‘অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে?’
প্রবুদ্ধ বাগচী
প্রায় বিশ বছর আগে কলকাতার একটি কবিতা-পত্রিকা ঘোষণা করেছিল, বাংলা কবিতায় আধুনিকতার শেষ হয়ে উত্তর-আধুনিকতার সূত্রপাত হয়েছে, তাই তারা তাদের পত্রিকায় কেবল উত্তর-আধুনিক চরিত্রের কবিতাই প্রকাশ করবে। কেমন সে উত্তর-আধুনিক কবিতা? কবিতা-পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী জানালেন, আধুনিকতার ইশারা আছে এমন কবিতা পরিত্যাজ্য। তাদের বিচারে, প্রযুক্তি বিপ্লবের ফলে যে নতুন বিশ্ববীক্ষা তৈরি হয়েছে, যেখানে অনেক সাবেকী ধারণার অবসান সূচিত হয়ে গেছে, পুরনো অর্থনীতি দিয়ে এখনকার অর্থনীতিকে আর ব্যাখ্যা করা যায় না- শ্রেণি পরিচয়ের ক্ষেত্রে, শ্রেণির ভিতরকার নানা আন্তঃসম্পর্কের ক্ষেত্রেও নাকি অনেক ধারণা পাল্টে গেছে বলে তাদের বিশ্বাস। তখন অতটা তাত্ত্বিক বিষয়ে জ্ঞানগম্যি ছিল না ঠিকই কিন্তু দুটো জিনিস নিজের সামান্য চিন্তায় বুঝতে পেরেছিলাম। একটা হল, কোনও বিশেষ কালপর্বে হঠাৎ করে আধুনিক থেকে উত্তর-আধুনিকতায় উল্লম্ফন, এটা বাস্তবে ঘটতে পারে না, সমাজ বিকাশের ধারা রাসায়নিক বিক্রিয়া নয়। অন্যটা হল, এই কথাগুলো বলার পেছনে মার্কসবাদী বিশ্ববীক্ষার ধারাকে কিছুটা নাকচ করে দেবার প্রবণতা রয়েছে। মার্কসবাদকে সর্বশক্তিমান না ভাবি, তার বৃহত্তর ভাবনাকে অত সহজে বোধহয় বাতিল করা যায় না। তাছাড়া, একটা সমাজে নানারকম আর্থিক স্তর থাকে, একটা স্তরের কাছে হয়তো বিদেশি সুরার দাম বাড়াটা মাথা ব্যথার কারণ, অন্য কারওর ক্ষেত্রে মাথায় হাত দিয়ে বসতে হয় বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়লে। এই দুজনের বিশ্ববীক্ষা কি এক হতে পারে ?
পরে, অল্প কিছু পড়াশোনার মাধ্যমে জেনেছি, এই উত্তর-আধুনিকতার ধারণা একেবারেই একটা অ্যাকাডেমিক ইউরোপিয় ভাবনা এবং এই তত্ত্বের প্রবক্তারা মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা বেশ খানিকটা অস্বীকার করেন। তা করুন, কিন্তু একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশের নাগরিক হয়ে চারদিক দেখেশুনে আমার মনে হয়নি শ্রেণিগত বিবেচনার ধারণাকে একেবারে বর্জন করাই উচিত। প্রযুক্তির দৌলতে তৃতীয় শিল্প বিপ্লব হয়ে গেছে বলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক আলোচনার ক্ষেত্রে মার্কসবাদী চিন্তাকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় করতে হবে এবং এইসব আচারপর্ব শেষে কবিতা লিখতে বসতে হবে, তবেই সেই কবিতা উত্তর-আধুনিকতায় স্নাত হবে, এমন বেয়াড়া ব্যাপারে আমার পক্ষে মত দেওয়া সম্ভব হয়নি। আমি আমার প্রশ্নগুলো তাদের বিশদে লিখে জানিয়েছিলাম, তারা সেটা তাদের পত্রিকায় প্রকাশ করলেও সেগুলোর আজ অবধি জবাব দেননি। হয়তো জবাব ছিল না, তাই।
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য'এর ‘আশায় বাঁচে চাষা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও একুশ শতকের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ পড়তে গিয়ে প্রথমেই আমার মনে পড়ে গিয়েছিল ওই পুরনো অমীমাংসিত জিজ্ঞাসাগুলোর কথা। কিন্তু গোড়া থেকেই দেখলাম, লেখক তার ভাবনার ধ্রুবপদ একটা জায়গায় ধরে রেখেছেন। তা হল, মার্কসবাদী অর্থনৈতিক বিচার। গত তিরিশ বছর ধরে, বিশেষ করে, সাবেক সোভিয়েতের পতনের