ব্রিজভূষণরাই যখন দেশ চালাচ্ছে
প্রবুদ্ধ বাগচী
গত
কয়েক দশকে দেশের শাসনকর্তাদের থেকে দুটো আপ্তবাক্য শুনে শুনে আমরা পরিশ্রান্ত। তার
একটি হল ‘সুশাসন’,
অন্যটি ‘উন্নয়ন’।
এই দুটো শব্দের ব্যঞ্জনা
নিয়ে নানা মুনির নানা মত আছে, থাকাই স্বাভাবিক।
কিন্তু দেশের গড়পড়তা আমজনতার কাছেও এর একটা
গ্রাহ্য চেহারা আছে। ‘সুশাসন’ বলতে
তাঁরা মনে করেন, দেশের আইন যারা ভাঙেন সরকারি প্রশাসনের উচিত তাঁদের শাস্তিবিধানের ব্যবস্থা
করে দেশের সাধারণ নাগরিককে সুরক্ষিত রাখা। এটা
একটা খুবই সহজ ন্যারেটিভ। যে রামচন্দ্র’কে নিয়ে আজ সারা দেশকে
উত্তেজিত করার চেষ্টা হচ্ছে, তাঁর মুকুটেও আছে এই ‘সুশাসনের’ পালক। কিন্তু
রামের মতো পুরাণপুরুষকে যারা দেশের রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসতে মরিয়া, তাঁদের রক্তে
যে সুশাসনের কোনও বালাই নেই, তা প্রমাণ হয়ে গেল আবার; যখন
কুস্তিগীর সাক্ষী
মালিক তাঁর খেলার
জুতোটি সাংবাদিক
সম্মেলনে টেবিলে তুলে রেখে জানিয়ে দিলেন, আর তিনি খেলায় নেই। তাঁরই
অনুসরণে পরদিন বজরং পুনিয়া প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে
দিল্লির রাজপথে বিছিয়ে
দিলেন তাঁর পদ্মশ্রী খেতাব ও রেখে এলেন একটি বিনম্র প্রতিবাদ-পত্র। এখনও অবধি
যা সংবাদ, এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশের ক্রীড়াবিদরাই ক্ষুব্ধ ও বিড়ম্বিত বোধ করছেন। অচিরেই
আরও কোনও প্রোজ্জ্বল
ক্রীড়াবিদ যদি তাঁর খেতাব ফিরিয়ে দেন, তাতে অবাক হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু
এই পরিস্থিতি তৈরি হল কীভাবে?
ঘটনাটা
সবাই জানেন। সাক্ষী
মালিকের মতোই একদল জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কুস্তিগীর
যারা আন্তর্জাতিক আসরেও দেশের হয়ে পদক জিতেছেন,
তাঁরা একযোগে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিং’এর দিকে।
উত্থাপিত অভিযোগ নারী কুস্তিগীরদের ওপর তাঁর
নিয়মিত যৌন নির্যাতন, শ্লীলতাহানির। দেশের আইন বলে,
এইসব গুরুতর অভিযোগের খবর পাওয়া মাত্র পুলিশকে
দ্রুত এফআইআর দায়ের করে আপাত-অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে শুরু করতে হয় তদন্ত। দিল্লির
পুলিশ কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র দফতরের অধীন এবং অভিযুক্ত ‘মহাপুরুষ’টি যেহেতু বিজেপি প্রজাতিভুক্ত,
তাই দুয়ে দুয়ে চার হয়ে যাওয়ায় এ ক্ষেত্রে পুলিশ
ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাকে। ক্ষোভ বাড়তে থাকে আক্রান্তদের মধ্যে, যা অচিরেই নেমে আসে নয়াদিল্লির
রাজপথে (আপাতত নাম পাল্টে যা ‘কর্তব্যপথ’)। কার কর্তব্য কে
করলেন জানা যায়নি, তবে বিক্ষোভের তীব্রতা দেখে দিল্লি পুলিশ অবস্থানে বসা খেলোয়াড় ও
কুস্তিগীরদের টেনে হিঁচড়ে কুৎসিত ভাবে গ্রেফতার করে
ও ছত্রভঙ্গ করে দেয়। অবস্থানকারীরা কেউ সশস্ত্র ছিলেন না, আর প্রায় প্রত্যেকেই জাতীয় বা
আন্তর্জাতিক পদকজয়ী। দেশের হয়ে যারা মুখ উজ্জ্বল করেছেন, তাঁদের
