ইতিমধ্যেই ১৯৪০'এ Itzel ভেঙে তৈরি হয়েছে চরম দক্ষিণপন্থী Stern Gang বা 'Lohamei Heruf Yisrael' (Fighter for the Freedom of Israel)। ১৯৪৮'এ ব্রিটিশ ম্যান্ডেটে ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠন হবার পরে এই সমস্ত গোপন, আধা-গোপন বা খোলাখুলি থাকা সামরিক সংগঠনগুলি দ্রুত ইজরায়েল স্টেট মিলিটারিতে মিশে যায় এবং Haganh'এর সামরিক নেতা Pinhas Sapir নির্বাচিত হন Director General, Ministry of Defence। এই Pinhas Sapir নামটি গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, ১৯৬৩'এ অর্থমন্ত্রী হবার পর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্যের নিশ্চয়তা আদায়ে চুক্তি করতে সক্ষম হন। ইতোমধ্যে, ১৯৬৭'তে আরব-ইজরায়েল দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় এবং তার প্রভাব হয় সুদূরপ্রসারী। সে অন্য আলোচনা।

এখন প্রশ্ন হল, এই সমস্যার সমাধান কিছু আছে কী? থাকলে তা কী? এটা সম্ভবত স্পষ্ট যে ধর্মীয় ভাবনার উপরে ভিত্তি করে নির্মিত রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও রাষ্ট্রভাবনা সমূহ, কিংবা শুধুমাত্র ধর্মীয়-জাতিরাষ্ট্র গঠন এ সমস্যা থেকে বের হতে দেবে না। ফলে, ইসলামি রাষ্ট্রভাবনা, ক্রিস্টানি রাষ্ট্রভাবনা, ইহুদি রাষ্ট্রভাবনা, এমনকী আমাদের দেশের হিন্দু রাষ্ট্রভাবনাকেও বিরোধ করতে হবে। একটি আধুনিক রাষ্ট্রের থাকতে হবে মানবিক দৃষ্টিকোণ, সমতার দৃষ্টিকোণ, ন্যাচারাল জাস্টিসের দৃষ্টিকোণ। এ ছাড়া কোনও বিরোধ মীমাংসা, ধর্মীয় সংকীর্ণতা দিয়ে কোনও বিরোধ মীমাংসা আসলে অসম্ভব, অবাস্তব ও আধুনিক জগতের ক্ষেত্রে অচল। ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া, উচ্চতর স্তরের ক্রিয়া এবং আরও উচ্চতর স্তরের প্রতিক্রিয়া- এভাবে চলতে চাইলে মানবিক অবক্ষয়, জাতি দাঙ্গা, ধর্মীয় দাঙ্গা, যুদ্ধ ও নানান স্তরের পারস্পরিক হানাহানি থেকে মুক্তি নেই। আমাদের চিন্তন প্রক্রিয়ার অভিমুখ হচ্ছে (প্রায় অধিকাংশ সময়ে তাইই নজরে আসে ) প্রধানত কৌশলগত যা সাময়িক লাভ-ক্ষতির নিরিখে চুলচেরা হিসেবনিকেশের উপরে ভিত্তি করে করা। কৌশলগত হিসেবনিকেশ প্রধান জায়গা নিয়ে নিলে ইতিহাসের নির্দিষ্ট নিয়মে তার মূল্য চোকানোই দস্তুর। আমার নিজের বিশ্বাস, ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে এমন একটি ঐতিহাসিক ভুল ছিল খিলাফৎ আন্দোলনকে সমর্থন করা। ঐতিহাসিক ভুল ছিল ধর্মের ভিত্তিতে জাতিসত্তার স্বীকৃতি। আজকের দিনে কৌশলগত অবস্থানের তুলনায় নীতিগত অবস্থান ক্রমশ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। নীতিগত অবস্থানের উপরে কৌশলগত অবস্থানকে স্থান দেবার মানসিকতা একটি বিপজ্জনক প্রবণতা বলেই মনে করি। 

আজ এত বছর পরে এসে ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের বিরোধ করা অর্থহীন। কিন্তু বিরোধ করতেই হবে জিওনিস্ট ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের উদগ্র ইচ্ছেকে। আজ যদি হামাস দাবি করে, পুরো ইজরায়েলকে ইসলামি রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করাই তাদের লক্ষ্য, তবে সে লক্ষ্যকেও বিরোধ করতেই হবে। ফিলিস্তিন, ইসলামি ও ইহুদি সমন্বিত রাষ্ট্রভাবনায় রাষ্ট্র গঠনই বাঞ্ছনীয় বিকল্প হতে পারে। কিন্তু তা কার্যকরীভাবে হতে গেলে দু' পক্ষকেই কট্টরপন্থী জিওনিস্ট ধর্মমুখি রাষ্ট্র গঠনের মনোভাবকে ছাড়তে হবে। সেই আপাত অসম্ভব কাজটি তারা করবে এমন কোনও আশু বা দূরবর্তী সম্ভাবনা যেহেতু দেখা যাচ্ছে না, সুতরাং যা চর্মচক্ষে দেখা যাচ্ছে তার উপরে দাঁড়িয়ে ভাষ্য নির্মাণ করা চলে না। 

ইজরায়েল ও হামাসের ইহুদি ও মুসলিম বিরোধের মাঝখানে থাকা ও ঘটনার বলি হওয়া শান্তিপ্রিয় আধুনিক মননের অধিকারী মানুষরা সেখানে নেই, একেবারেই নেই, স্রেফ শূন্য, এমনটা ভাবা চলে না। এ দেশে যখন খিলাফৎ আন্দোলনের সমর্থন চলছিল তখন তুর্কিতে কামাল আতাতুর্কের উত্থানের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল, আমরা নেহাতই কানে খাটো হয়তো, তাই শুনতে পাইনি। তাই মনে হয়, সেই আধুনিক মননের অধিকারী মানুষরাই- তা সে আজ যতই অবরুদ্ধ স্তরে থাকুক না কেন- হতে পারে ভবিষ্যতের সত্যিকারের দিশারী। এমন মানুষ সব দেশে, সব কালেই ছিল। ফিলিস্তিন ও ইজরায়েলেও নিশ্চিতভাবে আছে। তাদের মননগত ঐক্যই বাঞ্ছিত ও কাম্য ঐক্য। সেই ঐক্যের সন্ধানই আজকের রাজনৈতিক দিশা হওয়া উচিত এবং নির্দিষ্ট দিশায় তার প্রয়োগ হতে হবে। ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রেও আজকের সময়ে বিষয়টা একইরকমভাবে সত্যি।

(শেষ)।


Saturday, 28 October 2023

অনন্ত যুদ্ধে ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন? (২)

জেরুজালেম'এর ইতিহাস

সুব্রত হালদার



প্রথম পর্ব:

https://ekakmatra2013.blogspot.com/2023/10/blog-post_27.html

তৃতীয় পর্ব:

https://ekakmatra2013.blogspot.com/2023/10/blog-post_29.html


দ্বিতীয় পর্ব:

জেরুজালেমকে হিব্রুতে বলা হয় 'ইয়ারশালেইম' বা 'শান্তির নগর'। অথচ, যুগ যুগ ধরে জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে অশান্তি নেহাত কম হয়নি এবং কেউ বলতে পারবে না এ অশান্তির আদৌ কোনও শেষ আছে কিনা। 

মধ্যপ্রাচ্যের জুদিয়া পাহাড়ি এলাকার মালভূমিতে ভূমধ্যসাগর আর মৃত সাগরের মাঝে এ শহরের অবস্থান। ইজরায়েল ও ফিলিস্তিনি উভয়েরই দাবি, জেরুজালেম তাদের রাজধানী। জেরুজালেম নগরীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এ নগরী অন্তত দু'বার ধ্বংস, ২৩ বার অধিকৃত, ৫২ বার আক্রান্ত হয়, আর উদ্ধার করা হয় ৪৪ বার। খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ সন নাগাদ রাজা ডেভিডের সময় জেরুজালেম ইজরায়েলের রাজধানী ছিল। জেরুজালেমের উপর ইহুদিদের দাবির প্রাচীন ইতিহাস দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি অতিকথার উপরে, যে অতিকথার উল্লেখ বাইবেলে রয়েছে। সেই অতিকথা অনুযায়ী, বর্তমান জেরুজালেমের একটি পাথরের উপর আব্রাহামের পৌত্র জ্যাকবের সঙ্গে তাদের ঈশ্বরের ফেরেসতার মল্লযুদ্ধ হয়। যুদ্ধ শেষে তিনি জ্যাকবকে আশীর্বাদ দান করে তাঁর নতুন নামকরণ করেন 'ইজরায়েল'। সেখান থেকেই এই নামানুসারে এই ভূখণ্ড ইজরায়েল নামে পরিচিতি পায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইহুদিদের ঐতিহ্যগত ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাদের নিজস্ব ইতিহাসের ইহুদি ধর্মের প্রাচীন বাইবেলের (তোরাহ) বর্ণনার উপর ভিত্তি করে তারা বিশ্বাস করে যে আব্রাহাম তাদের জৈবিক পিতৃপুরুষ। অর্থাৎ, ইহুদিরা আসলে একটি ফ্যামিলি-ট্রি'র জাতিগত অংশ হিসেবে একটি ধর্মীয় বর্গ। এ ক্ষেত্রে পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মের মতো ইহুদি ধর্মপ্রচার বা সে ধর্ম গ্রহণ বা বর্জনের আলাদা করে কোনও সুযোগ সম্ভবত নেই। আবার যেহেতু তা জাতিগত ও পরিবারগত অনুভবকে প্রাধান্যে রেখে তারা নিজেদের সত্তাকে বহন করে, সেই হেতু নাস্তিক বা পৌত্তলিক হলেও সে ইহুদি হিসেবেই বিবেচিত হবে। যেমন, জায়োনিস্ট রাষ্ট্র গঠনের প্রকল্পের বিরোধী অংশও ইহুদি। তারা নন-জায়োনিস্ট হিসেবে বিবেচিত।

জ্যাকব বা ইজরায়েলের সঙ্গে ঈশ্বরের ফেরেসতার লড়াই যেখানে হয়েছিল, সেটিকে বলা হয় টেম্পল মাউন্ট, যার অর্থ 'ঈশ্বরের ঘরের পাহাড়'। এই টেম্পল মাউন্ট ধর্মপ্রাণ ইহুদিদের কাছে সর্বোচ্চ পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। খ্রিষ্টপূর্ব মোটামুটি ১০০০ বছর আগে এখানে ইজরায়েলিরা শহর গড়ে তুলতে শুরু করে। খ্রিষ্টপূর্ব ৯৫৭ সালে কিং সলোমন নির্মাণ করেন ফার্স্ট টেম্পল বা 'বাইতু ল মুকাদ্দাস'। দ্বিতীয় লৌহ যুগে দুটি ইজরায়েলি রাজ্যের আবির্ভাব হয়েছিল- ইজরায়েল ও জুডা। ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা একমত যে ইজরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল খ্রিষ্টপূর্ব নবম শতাব্দী পর্যন্ত এবং জুডা রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ শতাব্দী পর্যন্ত। ইহুদিরা দিনে তিনবার প্রার্থনা করত 'বাইতু ল মুকাদ্দাস'এর দিকে মুখ করে। আবার ইসলাম ধর্মের গোড়ার দিকে নবী হজরত মহম্মদ মক্কা ছেড়ে মদিনায় চলে যাবার (৬২২ খ্রিষ্টাব্দ) সতেরতম মাস পর্যন্ত নামাজ আদায়ের অভিমুখ ছিল 'বাইতু ল মুকাদ্দাস'। যদিও সেই পুরনো কাঠামোটি আর ছিল না।

৫৮৬ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে ব্যাবিলনীয়রা ধ্বংস করে দেয় ফার্স্ট টেম্পল। কিন্তু পারস্য অঞ্চলের গভর্নর জেরুবাবলের পৃষ্ঠপোষকতায় ৫১৬ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে ওই জায়গাতেই নির্মিত হয় সেকেন্ড টেম্পল, যার নাম হয় 'জেরুবাবেল' বা 'বাবলের বীজ'। বাবেল মানে ব্যাবিলন। কিন্তু ওই অঞ্চলে রোমান বিজয় ও রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ইহুদি জনগোষ্ঠীর পরপর ব্যর্থ সামরিক অভ্যূত্থানের পরে ৭০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ রোমানরা সেকেন্ড টেম্পল বা জেরুবাবেলকে ধ্বংস করে দেয় এবং সেখানে রোমান দেবতা জুপিটারের মন্দির তৈরি করে। ইহুদি জনগোষ্ঠীকে কার্যত গণবিতারণ করা হয়। তারা ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে ।

