Monday, 27 July 2020

চেনা দুঃখ চেনা সুখ

সোনামুখ করে খেয়ে নাও বাবা
অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী

'কী রান্না হয়েছে আজকে?'
 সকালবেলা উঠে  ঘুমের ঘোর কাটার পরেই মাকে ঠিক এই প্রশ্নটাই করতাম।

যদি মা বলতেন, আজ নিরামিষ, ভাত ডাল আলু ভাজা, আলু পটলের ডালনা... অমনি মেজাজ বিগড়ে যেত। আমি বলতাম, সে কি? মাছ হয়নি? কিংবা ডিম?

মা তখন অবধারিতভাবে বলতেন, এমন করতে নেই বাবা। এইটুকু কত লোক জোগাড় করতে পারছে না। যা পাচ্ছ সেটাই সোনামুখ করে খেয়ে নিতে হয়।

তাতেও আমার মাথা ঠান্ডা হচ্ছে না দেখে মা বলতেন, তুই তোর বন্ধু বাচ্চুকে দেখে শেখ। ওর মা আমাকে বলেছে, দ্যাখেন দিদি, ভগবানের আশীর্বাদে আমার বাচ্চু কত সমঝদার হয়েছে কী বলব। কলমি শাক ভাত, আলু সেদ্ধ ভাত, যা দেব হাসিমুখে খেয়ে নেয়। নইলে আমাদের সংসার চলে কী করে বলুন?

বলাই বাহুল্য, এসব কথা শুনতে আরও বিরক্ত লাগত। তবে আজ এটুকু বলতে পারি, সেদিন না খেয়ে উঠে যাইনি কোনওদিন। পরে মুসুর ডাল আর আলু ভাজা হলে খুশি মনেই খেয়ে নিতাম। মায়ের শাসনে ধীরে ধীরে এই অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।

একেবারে অভাবগ্রস্ত পরিবারের সন্তান ছিলাম না। বাবা একটি নামী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। তখনকার বিচারে মধ্যবিত্তই বলতে হবে। কিন্তু খাদ্যের সংকট প্রত্যক্ষ করেছি। না, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ দেখিনি। দেখার কথাও নয়। বাবার মুখে বর্ণনা শুনেছি, কলকাতার রাস্তায় 'ফ্যান দাও ফ্যান দাও' চিৎকার। রাস্তাঘাটে যত্রতত্র কঙ্কালসার নারী-পুরুষ পড়ে আছে। জেনেছি সুনীল জানার ফটোগ্রাফ, সোমনাথ লাহিড়ীর কলিযুগের গল্প, জয়নুল আবেদিনের আঁকা, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের নবজীবনের গান অথবা সত্যজিৎ রায়ের অশনি সংকেত  থেকে। সেদিন অবিভক্ত বঙ্গে কমপক্ষে ৬০ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল। আমি বলছি গত শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকের কথা।

আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, সকাল থেকে 'দুটো ভাত দেবে গো' বলে ভিখারী দলের পাড়া পরিক্রমা। অধিকাংশ বাড়িতে তখন রেফ্রিজারেটর ছিল না। সকলের বাড়িতেই কিছু না কিছু খাবার বাঁচত। ভিখারীর দল সেটা নিয়েই চলে যেত, নগদ পয়সা আশা করত না। খোলাবাজারে চাল পাওয়া যেত না। কেনার সামর্থ্য থাকলেও বাবা প্রায়শই চাল জোগাড় করতে পারতেন না। তাই আমাকে রেশনের লাইনে দাঁড়াতে হত। সেই চালে যখন ভাত রান্না হত তার দুর্গন্ধে টেকা যেত না। আমার এক আত্মীয় লুকিয়ে আমাদের জন্য চাল আনতে গিয়ে বিস্তর পুলিশি হয়রানির মুখে পড়েছিলেন। বহুবার দেখেছি মহিলা চাল বিক্রেতাদের চুলের মুঠি ধরে পুলিশ টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। দেখেছি খোলা লরিতে চালের বস্তা। ধীরগতি লরির পিছন পিছন দৌড়চ্ছে  বস্তির ছেলেগুলো। ছুরি দিয়ে ফুটো করে দিচ্ছে বস্তা। সেই ফুটো বস্তা দিয়ে ঝুরঝুর করে চাল পড়ছে। সেই চাল বাটিতে ধরছে ওই সব ছেলেরা। শৈশবে এ দৃশ্য দেখে বেশ মজাও পেতাম। আবার যখন দেখেছি বিয়ে বাড়ির পিছনে আবর্জনার মধ্যে ফেলে দেওয়া খাবার নেবার জন্য কুকুর আর মানুষের মধ্যে কামড়াকামড়ি, তখন মনের মধ্যে কিছু রেখাপাত করেছে বৈকি।

