Monday, 18 May 2015

ছিটমহলের ভবিষ্যৎ



ওরা থাকে ওপারে
সোমেন চক্রবর্তী

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত নির্দিষ্টকরণ সংক্রান্ত কানুনটিতে লোকসভা এবং রাজ্যসভার পরিপূর্ণ সম্মতি প্রাপ্তির সাথে সাথে ছিটমহল সম্পর্কিত আড়াইশো বছরেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক লজ্জাজনক অধ্যায়ের অবসানের সম্ভাবনা তৈরি হল। প্রবাদ আছে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগরার প্রান যায়’ব্যাপারটা সেরকমই। মোগল আমলে যুদ্ধ সাঙ্গ হলে সম্রাটের সঙ্গে কোচবিহারের মহারাজার কী এক চুক্তি হয়েছিল ১৭১৩ সালেসন্ধি একটা হল বটে, কিন্তু কোন রাজার ভাগ্যে কোন গ্রাম, খসরা আর মৌজা রইল সেটা পরিষ্কার নির্ধারিত হল না। ‘ছিটমহল’ নামক অপমানিতের ইতিহাসের শুরু এখানেই। প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং স্থানীয় নদ-নদীর গতিবিধি পরিবর্তনও ভূখণ্ডকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে বারবার। ভারত-পাকিস্তানের সোজা-সাপ্টা আন্তর্জাতিক সীমারেখা তৈরি করতে গিয়ে ছিটমহলের যেটুকু সম্ভাবনা বেঁচে ছিল, সিরিল র‍্যাডক্লিফ অবশেষে তারও বারোটা বাজিয়ে দিলেন।

মোগল সাম্রাজ্যের পতন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গোড়াপত্তন, দুই বাংলা জুড়ে স্বাধীনতার আন্দোলন এবং অনিঃশ্বেষ আর্থ-সামাজিক পট পরিবর্তন এই পরিচয়হীন, অবয়বহীন এবং রাষ্ট্রহীন মানুষগুলোকে অপাংক্তেয় করে রেখে দিয়েছে দীর্ঘ্ কয়েক শতাব্দী পরবর্তীকালে কোচবিহার আর রংপুরের মহারাজার লড়াই আর বন্ধুত্বের টানাপোড়েন সমস্যাকে আরও গভীর করে তুলল। ছিটমহলের সংখ্যা আর জটিলতা বাড়ল বই কমল না।

১৯৪৭’এ কোচবিহার ছাড়া ভারত আর রংপুরকে বাদ দিয়ে পাকিস্তান স্বাধীন হল। কিছু পরে রংপুর পূর্ব-পাকিস্তানের সঙ্গে মিশে গেলেও, কোচবিহার ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত হল অনেক পরে, ১৯৪৯ সালে। সেই সঙ্গে দুই রাজ্যপাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছিটমহল বিদীর্ণ হয়ে গেল রাষ্ট্র, ধর্ম, ভাষা এবং সম্প্রদায়ের অমানবিক কৃত্রিম বেড়াজালে। বিছিন্ন দ্বীপের মতো পাকিস্তানের মধ্যে জেগে রইল ভারতের গ্রাম, অনাগরিক জনসমাজ। অসীম ঘৃণা, বিদ্বেষ এবং অসহনীয় অপমান সহ্য করে ভারতের সীমানায় টিঁকে থাকল পাকিস্তানের অনাহূত জনবসতি। সুদীর্ঘ ঔপনিবেশিকতার ভয়াভয় স্মৃতি, দেশভাগের ক্ষোভ ও যন্ত্রণা, সাম্প্রদায়িক ঘৃণা আর মুক্ত দেশ গড়ে তোলর আশু দায়িত্ব না সমাজকে ছিটমহল নিয়ে ভাববার অবকাশ দিয়েছিল, না রাষ্ট্রনেতাদের কাছে সেই সন্ধিক্ষণে ছিটমহলের কোনও প্রাধান্য ছিল।