প্রায় ৬০০ বছর পরে খলিফা হজরত উমর রোমানদের সাথে চুক্তি সম্পাদন করতে সক্ষম হন। রোমানরা জেরুজালেম ছেড়ে চলে যায়। হজরত উমর 'বাইতু ল মুকাদ্দাস'এর সামনে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। পরে খলিফা আব্দুল আল মালিক (৬৮৫-৭০৫ খ্রিস্টাব্দ) বা খলিফা আল ওয়ালিদ (৭০৫-৭১৫ খ্রিস্টাব্দ) বা দু'জনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মসজিদটি নতুন করে তৈরি হয়। নাম হয় 'মসজিদুল আকসা'। প্রসঙ্গত, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছেও জেরুজালেম অত্যন্ত পবিত্র শহর, কারণ, এখানেই এক পাথরের উপরে হেলান দিয়ে নবী হজরত মহম্মদের দেহান্ত হয়েছিল।

খ্রিষ্টানরা বিশ্বাস করে এই জেরুজালমেই জিসু খ্রিস্ট প্রথম ধর্মপ্রচার করেন। তারা মনে করে, জিসু ক্রুশবিদ্ধ হবার পর এখানেই কোনও গুহায় তাঁর দেহ রাখা হয় এবং তাঁর পুনঃআবির্ভাব এখানেই হয়েছিল। 'কনস্টানটাইন দ্য গ্রেট'এর উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় Church of the Holy Sepulchre বা Basilica of the Resurrection। এটির নির্মাণ কাজ ৩২৬ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়ে শেষ হয় ৩৩৫ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ। পরে খলিফা আল হাকিম ১০০৯ খ্রিষ্টাব্দে Church of the Holy Sepulchre'কে ধ্বংস করে দেন। পরবর্তী কালে খলিফা আজ জাহিরের নির্দেশ ও ব্যবস্থাপনায় চার্চটি পুনঃনির্মিত হয়। এই চার্চের সামনেই খলিফা হজরত উমর নামাজ পড়েছিলেন। পরে মুসলিমরা সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করে। সেটির নাম দেওয়া হয় 'মসজিদে উমার'। 

দেখা যাচ্ছে, জেরুজালেম এমন এক 'পবিত্র' নগরী যা ইহুদি, মুসলিম, খ্রিষ্টান- তিন ধর্মের কাছেই পবিত্র। আবার খ্রিষ্টানদের একটা বড় অংশ মনে করে জিসু খ্রিস্টের মৃত্যুর জন্য ইহুদিরাই দায়ী। আর ইহুদি ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, 'বাইতু ল মুকাদ্দাস' বা 'পবিত্র ঘর' এখন সেখানে না থাকলেও তৃতীয়বারের জন্য নির্মিত হবে। সেটি কোথায় হবে? অনুমান করা হয় টেম্পল মাউন্ট বা হারাম শরিফ এলাকাই সেই জায়গা। ফলে, এই জায়গাটিকেই এখন 'বাইতু ল মুকাদ্দাস' বলা হয়, কোনও নির্দিষ্ট কাঠামোকে নয়।

সংক্ষেপে এবার দেখে নেওয়া যাক বিখ্যাত সোনালী গম্বুজ বা 'ডোম অফ দ্য রক'এর ইতিহাস। এটিকে আরবিতে বলে 'কুব্বাতু স সাখরাহ', আর হিব্রুতে 'কিপ্পা হা-সেলা'। এটি নির্মাণ করেন খলিফা আব্দুল মালিক ৬৯১ খ্রিষ্টাব্দে। এটি তিনি ঠিক সেই জায়গাতেই নির্মাণ করেন যেখানে সেকেন্ড টেম্পলকে ধ্বংস করে রোমানরা বানিয়েছিল তাদের জুপিটারের মন্দির। এই গম্বুজটি ১০১৫ খ্রিষ্টাব্দে ধ্বংস হয়ে যায় এবং ১০২২-২৩ খ্রিষ্টাব্দে পুনর্নির্মিত হয়। এটি ইসলামি স্থাপত্যবিদ্যার প্রাচীন নিদর্শন একটি আট কোণা গম্বুজ। এই 'ডোম অফ দ্য রক' হচ্ছে টেম্পল মাউন্টের অন্তর্গত এবং মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র পাথর। এটির সোনালী গম্বুজ জর্ডনের রাজার পাঠানো সোনা গলিয়ে নির্মিত। আপাতত হামাসের আক্রমণে একটি অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত।

প্রসঙ্গত ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান সুলেমান পুরনো জেরুজালেম শহরের চারপাশে পাঁচিল তুলে দেন। সেই পাঁচিল দেখেই ওল্ড সিটিকে চেনা যায়। পুরনো শহর ঐতিহ্যগত ভাবে চার অংশে বিভক্ত হয়ে বসতি সেটলমেন্ট রয়েছে- আর্মেনীয়, ইহুদি, মুসলিম ও খ্রিষ্টান অংশ। 'ডোম অফ দ্য রক' জর্ডন-প্যালেস্টাইন ওয়াকফ বোর্ডের অধীনে। ১৯৮১ সালে ওল্ড সিটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই ওল্ড সিটিতে ঢোকবার জন্য গেট আছে মোট ১৭টি। তার মধ্যে ৬টি স্থায়ীভাবে বন্ধ। বাকি ১১টি গেট দিয়ে ভিতরে ঢোকা যায়, যার ১০টি মুসলিমদের জন্য আর মাত্র ১টি ইহুদিদের জন্য খোলা। এই আশ্চর্য ব্যবস্থা কেন, এ প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। কারণ, ইহুদিরা টেম্পল মাউন্ট বা হারাম শরিফ এলাকাটিকে এতটাই পবিত্র মনে করে যে তার পবিত্রতা রক্ষার্থে ওই এলাকাতে তারা পা ফেলতেও চায় না। ধারণা করা হয়, 'ডোম অফ দ্য রক'এর ঠিক নিচেই ওই জায়গা।

ক্রমশ...

Friday, 27 October 2023

অনন্ত যুদ্ধে ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন? (১)

ইতিহাস ও বর্তমান

সুব্রত হালদার



ইজরায়েলের বর্তমান ঘটনাবলী জীবনের সমস্ত ধরনের অধিকারকে ক্রমাগত অস্বীকার করে যে অভিমুখে চলেছে তাতে কবির ভাষায় বলতে হয়-

'প্রতিটি শিরা অশ্রুস্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে হৃদয়াভিগর্ভে

শাশ্বত অসুস্থতায় পচে যাচ্ছে মগজের সংক্রামক স্ফুলিঙ্গ।' 


যে ভাবে ঘটনাপ্রবাহ ও সম্ভাব্য ঘটনাবলী আমাদের যুগপৎ আশঙ্কিত ও আতঙ্কিত করে তুলেছে তার অভিঘাত এতটাই প্রবল ও হৃদয়স্পর্শী হয়ে উঠেছে যে, সমস্ত জটিলতা সরিয়ে রেখে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ ও জীবনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই সময়ের প্রাথমিক ও সর্বোচ্চ দাবি হয়ে উঠেছে। সমস্ত শুভবুদ্ধি ও গণতান্ত্রিক বোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলের সামনে যুদ্ধ, সম্পত্তি ও প্রাণহানি বন্ধ এবং সর্বার্থে জীবনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে কার্যকরী উদ্যোগ ও হস্তক্ষেপের দাবি জানানো ছাড়া আর কোনও দ্বিতীয় উপায় দেখি না। ঘটমান যুদ্ধ কারা শুরু করেছে, তার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় কারা কতটা যুদ্ধাপরাধ করেছে ও করছে- সে প্রশ্নের চুলচেরা বিশ্লেষণ আপাতত থাক; বরং সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য যে বারুদের স্তূপের উপরে দাঁড়িয়ে আছে তাতে অগ্নিসংযোগ করা থেকে বিরত হওয়াটাই প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত। ফলে, ভূমধ্যসাগর থেকে মার্কিন রণপোত সরিয়ে নেওয়াটাই প্রথম কর্তব্য।

একদিকে ইজরায়েল-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ, অপরদিকে হামাস সহ প্যালেস্টাইনের জনগণের থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন জঙ্গী গোষ্ঠীর সাথে পেট্রোডলারে সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের গোপন বা খোলাখুলি সম্পর্ক যে পরিস্থিতিকে ক্রমাগত জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে, এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। আর একটি বৃহত্তর আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের প্রেক্ষাপট যে ভাবে রচিত হচ্ছে তার প্রভাব অকল্পনীয় রকমের সূদুরপ্রসারী হতে পারে। একমাত্র সব পক্ষের নিবৃত্তি ও আধুনিক মনস্কতা নিয়ে বিরোধ মীমাংসা করাটাই সুবিবেচনার কাজ হবে বলে বিশ্বাস। দেখা যাচ্ছে, ইয়াসের আরাফতের নেতৃত্বে PLO ও স্টেট অফ ইজরায়েলের মধ্যে যে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তার মান্যতা আর সেভাবে নেই। ফলে, প্রয়োজন রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফে নতুন করে উদ্যোগ গ্রহণ করা।

এই পরিস্থিতির আবর্তের থেকে আপাতভাবে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে একটু দেখে নেওয়ার চেষ্টা করা যাক ঘটনাক্রম ও পরিস্থিতির জটিলতাকে। 

প্রথমেই এই প্রশ্ন আসবে, হামাস (Harakat al-Muqawama al-Iskamia বা Islamic Resistance Movement) হঠাৎ এমন হামলা করতে গেল কেন? এক রাতেই ৫০০০ থেকে ৭০০০ রকেট হামলা হয়েছে, প্যারাট্রুপিং করে হামাস গেরিলা যোদ্ধাদের নামানো হয়েছে এবং এক বড় সংখ্যক নাগরিকদের পণবন্দী করা হয়েছে। আপাত ক্ষমতার ভারসাম্যের নিরিখে হামাস একটি অসম যুদ্ধ শুরু করেছে যা স্ট্রাটেজিকালি ও ট্যাকটিকালি গেরিলা যুদ্ধের পর্যায়ভুক্ত। ১৯৮৭ সালে মুসলিম ব্রাদারহুড থেকে ভেঙে আসা এই সুন্নি ইসলামি রাজনৈতিক ও সশস্ত্র মিলিটারি সংগঠন মূলত গাজা স্ট্রিপে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটিয়েছে এবং সেখানে ডি-ফ্যাক্টো সরকার চালাচ্ছে। কিন্তু সম্ভবত এদের নেতৃত্ব বসে আছে কাতারে। ইজরায়েলের অভিযোগ এবং স্বাভাবিক গেরিলা যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী, এ ক্ষেত্রে সাধারণ ফিলিস্তিনি জনগণকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে হামাস। বিদেশি মদত আছে- এই অভিযোগের আঙুল তোলা হয়েছে মিশর, ইরান, সিরিয়া, জর্ডন, লেবানন, তুর্কির দিকে। মিশর থেকে টানেল যোগাযোগ মারফত নিয়মিত অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ আছে। 

হামাসের ঘোষিত লক্ষ্য সমগ্র ইজরায়েলকে ইসলামি দেশে রূপান্তর ও ফিলিস্তিন জনগণের স্বাধীনতা ও মুক্তি। কিন্তু সেই লক্ষ্যকে সফল করতে কি তারা স্ট্রাটেজি হিসেবে আসলে অন্যান্য ইসলামিক দেশকেও যুদ্ধে জড়িয়ে নিতে চাইছে? নাকি, তারা আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে ফিলিস্তিন জনগণের দীর্ঘ বঞ্চনা ও দুর্ভাগ্যপীড়িত জীবনের দিকে? নাকি, হামাস মনে করে যে, দীর্ঘ গেরিলা ও প্রথাগত যুদ্ধে তারা ইজরায়েলের উপরে সামুহিক বিজয় অর্জনে সক্ষম এবং তার জন্য তারা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট প্রস্তুতি গড়ে তুলতে পেরেছে। নাকি, তারা স্রেফ শিখণ্ডী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে? 