গুরুতর অভিযোগ প্রশাসন উপেক্ষা করে। এই উপেক্ষার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে কুস্তিগীররা সিদ্ধান্ত নেন বারাণসীর গঙ্গায় তাঁরা তাঁদের
পদক ভাসিয়ে দেবেন।
একে
পুণ্যতোয়া জাহ্নবী অন্যদিকে বারাণসীর সাংসদের ওজন অত্যন্ত বেশি, তাই তড়িঘড়ি কেন্দ্রের
ক্রীড়ামন্ত্রী যিনি ‘গোলি মারো শালোকো’ বাচনের জন্য সুবিখ্যাত, আসরে নামেন। তাঁর
দেওয়া প্রতিশ্রুতি ছিল, ওই অভিযুক্ত ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে উপযুক্ত তদন্ত করা হবে এবং তিনি বা তাঁর নিকটজন অথবা তাঁর
পরিবারের কেউ যাতে আর জাতীয় কুস্তিগীর ফেডারেশনের সঙ্গে সংশ্রব না রাখেন, সেদিকেও
খেয়াল রাখা হবে। যদিও এই প্রকরণকে তথাকথিত সুশাসনের নজির বলা যাবে না, কারণ, এই
পদক্ষেপের জন্য পুলিশের হাতে থাকা আইনি সংস্থানই ছিল যথেষ্ট।
রাতারাতি নোটবন্দি করে যেমন ‘কালাধন’কে ঘরে
ফেরানো যায়নি বা সন্ত্রাসীদের অর্থের উৎস বন্ধ করা সম্ভব হয়নি, বা যেমন থালা বাজিয়ে আটকানো
যায়নি করোনা ভাইরাস’কে, সেইভাবেই বিজেপির এই ‘কালাধন’কেও সবক শেখানো গেল না। তা
সম্ভবও ছিল না, কারণ বিগত কয়েক মাসে পুরনো অভিযোগে
তাকে পুলিশ গ্রেফতার করেনি, তিনিও বুক ফুলিয়ে নয়াদিল্লিতেই ছিলেন- তাঁর বিরুদ্ধে কোনও তদন্তও হয়নি।
যদিও অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ
বা কেন্দ্রীয় এজেন্সি তাঁদের চক্ষুশূল নানা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রাগৈতিহাসিক
অভিযোগ খুঁচিয়ে তুলে তাঁদের ‘ফাঁসিয়ে দেওয়া’কে একেবারে তাঁদের নিত্যকর্ম পদ্ধতির অঙ্গ
করে নিয়েছে—- কিন্তু এ ক্ষেত্রে আইনের দু’ চোখে তাঁরা নিজেরাই এমন দলীয় আধিপত্যের ঠুলি
পরিয়ে রাখলেন যে দেশের বিশিষ্ট কুস্তিগীরদের
আজ নেমে আসতে হল অপমানের তলে।
দেশের
কুস্তিগীর ফেডারেশনের
নিয়ন্ত্রক কমিটিতে জয়ী হলেন সেই কুকীর্তির নায়কেরই ‘আপনজন’—- যার বিরুদ্ধে মহিলা কুস্তিগীররা ধারাবাহিক
শ্লীলতাহানির অভিযোগ তুলেছিলেন, যাকে আড়াল করার জন্য সরকারের সর্বোচ্চ প্রশাসন মায়
‘খেল’মন্ত্রী অবধি বাজার গরম করেছিলেন—- সেই ‘মহারাজ’ যদি আজ ‘সাধু’ হয়ে যায় তাহলে
আর কীই বা করতে পারেন অপমানিত ক্রীড়াবিদরা? তাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতায় জেনেছেন, মল্লযুদ্ধের আসরে মঞ্চের প্রতিযোগীকে
মোকাবিলা করা যায় খেলার নিয়মে-- কিন্তু যে
খেলায় কোনও নিয়ম নেই, যার সবটাই ক্ষমতার দাপট আর নারী-অধিকার ও সম্মানকে ধ্বস্ত
করার এক ব্যাপ্ত আয়োজন, সেখানে কী করবেন তাঁরা? সেখানে কতদূর পর্যন্ত উচ্চকিত করা যায়
তাঁদের কন্ঠ? কত নগ্নভাবে প্রদর্শন করা যায় নিজেদের ক্ষত? যে মহাভারত আমাদের সভ্যতার
গর্ব, সেখানেও রাজসভায় আক্রান্ত পাঞ্চালী তাঁর অবমাননা নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন
সভার প্রবীণ গুরুজনদের দিকে—-- ক্ষমতার বিরুদ্ধে গিয়ে কেউ 'রা কাড়তে পারেননি। আজকের
ভারতেও কোনও সংবেদী ‘গুরুজন’ আর কেউ নেই, যিনি এই অনাচারের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে দিতে পারেন
তাঁর প্রতিবাদের বিভা, প্রতিরোধের দ্যুতি!
