Friday, 20 December 2024

অধ্যাপক বাগচীকে যেমন দেখেছি

একজন দার্শনিক ও আদর্শ শিক্ষক

বিনয় কৃষ্ণ পাল


(১৯৩৬ - ২৮ নভেম্বর ২০২৪)

আমৃত্যু মানবতাবাদী ও বামপন্থী অর্থনীতিবিদ শুধু নয়, একজন দার্শনিক, আদর্শ  শিক্ষক এবং মানুষ হিসেবে আমাদের কাছে ধরা দিয়েছিলেন অধ্যাপক অমিয় কুমার বাগচী। এমফিল পড়ার সময়েই দেখেছি, এত বড় মাপের একজন মানুষ মাটির কাছাকাছি থেকে ছাত্রছাত্রীদের বোধগম্য করে শেখাতেন, তাদের সঙ্গে সতত যোগাযোগ, আত্মীয়সূচক ব্যবহার ও পরিচর্যার মাধ্যমে তাদের বড় হয়ে উঠতে সাহায্য করতেন। দেখা হলে প্রথমেই, 'কেমন আছো বিনয়?', কেমব্রিজ ছেড়ে আসা এক অধ্যাপকের সাথে এক সাধারণ ছাত্রের সমস্ত মানসিক দূরত্বের অবসান ঘটিয়ে দিত। 

একমুখি বই-নির্ভর পড়ানোর বদলে দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্য, সিনেমা, ঘটনা, গল্পের মাধ্যমে আমাদের শেখার পরিধি বহুধা বিস্তৃত করেছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে IDSK'এর পড়া শেষ হলেও, ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মী ও স্যারের সাথে যোগাযোগ রাখি। ২০১৫ সালে ওনার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর জানতে পারি তিনি কিছুটা একাকিত্বের মধ্যে রয়েছেন। সেই সূত্রে মাঝে মধ্যেই তিনি আমায় বাড়িতে ডাকতেন। স্যারের বাড়ির এক সহায়ক একদিন রাত্রে আমায় খাবার পরিবেশন করতে গিয়ে খাবার পাতে এক খণ্ড ইলিশ মাছ তুলে দেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেই ইলিশ উদরস্থ করি। খেতে খেতেই এক দিকে কথা বলছি, অন্যদিকে চোখ প্লেটে পড়ে থাকা আরও দুই খণ্ড ইলিশের দিকে। স্যার বুঝতে পেরেই  বলেন, 'ওই দুটিও তোমারই জন্য!' শুনে আমার চোখে আনন্দ ফুটে ওঠে এবং উনি হাসতে হাসতে বলেন, 'বাঙালিকে মাছ এবং মূলত ইলিশ দেখে চেনা যায়!' খাওয়ানোর তৃপ্তি ও রসিকতা আমায় আপ্লুত করে, যা আজও স্মৃতিতে বয়ে নিয়ে চলেছি। একান্ত সেই আড্ডাগুলিতে আরও পরিশীলিত হয়েছে আমার অর্থনীতি, ইতিহাস ও রাজনীতির জ্ঞান। বারবার বলতেন শুম্পেটার, মার্কস, স্মিথ, অমর্ত্য সেন, রবীন্দ্রনাথকে পড়তে, বুঝতে, লিখতে, 'পড়তে ও লিখতে লিখতেই হাতে লেখা আসে।' উৎসাহ দিতেন-- যা পড়ছি, সঠিক বলে ভাবছি, তা মুক্তকণ্ঠে-নির্ভয়ে বলতে। 

ওনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, পূর্ব ভারতে সেন্টারের (কলকাতার 'সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস') মতো ঐতিহ্যশালী সমাজ বিজ্ঞান চর্চার একটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও IDSK তৈরি করার পিছনে আপনাদের কী চিন্তা-ভাবনা ছিল? উত্তরে বলেছিলেন, 'আমাদের সাধারণ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সহ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির সমাজ বিজ্ঞানের যে চর্চা হয় তা অনেক ক্ষেত্রেই তাত্ত্বিক এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ খুবই কম। তথ্য সংগ্রহে নানা কারচুপি, ছল-চাতুরি থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত বাস্তব উঠে আসে না! IDSK তৈরি এবং ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কোর্সের মাধ্যমে আমরা একদিকে একটি উন্নততর সমাজ গঠনে জ্ঞান চর্চা, তাত্ত্বিক সমাজ বিজ্ঞান চর্চা এবং বর্তমান সমাজের নানা জনগোষ্ঠী, প্রান্তিক মানুষজন, পরিবেশ এবং সর্বোপরি মাটির সঙ্গে মেলবন্ধন তৈরি করতে চেয়েছিলাম। তোমরা যদি ক্রমাগত ফিল্ড ওয়ার্ক করে, যাচাইযোগ্য তথ্য ও ঘটনার মাধ্যমে একদিকে আর্থিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ ও বর্তমান সময়ের সমস্যা তুলে ধরতে পারো এবং তাদের সমস্যায় পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারো, তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে।' গরিব কৃষকদের থেকে বহুফসলি জমি কেড়ে শিল্পায়নের বিরোধী ছিলেন অধ্যাপক বাগচী। মূলত অর্থনীতির অধ্যাপক হলেও জ্ঞানের বিস্তৃত পরিসরে অবাধ যাতায়াত ছিল তাঁর। 

সদ্য কিছুদিন কলেজে পড়ানোর সুবাদে ওনাকে জানিয়েছিলাম, 'আমার কলেজগুলির অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী খুব প্রান্তিক স্তর থেকে আসা, ওদের শেখানোর ক্ষেত্রে আমার তরফ থেকে অনেক সমস্যা বোধ করছি, মনে হচ্ছে ওদের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছতে পারছি না।' নানা অভিজ্ঞতা ভাগ করার সুবাদে তিনি আমায় কিছু পরামর্শ দেন ও IDSK লাইব্রেরি থেকে আমার হাতে একটি অসামান্য বই  তুলে দেন: The Pedagogy of The Oppressed। উন্নয়নশীল ও বিপুল বৈষম্যের দেশে শিক্ষক-শিক্ষণ, প্রান্তিক ছাত্রছাত্রীদের শেখানোর পদ্ধতি নিয়ে ব্রাজিলিয় লেখকের কালজয়ী সৃষ্টি এই গ্রন্থ আজও আমার অবশ্যপাঠ্য। 

আমাদের অগ্রজদের থেকে শোনা, বাগচী স্যারের (একদিনের) এক নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ ছিল তাঁদের জন্য। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজের তাগিদে হঠাৎ/ বিলম্বে তাঁর অফিসে হাজির। অফিস থেকে স্যারের কাছে বার্তা পাঠালে তিনি জানান, 'ওরা অপেক্ষা করুক। আমার কাছে ছাত্রছাত্রীদের সময় আগে। এখন হঠাৎ ওদের জন্য ছাত্রছাত্রীরা তার মাশুল দিতে পারে না।' ছাত্রছাত্রীদের ও তাদের সময়ের প্রতি দায়বদ্ধতার এরকম নজির সত্যি বলতে আমার জীবনে খুব কমই দেখেছি। উদারমনস্ক, মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী বাগচী কঠোর নিয়মশৃঙ্খলার ঘেরাটোপে জীবন তৈরিতে নিরাসক্ত ছিলেন। তাই একদিকে যেমন বেলুড় মঠের পড়া ছাড়তে বাধ্য হন, তেমনই আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান IDSK'কে এক মুক্তাঙ্গন হিসেবে আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন। অধ্যাপক বাগচী ছাড়াও আমরা পেয়েছিলাম গবেষণা শেখার কিছু ব্যতিক্রমী শিক্ষক-গবেষক ও পরিমণ্ডল। 

বয়সে বৃদ্ধ হলেও মনের দিক থেকে তিনি ছিলেন চির কিশোর, তাই হয়তো আমাদের মতো শিক্ষানবিশদের থেকে বিভিন্ন বিষয়ে, বিশেষত ক্ষেত্র সমীক্ষা ও তা থেকে পাওয়া ফলাফলের ব্যাপারে মনোযোগ সহকারে শুনতেন, আমাদের মতামতের ওপর শিশুসুলভ তর্ক করতেন এবং তাতে সত্যিই অহংবোধ বা দমিয়ে দেওয়ার লেশমাত্র থাকত না। হরিয়ানা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যুক্ত হওয়ার সুবাদে দিল্লি ও গুরুগ্রাম কেন্দ্রিক বিভিন্ন বিশিষ্ট মানুষ ও তাঁর ছাত্রদের যোগাযোগ দিয়েছিলেন আমায়। 

নিয়মমতো ২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় আমার অন্যতম শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক প্রশান্ত রায়ের কুশল নেওয়ার সময় অমিয় স্যারের অসুস্থতার কথা বললাম। উনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, 'খুবই অসুস্থ! সামনে গিয়ে দেখা করলেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে, তাই যেতে পারছি না!' ফোন রাখার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওনার আবার বার্তা, অধ্যাপক অমিয় বাগচী নেই! আমার নতুন কাজে যোগ দেওয়া ও সেখানকার অভিজ্ঞতার বিষয়ে শুনতে আমায় কোনও এক ছুটির সকালে দেখা করতে বলেছিলেন। নভেম্বরের সন্ধ্যার মলিনতা আমার জীবনের একটি সকাল গ্রাস করল! দেশ-সমাজ জীবনের চরম অনিশ্চয়তার অন্ধকারে আলোর দূত হয়ে আসা আমাদের প্রিয় শিক্ষক চলে গেলেন, আমরা অভিভাবকহীন হলাম! সামনে থাকল এক শোষণহীন সমাজ গঠনে তাঁর সুবিশাল কর্মজীবনে আমাদের জন্য রেখে যাওয়া আলোকবর্তিকা। 

অধ্যাপক বাগচীর মৃত্যুতে, শিক্ষাক্ষেত্রে ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে ওনার বহুধা বিস্তৃত কাজের কিছু অংশ আন্তর্জাল ও সংবাদমাধ্যমের পাতায় উঠে এসেছে। বিস্তারিত নিচের এই লিঙ্কে পাওয়া যাবে- 

https://shorturl.at/JB2jy


Wednesday, 18 December 2024

অমৃতলোকে সংশপ্তক সাধক

স্বয়ং প্রজাপতির তুল্য

অমৃতা ঘোষাল


(৯ মার্চ ১৯৫১ - ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪)

'তুই হাততালি দিলে জ়াকির হোসেন

তবলা বাজানো ছেড়ে পায়রা পোষেন...'

(কবীর সুমন)

গায়কের এই অহেতুক স্বপ্ন গেল অস্তাচলে! অজস্ৰ শিল্পবেত্তার হৃৎস্পন্দনকে তীব্রভাবে আন্দোলিত করা সেই তবলার বোল আর বাজবে না। 'ওয়াহ তাজ' বলে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার ভঙ্গিটিও আর তিনি বিনির্মিত করবেন না! তবলা বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কোঁকড়া কেশগুচ্ছের হিল্লোল পুরুষ-সৌন্দর্যের গতানুগতিক মাপকাঠিতে এক অন্য মাত্রা যোগ করেছিল। 

ওস্তাদ আল্লাহ রাখা'র (২৯ এপ্রিল, ১৯১৯ - ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০০০) সুপুত্র জ়াকির ধ্রুপদী শিল্প-সংস্কৃতির পরিসরে বেড়ে উঠেছিলেন। তবলাকে চিনেছিলেন সরস্বতীর রূপান্তর হিসেবেই। দৈনন্দিন জীবনচর্যার স্রোতের সঙ্গে গেঁথে নিয়েছিলেন তবলা-সাধনার অনুষঙ্গ। পিতা আল্লাহ রাখা'র শিক্ষা আর সহজাত অনুশীলন-ক্ষমতার প্রভাবে দক্ষ থেকে দক্ষতর হয়ে উঠেছিলেন। মাত্র সাত বছর বয়সেই পরিণত শিল্পীর মতো তবলা বাজাতে পারতেন; আর মাত্র বারো বছর বয়সেই জীবনের প্রথম কনসার্টটি যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গে করেন। বাবার সহযোগে এই উপস্থাপনাটি করে তিনি অর্জন করেন পাঁচ টাকা। মুম্বাইয়ে বেড়ে ওঠা জ়াকিরের স্কুল-জীবন কাটে সেন্ট মাইকেলস হাই স্কুলে। এরপর মুম্বাইয়েরই সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে অর্জন করেন স্নাতক ডিগ্রি। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে সঙ্গীতের ওপর ডক্টরেট উপাধিও পেয়েছিলেন। 

পিতা আল্লা রাখা তাঁকে শিখিয়েছিলেন ভোরের সৌকুমার্য কীভাবে তবলার তানকে প্রভাবিত করে। তাই খুব ভোরেই তবলার সাধনা আরম্ভ হয়-- এমনটাই ছিল তাঁর অন্তরের বিশ্বাস। জ়াকিরের দুই ভাই তৌফিক কুরেশি ও ফজ়ল কুরেশিও ছিলেন তবলাবাদক। ষাটের দশকেই রীতিমতো খ্যাতির শিখরে পৌঁছতে থাকেন জ়াকির। তাঁর তবলার ভাষা শুধু সনাতন শিল্পের দর্পণ হয়ে ওঠে না, যেন বিশ্বজগতের সমস্ত ধ্বনিই ভর করে সেই ছান্দসিকের গতিময় আঙুলে। বায়া আর ডানের দ্বিরালাপে তিনতাল থেকে দাদরা কিংবা একতাল থেকে ঝাঁপতাল-- সর্বত্র ছিল সেই মায়াবী আঙুলের অবাধ গতি। তবলার ত্বকে মৃদু আঘাত করে আনতে পারেন ধাবমান অশ্বখুরের ধ্বনি, কখনও দ্রুতবেগে, কখনও বা মৃদু। রেলের  একঘেয়ে কু-ঝিকঝিক শব্দও তবলায় বিম্বিত করার ক্ষমতা রাখতেন জ়াকির। আবার সংক্ষিপ্ত মানবিক কথোপকথনকেও ফুটিয়ে তুলতেন চক্র-গৎ-বোলের বৈচিত্রে। তাঁর বাজানোর পদ্ধতিতে সম থেকে খালির মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল অজস্ৰ রেলা আর ফরমান। শুধুমাত্র বায়া বা ডুগির সাহায্যে গম্ভীর নাদ উৎপন্ন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়েছিলেন। তাঁর বাম হাতের আঙুলের খেলায়, ধাতব আধারযুক্ত বায়ার চর্ম-পৃষ্ঠ থেকে জলদমন্দ্র ডম্বরুধ্বনি নির্গত হতে আরম্ভ করল। বিস্মিত-মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতারা অবিশ্বাস্য আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল যখন ডমরুর সঙ্গে সঙ্গে ধ্বনিত হল শঙ্খনাদ। ডায়ার কৃষ্ণ-চক্রে অঙ্গুলি হেলিয়ে একেবারে সমুদ্র-শঙ্খকে বাজিয়ে তুলতে সমর্থ হলেন। সৃষ্ট হল এক ঐশ্বরিক মুহূর্ত! এ তো কোনও পুরাণ-ধর্মের খেলা নয়। জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে প্রকৃত শ্রোতারা অনুভব করলেন এ শিল্পী স্বয়ং প্রজাপতির তুল্য, কারণ ব্রহ্মাস্বাদ-সহোদর প্রীতি উৎপন্ন করার ক্ষমতা তাঁর ছিল। ষড়জ থেকে নিষাদের সুর সৃষ্টি করে এক বৈশ্বিক ঐকতান রচনা করতেন জ়াকির। পণ্ডিত রবিশঙ্কর আর ওস্তাদ আলী আকবর খানের সঙ্গে তিনি তবলার উপস্থাপনা করেছেন প্রায় প্রথম যৌবনকাল থেকেই। 

আসলে ছন্দকেও একটি বিশিষ্ট ভাষার গুরুত্ব দিতেন জ়াকির। তাই ধ্রুপদী সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত যাবতীয় বাদ্যের স্পন্দনকে পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণ আর অনুভব করতেন সম্যক নিষ্ঠার সঙ্গে। মৃদঙ্গ, পাখোয়াজ কিংবা কাঞ্জিরার সঙ্গে তবলার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছেন সৎ শিল্পী হওয়ার অঙ্গীকারেই। পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার সন্তুরের ঊর্মিমুখরতাকে তুলে ধরেছিলেন তাঁর তবলা-নিঃসৃত স্রোতে। পত্রী সতীশ কুমারের মৃদঙ্গ আর জ়াকিরের তবলার বোল যেন এক শাশ্বত গীতিকাব্য গড়ে তুলেছিল। হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া থেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাকেশ চৌরাসিয়ার বাঁশি উদ্দীপিত হয়ে উঠেছিল জ়াকিরের তবলার আলিঙ্গনে। ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের সরোদের প্রতিটি তারে গেঁথে গিয়েছিল জ়াকিরের তবলার অভিঘাত। প্রণম্য কত্থকশিল্পী পণ্ডিত বিরজু মহারাজের পদবিভঙ্গ আর নৃত্যমুদ্রা আরও প্রকট হয়ে উঠেছিল জ়াকিরেরই তবলার ঝঙ্কারে। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমালাপসিক্ত সংক্ষিপ্ত আখ্যানকেও বোল-মাধুর্যে আভাসিত করার প্রত্যয় ছিল তাঁর। মটকা বা হাঁড়ি, শ্রীখোল কিংবা ডাফলির ছন্দযতিকেও আয়ত্ত করে তবলার অনিবার্যতাকে দুনিয়ার খাস-দরবারে তুলে ধরেছিলেন জ়াকির। ওস্তাদ রশিদ খান থেকে গজ়ল-শিল্পী অনুপ জলোটার সঙ্গে দুর্দান্ত যুগলবন্দী রচনা করেছেন। সানাই-বীণার মতো অভিজাত বাদ্যের সমান্তরালে লোকায়ত বাদ্যের চলিষ্ণুতাকেও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন।

১৯৭০'এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস শুরু করেন জ়াকির। ১৯৭৯ সালে প্রায় সাত বছরেরও বেশি তাঁরই ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে থাকা কত্থক নৃত্যশিল্পী ও শিক্ষক আনতোনিয়া মিনেকোলাকে বিয়ে করেছিলেন। এই প্রতিভায় দীপ্যমান দম্পতির দুই কন্যা-- আনিসা কুরেশি ও ইসাবেলা কুরেশি। তাঁরা যথাক্রমে চলচ্চিত্র নির্মাতা-প্রযোজক এবং নৃত্যশিল্পী। সম্ভবত জ়াকির-আনতোনিয়ার প্রেমবিবাহ ঘটার পথটি জাতিগত আর সামাজিক কারণে বিশেষ সুগম ছিল না বলেই গোপনে পরিণয়-পর্বটি মিটেছিল। 

নিউ ইয়র্কে থাকাকালীন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই তবলাবাদক ১৯৭৩ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ গিটারিস্ট জন ম্যাকলফ্লিন-এর সঙ্গে মিলে 'শক্তি' ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠা করেন। এই ব্যান্ডটি ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের দুরূহ তাল ও জ্যাজ়-সঙ্গীতের ইম্প্রোভাইজেশনের এক অভিনব সংমিশ্রণ তৈরি করেছিল। তাঁর সঙ্গে ব্যান্ডের অন্যান্য সদস্য, যেমন, বিখ্যাত বেহালাবাদক এল শঙ্কর এবং ঘটম-শিল্পী টিএইচ 'ভিক্কু' বিনায়করাম লয় আর সুরের এক অপূর্ব সমন্বয় তৈরি করেন। সত্তরের দশকে 'শক্তি' ব্যান্ডের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অ্যালবাম প্রকাশিত হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- 'Shakti with John McLaughlin' (১৯৭৬), 'A Handful of Beauty' (১৯৭৬), 'Natural Elements' (১৯৭৭)। এক দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৯৭ সালে 'শক্তি' পুনরায় গঠিত হয় 'Remember Shakti' নামে। এই নতুনভাবে সেজে ওঠা ব্যান্ডের সঙ্গে যোগ দেন ম্যান্ডোলিন শিল্পী শ্রীনিবাস এবং কাঞ্জিরা-শিল্পী ভি সেলভগণেশ। ব্যান্ডের এই নতুন পর্বেও জ়াকির হুসেন সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং নতুন প্রজন্মের শ্রোতাদের মধ্যে ফিউশন সঙ্গীতের আবেদন বৃদ্ধি করেন। ২০২৩ সালে 'শক্তি' ৪৬ বছর পর তাদের প্রথম স্টুডিও অ্যালবাম 'This Moment' প্রকাশ করে। ব্যাপকভাবে প্রশংসিত এই অ্যালবামটি ২০২৪ সালের গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডে Best Global Music Album বিভাগে পুরস্কার অর্জন করে। বর্তমানে এই ‘শক্তি’ ব্যান্ডের প্রধান কণ্ঠশিল্পী শঙ্কর মহাদেবন। 