পর সব থেকে বেশি আন্তর্জাতিক আক্রমণ এসেছে মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতার ওপর। ওই বিশেষ মতাদর্শ কতদূর ভ্রান্ত ও ভুয়ো তা নিয়ে চর্চা হয়েছে বিস্তর, কুৎসা হয়েছে নাগাড়ে- আজও দেশে-বিদেশে তার জোয়ারে ভাঁটা এসেছে এমন নয়। পুঁজিবাদ যে থেকে গেল এবং আরও চওড়া করে মেলে দিল তার দুই ডানা, এই নিয়ে কারও কারও মনে পুলকের পর পুলক, চোখে মদির স্বপ্ন, মনে মনে উদ্বাহু নৃত্যের প্রণোদন। লেখক অনিন্দ্য সেই নাচানাচির গোড়া মেরে রেখে প্রথমেই বলে দিয়েছেন, প্রথম শিল্প বিপ্লব থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ঘিরে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, যাই হোক না কেন এর মূলে আছে মার্কস'এর মূল্যতত্ত্ব, অর্থাৎ, একজন শ্রমদাতা যখন তার শ্রম নিয়োগ করে কোনও একটি পণ্য ( বস্তু বা পরিষেবা) তৈরি করেন তখন তার শ্রমের মাধ্যমে তিনি উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি করেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় যাকে বলেছিলেন ‘ভূতের বেগার’। এই উদ্বৃত্ত মূল্যই শ্রমের নিয়োগকারী বা মালিকের কাছে আসল জিনিস। কারণ, এইটাই তার হাতে আসে মুনাফা হিসেবে আর এই মুনাফার হার সব সময় চড়া না রাখতে পারলে পুঁজির বিনিয়োগ ও তার ফেরত লাভ নিয়ে তৈরি হয় ঘোর সংকট। গাণিতিক হিসেবেই এই চড়া মুনাফার হার বজায় রাখতে গেলে নিয়োজিত শ্রমের মজুরিকে ক্রমশ কমিয়ে আনতে হয়, আর, সেই অনন্ত মুনাফা ক্ষুধার জন্যই শ্রমের উপকরণ ক্রমশ পাল্টে যেতে থাকে। স্টিম এঞ্জিনের কালেও তা যা ছিল আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজারেও তার মূল সুত্র এক।
কিন্তু যে বিষয়কে কেন্দ্র করে এইসব আলোচনা, অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা যন্ত্র নির্ভর প্রায়-মনুষ্যশ্রমের একটা প্রতিস্থাপন, তার কিছু কিছু অন্য ধরনের বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা নিবিড় ভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। প্রযুক্তি বিপ্লবের হাত ধরে ভার্চুয়াল দুনিয়ার যে বিপুল বিস্ফোরণ তার ফলে কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেছে যা এর আগে দেখা যায়নি। একটা হল ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের ক্রমিক ক্ষয় ও পরিষেবা শিল্পের বিস্তার; অন্যটা হল ডাটা বা তথ্যের একটা সুবিশাল বাজার যার মালিক হয়ে উঠেছে গুটিকয় বহুজাতিক যারা প্রায় আক্ষরিক অর্থেই দুনিয়াকে তাদের মুঠির মধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছেন। আর বর্তমানের যা প্রবণতা তাতে আগামী কয়েক বছরে নিজেদের লাভের কড়িকে এক পর্বতপ্রমাণ জায়গায় নিয়ে যাওয়ার তাড়নায় তাঁরাই বিপুল বিনিয়োগ করছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-বিষয়ক গবেষণায়। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে শিক্ষা, গবেষণা, অর্থনৈতিক দুনিয়ায় এবং রাজনীতির বাজারেও। দেশে দেশে রাষ্ট্র ব্যবস্থা অনেক আগে থেকেই বণিকের মানদণ্ড দ্বারা পরিচালিত হত এখন তা ছাড়িয়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থাটাই প্রায় একরকম এই সব বহুজাতিকের কব্জায়। তারা নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করবেন, অর্থনীতির অভিমুখ ঠিক করবেন আর এই সবটাই হবে সেই মুনাফার হারের সুউচ্চ গতির স্বার্থে। স্বাভাবিক, এই বিশ্ব ব্যবস্থায় চাকরির বাজার ক্রমশ সংকুচিত, স্থায়ী চাকরির বদলে গিগ অর্থনীতি থেকে চুইয়ে আসা স্বল্পস্থায়ী চুক্তি-চাকরি, যার কোনও নিরাপত্তা নেই। লেখক তথ্য দিয়েছেন, আগামী কয়েক বছরে সত্তর শতাংশ মানুষের হাতে স্থায়ী কোনও চাকরি থাকবে না। কথাটা দুইদিক দিয়ে বিপজ্জনক।
