গ্রামবাসীদের প্রশ্নে পাওয়ার গ্রিড কর্তারা দিশেহারা
তুষার চক্রবর্তী
যে কাজ শুরু করার কথা
প্রকল্প হাতে নেবার আগে, অনেক বিপর্যয়ের পর অবশেষে পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন অফ
ইন্ডিয়ার কর্তাব্যক্তিরা থমকে যাওয়া সেই প্রকল্প নিয়ে
গ্রামবাসীদের সঙ্গে আলোচনার সোজা রাস্তায় পা রাখলেন গত শনিবার (১৬/৯/২০১৭)l পাওয়ার
গ্রিড সংক্রান্ত এই বিশেষ আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হল পোলেরহাট হাই স্কুলেl
গ্রামবাসীদের স্বসংগঠিত 'জমি জীবিকা
বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষা কমিটি'র সঙ্গে ১২ সেপ্টেম্বর বারুইপুর জেলার পুলিশ
সুপারের মিটিংএ, পুলিশ সুপারের তত্বাবধানে ও জেলা পরিষদের সদস্য কাইজার
আহমেদের আয়োজনে এই আলোচনা সভার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়l সভায় গ্রামবাসীদের জন্যে
২০০টি গেটপাস ছাপানো হয় যার অর্ধেক কাইজার নিজের অনুগতদের মধ্যে বিলি করেন ও
বাকী অর্ধেক জমি রক্ষা কমিটির হাতে দেওয়া হয়l কিন্তু, এই সভার সব চাইতে লক্ষণীয় দিক
হল এই যে তা সত্বেও সভায় গ্রামবাসীদের মধ্যে বিন্দুমাত্র বিভাজন দেখা যায়নিl
ভরাট সভা একযোগে জমি রক্ষা কমিটির আমন্ত্রিত বিশেষজ্ঞদের প্রতিটি বক্তব্য বিপুলভাবে
করতালি দিয়ে সমর্থন করেন ও পাওয়ার গ্রিড কর্তৃপক্ষকে বারংবার বেআইনি কাজের অভিযোগে
জর্জরিত করেনl আর পাওয়ার গ্রিড কর্তাদের যোগাড় করা দুজন বিশেষজ্ঞ এ সব দেখে কোনও
কথা না বলে সভা থেকে চুপি চুপি মাঝপথে পালিয়ে যানl
সভায় পাওয়ার গ্রিড
কর্পোরেশনের তরফে ছিলেন মোট ১১ জন, যাদের
৭ জন নিজেদের পরিচয় দেনl এঁদের নেতৃত্ব দেন এস কে লাহিড়িl কলকাতা ছাড়াও
দিল্লি থেকেও এঁদের কয়েকজন এসেছিলেনl সম্পূর্ণ সভার কাজ পাওয়ার গ্রিডের তরফে ভিডিও
রেকর্ড করা হয়l পাওয়ার গ্রিডের আমন্ত্রণে শিবপুর ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের
দুজন অধ্যাপক নির্বাক শ্রোতা হিসেবে সভায় প্রথম দিকে ছিলেন এবং গ্রামবাসীদের প্রশ্নে পাওয়ার গ্রিড কর্তৃপক্ষ
যখন দিশেহারা হচ্ছেন, তখন তাঁরা সেমিনার ত্যাগ করেনl একটি সংবাদপত্রে তাঁদের নাম
করে যে বক্তব্য ছাপা হয়েছে তার কোনও বাস্তব অস্তিত্ব সভার রেকর্ডিং'এ তাই পাওয়া
যাবে নাl
জমি রক্ষা কমিটির তরফে সভায়
যোগ দেন বিজ্ঞানী নিশা বিশ্বাস,
জীববিজ্ঞানী তুষার চক্রবর্তী, যাদবপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক সঞ্জীব
আচার্য, কম্পুটার সায়েন্সের ছাত্র প্রিয়ম বসু ও ভাঙড় সংহতি কমিটির সভাপতি শংকর
