নব স্বাভাবিক যুগে রাষ্ট্রের সমস্যা
অশোকেন্দু সেনগুপ্ত
পাখা মুড়ে যেন বিদায় নিয়েছে দিন, ঘন অনিশ্চিত অন্ধকারে ডুব দিয়েছে রাত্রি। এই অসময়ে জেগে আছে বা কে? কেউ নেই?
আছে, আছে। রাষ্ট্র পরিচালক জেগে আছে। সত্যি! সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে জানি রাষ্ট্রপরিচালক নিশ্চয় জেগে আছে। তার তো না জেগে উপায় নেই। সে একদা শাসনযন্ত্র হাতে পেয়েছে মানুষেরই ইচ্ছায়। সে কী জেগে আছে ‘আত্মা’ অথবা বিবেকের মতো? নাকি সে জেগে আছে দখল চিরস্থায়ী করার ইচ্ছে নিয়ে? কে জানে! জেগে আছে রাষ্ট্র ও তার অসহায় জনতাও – শিশু, কিশোর, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। কেউ জেগে আছে অতীত গর্ব নিয়ে, কেউ জেগে আছে ভবিষ্যতের সুখময় দিনের পদধ্বনি শোনার আশায়।
এদের জন্য কী জেগে আছে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র পরিচালক? হায়, সে কাল গত, এখন রাষ্ট্র জাগে কেবল নিজ প্রয়োজনে। আর রাষ্ট্র পরিচালক জাগে ক্ষমতা নিশ্চিত করতে। তার ইচ্ছায় বা অত্যাচারে ক্লান্ত দেশ এক অবিশ্বাস বুকে চেপে ঘুমিয়ে থাকে।
অবিশ্বাস! হ্যাঁ, তাই। এই ঘন অন্ধকারে জেগে আছে ভূতের মতো এক অবিশ্বাস। না রাষ্ট্র, না জনতা কেউই জানে না এই করোনা-পীড়িত বিশ্বে পথ কোথায়? অবিশ্বাস কেবল প্রশ্ন তোলে। প্রশ্ন তোলে দেশের হয়ে, দেশের পরিযায়ী শ্রমিকের হয়ে, অসুস্থ মানুষের হয়ে, মানবিকতার হয়ে। প্রশ্ন তোলে করোনা-সন্ত্রাস শেষে এই পরিচালক কেড়ে নেবে না তো আমার অধিকার? পরিচালকের মনেও প্রশ্ন। সে প্রশ্ন তোলে নিজের আয়নায়– কৌশলে ফাঁক নেই তো, মিলবে তো চিরদিন তখতে থাকার অধিকার?
এই প্রথম এমন তো নয়– প্রতি একশো বছরের ব্যবধানে সৃষ্টির প্রাসাদ গুঁড়িয়ে দিতে এসেছে ওরা– কখনও করোনা হয়ে, কখনও ফ্লু হয়ে। করোনার আগেই এসেছিল ‘স্প্যানিশ’ ফ্লু (১৯১৮-২০)। তখনও তার মোকাবিলায় রাষ্ট্র নানা জনপদে লকডাউন ঘোষণা করেছিল, আর এখনকার মতোই মুখোশ ইত্যাদির সুপারিশ রেখেছিল। তার কতটা মানুষ মেনেছে তার পূর্ণ ইতিহাস অন্তত আমার জানা নেই। জানা নেই সেই সব ব্যবস্থার কারণে কতটা জব্দ হয়েছে সেই ফ্লু। কারও কী জানা আছে? আমরা কেবল এটুকু জানি, তারপরও মানুষ আছে, সৃষ্টি আছে, মহিমময় সভ্যতার চাকা ঘুরছে, রাষ্ট্র আছে। আহত হয়েও দেশ আছে। তবে কেন আশা করব না যে করোনা-সন্ত্রাস শেষে আমরা সবাই থাকব। আমরা– এই মানবজাতি, সমাজ ও সভ্যতা। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য এই যে, তখনও থাকবে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র পরিচালক। তারা কী একই চেহারা নিয়ে থাকবে? ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে? সংশয় যে যায় না।