এই আপাত ইজরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে নানান দিকের নানান লাভক্ষতির হিসেবনিকেশ আছে। যেমন, রাশিয়ার লাভটাও ফেলে দেওয়া যায় না। ইউক্রেন থেকে এর ফলে ফোকাসটা যেমন ঘুরে গেল, ঠিক তেমনই ইউক্রেনে মার্কিন সাহায্য অর্ধেক ছেঁটে ফেলে তা তড়িঘড়ি ভূমধ্যসাগরের পূর্ব পাড়ে পাঠানো হচ্ছে। অথবা, পশ্চিমি শক্তিগুলির সামগ্রিক বলকান ও মধ্যপ্রাচ্য নীতির সাথেও এটা সংযুক্তভাবে দেখা চলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেন ধরেই নিচ্ছে ইরান এ যুদ্ধে যে কোনও সময় জড়াবে, তাই মার্কিন আস্ফালন ইরানের দিকে; বা একটা ব্লক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলি এই যুদ্ধে ১৯৪৮ কিংবা ১৯৬৭ সালের মতোই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংযুক্ত হয়ে পড়তে পারে। আবার পরিস্থিতি তেমন মোড় ঘোরার জায়গায় পৌঁছলে রাশিয়া নিজেকে বিযুক্ত রাখবে এমনটা নাও ঘটতে পারে।

ফিলিস্তিন জনগণের সাথে ইহুদি জনগোষ্ঠীর বর্তমান সংঘাতের ইতিহাস প্রায় ১০০ বছরের বেশি সময়ের পুরনো, যদিও তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের প্রাচীনত্ব প্রায় তিন হাজার বছরের। এই সংঘাতের মর্মবস্তুতে একদিকে রয়েছে অতিকথা, বিশ্বাস, ধর্ম, আচার, সুপ্রাচীন ঘটনা পরম্পরা ও ইতিহাসের বোঝা। অতীত এসে ঢুকে পড়েছে বর্তমানে এবং তা প্রতি মূহুর্তে প্রভাবিত করছে বর্তমানকে; আর অন্যদিকে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীগুলির আগ্রাসন, হস্তক্ষেপ, ও ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাস-নির্দিষ্ট ফলশ্রুতি। একদিকে রয়েছে কমিউনিজমের বিস্তার রোধে পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদের সাথে ইসলামি দেশগুলির ঐক্য ও একই সাথে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। আবার জিওনিস্ট ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েলের সাথে একই প্রশ্নে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির ঐক্য সুপ্রসিদ্ধ। একদিকে রয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ইহুদি জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ ও তার ফলশ্রুতিতে তাদের উদ্বাস্তু হয়ে যাবার সুদীর্ঘ ইতিহাস, যার সর্বোচ্চ পরিণতি জার্মানিতে ইহুদি হলোকাস্ট; আবার রয়েছে পশ্চিমি সমাজ-অর্থনীতি-বিজ্ঞান-রাজনীতিতে ইহুদি জনগোষ্ঠীর মূল্যবান অবদান। একদিকে রয়েছে ইসলামি ব্রাদারহুড বা প্যান ইসলামিক মুভমেন্ট, আর অন্যদিকে রয়েছে জায়োনিস্ট রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষায় ইহুদি পবিত্রভূমি দখলের জন্য জঙ্গি আন্দোলনের ইতিহাস। রয়েছে দু' দুটো আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ (১৯৪৮ ও ১৯৬৭)। রয়েছে ১৯৪৮ পরবর্তীতে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার যুদ্ধ বনাম ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠন ও তার সীমানা বাড়ানো, ইজরায়েল স্টেট আর্মি ও প্যালেস্টাইনের জনগণ ও সশস্ত্র সংগঠন সমূহের মধ্যে নিরন্তর সংঘর্ষের ইতিহাস। রয়েছে জমি ও এথেনিক জনতার অনুপাত ও আনুপাতিক হারের নিয়মিত একপাক্ষিক পরিবর্তন, ফিলিস্তিনি জনতার 'নবকা' হলোকস্টের ইতিহাস। রয়েছে অত্যাচারিত থেকে অত্যাচারী হয়ে ওঠার ইতিহাস, এক সময় উদ্বাস্তু হতে থাকা ইহুদি জনগোষ্ঠীর জায়োনিস্ট আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ফিলিস্তিন জনগোষ্ঠীর উদ্বাস্তু হয়ে যাবার ইতিহাস। রয়েছে ১৯৪৮'এর আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের পর বর্তমান গাজা স্ট্রিপ মিশর ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক জর্ডনের দখলে চলে যাবার ইতিহাস; আবার ১৯৬৭ সালের আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের পর অঞ্চল দুটিকে ইজরায়েলের দখলে আনা।

১৯৬৪'তে Palestine Liberation Army (PLO) গঠন (হেড কোয়ার্টার আল বিরেহ, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক), যাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল সমগ্র ইজরায়েল ভূ-খণ্ডকে ইসলামিক আরব রাষ্ট্রে রূপান্তর ও ইহুদি জিওনিস্ট রাষ্ট্রের অপসারণ। ১৯৯৩'তে বিরোধ মীমাংসার লক্ষ্যে সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে অসলো চুক্তি সম্পাদিত হল, যেখানে PLO প্রধান মেনে নেবেন ইজরায়েল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং প্যালেস্টাইন অঞ্চল হিসেবে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজা স্ট্রিপ দাবি করবেন। ইজরায়েলও সে দাবি মেনে নেবে। বর্তমানে গাজা স্ট্রিপে বাস করেন প্রায় ২০ লক্ষ ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে প্রায় ৩০ লক্ষ প্যালেস্টাইন জনগোষ্ঠী। কিন্তু ইতিপূর্বে ১৯৮২'তে তৈরি হয়েছে Hezbollah (১৯৮২) নামক শিয়া জঙ্গী গ্রুপ, যার অর্থ Party of Allah বা Party of God, যাদের সদর দফতর লেবাননের রাজধানী বেইরুটে, কিন্তু প্রভাবিত অঞ্চল ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে।

হামাস ছাড়াও গাজা স্ট্রিপে সক্রিয় আর একটি সুন্নি ইসলামি সংগঠন Islamic Jihad Movement in Palestine বা Palestine Islamic Jihad, সংক্ষেপে PIJ (১৯৮১); দুটোই ভেঙে তৈরি হয়েছে 'The Society of the Muslim Brotherhood' (জন্ম ১৯২৮ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের অব্যবহিত পরে ), যাদের লালিত স্বপ্ন ও অঙ্গীকার সব দেশের মুসলমানদের ঐক্যের উপরে দাঁড়িয়ে এক বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র গঠন, যা উত্তর আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে সুদূর ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হবে, সংক্ষেপে যা প্যান-ইসলামিক আন্দোলন। লক্ষণীয়, এটি জাতি রাষ্ট্রকে প্রতিস্থাপন করতে চায় ধর্মরাষ্ট্র দিয়ে। হামাস দাবি করে সমগ্র ইজরায়েল রাষ্ট্রকে তারা ইসলামিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করবে, ফলে ধর্মরাষ্ট্র ও জাতিসত্তাগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এ ক্ষেত্রে হাত ধরাধরি করে আছে। প্রসঙ্গত অভিযোগ যে, হামাস ও অন্যান্য ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে সামরিক, মানবিক, অর্থনৈতিক সহযোগিতা করছে ইরান, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডন, মিশর, লিবিয়া, তুরস্কের মতো দেশগুলি। ফলে, সমস্যাটি আদতে একটি বৃহত্তর আন্তর্জাতিক পরিসর পেয়েছে। এই সামুহিক জটিলতার মাঝে আর একটি নির্দিষ্ট জটিলতা তৈরি হয়ে রয়েছে 'পবিত্র' জেরুজালেম শহরকে কেন্দ্র করে। সেই প্রশ্নটি আমরা সংক্ষেপে দেখে নেব।

ক্রমশ...

দ্বিতীয় পর্ব:

https://ekakmatra2013.blogspot.com/2023/10/blog-post_28.html

তৃতীয় পর্ব:

https://ekakmatra2013.blogspot.com/2023/10/blog-post_29.html


Tuesday, 24 October 2023

মহুয়া বনাম আদানি-মোদি

এক বিস্ফোরণের মুখে?

প্রশান্ত ভট্টাচার্য



'আমার বাড়িতে সিবিআই হানা দিতে পারে বলে শুনেছি। আমি এখন দুর্গাপুজো নিয়ে ব্যস্ত রয়েছি। এই মুহূর্তে সিবিআই যদি আমার বাড়িতে আসে তবে আমার ক' জোড়া জুতো আছে তা গোনা ছাড়া আর কোনও কাজ থাকবে না। আমি সিবিআই'কে জুতো গোনার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। তবে প্রথমে অনুগ্রহ করে, ভারতীয়দের কাছ থেকে আদানি ১৩ হাজার কোটি টাকার যে কয়লা চুরি করেছে, তার  এফআইআর হোক।' 

শাবাশ মহুয়া! আপনি শুধু বাগ্মী সাংসদই নন, আপনি সাহসী এবং দুর্মুখও। যখন আপনাকে বিঁধবার জন্য ব্যূহ রচনা করেছে মোদী-আদানি কম্বিনেশন, আর আপানার পাশে আপাত-দৃশ্যে আপনার দল নেই, তখনও আপনি সপাটে হাঁকিয়ে খেলছেন আপনার এক্স-হ্যান্ডেলে। 

বাংলার সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক দলগুলো গোটা ব্যাপারটা নিয়ে হিম-নীরবতা পালন করছিল। কিন্তু যখন দেখছে, আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় লড়াই জারি রেখেছেন, তখন দু'-একজন সরব হতে শুরু করেছেন। দেরিতে হলেও তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা ফিরহাদ হাকিম মুখ খুলেছেন। এক টিভি সাক্ষাৎকারে ফিরহাদের মন্তব্য, ‘আমি মনে করি, মহুয়ার কণ্ঠরোধ করার জন্য একটা ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। মহুয়া যেহেতু ভোকাল বেশি তাই এরকম করা হচ্ছে।’ কলকাতার মেয়র সুনির্দিষ্টভাবে দাবি করেছেন, মহুয়া বিজেপি'র বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলেন বলেই তাঁকে বিপাকে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। অথচ, দলগত ভাবে তৃণমূল কিন্তু অন্য কথা বলছে! দলের রাজ্য সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষ জানিয়েছিলেন, আপাতত এ ব্যাপারে দলের কিছু বলার নেই। অন্যদিকে, তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ তথা জাতীয় স্তরের মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন রবিবার সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে জানান, কৃষ্ণনগরের সাংসদের বিরুদ্ধে সংসদীয় প্যানেল অর্থাৎ এথিক্স কমিটির তদন্ত শেষ হলে তাঁকে নিয়ে দল যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেবে। 

এখানে একটা এড়িয়ে চলা মনোভাব কি স্পষ্ট নয়? তৃণমূল জানে, বিজেপি সাংসদ বিনোদ কুমার সোনকারের নেতৃত্বে লোকসভার এথিক্স কমিটির ১৫ জন সদস্যের মধ্যে (সাতজন বিজেপি, একজন শিবসেনা (শিন্দে), চারজন কংগ্রেস এবং একজন করে শিবসেনা, বিএসপি, জনতা দল (ইউনাইটেড) এবং সিপিআই(এম) সাংসদ) তাদের দলের একজনও নেই। ফলে, মহুয়ার বিরুদ্ধে তোলা বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবেকে পালটা প্রশ্ন ছোড়ার কেউ নেই। সমূহ সম্ভাবনা মহুয়ার বিরুদ্ধে একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়ার, আর তখন ঘাসফুল শিবির হাত গুটিয়ে নেবে, কেননা, সংসদ ও তার কমিটিগুলো বাইবেল-গীতা-কোরানের মতো পবিত্র ও অনড়। কৃষ্ণনগরের সাংসদ প্রশ্নে কেন তৃণমূল দলগতভাবে এমন পদক্ষেপ করছে তা নিয়ে পরে আলোচনায় আসা যাবে, তার আগে মহুয়া মৈত্রর 'অপরাধ' বা 'ভুল'টা কোথায় আলোচনা করে নেওয়া যাক। 