পুরস্কার-প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও জ়াকিরের প্রাপ্তিযোগ শিখরস্পর্শী। ১৯৮৮, ২০০২ ও ২০২৩ সালে যথাক্রমে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ আর পদ্মবিভূষণ সম্মানে ভূষিত হন। একাধিকবার গ্র্যামি-পুরস্কার অর্জন করেছেন:

• ১৯৯২: 'Planet Drum' অ্যালবামের জন্য,  মিকি হার্টের সঙ্গে;

• ২০০৯: 'Global Drum Project' অ্যালবামের জন্য, যেখানে তিনি মিকি হার্ট, সিকিরু আদিপোজু এবং জিওভানি হিদালগোর সঙ্গে কাজ করেছিলেন;

• ২০২৪: ৬৬তম বার্ষিক গ্র্যামি পুরস্কারে তিনি তিনটি পুরস্কার লাভ করেন তাঁর 'Pashto' (বেলা ফ্লেক, এডগার মেয়ার এবং রাকেশ চৌরাসিয়া সহ), 'As We Speak' এবং 'This Moment' ('শক্তি' ব্যান্ডের সঙ্গে)-এর জন্য।

এছাড়াও ১৯৯৯ সালে পেয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এন্ডোউমেন্ট ফর দ্য আর্টস (NEA) দ্বারা প্রদত্ত ন্যাশনাল হেরিটেজ ফেলোশিপ। ২০২২'এ তাঁর প্রাপ্তি জাপানের ইনামোরি ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রদত্ত কিওটো পুরস্কার। এছাড়াও তাঁর সম্মাননার ঝুলিতে রয়েছে সঙ্গীত নাটক একাডেমি পুরস্কার (১৯৯০), কালিদাস সম্মান (২০০৬), মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত এলএলডি ডিগ্রি (২০২২), সান ফ্রান্সিসকো জ্যাজ় সেন্টার কর্তৃক প্রদত্ত লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড (২০১৭) প্রভৃতি। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁকে হোয়াইট হাউসে আন্তর্জাতিক জ্যাজ় দিবসের গ্লোবাল কনসার্টে পারফর্ম করতে আমন্ত্রণ জানান। এই অনুষ্ঠানটি ৩০ এপ্রিল ২০১৬-এ অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং বিশ্বব্যাপী সুরসাধক মানুষ জ্যাজ় সঙ্গীতের প্রভাব আত্মস্থ করে আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছিল। সেখানে ওস্তাদ জ়াকির হুসেনের অংশগ্রহণ ছিল একটি বিশেষ পাওনা, কারণ প্রথমবারের মতো কোনও ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী হোয়াইট হাউসে পারফর্ম করলেন, যা ভারত ও আমেরিকার মধ্যে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনকেও কূটনৈতিকভাবে দৃঢ় করেছিল। এই অনুষ্ঠানে বিশ্বের তাবড়-তাবড় সঙ্গীতশিল্পীরা অংশ নেন এবং জ়াকির হুসেনের উপস্থাপনা আন্তর্জাতিক সঙ্গীত পরিবেশনায় এক অনন্য ও চিরন্তন স্থান তৈরি করে। 

অভিনয়ের ক্ষেত্রেও চমকপ্রদভাবে কিছুটা পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন জ়াকির হুসেন। ১৯৭৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'সাজ' (SAAZ) চলচ্চিত্রে শাবানা আজমির প্রেমিকের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন। তাঁর ফিল্ম-কেরিয়ারে মোট ১২টি ছবি চোখে পড়ে। এর মধ্যে ১৯৮৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত শশী কাপুরের 'হিট অ্যান্ড ডাস্ট' ছিল অন্যতম। এছাড়াও তিনি 'দ্য পারফেক্ট মার্ডার' (১৯৮৮), 'থান্ডুভিটেন এনাই' (১৯৯১, তামিল), 'মিস বিটিস চিলড্রেন' (১৯৯২), 'জ়াকির অ্যান্ড হিজ় ফ্রেন্ডস' (১৯৯৮) এবং 'টর' (২০১৮) চলচ্চিত্রে তাঁর মনকাড়া উপস্থিতি ছিল। চলচ্চিত্র-নির্মাতা দেব প্যাটেলও তাঁর সাম্প্রতিক মুক্তিপ্রাপ্ত 'মাঙ্কি-ম্যান' (২০২৪) সিনেমায় জ়াকির হুসেনের তবলা বাজানোর দৃশ্য তুলে ধরেন। স্মর্তব্য যে, ১৯৯৪-এ ভারতীয় পত্রিকা 'জেন্টলম্যান'-এ 'সেক্সিয়েস্ট ম্যান' হিসেবে বিপুল ভোট পেয়ে অমিতাভ বচ্চনকেও হারিয়ে দেন জ়াকির।

সাঙ্গীতিক দুনিয়ার সংশপ্তক এই কালজয়ী শিল্প-অধীশ্বর ইডিওপ্যাথিক পালমোনারি ফাইব্রোসিসে আক্রান্ত হয়ে সান ফ্রান্সিসকোয় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সেই অপূরণীয় বেদনা সর্বজনীন হয়ে ছড়িয়ে গেল দেশ-দেশান্তরে, তবলার বোলে যেন বেজে উঠল বিশ্বনাথ কবিরাজের 'সাহিত্যদর্পণ'এর অমোঘ সেই পঙক্তিটি: 'পরস্য ন পরস্যেতি, মমেতি ন মমেতি চ'...।


Tuesday, 17 December 2024

অতুল সুভাষ বিচার পাবেন?

গণহত্যা মঞ্চের পর্দা সরালেন অতুল সুভাষ

নন্দিনী ভট্টাচার্য



এ বছর আমরা পেরিয়ে এলাম আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস পালনের ২৫ বছর, যা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ সাল থেকে। এ এক সালতামামির সময়, যে আমরা কতটুকু এগোলাম। আন্দোলনে কী পেলাম-- এই ভাবনা সঠিক নয়; কী দিতে পারলাম বা কতটুকু সেই কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলাম, এমন ভাবনাই আরও বৃহত্তর আন্দোলনের জন্ম দেয়। 

এই পঁচিশ বছর পূর্তিতে ভারতবর্ষের বুকে ঘটে গেল এমন এক ঘটনা যা আমার এই লড়াইয়ের (যার বয়স এবার ৮ হল) সময়কালে দেখিনি এমন নয়, তবে তা নিয়ে সারা দেশকে এত কথা বলতে শুনিনি: এক পুরুষের আত্মহত্যা। 'পুরুষ' মানুষ তো! লিঙ্গ অন্য হলে এতক্ষণে 'দেশে দেশে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে' এটা নিশ্চিত বলতে পারতাম। মানুষটির নাম অতুল সুভাষ। তিনি চলে গেছেন। বলা উচিত নিজেকে শেষ করে দিয়েছেন। পেছনে রেখে গেছেন এক ২৪ পাতার 'সুইসাইড নোট' ও একটি দেড় ঘণ্টার ভিডিও। এগুলোতেই নাড়া পড়েছে অনেকের, এতদিনের জেগে ঘুমোনো বিভিন্ন চিন্তাভাবনার গোড়ায়।

২০১৯ সালে বিয়ে হয় অতুল সুভাষ মোদী ও নিকিতা সিংহানিয়ার। কিছুদিন পর থেকেই শুরু হয় অতুল সুভাষের উপর মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার। টাকার চাপ। এতে নিকিতার মা/ ভাই/ কাকা সবাই যুক্ত ছিলেন। এরপর অতুল ও নিকিতা'র সন্তান হয়। ধীরে ধীরে সে শিশু হয়ে ওঠে Emotional Blackmailing'এর হাতিয়ার। অতুল ও নিকিতা ইতিমধ্যে আলাদাও থাকতে শুরু করেছেন। সন্তানকে দেখতেও দেওয়া হত না অতুলকে (এটি বহু পুরুষের সঙ্গেই প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে)। ক্রমশ মানসিক/ অর্থনৈতিক নানা চাপে এক নিঃসীম অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এরপর ৯ই  ডিসেম্বর ২০২৪, আত্মহত্যা করেন অতুল। বেঙ্গালুরুর নিজের বাড়িতে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়। ঘর থেকে একটা প্ল্যাকার্ডও পাওয়া যায় যাতে লেখা ছিল 'বিচার এখনও বাকি আছে'। আগেই লিখেছি তাঁর ২৪ পাতা সুইসাইড নোট ও দেড় ঘণ্টার ভিডিও'র কথা। ছেলের উদ্দেশ্যে লিখে যাওয়া অতুলের চিঠিটি আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি প্রত্যেক পুরুষের অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। এই আত্মহত্যার ঘটনায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে অতুল সুভাষের ভাই থানায় এফআইআর দায়ের করেছিলেন নিকিতা সিংঘানিয়া এবং তাঁর বাড়ির লোকদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করেছে। 

অতুল আগে থেকেই নিকিতার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ এবং সন্তানের হেফাজত নিয়ে আইনি জটিলতায় জড়িয়েছিলেন। তাঁর নিজের বাড়ি উত্তরপ্রদেশের জৌনপুর আদালতে এই মামলা চলছিল। পুলিশ জানিয়েছে যে নিকিতার কারণেই অতুল মানসিক কষ্টে ছিলেন। এমনকী এই মামলা তুলে নেওয়ার বিনিময়ে ৩ কোটি টাকার দাবিও জানিয়েছিল নিকিতার পরিবার। তাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন এক বিচারক। তাঁর সম্পর্কেও FIR করা হয়েছে। ছেলেকে দেখার জন্য অতুলের কাছ থেকে ৩০ লক্ষ টাকাও চেয়েছিলেন নিকিতা, জানিয়েছে পুলিশ।

আমাদের (পুরুষ অধিকার কর্মীদের) সম্পর্কে যাঁরা এতকাল মনে করেছেন শুধুই Limelight পাওয়া বা নারী-পুরুষের সংসার ভেঙে দেওয়া বা নারীকে ছোট করে দেখাবার জন্য এই কাজটি করে চলেছি, তাঁরা হয়তো (?) সামান্য হলেও বুঝতে পারছেন যে তাঁরা ঠিক ছিলেন না (অবশ্যই যদি অতুলের ঘটনাটি জানেন, তবেই)। অতুলের নোটটি পড়লে বা ভিডিওটি শুনলে আপনারা জানতে পারবেন কী অমানুষিক মানসিক নির্যাতনের (হয়তো শারীরিকও) মধ্যে একজন পুরুষকেও যেতে হয়। কিন্তু বলার বা শোনার কেউ থাকে না। তাই উনি এইভাবে সারা দেশকে শুনিয়ে চলে যেতে বাধ্য হলেন। আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থার একনায়কতন্ত্রও কি এর জন্য দায়ী নয়? এঁরা মধ্যস্থতা করতে আসেন ৩ কোটি টাকা আদায় বা সন্তানকে দেখার বিনিময়ে ৩০ লক্ষ টাকা দেবার অন্যায় আবদারে সীলমোহর দেবার জন্য! এ দেশ জুড়ে বহু নিরপরাধ/ নিরীহ/ সাধারণ বা অসাধারণ, উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পুরুষের মানসিক ও শারীরিক গণহত্যার যে মঞ্চ অনেকদিন ধরে তৈরি হয়েছে, সেই মঞ্চের পর্দা তুলে দিয়ে গেলেন অতুল নিজের জীবন স্বহস্তে বলি দিয়ে।

একটি জরুরি বিষয় মনে রাখতে হবে। বিশেষত যাঁরা পুরুষ অধিকার আন্দোলন নিয়ে সামান্যতমও আগ্রহী তাঁদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ভারতবর্ষের পুরুষ অধিকার আন্দোলন এখন থেকে স্পষ্টতই দু' ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একটি ভাগ অতুল সুভাষ'এর মৃত্যু পূর্ববর্তী, অন্যটি তাঁর মৃত্যু পরবর্তী। উনি দেখালেন, 'এভাবেও চলে যাওয়া যায়', আর আমাদের দিশা দেখিয়ে গেলেন এক নতুন লড়াই শুরুর; না থামার লড়াইয়ের। ওঁনার এই মৃত্যু যেন বৃথা না যায়, তা দেখার দায় আমাদের সবার। আশার কথা, গত ১৪ ডিসেম্বর এই বাংলা ও দেশের অন্যত্র বহু জায়গায় 'Reclaim the Night' আওয়াজ তুলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বহু সাধারণ মানুষ অতুল সুভাষের বিচারের দাবিতে পথে নেমেছিলেন। আজ এ কথা সকলেই বুঝছেন যে, আইনি সুযোগ নিয়ে ও মিথ্যা অপবাদে নিছক পুরুষ হওয়ার কারণে পুরুষদের নির্বিবাদে অপদস্থ, হেনস্থা ও হত্যা করার যে প্রবণতা বিশেষত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে, তার বিরুদ্ধে সদলবলে আওয়াজ তোলার সময় এসে গেছে।

আসলে পুরুষ মানুষ তাঁর জন্মলগ্ন থেকেই 'হয় রক্ষক, নয়তো ভক্ষক'-- এই দুই তকমাতেই আটকে থাকে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সবচেয়ে বড় শিকার কিন্তু পুরুষমানুষ। তাঁর অসহায়তা বা চোখের জল দুই বড় করুণা ও লজ্জার। তাই আজ এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে, নয়তো আমাদের বাবা, ভাই, স্বামী, পুত্র, প্রেমিক কাউকে হয়তো এই আইনি সন্ত্রাসবাদের কবল থেকে মুক্ত করা যাবে না। কাল বা পরশু সে হয়তো থাবা বসাবে আমার বা আপনার ঘরে!

যে দেশে পশু পাখির জন্য মন্ত্রণালয় আছে, পরিবেশ রক্ষায় আইন আছে, সে দেশে একটি পুরুষ কমিশন'এর দাবি এখন অত্যন্ত একটি ন্যায্য দাবি। আসুন, সবাই সে জন্য সওয়াল শুরু করি। নতুন করে শুরু হোক পথচলা, শুরু হোক কথা বলা।

(নন্দিনী ভট্টাচার্য, প্রেসিডেন্ট, অল বেঙ্গল মেনস ফোরাম: +917003624865/ +919903318148)


Tuesday, 10 December 2024

এই বৈঠক জরুরি ছিল

দু’ দেশের সম্পর্কে জনগণই চালিকাশক্তি

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য



গত এক মাসে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্কের অবনমন ও কিছু নেতিবাচক টানাপোড়েনের মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্ত্রীর ৯ ডিসেম্বর ঢাকা সফর, সে দেশের সরকারের সঙ্গে তাঁর আলোচনা ও পরবর্তীতে আশাপ্রদ বিবৃতি প্রদানে মনে হতে পারে যে বহমান চাপা উত্তেজনার এবার কিছুটা অবসান হবে। সবচেয়ে বড় কথা, দুই দেশের আলোচনায় কোনও তিক্ততা উঠে আসেনি, দুই তরফেই কিছু উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে মাত্র (যার হয়তো কিছু ভিত্তিও আছে) এবং দু’ পক্ষই মার্জিত ও বন্ধুসলুভ বিবৃতি দিয়ে প্রতিবেশিসুলভ আচরণ করেছে। আপাতদৃষ্টিতে এই বৈঠক আগামী দিনের পক্ষে ইতিবাচক।

কিন্তু এ দেশের গোদি মিডিয়া দেখলে মনে হবে, বাংলাদেশ যেন একেবারে উচ্ছন্নে চলে গেছে, সেখানে সংখ্যালঘুরা ভীষণ ভাবে অত্যাচারিত ও বিপন্ন এবং প্রতিনিয়ত গণ্ডগোল ও সংঘর্ষ লেগে রয়েছে। কেউ কেউ বললেন, ‘এবিসি নিরানন্দ’ টিভি চ্যানেল খুললে বোঝাই যাচ্ছে না যে তাদের দফতর কলকাতা না ঢাকায় অবস্থিত; সারাদিন, সারাক্ষণ বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে রুদালি চলেছে। ‘ঢিপাবলিক’ চ্যানেল তো ঢিল ছুঁড়েই ব্যবসা করে, তাদের বাংলাদেশ নিয়ে চিল-চীৎকার যে কহতব্য নয়, তা বলাই বাহুল্য। আর সেই তালেই নেচেকুঁদে এ রাজ্যের বিরোধী নেতা পেট্রাপোল সীমান্তে গিয়ে দু-দেশের ব্যবসা বন্ধের হম্বিতম্বি করে (যদিও প্রায় স্বভাবিক গতিতেই সীমান্ত দিয়ে বাণিজ্য পরিবহন চলেছে), তারপর রণে বঙ্গ দিয়ে এখন হাঁক পেড়েছে যে ‘শেখ হাসিনাই বাংলদেশের বৈধ প্রধানমন্ত্রী’। অথচ তারই দল পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশে গিয়ে বৈঠক করে এলেন হাসিনার জমানার বিরুদ্ধে জনঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যারা ইতিমধ্যে হাসিনাকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করেছে। তাহলে কি পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় এক ‘অবৈধ’ সরকারের সঙ্গে বৈঠক করে ফিরলেন? বিরোধী নেতা অধিকারীবাবুর বক্তব্য কি সে ক্ষেত্রে ভারত সরকার বিরোধী? এই বক্তব্যের জন্য দল বা সরকার কি তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে?