এত মানুষের হাতে কাজ না থাকলে অর্থনীতির কী দশা হবে? এক শ্রেণির মানুষের হাতে এমনিতেই বিশ্বের সম্পদ কেন্দ্রীভুত হচ্ছে, অসাম্য বাড়ছে- তা কি এসে দাঁড়াবে আরও ভয়াবহ কিনারায়? অন্যদিকে, এত মানুষের কর্মহীনতা, জীবন ঘিরে অনিশ্চয়তা তাদের কি ঠেলে দেবে না নতুন কোনও পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বিক্ষোভের দিকে? মনে পড়ে যায়, শঙ্খ ঘোষের ‘রাধাচূড়া’ কবিতার কথা! এর একটা অভিঘাতে লেখকের বক্তব্য, এই বিদ্রোহের সম্ভাবনায় মাটিচাপা দিতে উঠে আসছে ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকামের ধারণা- রাষ্ট্র তার নিরাপত্তা রক্ষায় তার নাগরিকদের জন্য বরাদ্দ করবে কিছু মাসিক অর্থ- উপায় নেই, অলস মস্তিষ্ক কী থেকে কী করে ফেলে তার কি হিসেব রাখা সম্ভব? যদিও তথ্যের নজরদারি দিয়ে নিয়ত ম্যাপিং হয়ে চলেছে নাগরিকের- তবু, তবুও। খেয়াল রাখি, আমাদের দেশেও এই ন্যূনতম আয়ের ধারণা নিয়ে কথাবার্তা চালু হয়েছে সম্প্রতি। সবদিক দিয়ে লেখক যে বিপুল পরিশ্রম করে অত্যন্ত সুন্দর ঝরঝরে ভাষায় এইসব কথা আলোচনা করেছেন তা প্রশংসার। অন্তত বাংলা ভাষায় এমন একটি বিষয় নিয়ে যে বই লেখা যায় তা প্রমাণিত এই উদ্যোগে।
সব শেষে কয়েকটা প্রসঙ্গ না তুললেই নয়। পুঁজিবাদ যে ক্রমশ তার নিজের চেহারাকে
আরও আগ্রাসী করে তুলছে এবং নিজের সম্ভাব্য সংকট থেকে মুক্তির জন্য নিয়ত উদ্ভাবন করে
চলেছে ফন্দি-ফিকির, এটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রেও সমান সত্যি। আর পুঁজির (যতদূর
জানি, মার্কস নিজে পুঁজিবাদ কথাটি ব্যবহার করেননি) এই আগ্রাসন ও মুনাফাকেন্দ্রিকতা
নিয়ে মার্কস তাঁর অর্থনৈতিক লেখাপত্রে স্পষ্ট মত প্রকাশ করেছিলেন- মার্কসবাদ অনড়
এক স্থায়ী মতাদর্শ বলে স্বীকার না করলেও তাঁর এই প্রাসঙ্গিকতা এইভাবে প্রতিষ্ঠা পায়।
পরের কথাটা হল, আলোচনা যা করা হয়েছে সেখানে পুঁজিবাদী দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
প্রসঙ্গ এসেছে বেশি। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ যেখানে তথ্য প্রযুক্তির সঙ্গে
নাগরিকদের যোগাযোগ তুলনায় অনেক কম সেখানে এই নতুন শিল্প বিপ্লবের ধাক্কা কেমন ভাবে আসবে
তার একটা আভাস দেওয়া মনে হয় দরকার ছিল। এই লকডাউনের সময়ে প্রযুক্তি-নির্ভর ভার্চুয়াল
জীবনযাপন করতে গিয়ে দেখা গেল বহু মানুষ এর নাগালের বাইরে। প্রতীচী ট্রাস্টের সদ্য প্রকাশিত
এক তথ্য হল, এই রাজ্যের মাত্র ৯ শতাংশ পরিবার কম্পিউটার ব্যবহার করেন, সারা দেশে সেই সংখ্যাটা
১৫ শতাংশের আশেপাশে; ইন্টারনেটের ব্যবহারকারীও সারা দেশের জনসংখ্যার তুলনায় বেশ কম। এই
বাইরে থাকা মানুষের জন্য বার্তাটা কী? আর, এই নতুন জমানায় ব্যক্তি মানুষের আদল কী বা
কেমন হবে সেই বিষয়ে এই বইয়ে লেখক কিছু ভাবনাবহ প্রসঙ্গ তুলেছেন, সময় ঠিক করবে তার যাথার্থ্য। তবে সব মিলিয়ে এই বই আমাদের একটা বড় প্রাপ্তি।