বিহার মে কা বা?
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
‘অব উঠা হ্যায় লহর’- কিন্তু কীসের লহর? কার লহর? এই প্রশ্নটাই আপাতত ব্যতিব্যস্ত রেখেছে সারা দেশের কৌতূহলী মনকে। যে মন তাকিয়ে আছে ১০ নভেম্বরের দিকে- যেদিন বিহার বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরবে।
বলাই বাহুল্য, এক জলবিভাজিকার মাঝে দাঁড়িয়ে আপামর মানুষ গভীরভাবে বুঝতে চাইছেন কী হতে চলেছে বিহারের ভোটে! এই মাসখানেক আগেও অধিকাংশ জনই ধরে নিয়েছিলেন, ছত্রভঙ্গ বিরোধীকুল যাদের প্রধান নেতা জেলবন্দী, করোনা পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে এক প্রকার জোরজবরদস্তি নির্বাচন করিয়ে আয়েসে ভোটে জিতে আসাটা মোদি-নীতিশ জোটের পক্ষে ‘বাঁয়ে হাতকা খেল’। সেই মতো প্রস্তুতি সেরে ও ঘোষণা দিয়ে যখন মাঠে নামার উপক্রম হল, তখনও এ বিষয়ে কারও মনে এতটুকু সন্দেহ ছিল না যে এই ভোটে এনডিএ জোটের জয় একপ্রকার নিশ্চিত।
কিন্তু সে চেনা ছবিতে কিছুটা যেন চোনা পড়ল দুটি দৃশ্যত মামুলি ঘটনায়: এক, চিরাগ পাসওয়ানের নেতৃত্বাধীন এলজেপি দলের বিহারের এনডিএ ত্যাগ ও নীতিশকুমারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও দুই, এনডিএ’র অনেক আগেই মহাগঠবন্ধনের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা। বড় বড় পণ্ডিত ও কর্পোরেট মিডিয়ার ‘দৃষ্টি এড়িয়ে’ গেলেও আসলে এই দুটি ঘটনা ছিল এক আগত ভবিষ্যতের শঙ্খধ্বনির মতো। কারণ, আচম্বিতে ঘটে যাওয়া এই দুটি ঘটনা কোনও কাকতালীয় ব্যাপার ছিল না। বরং, বিহারের বুকে ইতিমধ্যেই যে পরিবর্তনের অন্তঃসলিলা স্রোত বহমান হয়েছে, তারই এক প্রতিফলন ছিল মাত্র। অর্থাৎ, নীতিশকুমার সরকারের বিরুদ্ধে যে জনরোষ নির্মিত হয়ে আছে ও তা বিজেপি’র হিন্দুত্ব এজেন্ডা দিয়ে ঠেকানোর কোনও উপায়ই যে আর নেই- এই দুই বার্তাই যেন উক্ত ঘটনাদ্বয়ের মধ্য দিয়ে প্রাথমিক ভাবে দেওয়ার ছিল। তারপর গঙ্গা দিয়ে যত জল গড়িয়েছে, বিহারের মানুষ ততই পরিণতমনস্কতা ও রাজনৈতিক সচেতনতার পরিচয় রেখেছেন। সেইগুলিকে বরং একে একে সাজিয়ে ফেলা যাক।
১) এই প্রথম ও অতি দ্রুত আরজেডি ও বামপন্থীদের মধ্যে এমন এক সুষ্ঠু নির্বাচনী সমঝোতা হল যা আগামী দিনে হিন্দি বলয়ে এক নতুন রাজনৈতিক মাত্রার উন্মেষ ঘটাতে চলেছে। আর এই সমঝোতাই বিহারের নির্বাচনের চেহারাটাকেও আমূল বদলে দিয়েছে যেখানে প্রথম চোটেই প্রকারান্তরে মুখ থুবড়ে পড়েছে এনডিএ। কেন বলছি এ কথা? কারণ, এই সমঝোতার ফলে নির্বাচনের প্রধান ইস্যু বা মুদ্দাই আমূল বদলে গেছে। গত পাঁচ-ছ বছরে যে কোনও জায়গায় নির্বাচনে কী ইস্যু হবে