যদুবংশ ধ্বংসের
প্রকল্প
যাদববন্ধু
একান্ত আলাপে প্রথম ও তৃতীয় পাণ্ডব)
প্রঃ পাঃ - কবেই বরিষ্ঠ দুই মুনি যদুবংশ ধ্বংসের অভিশাপ দিয়েছেন, আজও ব্যাটারা দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে। অর্জুন, তোমারই ওপর তো দায়িত্ব ছিল তাদের ধ্বংসপর্বের তত্ত্বাবধান এবং শেষপর্যন্ত একেবারে তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করার। তবেই না আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে স্বর্গারোহণ করতে পারি! হে কুশলী সব্যসাচী, এই কাজটুকু তুমি করে উঠতে পারছ না?
তৃঃ পাঃ – এটা যে ঘোর কলি,
মহারাজ! আমার ক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক খর্বিত।
প্রঃ পাঃ – তোমার সখা পার্থসারথি মানে কৃষ্ণই বা কি
করছে? সে তো যাদবদেরই মধ্যে অবস্থান করে! ভেতর থেকে ভাঙন ধরাতে পারছে না?
তৃঃ পাঃ – বললাম না, ঘোর কলি! সেই বিশ্বামিত্র,
নারদদের যুগে যা হতে পারত তা আজ চট করে হবে কেন! স্থান, কাল, পাত্র সবই বদলে গেছে।
হায়, কোথা সে দ্বারকা, কোথা সে দ্বাপর যুগ, আর কোথা সেই বীর যাদবরা যারা নিজেদের
মধ্যে মুষলযুদ্ধ করে পট পট মরে গেল! তাছাড়া,
এযুগে আসলে পার্থসারথিও তো আমি, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
নয়। মানে আমাকেই চালাতে হয় বাসুদেবকে। বড়ই মেদামারা হয়ে গেছে ভগবান।
প্রঃ পাঃ – তুমি পার্থ,
আবার তুমিই পার্থসারথি? ও, বুঝেছি - ‘পার্থের সারথি’র বদলে ‘যে পার্থ সেই সারথি’। ব্যাসবাক্যটা বদলে গেছে , সমাসটাও।
তৃঃ পাঃ - কি বললেন? সমস্যা? ও না, সমাস! মানে ব্যাকরণ?
বাপ রে, সেসব আমি জানি না! আপনার মত জ্ঞানার্জনের সুযোগ তো হয় নি - আচার্য দ্রোণ তীরন্দাজি
ছাড়া কিছুই শেখান নি। তাছাড়া ওসব ব্যাকরণ-ট্যাকরণ আমরা এখন এমনিতেই মানি না। কিন্তু সমস্যা
যদি বলেন, তার সমাধানের জন্য কি চেষ্টার ত্রুটি রাখছি! স্বয়ং কৃষ্ণ ছাড়া আরও লোক
ঢুকিয়ে দিয়েছি যাদবদের মধ্যে, কিন্তু কিছুতেই সুবিধে হচ্ছে না। আজকের যাদব হতভাগাগুলো সব যুদ্ধ না করে পড়াশোনা করে, আগে যেটা শুধু ব্রাহ্মণরাই করত আর তারা সবাই
আমাদের নিতান্ত অনুগত ছিল। কলিযুগে এখন গণতন্ত্র
চলছে তো, সকলেই বিদ্যার্থী। তা বিদ্যাচর্চাই নাহয় করল - আরো কতজনই তো করছে! অন্য কত ‘বিদ্যাস্থানে ভয়’ ঢুকিয়ে
দিয়েছি - ছাত্রদের হাতে মুষল থুড়ি রড-লাঠি-বাঁশ ধরিয়ে তাদের যোদ্ধৃজাতিতে পরিণত করেছি, তারা নিজেদের
মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব করে প্রায়ই রণকুশলতা দর্শায়, আর দারুণ ভয়ের আবহ ঘনিয়ে তোলে। যাদবরা কিন্তু কিছুতেই সেসব করবে না! জেদি, অবাধ্য সব ছেলেমেয়ে!
তারা তাদের মত পড়াশোনা করবে, আমার কোনও কথা শুনবে
না!
প্রঃ পাঃ – তবে তো ‘উলটা বুঝলি রাম’ হল। মৌষলপর্ব এসে গেল অন্যত্র, যাদবরা দিব্যি আছে।
তৃঃ পাঃ – আরও আছে। অন্য অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুষলধারী ছাত্রনেতারা ছাত্রভর্তির
জন্য শুল্ক আদায় করছে দোর্দণ্ডপ্রতাপে। যাদবরা তা-ও করবে না, নতুন ছাত্রও
ভর্তি করবে নিজেদের নিয়মে। আমি যে আমার ছেলেদের
ঢোকাব, ঢুকিয়ে প্রথম থেকে তাদের আনুগত্য আদায় করব, সে উপায় নেই। আর ওদের গুরুমশাইগুলোও কম শয়তান নয় – সর্বক্ষণ ছাত্রদের উশকানি দিচ্ছে! গুরু না ছাই, ঢ্যাঁটা গোরু!