দাসl প্রিয়ম বসু এঁদের তরফ থেকে পাওয়ার গ্রিড কর্তৃপক্ষের বেআইনি কাজের তালিকা পেশ
করা শুরু করতেই গ্রামবাসীদের পূর্ণ সমর্থন দেখে উদ্বিগ্ন কাইজার পাওয়ার গ্রিড কর্তৃপক্ষের কাছে উঠে আসা প্রশ্নের একে একে জবাব চাইতে শুরু করেনl সম্ভবত, মতলব
ছিল পাওয়ার গ্রিড কর্তৃপক্ষকে গুরুত্ব দিয়ে অবস্থা বাগে আনাl কিন্তু, পাওয়ার গ্রিড কর্তৃপক্ষ সাফাই গাইতে গিয়ে আরও বিপদে পড়ে যানl শেয়ার বাজারে শেয়ার বিক্রি করতে
গিয়ে SEBI'র কাছে দেওয়া নথিতে পাওয়ার গ্রিড যে সব আশংকা ও ক্ষতির কথা স্বীকার করেছে, তার ব্যখ্যা দিতে গিয়ে হাস্যকরভাবে আমতা আমতা করে বলে ফেলেন যে 'সরকার আমাদের ওসব লিখতে বলে, তাই ওগুলো আমাদের লিখতে হয়l'
IFC'র আন্তর্জাতিক নিয়মে যে জলাভূমির ওপরে ট্রান্সমিশন লাইন টানার নিষেধ আছে, অথচ
এখানে একাধিক জলাভূমির ওপর দিয়ে লাইন টানা হয়েছে সেই অপরাধ তারা মেনে নিতে বাধ্য
হনl ইটভাটার ৫০০ মিটারের মধ্যে লাইন টানার নিষেধ আইনে থাকা সত্বেও তাঁরা কেন
একেবারে ইটভাটার ওপর দিয়েই লাইন টেনেছেন তার উত্তরে তাঁরা নতুন প্রযুক্তির যুক্তি
দিতে ব্যগ্র হয়ে ওঠেন, কিন্তু সেই যুক্তি যাই হোক, আইন না ভেঙ্গে দরকার হলে আগে যে
আইন বদলাতে হবে সে কথা গ্রামবাসীরা সমস্বরে মনে করিয়ে দিলে তাঁরা দিশেহারা হয়ে যানl বসতবাড়ি এমনকি প্রাথমিক স্কুলের ওপর দিয়ে বেআইনি ভাবে কেন লাইন টানা হয়েছে এর জবাব দিতেও তাঁরা ব্যর্থ হনl এমনকি এর জন্যে লাইনের দু' পাশে আইনগত ভাবে যে ছাড় দেবার কথা সেই ৪৬ মিটার ROW'এর
(right of way) প্রশ্ন উঠলে তাঁরা ৩০ মিনিট ধরে বিষয়টি না বোঝার ভান করে
কালক্ষেপ করা শুরু করে দেন; যা গ্রামবাসীরা ধরে ফেলেনl গ্রামবাসীরা পাওয়ার গ্রিডের সরকারি বিবৃতিতে এর নাম 'রাজারহাট প্রকল্প' এবং কোনও নথিতে ভাঙড় উল্লেখিত
না থাকার অসংগতির জবাব চাইলে কর্তৃপক্ষ দিল্লির কাছে 'যা রাজারহাট তাই ভাঙড়' বলে আরও
বিপদে পড়ে যানl আসলে, রাজারহাট অ্যাকশন এরিয়া ৩ যে পাওয়ার গ্রিডের জন্যে ধার্য
ছিল সেই ঘোষণা ও সাইনবোর্ড ভাঙড় এলাকাবাসী দেখেছেনl তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরে যার পরিবর্তন ঘটেছে এদের চোখের সামনেl দিল্লির অজ্ঞতা দেখিয়ে সেই অপ্রিয় সত্যকে ঢাকার চেষ্টা তাই মাঠে মারা যায়l
সময় তখন প্রায় পাঁচটাl পাওয়ার গ্রিড কর্তৃপক্ষ পালাতে চাইছেনl বিতর্ক যে শুরু হয়েছে তার ইতিবাচক দিক মেনে ও পাওয়ার গ্রিড যেন আরও দক্ষতা সম্পন্ন বিশেষজ্ঞ