তার স্টিয়ারিংটা থাকত আরএসএস-বিজেপি’র থিঙ্ক-ট্যাঙ্কের হাতে; যেখানে ৩৭০, রামমন্দির, দেশদ্রোহিতা, হিন্দু-মুসলমান, পাকিস্তান, হিন্দুত্ব এগুলোই হত চর্চার বিষয় এবং বিজেপি খুব কৌশলে বিরোধী ও সমূহ জনমতকে সেদিক পানেই টেনে আনত। কিন্তু এবারে লক্ষণীয়, অতি তৎপরতার সঙ্গে বিজেপি’র এই কৌশলটিকে মহাগঠবন্ধন প্রথম রাতেই ভোঁতা করে দিয়েছে। মণ্ডল কমিশন ও জাতপাতের রাজনীতির ওপর ভিত্তি করে যে আরজেডি’র উত্থান, জনপ্রিয়তা ও ১৫ বছরের শাসন, তাকে তারা শিকেয় তুলে রেখে বেরোজগারি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সড়ক, বিজলি, পানি’র মতো ইস্যুগুলিকে নিয়ে প্রচারে নামতে পেরেছে। এর প্রথম কারণ হল, বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বামপন্থীদের, বিশেষত সিপিআই(এম-এল)-লিবারেশন দলের গরিব ও শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ব্যাপক উপস্থিতি ও দীর্ঘ সংগ্রাম এবং আরজেডি দলের এক সময়ে সোশালিস্ট রাজনীতির ঐতিহ্য (জয়প্রকাশ নারায়ণ, রামমনোহর লোহিয়া প্রমুখ)- এই দুই মাত্রা একযোগে এসে মিলতে পারার ফলে ঐক্যের এক সবল ভিত্তিকে খুঁজে পেয়েছে। বামপন্থী শক্তি ও আরজেডি’র এই রাজনৈতিক সংযোগে বিলুপ্ত-প্রায় কংগ্রেসের তাল মেলানো ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। কারণ, বিজেপি’র বাড়বাড়ন্ত মানে জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের আরও ক্ষয়, তাই যে কোনও প্রকারে বিজেপিকে পর্যুদস্ত করতে পারলে কংগ্রেস নিজেকে খানিক তাজা মনে করতে পারে। দ্বিতীয় কারণ, গত লোকসভা ভোটে বামপন্থী ও আরজেডি’র মধ্যে যে চারটি আসনে সমঝোতা হয়েছিল সেখানে তাদের জোট প্রার্থীরা প্রতি আসনে ৪ লক্ষের ওপর ভোট পেয়েছিল। অর্থাৎ, এই দুই শক্তির মিলিত মূল জনভিত্তি হল গরিব ও শ্রমজীবী জনতা যাদের ভোট আলাদা হয়ে অপর পক্ষকে বরাবর সুবিধা করে দিয়েছে। এই ভোট বিভাজন যেন এবারে না হয় সে চিন্তা দু পক্ষেরই ছিল। আর তাই শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার দাবি-দাওয়াকে আঁকড়ে ধরাটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল। তৃতীয় ও সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল, বিহারের মেহনতি জনগণের ব্যাপক অংশ লকডাউন, বেরোজগারি, বন্যা ও নানা কারণে এতই দুঃসহ অবস্থা ও বিপন্নতার মধ্যে ছিল যে তাদের অনুভবকে পড়ে ফেলতে এই দুই শক্তি বেশি দেরি করেনি।