যাবে বা কেন? ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে কেমনে? স্প্যানিশ ফ্লু চোখ রাঙাতে শুরু করার ঠিক আগে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে প্রথম মহাযুদ্ধ। করোনা তো তেমন যুদ্ধ দেখেনি, দেখবে কী? বিশ্বব্যবস্থা এখন আরও চতুর, আরও পরিশীলিত, তাই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা বেশি হয়, প্রকৃত মহাযুদ্ধ হয় না। সেই স্প্যানিশ ফ্লু-র অল্প আগেই আমরা দেখা পেয়েছি মহান রুশ বিপ্লবের। পরবর্তী সময়ে বা সমকালে দেখা পেয়েছি মহাত্মা গান্ধীর। করোনার সমকালিক সঙ্গী হয়ে তো দেখা দিল না তেমন কোনও ব্যক্তি বা বিপ্লব? তবে কী এবার দেখা দেবে না মহাত্মা গান্ধী বা লেনিন বা রবি ঠাকুরের মতো কোনও ব্যক্তিত্ব? নাকি আরও কিছুকাল আমাদের অপেক্ষায় রেখে দেখা দেবে কোনও হিটলার? এসে পড়বে কোনও মহা সঙ্কট (Great Recession)। আমরা তো জানি না, তাই সংশয়। সংশয় বাড়াচ্ছে আমাদের রাষ্ট্র, তার পরিচালক বা নেতা তথা রাষ্ট্রব্যবস্থা। আমরা খুঁজেই চলেছি মিল ও অমিল। এক এক খবরের ঘাতে আমরা কেউ কেউ চমকিত হচ্ছি, কেউ চমৎকৃত। হায়, কেউ বা আহ্লাদিতও।
করোনা ত্রাসের গোড়ার পর্বে এ দেশে এলেন মহামতি ট্রাম্প, দেশের মানুষ তখন এনআরসি আর ক্যা-বিরোধী আন্দোলনে মত্ত। একদিকে ট্রাম্পের সেবায়, অন্যদিকে রাজ্য সরকার (মধ্যপ্রদেশ) দখলে মত্ত পরিচালক। ট্রাম্প চলে যাবার পর রাজ্যে রাজ্যে শোনা গেল সেই ত্রাসের কথা, সেই হাহাকারের কথা। হাহাকার কেন? ভয়! অজানার ভয়। জানে না তো কেউ কী করলে বিদায় নেবে এই শত্রু, কোথায় তার উৎস বা জন্ম, কোথায় বা বিস্তার, কোথায় মৃত্যু। শোনা গেল, এ দেশের মানুষদের- গোমূত্র, গোবর খায় যারা- কিছুতেই কাবু করতে পারবে না এই আটকুঁড়ের বেটা; আর কাঁসর ঘণ্টা ইত্যাদি বাজালে বেচারা করোনা নাকি পালানোর পথ পাবে না। এ তো এপারে এই রাষ্ট্রের কথা, ওপারে মহামতি ট্রাম্প বললেন, ও (করোনা) ভয়ে ভীত নয় বীরের হৃদয়। বীরই বটে, তিনি লকডাউন মানবেন না, মুখোশ বাঁধবেন না। (কিছুদিন পর অবশ্য দেখা যাচ্ছে তিনি তার দেশের মানুষের মতোই সবই মানছেন, মানতে হচ্ছে)। এপারে যেমন দেখা গেল বেচারা করোনা পালাল না, আরও প্রতাপ বাড়িয়ে রাজত্ব বিস্তারে মন দিল, ওপারেও তাই। নেতারা প্রায় কেউই গোমূত্র বা গোবরে ভরসা রাখলেন না। চারিদিকে বাড়ল ভয়। একদিকে বাজার অর্থনীতি তথা বিকাশ ও জিডিপি, অন্যদিকে অপ্রস্তুত পরিযায়ী শ্রমিক। একদিকে যদি পরিবহন বা স্বাস্থ্য কাঠামো তো উল্টোদিকে শিক্ষা কাঠামো চিৎকার জুড়েছে, গেল গেল রব তুলেছে। কোথায় গান্ধী, কোথায় লেনিন? তবে কী আসছেন হিটলার বা স্ট্যালিন বা ফ্রাঙ্কো? ভয় বেড়েই চলে। ভয় কাটাতে চাই নাকি ভ্যাকসিন। N- 95 মুখোশেও মুক্তি বা নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়।
এই স্তরে এসেই জানা গেল বিজ্ঞানীদের কথা শোনা দরকার। এর আগে পর্যন্ত তো কেবল কিছু নকল বিজ্ঞানী আর চিকিৎসক ও ব্যবসাদার তথা বাজারের কথাই শুনেছে রাষ্ট্র। তবে রাষ্ট্রও তো ধমক খায় বাজারের কাছে, ধমক খেয়ে সে ধমক দেয় প্রজাদের। তাই বিজ্ঞানী-গবেষকদেরও দুটো কথা না শোনালে তার চলবে কেন? আমাদের রাষ্ট্র আরও একটু এগিয়ে। সে তার অধীনস্থ গোলাম একটি সংস্থাকে– যেমন তেমন সংস্থা নয়, সে নিজেও এক নিয়ামক সংস্থা (ICMR-এর কথা বলছি, যে নাকি আর এক বিশ্বসংস্থা (WHO)র চর বা অনুচর)– ডেকে নাকি বলল, টিকা লাও, আভি লাও, জলদি লাও। ১৫ অগাস্টের মধ্যে দাও। টিকা আবিষ্কারের পদ্ধতি ও তার ব্যবহারবিধি বাতিল করা যে যায় না, তাতে কী? কর্তারা চেয়েছিল বলেই না তড়িঘড়ি পরমাণু বোমা পেয়েছিল বিশ্ব। কারও হয়তো মনে পড়বে হিটলারের কথাও। আমার মনে পড়ছে সত্যজিৎ রায়ের বানানো ছবি ‘মহাপুরুষ’এর কথা। নেতা বললে উঠতেই হবে সূর্যকে– ওঠ, ওঠ।