এনে ও প্রশ্ন না এড়িয়ে অনতিবিলম্বে ঠিক ঠিক জবাব দেন সেই আশা রেখে কাইজার আহমেদ সভা শেষ করে দেনl সভায় পাওয়ার গ্রিডের পরাজয়ে কার্যত বিপুল
বিরক্তি তিনি চোখে মুখে প্রকাশ করে ফেলেনl
তর্কে নেমে গ্রামবাসীরা যে
কথাটা সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিয়েছেন তা হল, এলাকায়
না এসে, উদ্বিগ্ন গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথাবার্তা না বলে যারা বাড়িতে বা দফতরে বসে প্রকল্পের ফলে ক্ষতি হবে কী হবে না সেই বিধান দেবেন, তাঁদের কথা তাঁরা কখনই মানবেন নাl কলকাতা হাইকোর্ট অন্যায়ভাবে
UAPA ধারা প্রয়োগ ও কর্তব্যে গাফিলতির জন্যে নিম্ন আদালতের বিচারকদের তিরস্কার করেছিলl পুলিশ সুপার কয়েকদিন আগে
স্বীকার করেছেন যে গ্রামবাসীদের আন্দোলন গণতান্ত্রিক, অথচ তা নাকি বে-আইনিl বোঝা গেল,
তিনি প্রবাদপ্রতিম সোনার পাথরবাটির সমঝদার! আর, গ্রামবাসীরা এককাট্টা হয়ে যেভাবে আজ তর্কের নামে বিভাজনের পাশা উল্টে দিয়ে পাওয়ার্ গ্রিড
কর্তাদের খাবি খাওয়ালেন, আশা করি তা থেকে শিক্ষা নেবে এ রাজ্যের সরকারl সভা শেষে, গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা
বলে এটাই জানলাম যে তাঁরা আশা করছেন, এবার
অন্তত মুখ্যমন্ত্রী প্রকল্পকে ভাঙড় থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে নেবার নির্দেশ দেবেনl
বা! নতুন ধরণের সামাজিক সংলাপ শুরু হল যেখানে মাটিতে পা রেখে আন্দোলন এবং বৌদ্ধিক চর্চার যুগলবন্দী ঘটেছে। এ বার্তাকে কিভাবে সামাজিক মননে disseminate করা যায় সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ReplyDeleteএকদম ঠিক কথা। Development'এর নামে যা খুশি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে সকলের যুদ্ধ জারি থাক।
ReplyDeleteযুক্তিযুক্ত
Deleteআশা রাখি ভাঙড় আন্দোলন এভাবেই সরকারের সমস্ত অপপ্রচারকে ভুল স্থাপিত করে নিজের জয় হাসিল করে নেবে। মানুষের স্পৃহা এবং বিজ্ঞান এভাবেই একসাথে হাত ধরে হাঁটলে তা বৃহত্তর প্রগতির দিকেই হাঁটে
ReplyDeleteউচ্চ বিভব সম্পন্ন তড়িৎ প্রবাহের প্রভাব মানুষ এবং প্রকৃতির ওপর কী ভাবে পড়ে- এ সম্পর্কে সরকারী বিজ্ঞানীরা কী বললেন এবং তাদের যুক্তির সমর্থনে কী কী প্রামাণ্য নথি সামিল করলেন তা একটু বিস্তারিত ভাবে জানালে ভাল হয়।
ReplyDeleteহ্যা,সরকারী বিজ্ঞানীদের মতটাও জানা দরকার।
ReplyDeleteসরকারি বিজ্ঞানীরা কোনও মত রাখেননি। তাঁরা সভা ছেড়ে মাঝপথে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে যান। প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে।
ReplyDelete