আমাদের বাড়ির পিছনে চিৎপুর রেলওয়ে ইয়ার্ড। ওয়াগন ব্রেকারদের তখন পোয়াবারো। প্রায়ই ওয়াগন ভেঙে এটা ওটা চোরাই মাল খেলার মাঠের এক কোণে ফেলে জলের দরে বিক্রি করত। কখনও জুতো, কখনও থালা-বাটি, কখনো চাল। একবার খবর এল সস্তায় চাল পাওয়া যাচ্ছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে বাড়িতে এসে মায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা আর থলি নিয়ে গিয়ে কিলো পাঁচেক চাল কিনে আনলাম সেখান থেকে। বাড়িতে সারাক্ষণই শুনতে হত চাল নেই চাল নেই। তাই এ হেন সস্তার চাল আনতে পেরে বেশ একটা গর্ব হচ্ছিল। কিন্তু ব্যাপার হল উল্টো। সেদিন রাত্রে বাবা বাড়িতে ফিরে ঘটনাটা শুনে রেগে আগুন হয়ে গেলেন। মাকে বলতে লাগলেন, আর কি। তোমার ছেলে তালেবর হয়ে গেছে। ওয়াগন ব্রেকারদের খাতায় নাম লিখিয়েছে। আর চিন্তা কী? পড়াশোনার পিছনে খরচা করে কী হবে? শুধু আমার কবে হাতকড়া পড়বে তাই ভাবি। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙার আগেই বাবা সেই চাল সরিয়ে দিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। কাউকে দিয়ে দিয়েছিলেন সম্ভবত।

যে সহৃদয় পাঠক এতক্ষণ ধরে এই লেখা পড়ছেন, তিনি  হয়তো ভাবছেন, হঠাৎ এ হেন স্মৃতিচারণের হেতু কী? কেনই বা খাদ্য সংকটের প্রসঙ্গ?

দিনগুলোর কথা মনে পড়ল এই সেদিন কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে। গত সপ্তাহে জরুরি প্রয়োজনে গিয়েছিলাম ওইদিকে। করোনার কবলে থাকা কলেজ স্ট্রিট এবং গোলদিঘিকে চেনা যাচ্ছে না। কে যেন তার সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে। বইয়ের দোকান খোলা আছে কিন্তু ক্রেতা নেই। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা নেই। প্যারামাউন্ট শরবতের দোকান বন্ধ। দিলখুসা কেবিনে টেবিলের ওপর চেয়ার উল্টানো। দরজা বন্ধ কফি হাউসের। কলেজ স্কোয়ারে শান বাঁধানো আচ্ছাদনের নিচে উদাস বৃদ্ধ, ভবঘুরে, প্রেমিক-প্রেমিকা এবং পুলিশের ইনফরমারদের কাউকেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। বিদ্যাসাগর মূর্তির সামনে কেউ বিশ্ব বিপ্লবের আহ্বান জানাচ্ছে না। বরং তার জায়গায় এক আশ্চর্য দৃশ্য! ইউনিভার্সিটির মূল প্রবেশপথের সামনে প্রেসিডেন্সি কলেজের কিছু ছাত্রছাত্রী ভাত ডাল সবজি বিতরণ করছে। সারিবদ্ধ ভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে গ্রহণ করছেন অসংখ্য পুরুষ এবং মহিলা। লাইন এঁকেবেঁকে কলুটোলার  দিকে চলে গেছে, শেষ দেখতে পেলাম না।

এ দৃশ্য দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল আমার। কলেজ স্ট্রিটের এই পিচঢালা রাস্তায় অনেক মিছিলে পথ হেঁটেছি। মানুষের সার্বিক মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু আজ ঘুরেফিরে সেই খাদ্যের সারিতে দীর্ঘ প্রতীক্ষা দেখতে হল? একেবারে দ্বিপ্রহরে, মধ্য কলকাতার রাজপথে?