ক্রমশ সংগঠিত হল প্রতিবাদসমূহের গর্জন প্রতিধ্বনিত হল। অন্তরাষ্ট্রীয় সমস্যার স্বীকৃতি পেল ছিটমহল১৯৫৮’এ জহরলাল নেহেরু এবং ফিরোজ খান নুন ছিটমহল নিয়ে এক চুক্তি স্বাক্ষর করলেন বটে কিন্তু বাঁধ সাধল ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। সংবিধান ভারতের ভূখণ্ডকে দ্বিখণ্ডিত বা হস্তান্তরিত করবার কোনও সুযোগই দেয়নি। ইচ্ছে থাকলেও ছিটমহল ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’ অবস্থায় থেকে গেল। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ১৯৭৪’এ ইন্দিরা গান্ধী এবং মুজিবর রহমান নতুন করে চুক্তি সাক্ষরিত করে আরও একবার চেষ্টা করলেন। মুজিবর হত্যার সঙ্গে সেই প্রচেষ্টারও অকাল মৃত্যু ঘটল। সাক্ষী হয়ে টিঁকে থাকল যন্ত্রণাদগ্ধ, বিতর্কিত, অর্ধসমাপ্ত প্রায় ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ্ ১৭৮ x ৮৫ মিটার চওড়া ‘তিন বিঘা’ করিডর।

বাংলাদেশ এবং ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরবর্তী সময়ে জটিল সব ঘটনার মধ্যে দিয়ে এগোতে থাকল অন্যদিকে, ছিটমহল রাষ্ট্রীয় মর্যাদা হারিয়ে, কয়েকটি রাজ্যের আঞ্চলিক সমস্যা হিসাবে ধুকুধুকু বেঁচে রইল। উন্নয়নের অবহেলায়, পরিষেবার অনুপস্থিতিতে এক কোণে পড়ে রইল ১০৬টি ভারতীয় এবং বাংলাদেশের ৯২টি ছিটমহল। আর সেখানকার রাষ্ট্রহীন, নাগরিকতাহীন, অসহায় এবং বিপন্ন লক্ষাধিক মানুষছিটমহলবাসীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, এবং জীবিকার ব্যাপারে কোনও রাষ্ট্রেরই দায়বদ্ধতা থাকল না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষক, রাজনৈতিক নেতা এবং সমাজবিরোধীরা কখনও একক শক্তিতে, অন্য সময়ে দলবদ্ধভাবে এই অনিশ্চিত অবস্থার সুযোগ নিল। নগ্ন পাশবিকতায় নারী সম্মান লুণ্ঠিত হতে থাকল। কৃষকের ফসল, গাই-বাছুর বেদখল হয়ে গেল বিনা বাধায়। সাম্প্রদায়িক অত্যাচার, জমি-জায়গার জবরদখল সেখানে নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা মাত্র। রাষ্ট্রের সীমারেখা ছাড়িয়ে মানবাধিকারের এই বর্বরোচিত উল্লঙ্ঘন চলতেই থাকল ছিটমহলের অন্দরমহলে - নিঃশব্দে, নীরবে।

বিতারিত, সব ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষগুলোকে কেউ কোথাও আপন করে নেয়নি। পালিয়ে আসা ভারতীয়দের ‘বাংলাদেশী’ আখ্যা দিয়ে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একই ছবি ভেসে উঠেছে বাংলাদেশের সীমান্তে। তারা নাগরিকত্বের সম্মান পায়নি। আবার তাদের উদ্বাস্তুর স্বীকৃতিও দেওয়া হয়নি। ত্রিশঙ্কু অবস্থার অন্য কারণও ছিল। রাষ্ট্র যদি মেনে নেয় যে এই মানুষগুলো নিজের দেশের এক ভূখন্ড থেকে অন্য ভূখন্ডে নিজেকে স্থানান্তরিত করেছে, তবে তারা ভ্রাম্যমান নাগরিক কিংবা বিস্থাপিত সম্প্রদায়। নয়তো উদ্বাস্তু। তাদের প্রাপ্য হয় সংবিধান প্রদত্ত নাগরিক অধিকার অথবা আন্তর্জাতিক আইনানুগ উদ্বাস্তু সুরক্ষা ও স্বীকৃতি। এই সত্যিকে মেনে নেওয়াটাই ভারত এবং বাংলাদেশের কাছে অসম্ভব হচ্ছিল।