পরিচালকদের দুর্ভাগ্য এই যে, তাদের মাত্র দুটো কান। একটা কান আবার চিরতরে বাজারে বন্ধক দেওয়া। আর একটা কানে শুনতে হচ্ছে হাজারও সমস্যার কথা। সমস্যা তো এক নয়, তার মধ্যে কোথায় ঝড়, কোথায় ঘোড়া কেনা-বেচা, কোথায় বন্যা তাও দেখতে হবে। মানুষ এখন সব জেনে যাচ্ছে, সব শুনতে পাচ্ছে, বুঝতে পারছে। তবে কেন কেবল এটা বুঝতে পারছে না বা বুঝতে চাইছে না যে সব কিছু করে দিতে পারবে না সরকার। ভোট চাইতে এসে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বলে? কেন মানুষ বুঝতে চাইবে না যে পরিচালকেরও ঘর-দোর-সংসার-উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে এবং তা দোষের নয়! কে ওদের, ওই হতভাগাদের বোঝাবে পরিচালকদের দুঃখ বা কষ্টের কথা। তারা যে বুঝবে না বলে গোঁ ধরেছে। একালের নিয়মে যে ‘গজাল মেরে’ বোঝানোর রীতি বাতিল। তবু, সেনা-পুলিস-আদালত আর অন্ধ ক্যাডার লেলিয়ে ভয় দেখানো যায় বৈকি। তার চেষ্টাও চলছে যদিও কাঙ্খিত ফল মিলছে না।
কী করে মিলবে? শিশু আর খোকাদের এই দেশ বড় ঝামেলার দেশ। কত বলা হচ্ছে রামমন্দির হলে সব বিপদ দূর হবে, স্বয়ং রামচন্দ্র তোমাদের দেখবে। লোকে শোনে না। কারা ঈশ্বর নিয়ে পাকা ও বোকা কথা বলে বেড়াচ্ছে, কারা উগান্ডার প্রেসিডেন্টের ভাষণও ছড়াচ্ছে। ওদের এমনও বলা হল– ভাবীজি পাপড় খাও, সুখে নিদ্রা যাও– তাও শোনে না, বড় খোকারা মজা ওড়ায়। অবিশ্বাস আর অবিশ্বাস এবং প্রশ্ন। প্রশ্ন তোলে কেন আমাদের রুটি-কাপড়া-মোকান দেবে না, কেন পাব না চিকিৎসা, কেন তেলের দাম বাড়াবে রোজ? কেন বৃদ্ধ কবিকেও তোমরা জেলে আটকে রাখবে? শিশু আর ছোট খোকারা বলে আমাদের দিকে তাকাও– কী হবে আমাদের শিক্ষা, পুষ্টি, মানসিক বিকাশের?
এসব অবান্তর প্রশ্ন তাই কোনও উত্তর দেব না, তা যে পরিচালক বলতে
পারছেন না। এ যে নব স্বাভাবিক (New Normal)'এর যুগ। সে একটা যুগ ছিল বটে যখন বলা যেত,
answers must be precise & to the point, কিন্তু সমস্যা তো এখন প্রশ্ন নিয়েই। কেন
অনলাইনে পড়াশোনা ভালো নয়, কেন প্রাইভেট স্কুলের এতো রমরমা, কেন স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থা
থেকে সরে যাচ্ছে শিশুরা, কেন মিড ডে মিলে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ থাকা সত্ত্বেও রান্না
করা খাবার মেলে না? যাদের উত্তর দেবার কথা, তারাই এখন কত প্রশ্ন তোলে। তাও তো বুড়োরা, শিশুরা কেউ বলতে পারে না ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’
বলবে কেমনে– প্রাণের মায়া আছে না! বুট-বন্দুক-বুলেটের ভয় আছে না?
No comments:
Post a Comment