উল্লেখ্য, পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্ত্রী তাঁর বিবৃতিতে এও বলেছেন যে, দু’ দেশের সম্পর্কে জনগণই চালিকাশক্তি এবং অতীতের মতো ভবিষ্যতেও এই সম্পর্ক গণ-কেন্দ্রিক ও গণমুখি ভিত্তির ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকবে। অর্থাৎ, দু’ দেশেই সরকারি ক্ষমতায় যখন যেই আসুক না কেন, উভয় দেশের মধ্যে সুসম্পর্কে কোনও বাধা পড়ার কথা নয়। ফলত, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের উপদেষ্টা মহঃ তৌহিদ হোসেন ভারতের মাটিতে গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা’র বসবাস সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করতে পেরেছেন, কারণ, তা প্রকারান্তরে সে দেশ থেকে পলাতক এক রাজনৈতিক নেত্রীকে আশ্রয় দেওয়ার সামিল এবং প্রত্যার্পণের নীতিতে তাঁকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোই দস্তুর। বলাই বাহুল্য, বিভিন্ন দেশের মধ্যে সরকারি স্তরে নানা ধরনের কূটনৈতিক আদানপ্রদান ও বার্তালাপ থাকবে, বাণিজ্যরীতি ও যাওয়া-আসারও বিধিব্যবস্থা থাকবে, কিন্তু, মানুষে মানুষে যদি বিশ্বাস ও আস্থার সূত্রটি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তার থেকে বেশি বিপজ্জনক আর কিছু হতে পারে না। আর সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগায় ধুরন্ধর মৌলবাদী শক্তিসমূহ। আজ বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে এই উপমহাদেশে ঘনায়মান পটভূমিতে তেমনই কিছু ইঙ্গিত যেন স্পষ্ট।

৫ অগস্ট যেদিন শেখ হাসিনা গণ অভ্যুত্থানের ব্যাপ্তি ও বিস্ফোরণে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন, সেদিন থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যা কিছু ঘটেছে তা একান্তই সে দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। সেই সব ঘটনাবলীর দিকে সারা বিশ্বের নজর ছিল। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের নজর ছিল আরও নিবিড়; বিশেষত একই ভাষা-সংস্কৃতির কারণে পশ্চিমবাংলার মানুষেরা আরও কড়া নজর রেখেছেন। ভারত-বাংলাদেশ দুই রাষ্ট্র গঠনে যেহেতু দু’ জায়গাতেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থান ও অংশীদারিত্বের প্রশ্নটি একটা কমন ফ্যাক্টর, যার স্পর্শকাতরতা আজও কমবেশি থেকে গেছে, তাই খুব স্বাভাবিক যে বাংলাদেশে হাসিনা পরবর্তী আমলে এই বিষয়টি কতটা হানিকর হল বা হল না, তা নিয়ে তীব্র কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা থাকবে। চূড়ান্ত গণ অভ্যুত্থানের পর কিছু কিছু সংখ্যালঘু মানুষের ওপরে যে আক্রমণ নেমে আসেনি তাও নয়, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে আওয়ামী লিগ’এর সমর্থক হিসেবে বহুজনের ওপর নির্যাতন হয়েছে যারা হিন্দু (তারা হিন্দু বলে তাদের ওপর আক্রমণ হয়নি)। যদিও আওয়ামী লিগের মুসলমান কর্মীরাও বহু জায়গায় আক্রান্ত হয়েছেন কিন্তু হিন্দু সদস্য বা সমর্থকের ওপর আক্রমণকে কোনও কোনও মহল থেকে ‘হিন্দুদের ওপর আক্রমণ’ বলে চিত্রায়িত করা হয়েছে। যদিচ, এই ধরনের রাজনৈতিক হামলাও নিন্দনীয়, কিন্তু সেই অজুহাতে তাকে সাম্প্রদায়িক মোড়ক দেওয়াটা ভয়ঙ্করজনক ভাবে কুৎসিত। অবশ্য, এ ব্যতিরেকে বেশ কিছু জায়গায় সংখ্যালঘু খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-হিন্দু এবং কিছু মন্দির-মাজারে সংখ্যালঘু বলেই আক্রমণ হয়েছে, কিন্তু তা তত ব্যাপক নয়। অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হওয়ার পর এই ধরনের ঘটনা ক্রমেই কমে আসে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ছাত্র-যুবদের পাহারাদারিতে তা আরও প্রশমিত হয়। কিন্তু নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ইস্কনের জনৈক সাধু চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে (যদিও বাংলাদেশ ইস্কন এই সাধুকে বেশ কিছুদিন আগেই শিশু নির্যাতনের অভিযোগে তাদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে বলে প্রেস বিবৃতি দিয়ে জানায়) গ্রেফতারির পর যেন নতুন করে এক হৈচৈ শুরু হয়।

চট্টগ্রামে বাঙালি-পাহাড়ী একটা বিবাদ চলছিল। তার উপর সেখানকার সংখ্যালঘু জোটের মানুষজনও সংঘবদ্ধ হয়ে মিছিল-মিটিং করছিলেন। অভিযোগ, এই মিছিল-মিটিং-বিক্ষোভের সময় চিন্ময় দাস ও তাঁর কিছু সহযোগী বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা করেন এবং একটি গেরুয়া পতাকা তার ওপর টাঙিয়ে দেন। এই অভিযোগে চিন্ময় দাস ও তাঁর কতিপয় সঙ্গীকে পুলিশ ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ অভিযোগে গ্রেফতার করে আদালতে পেশ করে। আদালত চত্বরে চিন্ময় দাসের মুক্তির দাবিতে জনবিক্ষোভের রোষে সাইফুল ইসলাম নামে এক আইনজীবী আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মারা যান। এই ঘটনা গোটা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। চিন্ময় দাসের গ্রেফতারির প্রতিবাদে কলকাতা ইস্কন থেকে নিন্দামূলক বিবৃতি দেওয়া হয় এবং বিবিধ হিন্দু সংগঠন কলকাতা ও অন্যত্র মিছিল বের করে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও প্রতিবাদ জানান, বিজেপি ‘সংখ্যালঘু নির্যাতনের’ অভিযোগ তুলে সর্বশক্তি দিয়ে হৈ-হট্টগোল শুরু করে দেয়। আর ঠিক এই সময় থেকেই ‘এবিসি নিরানন্দ’ ও ‘ঢিপাবলিক’ টিভি আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবেদন’ নিয়ে। তবে, তাদের তরফে সব সময় যে তেমন তথ্যনিষ্ঠ খবর বা ভিডিও প্রচার করা গেছে তা নয়, কিছু পুরনো ও ফেক ভিডিও দিয়ে কাজ সারতে হয়েছে। কারণ, খানিক অনুসন্ধান করলেই দেখা যাবে যে, বাংলাদেশে গত দু-তিন মাসে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ তেমন ব্যাপক ভাবে কিছু হয়ইনি।

পেট্রাপোল সীমান্তে টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা দাঁড়িয়ে আছেন এই ছবি তুলতে যে সংখ্যালঘুরা সব দলে দলে বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে আসছে। সে সব ছবি তো পাওয়া যায়ইনি বরং যে দু-একজন বাসে করে কোনও কাজে ভারতীয় সীমান্তে সবে এসে পৌঁছেছেন, তাঁরাও সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে খুব কিছু বিপদ বা আক্রমণের কথা শোনাতে পারেননি; সাংবাদিকদের চোখা চোখা প্রশ্নের সামনে পড়ে, ‘হ্যাঁ, আশঙ্কা তো একটা আছে’, এই ধরনের অস্পষ্ট কিছু মন্তব্য করে পালিয়ে বেঁচেছেন। সম্ভবত আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারও তাদের গোয়েন্দা ও অন্যান্য সূত্রে তেমন কোনও সংখ্যালঘু নিপীড়নের হদিশ পায়নি, ফলে, তারা তড়িঘড়ি পররাষ্ট্র সচিবকে সে দেশে পাঠিয়ে আসলে গোদি মিডিয়ার উন্মাদ আচরণকে ধামাচাপা দিতে চেয়েছে। শোনা যাচ্ছে, পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্ত্রী নাকি এ কথাও বলেছেন যে, মিডিয়া কী বলছে তাতে সরকারের কোনও হাত নেই। অনুমান করি, নিপীড়নের তেমন কোনও বিস্তৃত তথ্য থাকলে তা পররাষ্ট্র সচিব নিশ্চয়ই পেশ করতেন।

অথচ, আমাদের দেশে মণিপুর পুড়ছে। সম্বল জ্বলছে (ইতিমধ্যেই সেখানে পাঁচজন সংখ্যালঘুকে হত্যা করা হয়েছে)। উত্তরপ্রদেশ হাইকোর্টের বিচারপতি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভাতে গিয়ে প্রকাশ্যে বলছেন, এখানে থাকতে হলে হিন্দুবাদীদের কথা শুনেই চলতে হবে। একে একে সব মসজিদের তলা থেকেই নাকি পাওয়া যাচ্ছে শিবলিঙ্গ বা মন্দিরের ভগ্নাবশেষ। অর্থাৎ, ভবিষ্যতে আবার মন্দির পুনরুদ্ধারের রাজনীতিই মুখ্য হবে। তাই, আমরা যদি বাংলাদেশের দিকে নিশানা তাক করতে পারি, তাহলে এ দেশের নিপীড়নের ছবিগুলিকে বেমালুম হাওয়া করে দেওয়া যেতে পারে-- রাজনৈতিক কৌশলটাকে এমন করারই চেষ্টা চলেছে। কিন্তু সমস্যা হল, আজকাল মানুষ আর শুধু টিভি দেখে না, তার সামনে এখন খবর ও বিশ্লেষণের সহস্র সূত্র। উপরন্তু, তারা নিজেরাও এখন বিশ্লেষক ও পাহারাদার। অতএব, মিথ্যা খবর ও গুজব ছড়িয়ে কেল্লা ফতে করা খুবই শক্ত।

মুখ্য কথাটা হল, যদি দেশের সরকার বর্ণ-ধর্ম-লিঙ্গ-জাতি নির্বিশেষে সকল মানুষকে একসঙ্গে নিয়ে রামধনু সমাজের ন্যায্যতাকে মান্যতা দেয়, তাহলে বিপথগামী বা নাশক শক্তি চেষ্টা করলেও খুব বেশি দূর সফল হতে পারে না। বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নভাবে যে অন্যায় ঘটনাগুলি ঘটেছে বা ঘটছে, মালুম হচ্ছে, বর্তমানের অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করছে সেগুলিকে প্রতিরোধ করার। তার মানে অবশ্য এমন ভাবার কোনও কারণ নেই যে এই সরকারে সকলেই উদার মনোভাবাপন্ন মানুষ। লড়াইটা চলছে, চলবে। কিন্তু আমাদের দেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় বা বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির সরকার সামগ্রিক ভাবে কতটা আন্তরিক? নাকি, তারা ইন্ধনদাতাও? এখানেও লড়াইটা চলছে, চলবে।

ভারত ও বাংলাদেশ উভয়তই শান্তি ও সম্প্রীতি বিরাজ করুক। স্ব স্ব সার্বভৌমত্ব রক্ষা পাক। প্রতিবেশিসুলভ আত্মীয়তা বজায় থাকুক।               


Tuesday, 3 December 2024

'বার খেয়ে ক্ষুদিরাম'!

ভুল করেও ভুল করার সাহস

মালবিকা মিত্র



'একজন উইলমড সাহেব মরবে, তার জায়গায় আসবে আর একজন। সে হবে আরো বেশি হিংস্র উন্মত্ত নিষ্ঠুর। মেরে মেরে কি ইংরেজ রাজত্ব শেষ হবে?' (ফেরারী ফৌজ নাটক/ উৎপল দত্ত)। এই প্রশ্নগুলো হামেশাই কমিউনিস্টরা তুলতেন আমাদের দেশের বীর সশস্ত্র বিপ্লবীদের সম্পর্কে সমালোচনার সুরে। 

শোষক শ্রেণি তার নিজের আধিপত্য বজায় রাখার স্বার্থে একটা ক্ষমতা কাঠামো তৈরি করে। সেই কাঠামোর মধ্যে পুলিশ, প্রশাসন, আইন, আদালত, ধর্ম, এমনকি উচিত অনুচিত বোধ, সবই অন্তর্ভুক্ত। আর এইসব নিয়েই গড়ে ওঠে রাষ্ট্র। অতএব শোষক শ্রেণিকে আঘাত করা মানে, একজন পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেটকে খতম করা নয়। সেটা হবে অ্যাডভেঞ্চার। দরকার এই সমগ্র কাঠামোটাকে পরিবর্তন। আমাদের দেশের সশস্ত্র বিপ্লবী গুপ্ত সমিতিগুলি এই সত্য বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল।

ছোট মাঝারি খুচরো কমিউনিস্ট নেতাকর্মীরাও সরাসরি খোলামেলা এই সমালোচনা করতেন। তারা কেবলই ব্যবস্থা, তাকে পাল্টানো, কাঠামো পরিবর্তনের বক্তৃতা দিতেন। একই সুরে তারা সুভাষচন্দ্রকে সমালোচনা করেছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসুর পথ ভ্রান্ত বলতে কুন্ঠা বোধ করেননি। ফ্যাসিস্ট জাপানকে নিমন্ত্রণ করে দেশে ডেকে আনার অভিযোগ পর্যন্ত করেছেন। এমনকি জাপানের ফ্যাসিস্ট প্রধান তোজোর কুকুর, পঞ্চম বাহিনী, হিটলারের মুখপাত্র বলেও সুভাষচন্দ্রকে বিদ্রূপ করতে ছাড়েননি। 

আশ্চর্য লাগে, অহিংসবাদী কংগ্রেসও সশস্ত্র বিপ্লববাদকে সমর্থন করেনি। কিন্তু তারা এভাবে কঠোর সমালোচনা করেনি। বরং স্বাধীনতা দিবসে গান্ধী নেহেরু সুভাষ ছাড়াও ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, ভগৎ সিং, অরবিন্দ ঘোষ সমান মর্যাদায় স্থান পেয়েছেন। এইখানে এসেই ভারি বিস্ময় লাগে, আরএসএস যতটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে, ততটাই তাচ্ছিল্যভরে কমিউনিস্ট পার্টি স্লোগান দিয়েছিল 'ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়'। ১৯৭৭ সালে সরকারে আসার পর সিপিআইএম কী করি, কী করি ভাব সহ এদিকে ওদিকে ১৫ অগস্টে জাতীয় সংহতি দিবস পালন করতে শুরু করে। কারণ, তারা পার্টি কর্মসূচির দিক থেকে তখনও ভারতের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে না। 

উল্লেখযোগ্য যে, ঐতিহ্যগত ভাবে বাংলায় বামপন্থী আবহ বিরাজমান। সিপিআইএমের অন্যতম প্রধান শক্তিশালী ঘাঁটি এই পশ্চিমবাংলা। ফলে, এখানে সাধারণভাবে একটি গান্ধী বিরোধী, স্বাধীনতা বিরোধী, সশস্ত্র বিপ্লব বাদ বিরোধী মনোভাব আছে। বামফ্রন্টে অন্যতম শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক থাকার কারণে তারা সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে প্রকাশ্য মতামত প্রকাশে অনেকটাই সংযত; যদিও প্রকাশ্যে ভুল স্বীকার করেনি, দুঃখপ্রকাশ করেনি যে সুভাষকে পঞ্চম বাহিনী, তোজোর কুকুর ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত করা অন্যায় হয়েছিল। এরই ফলশ্রুতিতে এই বাংলায় একজন সোচ্চারে বলতে পারেন যে তিনি 'বার খেয়ে ক্ষুদিরাম' হবেন না। 

কথাটায় উহ্য আছে যে, না বুঝে, অপরের উস্কানিতে, ক্ষুদিরামের মতো তরুণ প্রজন্ম বিপ্লব করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিল। দেশপ্রেম সেফ বাজে কথা। এরা কিছু নেতার দ্বারা প্ররোচিত হয়েছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার, এই উক্তি সংবাদপত্রে প্রকাশের পরেও সারা বাংলা বা দেশব্যাপী সমালোচনা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠেনি। স্বাধীনতা আন্দোলনের শহীদের প্রতি এত অবজ্ঞা অকল্পনীয়। আরও অবিশ্বাস্য যে, সমালোচনা নিন্দা তো হলই না, উল্টে 'বার খেয়ে ক্ষুদিরাম' একটি বাগধারায় পরিণত হল। 

শোষক শ্রেণির এই শোষণ যন্ত্র বা কাঠামোটার প্রকৃত চরিত্র রাষ্ট্রকে বিশ্লেষণ করেছিলেন লেনিন তাঁর 'রাষ্ট্র ও বিপ্লব' রচনায়। লেনিনের দাদা (আলেকজান্ডার সলোভিয়ার) নিজে ছিলেন রাশিয়ার গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি 'জনতার ইচ্ছা'র সদস্য। তিনি রুশ জার আলেকজান্ডারকে হত্যার ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৩ নাগাদ রুশ জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে তিনি হত্যা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন ও তাঁর ফাঁসি হয়। বালক লেনিন প্রবলভাবে জ্যেষ্ঠ বিপ্লবী ভ্রাতা দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। লেনিনের দিদির লেখা থেকে জানা যায়, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার ফাঁসির দিন সারা রাত লেনিনের চোখে ঘুম ছিল না। তিনি কেঁদেছিলেন এবং বিড়বিড় করে আউড়ে ছিলেন, এ পথ নয়, এ পথে নয়, আমাদের অন্য পথ খুঁজতে হবে। 

লেনিন কখনই পণ্ডিতি চালে নারোদনিক বা জনতাবাদীদের সমালোচনা ও নিন্দা করেননি। বরং তিনি এই বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ, কমিটমেন্ট, ডিভোসনকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন। হাতের মুঠোয় প্রস্তুত রাখা প্রাণ ছাড়া কোনও বিপ্লব সম্ভব নয়। সেই আবেগ এই বিপ্লবীদের ছিল। কিন্তু তাঁদের অনুসৃত পথ যথার্থ ছিল না। তিনি এটাও স্বীকার করেন যে, পথ যতই যথার্থ হোক, যদি ডিভোসন ও কমিটমেন্ট না থাকে, আবেগে যদি ঘাটতি থাকে, তাহলে বিপ্লব সম্পন্ন হয় না। আবেগ, রোমান্টিকতা এগুলোতে ঘাটতি পড়া খারাপ, একটু বেশি থাকলে বরং ক্ষতি নেই। এমনকি মার্কসবাদী বিপ্লবীরা এ কথা স্বীকার করেন যে, জনগণের কাছে রাষ্ট্রের স্বরূপ উদঘাটন করার পরেও এই রাষ্ট্রটাকে মানুষ আঘাত করতে সাহসী হয় না। কারণ, তার মধ্যে একটা আদিকল্প বিরাজ করে। সে সময় এই বিপ্লবীরা রাষ্ট্রকে আঘাত হেনে একটা দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করে। রাষ্ট্রের সর্বশক্তিমান ধারণাকে ভেঙে দেয়। বলা যায়, সলতে পাকালেই হয় না, তাতে আগুন লাগাতে হয়।

শুধু তো গুপ্ত সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী সংগঠন নয়, মার্কস-এঙ্গেলস তাঁদের পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীদের যখন সমালোচনা করেন, সেটাও কি অপরিসীম মানবিক ও শ্রদ্ধাপূর্ণ। তিনি এই সমাজতন্ত্রীদের 'ইউটোপিয়' আখ্যা দিয়েছিলেন। বিস্ময় লাগে, আমরা নিন্দার্থে 'ইউটোপিয়ান' শব্দটি ব্যবহার করি। কিন্তু তাঁরা অত্যন্ত সহানুভূতি ও শ্রদ্ধার সাথে 'ইউটোপিয়' শব্দটিকে প্রয়োগ করেছিলেন। তাঁদের মতে, পুঁজিবাদ যখন বিকাশমান, যখন তার সমগ্র বৈশিষ্ট্যগুলি প্রকাশ পায়নি, অর্থাৎ অপরিণত, সেই অবস্থায় পুঁজিবাদের রোগগুলি নিরাময় সংক্রান্ত ধারণাটিও অপরিণত হতে বাধ্য। পুঁজিবাদের লক্ষণগুলি স্পষ্ট ছিল না, তার দাওয়াইগুলিও ঐতিহাসিকভাবেই অস্পষ্ট ছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে, পুঁজিবাদের নির্মম অমানবিক প্রকাশ দেখে এই সমস্ত মানুষের দরদী মন কেঁদে উঠেছিল। তাঁরা বৌদ্ধিক বিশ্লেষণ দিয়ে রোগের নিরাময়ে পথ খুঁজেছিলেন। ফলে, সমাজতন্ত্র ছিল কাল্পনিক বা ইউটোপিয়।

জনতাবাদী'দের উদ্যোগেই ১৯০৫ সালে যে ব্যর্থ অভ্যুত্থান ঘটল, লেনিন জানতেন এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে। তথাপি জনতার এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে থাকেননি। যারা পাণ্ডিত্য দেখিয়েছিলেন, প্লেখানভ ও তাঁর অনুগামীরা, তাঁরা নিজেরাই এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন। কার্ল মার্কসও তো সেই শিক্ষাই দিয়েছেন। প্যারি কমিউনে শ্রমিকদের ক্ষমতা দখলের সিদ্ধান্তকে তিনি 'হতাশার মূর্খতা' বলে মেনে নিয়েও কমিউন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেননি। তিনি আন্তরিকভাবে প্যারী কমিউন'এর অভ্যুত্থানের সঙ্গী হয়েছিলেন। 

আমরা মার্কসের চেয়েও মার্কসবাদী, লেনিনের চেয়েও লেনিনবাদী। তাই কত সহজে দাম্ভিকের মতো বলতে পারি, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, মাস্টারদা ছিলেন ভুল। আর সেই দাম্ভিকতারই নাগরিক রূপ ও কন্ঠ বলতে পারে-- 'বার খেয়ে ক্ষুদিরাম' হব নাকি? ভুল করেও ভুল করার সাহস নেই, তাই ঠিকটা করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

ক্ষুদিরাম বসু: ৩ ডিসেম্বর ১৮৮৯ - ১১ অগস্ট ১৯০৮।

Wednesday, 27 November 2024

প্রসাধনী অস্ত্রোপচার?

‘বাম বিকল্প’ কেন এখনও দূরে

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

গত ১০-১৫ বছর ধরে এ রাজ্যের রাজনৈতিক পরিসরে তিন-চারটি শব্দ বা শব্দবন্ধ বার বার করে শোনা যায়: রক্তক্ষরণ, ঘুরে দাঁড়ানো, বাম বিকল্প, পাকা চুল, তরুণ নেতৃত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব শব্দগুচ্ছ কেন্দ্রিক বিবিধ আলোচনা চলতেই থাকে, প্রকৃতির নিয়মে বছরও ঘুরে যায়, কিন্তু উচ্চারণ ও চর্চায় ইতি পড়ে না। এ কি নিছকই মুদ্রাদোষ, নাকি গোড়ায় গলদ?