ঝড়ের গতিতে ইংরেজি বলা, স্যাম্পেন মুখে ছবি পোস্ট করা, সংসদে তথ্যসমৃদ্ধ ও তীক্ষ্ণ বক্তব্য রাখা বাঙালি ললনা মহুয়া মৈত্র আদানিকে এক্সপোজ করার যুদ্ধে নেমেছেন। আদানির স্ক্যান্ডাল এতটাই গভীর ও ভয়ঙ্কর যে সেগুলি এক্সপোজ করে দিলেই বিজেপি ও আরএসএস ধরাশায়ী হয়ে যাবে। জাহাজডুবি হয়ে যাবে। তাই গেরুয়া শিবির পাগল হয়ে গিয়েছে। সংসদে যিনি আদানির বিরুদ্ধে সরব হবেন তাঁকেই 'কোতল' করতে হবে। প্রথম উদাহরণ রাহুল গান্ধী। এরপর সঞ্জয় সিং- তাঁকে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হয়েছে। এখন টার্গেট মহুয়া মৈত্র। কিন্তু মহুয়াকে দমানো যাচ্ছে না। ২১ অক্টোবর শনিবার সরাসরি এক্স-হ্যান্ডেলে মহুয়া লিখেছেন, 'দুঃখিত মিস্টার আদানি। আমি 'শান্তি'র বিনিময়ে ছ' মাসের জন্য মুখ বন্ধ রাখার আপনার প্রস্তাবিত ডিল গ্রহণ করছি না। আমি আপনার দ্বিতীয় প্রস্তাবটিও মানছি না, যেখানে আপনি আপনাকে আক্রমণ করাটা মেনে নিতে চান, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে নয়।' শুধু এটুকুই নয়, মহুয়া আরও লিখেছেন,  'Adani used to CASH TO NOT QUESTION. Now he is forced to create a fake CASH FOR QUESTIONS.'। 

দল পাশে না থাকলেও মহুয়া প্রথম থেকেই আক্রমণাত্মক। এমনকী, দর্শন হিরানন্দানির হলফনামার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পরে মহুয়া পালটা পিএমও-র দিকে আঙুল তুলেছেন। মহুয়ার বক্তব্য, হিরানন্দানির ‘হলফনামা’ সাদা কাগজে লেখা হয়েছে। তাতে কোনও ‘অফিসিয়াল লেটারহেড’ বা ‘নোটারি’ করা নেই। কৃষ্ণনগরের সাংসদের প্রশ্ন, মাথায় বন্দুক ঠেকানো না হলে কি হিরানন্দানির মতো একজন সম্মাননীয় এবং শিক্ষিত শিল্পপতি কখনও এরকম সাদা কাগজে সই করবেন? এই অভিযোগ সপাটে গিলে হিরানন্দানি একদিন পরেই দুবাই থেকে (এবারে নোটারি করে) আবারও হলফনামা দাখিল করেছেন। হিরানন্দানির ‘হলফনামা’য় কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী এবং শশী তারুরের নামও উল্লিখিত হয়েছে। প্রেস বিবৃতিতে মহুয়ার মন্তব্য, ‘সব কা নাম ঘুসা দো, অ্যায়সা মওকা ফির নেহি আয়েগা!’ অর্থাৎ, সকলের নাম ঢুকিয়ে দাও, এরকম সুযোগ আর আসবে না।

'টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন' বিতর্কে সাংসদ আরও দাবি করেছেন, হিরানন্দানি ও তাঁর বাবাকে ২০ মিনিট সময় দেওয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে তৈরি খসড়া ‘হলফনামা’য় সই করার জন্য। সই না করলে হুমকি দেওয়া হয়েছে তাঁদের সব ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার। মহুয়ার বক্তব্য, 'দর্শন হিরানন্দানির বাবার আবাসন শিল্প রয়েছে। তাঁকে সরকারি লাইসেন্সের ওপর নির্ভর করতেই হয়। হিরানন্দানিও যে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, সেখানেও দরকার হয় সরকারি লাইসেন্স। উত্তরপ্রদেশেই ওঁর ৩০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। ওঁদের বলা হয়েছে, সব ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হবে। সিবিআই অভিযান চালাবে। ইডি নামবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ওঁদের ঋণ পাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।’ মহুয়ার দাবি, এই চাপে পড়েই তৈরি করা ‘হলফনামা’য় সই করতে বাধ্য হয়েছেন হিরানন্দানি।

বিতর্কিত সাংসদের এসব দাবিও প্রমাণ সাপেক্ষ। কিন্তু যেটা লক্ষ করার, মহুয়া আক্রমণাত্মক হলেও বিজেপি-বিরোধী দলগুলো মহুয়া বনাম আদানি-মোদী দ্বৈরথে আশ্চর্যজনক ভাবে এখনও নীরব। যদিও কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী ও মুখপাত্র সুপ্রিয়া শ্রীনেট মহুয়ার প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন ব্যক্ত করেছেন; সিপিআই(এমএল) লিবারেশন'এর নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য'ও বিবৃতি দিয়ে মহুয়া মৈত্র'র পাশে দাঁড়িয়েছেন। তৃণমূলের মতো ইন্ডিয়া জোটের অন্যরাও হয়তো মনে করছে, মহুয়া নিজে যথেষ্ট সাবলীল এই বিষয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। এই ভাবনাটা বিপদজনক। গণতন্ত্রের মোড়কে আসা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কাউকে একা ছেড়ে দেওয়া শিশুসুলভ রাজনৈতিক প্র্যাকটিসের লক্ষণ। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের স্বার্থে মোদী-আদানি সমীকরণকে যেখানে অনেক বেশি এক্সপোজ করা জরুরি, তখন তা মহুয়ার ব্যক্তিগত লড়াই বলে ছেড়ে দেওয়াটা বড় বিপদ ডেকে আনছে। বিজেপি কিন্তু বিরোধীদের মতো ফেন্সিং-এ বসে পা দোলাচ্ছে না, তারা রীতিমতো আক্রমণ শানাচ্ছে। বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র শেহজাদ পুনওয়াল্লা দাবি করেছেন, 'তৃণমূল মুখপাত্র জানিয়েছেন, 'আমরা মন্তব্য করব না। সাংসদ নিজে আত্মরক্ষা করবেন’। এর অর্থ, এক, তৃণমূল মেনে নিয়েছে মহুয়া মৈত্র গুরুতর অন্যায় করেছেন। সুবিধা নিয়ে বিদেশের মাটি থেকে তাঁর সংসদের লগ-ইন আইডি ব্যবহার করতে দিয়েছেন। দুই, তৃণমূল এটা মেনে নিলে তাঁকে কেন বহিষ্কার করছে না?' 

মূল অভিযোগকারী বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে মহুয়ার বিরুদ্ধে লোকপাল তদন্তের দাবিও তুলেছেন। বিজেপি এত তৎপরতা দেখাচ্ছে কারণ তারা জানে, লোকসভার এথিক্স কমিটি বহিষ্কারের সুপারিশ করে না এবং তা কখনও করেনি। এ প্রসঙ্গে লোকসভার প্রাক্তন মহাসচিব পিডিটি আচারির মন্তব্য, এটি সর্বোচ্চ স্তরে সাধারণত সাসপেনশনের সুপারিশ করে, এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু বিজেপি চায়, মহুয়া যেন আর লোকসভায় ঢুকতে না পারে, না পারে মোদী-আদানিকে জড়িয়ে যুক্তিজাল বিস্তার করতে। মোদী-শাহরা জানেন, আহত বাঘ মহুয়া যদি এরপরে লোকসভার আগামী অধিবেশনে ঢোকার সুযোগ পান, তবে ছিঁড়ে ফেলবেন আরএসএস-বিজেপির সেরা কম্বিনেশন মোদী-আদানিকে। তাই হিরানন্দানিকে দিয়ে 'হলফনামা' পেশ এবং তা পাবলিক করে দেওয়া। এর ফলে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এথিক্স কমিটিকে ছাপিয়ে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়বে সিবিআই-ইডি। আর এটা সকলেই জানেন, ইডি কোনও কারণ না দর্শিয়েই স্রেফ সন্দেহের বশে ও 'তদন্তের প্রয়োজনে' যে কাউকে মাসের পর মাস জেলে পুরে রাখতে পারে। 

মোদি সরকার সেই পথেই চলেছে আর তৃণমূল বলছে, এটা মহুয়ার ব্যাপার তিনিই সামলে নেবেন। আমার মতো পাঠকের মনেও প্রশ্ন জাগছে, তৃণমূল কেন এই ইস্যুতে অলআউট লড়াইয়ে নামছে না? কেন ইন্ডিয়া জোটকে সঙ্গী করছে না, যেমন করেছিল জোটের সমন্বয় কমিটির বৈঠকের দিন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ইডির তলব নিয়ে? উত্তর কি একটাই যে, আদানি বাংলায় লগ্নি করেছে এবং করবে, অতএব ভাঁড়-মে-যাক একটা মহুয়া মৈত্র। তাছাড়া, মহুয়াকে বাগে আনা যাচ্ছে না, ফলে অ্যাট দ্য কস্ট অফ মহুয়া যদি টিকে থাকা যায় তবে মন্দ কী! 

আমার কথা হচ্ছে, মনে রাখবেন, ঝড়ে ভিত নড়লে চাল কখনও স্থির থাকে না। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে কোনও ধরনের নীরবতা ফ্যাসিস্ত শক্তিকেই পুষ্ট করে।


Thursday, 12 October 2023

সুন্দরবনের মৎস্যজীবীরা

'মৎস্য শিকারের পূর্ণ অধিকার চাই' 

বর্ণালী রায়



কথায় বলে, 'মাছে ভাতে বাঙালি'। আর তাই নাকি বাঙালির এত বুদ্ধি! শেষ কথাটি নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু মাছ না হলে সত্যি আমাদের মুখে ভাত ওঠে না। কিন্তু যারা ভাতের পাতে মাছের সমাবেশ ঘটান তাঁদের খবর কে রাখে?

কাকদ্বীপ: প্রতিবাদের ঐতিহাসিক এক নাম। গত ৩ অক্টোবর সেখানকার বাসস্ট্যান্ডে উপস্থিত অগুনতি মানুষ। চোখে পড়ছে মহিলাদের সংখ্যাগুরু উপস্থিতি। দেখেই বোঝা যায় তারা দরিদ্র মেহনতি মানুষ। কিন্তু চিত্তের দৃঢ়তায় কোনও দারিদ্র্য নেই। এঁরা প্রত্যেকেই মৎস্যজীবী। সেদিন ছিল তাঁদের মহাসমাবেশ ও বিক্ষোভ ডেপুটেশন। আয়োজক 'দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরাম'। এর আগেও এঁদের নদী-খাল-বিল-হাওড়-বাওড়-পুকুর-জলাশয় বাঁচানোর দীর্ঘস্থায়ী একরোখা আন্দোলনে দেখা গেছে। কী নিয়ে বিক্ষোভ?

সুন্দরবন অঞ্চলের বাসিন্দাদের হাতে গোনা কয়েকটি জীবিকার মধ্যে নদী, খাঁড়ি, সমুদ্রে মাছ শিকার অন্যতম। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ সামুদ্রিক পরিবেশের মধ্যে বসবাস করে। তারা ঋতু, জোয়ার-ভাটা ইত্যাদির টানে, খাদ্যের সন্ধানে বা প্রজননের কারণে উপকূলের কাছাকাছি চলে আসে, কখনও বা গভীর সমুদ্রে চলে যায়। এই আসা-যাওয়ার পথেই তারা জেলেদের জালে ধরা পড়ে। এভাবেই রূপোলী শস্য ইলিশ মানুষের পাতে উঠে আসে। 

বর্ষাকাল ইলিশের উপযুক্ত সময়। এই সময় সমুদ্র উত্তাল থাকে। তবু, জেলেরা ইলিশের সন্ধানে জীবনকে বাজি রেখে বরফ, চাল-ডাল বেঁধে নিয়ে সমুদ্রে পাড়ি জমান। একেকটা ট্রিপ ৭ থেকে ১০ দিনের। পরিবারের কাছের মানুষেরা ট্রিপের সময় আতঙ্কে প্রহর গোনেন। রুদ্ধশ্বাসে বাড়ির গা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদী কিংবা দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ঘাটে ফিশিংবোট ফিরেছে খবরটা কানে এলেই তবে তাঁরা হাঁফ ছাড়েন। কখনও কান্নায় ভেঙে পড়েন আপনজন না-ফেরার বেদনায়।

কিন্তু মাছ কি সব সময় পাওয়া যায়? না। কারণ, বড় বড় মৎস্য শিকারীরা বিরাট বিরাট ট্রলি নিয়ে সারা বছরই গভীর সমুদ্র দখল করে রাখে। তাদের ধ্বংসাত্মক জাল আগেভাগেই সব মাছ তুলে নেয়। এরপর যখন ভটভটি বা ছোট দাঁড় টানা নৌকোয় ছোট মৎস্য শিকারীরা সেখানে পৌঁছন তখন মাছ শেষ। মাছের পরিমাণ জলবায়ুর পরিবর্তন ও অত্যাধিক দূষণ ইত্যাদির কারণে এমনিতেই কমে গেছে। তার ওপর এই ট্রলিগুলো তাদের বিরাট বিরাট ট্রলনেট দিয়ে সমুদ্রের তলদেশ ছেঁচে ধ্বংস করে দিচ্ছে। উজাড় করে দিচ্ছে মাছ সহ সকল প্রকার জলজ প্রাণীর বাসা ও প্রজননস্থল। তলদেশেও সামুদ্রিক প্রাণীদের পিশে দিয়ে যাচ্ছে অবিরত। ছোট-বড় সব মাছই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সে কারণে মাছের জন্ম বা বৃদ্ধি কোনওটাই হয়ে উঠছে না। রত্নগর্ভা সমুদ্র ট্রলি'র অত্যাচারে আজ বাঁজা হয়ে গেছে। আজকাল জালে মাছ পড়ে না বললেই চলে। আর তাই হাঁড়িও চড়ছে না ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের হেঁসেলে। 

তাই ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের দাবি, 'অবিলম্বে ট্রলিং বন্ধ করতে হবে', 'ধ্বংসাত্মক সব ধরনের মৎস্য শিকার বন্ধ করতে হবে'। মৎস্য শিকার নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনকানুন আছে। যেমন, ২৩ সেন্টিমিটার'এর ছোট ইলিশ (যার ওজন ৫০০ গ্রাম মতো) ধরা বারণ। কারণ, এরা তখনও পূর্ণবয়স্ক নয়। এদের ধরে ফেললে ডিম পাড়বে কারা? আর ডিম না পাড়লে পরবর্তী মাছের প্রজন্ম রুদ্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তাও কি আটকানো যাচ্ছে?  

ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা যেমন কাঁচা মাছ উৎপাদন করেন, তেমনি শুঁটকি মাছও উৎপাদন করেন। সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ শুঁটকি মাছ উৎপাদনের মরশুম। জেলেরা সমুদ্রের বুক থেকে ধরে আনা পাতা, লোইটা, আমোদী, রুপাপাটি, চিংড়ি ইত্যাদি মাছ সমুদ্রের বালুকাতটে শুকান। একে খোটি বলে। হাজার হাজার পুরুষ মহিলা খোটি মরশুমে খোটিতে মাছ শিকার, শুকানো, বিক্রি, জাল সারাই ইত্যাদি কাজে নিযুক্ত থেকে জীবিকা যাপন করেন। জম্বুদ্বীপেও তেমন হত। কিন্তু বন সংরক্ষণের অজুহাতে আর পর্যটন শিল্প স্থাপনের সরকারি চক্রান্তে ২০০৩ সালে জম্বুদ্বীপ থেকে প্রায় দশ হাজার মৎস্যজীবীর জীবিকা উৎখাত করা হয়েছে।      

বুদ্ধবাবুর আমলে জম্বুদ্বীপ থেকে উৎখাত হওয়া খোটি মৎস্যজীবীরা আজও জম্বুদ্বীপ ফিরে পাননি। তাই খোটি-মৎস্যজীবীদের দাবি, জম্বুদ্বীপে মাছ শুকানোর অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। সাগর, ফ্রেজারগঞ্জ ইত্যাদি এলাকার খোটিগুলো একটু একটু করে বন দফতর দখল করে নিচ্ছে। তার উপর তথাকথিত উন্নয়নের নামে খোটির জমি দখল করে নেওয়ার নিরন্তর চাপ তো রয়েছেই। তাই ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের দাবি, খোটির জমির উপর মৎস্যজীবীদের সমষ্টিগত আইনানুগ অধিকার দিতে হবে।  

ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা চান, জলাশয়-নদী-সমুদ্রে সমষ্টিগত পাট্টা। দুর্নীতির দুর্গন্ধ যখন সর্বত্র তখন মাছের জগতই বা বাদ পড়বে নাকি? ক্ষুদ্র সামুদ্রিক মৎস্যজীবীদের আর্থিক উন্নতির জন্য সরকার মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিগুলির মাধ্যমে কখনও কখনও কিছু ঋণের ব্যবস্থা করে। ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থ বর্ষে 'ট্র্যাডিশনাল মেরিন ফিশ প্রোডাকশন বেহুন্দি ফেজ-৩ স্কিম' নামে সাবসিডি সহ লোন স্কিম ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। সাবসিডি সহ লোন স্কিম ছিল ৪,৭৩,০০০ টাকা। এই টাকার মধ্যে ২,৩৮,০০০ টাকা ছিল সাবসিডি বা অনুদান। এই অনুদানের টাকার প্রায় সবটাই মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির দুর্নীতিগ্রস্ত কর্তাব্যক্তিরা রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গে যোগসাজশে লুঠ করে নেয়। ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই থেকে যান। তাই তাঁরা আওয়াজ তুলেছেন, লুঠ হয়ে যাওয়া সাবসিডির টাকা ফেরত দিতে হবে এবং সাবসিডি চোরদের গ্রেফতার করতে হবে।

১৯৭৩ সালে সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প প্রতিষ্ঠার পর থেকে মৎস্যজীবীদের উপর বন দফতর নিরন্তর অত্যাচার করে চলেছে। সুন্দরবন নদী খাঁড়ি জঙ্গলে মৎস্যজীবীদের মাছ কাঁকড়া ধরার পরম্পরাগত অধিকার বন দফতর কেড়ে নিয়েছে। সুন্দরবনের কোর এলাকায় ও সীমানা অঞ্চলে ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা মাছ ধরতে পারেন না। বন দফতর ও  বিএসএফ'এর অত্যাচারে ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের জীবিকা বিপন্ন। তাই মৎস্যজীবীদের দাবি, তাঁদের সুন্দরবনে মাছ ধরার অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। সীমান্ত এলাকায় মৎস্যজীবীদের জীবিকাকে সুরক্ষিত করতে হবে।  

এইসব সমস্যা নিয়েই ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা দাবি তুলেছেন। তাঁরা প্রতিবাদ করছেন, বিক্ষোভেও সামিল হচ্ছেন। প্রায় অর্ধ শতাব্দী হল সে আন্দোলনের বয়স। সম্প্রতি 'দুয়ারে সরকার' থেকে মৎস্যজীবী রেজিস্ট্রেশন কার্ড দেওয়া হয়েছে। তাতে কোনও মৎস্যজীবী মাছ ধরতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেলে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। এটা মৎস্যজীবীদের দীর্ঘ আন্দোলনের ফল। 

সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চল (গোসাবা, নামখানা, সাগর, পাথরপ্রতিমা, ডায়মন্ডহারবার, কুল্পি ও কাকদ্বীপ ব্লকের বিভিন্ন এলাকা) থেকে ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা গত ৩ অক্টোবর কাকদ্বীপের সমাবেশে এসেছিলেন। মহিলারা জাল সারাই, মাছ ধরা, মাছ বাছা, মাছ শুকোনো, বিক্রি- সবই করেন পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। মিটিং মিছিলেও তাঁরা খুবই সক্রিয়। মৎস্যজীবী সমাজের মাথায় তাই আধখানা নয়, মস্ত একখানা আকাশ। তাঁদের ডেপুটেশনেও এসডিও দাবি-দাওয়াগুলির বাস্তবতা অনেকটাই স্বীকার করে নিয়েছেন। নিজের ক্ষমতার মধ্যে কিছু করার আশ্বাসও দিয়েছেন। বাকিটা যথোপযুক্ত জায়গায় পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন বলে জানিয়েছেন।

মৎস্যজীবীরা হলেন সমাজের বন্ধু। আর বন্ধু ভালো না থাকলে সমাজ কীভাবে ভালো থাকে!


Wednesday, 11 October 2023

অথর্ব বাম? বামপন্থা দীর্ঘজীবী হোক!

‘আর্বান নকশাল’ কারা?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

জাতীয় নির্বাচন কমিশন দেশের পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের নির্ঘন্ট ঘোষণা করেছে। ফলাফল প্রকাশ পাবে ৩ ডিসেম্বর। নবগঠিত ইন্ডিয়া ও এনডিএ’র দ্বৈরথ এবার একপ্রস্থ নিজ নিজ শক্তি পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছে যা হয়তো অনেকাংশে আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে একপ্রকার মহড়া হিসেবে কাজ করবে। এই যুযুধান পরিসরে, যাদের আমরা বাম দল বলে চিনি তাদের সার্বিক অবস্থাটা কেমন? আগামী লোকসভা নির্বাচনেও বা বামেরা কেমন অবস্থায় থাকবে?

এই প্রশ্নের গুরুত্ব এই কারণেই যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মাত্র কিছুদিন আগে রাজস্থানে বিজেপি’র এক কর্মী সমাবেশে হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন, কংগ্রেস ও ইন্ডিয়া জোট ‘আর্বান নকশাল’দের হাতে চলে গেছে এবং তাদের দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে। এই ঘোষণার অল্প কিছুদিন পরেই ‘নিউজক্লিক’ অফিসে ভোররাতে হানা দিয়ে দিল্লি পুলিশ তাদের প্রধান সম্পাদক ও এক কর্মচারীকে গ্রেফতার করে ইউএপিএ ধারায় মামলা দেয় এবং অন্তত ৪৬ জন নামীদামী, পরিচিত সাংবাদিকদের উঠিয়ে নিয়ে যায়। পাশাপাশি, একই সময়ে দিল্লিতে আপ নেতা সঞ্জয় সিং’কে গ্রেফতার করে। রাঘব চাড্ডাকে নোটিশ দেওয়া হয় তাঁর সাংসদ বাংলো ছেড়ে দেওয়ার জন্য। এ রাজ্যেও ইডি-সিবিআই’এর তৎপরতা তুঙ্গে ওঠে এবং তৃণমূলের কিছু শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অচিরেই গ্রেফতারের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সর্বশেষ, ২০১০ সালে প্রদত্ত একটি ভাষণকে টেনে এনে দিল্লির এলজি অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে মামলা সাজাতে নির্দেশ দিয়েছেন। এই পরিস্থিতি কম-বেশি প্রায় সমস্ত বিরোধী শাসিত রাজ্যেই বহমান। তাহলে, এখন পর্যন্ত যারা গ্রেফতার হলেন বা হবেন, তাঁরা কি সকলে ‘আর্বান নকশাল’? যদি হন তাহলে তো বিবৃতি দিয়ে সে কথা ঘোষণা দিলেই হয়! যদি না হন, তাহলে ‘আর্বান নকশাল’ কারা? প্রধানমন্ত্রী কেন তাদের এত গুরুত্ব দিচ্ছেন? তাদের কি তিনি ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করে ফেলেছেন? নাকি, তিনি ভয় দেখাচ্ছেন? অথবা, একটি গল্প তৈরি করছেন। সেই গল্পের মালমশলাগুলো কী?

