Wednesday, 2 July 2025

অতঃপর?

রাজনৈতিক ভাবনা ও অনুশীলনকেই পাল্টাতে হবে

উত্তাল ঘোষ



কল্পনাও করতে পারিনি, এরকম দুর্দান্ত কিছু ঘটে গেলে আমরা আত্মহারা হয়ে পড়ি। যেমন, ১৯৮৩ সালে বিশ্বকাপ জেতার পর জুনের গরমেও অনেকে ক্রিকেট খেলতে নেমে পড়েছিলাম।

কল্পনাও করতে পারিনি, এরকম ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে গেলে স্নায়ু অবশ হয়ে যায়, রাগ হয়, চিৎকার করতে ইচ্ছে করে, সব ভেঙেচুরে ফেলার ইচ্ছে হয়। যেমন, সাউথ ক্যালকাটা ল' কলেজের মধ্যেই এক ছাত্রী গণধর্ষিতা হওয়ার খবর জানার পর হয়েছে। যেমন হয়েছিল আরজি কর মেডিক্যালের ভিতরেই ডাক্তারি ছাত্রীকে ধর্ষণ-খুনের কথা জানার পর। অথবা, কালীগঞ্জে বোমার আঘাতে ন' বছরের নাবালিকার মৃত্যুতে।

দেখবেন, আরজি করের ঘটনা যেমন রাস্তায় মানুষের ঢল নামিয়েছিল, কসবার ঘটনায় তা হয়নি। কারণ, আরজি কর আন্দোলন ফলপ্রসূ হয়নি। যদিও ওই ঘটনার পর পরই কিন্তু দলে দলে মানুষ পথে নামেননি। নেমেছিলেন ৫ দিন পর জনৈক রিমঝিম সিনহার ডাকে আলোড়িত হয়ে। সে আলোড়ন ছিল নারী নিরাপত্তার দাবিতে। তারপর? বিজেপি ঠেক না পেয়ে সরে গেল। সিপিএম-সহ বামেরা রাশ হাতে নিয়ে নারী নিরাপত্তার বৃহত্তর আঙ্গিক থেকে আন্দোলনকে স্রেফ ঘটনার মধ্যে আটকে ফেলল। সিস্টেম সব সামলে নিল। 

যাঁরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খবর রাখেন, তাঁরা জানেন কসবার ঘটনা ঘটারই ছিল। কলকাতাতেই যদি এসব হয় তাহলে গ্রামের ছবিটা কেমন বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সেরকম কয়েকটা ঘটনার কথা কানে এলেও তেমন আন্দোলিত হয় না মধ্যবিত্ত মন। দৈন্য আমাদের চিন্তার। আমরা সব কিছুকেই রাজনৈতিক দলের ছাঁচে দেখতে অভ্যস্ত। তার ফল কী হয়, তা আরজি করের ঘটনার পর দেখেছি। কসবার ঘটনাতে নির্যাতিতা ও অভিযুক্ত তিনজনই তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সদস্য। কষে তৃণমূলকে গালমন্দ শুরু হয়েছে। তৃণমূল বলছে, পুলিশ তো সবাইকে গ্রেফতার করেছে। তৃণমূল আঙুল তুলছে বিজেপি-সিপিএমের দিকে। রাশ কার হাতে থাকবে তা নিয়ে কসবার কলেজের সামনে 'রাত দখল' আন্দোলনকারীদের ওপর বিজেপি হামলা চালিয়েছে। নীতি-নৈতিকতার জন্য নয়, সবই ভোটের জন্য। সেখানে রাজনৈতিক দলের আওয়াজই শুধু শোনা যায়। আমজনতার কথা হারিয়ে যায়। আমজনতার অনেকে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাষাতেই বলতে শুরু করে। দলীয় রাজনীতির সেই ভাষায় তর্কাতর্কি করতে করতেই রাগ সব বেরিয়ে যায়। আরজি কর, কালীগঞ্জ, কসবার মতো আরও ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটার ভয় নিয়ে আমজনতার বড় অংশ বোবা হয়ে যায়। সিস্টেম দিব্যি বেঁচেবর্তে থাকে।