প্রঃ পাঃ – ওদের মুষল-রাজনীতির আওতায় আনার ব্যাপারে কেন তোমার এমত ব্যর্থতা, পার্থ?
তৃঃ পাঃ – আসলে কি জানেন জ্যেষ্ঠ
ভ্রাতঃ, হোগলা-ঘাস থেকে লৌহমুষল তৈরি করা যায় যাদুমন্ত্রে,
যেটা অন্য অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করতে পেরেছি। যাদবদের হাতে যে সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি। সোনা-রুপো থেকে লোহা বানানো মুশকিল।
প্রঃ পাঃ – পার্থ, এটা কিন্তু চিন্তার বিষয় হল। আমরা মুষল-কৌশলে যা পারি নি, এরা না মুদ্রারাক্ষসের সাহায্যে সেটা করে ফেলে! অর্থবাণেই যাদবদের বধ থুড়ি বশ করে ফেলবে হয়ত!
প্রঃ পাঃ - তবে যা খবর পেলাম,
কিছু কিছু গোলমালের চিহ্ন যাদবদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে - ঐ দ্বাপরের যদুবংশের বেলায় যেমন হয়েছিল আর কি, এবং সেটা
আমাদের পক্ষে শুভলক্ষণ। তখন যেমন গাভীর গর্ভে
গর্দভ জন্মেছিল, সারস পাখি প্যাঁচার মতো
ডাকছিল, তেমনি শুনছি ইদানীং যাদবদের কোনও কোনও মান্যগণ্য অধ্যাপক
বা অধ্যক্ষের লিখনে বানান বিপর্যস্ত, কারও লিপি প্রলাপের মতো পড়তে লাগে।
তৃঃ পাঃ – গোলমাল এমনি এমনি হয়নি, ভ্রাতঃ। আমাকেই অনুসন্ধান করে, উদ্যোগ নিয়ে এমন সব রত্নপ্রভ শিক্ষক-আধিকারিক নিয়োগ করতে হয়েছে। ছাত্রদের যখন কায়দা
করতে পারছি না, মাস্টারদেরই চেষ্টা করি। অন্যদেরও পথে আনার চেষ্টা করছি এদেরই সাহায্যে। এদের দুয়েকজন নিয়মিত সোমরস পান করে এবং যথোচিত প্রমত্ত অবস্থায়
গভীর রাতের নিরিবিলি অবকাশে যাদবদের জনে জনে ফোন করে আমাদের মতবাদ প্রচার করে। কিন্তু তাতেও খুব কিছু সুবিধে হচ্ছে না। এরা চেয়ারে সমাসীন এবং মণিরত্নভূষিতও বটে, কিন্তু তেমন দিব্যকান্তি দেখাচ্ছে না। তাছাড়া এরা যাদবদের মধ্যে সংখ্যালঘুও বটে।
প্রঃ পাঃ – তবে শ্রীকৃষ্ণকে তুমি
যা জব্বর চেয়ারখানা দিয়েছ, তাতে অনেকটা কাজ হবে বলে মনে হয়। কোথায় পেলে গো এমন যাদু-কেদারা? চেয়ারে বসলে নাকি তার একরকম মতবাদ, চেয়ার ছেড়ে উঠলে আরেক রকম! সেদিন নিজেই দেখি ছাত্রদের
সে কথা বলছে। মানে বলতে চাইছে – চেয়ারের বাইরে আমি যাদবদের স্বাধিকারে বিশ্বাসী, চেয়ারে
থাকলে ক্ষমতার অনুগত। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম
– ঐ আজকাল কিসব বলে না - বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা স্কিটজোফ্রেনিয়ার মত কোন অসুখে ভুগছে বেচারা বাসুদেব। ওর অসুস্থতার কথা ক’দিন ধরেই শুনছিলাম। তা নারদমুনি সেদিন এসেছিলেন অনেকদিন বাদে, বললেন - না, ওটা চেয়ারেরই যাদু। উনি আবার ঢেঁকি, চেয়ার ইত্যাদির যাদুকরণের ব্যাপারগুলো ভাল বোঝেন।
তৃঃ পাঃ – কৃষ্ণের এই বর্তমান
অবতার বরাবরই সুশীল কেদারারঞ্জন দাস। শেষপর্যন্ত সবসময়ে ক্ষমতারই দিকে। সম্প্রতি ভর্তি নিয়ে আমাদের আদেশ লাগু করতে যে ব্যর্থ হল, তা নিয়ে বেচারা খুবই মুষড়ে পড়ছে। কিন্তু ওর আরেকটু ডাকাবুকো হওয়া দরকার ছিল। সুদর্শন চক্রটাই খুইয়ে বসে আছে - সকলের চোখের সামনে দিয়ে আকাশে উড়ে চলে গেল!