২) হতে পারে, আরজেডি তেজস্বীর মতো এক তরুণ নেতৃত্বে নতুন ভাবে সমাজকে দেখতে চাইছে ও আগামী ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করছে। যে কারণে, এবারে তাদের প্রচারের ব্যানারে, হোর্ডিং’এ, পোস্টারে যেমন পুরনো জমানার লালুপ্রসাদের ছবি নেই, তেমনই রাজনৈতিক বার্তাতেও জাতপাত ও পিছড়ে বর্গের উল্লেখ নেই। বরং, বামপন্থী ও সোশ্যালিস্টদের রোটি-কাপড়া অউর মকান’এর দাবিকেই তারা আপাতত সম্যক বলে উপলব্ধি করেছে।
৩) তাই, জীবন-জীবিকার মুদ্দা ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে এই নির্বাচনে বামপন্থী-আরজেডি’র সজোরে উত্থান ও ব্যাপক প্রচারাভিযানে থতমত খেয়ে যাওয়া এনডিএ, যোগী আদিত্যনাথ ও মোদিকে দিয়ে চেষ্টা করেছিল তাদের চিরাচরিত হিন্দুত্বের এজেন্ডাকে তুলে ধরে প্রচারের বিষয়কে পাল্টাতে। কিন্তু ভবি অত সহজে ভোলেনি। মহাগঠবন্ধনও সে ফাঁদে পা দেয়নি। উপায়ন্তর না পেয়ে ১৯ লক্ষ কাজের প্রতিশ্রুতি, বিনামূল্যে করোনা ভ্যাকসিন ও আইটি-হাব গড়ে ৫ লক্ষ কর্মসংস্থান- এইসব জীবন-জীবিকার প্রচারে তারাও নামতে বাধ্য হল। সুস্পষ্ট দেখা গেল, নির্বাচনী মুদ্দার স্টিয়ারিং’টা বিজেপি’র হাতে আর নেই।
৪) আর এই আবহেই চিরাগের এলজেপি পার্টির আলাদা ভাবে জেডিইউ’র বিরুদ্ধে (কিছু ক্ষেত্রে বিজেপি’র বিরুদ্ধেও) প্রার্থী দেওয়া বহু আসনে এনডিএ’র পক্ষে এক আতান্তরের অবস্থা তৈরি করেছে। এটা পরিষ্কার যে, এলজেপি ভোট কাটাকাটি করে অনেক জায়গায় জেডিইউ’কে হারিয়ে দেবে। কেউ কেউ বলছেন, এটা বিজেপি’রই গেমপ্ল্যান, যেখানে তারা ভেবেছিল এইভাবে জেডিইউ’কে তারা দুর্বল করে নিজেরা প্রধান শক্তি হিসেবে বিহারে আত্মপ্রকাশ করবে! কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে গুড়ে বালি। কারণ, গেমপ্ল্যানটা যখন তারা কষেছিল তখন ধরে নিয়েছিল যে নির্বাচনের হালটা তাদের হাতে ধরা আছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণত বদলে গেছে, যে কারণে, ব্যুমেরাং হওয়াটা আর সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
৫) সরেজমিনে মাটিতে নেমে যখন দেখা গেল মানুষ বেজায় ক্ষিপ্ত, তখন নীতিশকুমারকে শিখণ্ডী খাড়া করা ছাড়া বিজেপি’র আর উপায়ই বা কী! যদিও তাদের নেতৃত্ব বারবার বলে চলেছে, যে কোনও অবস্থাতেই তাদের জোটের মুখ্যমন্ত্রী পদপর্থী নীতিশকুমারই থাকবেন, কিন্তু প্রথম পর্বের ভোটের প্রচারপর্ব শেষ হওয়ার মুখে দেখা গেল বিজেপির তরফে নির্বাচনী ক্ষেত্রগুলিতে শুধুমাত্র মোদির ছবি দিয়ে বিজেপি নতুন করে হোর্ডিং ও ব্যানার টাঙাতে শুরু করেছে। তাহলে কি নিজেদের পরাজয় নিশ্চিত বুঝে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখা, যদি শিখণ্ডী নীতিশকুমারকে প্রচারের আলো থেকে সরিয়ে রেখে মানুষের মনে কিছু বিভ্রান্তি তৈরি করা যায়!