রাজনীতি নির্ভর করে অর্থনীতির উপর। মূলত অর্থনীতির উপরই নির্ভর করে সমাজ ও রাজনীতির নীতি-নৈতিকতা বোধ। ১৯৯১ সালে আমাদের মতো দেশে বাজার অর্থনীতির দরজা হাট করে খুলে দেওয়া হয়েছে। বাজার অর্থনীতি মানে তো ভোগ-লোভ ও আরও মুনাফার আকাঙ্ক্ষা। খেয়াল করলে দেখা যাবে, বাজার অর্থনীতির দরজা খোলার পর থেকেই ধীরে ধীরে সামাজিক মূল্যবোধ-নীতি-নৈতিকতা পাল্টে যাচ্ছে। রাজনীতিতেও তার ছাপ পড়তে বাধ্য। পড়ছেও। বাজার অর্থনীতি মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলোর কোনও সমাধান করতে পারে না। কিন্তু চকচকে প্রচার আমজনতার মনকে সে সব থেকে সরিয়ে ভোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ভোগের সঙ্গেই তো জড়িয়ে থাকে লোভ-লালসা ও শুধুমাত্র নিজেকে নিয়ে বাঁচা। মনে থাকবে, আগে মাস্তানদের একটা রবিনহুড-মনোভাব ছিল। তারা কেউ মহিলাদের অসম্মান করেছে এরকম উদাহরণ প্রায় নেই। এখন আর মাস্তান নেই, এখন সব মাফিয়া ডন। তারা পারে না এমন কোনও কাজ নেই।

যে কোনও ভাবে ভোটে জিততে হবে, এটাও তো একটা লোভ। ভোগবাদী মুনাফাসর্বস্ব রাজনীতির অনিবার্য ফল। ভোটে জিততে হলে কী লাগবে? মানি পাওয়ার, মাসল পাওয়ার।

কসবার কলেজের ঘটনা সম্পর্কে অনেকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার কথা বলছেন। বাম জমানায় একটা সময়ের পর থেকে নির্বাচন হত? নাকি গায়ের জোরে প্রতিপক্ষকে ভোটে লড়তে না দিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছাত্র সংসদ দখল হত? টাকা নিয়ে ভর্তি হত না? ছাত্র সংসদের টাকা খরচে দুর্নীতি হত না?  সে সময় এসএফআই রাজ্য সম্মেলনের রিপোর্ট দেখলেই বোঝা যাবে, নেতারা সব জানতেন। তবু সে সব অপকর্ম চলতেই থাকত। ক্ষমতা দখলে রাখতে হবে। তাই নেতারাও বদলের চেষ্টা করতেন না। 

বাম জমানায় নেতারা বুদ্ধি করে রেখেঢেকে চলতে পারতেন। সোশ্যাল মিডিয়া, অডিও ভিসুয়াল মিডিয়া না থাকায় জানাজানিও কম হত। তার চেয়েও বড় কথা, বাজার অর্থনীতির দর্শন রাজনীতিকে পুরোপুরি গিলে খেতে পারেনি। বামেরা যাওয়ার পর রাজনীতির রাশ বহু জায়গায় চলে গেল লুম্পেনদের হাতে। আগে নেতারা গুণ্ডাদের ব্যবহার করত। ভোটে জেতাটাই যত বেশি রাজনীতির মোক্ষ হল ততই গুণ্ডাদের হাতে চলে গেল রাজনীতির রাশ। এর শুরু সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জমানা থেকে হলেও বাম আমলে এর বিস্তার ঘটেছে, এখন বিষবৃক্ষ হয়ে গেছে। তার ফল ঝরে ঝরে পড়ছে। আরও পড়বে।