বঙ্গে এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ দলটি নির্বাচনের হিসেবে শূন্যের গেরোয় আটকা পড়েছে! কেউ বলছেন ‘আর্যভট্টের দশা’। চরম আশাবাদীরা বলেন, হবে হবে, মানুষের কাছে যেতে হবে। দিন যায়, রাত যায়, এক ধ্রুবক রাশির মতো ‘০’ লেপ্টে থাকে। অতএব, বিষয়টি রীতিমতো কৌতূহলোদ্দীপক এবং অভিনব।

কে না জানে, সংসদীয় গণতন্ত্রে কোনও এক সময় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের রাজ্যপাট যায়, বিরোধী আসনে তাদের অধিষ্ঠান হয়, কিন্তু একেবারে শূন্য হয়ে যায় কী? যায়; যখন সমকালীন রাজনীতিতে তাদের প্রাসঙ্গিকতা বা কার্যকলাপের মেয়াদ ক্রমেই বিলীন ও অবসাদগ্রস্ত হতে থাকে। এক সময়ে ‘স্বতন্ত্র পার্টি’ নামে একটি দল এ দেশে বেশ সচল ছিল, রাজাগোপালাচারী, মিনু মাসানি প্রমুখেরা গড়ে তোলেন, আজ সে দলের আর অস্তিত্বই নেই; অথবা ‘মুসলিম লিগ’। কিন্তু তা বলে সিপিএম বা তাদের সহযোগী দলগুলির কি এ রাজ্যে এরকমই করুণ অবস্থা যে তাদের অস্তিত্বই আজ প্রশ্নের মুখে? না, তেমনটা বলা অসমীচীন। কারণ, নির্বাচনী রাজনীতিতে তাদের ভোটের অঙ্ক ক্রমেই তলানিতে এসে ঠেকলেও তাদের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা মোটেই ফুরিয়ে যায়নি। ‘বাম’ আদর্শ বলে যে নীতিসমূহ এখনও জনমানসে উজ্জ্বল, তার প্রাসঙ্গিকতা বা কার্যকারিতা ফুরোয় তো নিই, বরং তার আরও ব্যাপ্তি ও বহর বেড়েছে। যা ঘটেছে তা হল, হাইজ্যাক। বাম দলগুলির রাজনৈতিক মতাদর্শ ও কার্যকলাপ বাকী দলগুলির (মূলত শাসক ও প্রধান বিরোধী দল) কাছে গচ্ছিত পড়েছে। অর্থাৎ, তাদের কিছু রসদ (ভাবনা, ইস্যু, কর্মসূচি, প্রোগ্রাম) যেমন গেছে ওদের কাছে, ওদেরও কিছু এসেছে তাদের কাছে। এই লেনদেনের সমীকরণেই আসল গেরো লুকিয়ে!

ফলে, মানুষের কাছে শুধুমাত্র গিয়ে, ভাষণ দিয়ে অথবা তরুণ বয়সীদের নেতৃত্বে এনে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় খিল্লি আর হৈচৈ করে প্রসাধনী অস্ত্রোপচারে রক্তক্ষরণ যে বন্ধ হবে না, তা বলাই বাহুল্য। কারণ, সমস্যাটা মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের নয়, সমস্যাটা অন্তর্বস্তুতেই; অর্থাৎ, কী বিষয় নিয়ে মানুষের কাছে যাওয়া হচ্ছে, সেই বিষয়ের সঙ্গে মানুষের দৈনন্দিন যাপন, আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনও সম্পর্ক আছে কিনা, দেশকাল, রাজনীতি, অর্থনীতির বাস্তবতা সেই সব বিষয় থেকে সমাধানের কোনও আশু পথ পাচ্ছে কিনা— এইগুলিই মুখ্য বিচার্য বা গ্রহণযোগ্যতার চাবিকাঠি। এই সময়ে এ রাজ্যের বামেদের গোড়াতেই গলদ এইখানে যে, তারা শত কসরত করে যে বিষয়গুলিকে মানুষের কাছে উপস্থিত করছে তার কোনও গ্রহণযোগ্যতাই তৈরি হচ্ছে না। অস্যার্থে, তারা মানুষের কাছে হাজির হতে পারছে না তা নয়, তারা মানুষকে যে কথাগুলি বলছে, তার মধ্যেই একটা ভ্রান্তি ও দূরত্ব থেকে যাচ্ছে!

১৯৫৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে বাম দলগুলি যে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে, তার তীব্র অভিঘাতের প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের এক কটূ প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন বিরোধী দল নেতা জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ভাড়া তো মাত্র এক পয়সা বেড়েছে— কিন্তু প্রশ্নটা সেখানে নয়, প্রশ্নটা কার পকেটের পয়সা কার পকেটে যাচ্ছে (তখনও ট্রাম কোম্পানি ব্রিটিশ মালিকানাধীন একটি বেসরকারি সংস্থা)। সে সময়ের এই শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গিটাই আজ বামেরা খুইয়েছে। এখনও তারা সিঙ্গুরে টাটা’র ন্যানো প্রকল্প নিয়ে হা-হুতাশ করে, বিশ্বাস করে যে উন্নততর প্রযুক্তির এই আধুনিক সময়েও বৃহৎ শিল্প হলেই যথেষ্ট কর্মসংস্থান হবে, এমনকি উর্বর কৃষি অঞ্চলেও, যেখানে ইতিমধ্যেই হাজারও মানুষ কৃষিকর্মে নিয়োজিত (সুপ্রিম কোর্ট সিঙ্গুর মামলায় প্রশ্ন তুলেছিল, ১৯,০০০ কৃষিজীবীকে উৎখাত করে ১২০০ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসৃষ্টি কি আদপে কর্মসংস্থানের প্রসার না হরণ?)। অর্থাৎ, কৃষকের জমি কেড়ে নিয়ে শিল্প স্থাপনের যে স্বপ্ন শিল্পপতি বা কর্পোরেট হাউজ দেখে এবং তাকেই ‘উন্নয়নের’ সোপান হিসেবে মনে করে, সেই পথকে সাবেক বামেরাও শিরোধার্য করেছে। সে আতান্তর থেকে তারা আজও বেরতে পারেনি।

ফলে, লগ্নি ও কর্মসংস্থানের আন্তঃসম্পর্ক ও সমবৃদ্ধির তত্ত্ব ও তথ্য আজ যে আধুনিক প্রযুক্তি-যুগে, বিশেষত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই আগ্রাসী সময়ে একেবারেই অচল, সে পাঠ তাদের এখনও মেলেনি। আর সেই সূত্রেই তারা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না যে, আধুনিক কালে নিয়মিত চাকরির তেমন কোনও সুযোগও নেই, কারণ, কাজের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে। কাজের যে সুযোগ মিলছে তা অনিয়মিত, স্বল্পস্থায়ী ও বহু ক্ষেত্রে পার্টনার মডেলে। তাহলে মানুষের দিন চলবে কেমনে? এই প্রশ্নের মোকাবিলায় বামেদের কাছে গত একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে যে উত্তরটি মজুত আছে তা হল: বিপ্লব। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চালকেরা এর মধ্যেই বুঝে ফেলেছেন কালের অন্তর্নিহিত গতি: যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে জগতের ভার চলে যায়, মনুষ্য-শ্রমকে প্রতিস্থাপিত করে ফেলে humanoid robot, ফলত সমাজে আরও বেশি উদ্বৃত্ত সৃষ্টি হয়, তাহলে সেই উদ্বৃত্তের একটা অংশ প্রত্যক নাগরিকের হাতে তুলেই দেওয়া যেতে পারে। একেই কেউ কেউ বলেন ‘Universal Basic Income’ বা ‘Citizens’ Dividend’, যার আংশিক রূপ আজ আমরা দেশ জুড়ে দেখছি লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, লাডলি বহিন, মাইয়া সম্মান, কৃষক বন্ধু প্রকল্প ইত্যাদির মাধ্যমে যেখানে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নাগরিকদের কাছে নগদ হস্তান্তরের নীতি রাজনৈতিক অর্থনীতির এক প্রধান প্রবাহ হয়ে উঠেছে। অথচ, এই নগদ হস্তান্তরকে সাবেক বামেরা ‘ভিক্ষাবৃত্তি’, ‘ডোলের রাজনীতি’, ‘পাইয়ে দেওয়া’ ইত্যাদি বলে উড়িয়ে দিয়ে কালের নিদানকেই বুঝতে অস্বীকার করেছে। তাদের শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি লুপ্ত হওয়ায় তারা ধরতেই পারেনি যে সমাজের নিম্নবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষেরা সাধারণ ভাবে স্বল্প বা প্রায় বিনা মজুরিতেই কাজ করে থাকেন। সেই বিচারে এই অর্থ প্রাপ্তি তাদের ন্যায্য হক (citizens’ dividend)। বরং বামেদের উচিত ছিল, নগদ হস্তান্তরের এই প্রবণতাকে universal basic income প্রবর্তনের অভিমুখে নিয়ে যাওয়ার দাবি তোলা এবং মজুরি দাসত্ব থেকে মুক্তির আন্দোলনে শ্রমজীবী মানুষকে সামিল করা। সেটা না করার অর্থ, বাম রসদকে হাইজ্যাক হতে দেওয়া!

এ ব্যতীত, বিচিত্র হলেও সত্য যে, এ রাজ্যে সাবেক বামেদের এক বড় অংশ হিন্দুত্ববাদী প্রচারে প্রভাবিত হয়ে মুসলমান বিদ্বেষকেই জাতীয় মুক্তির পথ ধরে নিয়ে দলে দলে বিজেপির ভোট বাক্সে সমবেত হয়ে পড়ল। কেউ কেউ বলেন, এর মধ্যে আসলে লুকিয়ে ছিল তীব্র মমতা-বিদ্বেষ। কিন্তু খানিক গভীরে গিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, এই উগ্র হিন্দুবাদের প্রতি তাদের আকর্ষণ কর্পোরেট পুঁজির প্রতি আস্থার মনোভাব এবং পুঁজি-লগ্নির পথ ধরে অর্থনৈতিক বিকাশের ভাবনার মধ্যেই সুপ্ত। বিশেষ করে সাবেক বাম নেতৃত্বে বর্ণহিন্দুদের আধিপত্য থাকায় তারা খুব সহজেই কর্পোরেট পুঁজির প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে এবং ততদিনে কেন্দ্রে বিজেপিও এই পুঁজির সহজাত তল্পিবাহক হয়ে ওঠায় তারা বিজেপির সঙ্গে মানসিক ভাবে যে আত্মীয়তাবোধ অনুভব করে সেখানে হিন্দুত্ববাদী বয়ান ও মুসলমান বিদ্বেষ এবং মমতা-অসূয়া পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে এক নতুন রাজনৈতিক দিগন্ত নির্মাণ করে। এই পরিসর থেকে বেরিয়ে আসাটা সাবেক বামেদের পক্ষে দুরূহ, যদি না তারা নিজেদের ঝুঁটি ধরে নাড়া দেয়! সে ক্ষেত্রে তাদের বহু আচরণ ও কার্যক্রম তৃণমূল দলের মতো দেখাতে পারে, এই আশঙ্কাও প্রবল। অর্থাৎ, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারকে স্বাগত জানালে অথবা তীব্র ভাবে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা করলে, নিন্দুকেরা তাদের ‘চটিচাটা’ বলে দেগে দিতে পারে (যেমন তারা নিজেরা অন্যদের প্রতি হামেশাই করে থাকে)। এই ঝুঁকি নিতে পারার রাজনৈতিক সাহস তাদের এখনও হয়নি। ফলে, কর্মসংস্থানের গালগল্পে ভরা বৃহৎ পুঁজি অনুসৃত ‘শিল্প গড়ে ওঠা’র একমাত্রিক আবর্তেই তারা এখনও বদ্ধ।

তাই, স্থিতাবস্থা বজায় রয়। প্রসাধনী অস্ত্রোপচারের গুরুত্ব বাড়ে। ডিজিটাল কুশীলব ভাড়া করার তোড়জোড় চলে, কিন্তু content বা অন্তর্বস্তুতে পরিবর্তন কই? বিজেপির প্রচারগুলিকে একপ্রকার ছড়িয়ে নিজেদের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্যকে ক্রমেই বিসর্জন দেওয়া চলতে থাকে! বিদেশি রাষ্ট্র বাংলাদেশে চিন্ময় দাসকে গ্রেফতার করলে তাদের কর্মী ও সমর্থকেরা উঠেপড়ে যে ভাবে বিজেপির প্রচারগুলিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে তার এক কণা রা’ও কাড়তে দেখি না উত্তরপ্রদেশের সম্বলে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড নিয়ে। এইভাবেই কি পোক্ত হচ্ছে নিজেদের কবরখানা আর উর্বর হচ্ছে বিদ্বেষ বিষ? পশ্চিমবঙ্গ ক্রমেই আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যাচ্ছে দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক পরিসরে। ‘বাম বিকল্প’ কি আপাতত এক মরীচিকা?

      

Friday, 22 November 2024

জালিয়াত আদানি?

এবার খোদ মার্কিন আদালত!

পার্থ হালদার



ইতিমধ্যেই খবর ছড়িয়ে পড়েছে। এতদিন ভারতের বাণিজ্য জগতে আদানির তুমুল উপস্থিতি দেখেছি, এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সুদূর আমেরিকাতেও আদানি-সরগরম টের পাওয়া যাচ্ছে। ভাবলাম, টিনটিনের স্রষ্টা যদি বেঁচে থাকতেন, টিনটিনের দ্বিতীয় খণ্ড তিনি হয়তো লিখতে শুরু করতেন আমেরিকায় আদানি রহস্যের ওপর।

গতকাল বাজার খুলতেই যা ঘটবার তাই ঘটল, আদানির কোম্পানিগুলির পতন প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে গেল। তার জেরে নিফটি পতন প্রায় ২০০ পয়েন্টেরও বেশি ও অন্যান্য ছোটখাটো শেয়ার প্রায় ধরাশায়ী। কারণ, এবার আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ জানিয়েছে খোদ মার্কিন প্রশাসন। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে গৌতম আদানির ভাইপো এবং আরও কিছু নাম। অভিযোগ, সোলার ইলেকট্রিসিটি চুক্তি আদায়ের জন্য আদানির তরফে বিভিন্ন সরকারি কর্তাব্যক্তিদের ২৬৫ মিলিয়ন ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ২০০০ কোটি টাকার বেশি) ঘুষ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা FBI তদন্ত করে প্রামাণ্য তথ্য পেয়েছে। 

এ সম্পর্কে বিরোধী দল নেতা রাহুল গান্ধী শুধুমাত্র তাঁর নিজ শঙ্কার কথা ব্যক্ত করেননি, আদানির গ্রেফতার ও ভারতীয় তদন্ত সংস্থাদের দিয়ে তদন্ত করারও দাবি জানিয়েছেন। তিনি সরাসরি আঙুল তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীরও বিরুদ্ধে। মোদী ও আদানির যূথবদ্ধতায় 'মোদানি জোট' যে ভারতবর্ষের কাছে ভয়ঙ্করতম এক বিপদ হয়ে উঠেছে, সে ব্যাপারেও তিনি দেশের মানুষকে সাবধান হতে বলেছেন। প্রশ্ন উঠেছে, এ দেশে আর্থিক দুনীতির জন্য যদি বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতারা জেলে যেতে পারেন তাহলে দেশে-বিদেশে এত বড় আর্থিক দুর্নীতির কারিগর কীভাবে এখনও দেশের মাটিতে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন! এ প্রসঙ্গে রাহুল সেবি চেয়ারম্যান মাধবী পুরী বুচ'এর পূর্ববর্তী অভিযোগের প্রসঙ্গও টেনে আনেন।

গৌতম আদানি করেছেন'টা কী যে তার উপর এইভাবে মার্কিন প্রশাসন ও আদালত খড়্গহস্ত? সংক্ষেপে তা এইরকম:

১) নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে নথিবদ্ধ সংস্থা Azure Power এবং Adani Green Power ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সংস্থা Solar Energy Corporation of India (SECI)'র সঙ্গে বিভিন্ন রাজ্য সরকারি বিদ্যুৎ সংস্থাগুলিকে একটি অনৈতিক চুক্তি করতে প্ররোচিত ও বাধ্য করে। এই প্ররোচনা ও বাধ্যতা আদায় করা হয় বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির আমলাদের বিপুল উৎকোচ জুগিয়ে যার পরিমাণ ২০০০ কোটি টাকার বেশি;

২) কারণ, এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে Azure Power ও Adani Green Power'এর নিজেদের উৎপাদিত সৌরশক্তি থেকে SECI'কে যথাক্রমে ৪ ও ৮ গিগাওয়াট শক্তি বিক্রি করার কথা যা আবার SECI'র থেকে রাজ্য সরকারের বিদ্যুৎ সংস্থাগুলি কিনবে। কিন্তু এই সৌরশক্তির মূল্য এতটাই বেশি যে সরকারি বিদ্যুৎ সংস্থাগুলি ওই দামে এই শক্তি কিনতে রাজী হচ্ছিল না। অতএব, আদানি গোষ্ঠী এবার টাকার থলি নিয়ে নেমে পড়ল এবং বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির আমলাদের ঘুষ দিয়ে তাদের বাধ্য করল SECI'র সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে উচ্চমূল্যে সৌরশক্তি কিনতে;

৩) ফলে, যদি উক্ত দুই গোষ্ঠী (Azure ও আদানি) SECI'কে নিজেদের নির্ধারিত উচ্চমূল্যে সৌরশক্তি নিয়মিত বেচতে পারে এবং তা সরকারি বিদ্যুৎ সংস্থাগুলি কেনে, তাহলে আগামী ২০ বছরে এই বেচাকেনায় তাদের মুনাফা হতে পারে ২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

অর্থাৎ, এ এমন এক মুনাফাবাজি যেখানে সরকারি সংস্থাগুলিকে বাধ্য করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেশি অর্থ দিয়ে দুই কর্পোরেট বাণিজ্যপতির সৌরশক্তির বাণিজ্যকে পুষ্ট করতে। আর এ তো হামেশাই হচ্ছে! বিশেষত যখন বারবার আদানির বিরুদ্ধে প্রায় সর্বত্র এই অভিযোগ আসছে, তখনও তার পরম মিত্র দেশের প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রমুগ্ধ মৌনতা অবলম্বন করে তাকে পারাপার হতে সাহায্য করছেন।

কিন্তু, মার্কিন দেশের প্রশাসন ও আদালতের এ নিয়ে মাথাব্যথা কেন? কারণ, এইসব তঞ্চকতা করে ও উৎকোচ দিয়ে মুনাফা হাতাবার যে জালিয়াতি, তাতে জড়িয়ে পড়েছে ওই দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের বিপুল অর্থ (আগেই বলেছি, Azure Power নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে নথিবদ্ধ একটি সংস্থা)। উপরন্তু, আদানিদের ৪টি সংস্থা মার্কিন দেশ থেকে ১.৩৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ তুলেছে এই সংক্রান্ত মিথ্যা তথ্য ও বয়ান দিয়ে এবং সরকারি আমলাদের উৎকোচ প্রদানের কথা স্বীকারই করেনি। অর্থাৎ, মার্কিন দেশের বিপুল বিনিয়োগকে এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে, US Securities Exchange Commission (SEC) এই জালিয়াতির জন্য উক্ত দুই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে Foreign Corruption Prevention Act (FCPA)'এর আওতায় আদালতে অভিযোগ দায়ের করেছে। আমেরিকার Dept of Justice উত্থাপিত সমস্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখে উল্লিখিত দুই সংস্থার বিরুদ্ধে পাঁচটি তির বিঁধেছে: ১) FCPA উল্লঙ্ঘনের ষড়যন্ত্র ২) বন্ড জালিয়াতি ষড়যন্ত্র ৩) ডিজিটাল জালিয়াতি ষড়যন্ত্র ৪) ২০২১ সালের বন্ড জালিয়াতি ও ৫) বিচারকে বাধা দেওয়ার ষড়যন্ত্র।

২০২৩'এ হিন্ডেনবার্গ উত্থাপিত অভিযোগগুলির সঙ্গে এবারের অভিযোগগুলির মূল তফাত হল, হিন্ডেনবার্গ ছিল একটি বেসরকারি ব্যবসায়িক সংস্থা কিন্তু এবারে অভিযোগ এসেছে সরাসরি মার্কিন প্রশাসন ও আদালতের তরফ থেকে যেখানে নির্দিষ্ট ভাবে আইনকে লঙ্ঘন করার মামলা দায়ের হয়েছে। শুধু তাই নয়, গৌতম আদানি ও সাগর আদানির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা পর্যন্ত জারি হয়েছে। এবার সময় এসেছে অতীত এবং আজকের এই ঘটনাকে একত্রিত করে আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণ করার। কেবলমাত্র ধর্মীয় ভেদাভেদের উপর ভিত্তি করে একচেটিয়া পুঁজিবাদ মানে ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের শিকড় ধীরে ধীরে মজবুত হচ্ছে কিনা তা বোঝার আছে। কারণ, এই একচেটিয়া পুঁজিবাদই আগামী দিনে জন্ম দেবে নব্য ফ্যাসিবাদের। প্রতিযোগিতার যোগ্যতা যদি ঘুষের টাকার কাছে নতি স্বীকার করতে শুরু করে তাহলে আমরা একচেটিয়া পুঁজি ও একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব না। তাছাড়া এই মুহূর্তে ভারতীয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করার যে কটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠে যাবে। 

আদানি গোষ্ঠী যে কোনও ভাবেই হোক, হিন্ডনবার্গ ও অন্যান্যদের অভিযোগের আবহেই নিজেদের কর্মকাণ্ড এখনও বহাল রেখেছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয়টি হল, হিন্ডেনবার্গ কাণ্ডের পর থেকে তাদের 'আদানি এন্টারপ্রাইজ'এর শেয়ারের দাম কিন্তু সর্বোচ্চ দামের থেকে অনেক নিচে এবং ক্রমাগত নিম্নগামীই হতে থেকেছে। শেয়ার বাজার বড় বিচিত্র জায়গা, যদি কোনও সংস্থাকে বাজার নিজেই শাস্তি দিতে এগিয়ে আসে, তা বড় নির্মম। তাই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সুদিনের আশায়  রইলাম।

সুখবর হল, আদানির জালিয়াতি সামনে আসার পরেই কেনিয়ার রাষ্ট্রপতি তাঁর দেশের সঙ্গে আদানি গোষ্ঠীর বিমানবন্দর ও শক্তি ক্ষেত্রে মোট যে ২.৫ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প ছিল তা সপাটে বাতিল করেছেন। আজ সপ্তাহের শেষ কর্মদিনের অন্তে দেখার আছে, আদানির শেয়ার কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়; কিন্তু ইতিমধ্যে তদন্তে যে জালিয়াতি উদ্ঘাটিত হয়েছে ও এর বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তার কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা এখন সবিশেষ কৌতূহলের বিষয়! 