এই শেষ প্রশ্নটিই আমাদের নিয়ে যেতে পারে ‘আর্বান নকশাল’ বা বামেদের ডেরায় যেখানে তাদের চাক্ষুষ তেমন দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু তারা আছে। কতকটা ‘পাঠান আভি জিন্দা হ্যায়’এর মতো। কিন্তু তার আগে, একটি বইয়ের কথা বলে নিতে হবে। 

এই বইটি নিয়ে ইতিমধ্যেই একটি আলোচনা প্রকাশ পেয়েছে। উৎসাহীরা দেখে নিতে পারেন: https://ekakmatra2013.blogspot.com/2023/05/blog-post_25.html  

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক দর্শনের অধ্যাপক মাইকেল জে স্যান্ডেল তাঁর সুবিখ্যাত ‘The Tyranny of Merit’ গ্রন্থে আমাদের নজর টেনেছেন আমেরিকার ডেমোক্রাটিক পার্টি-ঘেঁষা এমএসএনবিসি টেলিভিশনের সঞ্চালক ক্রিস্টোফার হেইস’এর কিছু পর্যবেক্ষণের দিকে। হেইস’এর মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে চিরায়ত বামেরা তেমন তেমন ক্ষেত্রগুলিতেই সাফল্য পেয়েছে যেখানে ‘মেধা’র গুরুত্ব আছে- যেমন, বর্ণ বিদ্বেষের মোকাবিলা, উচ্চশিক্ষায় মহিলাদের আরও বেশি উৎসাহ দান এবং সমকামের অধিকারকে ত্বরান্বিত করা। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে তারা ফেল মেরেছে যেগুলি মেধাতন্ত্রের এক্তিয়ারের বাইরে- যেমন, বৈষম্য বৃদ্ধি। অথচ, এখানেই তাদের মূলত থাকার কথা। অর্থাৎ, যে শোষণ, দারিদ্র্য ও বঞ্চনার অবসানকে বামেরা রাজনীতির মূল লক্ষ্য ধরে এগোয়, সেখানের বাস্তব জমিতে তারা প্রান্তিক।   

উল্লিখিত বইটিতে স্যান্ডেল ছত্রে ছত্রে বিধৃত করেছেন, কীভাবে ভদ্রলোক ও উচ্চশিক্ষিতেরা বাম রাজনীতির কাণ্ডারী হয়ে মেহনতী মানুষের থেকে বাম আন্দোলনকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন করেছেন। তত্ত্বগত আলোচনার আধিক্য, সেমিনার ঘরে আয়েসি বিপ্লব-বিচ্ছুরণ, মাঠঘাটের লড়াই থেকে সমীক্ষা ও পেপার তৈরিতে বেশি মনোনিবেশ এবং ফলত প্রাতিষ্ঠানিক ‘শিক্ষা’র ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়ার কারণে সমাজে অত্যাধিক আয়ের বৈষম্য বৃদ্ধি এক নৈতিক মান্যতা অর্জন করেছে। কারণ, এই ‘শিক্ষার বড়াই’ এমন এক ধারণা গড়ে তুলেছে যেখানে অধিক শিক্ষা অর্জন মানে আরও আরও সাফল্য যার অর্থ আরও বেশি বেশি আয়। ফলে, এমন এক সামাজিক নৈতিকতার ভিত্তি তৈরি হয়েছে যার মূল বার্তাটি হল: ‘আর্থিক অসাম্যের কারণ এই সমাজব্যবস্থা নয়, তোমার ব্যর্থতাই এর জন্য দায়ী’। অতএব, তোমাকে আরও শিক্ষিত হয়ে উঠতে হবে। বাম দলগুলি প্রধানত ভরে গেছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আসা ডিগ্রিধারী মানুষজনে যারা অনেক বেশি কাতর ‘শিক্ষিত’ জনের চাকরি না মেলায়। বাদবাকী ‘অশিক্ষিত’ মানুষজনের আশা-আকাঙ্ক্ষা যেন তাদের সঙ্গে সমপাটাতনে আর যায় না। গত এক দশকে প্রায় সারা বিশ্বেই দক্ষিণপন্থীদের জনভিত্তি প্রসারিত হওয়া ও তাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কারণ শুধুমাত্র তাদের ঘৃণা-মিশ্রিত উগ্র ধর্মান্ধ-বর্ণান্ধ ভিত্তিক রাজনীতি নয়, উদারবাদী বা বামপন্থা অনুসৃত এই মেধাতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক জনরোষও বটে।

ঘটনা হল, গত শতকের ৯০-এর দশক থেকে উদারবাদী অর্থনীতি যত বেশি খোলামেলা ও মুক্তকচ্ছ হয়েছে, তত বেশি করে শিক্ষার ওপরে প্রাধান্য ও গুরুত্ব বেড়েছে। বিশেষ করে তথ্য প্রযুক্তি ও পরবর্তীকালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সার্বিক উত্থানের ফলে প্রযুক্তির যে বিপুল পরিমাণ প্রয়োগ হয়েছে, সেখানে কারিগরি শিক্ষা ও সেই শিক্ষায় পারদর্শী লাখো লাখো নতুন শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রয়োজন বহু গুনে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলত, এমন একটা ধারণা গড়ে উঠতে শুরু করে যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ‘সব থেকে সেরা ও মেধাবী’রাই সর্বত্র, এমনকি সরকার পরিচালনাতেও বেশি পারদর্শী। স্যান্ডেল বলছেন, এই মনোভাব হল এক অতিকথা যা মেধাতন্ত্রের ঔদ্ধত্য থেকে উদ্গত; আমেরিকার দুই শ্রেষ্ঠতম রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন ও আব্রাহাম লিঙ্কনের কিন্তু কলেজ ডিগ্রি পর্যন্ত ছিল না।

তাহলে কি মেহনতী মানুষের থেকে বামপন্থীদের এমনতর ভাবনাগত ও প্রায়োগিক বিচ্ছিন্নতার কারণে বামপন্থাই আজ নিঃশেষের পথে? কোনও এক রাজার মৃত্যু হলে যেমন রাজতন্ত্রের অবসান হয় না, তেমনই বাম শক্তির ক্ষয়প্রাপ্তি ঘটলেও বামপন্থার ইতি নেই। কেন, সে কথা অন্যত্র আলোচনা করা যাবে। আর, সেই কথাটা বুঝেছেন বলেই মোদি ‘আর্বান নকশাল’ বলে আসলে বামপন্থার মতাদর্শকে আক্রমণ করেছেন; যে মতাদর্শ ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের উত্থান ও পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে তালেগোলে মিলে আজ প্রবল ভাবে বহমান এবং এক রাজনৈতিক ধারা হিসেবে মোদি শাহের হিন্দুবাদী রাজতন্ত্র ও আদানি কেন্দ্রিক সাম্রাজ্যের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

বলাই বাহুল্য, ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র পরে রাহুল গান্ধীর এক রাজনৈতিক পুনর্জন্ম হয়েছে। তিনি নিজেও সে কথা স্বীকার করেছেন। কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত হাঁটতে হাটতে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে চলতে চলতে তিনি উপলব্ধি করেছেন, প্রজ্ঞা ও বাস্তববোধ সাধারণ মেহনতী মানুষের মধ্যে এমন প্রগাঢ় ভাবে নিবিষ্ট হয়ে থাকে যে তা হাজারও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের থেকে বহু গুনে অনুশীলন, উপলব্ধি ও জ্ঞানের সাপেক্ষে পরিবর্তন ও বিকাশের প্রধান আকর। বিজ্ঞান যেমন নিবিড় ভাবনায় ল্যাবরেটরিতে অনুশীলিত হয়, সেখানে বিজ্ঞানীদের নিরলস সাধনা হল আবিষ্কারের প্রধান দ্যোতক, বিপ্রতীপে, সমাজবিজ্ঞানের অনুশীলন হয় বাস্তব সমাজের মাটিতে, যেখানে মনুষ্য-বিচ্ছিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সমাজবিজ্ঞানীদের প্রকৃত প্রস্তাবে তেমন কোনও ভূমিকাই নেই। কিন্তু, যে সমস্ত সমাজবিজ্ঞানীরা তাঁদের জ্ঞানচর্চাকে বৃহত্তর সমাজ ও নিজ অবস্থানের মধ্যে গেঁথে নিতে পারেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে যুগকাণ্ডারী। তাঁদের সংখ্যা হয়তো স্বল্প।

এমতাবস্থায়, বাস্তব জমিতে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে বাম বলে চিহ্নিত দলগুলির জনভিত্তি দু-একটি রাজ্যে ও অন্যান্য রাজ্যের কিছু অঞ্চল ব্যতিরেকে তেমন কিছু আর নেই। এই শতকের প্রথম দশকেও বাম দলগুলির যে জনভিত্তি ছিল, তা অনেকাংশে আজ ক্ষয়প্রাপ্ত। সত্য হল, চিরায়ত বামেদের এই দুর্বলতা সত্ত্বেও বামপন্থার মতাদর্শ কিন্তু বহমান বিভিন্ন আঞ্চলিক দলগুলির নানান কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। ১৯৫১ সালে কলকাতায় যখন ট্রামের ভাড়া ১ পয়সা বেড়েছিল, তার বিরুদ্ধে উত্তাল গণ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বিধানসভায় দাঁড়িয়ে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, প্রশ্নটা সামান্য ১ পয়সা বৃদ্ধির নয়, প্রশ্নটা কার পকেট থেকে কার পকেটে পয়সাটা যাচ্ছে! এখানেই বামপন্থার সারবত্তা, যার পিছনে মেহনতী ও শ্রমজীবী মানুষের এক বড় অংশ সমবেত হয়েছিলেন। এই হিস্যা বুঝে নেওয়ার লড়াইয়ে আজ বাম দলগুলি শ্রমজীবী মানুষজনের থেকে ক্রমশই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। বরং, যে দলগুলি পুঁজিবাদ উচ্ছেদের লড়াই করে না কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের প্রাপ্তির দিকে নজর রাখতে চায় (যে কারণেই হোক, হতে পারে সংসদীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতা), তেমন তেমন দলগুলির দিকে মানুষের ঢল বেড়ে চলেছে। হয়তো সেও এক আপাত স্থিতাবস্থা, কিন্তু বাস্তবতা তো বটেই।

শিক্ষার বড়াইয়ে নাক-উঁচু বাম দলগুলি নানান আলোচনাসভা করছে, সম্মেলন করছে, তর্ক-বিতর্ক চালাচ্ছে, বাম কর্মী ও সমর্থকেরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাল-মন্দ মিশিয়ে নানারকম লেখালিখি করছেন, কিন্তু আদতে তাদের পিছনে জনজোয়ার নামার কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। যে জনকল্যাণের রাজনীতি আজ প্রধান অক্ষ হয়ে উঠেছে, তাকে ধরে বরং আঞ্চলিক দলগুলি বহু ক্ষেত্রে জনমুখি ভূমিকা রাখার চেষ্টা করে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে (যদিও তাদের ভুল-ভ্রান্তি অথবা অন্যায়-অবিচারও কম কিছু নয়, অবশ্য শুধরে নেওয়ার প্রয়াসও থাকছে। সবটাই কি ভোটের চাপ?)। যেমন, ব্রাজিলে লুলা’র দল ওয়ার্কার্স পার্টি ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করেছে। অথচ, তারা কিন্তু চিরায়ত বামপন্থী দল নয়। আজকের রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রেক্ষিতে কি বামপন্থার পুনর্নির্মাণ হচ্ছে নতুন নতুন ধরনের বামপন্থী দলের উত্থানের মধ্য দিয়ে? ইন্ডিয়া জোটের মতাদর্শে কি তাই বামপন্থার ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে? মোদি কি সে গন্ধ পেয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন? কারণ, তাঁর বিভাজনের রাজনীতির সার্বিক ও আসলি পরাজয় তো বামপন্থার হাতেই সম্ভব! ইতিহাসের নবতর পরিহাসে, চিরায়ত বাম দলগুলি কি মরিয়া প্রমাণ করিবে যে বামপন্থা মরে নাই!

                

Wednesday, 4 October 2023

বিনাশকালে বুদ্ধি নাশ?

দিল্লিতে তাণ্ডব

সোমনাথ গুহ



গতকাল খোদ রাজধানীতে দিল্লি পুলিশ সাংবাদিক, লেখক ও রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের ওপর বেনজির হামলা চালিয়েছে। চিন থেকে অর্থ সাহায্য পাওয়ার ভুয়ো অভিযোগ খাড়া করে তারা ‘নিউজক্লিক’ সংবাদ সংস্থার সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ এবং বরিষ্ঠ সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা, উর্মিলেশ সহ ৪৬ জন সাংবাদিক ও লেখকদের ঘরবাড়ি, অফিস তল্লাশি করেছে, তাঁদের মোবাইল, ল্যাপটপ বাজেয়াপ্ত করেছে, দীর্ঘক্ষণ ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। পরে থানায় সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ ও অমিত চক্রবর্তীকে ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার করেছে। 

একই দিনে কৃষি ভবনে গ্রামোন্নয়ন দফতরের প্রতিমন্ত্রী সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিনিধি দলের সাথে পূর্ব-নির্ধারিত সময়ে দেখা করতে হঠাৎ করে অস্বীকার করেন। তিন ঘন্টা বসিয়ে রাখার পর অভিষেক বান্যার্জি সহ দলের নেতানেত্রীদের পুলিশ কৃষি ভবনের বৈঠক স্থল থেকেই জবরদস্তি টেনে হিঁচড়ে তুলে থানায় নিয়ে যায় ও রাত এগারোটা অবধি আটক করে রাখে। 

আজ (৪ অক্টোবর) সাত সকালে ইডি হানা দিয়েছে আপ নেতা সঞ্জয় সিং'এর বাড়ি, যিনি গতকাল আদানি'র চৈনিক অর্থের সংযোগ এবং দিল্লি'র সাংবাদিকদের মিথ্যা অভিযোগে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার কন্ঠে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এই প্রতিবেদন প্রকাশ পাওয়ার মুখে তল্লাশি এখনও চলেছে।

কোনও সংবাদসংস্থার ওপর এরকম বেলাগাম আক্রমণ ও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের সাংসদ-মন্ত্রীদের এই ধরনের চরম হেনস্থা ইদানীংকালে দেখা যায়নি। অবশ্যম্ভাবী ভাবে যে প্রশ্ন উঠে আসে তা হল, আমরা কি জরুরি অবস্থার কানাগলিতে ঢুকে পড়লাম? 