চেয়ারের কি আর চক্রের মত জোর আছে! এর আগে তবু আরেক
অবতার কেদারানাথ নিজে হাতে না পারলেও পুলিশ ডেকে যাদবদের বেশ করে ঠেঙিয়ে দিয়েছিল…
প্রঃ পাঃ – তার কথা আর বোলো না। সে তো আমাদের মুখ পোড়ালো! যাদবরা স্রেফ কলরোল করে তাকে তাড়িয়েই ছাড়ল।
তৃঃ পাঃ – তা ঠিক। তবে কেদারানাথদের একটু শক্তপোক্ত না হলে চলে, যতই যাদু-কেদারা হোক!
প্রঃ পাঃ – আচ্ছা, তোমার সখা কেদারারঞ্জনকে বল, এরপর আর কিছু না পেলে চেয়ারের
হাতল খুলে নিয়ে ছাত্রদের পেটাতে।
তৃঃ পাঃ – দেখা যাক, এরপর কবে কিভাবে সুযোগ আসে। অপেক্ষায় আছি।
প্রঃ পাঃ – আমি কিন্তু ভয় পাচ্ছি
মুনিরা অভিশাপ ফলছে না দেখে শেষে আমাদেরই না অভিশাপ দেয়। যুগন্ধর মুনি, যুগপতি মুনির প্রভূত তপস্যাবল।
(দরজায় করাঘাত, দৌবারিকের
প্রবেশ এবং প্রথম পাণ্ডবের হাতে একটি পত্র প্রদান)
দৌবারিক – মহামান্য মহারাজাধিরাজ
দূত পাঠিয়েছেন, মাননীয় মহারাজ।
প্রথম পাণ্ডব চিঠিটি পড়তে লাগলেন, তাঁর মুখমণ্ডল
ক্রমশ গম্ভীর ও ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হয়ে উঠতে লাগল। পড়ে নিয়ে তিনি তৃতীয় পাণ্ডবকে বললেন – মহারাজাধিরাজ যাদবদের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য জানিয়েছেন। বলে
পাঠিয়েছেন – তাদের ওপর কড়া নজরদারির ব্যবস্থা হচ্ছে এবং তাদের বাধ্যতামূলক কেন্দ্রীয়
কর্মসূচির আওতাতেও আনা হচ্ছে। কৃষ্ণের জীবনী লেখার জন্য যাদবদের ইতিহাস বিভাগ,
তাঁর জন্মস্থানের সঠিক ভূগোল নির্ণয়ের জন্য ভূগোল বিভাগ ও মন্দির নির্মাণের জন্য সিভিল
ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগকে আদেশ দেওয়া হচ্ছে। এসবের জন্য সহস্রকোটি স্বর্ণমুদ্রা তাদের
অনুদানও দেওয়া হবে। তিনি আশা করেন, মুদ্রার বিনিময়ে তাদের আনুগত্য সুনিশ্চিত
করা যাবে। আর তাতে তারা অস্বীকৃত হলে তাদের ধংস ত্বরান্বিত করার উপযুক্ত অজুহাতও
মিলে যাবে। আরো বলে পাঠিয়েছেন যে, তিনি নাকি শুনেছেন আমরা মাঝে মাঝেই
শিক্ষাগুরুদের গোরু বলে গোমাতাদের অপমান করে থাকি। এ ব্যাপারে তিনি
আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন, বলেছেন এতে ফল ভাল হবে না।
শুনতে শুনতে তৃতীয় পাণ্ডবের মুখমণ্ডলও রক্তবর্ণ হয়ে উঠল, কিন্তু
দ্রুত মুখে শান্ত ভাব এনে তিনি দৌবারিককে বললেন –
মহারাজাধিরাজের দূতকে বলে দাও, আমাদের প্রশাসনে যেন তিনি নাক না গলান। আমরা আমাদের
মাধব, যাদব, গো-গর্দভদের নিয়ে কি করব সেটা আমাদের ব্যাপার। তিনি যেন মনে রাখেন এটা
গণতন্ত্র এবং আগামী নির্বাচনে নিজেই তিনি ধ্বংস হতে যাচ্ছেন। যাদবদের ধ্বংসের ভার
নাহয় আমাদের হাতেই ছেড়ে দিন।
দৌবারিক – যথা আজ্ঞা,
মহারাজ!
(দৌবারিকের প্রস্থান)
প্রঃ পাঃ – পার্থ, এটা কিন্তু চিন্তার বিষয় হল। আমরা মুষল-কৌশলে যা পারি নি, এরা না মুদ্রারাক্ষসের সাহায্যে সেটা করে ফেলে! অর্থবাণেই যাদবদের বধ থুড়ি বশ করে ফেলবে হয়ত!
তৃঃ পাঃ – চিন্তা করবেন না মহারাজ। আমি যথাসাধ্য
চেষ্টা করছি। নতুন কোন কৌশল ঠিক বের করে ফেলব।
প্রঃ পাঃ – তাড়াতাড়ি কর।
আমাদের স্বর্গারোহণ পর্বটা বড্ড পিছিয়ে যাচ্ছে।