Sunday, 17 November 2024

প্রজাপতির ন্যায় এক ত্বষ্টা

কেউ শব্দ কোরো না

অমৃতা ঘোষাল


(২২ ডিসেম্বর ১৯৩৮ - ১২ নভেম্বর ২০২৪)

সাজানো বাগানে বেশ কিছু রঙিন আর সাদা-কালো ছবির মতো ফুল ছিল। চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর মতো! আর গভীরভাবে দেখলেই দ্রষ্টার বুকের মধ্যে স্বর্গসুখকে ছাপিয়ে প্রকট হবে গুলজার এক নরক। বাস্তববাদী নাট্যকার যে অপার নাট্যজগতে প্রজাপতির ন্যায় এক ত্বষ্টা, তার সার্থক উপমা মনোজ মিত্র। 

ব্রিটিশ-ভারতের খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার ধূলিহর গ্রামে জন্ম নেওয়া মনোজ শৈশবেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন দেশভাগের ফলাফল। খুলনা তাঁর জন্মভূমি হলেও আর ভারতভূমি হিসেবে রইল না! কাঁচা বয়সেই সৃজনশীল রচনায় দক্ষ মনোজকে যথেষ্ট ভাবিয়েছিল ভারত-পাকিস্তানের স্বাধিকারপ্রমত্ত রাজনীতি। গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে নাটকের অভিনয় দিয়েই তাঁর নাট্যজগতে পদার্পণ, বললে অত্যুক্তি হয় না। জীবনের ঊষালগ্ন থেকেই 'imitation of an action'-কে চ্যালেঞ্জ জানাতে পেরেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের হাস্যকৌতুক 'রোগের চিকিৎসা'-র অভিনয়ে, হাঁস-চুরি-করা বালকটির ভূমিকায় তিনি এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। কোনও অনুকৃতি নয়! জামার ভেতর গোটা হাঁস লুকিয়ে শিশু-মনোজ স্টেজে এসে অভিনয় করল। তবে হাঁসের আঁচড়ে-কামড়ে পেট-বুক রক্তাক্ত হয়ে তাঁর সহ্যসীমাও সহজেই অতিক্রান্ত হয়েছিল। দর্শক অনুভব করেছিল, নাটককে সাধারণ দর্শকের বিশ্বাসযোগ্য তথা 'universalized' করে তোলার জন্য তাঁর প্রতিটি সত্তা চূড়ান্তভাবে উন্মুখ। সেই যন্ত্রণায় মাখা কৌতুক-স্মৃতি সম্ভবত তাঁর জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারেও আমরা খুঁজে পাব। 

দেশভাগের প্রভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন বঙ্গদেশের বিভিন্ন স্তর-মর্যাদার বহু  মানুষ। মাতৃভূমি ছেড়ে ১৯৫০ সাল নাগাদ তিনি চলে আসেন এই বাংলায়। বেলেঘাটার ভাড়াবাড়ি, বসিরহাটের বাড়ি পেরিয়ে তরুণ মনোজ মিত্র থাকতে শুরু করলেন বেলগাছিয়ার বাড়িতে। এরপর স্কটিশচার্চ কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন ১৯৫৪ সালে। আর তখন থেকেই একটা নাটক রচনার প্রতিবেশ নিজের চারিপাশে আবিষ্কার করে ফেলেন। পার্থপ্রতিম চৌধুরী, অতনু সর্বাধিকারী আর দীপার  (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী) মতো বন্ধুদের সান্নিধ্যে থিয়েটারের সঙ্গে একেবারে গভীর সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। সেই পার্থর অফুরান উৎসাহেই ১৯৫৬ সালে গড়ে ওঠে নাটকের দল 'সুন্দরম'। চলচ্চিত্র-সংরূপের সঙ্গে জড়িয়ে নাটকের এক অভিনব দিশা সন্ধান করেছিল সেই দল। তাই 'পথের পাঁচালী'র নাট্যরূপ মঞ্চে উপস্থাপিত করার পরিকল্পনা করেছিল সেই দল, যদিও মনোজ প্রাধান্য দিতে চেয়েছিলেন সমকালীন বাস্তবতার জ্বলন্ত পাবককেই। সম্ভবত প্রদর্শনধর্মী  উন্মাদনা আর যুগীয় প্রবণতার কিছুটা বিপরীতে হাঁটতেন তিনি। 

দর্শন নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়াকালীন ১৯৫৯ সালে লিখলেন প্রথম নাটক 'মৃত্যুর চোখে জল'। ২১ বছরের যুবার কলমে সেই একাঙ্কের পরতে পরতে দীপ্ত হয়ে উঠল এক বার্ধক্য-আক্রান্ত প্লট। শৈশব থেকেই বৃদ্ধ পিতামহকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করা মনোজ উপলব্ধি করেছিলেন জীবনসায়াহ্ন-জনিত ক্রাইসিস। অথচ তাঁর সেই ঠাকুরদা অন্নদাচরণ মিত্র কিন্তু ছিলেন থিয়েটার-বিরোধী। তবে  অন্নদাচরণের কর্তৃত্বে তাঁদের গ্রামের বাড়িতেই থিয়েটারের উপকরণ-সরঞ্জাম রাখা হত। মাত্র একুশ বছর বয়সেই তিনি অভিনয় করলেন 'মৃত্যুর চোখে জল'-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র বৃদ্ধটির ভূমিকায়। আর্টিস্ট অনন্ত দাসের অসামান্য সাজানো, গলায় বার্ধক্যের ভঙ্গিমা, হাঁটার কায়দায় অবসন্ন ভাব কিংবা বয়সজনিত জরা-- এ সমস্ত কিছুকে আয়ত্ত করে সদ্য যুবক মনোজ একেবারে তাক লাগিয়ে দিলেন দর্শককে।  ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ অবধি 'সুন্দরম'-এ কাটিয়ে শ্যামল ঘোষের দল 'গন্ধর্ব'-এর সঙ্গে কিছুটা যুক্ত হলেন। সেই দলের নাট্যপত্রিকায় ছাপা হল তাঁর 'মোরগের ডাক' ও 'নীলকণ্ঠের বিষ'।

১৯৬০-এ রানীগঞ্জ কলেজ, ১৯৬৪'তে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র কলেজ আর ১৯৬৫'তে নিউ আলিপুর কলেজে দর্শন বিষয়ে অধ্যাপনাও করেন। পরবর্তীকালে অবশ্য রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক বিভাগেই অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। রানীগঞ্জ থেকে কলকাতায় ফেরার পর মহানগর দায়িত্ব নিয়েই তাঁর প্যাশনের স্রোতকে সঠিক খাতে বইয়ে দিল। শুরু করেছিলেন যে গবেষণার কাজ, তা-ও বন্ধ হয়ে গেল। শ্যামল ঘোষের নতুন দল 'গন্ধর্ব' কিংবা পার্থর 'সুন্দরম'-এ তিনি আর ফিরলেন না। কয়েকজন মিলে গড়ে তুললেন এক ক্ষণস্থায়ী দল 'ঋতায়ন'। সেই দলও ভেঙে যাওয়ার পর তাঁর লেখা নাটক 'চাক ভাঙা মধু' বেশ সাড়া ফেলে দেয়। সেই নাটকের পরিকল্পনা-রিহার্সাল আরম্ভ হওয়ার পর নতুন গড়ে ওঠা দলটির সামগ্রিক ছন্দে কিছু খুঁত ফুটে ওঠে। অন্যদিকে 'সুন্দরম' দলের দেহেও তখন কিছুটা অকাল-ভাঙন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও নির্মাল্য আচার্য সম্পাদিত 'এক্ষণ' পত্রিকায় এবার  প্রকাশিত হল তাঁর 'চাক ভাঙা মধু', আর বিভাস চক্রবর্তীর 'থিয়েটার ওয়ার্কশপ'-এর উদ্যোগে তা মঞ্চে অভিনীত হল। 

রানীগঞ্জ কলেজে হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক নারায়ণ পাণ্ডের লোকসাহিত্য বিষয়ক গবেষণার আঁচ পেয়েছিলেন তিনি। সেই গবেষণার উত্তাপ থেকেই সংগ্রহ করেছিলেন 'সাজানো বাগান' নাটকের রসদ। ১৯৭৭-এ 'সুন্দরম'-কে উপহার দিলেন 'সাজানো বাগান'-এর মতো মাস্টারপিস। ১৯৮০'তে সেই প্লটের ওপর ভিত্তি করে তপন সিংহ পরিচালিত চলচ্চিত্র 'বাঞ্ছারামের বাগান'এ রুপোলি পর্দায় প্রথম দেখা গেল নাট্যকার মনোজ মিত্রকে। প্রায় ষাটটির মতো বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জায়গা করে নিতে একটুও ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত থেকে হরনাথ চক্রবর্তী কিংবা সত্যজিৎ রায় থেকে অঞ্জন চৌধুরী-- সর্বত্রই তাঁর সাবলীল কিন্তু নজরকাড়া উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। নিন্দুকেরা আড়ালে তাঁকে বলতে লাগলেন উৎপল দত্তের কপি, সমালোচকেরা বললেন, উত্তরসাধক। বাদল সরকার আর রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত'র মতো শিল্পীদের নৈকট্য ও সান্নিধ্যপ্রাপ্ত মনোজ লিখেছিলেন 'নরক গুলজার' (১৯৭৪)। রাজনীতি ও অর্থনীতির স্যাটায়ারে ভরা এই নাটকে দর্শক প্রত্যক্ষ করল, কল্পতরু থলিতে স্বর্গরূপসী রম্ভাকে চেয়ে হাত ঢোকালে অনিবার্যভাবেই বেরয় মর্তমান কলা। সেখানে আবার প্রজাস্রষ্টা ব্রহ্মাকে উৎকোচ গ্রহণের সমর্থক হিসেবে দেখিয়ে, সমাজের ভয়াবহ অন্তঃসারশূন্যতাকে প্রকট করালেন মনোজ। 

শেষ জীবনে স্ত্রী আরতি মিত্রকে নিয়ে সল্টলেকে বাস করতেন। তাঁর দুই অনুজ অমর ও উদয়নও তাঁদের সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন যথাক্রমে বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও ইতিহাস-গবেষক রূপে। এই বছরই সেপ্টেম্বর মাসে মনোজ মিত্রের একমাত্র কন্যা ময়ূরী মিত্র জানান পিতার হৃৎযন্ত্র বিকল হওয়ার কথা। সেই সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিস, কিডনির সমস্যা, সিওপিডি আর ডিমেনশিয়ার মতো ব্যাধি তাঁকে ক্রমশ গ্রাস করছিল। ৮৫ বছর বয়সে বটবৃক্ষর মতো এই শিল্পীর জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে চিরপ্রস্থান ঘটে, রয়ে যায় অসীম প্রত্যয়ে ভরা প্লট-চরিত্র-সংলাপের শিকড়-ঝুরি। তাঁর মৃত্যুর পর সম্ভবত শুভানুধ্যায়ী আর নিন্দুকদের মুখে একসঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে 'নরক গুলজার' নাটকের সেই অমোঘ পঙক্তি--

'কথা বোলো না কেউ শব্দ কোরো না 

ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন 

গোলযোগ সইতে পারেন না।'

সহৃদয় সামাজিকের নয়ন সমুখে অভিনেতা কিংবা শিল্পবেত্তা মনোজ আর কোনও দিনও অবতীর্ণ হবেন না। অপেক্ষা ফুরলো, নটে গাছটি মুড়োলো।


Friday, 15 November 2024

বুলডোজার শাসন নিষিদ্ধ

নিকৃষ্টতম শাসনের ইতি

বর্ণালী মুখোপাধ্যায়



বুলডোজার শাসনকে নিষিদ্ধ করে সর্বোচ্চ আদালত আপাতত আমাদের স্বস্তি দিয়েছে; বিশেষত বিরোধী দলের সদস্য, সমর্থক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষকে। বেআইনি দখল করা জমিকে পুনরুদ্ধার করতে হলে যদি বুলডোজার ব্যবহার করতে হয় তবে আগে থেকে পোর্টালে সেই নোটিশ আপলোড করতে হবে, নির্দেশ দিয়েছে আদালত। তাছাড়া প্রক্রিয়া না মেনে বুলডোজার চালালে সরকারি আধিকারিককে আদালত অবমাননার দায়ে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হতে পারে। নোটিশ পেয়ে পনেরো দিনের মধ্যে প্রশাসনের তরফে হিয়ারিং হবে। সেই হিয়ারিংয়ে যদি শেষ পর্যন্ত সেই বাড়ি বা দোকান ভাঙ্গা স্থির হয় তার পরে আরও ১৫ দিন সময় দেওয়া হবে যাতে সেই ব্যক্তি আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে।

দলিত বনাম মুসলিম সমীকরণে এই বুলডোজার সন্ত্রাস ব্যবহার করা হয়েছে কিনা সেটা সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা যারা করেন তাদের খোঁজ নিতে অনুরোধ করব। আদিবাসী, দলিত, তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষকে আর এসএস এবং বিজেপি এটাই ফিসফিসিয়ে বোঝায় যে মুসলিমদের জমি-দোকান-ব্যবসা-পুকুর-ক্ষেত দখল করে তাদের দেওয়া হবে। ফলে, তদন্ত করলে হয়তো দেখা যাবে, ৬৭,০০০ একর বুলডোজারের ব্যবহারে পাওয়া জমির একাংশ আদিবাসী, দলিত বিজেপি সদস্যদের দেওয়া হবে এমন আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। সেই আশ্বাস কতটা বাস্তবে কার্যকর হবে সেটা অবশ্যই বিচার্য নয়। মেরুকরণই লক্ষ্য। 

আমাদের দেশে শহর, আধা-শহরের বাড়িঘরের মধ্যে একটা বড় অংশেরই সব কাগজপত্র ঠিক নেই। সরকার, পৌরসভা সেটা জানে। কিন্তু সব বাড়ির সব কাগজ ঘাঁটতে বসলে লোম বাছতে কম্বল উজাড় হবে, সেটাও জানে প্রশাসন। ফলে, যে সরকার বা মুখ্যমন্ত্রী অথবা প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ জমি পুনরুদ্ধার করতে নামে, বুঝতে হবে তা আসলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের উপর সন্ত্রাস চালিয়ে ধর্মীয় মেরুকরণ করার ছল মাত্র। সেখানে বিন্দুমাত্র দখলদারি বন্ধ করার উদ্দেশ্য নেই। মুসলিম বস্তি উজাড় করে সেখানে তাদের পোষ্যদের বেআইনি ভাবেই ব্যবসা করার আশ্বাস দেওয়া হয়। বেআইনি দখল তুলতে হলে বিজেপির দলীয় অফিসগুলো আগে ভাঙতে হবে, এমনটা বলেছিলেন আপ দলের এক নেতা। কৃষক আন্দোলনের নেতা টিকায়েত বলেছিলেন যে বুলডোজার নিয়ে এমন আক্রমণ হলে ট্র্যাক্টর দিয়ে প্রতিরোধ করা হবে। 

বুলডোজারের ব্যবহারে এক নির্লজ্জ মুসলিম আক্রমণের নজির গড়ে তুলেছিল বিজেপি। একজন গরু খেয়েছে বলে অভিযোগ এল, তাকে মৃত বা অর্ধমৃত করা তো হলই, উপরন্তু তার বাড়িও ভেঙে দেওয়া হল। পরে প্রশাসন একটা ব্যাক ডেটেড নোটিশ দেখিয়ে বলল যে ওই বাড়ি নাকি বেআইনি ছিল! এখন আদালতে সে যাবে, হয়তো জিতেও যাবে, কিন্তু সর্বনাশ যা হওয়ার তা তো হয়েই গেল! আবার এমন উদাহরণও আছে যে একটা গোটা বস্তি উদ্বাস্তু কলোনি। কিন্তু তার মধ্যে একজন বিরোধী দলের সমর্থকের বাড়ি ভাঙা হল দখলিকৃত অভিযোগ এনে, অথচ সেই সংজ্ঞায় গোটা বস্তিটা বেআইনি!