ইতিমধ্যে অর্ধাহার অনাহারের খবর কানে আসছে। করোনার আতঙ্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সামনের মাসগুলোতে কোনওমতে খেয়ে পরে কিভাবে বেঁচে থাকব সেই দুর্ভাবনা। কোনও সুরাহার পথ না পেয়ে, সাহায্য তো দূরের কথা, কারওর কাছ থেকে এতটুকুও আশার আলো না পেয়ে অনেকে আত্মহত্যা করছেন। শুনতে ভাল লাগবে না, কিন্তু এই কলকাতা শহরে এমন ঘটনা অনেক ঘটছে। এই 'একক মাত্রা'র ব্লগেই অমৃতা ঘোষাল লিখেছেন এমন মর্মান্তিক পরিণতির কথা।

এ এক সমস্যা। দুনিয়া জোড়া সমস্যা। বিশ্বের রাষ্ট্রনায়করা কী করতে পারেন? দেশের সরকার কী করতে পারে? রাজনৈতিক দলগুলো কী করতে পারে? কী নীতি গ্রহণ করা উচিত? এসব প্রসঙ্গ তো অনেক বড় বড় ব্যাপার! আমি আপনি কি কিছু করতে পারি? আমরা কি খোঁজ নিতে পারি আমাদের  একান্ত চেনা পরিচিত মানুষজনের মধ্যে কেউ কি আছেন যিনি অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন? অথবা ভবিষ্যতের দুর্ভাবনায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন? সে ক্ষেত্রে আমি আপনি কি কোনওভাবে তার পাশে দাঁড়াতে পারি? আর্থিকভাবে হোক, মনে ভরসা যুগিয়ে হোক। কেউ হয়তো বলতে পারেন, অনেকেই তো দুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে আসছেন। অনেকে খাদ্য বিতরণ করছেন। সবজি বিতরণ করছেন। ঠিকই তো। অনেকেই করছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, আপনি কী করছেন? আমি কী করছি? আমরা কি সংসার খরচ থেকে কিছু বাঁচাতে পারি? সামান্য কিছু বাঁচিয়ে আরেকজনের পাশে একটু হলেও দাড়াতে পারি?

আমরা কি আমাদের সন্তানদের বলতে পারি, সোনামুখ করে খেয়ে নাও বাবা। এটাই কত লোক জোটাতে পারছে না।

6 comments:

  1. বাস্তব অভিজ্ঞতা। নগরজীবনের চেনা ছবি হঠাৎ কিরকম মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাকে টেনে তোলার তেমন প্রয়াস কই ?

    ReplyDelete
  2. বাস্তব অভিজ্ঞতা। নগরজীবনের চেনা ছবি হঠাৎ কিরকম মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাকে টেনে তোলার তেমন প্রয়াস কই ?
    অর্ণব রায়

    ReplyDelete
  3. খুব ভাল লাগল

    ReplyDelete
  4. আমি সুন্দরবন অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে ওঠা মানুষ। বাবা শিক্ষক ছিলেন বলে পরিবারে খাদ্যাভাব দেখিনি, কিন্তু দেখেছি ভিখিরিদের সারি, খাবারের জন্য মানুষ ও কুকুরের লড়াই। আপনার লেখা পড়ে সেই দিনগুলো মনের আয়নায় ভেসে উঠল।

    ReplyDelete
  5. একদম হৃৃদয়ের নিবেদন হয়েছে!

    ReplyDelete
  6. ভাল লাগল। তবে যতদিন না আমরা নিজেরা সংযত হব ততদিন কি আমরা আমাদের সন্তানদের সংযমের কথা শেখাতে পারব?

    ReplyDelete