এনরেগা সহ অন্যান্য প্রকল্পের বকেয়া আদায় করতে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিনিধি দল দিল্লিতে গত দু' দিন ধরে কর্মসূচি নিয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার কোন এক অজানা ভয়ে তাদের এই কর্মসূচি আটকাতে মরীয়া হয়ে ওঠে। প্রথমে তাঁদের দিল্লি যাত্রার ট্রেন বাতিল করে দেওয়া হয়, মন্ত্রী গিরিরাজ সিং ঠিক ঐ সময়েই বিহার চলে যান, প্রতিমন্ত্রী নিরঞ্জন জ্যোতি নির্ধারিত সময়ে দেখা করতে অস্বীকার করেন। তৃণমূলের এই দু' দিন ব্যাপী কর্মসুচি ইডি ও সিবিআই দ্বারা বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীদের হেনস্থা করা এবং রাজ্যের দাবিদাওয়ার দুটি বিষয়কে পুনরায় জনসমক্ষে নিয়ে এসেছে। 

সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের নেতানেত্রীরা প্রায় প্রত্যেকেই মনে করেন যে দুর্নীতির ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করা উচিত। অথচ ৩৫ বছর আগের বোফর্স কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের রাফায়েল বিমান, সারদা, নারদা কোনও ঘোটালাতেই আজ পর্যন্ত দোষীদের শাস্তি তো দূরের কথা, চিহ্নিতও করা যায়নি। প্রায় তিন বছর আগে কয়লা পাচার কেলেঙ্কারির অভিযোগে ইডি, সিবিআই তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। পরে নিয়োগ দুর্নীতিতেও তাঁদের নাম উঠে আসে। বারবার তাঁদের কেন্দ্রীয় এজেন্সির দফতরে ডাকা হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে কিন্তু তদন্তে এখনও লক্ষণীয় কোনও অগ্রগতি দেখা যায়নি। তদন্তের শ্লথ গতি দেখে এটা ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে দোষীকে খুঁজে বার করা ও শাস্তি দেওয়া এই এজেন্সিগুলির উদ্দেশ্য নয়, তাঁদের উদ্দেশ্য বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের নানা ভাবে হেনস্থা করা। দেখা যাচ্ছে, বেছে বেছে রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলিতেই তাঁকে তলব করা হচ্ছে। প্রায় আড়াই মাস আগে ২ এবং ৩ অক্টোবর দিল্লিতে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিবাদ কর্মসূচি নির্ধারিত হয়েছিল। ইডি ঠিক ৩ তারিখেই তাঁকে দফতরে ডেকে পাঠায়। এর আগে তাঁকে ১৩ সেপ্টেম্বর তলব করা হয়েছিল- ঐ দিন ছিল নবগঠিত ‘ইন্ডিয়া’ জোটের কো-অর্ডিনেশন কমিটির প্রথম বৈঠক। এর আগে ‘নবজোয়ার যাত্রা’র সময় সিবিআই তাঁকে তলব করেছিল। এতে তো সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে অভিষেকের রাজনৈতিক কর্মসূচি ব্যাহত করার জন্য কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কাজ করছে। 

ইডি, সিবিআই দ্বারা হেনস্থা হয়েছে এরকম ব্যক্তিদের তালিকা লম্বা। প্রায় সব বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলির নেতানেত্রীদের নাম এতে আছে। ২০১৫-১৬ সালে ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’ কেসে দিনের পর দিন সনিয়া ও রাহুল গান্ধীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, এখন সেই কেস ধামাচাপা পড়ে গেছে। তালিকায় আছেন প্রাক্তন মন্ত্রী পি চিদাম্বরম ও তাঁর পুত্র কার্তি চিদাম্বরম, শিব সেনার সঞ্জয় রাউত, ফারুক আবদুল্লা, তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রশেখর রাওয়ের কন্যা কে কবিতা, তামিলনাড়ু মুখ্যমন্ত্রী স্ট্যালিনের কন্যা সেন্থামারাই, লালু যাদব, তেজস্বী, রাবরি দেবী, ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সরেন, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, তৃণমূল কংগ্রেসের বিভিন্ন নেতানেত্রী। এমনকি কেরালার বাম সরকারের জনপ্রতিনিধিরাও এদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। শরদ পাওয়ারের এনসিপি দলের কোনও নাম এই তালিকায় দেখা যাচ্ছে না। কী করেই বা থাকবে! জুন মাসে অজিত পাওয়ার যখন দল ভাঙিয়ে একটা বড় অংশ নিয়ে বিজেপি-শিব সেনা (শিন্দে) সরকারে যোগ দেন তখন তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন যাঁদের মাথার ওপর ইডির খাঁড়া ঝুলছিল। অভিযোগ, অজিত পাওয়ার, প্রফুল্ল প্যাটেল, ছগন ভুজব্যালরা একেক জন দুর্নীতির শিরোমণি। এঁদের বিরুদ্ধে ইডির বিস্তর সব অভিযোগ দলবদলের সাথে সাথে ধামাচাপা পড়ে যায়। 

আম আদমি পার্টি'র দুজন মন্ত্রী সত্যেন্দ্র জৈন ও মণীশ শিসোদিয়া (যিনি দিল্লি সরকারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন) দুর্নীতির অভিযোগে কারাবাস করছেন। যে অভিযোগের ভিত্তিতে এই দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাতে বিস্তর ফাঁক আছে। জৈনের ক্ষেত্রে অভিযোগ, যে জুয়েলারি কোম্পানিতে তাঁর শেয়ার আছে সেই কোম্পানি কলকাতা থেকে ৪.৮ কোটি টাকা পায়। জৈনের আইনজীবীরা বলছেন, রেজিস্ট্রার অফ কোম্পানির তথ্য অনুযায়ী ঐ অলঙ্কার কোম্পানিতে জৈনের শেয়ার ২ থেকে ১৯ শতাংশ, অর্থাৎ ৫৭ লাখ টাকা। আইন অনুযায়ী এক কোটি বা তার বেশি অংকের দুর্নীতি হলে তবেই ইডি সেই কেসের তদন্ত করতে পারে। পিএমএলএ (প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট) অনুযায়ী টাকার অংক এক কোটির কম হলে অভিযুক্ত অবিলম্বে জামিন পাওয়ার যোগ্য। অথচ জৈন গত বছরের মে মাস থেকে বন্দী আছেন। অনেকের মতে, শিসোদিয়ার ক্ষেত্রে অভিযোগ ভুয়ো। যে আবগারি নীতির জন্য তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছে তা মন্ত্রীসভায় সিদ্ধান্ত সহ অর্থ ও শুল্ক দফতরের সম্মতিতেই নেওয়া হয়েছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, লেফট্যানেন্ট গভর্নর যিনি কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা নিযুক্ত, সেই নীতিতে সই করে সহমত প্রকাশ করেছিলেন। 

সাম্প্রতিক কালে সংশোধনের ফলে পিএমএলএ দানবীয় আকার নিয়েছে। কুখ্যাত ইউএপিএ আইনের মতো পিএমএলএ'তেও অভিযুক্তকে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হয়। এছাড়া সংস্থার ডিরেক্টরের হাতে অভূতপূর্ব ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে ও তথাকথিত জাতীয় স্বার্থে একজন ডিরেক্টরের মেয়াদ বারবার বাড়ানো হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ২০১৪'র পর থেকে ইডি'র অধীনে তদন্ত চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অভিযুক্তদের ৯৫ শতাংশ বিরোধী দলগুলির নেতানেত্রী। ২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ কেসের সংখ্যা ৫০৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে- ১৯৫ থেকে ১১৮০। ইডির দ্বারা তল্লাশি ২০০৪-১৪ থেকে ২০১৪-২২- অভূতপূর্ব ভাবে ২৫৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ('দ্য ওয়ার' – ১৪ এপ্রিল ২০২৩)। ইডির কার্যকলাপে কতিপয় বিচারক বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। গত নভেম্বর মাসে সঞ্জয় রাউতের জামিনের আবেদন মঞ্জুর করে সেশনস জজ এম জি দেশপান্ডে বলেন, যে দ্রুততার সাথে একজন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয় তার ছিটেফোঁটা তৎপরতা তার বিচারের সময় দেখা যায় না। জামিনের আবেদনের পর ইডি সেটার উত্তর দিতে তিন-চার সপ্তাহ নেয়, সামান্য আবেদনেরও উত্তর দিতে তারা প্রচুর সময় নেয়। এই বিলম্বের জন্য ইডিকে কি দোষী সাব্যস্ত করা উচিত নয়? বিচারক প্রশ্ন করেন। 

এনরেগা প্রকল্পে আমাদের রাজ্যের উপভোক্তারা শেষবার টাকা পেয়েছেন ২৬ ডিসেম্বর ২০২১। এরপর এনরেগা আইনের ২৭ নম্বর ধারা প্রয়োগ করে দুর্নীতির অভিযোগে কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রকল্প বাবদ টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। ২০২১-২২ সালে পশ্চিমবাংলায় ১,১১,১৯৭৬৫ মানুষ এই প্রকল্প বাবদ টাকা পেয়েছেন, যা দেশে সর্বোচ্চ। এই সময়ে ৩৬.৪১ কোটি শ্রম দিবস সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে এই প্রকল্প বাবদ রাজ্যের প্রাপ্য ৭০০০ কোটি টাকা। সেই টাকা না দেওয়ার ফলে ২০২২'এর অক্টোবরে শ্রম দিবসের সংখ্যা নেমে দাঁড়ায় ৩.৬৭ কোটি। সমস্ত রাজ্যের মধ্যে একমাত্র পশ্চিমবাংলার টাকাই আটকে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রের অভিযোগ, প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে, ২৫ লক্ষ ভুয়ো জব কার্ডের মাধ্যমে তৃণমূলি নেতারা টাকা আত্মসাৎ করেছে। রাজ্য সরকারের দাবি, এই অভিযোগ খতিয়ে দেখে তারা কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রামোন্নয়ন দফতরে চারটে অ্যাকশন টেকেন রিপোর্ট পাঠিয়েছে, শেষের'টি পাঠানো হয়েছে ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। অপর দিকে কেন্দ্র জানিয়েছে, এই রিপোর্টগুলিতে দুর্নীতির অভিযোগের কোনও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা তারা পায়নি।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং এই দুর্নীতি উন্মোচন করার জন্য সিবিআই তদন্তের হুমকি দিয়েছেন। তাহলে তদন্ত যত দিন চলবে তত দিন মানুষ বঞ্চিত থাকবে? এছাড়া প্রায় দু' বছর হয়ে গেল এখনও কেন সেটা করা হয়নি? আর এও প্রশ্ন, ২৫ লক্ষ কার্ড যদি ভুয়োও হয়, ২০ লক্ষ উপভোক্তাকে কেন তাঁদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে? দুর্নীতি কি খালি পশ্চিমবাংলাতেই আছে? অন্যান্য রাজ্য সরকার এবং খোদ কেন্দ্রীয় সরকার কি দুর্নীতিমুক্ত? দেখা যাচ্ছে, আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পে ৩৪৪৬ জন এমন রুগীর পিছনে ৬.৯৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে যারা আগেই মৃত ঘোষিত। ক্যাগ রিপোর্টে কেন্দ্রীয় সড়ক প্রকল্পে বিপুল গরমিল ধরা পড়েছে। বরাদ্দ অর্থ ও ব্যয় করা অর্থের মধ্যে পাহাড়প্রমাণ ফারাক! আর বিজেপি নেতাদের কথা বলতে গেলে তো ঠক বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে! অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা, মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহান, কর্নাটকের রেড্ডি ভাইয়েরা, শুভেন্দু অধিকারী- এঁদের বিরুদ্ধে তো বিস্তর অভিযোগ! এইসব দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তদন্ত কোথায়? কেন্দ্রের মন্ত্রীদের মুখে আদৌ কি দুর্নীতি-বিরোধী কথাবার্তা মানায়? 