কী
করবেন আমাদের ঘরের এই মেয়েরা? যারা অনেক কষ্ট করে খেলা শিখেছেন, নিজেদের প্রস্তুত করেছেন
কঠিন প্রতিযোগিতার জন্য, দাঁতে দাঁত চেপে বিদেশের
মাটিতে দেশের নামে শপথ নিয়ে লড়াই করেছেন আর জয় করেছেন পদকের পর পদক—- এই যাবতীয় অর্জন আজকে
কোথাও যেন তরল হয়ে যায়। এসবের মূল্য কি এক ধর্ষকাম পুরুষের কাছে নিজেদের সম্ভ্রম বিসর্জন, তাঁর
সবল ক্ষমতাবৃত্তের সামনে অসহায় নতজানু হয়ে থাকা? ‘সুশাসন’ বলে আর কণামাত্র কিছু কি
আছে এই পোড়া দেশে? নাকি যা আছে তা কেবল প্রকীর্ণ
অন্যায় আর কণ্ঠরোধের ধারাভাষ্য? এর জবাব পাননি সাক্ষী মালিক, ভিনেশ ফোগট, সঙ্গীতা
ফোগট, বজরঙ্গ পুনিয়া'রা। তাই তাঁরা নিজের নিজের মতো তৈরি করেছেন প্রতিবাদের
আদল।
দশ
বছরের রাজ্যপাটে ভাজপা সরকারের নতুন করে বলার মতো তেমন কিছু নেই। ‘উন্নয়ন’ বলতে তাঁরা যা বোঝেন বা বোঝাতে চান
তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের চাহিদার তেমন কোনও যোগ নেই।
আর যোগ নেই বলেই আজ লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে
‘রাম মন্দির’এর মতো একটা বায়বীয় ইস্যু নিয়ে তাঁদের পথে নামতে হচ্ছে। কিন্তু
এই এক দশকে তাঁরা যেটা করেছেন, সারা দেশে যে কোনও
বিরোধী পরিসরকে তাঁরা সংকীর্ণতর করতে করতে
প্রায় লুপ্ত করে ফেলেছেন। শুধু তাই নয়, সংগঠিত অপরাধের সঙ্গী হিসেবে তাঁদের নিজেদের নেতা কর্মী সংগঠকরা
যখন নানাভাবে যুক্ত, তার প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রশাসন নীরব।
উত্তরপ্রদেশে যখন কিশোরী ধর্ষণের পক্ষে ভাজপা
নেতা মিছিল করেন, দলিত নিগ্রহের সপক্ষে গলা ফাটান অথবা গুজরাটের ছাড়া পাওয়া ধর্ষকদের
সম্বর্ধনা দেন—- তার প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে প্রশাসন ও দলের পক্ষে পালন করা হয় হিরণ্ময়
নীরবতা। অন্তত
কেউ তাঁদের ‘দুষ্টু ছেলে’ বলে নরম করে ‘বকে দেওয়ার’ কথাও বলেন না! এমন নয় যে ওইসব
‘দলীয় সম্পদ’ ছাড়া দলের রথচক্র মাটিতে বসে যাবে, তবু এইটাই রীতি, এইটাই তাঁদের স্পর্ধার
দর্পিত রক্তচোখ।
এই
পরিবর্ধিত এক দাপটের আবহেই কীর্তিমান ব্রিজভূষণ না হলেও তার ‘জিগরি দোস্ত’ জনৈক সঞ্জয়
সিং যখন সর্বৈসর্বা হয়ে ওঠে ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের—-- উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে ব্রিজভুষণ, যেন
বা এক ‘হেলায় লঙ্কাজয়’ ঘটিয়ে ফেলল সে। ফুলের মালা আর স্লোগানের আওয়াজে কেঁপে ওঠে
শীতার্ত দিল্লির সন্ধ্যে—- আর এই হিম অন্ধকারে মুখ লুকোয় যাবতীয় সুশাসন ও আইনের ধারা-উপধারা। একা
সাক্ষী মালিক এবং আরও অনেকে আরেকবার বুঝে যান, তাঁদের শ্রম,
নিষ্ঠা আর উদ্যোগ দিয়ে যে দেশকে তাঁরা উজ্জ্বল করতে চেয়েছেন বিশ্বের মঞ্চে, সেই দেশ আজ আর তাকে তাঁদের যোগ্য প্রতি-সম্মান ফিরিয়ে দিতে
নারাজ। কখন
যেন তাঁদের দেশ আর তেমন করে আর তাঁদের দেশ নেই-- এখানে শুধুই এক গর্ব-নিনাদ ছেয়ে ফেলছে নারীর
সম্ভ্রম, দলিতের জীর্ণ কুটির, সংখ্যালঘুর জড়োসড়ো অস্তিত্ব।
এই দেশের জন্য তো সাক্ষী মালিক, বজরং
পুনিয়ারা মাঠে নামেননি!
যেহেতু
জেগে থাকাও একরকমের ধর্ম, তাই কেউ কেউ নিশ্চয়ই জেগে আছেন।
এক দেশ এক আইন এক ধর্মের পাশে পাশে এক মিডিয়াও
যখন প্রায়-বাস্তব তবু বিকল্প কন্ঠ শোনা যাচ্ছে, যারা এই ‘ন্যায় সংহিতা’ বিল পাশ করানো
সরকারকে ন্যায় অন্যায়ের তফাতের কথা চিনিয়ে দিতে চায়।
প্রতিবাদ ছড়াচ্ছে কৃষ্ণা কাবেরী থেকে নর্মদা
গোমতীর বাঁকে বাঁকে। বছর শেষের এই উৎসব-নন্দিত ঋতুতে কেউ
ভাল থাকবেন না, সজাগ থাকুন।