মাফিয়া গোষ্ঠীদের মধ্যেও অলিখিত আইন আছে যে শত্রু গ্যাং'এর পরিবারদের বিরক্ত করা হবে না, খুন করা তো দূরের কথা। সেরকম কোনও অঘটন হলে সেটাকে যুদ্ধ বলে ধরা হয়। আদিত্যনাথ যোগী যে নিকৃষ্টতম মাফিয়া বস সেটা তার বুলডোজার শাসন থেকেই প্রমাণিত। সমগোত্রীয় নরেন্দ্র মোদিও ভোটের প্রচারে বুলডোজার ব্যবহার করতে স্পষ্ট ভাষায় বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীদের উৎসাহ দিয়েছিলেন। তাই মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরাখণ্ডের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীরাও পিছিয়ে নেই। রাজস্থানের কংগ্রেস সরকারও মোদী, যোগী অনুপ্রাণিত ছিল এমন অভিযোগ আছে। 

রাজনীতি মানেই বিপদ। সরকারি দল করলে লাভ আর বিরোধী দল করলে 'হাজতবাস, আহত, নিহত হতে পারি' এটা জেনেই মানুষ রাজনীতি করতে আসে। কিন্তু বিরোধী জনের পরিবারও ছাদহীন হবে এই আশঙ্কা থাকলে, মেহনতি জনতার ক্ষেত্রে না হলেও, আমাদের মতো শহুরে আরবান নকশাল, আন্দোলনজীবীদের সংখ্যা যে অনেক কমে যেত তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়।


Tuesday, 12 November 2024

'পিপাসা, হায় না মিটিল'

প্রলম্বিত এক ছায়াপথ 

প্রবুদ্ধ বাগচী



আরও পাঁচটা না-পাওয়ার মতোই ঋত্বিকের ছবিকে তাঁর প্রকৃত চেহারায় খুঁজে পেতে আমাদের অনেকদিন লেগে গিয়েছে। আমরা মানে, যারা আশির দশকে বেড়ে উঠেছিলাম কলকাতার আবহাওয়া থেকে বেশ কিছুটা দূরত্বে। ১৯৮৭'র শহরে ‘নন্দন’ নামের এক অত্যাশ্চর্য প্রেক্ষাগৃহের স্থাপনার পর সেখানে ওই বছরের নভেম্বর মাসে সরকারি উদ্যোগে করা হয়েছিল ‘ঋত্বিক ঘটক রেট্রোস্পেক্টিভ’। মাত্র পাঁচ টাকার টিকিট কেটে সেবার দুটো ছবি দেখি। ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ও 'কোমল গান্ধার'। নন্দনের বিশাল স্ক্রিনে নীলকণ্ঠ বাগচীর পাশ-করা মুখের ফ্রেমে এসে দাঁড়ায় বঙ্গবালা, আর গোটা প্রেক্ষাগৃহে বিদ্যুতের শকের মতো বেজে ওঠে ‘কেন চেয়ে আছো গো মা’— এই দৃশ্য আসলে একটা জন্মান্তর। আমাদের ভিন্ন জন্ম হয়। আগামী সময়ে আমরা কেবল তার মধ্যেই বেড়ে উঠব অবিরাম। 

প্রায় একইরকম গায়ে-কাঁটা-দেওয়া 'কোমল গান্ধার'এর সেই লংশট— ট্রলির ওপর ক্যামেরা চলতে চলতে আচমকা লাইন থেমে যায় দুটো অনিবার্য বাফারে। এপার বাংলা ওপার বাংলা, মধ্যিখানে চর— চর নয় চরাচর। একটা প্রজন্মের বিধিলিপি লেখা হয়ে গেল ওই শটে। তুলনায় তাঁর ‘মেঘে ঢাকা তারা’ হিট ছবি। আটের দশকে নিঃসঙ্গ দূরদর্শন-জমানায় সেই ছবি প্রায়ই দেখানো হত রবিবার। সে ছবিতে নীতার জীবন নিংড়ে-নেওয়া বাঁচতে চাওয়ার আর্তি বাড়ির মা-মাসিমাদের কাছেও এক প্রবল শোকের ভ্রূণায়ন বলে চিহ্নিত হয়েছিল। ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’ গানটির অমন সুতীব্র অভিঘাত ও ব্যঞ্জনা ছিল প্রায় অলৌকিক। আর এই সূচিমুখ তীব্রতার মধ্যেই আমরা খেয়াল করতে ভুলে যেতাম আজাদগড় কলোনির পরিবার-বঞ্চিত এক রিফিউজি যুবতী কোথাও যেন মিশে যায় কুমারসম্ভবের পার্বতীর অনুষঙ্গে, ভুলে যেতাম বাগেশ্রীর ওই স্বরলিপির মধ্যে কীভাবে আছড়ে পড়ছে চাবুকের আওয়াজ! গান না আর্তনাদ ? 

এত দূর মুগ্ধতার আগে কিন্তু আমরা সত্যজিৎ মৃণালের ছবি কিছু কিছু দেখে ফেলেছি। তাই এটা বলার কথা যে, আসক্ত মুগ্ধতা থেকে ঋত্বিকের পরের ছবিগুলি খুঁজে পেতে দেখতে গিয়ে তেমন বড় কিছু লাভ করেছি এটা বলা ঠিক হবে না। বাংলার দিকপাল তিন চলচ্চিত্র পরিচালকের মধ্যে ঋত্বিক সব থেকে ছোট, তাঁর তৈরি করা ছবির পরিমাণও কম। অনেকে মনে করেন, সুযোগ পেলে তিনি অন্যদের থেকে নিজেকে আরও ভাল ছবি করার কাজে নিয়োজিত করে মহত্তর হতে পারতেন। এই আপ্তবাক্যে আমাদের তেমন আস্থা নেই। এটা ঠিক, তাঁর প্রথম ছবি ‘নাগরিক’ কার্যত ‘পথের পাঁচালী’র আগে রিলিজ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ‘নাগরিক’ বা ‘কোমল গান্ধার’ সময়ান্তরে দেখে তাঁর নির্মাণের মধ্যে এমন কিছু পাওয়া যায়নি যা নাকি ‘পথের পাঁচালী’কে অবান্তর করে দিতে পারে। তবে তাঁর শতবর্ষের সীমানায় এসে তাঁকে কোনও ‘বনাম’ এর মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়াটা সমুচিত নয় বলেই আমাদের ধারণা। বাংলার প্রবাদ হল, ‘অতি বড় সুন্দরী না পায় বর/ অতি বড় ঘরণী না পায় ঘর’— ঋত্বিক ঘটকের ক্ষেত্রে এই ধারণাটা কিছুটা ব্যবহার করা চলে। হ্যাঁ কিছুটা, অবশ্যই পুরোটা নয়। সিনেমা ব্যাপারটাই তো এরকম, তার জন্য পুঁজি, লোকলস্কর, প্রযুক্তি লাগে, লাগে তৈরি হওয়া চলচ্চিত্রের বিপণন। মুঠো মুঠো সদিচ্ছা আর বিপুল মেধা ও জ্ঞান থাকলেই যে তাতে সিদ্ধিলাভ ঘটবে এমন মোটেও নয়। যদিও প্রখর পাণ্ডিত্য ও ফিল্ম-বিষয়ক ভাবনায় ঋত্বিক নিজে সত্যিই একজন পথিকৃৎ। পুনার ফিল্ম ইন্সটিটিউটে তাঁর কিছু কৃতবিদ্য প্রাক্তন ছাত্ররা বলেছেন, লিখেছেন সেই ঋত্বিক-সংসর্গের কথা। জীবনের শেষ দিন অবধি ঋত্বিককে কাছ থেকে পেয়েছেন নবারুণ ভট্টাচার্য, তিনিও বলেছেন এই বিরল ব্যক্তিত্বের নানা কথা। প্রতিটিই প্রণিধানযোগ্য। 

ইতিহাসে ও বাজারে নানারকম মতামত ঘুরে বেড়ায়। তার একটা হল, বিশ্রুত প্রতিভাধরদের নাকি একটু এলোমেলো বিশৃঙ্খল না হলে চলে না। ঠিক ভোট  দিয়ে এই বক্তব্যের সার নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তবে দুনিয়ার সব প্রতিভাকেই যে নৈরাজ্যের উপাসক হতে হবে এটা কোনও নেসেসারি ও সাফিসিয়েন্ট শর্ত নয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তার প্রোজ্জ্বল উদাহরণ, যিনি এমনকি অন্যের কাছে নিজের লেখা চিঠি অবধি কপি করে রেখে দিতেন। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কতদূর সুশৃঙ্খলভাবে নিজের কাজগুলো করে নেওয়া সম্ভব এর অভিধান তিনি নিজেই রচনা করে নিয়েছিলেন। ইচ্ছে করেই এই ডিসিপ্লিনের নিরিখে  ঋত্বিক-সমকালীন সত্যজিতের কথা তুলছি না, কারণ, তাতে আবার ওই ‘বনাম’ এর বদনাম হবে। কিন্তু সিনেমা এমনই একটা মাধ্যম যা তার স্রষ্টার কাছ থেকে দাবি করে নিখুঁত নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলা, কারণ, আদপে সিনেমাটা তৈরি হয় একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া মেনে যার মধ্যে ছেলেমানুষির জায়গা থাকে না। তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে ঋত্বিক বলেছিলেন, যদি তিনি সিনেমার থেকেও জোরালো কোনও মাধ্যম কোনওদিন পান, সিনেমার মুখে লাথি মেরে তিনি সেখানেই চলে যাবেন। 

প্রথম জীবনে তিনি নাটক লিখেছেন, অভিনয় করেছেন। এর পরেও সিনেমা নামক মাধ্যমটিকে তিনি খুব সিরিয়াস ভাবে নিতে পেরেছিলেন কি না, এ নিয়ে আজ একটা প্রশ্ন তোলাই যায়। কারণ, সিনেমায় নিজের মতো করে কিছু করে দেখাতে গেলে গোড়ার দিকে তাঁর অবস্থানটা পোক্ত করার কাজটা নিজেকেই করতে হয়। সবাইকেই তা করতে হয়েছে। সম্ভবত এই প্রয়াসটায় তাঁর কিছু ঘাটতি ছিল। আজ এ কথা বলা কতদূর সঙ্গত জানি না, তবু বিনীতভাবেই সপ্রশ্ন হই, নিজেকে ‘জিনিয়াস’ ভাবা এবং কেবল সেই গুণেই প্রযোজকরা আগ বাড়িয়ে এসে কাজ দেবেন, এমন একটা গোপন অহং কি ছেয়েছিল তাঁকে? আবাল্য ছটফটে ঋত্বিক ওরফে ভবা'র প্রতিভার মূল্যায়ন করতে গেলে এই কথাগুলো ওঠে। 

আরেকটা কথা ঝুঁকি নিয়েও বলা দরকার। ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের যে বিরাট সাংস্কৃতিক ছায়া একটা সময় প্রগতি শিল্পের মূল ধারা হয়ে উঠেছিল, ঋত্বিক মূলত তারই সন্তান। বাম রাজনীতি নিয়ে তাঁর বেড়ে ওঠা, তার সঙ্গে তাঁর বিতর্ক, নানা ভাবনার দোলাচল তাঁকে সারা জীবন ব্যস্ত রেখেছে। জীবনের শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’তে নীলকণ্ঠ বাগচীর চরিত্রে রূপদান বেশ অনেকটাই তাঁর রাজনৈতিক দোলাচলের আত্মকাহিনি। এই যাত্রাও কিন্তু কিছুটা ‘ছটফটে’ চরিত্রের। কোথাও থিতু নন। ফিল্ম ইন্সটিটিউটের পাকা চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। শেষ জীবনে কার্যত পথের ভিখারি ঋত্বিক। নবারুণ ভট্টাচার্য একদিন দেখলেন ভবানীপুরের এক ফুটপাথে ছিন্ন পোশাকে শুয়ে রয়েছেন তিনি। পর্যুদস্ত। চরম অ্যালকোহলিক। অসম্ভব মেধা, বিপুল জ্ঞান, সংগীতের রসপিপাসু, ফিল্মের ব্যাকরণকে ফালা ফালা করার পোটেন্সি সব একাকার হয়ে গেল হাহাকারে: 'আমি পুড়ছি! ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে!' 

বহরমপুরের কলেজ জীবনে তিনি আরএসপি দলের ঘনিষ্ঠ, পরে কলকাতায় পড়তে এসে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সখ্য, সস্তা ষোলো মিলিমিটার ক্যামেরা জোগাড় করে ‘তেভাগার লড়াই’কে নথিবদ্ধ করার তাগিদে বন্ধু সলিল চৌধুরীর সঙ্গে পথে বেরনো। তথাকথিত ‘রণদিভে লাইন’কে তিনি মানছেন না তার ছাপ পড়ল পঞ্চাশের দশকে পার্টির মধ্যে তাঁর তোলা বিতর্কে। বিস্তর লেখাপড়া করা ঋত্বিককে জ্যোতি বসু সমর্থন করতেন কিন্তু স্বভাবে কিছুটা ‘কুচুটে’ ও শিক্ষিত পার্টি সদস্যদের প্রতি বিদ্বিষ্ট প্রমোদ দাশগুপ্ত কলকাঠি নেড়ে ‘অন কালচারাল ফ্রন্ট’এর প্রস্তাবক ভবা'কে বহিষ্কার করে দেন। ষাটের মধ্যপর্বে নকশাল রাজনীতি তাঁকে কিছুটা টানল তবু ঠিক স্বস্তি দিল না। নকশাল খতমের গুলি বিনিময়ের মধ্যেই নিহত হলেন নীলকণ্ঠ বাগচী ওরফে ঋত্বিক। 

কিন্তু এই প্রজ্বলনের তো একটা পরিণতি চাই। আলো। শক্তি। গতি। কেবলমাত্র ভারতীয় উপমহাদেশের চরম ট্র্যাজেডি যে পার্টিশন, তাকে কেন্দ্রে রেখে অথবা তারই অবশেসনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেই কি একজন ফিল্মমেকার পুরো জীবন বেঁচে থাকতে পারেন? ঠিক, বাঙালির জীবনকে নতুন এক ছাঁদে ঢালাই করে নিয়েছে দেশভাগ। শিয়ালদহ রেল স্টেশনের বীভৎসা, বনগাঁ সীমান্ত, যাদবপুর, দমদম, হাবরা, কুপার্স ক্যাম্প, আজাদগড়, বিজয়গড়। একেকটি জনবসতির সঙ্গে একটি ধ্বস্ত জাতির শোক ক্রোধ প্রতিরোধ ক্লেদ যন্ত্রণা সব একাকার। কিন্তু তার পরের অন্তত সিকি শতাব্দী তিনি বেঁচে ছিলেন। এর প্রতিস্পর্ধী যে নানান রঙের মানচিত্র তৈরি হয়েছিল এই বাংলায় সেখানে কি কিছুই খুঁজে পেলেন না তিনি? চলচ্চিত্র পরিচালককে ফিল্মের বিষয় নিয়ে পরামর্শ দেওয়া লেখককে লেখার বিষয় বাতলে দেওয়ার মতোই অশ্লীল ঠিকই, কিন্তু আমরা বলছি একটা প্রত্যাশার কথা। তাঁর কাছে আসলে অপার প্রত্যাশা ছিল আমাদের। তিনি তাঁর মতো করেই না হয় গড়ে পিটে নিতেন তাঁর বাস্তবকে; আমরা জানি সেইটুকুতেই তিনি তাঁর ফাল্গুনী রচনা করে তাক লাগিয়ে দিতেন আমাদের। ‘পিপাসা, হায় না মিটিল’। ১৯৭৬'এর এক ফাল্গুনী ভোরে পিজি হাসপাতালের ক্লিন্ন বিছানায় ‘জীবনের ক্লান্তি ক্ষুধা আকাঙ্ক্ষার বেদনার’ ঋণ চুকিয়ে যেদিন তিনি চলে যাচ্ছেন, সেদিন তাঁর গুটিকয় সুহৃদ ব্যতিরেকে স্তব্ধ হয়েছিল একটা জাতি, রাজধানী-ভরা নাগরিক সমাজ। পড়ে-আসা বেলার দিকে যেভাবে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে সাদা বক। ছটফটে জীবন। প্রলম্বিত এক ছায়াপথ। 

[তথ্যসূত্র: সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় (সাক্ষাৎকার), বসু আচার্য (ফেসবুক পোস্ট)]

Sunday, 3 November 2024

ভেতরের মানুষটা কেমন!

এই পথে আলো জ্বেলে

মালবিকা মিত্র



আরজি কর হাসপাতালে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি ছাত্রীর ধর্ষণ ও মৃত্যু নিয়ে সারা বাংলা এমনকি বাংলার বাইরে মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। এই প্রতিবাদের 

১) একটা বড় অংশ সরকারের বিরুদ্ধে;

২) একটি অংশ নির্দিষ্টভাবে ওই ঘটনার বিরুদ্ধে ও হাসপাতালে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার দাবিতে ও 

৩) আরেকটি অংশ সমগ্র নারী জাতির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ও চিন্তান্বিত। 

কিন্তু এই তৃতীয় ধারাটি আন্দোলনের মূলধারা থেকে ক্রমশ বিলীয়মান। তাই একটু বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। কারণ, এই তৃতীয় ধারা ধর্ষণ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার; লিঙ্গ বৈষম্য বিলোপের দাবি করে, সাধারণভাবে সর্বত্র নারী নিগ্রহ ও তার বিরুদ্ধে নারীর নিরাপত্তার পক্ষে সোচ্চার। রাত দখল আন্দোলন তো শুধু ধর্ষিতা ও খুন হওয়া ডাক্তার ছাত্রীর জন্য নয়, মেয়েদের রাত দখল। কেন মেয়েরা একা রাত্রে বেরতে পারবে না, কেন মেয়ের জন্য বাড়ির মানুষকে দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে 'এখনও কেন ফিরল না', কেন একটি মেয়েকে ভাবতে হবে, থাক আমি বার্থডে পার্টিতে যাব না, ফিরতে রাত হয়ে যাবে। এই লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে মেয়েদের রাত দখল আন্দোলন। এটাই আন্দোলনের লক্ষ্য, তিলোত্তমা উপলক্ষ মাত্র। আমি এই তৃতীয় পক্ষে অঙ্গীভূত হতে চাইলেও শেষ অবধি পারলাম না। আর সেটাই আমার মানসিক যন্ত্রণা। এমন একটি প্রতিবাদে কোথাও সামিল হতে পারলাম না। এই যন্ত্রণা প্রকাশের ভাষা নেই। 

'স্বাধীন স্বতন্ত্র' (বে)নামে একটি সংগঠন নিচের এই আবেদনটি প্রকাশ করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আগে সরকারের রোষানল থেকে আত্মরক্ষার জন্য এরকম বেনামে আত্মগোপন করতে হত। এখন উপর্যুপরি নির্বাচনে জনগণের প্রত্যাখ্যান আসার ফলে জনগণের থেকে আত্মগোপন করতে হচ্ছে নানাবিধ বেনামে:

#রাজপথে_নির্যাতিতার_পোশাক_প্রদর্শনী 

''রাত' মেয়েদের জন্য সুরক্ষিত নয়। আজ প্রায় আড়াই মাস কেটে গেলেও সরকার নারীদের দাবি নিয়ে একটি কথাও বলেনি;

আমরা যারা যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছি, ধর্ষিত হয়েছি বা ইভ-টিজ হয়েছি, তারা তাদের এলাকায় সেই বয়সের পোশাক টাঙিয়ে দিই, যে বয়সে আমরা নির্যাতিত হয়েছিলাম;

নবজাতক শিশু, কিশোরী, যুবতী, গর্ভবতী এবং প্রৌঢ়া সকলেই আমরা এই নির্যাতন এবং ধর্ষণের স্বীকার হয়েছি বারংবার; 

সরকারকে বুঝিয়ে দিই, বাংলার ৫ কোটি মেয়েদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে নির্যাতিত হয়নি। যাদের বয়স ৪ থেকে ৯০, যারা স্কুল ছাত্রী থেকে বৃদ্ধা; 

প্রতিশ্রুতি নয় সমাধান চাই।'

অর্থাৎ বলা হচ্ছে, সকল নারীই ধর্ষিতা! প্রকারান্তরে সকল পুরুষই ধর্ষক! 

সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, All men are potential rapist-- এই কথার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে potential  শব্দটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। যার অর্থ, All men have the potential to rape.। মানুষ তো মূলগত ভাবে এক জৈব সত্তা। তাই তার মধ্যে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণ, যৌন চিন্তা, চেতনা কাজ করে থাকে। ধর্ষণ করার সামর্থ্য আছে। কিন্তু একই সাথে আবার মানুষ এক সামাজিক জীব। ফলে, তার একটা সামাজিক সত্তা আছে। সেই সামাজিক সত্তার মধ্যে সে মা কাকিমা দিদি বোন স্ত্রী ইত্যাকার নানা সম্পর্কে আবদ্ধ। নানাবিধ সামাজিক উচিত-অনুচিত, শোভন-অশোভন, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি বোধ, রেওয়াজ, রীতি বিদ্যমান, সর্বোপরি একটা লজ্জা, ভয় কাজ করে। এই সামাজিক রেওয়াজ ও রীতিগুলি তাকে, তার জৈব সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে, প্রবৃত্তি থেকে বিরত করে। নানাবিধ সম্পর্কগুলি তার জৈব সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে মূলগতভাবে মানুষ অ্যানিমেল হলেও অ্যানিম্যালিটি তার মধ্যে প্রাধান্য পায় না। কিন্তু সুপ্ত থাকে। মান্না দে'র গানে এই প্রবৃত্তির একটা নমনীয় রূপ বর্ণিত আছে:

'ও কেন এত সুন্দরী হল...

অমনি করে ফিরে তাকালে, 

দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই .... 

ও কেন তখন হঠাৎ এমন এলোচুলে বাইরে এল... 

দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই 

আমি তো মানুষ।' 

কিন্তু এই মুগ্ধতা, প্রবৃত্তি এসব ছাড়াও একটা বাড়তি জিনিস, একটা নিয়ন্ত্রক, একটা সেন্সর কাজ করে। বিকৃত মানসিকতা বলতে বোঝায়, ওই সেন্সরটি যখন ঠিকমতো কাজ করে না। অধিক মাত্রায় উত্তেজক পানীয় সেবন করলে সেন্সরটি, মানে পাহারাদারটি ঝিমিয়ে পড়ে, ঠিকমতো কাজ করে না। আবার নিয়মিতভাবে উত্তেজক সেবন করার ফলে ধীরে ধীরে অকেজো, অচল হয়ে যায়, পাহারাদার সর্বদাই ঝিমোতে থাকে। এইভাবেই সেন্সরটি অচল ও বিকৃত হয়ে যায়। বেশ মনে আছে, শেষ দফার বামফ্রন্টের শাসনে অর্থমন্ত্রী দেদার দেশি-বিদেশি মদের দোকানের লাইসেন্স দিয়েছিলেন। এমনকি চাঁপদানিতে একটি নার্সারি স্কুলের পাশের প্লটে এফ এল অন শপ লাইসেন্স দিয়েছিলেন। এখন সেগুলোই বটবৃক্ষের ছায়া বিস্তার করেছে। যে কোনও স্পট থেকে মাত্র এক কিলোমিটারের মধ্যে দেশি-বিদেশি মদের দোকান পাওয়া যাবে। মদ্যপান করে গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ থাকলেও, হাইওয়ের পাশেই দু' হাত অন্তর হাজার হাজার লাইসেন্স প্রাপ্ত পানশালা দেখতে পাবেন। 

শুধু তো উত্তেজক পানীয় না, পরিবার বা পরিবেশে যদি ছোটবেলা থেকে কেউ সুন্দর সম্পর্ক না দেখে, তার কাছে উচিত অনুচিত বোধ তৈরি হয় না। শৈশব থেকেই যদি কেউ বাড়িতে যৌনাঙ্গ ও যৌন সম্পর্ক বিষয়ক আকছার কুকথা সর্বক্ষণ শুনতে থাকে, তখন তার বাচনের মধ্যে খিস্তি খেউড় অন্যায় বা অস্বাভাবিক বোধ হয় না। প্রসঙ্গত বলি, আমার প্রতিবেশী আমারই এক ছাত্রী তখন সম্ভবত ক্লাস টু'তে পড়ে। সে তার খাতার এক পৃষ্ঠায় অত্যন্ত কুরুচিকর গালিগালাজ লিখে ভর্তি করেছিল। আমি সেগুলো উচ্চারণ করতে পারব না, এমনকি আমার উপস্থিতিতে সেগুলো খুলে দেখাতে পারব না বলে পড়ানোর শেষে ছাত্রীর মাকে বলেছিলাম, 'বৌদি, মনে হয় মান্তুর কিছু সমস্যা হচ্ছে। একটু নজর দিয়ে খাতাটা দেখবেন। খুব খারাপ কথা লিখেছে, আপনি দেখলেই হবে। মারধর বকাবকি করবেন না।' পরদিন ওই ছাত্রীর পিসি হাসতে হাসতে আমাকে জানালো, 'ওইগুলি কোনও খারাপ কথা না। এইগুলি তো দাদা'রা হামেশাই কয়। তবে দিদিমণি, এইডা কিন্তু মানতেই হইব, বানান দ্যাহেন, একখানও ভুল লেখে নাই।' আর বৌদি জানালেন, 'বিয়ের পর প্রথম প্রথম এ বাড়ির কথাবার্তা শুনলে আমি লজ্জায় মুখ ঢাকতাম। মনে হত কান থেকে বুঝি রক্ত বেরিয়ে আসছে। এখন সবই সয়ে গেছে।' পরিবার পরিবেশে যা শুনছে, যা দেখছে, সেগুলোই মুখে বলছে ও কাজে করে দেখাচ্ছে।

অবাধ্য দুর্বিনীত কোনও পড়ুয়ার অভিভাবককে ডেকে পাঠিয়েছি। দুদিন পর হাজির হল সেই ছাত্রের দিদিমা। তিনি জানালেন, 'আমি বুড়ো মানুষ, আমাকে দয়া করে ডেকে পাঠাবেন না। যা করার আপনারাই করবেন।' শুনলাম, ওই শিশুর মা বিবাহ-অতিরিক্ত একটি সম্পর্কের কারণে সন্তানকে দু' বছর বয়সে ফেলে রেখে অন্যত্র গমন করেছেন। নিশ্চয়ই আমার নারীবাদ এই স্বাধীনতা অনুমোদন করে। তার বাবা এই সন্তানের কারণে আর বিয়ে করেননি। কিন্তু একটু দূরে চাকরি করেন, ফিরতে রাত হয়। জামাই খুব ভালোমানুষ। এ ধরনের সিঙ্গল পেরেন্ট চাইল্ড বা নো পেরেন্ট চাইল্ড'এর সংখ্যা ইদানীং সংখ্যায় বাড়ছে। এদের চোখে নারী-পুরুষের সম্পর্কগুলি কোন মানদন্ডে দেখা হয় ভাবুন তো। মোবাইল ও নেট দুনিয়ার দৌলতে স্মার্টফোনে নাবালক ভাই বোন ব্লু ফিল্ম দেখছে। আবার সেই ব্লু ফিল্মকে নিজেরা অনুশীলন করছে। তারপর বাড়িতে জানাজানি হবে সেই ভয়ে নাবালক ভাই নাবালক বোনের গলায় ছুরি চালাচ্ছে। 

আসলে আমি বলতে চাইছি, ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি। একটি মানসিক বিকৃতি। সেই বিকৃতির হাত ধরে এসেছে ধর্ষণ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তি নাগরিকের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। আপনি গণতান্ত্রিক সমাজে বলতে পারেন না, নাইট ক্লাব থাকবে না, আপনি গণতান্ত্রিক সমাজে বলতে পারবেন না, রাত্রে হোটেল বারে মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, এটা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের প্রশ্ন। সেই কারণেই আপনি বলতে পারেন না, মেয়েদের নাইট ডিউটি দেওয়া যাবে না। সেই কারণেই আমরা বলতে পারি না, 'মেয়ে মানুষ' লেট নাইট পার্টি করে বাড়ি ফিরবে না। এটা সমানাধিকারের প্রশ্ন, আমি এই অধিকারের প্রশ্নে একমত। 

কিন্তু স্মরণে রাখবেন, বেশ কিছু ক্ষেত্রেই এই সমানাধিকারের মধ্যেও কিছু বিশেষ অধিকার রাখতে হয়। ধরুন, কর্মস্থলে মেটারনিটি লিভ তো রাখতে হয়, সমাজের স্বার্থে। বাসে লেডিজ সিট, ট্রেনে সংরক্ষিত লেডিজ কম্পার্টমেন্ট, এসবের তো প্রয়োজন আছে। অফিসে, সিনেমা হলে, শপিং মলে পৃথক লেডিজ টয়লেট প্রয়োজন হয় না? এগুলোকে অস্বীকার করব কীভাবে? আমার দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন নারীর অধিকারের প্রশ্নে খুবই যুক্তিপূর্ণ ও বাস্তব সম্মত। তাঁর অধিকার চিন্তায় একটা পরিমিতি বোধ লক্ষ করা যায়। তিনি লিখেছিলেন, 'মেয়েদের শরীরের এবং মনের প্রকৃতি পুরুষের হইতে স্বতন্ত্র বলিয়াই তাহাদের ব্যবহারের ক্ষেত্র স্বভাবতই স্বতন্ত্র হইয়াছে। আজকাল বিদ্রোহের ঝোঁকে একদল মেয়ে এই গোড়াকার কথাটাকেই অস্বীকার করিতেছেন।'

ধরা যাক একজন নারী নাইট ক্লাব বা বারে সিংগার অথবা ড্যান্সার। তিনি ডিউটি শেষে আকন্ঠ মদ্যপান করে রাত্রি দুটোয় বাড়ি ফিরছেন। এ পর্যন্ত কিছু সমস্যা নেই। কিন্তু সেই নারীর নিজস্ব কোনও বাহন নেই, এখানেই সমস্যা শুরু। তিনি লিফট চাইলেন অন্যের গাড়িতে, পেলেন। সেই গাড়িতে চার যুবক তারাও মদ্যপ। আকন্ঠ মদ্যপান করে আছে। এবার বলুন, ওই নারী গাড়িতে ওঠার পর কি তাঁকে মাতৃজ্ঞানে ও ভগ্নীজ্ঞানে তাঁর ঠিকানায় সুযোগ-সন্ধানী মাতালরা পৌঁছে দেবে? এখানেই এসে পড়ে সূচনায় উল্লিখিত মন্তব্যটি -- 'All men have the potential to rape.'। কিন্তু তার মানেই সবাই রেপিস্ট নয়। কিন্তু বিশেষ বিশেষ কতকগুলো শর্ত যখন তার হিতাহিত জ্ঞান, কাণ্ডজ্ঞান, উচিত অনুচিত বোধ নষ্ট করে দেয়, তখন সে একজন রেপিস্ট হতে পারে। নানান কারণে এই সেন্সরটি বিকল হতে পারে। তার কয়েকটি উল্লেখ করেছি মাত্র। এই ঘৃণ্য সামাজিক অপরাধটি যে সমস্ত কারণ থেকে উদ্ভূত তার অধিকাংশই আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, নিয়ন্ত্রণে থাকে না। কিন্তু কিছু বিষয় আছে আমাদের নিয়ন্ত্রণে। 

আমি যেন কোনওমতেই প্ররোচনার কারণ না হই। কদিন আগেই মমতাশঙ্কর এরকম একটি কথা বলার কারণে যথেষ্ট ট্রোলড ও সমালোচিত হয়েছেন। এমনকি কেউ কেউ পাল্টা উস্কানিমূলক মন্তব্য ও ছবি ছেপেছেন। সেটা যার যার ভিন্ন রুচি। ভগবান বুদ্ধ গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকবেন, তার চারপাশে যতই তাকে প্ররোচনা দেওয়া হোক, এটা একটা আইডিয়াল কনসেপ্ট। ঠিক তেমনি, কেন রাত্রি দুটোয় একজন মেয়ে রাস্তায় নিরাপদ থাকবে না? রাত্রি দুটোয় শুধু তো একজন মেয়ে নয়, আমরা কেউই নিরাপদ নই। ছেলে হলে তার সর্বস্ব ছিনতাই হতে পারে। বাধা দিলে প্রাণটিও। আর মেয়ে হলে যথাসর্বস্ব, প্রাণ ও সেই সাথে তার আব্রু ইমান। রাস্তার কুকুরও বেশি রাতে আপনাকে রাস্তায় অনুমতি দেয় না। আপনি বলবেন, রাতে কেন পর্যাপ্ত পরিমাণ পুলিশ পেট্রোলিং থাকবে না? গাড়ি থামিয়ে কেন চেক করা হবে না, মদ্যপ কিনা, গাড়িতে কারা যাচ্ছে, ভেতরে কী হচ্ছে, এটা নজরদারি করা দরকার। না, সেটাও হবে না। নীতি পুলিশি? ব্যক্তিগত পরিসরে নাক গলানো? তদুপরি এত রাস্তা, এত অলিগলি, এত এত গাড়ি, পেট্রোলিং করে এই নজরদারি সম্ভব? তার চেয়ে ভালো হয় না যে, রাত্রি দশটা বা এগারোটার পর বার বন্ধ হয়ে যাবে, নাইট ক্লাব বন্ধ হবে। জানি, এই প্রস্তাবে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, নাগরিক অধিকার হৈ হৈ করে উঠবে। 

বাস্তবিক, আমরা কেউ কি নিরাপদ? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বপ্নদীপ, সে কি সুরক্ষিত ছিল? সেটা ছিল ২০২৩'এর ৯ অগস্ট। তার ওপর যা হয়েছে, তাকে নগ্ন করে তাকে দিয়ে যা যা বলানো ও করানো হয়েছে, এমন কি প্রতিষ্ঠা দিবসের নামে পিতা-মাতার দৈহিক মিলনের দিনটি পর্যন্ত তাকে দিয়ে উচ্চারণ করানো হয়েছে। এটা কি যৌনপীড়ন নয়? শোনা যায় এই সমস্ত পীড়নে সিনিয়র দাদাদের সাথে সিনিয়র দিদিরাও থাকে, মজা উপভোগ করে।  আর অনিতা দেওয়ান'এর ধর্ষণের কথাটা উচ্চারিত হয় একটি বিশেষ কারণে; ওই ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন, এ তো হতেই পারে। 

অথচ কেতুগ্রামে একটি বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। সংবাদপত্রেই পড়েছি, ডাকাতরা সেই বাড়ির সর্বস্ব টাকা পয়সা গয়না লুঠ করে। তখন বাড়ির মেয়েটি ডাকাত সর্দারের পায়ে ধরে বলে, জেঠু, আমার বিয়ের জন্য সংগ্রহ করা এইটুকুই ছিল শেষ সম্বল। এগুলো তুমি নিয়ে গেলে আমার আর বিয়ে হবে না। তোমরা বরং আমাকেও মেরে রেখে যাও। সংবাদে প্রকাশ, এরপর ডাকাত সর্দার সমস্ত সোনা দানা অর্থ ফেরত দিয়েছিল। বাড়ির সবাইকে ছেড়ে দিয়েছিল। এমনকি কিছু অতিরিক্ত টাকা-পয়সাও তাদের দিয়ে গিয়েছিল। কথা দিয়েছিল বিয়ের দিন আশীর্বাদ করতে আসবে। বোঝা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই সেন্সর নষ্ট হয়ে যায়নি। লুঠপাটের সঙ্গে অতিরিক্ত প্রাপ্তি ধর্ষণের সুযোগ তারা কিন্তু নেয়নি। 

আমার মনে হয়, সমস্যাটা নারীর অধিকার, পুরুষতন্ত্র এসব নয়। সমস্যাটা হল ভেতরের মানুষটা, তাকে তো আগে মানুষ হতে হবে, তারপর সে নারী বা পুরুষ, চোর বা পুলিশ, সাধু অথবা ডাকাত ইত্যাদি। এনআরএস মেডিকেল কলেজে ছাত্ররা যখন আধপাগল কোরপান শাহকে ধরে হোস্টেলে এনে গণ পিটুনি দিয়ে হত্যা করে, তখন তাদের পরিচয় ডাক্তার নয়, অমানুষ। তিলোত্তমার ধর্ষক তেমনি সিভিক পুলিশ নয়, একজন অমানুষ।

কী চোখে দেখি, প্রশ্নটা এইখানে। খুব তৃপ্তির সঙ্গে স্মরণ করছি, বছর দশ আগের একটি ঘটনা। এপিডিআর'এর এক সভায় আমার এক দাদা স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীকে বলেছিলাম, 'কত দিন পরে দেখা। তোমাকে দেখতে খুব ভালো লাগছে।' সেই দাদা শুনে মুচকি হাসল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য এক মানবাধিকার কর্মী দাদাকে বলল, 'তুমি কেমন আশ্চর্য মানুষ গো! মালবিকার মতো একজন ভদ্রমহিলা তোমাকে সুন্দর বলছে, আর তুমি একটুও কোনও প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে রামগরুড়ের ছানা?' সেই দাদা বলেছিল, 'আমি মালবিকাকে একজন মেয়ে হিসেবে দেখি না, দেখি বোন হিসেবে। আর ও আমাকে পুরুষ হিসেবে নয়, দাদা হিসেবেই দেখে।' এই কমপ্লিমেন্ট আমি কোনওদিন ভুলব না। আর দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা যদি সামাজিক সমস্যা হয়, তাহলে আপনি নিশ্চিত জানবেন, দাদা কাকা দাদু এদের কাছে যেমন চার বছরের শিশুকন্যাটি নিরাপদ নয়, ইচ্ছাকৃত ভাবেই তাদের এখানে সেখানে স্পর্শ করা হয়, ঠিক তেমনি দিদি মা কাকিমা ঠাকুমার হাতেও চার বছরের শিশু পুত্রটিও খুব নিরাপদ নয়। শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ক একটি টিভি সিরিয়ালের একটি এপিসোড একদিন হঠাৎই চোখে পড়ে যায়। দেখি, খুব ছোটবেলায় কৃষ্ণকে মানে গোপালকে নিয়ে পাড়ার কাকিমা পিসিমা দিদি মামীমা'দের অদ্ভুত ধরনের আদর করার হিড়িক ও চোখে পড়ার মতো কিছু কার্যকলাপ। দেখে বুঝেছিলাম, শৈশবে যার এই ধরনের অভিজ্ঞতা, সে তো পুকুর পাড়ে অন্যদের বস্ত্রহরণ করবেই। পাড়ায় বা কোনও কলেজে একটু গোবেচারা শান্তশিষ্ট ছেলেকে নিয়ে মেয়েরা কেমন আলোচনা ও খোরাক তৈরি করে সে অভিজ্ঞতাও অনেকের আছে। আসলে ওই যে একটা ম্যাচো ফিগার, উন্মুক্ত সারা গায়ে লিপস্টিকের দাগ, চুম্বনের লক্ষণ বহন-- এসব তো বিপরীতমুখী ধর্ষণের ভাষ্য নির্মাণের চেষ্টা। আজকাল সিনেমায় যেমন অপ্রয়োজনে, জোর করে গালাগালি খিস্তি সংলাপের মধ্যে ব্যবহার করা হয়। আবার মহিলা চরিত্রকে দিয়ে সেগুলো বেশি উচ্চারণ করানো যেন একটা দ্বিগুণ সার্থকতা। 

কিন্তু এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ধর্ষণের রাজনৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি। এটা আমার চোখে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক। কারণ, এই রাজনীতি ও রাজনৈতিক দর্শন নারী ধর্ষণকে একটা বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে। ধর্ষণকারীকে বীর নায়ক সাজানো হয়। সেই ধর্ষক নায়ককে গলায় মালা পরানো, তাকে মিষ্টি মুখ করানো, বরণ করা হয়। ভি ডি সাভারকার লিখেছেন, আমরা গর্বের সঙ্গে ছত্রপতি শিবাজী এবং  চিমজি আপ্পার উল্লেখ করি যে, তারা যুদ্ধ জয়লাভের পরেও সসম্মানে কল্যাণের মুসলমান শাসনকর্তার গৃহবধূ এবং বেসিনের পর্তুগীজ শাসনকর্তার স্ত্রীকে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। সাভারকার বিস্মিত হয়ে মন্তব্য করছেন, শিবাজী মহারাজ বা চিমজী আপ্পা কি করে ভুলে গেলেন, গজনির মাহমুদ, মোহাম্মদ ঘোরি, আলাউদ্দিন খিলজী এই সমস্ত মুসলমান শাসকদের কথা, যারা হাজার হাজার হিন্দু নারীর উপর শারীরিক অত্যাচার ও পীড়ন করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁর বক্তব্যে উহ্য এই অভিযোগ যে, কেন শিবাজী বা চিমজি মুসলিম নারীদের ধর্ষণ না করে ছেড়ে দিলেন।

বিজেপি, আরএসএস'এর রাজনৈতিক কর্মসূচি, দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শনে বিধর্মীর ওপর, বিশেষভাবে মুসলিম মহিলার উপর ধর্ষণ ও হত্যা একটি স্বীকৃত ঘোষিত নীতি। এই কারণেই গুজরাত দাঙ্গায় বিলকিস বানো'র পরিবারের সকলের হত্যাকারী ও ধর্ষক দশজন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী গুজরাত সরকারের নির্দেশে মুক্তি লাভ করে। পার্টি তখন তাদের মিষ্টিমুখ করিয়ে, ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে নেয়। একইভাবে সাংসদ ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে দেশের অলিম্পিক পদকজয়ী সোনার মেয়েরা যখন শ্লীলতাহানির অভিযোগ করে, তারপরেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এমনকি ব্রিজভূষণ প্রধানমন্ত্রীর পাশে সংসদে উপবিষ্ট থাকেন। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির ছাত্রী গণধর্ষিতা হলে ধর্ষণকারী ছাত্রদের পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে না। কারণ, অভিযুক্ত ছাত্রদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে। তারপর যদি বা দু' মাস পর তাদের গ্রেফতার করা হল, সাত মাসের মধ্যে জামিনে মুক্ত হয়ে গেল। কারণ, ওই অভিযুক্তরা বিজেপির আইটি সেলের নেতা। একই কথা বলা চলে মণিপুরের ক্ষেত্রে। সেই রাজ্যে এক বছরের বেশি সময় ধরে চলেছে জাতি দাঙ্গা। ৩৭টির বেশি ধর্ষণের ঘটনা এফআইআর হয়েছে। এফআইআর না হওয়া ঘটনার সংখ্যা অজস্র। মহিলাদের সেখানে নগ্ন করে প্রকাশ্যে প্যারেড করানো হয়েছে, সে সব ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। 