৬) করোনার ভয়ে স্টুডিওতে বসে ও শহরের অল্প কিছু লোকের তথ্য নিয়ে বড় বড় টিভিওয়ালারা যখন নির্বাচনী সমীক্ষা করে সাব্যস্ত করছে যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকলেও এনডিএ’র জয় একপ্রকার নিশ্চিত, তখন বিহার নির্বাচনের আসল খবরগুলি পাওয়া যাচ্ছে নব-উত্থিত ‘সিটিজেন্স জার্নালিজম’এর (সচ মিডিয়া, অনলাইন জানকারি, সুধীর গুপ্তা, দ্য লাইভ টিভি ইত্যাদি) হরেক ভিডিও, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ থেকে। তাদেরই সংগৃহীত ছবি থেকে জানা যাচ্ছে, তেজস্বীর সভায় জনতার ঢল, উচ্ছ্বাস ও উন্মাদনা, যুবদের তীব্র সরকার-বিরোধী বক্তব্য এবং সর্বোপরি, জনতার বিপুল অংশ, বিশেষত শ্রমজীবী মানুষ যে বিকাশ নিয়েই ভাবতে চাইছে ও বেরোজগারি থেকে ছুটকারা চাইছে, তার ইতিবৃত্ত। আর তেমন আশ্চর্যের না হলেও দেখা যাচ্ছে, এইসব ‘সিটিজেন্স জার্নালিজম’এর ভিডিও ও খবরগুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পর কর্পোরেট বা মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার (বিহারে বলে ‘গদি মিডিয়া’) দ্বারাও প্রচারিত হচ্ছে। ফলে, টিভিওয়ালা ও বড় দৈনিকের বিভ্রান্তি আরও বাড়ছে এবং বিহারের নির্বাচন যে একতরফা হচ্ছে না তা এখন চাপে পড়ে প্রতিদিনই তারাও বলতে শুরু করেছে এবং তাদের নিত্য নতুন নির্বাচনী সমীক্ষায় ক্রমশ এনডিএ’র পাল্লা হাল্কা হয়ে আসছে। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, এই আবহে এক সময়ের মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার জনপ্রিয় ‘অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতা’র কদর একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে।
২০১৪ সালে দিল্লির তখতে মোদি সরকার সওয়ার হওয়ার পরে ভারতীয় রাজনীতির গতিবিধি ও বিষয়বস্তুতে যে পরিবর্তনগুলি এসেছিল তা বিহার নির্বাচনে এসে নতুন মোড় নিয়েছে। দিল্লির বিধানসভা ভোটেও সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নকে উসকে দিয়ে চেষ্টা হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন করিয়ে ভোটে জেতার। কিন্তু বিহার বিধানসভা ভোটে তেমন কোনও অবকাশই মেলেনি। সাধারণ মানুষ এতটাই প্রস্তুত ছিলেন যে জীবন-জীবিকার মুদ্দা ছাড়া তাঁরা অন্য কোনও বিষয়ে আলোচনা শুনতেই রাজী নন। উপরন্তু, বিহার সরকারের মন্ত্রীরা (মুখ্যমন্ত্রী সহ) প্রচারে গিয়ে ‘মুর্দাবাদ’ ধ্বনি শুনছেন, মানুষের গালাগালি খাচ্ছেন ও তাঁদের সভাতে তেমন ভিড়ও জমছে না। গত কয়েক দশকে এই প্রথম বিহারে নির্বাচন হচ্ছে যেখানে সাম্প্রদায়িকতা ও জাতপাতের মুদ্দা কোনওভাবেই তেমন দাগ কাটতে পারছে না। এ এক অভিনব পরিস্থিতি। এক নতুন দিশার ঝলক।
ভুলে গেলে চলবে না, এ দেশে ফিরে গান্ধীর বাস্তব রাজনৈতিক উন্মেষ হয়েছিল বিহারের চম্পারণ থেকে। ৪২’এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে বিহারের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। বহু পরিবর্তন ও নতুন দিশার আবাহনে বিহার সব সময়েই সমুজ্জ্বল। ১৯৭৪ সালে জয়প্রকাশ নারায়ণের ‘নবনির্মাণ আন্দোলন’এ বিহারের ছাত্র-যুবদের অত্যুজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। আজ আবার যুবশক্তি সোচ্চার হয়েছে। দেশের তমসাবৃত রাজনীতির আবহে এ নিঃসন্দেহে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। আমরা তাকিয়ে রইলাম ১০ নভেম্বরের দিকে। ‘ঠেঠ বিহারি’দের হাতে প্রজ্জ্বলিত মশালের দিকে।