শাসকের সন্ত্রাসে দেশ থরথর! সাংবাদিকের ওপর ইউএপিএ প্রয়োগ বিরল। জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত তুলে এখন যে কারও ওপর আক্রমণ হতে পারে। এডিটরস’ গিল্ড, ইন্ডিয়া জোট এই আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেছে। সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। 


Monday, 2 October 2023

নজরদারির চোখ

আপনি নজরবন্দী!

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

ঘটনাটি মাত্র কয়েকদিন আগের। হতাশায় নিমজ্জিত ২৮ বছরের এক যুবক মুম্বইয়ের মুলভানি অঞ্চলে বসে গুগল সার্চে খুঁজছিলেন ‘best way to commit suicide’ সম্পর্কিত কিছু তথ্য। বিষয়টা ইন্টারপোলের নজরে আসে, তারা তৎক্ষণাৎ মুম্বই পুলিশকে উক্ত সার্চের আইপি অ্যাড্রেস সহ ইমেইলে সতর্কবার্তা পাঠায়। পুলিশ সেই আইপি অ্যাড্রেস ধরে যুবকের অবস্থানে পৌঁছে যায় এবং তাকে সম্ভাব্য আত্মহত্যার হাত থেকে উদ্ধার করে।

উপর উপর দেখলে, ঘটনাটি শেষত মানবিক। মনে হতে পারে, ভালই তো! প্রযুক্তির সুবাদে আমরা জীবনরক্ষা করতেও পারঙ্গম হয়েছি। কিন্তু যে প্রযুক্তিগত নজরদারির সুবাদে এই ভাল কাজটি করা গেল, তা কি সর্বত্রই এমনতর ভাল ও সুখপ্রদ? খেয়াল করে দেখুন, এখানে কথিত যুবক গুগলে তার ব্যক্তিগত পরিসরে একান্ত গোপনে কিছু একটা খুঁজছিলেন, কিন্তু তা নজরে পড়ে গেল কোন সুদূরে অবস্থিত ইন্টারপোলের অফিসারদের। বুঝুন কাণ্ড! তাহলে কি আমরা প্রতিনিয়ত যে ইন্টারনেট সার্চগুলি করি, অথবা, বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ঘোরাঘুরি করি, কিংবা ইমেইলে কিছু লিখি বা কারও সঙ্গে চ্যাট করি, ফোনে কথা বলি- তা সম্পূর্ণতই কারও না কারও নজরদারির ফ্রেমে বন্দী? আমাদের ব্যক্তিগত পরিসর ও গোপনীয়তা বলে সত্যিই কিছু নেই?

সকলের মনে থাকবে, বেশ কয়েক বছর আগে এডওয়ার্ড স্নোডেন এই বিস্তৃত নজরদারি সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন কীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের NSA (National Security Agency) বিশ্বের তাবৎ কথাবার্তার ওপর আড়ি পাতে এবং তথাকথিত শত্রুদের চিহ্নিত করে। এনএসএ’র সুবিধা হল, বিশ্বের অধিকাংশ যোগাযোগ প্রযুক্তির সার্ভার ও ট্রাফিক যেহেতু আমেরিকা অথবা তাদের বন্ধু দেশ ব্রিটেনের মধ্যে অবস্থিত, অতএব, এনএসএ তার কারিগরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এই বহমান ট্রাফিককে ট্যাপ করতে পারে। এই ট্যাপিং অপারেশন চারটি কোড নামে চলে- BLARNEY, FAIRVIEW, OAKSTAR STORMBREW। স্নোডেন দেখিয়েছেন, নজরদারির এই কার্যক্রম এনএসএ বড় বড় টেলিকম ও ইন্টারনেট কোম্পানিগুলির যোগসাজসেই চালায়। এমনকি গুগল, ফেসবুক, অ্যাপল, ইয়াহু ও অন্যান্য বড় বড় ইন্টারনেট কোম্পানিগুলির সার্ভারে তাদের পূর্ণ অভিগম্যতা পর্যন্ত আছে। উপরন্তু, encryption’এর সুবিধার কথা বলে ইন্টারনেট কোম্পানিগুলি ব্যবহারকারীদের তথ্য সম্পর্কে যে সুরক্ষার আশ্বাসবাণী দেয়, তাও মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। স্নোডেন জানিয়েছেন, এইসব কোম্পানি পিছনের দরজা দিয়ে সমস্ত তথ্যের হাট মালদার ক্রেতাদের কাছে খুলে দেয়।

এই গোপন কীর্তিগুলি ফাঁসের দায়ে মার্কিন প্রশাসনের হাতে গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে বেড়ানো স্নোডেন ২৭টি দেশে বসবাসের আবেদন জানিয়ে অবশেষে বছর দুয়েক আগে রাশিয়ার নাগরিকত্ব পেয়ে এখন সেখানেই বাস করছেন। কিন্তু তিনি যে প্যান্ডোরার বাক্সটি খুলে দিয়েছিলেন তা এটাই প্রমাণ করে যে, নজরদারির ভয়াবহতা আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে আপনার কোনও তথ্য ও কার্যাবলী আর বিন্দুমাত্র ব্যক্তিগত বা গোপনীয় নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নজরদারির আরও ভয়ানক সব ইজরায়েলি প্রযুক্তি, যা আপনার অজান্তেই অথবা আপনাকে ভুল করারও কোনও সুযোগ না দিয়ে, নিঃশব্দে ঘাতকের মতো বসে যাবে আপনার ব্যবহৃত মোবাইল অথবা ল্যাপটপ কিংবা ডেস্কটপে। এইগুলিরই অন্যতম ‘পেগাসাস’ নামে এক ঘাতক সফটওয়ার সম্পর্কে আজ আমরা অনেকেই অবহিত। এই সফটওয়ার যে তারপর কী কাণ্ড ঘটাতে পারে তা আপনার কল্পনারও বাইরে। আপনার অজান্তেই সে আপনার ডিভাইসটি ব্যবহার করে যা খুশি করতে পারে- এমনকি ডার্ক নেটে ঢুকে অস্ত্র বা ড্রাগ কেনাবেচার ব্যবসাও। আপনি আদপেই যা করেননি অথবা ঘুণাক্ষরেও যা জানেন না, তেমন কোনও অপরাধ কর্মের জন্য আপনার মোবাইল বা ল্যাপটপটি সহ আপনার ফেঁসে যাওয়া এবার সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

বলাই বাহুল্য, এই নজরদারি আজ এক ভয়ঙ্কর পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। বলা হচ্ছে, আপনি মনে মনে যা চিন্তা করছেন, তাও ধরা পড়ে যেতে পারে কোনও নজরদারির ফাঁদে। এই মুহূর্তে কথাটা খানিক বাড়িয়ে বলা হলেও, আংশিক সত্য তো বটেই। প্রবাদে বলে, বোবার কোনও শত্রু নাই। আপনি যদি নিতান্ত শুধু চিন্তাই করেন, তার কোনও প্রকাশ না থাকে, তাহলে এখনও এমন কোনও প্রযুক্তির উদ্ভব হয়নি যা আপনার মস্তিষ্কের তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ করে আপনার অপ্রকাশিত চিন্তাকে পড়ে ফেলতে পারবে। কিন্তু যদি কোনও অসতর্ক মুহূর্তে আপনার চিন্তাকে বিন্দুমাত্র কারও সঙ্গে ফোনের বার্তালাপে অথবা মুখোমুখি কোনও ব্যক্তিকেও আপনি জানিয়ে বসেন, তাহলে কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে তার নজরদারি-বন্দীত্ব কঠিন বাস্তব সত্য।

অর্থাৎ, এক ‘নেটওয়ার্ক সাম্রাজ্যবাদ’ আজ দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। এই নিয়ন্ত্রণের দুটি উদ্দেশ্য আছে: ১) বাণিজ্যিক ও ২) রাজনৈতিক। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যটি হল, আপনার তথ্যগুলি ক্যাপচার করে অন্যের কাছে বিক্রি করা যারা আপনাকে সম্ভাব্য ক্রেতা বা উপভোক্তা হিসেবে পেতে থাকবে; রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটি বিবিধ এবং তা শাসক শ্রেণির চরিত্রের ওপর নির্ভরশীল যেখানে নাগরিকদের তথ্যগুলিকে সমবেত করে ভোটের রাজনীতিতে ব্যবহার করা ও তাদের ভাবনাকে প্রভাবিত করা থেকে শুরু করে, এমনকি বিরুদ্ধবাদীদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনে তাদের নানা উপায়ে শায়েস্তা করা পর্যন্ত হতে পারে। যেমন, গত দু-এক বছরে আমাদের দেশে দেখা গেছে, বহু সাধারণ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের অ্যাকাউন্টগুলিকে (X, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি) হয় সাসপেন্ড অথবা পুলিশি খবরদারি কিংবা আইনি প্যাঁচে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে, যারা মোদি বা বিজেপি বিরোধী নানারকম পোস্ট করছেন, তাদেরই বেছে বেছে এইভাবে টার্গেট করা হচ্ছে। অথচ, তারা যে খুব প্রভাবশালী ব্যক্তি তা কিন্তু নয়। এটা আসলে সাধারণ নাগরিকদের কাছে এই বার্তা দেওয়া যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় মোদি বিরোধী প্রচার করে নির্বিবাদে টিকে থাকা যাবে না। বরং প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে ততটা কড়াকড়ি নেই। কারণ, তাদের নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করলে তা সামাজিক বলয়ে নানারকম ঘাত-প্রতিঘাত সৃষ্টি করতে পারে। অতএব, অকিঞ্চিৎকরদের টাইট দিয়েই বাকী আমজনতার গলার স্বর যতটা নিচু করা যায়! কথাটা হল, ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলি ক্ষমতায় আসীন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেই এই নজরদারি ও অনুশাসনগুলি নির্দ্বিধায় চালিয়ে যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, গত ৩১ অগস্ট ‘ইন্ডিয়া টুডে’ একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার এয়ারটেল, জিও ও বিএসএনএল’এর মতো সংস্থাগুলিকে- সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে যে যোগাযোগ প্রযুক্তির কেবলগুলি গেছে- সেগুলিকে ট্যাপ করে নজরদারি চালানোর জন্য উপযুক্ত সরঞ্জাম বসাতে বলেছে। নজরদারির এই সরঞ্জামগুলি জোগান দিচ্ছে ইজরায়েলের Cognyte Septier ‘এর মতো কোম্পানি। এই কেবলগুলি দিয়ে যে অজস্র তথ্য বয়ে চলে, সেগুলিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডাটা অ্যানালিটিক্স মারফত কপি করে ভারতীয় নিরাপত্তা এজেন্সিগুলির হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই নজরদারিতে আপনার-আমার ইমেইল, হোয়াটসঅ্যাপ কল পর্যন্ত ধরা পড়ে যাবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনুশাসিত এই ব্যবস্থাপনায় শাসক কর্তৃক নির্দিষ্ট স্পর্শকাতর কীওয়ার্ডগুলিকে ছাকনির মতো ব্যবহার করে নির্দিষ্ট বক্তব্য ও ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হবে। অথচ, এই কুকর্মের জন্য ব্যক্তির স্বাধিকার ও গোপনীয়তা ভঙ্গ করার অভিযোগও আর তোলা যাবে না। কারণ, অতি সম্প্রতি দেশে লাগু হয়ে গিয়েছে ‘ডিজিটাল পার্সোনাল ডাটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট ২০২৩’, যা এই ধরনের কাজগুলিকে আইনি মান্যতা দিচ্ছে ‘দেশের অখণ্ডতা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে’র নাম করে।

অর্থাৎ, কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সেন্ট্রাল ভিস্তা নির্মাণ করে ও সংবিধানকে আমূল বদলে দিয়ে যে হিন্দুবাদী ‘সাংবিধানিক রাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার খোয়াব দেখছে কেন্দ্রীয় শাসক, সেখানে নজরদারির মাধ্যমে গোটা দেশটাকেই জাতীয় কারাগার বানিয়ে দেওয়াটা হল আবশ্যিক প্রাকশর্ত। সেই লক্ষ্যেই নজরদারির পূর্ণ অনুশীলনে সিদ্ধ হতে চাইছে শাসককুল, যাতে দেশটা অচিরেই হীরক রাজার সভাসদদের মতো ‘ঠিক ঠিক’ বলা প্রজাকুলে ছেয়ে যায়।

এই গভীর বিপন্নতার সামনে দাঁড়িয়ে নতুন করে ভাবতে হবে, কীভাবে আমরা মোকাবিলা করতে পারি একনায়কের অভিলাষ! তাই, মানুষজনও পালটা রণকৌশল বানিয়ে নিচ্ছেন। ভরসাটাও সেখানে।