এই পরিস্থিতিতে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, নারী সুরক্ষা এই সমস্ত প্রশ্নে আমার কাছে প্রধান হল, 

১) উল্লিখিত রাজনৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি। এটা শুধুমাত্র নারী ধর্ষণ ও নারী পীড়ন ঘটায় না, ঘটনাকে দার্শনিক বৈধতা দেয়। অতএব, তা সবচেয়ে বেশি বিপদজনক। একে যে কোনও মূল্যে প্রতিহত করা প্রয়োজন। এটা প্রতিহত না হলে সামাজিক আন্দোলন এগোতে পারবে না;

২) নারী সুরক্ষা ও নিরাপত্তার যাবতীয় বন্দোবস্ত ও সেই সংক্রান্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিশ্চয়ই সমর্থনযোগ্য ও আশু প্রয়োজন;

৩) নারী সম্পর্কে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন ঘটানো। অর্থাৎ, গোড়া থেকে সমস্যায় নাড়া দেওয়া চাই। এর জন্য এক দীর্ঘস্থায়ী জীবন দর্শন, মনোভাব, সংস্কৃতি গড়ে তোলা দরকার। ওটা সরকারের কাছে জবাব চাওয়ার বিষয় নয়।

'কে তুমি নন্দিনী আগে তো দেখিনি' যদি বিনোদন হয়, তাহলে আঁচল ধরে টান পড়বে, অর্থবান সুপুত্তুর টেনে গাড়িতে তুলবে, ফার্ম হাউসেও নিয়ে যাবে। একদম গোড়াতেই এর বিনাশ দরকার। হুগলি ডিএম'স রিক্রিয়েশন ক্লাবের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী সঙ্গীত ছিল 'জীবনে কি পাব না, ভুলেছি সে ভাবনা'। সেটা ২০০৪-০৫ সালের কথা। সঙ্গে অবশ্য নাটক ছিল 'ফেরারী ফৌজ'। ক্যাবারে  থাকবে, বার থাকবে, দ্রোহের নাটক থাকবে আর মাতাল লিঙ্গ সাম্যে আস্থাবান হবে, এটা অতি কাল্পনিক। তবুও আমি মানুষের সুবুদ্ধির উপরেই আজও আস্থাবান। ১৪০ কোটির দেশে অন্তত একজন তো বলেছিল, মালবিকাকে আমি মহিলা হিসেবে দেখি না, ও আমার বোন। এইটুকুই আমার কাছে আশাব্যঞ্জক। এই পথেই তাই ক্রমমুক্তির আশ্বাস।


Wednesday, 23 October 2024

প্রাপ্তিও কিছু আছে!

সব আন্দোলনেরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে 

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য



দেখা গেল, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর পরই ও অভয়া'র মা-বাবার অনুরোধে জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা আমরণ অনশন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিত্ব যারপরনাই বিরক্ত ও হতাশ হয়েছে। বোঝা ভার, তারা ঠিক কী চাইছিলেন জুনিয়র ডাক্তারদের এই সংঘবদ্ধ আন্দোলন থেকে। তবে কেউ কেউ যে এর মধ্যে এক ঘোরতর বিপ্লব সংগঠিত করে ফেলার যথেষ্ট উপাদান পাচ্ছিলেন, তা অমূলক হলেও দৃশ্যত অস্পষ্ট ছিল না। কেউ কেউ আবার দিবাস্বপ্ন দেখছিলেন যে, বাংলাদেশ স্টাইলে নবান্ন'র ছাদ থেকে হেলিকপ্টারে চড়ে মুখ্যমন্ত্রী পগার পার হবেন। এইসব অপরিণত, বালখিল্য আচরণে তিলোত্তমার সুবিচার ও লিঙ্গ সাম্যের দাবি এবং জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনে উত্থাপিত-- যদিচ কিছুটা প্রচ্ছন্নে থাকা-- জনস্বাস্থ্যের লক্ষ্যে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের দাবি কতকটা যেন আড়ালে চলে যাচ্ছিল।

অথচ, ৯ অগস্ট পরবর্তী ঘটনাবলী কিন্তু গোটা রাজ্য জুড়ে তিনটি অভিমুখকে বর্শাফলকের মতো ক্ষুরধার করেছিল: 

এক) অভয়া'র নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরিণতিতে জনমানসে এক তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি হেতু নাগরিক ক্ষোভের স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরণ; 

দুই) আরজিকর ও অন্যান্য সরকারি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে চূড়ান্ত দুর্নীতি ও অপকর্মের বিরুদ্ধে মেডিকেল ছাত্র-ছাত্রী ও জুনিয়র ডাক্তারদের দীর্ঘদিনের তীব্র অসন্তোষের এক ব্যাপক ও সুসংগঠিত আত্মপ্রকাশ; 

তিন) এই দুই গণবিক্ষোভের আবহে নাগরিক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির তৎপরতা।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, যেখানে নিরাপত্তার সর্বোচ্চ গ্যারান্টি কাম্য, সেখানে এক কর্মরত চিকিৎসকের ওপরে এমন এক নিদারুণ অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ডে সরকার ও তার প্রশাসনের কাঁধেই নৈতিক ও রাজনৈতিক দায় এসে পড়ে। সে অর্থে যে কোনও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও শাসক ও সরকারি দলের বিরুদ্ধেই প্রাথমিক ভাবে ধাবিত হয়। আর এ ব্যাপারে, বিশেষত দুর্নীতি প্রসঙ্গে এ রাজ্যে শাসক দলের যে বেশ দুর্নাম আছে, তাও অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই, ১৪ অগস্টের মধ্যরাতে যখন রাজ্য জুড়ে অন্তত ৩৫০'এরও বেশি জায়গায় লক্ষাধিক সাধারণ মানুষের, বিশেষত মহিলাদের তীব্র রোষ রাজপথে আছড়ে পড়ল, তা ড্যাবড্যাবে চোখে দেখা ছাড়া সরকারপক্ষ ও শাসক দলের আর কোনও উপায়ও ছিল না। তারা ইতিমধ্যে দেওয়াল লিখনও পড়ে ফেলেছে, আর তা যে একেবারেই তাদের পক্ষে স্বস্তিদায়ক নয়, তা বুঝতেও তাদের দেরি হয়নি। ইতিমধ্যে আরজিকরের জুনিয়র ডাক্তারেরাও সংগঠিত হয়ে ময়দানে নেমে পড়েছেন, তাদের পাশে অন্যান্য হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তারেরা ধীরে ধীরে সামিল হতে থেকেছেন। নিহত চিকিৎসকের মা-বাবা কলকাতা হাইকোর্টে সিবিআই তদন্তের দাবি করে তার মঞ্জুরি পেয়েছেন আর এসবের মাঝেই, আইএমএ'এর দৃষ্টি আকর্ষণ হেতু শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি গোটা বিষয়টিকে স্যুয়ো-মোটো নিজেদের এক্তিয়ারে নিয়ে এসেছেন।

তখন চারিদিকে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে আরজিকর নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা। মেইনস্ট্রিম ও সোশ্যাল মিডিয়া ভরে উঠছে কিছু সত্যের সঙ্গে মিথ্যার নানা অতিকথনে, এমনকি পাগলের প্রলাপেও। মানুষ কিছুটা ক্ষিপ্ত ও বিভ্রান্ত। শাসক দল নিজেদের দায়কে হাল্কা করতে নানারকম প্রশাসনিক পদক্ষেপ সহ দলীয় স্তরেও নানা উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। তবে তদন্তভার সিবিআই'এর হাতে চলে যেতেই শাসক আস্তে আস্তে নিজেদের কিছুটা গুটিয়ে নেয় এবং মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা দেন যে, আরজিকর বিষয়ে সরকারের তরফে যা বলার তা একমাত্র তিনিই বলবেন। পাশাপাশি, ১৪ অগস্টের 'রাত দখলের' অভূতপূর্ব সাফল্যের পর 'নাগরিক সমাজ' ও বিবিধ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নামে ইতস্তত আরও কয়েকটি 'রাত দখল' এদিক ওদিক সংগঠিত হয়, কিন্তু ক্রমান্বয়ে দেখা যায়, জমায়েত ও গণ অংশগ্রহণের গুনতি কমে আসছে। কিন্তু নাছোড়বান্দা কিছু বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি সোশ্যাল মিডিয়ার কয়েকজন ইউটিউবারদের দিয়ে রাতারাতি এক 'ছাত্র সমাজ' বানিয়ে ২৭ অগস্ট 'দফা এক দাবি এক/ মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ' শ্লোগান তুলে 'নবান্ন দখলের' ডাক দেয়; যদিও, পর্বতের মূষিক প্রসবের মতো কলকাতা শহরের ইতিউতি কয়েকশো লোকের বিচ্ছিন্ন দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও পুলিশের টিয়ার গ্যাস, জলকামান সহযোগে তার অকাল প্রয়াণ ঘটে। ইতিমধ্যে দানা বেঁধে ওঠা জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনকারীরাও জানিয়ে দেন যে, তাঁরা ওই 'নবান্ন দখল' অভিযানে একেবারেই নেই। 

তবে ইতোমধ্যে, জুনিয়র ডাক্তাররা এই কদিনে নিজেদের বেশ সংগঠিত করে ফেলেছেন এবং ১৪ অগস্ট আরজিকরে মধ্যরাতে বহিরাগত দুষ্কৃতীদের তাণ্ডবের পর পাঁচ দফা দাবি নিয়ে এক সর্বাত্মক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন; শুরু হয় অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি। সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা এক চ্যালেঞ্জের মুখে এসে পড়ে। তাদের আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়ায় সর্বস্তরের চিকিৎসক সমাজ। কর্পোরেট ও বেসরকারি হাসপাতালগুলি এতে উৎসাহ পায় এবং কর্মবিরতির কারণে সরকারি চিকিৎসা অপ্রতুল হয়ে পড়ায় অল্প কয়েক দিনেই তাদের ব্যবসা প্রায় ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে যায়। এ কথা স্বীকার করে নেওয়া ভাল, এ রাজ্যে গত কয়েক বছরে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা আগের থেকে কিছু উন্নত হয়েছে, নিখরচায় সে পরিষেবা পাওয়ার নানাবিধ ব্যবস্থাদিও গড়ে উঠেছে, ফলে, স্বাস্থ্য দুনিয়ার মুনাফাবাজদের একটা মতলবই ছিল এই সরকারি ব্যবস্থাদিগুলিকে পঙ্গু করে দেওয়ার। জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলন ও তাদের কর্মবিরতি তাদের সামনে সেই সুযোগকে 'পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা'র মতো এনে দিল। ফলে, কর্পোরেট হাসপাতাল, ফার্মা লবি ও স্বাস্থ্য বীমা কোম্পানিগুলি এই সুযোগকে ষোলোআনা উশুল করতে কোনও চেষ্টারই কসুর করতে বাকী রাখল না। সরকারি হাসপাতালে রোগী পরিষেবার ঘাটতি ও হয়রানি উত্তরোত্তর বেড়েই চলল। বিনা চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগও উঠল।

কিন্তু এমন কঠোর পরিস্থিতিতেও, এমনকি শীর্ষ আদালতের নির্দেশে জুনিয়র ডাক্তারেরা কর্মবিরতি না তুললে সরকারের তরফ থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলে আদালতের কিছু করার থাকবে না-- এই মোতাবেক হুকুম থাকা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার আলাপ-আলোচনার পথকেই বেছে নিল এবং দু-তিনবারের ব্যর্থ চেষ্টার পর সে আলোচনা প্রথম দফায় মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে সম্পন্নও হল। পাঁচ দফা দাবির প্রায় সবই মেনে নেওয়া হল (স্বাস্থ্য সচিবের অপসারণের দাবি ব্যতীত)। জুনিয়র ডাক্তাররা কর্মবিরতি তুলে নিলেন। কিন্তু আবারও দশ দফা দাবি সহ তারা ফিরে এলেন এবং কলকাতার কেন্দ্রস্থল ধর্মতলায় আমরণ অনশনে বসে পড়লেন। সেও কয়েকদিন গড়াল। তারপর আমরা জানি, ওই দশ দফা দাবির মধ্যেও (এক-দেড়খানা বাদ দিলে) প্রায় সবকটি মেনে নেওয়া হয়েছে এবং জুনিয়র ডাক্তাররা অনশন প্রত্যাহার করে আবারও কাজে ফিরে গেছেন।

কিন্তু প্রশ্ন হল, এত সব কিছুর পর, সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ (বা রোগী) ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মী-- উভয়ে উভয়ের দিক থেকে কি কিছু আদায় করতে পারলেন? অবশ্যই কিছু পারলেন; হয়তো সে পারা বা পাওয়ার মধ্যে সব-পাওয়া নেই, কিন্তু বেশ কিছু নতুন ও উল্লেখযোগ্য পাওয়া আছে বৈকি! আসুন, এক এক করে খানিক দেখে নেওয়া যাক:

১) নাগরিক সমাজ ও জুনিয়র ডাক্তারদের এই লাগাতার আন্দোলনের ফলেই তো সিবিআই আরও বেশি তৎপর হয়েছে এবং ৫৮ দিনের মাথায় শিয়ালদহ আদালতে প্রাথমিক চার্জশিট জমা দিয়েছে। ৪ নভেম্বর এই মামলার চার্জশিট পরবর্তী প্রথম শুনানি;

২) শীর্ষ আদালতের স্বতঃপ্রণোদিত হস্তক্ষেপে জাতীয় ও রাজ্য স্তরে বিশেষ টাস্ক ফোর্স গঠিত হয়েছে যারা স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কর্মরত সমস্ত কর্মীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়টিকে দেখভাল করবে। ২১ অক্টোবর মুখ্যমন্ত্রী ও জুনিয়র ডাক্তারদের বৈঠক থেকেও রাজ্য টাস্ক ফোর্সে ডাক্তারদের প্রতিনিধিত্বকে সুনিশ্চিত করা হয়েছে (জুনিয়র ডাক্তারদের জোরালো দাবিতে) এবং ইতিমধ্যেই সরকারের তরফে সে সম্পর্কে নির্দেশাবলীও প্রকাশ পেয়েছে;

৩) সব থেকে বড় পাওনা, যা জুনিয়র ডাক্তারদের দশ দফা দাবির মধ্যে ছিল, কেন্দ্রীয় রেফারেল ও ডিজিটাল বেড ভ্যাকেন্সি ব্যবস্থার প্রবর্তন। এই দ্বি-ব্যবস্থা শুধু ডাক্তারদের তরফে সুচিকিৎসা প্রদানকেই সুনিশ্চিত করবে না, রোগীদের অযথা হয়রানি ও ভর্তি সংক্রান্ত নানান দুর্নীতিকেও প্রতিরোধ করবে। সরকারের তরফে জানানোও হয়েছে, এই দুই ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই পাইলট আকারে পরীক্ষামূলক স্তরে রয়েছে, যা ১ নভেম্বর থেকে গোটা রাজ্যে চালু হয়ে যাবে;

৪) স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি রোধে আরও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে তোলা হয়েছিল-- কলেজে কলেজে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন, অর্থাৎ, নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র সংসদ সহ সমস্ত গণতান্ত্রিক কাঠামোয় প্রতিনিধি চয়ন। এ বিষয়েও উভয় পক্ষ সহমতে পৌঁছেছে এবং মার্চ ২০২৫'এর মধ্যে নির্ধারিত নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে সরকারের তরফে প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে;

৫) স্বাস্থ্য পরিষেবায় সমস্ত শূন্য পদগুলি পূরণ করাও ছিল একটি অন্যতম দাবি, যা নীতিগত ভাবে সরকার মেনে নিয়েছে, কিন্তু ওবিসি সংক্রান্ত আদালতের একটি নির্দেশ ও তার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে দায়ের করা মামলায় ব্যাপারটা আপাতত আইনি গেরোয় ফেঁসে আছে। আইনি জট খুলে গেলে এ ক্ষেত্রেও সদর্থক পদক্ষপ দেখা যাবে বলে উভয় পক্ষ আশা রেখেছে বলে মনে হয়।

নির্দিষ্ট ভাবে এই প্রাপ্তিগুলো কিন্তু কম কিছু নয়। যে সমস্ত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজের একাংশ, যারা কোনওভাবেই সরকারি হাসপাতালের দোরগোড়া অবধিও যান না, অর্থের জোরে স্বাস্থ্য পরিষেবা কিনে গর্ব প্রকাশ করেন, তাদের কাছে এই দাবিগুলির হয়তো কোনও অর্থই নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষ ও নিত্যভোগী যারা সরকারি পরিষেবায় চক্কর কাটেন, তাদের কাছে এই প্রাপ্তি অমূল্য। এই প্রাপ্তিগুলিতে (বিশেষত উপরে উল্লিখিত ৩ নং প্রাপ্তিটি) সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরও উন্নত হবে বলে আশা করা যায়।

তবে এর মধ্যেও দুটি কাঁটা যেন রয়ে গেল:

১) 'থ্রেট কালচার'এর নামে কলেজ একাডেমিক কাউন্সিলের নির্দেশে কলেজ থেকে ডজন ডজন ছাত্র বা জুনিয়র ডাক্তার বহিষ্কারের নীতি-নৈতিকতার এক্তিয়ার কতটা, তা নিয়ে ২১ অক্টোবরের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন শুধু তাই নয়, পরের দিন কলকাতা হাইকোর্টও আরজিকর থেকে ৫১ জন শাস্তিপ্রাপ্ত ছাত্র ও জুনিয়র ডাক্তারের ওপর শাস্তি রদ করে একই প্রশ্ন তুলে রাজ্য সরকারের কাছে তা বিচার ও সিদ্ধান্তের জন্য পাঠাতে নির্দেশ দিয়েছে;  

২) জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতির সময় তাদের যে ৫৬৩ জন বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করে অর্থ কামিয়েছেন, তথ্য হাতে মুখ্যমন্ত্রীর তোলা এই অভিযোগের জবাব এখনও কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারদের তরফ থেকে পাওয়া যায়নি।

এ ব্যতিরেকে, অভয়ার সুবিচারের দাবিতে জনসমাজের সোচ্চার আওয়াজ, কাজে নিরাপত্তা, গণতান্ত্রিকীকরণ ও রোগীদের সুচিকিৎসার দাবিতে জুনিয়র ডাক্তারদের জোরদার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, অন্যদিকে, আন্দোলনের প্রতি সরকারের ধৈর্য, নিজেদের গাফিলতির দায়কে প্রকারান্তরে স্বীকার করে নমনীয়তা অবলম্বন ও কোনওভাবেই দমন-পীড়নের পথে না হেঁটে গণতান্ত্রিক উপায়ে সমস্যা নিরসনের চেষ্টা-- উদ্ভুত সমস্যাকে কিছুটা হলেও সমাধানের দিকে এগোতে সাহায্য করেছে।     

কিন্তু তার মানে এও নয় যে, সব কিছু মিটে গেল। আন্দোলনের যেমন শুরু ও বিরতি থাকে, নানাবিধ ওঠানামাও থাকে, শাসকের তরফেও তাকে মোকাবিলার নানান তরিকা থাকে; প্রশ্নটা হল, বিপরীত দিক থেকে ধাবিত শাসক ও শাসিতের এই দুই প্রক্রিয়া কি উভয়ের পক্ষে ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছে, নাকি, সেখানে বোঝাপড়ার জায়গা থাকছে। এই দ্বান্দ্বিক নিয়ম যারা বোঝেন না, তারাই 'থ্রেট কালচারের' আসল তল্পিবাহক হন এবং 'ট্রোলিং' ও 'বুলিং'এর মাস্টারমাইন্ড হিসেবে জনবিচ্ছিন্ন মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে নিজেদের এজেন্ডাকে কোথাও অনুমোদন না করাতে পেরে খিস্তিখেউড় আর হিংসাকে অবলম্বন করে হতাশায় দিন কাটান।