বলাই বাহুল্য, আমাদের রাজ্যে সমাজ জীবন পুরোপুরি রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রিত। এটা বাম জমানাতেই শুরু হয়েছে, তৃণমূল জমানায় এই পার্টিশিল্প আরও পোক্ত হয়েছে। পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমজনতার বাঁচা-মরা, বিশেষত গ্রামে। তার সঙ্গে যোগ করুন এই ভোগ-লোভের-ভোটসর্বস্ব রাজনীতি। তাহলেই বোঝা সম্ভব কসবার কলেজের মনোজিৎ মিশ্ররা জন্ম নেয় কী ভাবে। যে ছেলেটা অপকর্মের জন্য কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়, যে কথা টিএমসিপি ইউনিট সভাপতি দলের উচ্চতম নেতৃত্বকেও জানিয়েছিলেন, সেই ছেলেটিই আবার কলেজে ভর্তি হওয়ার অনুমতি ও পরবর্তীতে অস্থায়ী কর্মীর চাকরি পায় কী করে? সে জন্য তো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি লাগে। হাত কতটা লম্বা সেটা পরিস্কার। এখন গ্রেফতারের পর হাত ধুয়ে ফেলার খেলা চলছে? 

রোগটা কোনও দলের নয়, রোগটা সিস্টেমের। সব রাজনৈতিক দলই এই সিস্টেমের অংশ। আপনি তৃণমূলের দিকে আঙুল তুললে তৃণমূল বলবে, হাথরাস-উন্নাও-কাঠুয়া-বিলকিস বানু-মনিপুর-কার্তিক মহারাজ-প্রজ্জ্বল রেভান্না-বানতলা-ধানতলা-মণীষা মুখার্জি-সুশান্ত ঘোষ-আরও কত কিছু। আসল কথা হারিয়ে যাবে। আসল কথা এই সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করার মতো বিকল্প রাজনীতি, বিপক্ষকে গালাগাল করার নেতিবাচক রাজনীতির বদলে চাই ইতিবাচক রাজনীতি।

আমিও ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম। আমাদের কলেজের শিক্ষাগত মান খুব একটা ভাল ছিল না। আমরা ঠিক করেছিলাম, ৬৫ শতাংশ উপস্থিতি না থাকলে কেউ পরীক্ষা দিতে পারবে না। একবার ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতি ৬৫ শতাংশ ছিল না। তিনি পরীক্ষা দিতে পারেননি। সব অধ্যাপকই জানতেন ছেলেটি নিয়মিত কলেজে যেত। ছাত্র সংসদের কাজ করতে গিয়ে ক্লাসে যেতে পারত না। আমরা তাঁকে ছাড় দিতে বলিনি। আমাদের কলেজের শিক্ষার মান ক্রমশ বাড়তে বাড়তে কলকাতার সামনের সারির কলেজে পরিণত হয়েছিল। সিপিএম-কংগ্রেস-নকশাল সব মনোভাবের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা এই কাজে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছিলেন। ছাত্র সংসদের ভোট হত। মারধর-মারামারি হত। কিন্তু ভোটের পর বিরুদ্ধ ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের সঙ্গে কোনও তিক্ততা থাকত না।

এসএফআই দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায় বেশ দুর্বল ছিল। আমি সম্পাদক থাকার সময় আমরা জেলার শিক্ষাগত উন্নয়নের দাবিকে সামনে রেখে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম। তৃণমূল কর্মী হিসেবে কাজ করা শিক্ষকরাও ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সমাবেশে এসেছিলেন। দলীয় রাজনীতির গণ্ডী ভেঙে গিয়েছিল। এই ইতিবাচক মনোভাবের রাজনীতি চাই যা সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। আমার মতে, কান্নাকাটি রাগারাগি করে অন্যকে দোষ দেওয়ার বদলে বিকল্প রাজনীতির ভাষ্য তৈরি করাটাই বেশি জরুরি। এই বিকল্প ভাবনার কেন্দ্রে থাকতে পারে প্রতিটি পরিবারের আয় বাড়ানো, স্বনির্ভর পরিবার গড়ে তোলার উদ্যোগ, প্রকৃতি-বন্যপ্রাণ-পরিবেশকে বাঁচিয়েই উন্নয়ন, বিষমুক্ত খাদ্যের দাবি। সঙ্গে স্বপ্ন। প্রয়োজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, নানা মনোভাবের মানুষকে নিয়ে চলার মানসিকতা। তাহলেই কাঙ্ক্ষিত বিশল্যকরণীর খোঁজ পেতে পারি আমরা। 

নয়তো থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়।