নাগরিকত্বের স্বীকৃতি তো দূরের কথা, কোচবিহারের মহারাজার দেওয়া প্রজা পরিচিতি আর পাট্টার কাগজকেও কেউ মূল্য দিল না। নাগরিকত্ব নেই, তাই নেই রেশন কার্ড। ভোট নেই, তাই নেতা নেই। নাগরিক নয়, তাই জনগণনায় তারা নেই। দায়বদ্ধতা নেই, সুতরাং তাদের প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থের কোনও সুব্যবস্থা নেই‘নেই জগতের’ এই বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের ঝক্কি নিতে কোনও গনতান্ত্রিক দেশ এবং সরকারই রাজি হয়নি বিগত ৬৮ বছর এই অনিশ্চয়তার অবসান ঘটাতে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সীমান্ত রেখা পুনর্বিচারের এবং ছিটমহল লজ্জার অবসানের উদ্দেশ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেনপ্রায় চার বছর বাদে, গত ৭ মে দলমত নির্বিশেষে লোকসভা এবং রাজ্যসভার পরিপূর্ণ সম্মতিতে সেই চুক্তিই আইনে পরিণত হয়েছে

স্বাধীনতা হীনতায় কেউ বাঁচতে চায় না। ছিটমহলের মানুষও চায়নি। এখন তারাই ঠিক করবে কোন ভুখন্ডে থাকবে, কোন দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করবে। সংরক্ষণশীল মানসিকতা এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এই পরিবর্তনকে হয়তো সহজে এগোতে দেবে না। এটাও সত্যি যে অভাব এবং দারিদ্রের অবসান অনেক লম্বা এবং কঠিন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসে। মানুষই মানুষের ইতিহাস গড়ে তোলে। উন্নয়নের রাস্তা তারা নিজেরাই খুঁজে নেবে। সেখানে রাষ্ট্রের ভুমিকা যদিও সীমিত, তবুও এই প্রেক্ষিতে তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণএই আইন অবশ্যই মুক্তির রাস্তাটা খুলে দিল। মানুষের মর্যাদা দিল তাদের নব্য নাগরিক এবার সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় গড়ে তুলবে নিজস্ব নিয়মে, সামূহিক অধিকারে ‘ছিটমহলের মানুষ’ যে এখন সন্মানিত নাগরিক।
(c_somen@yahoo.com)

Wednesday, 13 May 2015

Release Chatttrodhor Mahato!




Chattrodhar Mahato was a leader of a mass upheaval which could be a model of the most-spoken 'participatory democracy'..
Instead he has been put into life imprisonment.. Shame to our rulers and 'justice'!

He was arrested in September 2009 by the then Left Front rulers under the draconian UAPA, framed with false charges. It was condemned by all democratic forces and the opposition too.. But the then opposition (TMC) coming to power followed the same track of the Left Front.

Let us raise our voice! Let us demand withdrawal of all false charges and unconditional release of Chattrodhar Mahato and 5 others!! The historic Lalgarh movement was an experiment in direct democracy which could have strengthened the pillars of Justice, Equality and Fraternity!!!

Please sign on this online petition if you demand his unconditional release:
https://www.change.org/p/chief-minister-govt-of-west-bengal-nabanna-unconditional-release-of-chattrodhar-mahato-and-all-others

Wednesday, 6 May 2015

২৫ বৈশাখ ১৪২২



চোখে ন্যাবা, ২৫শে বৈশাখ ও বৌঠান
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

এই বছর বিশেক আগেও এ রোগের প্রকোপ তেমন মারাত্মক ছিল না। এলাহাবাদ প্রকাশনির পানু ও অচিরেই ভিডিও জমানায় দেদার XXX-মার্কা ছবির দৌলতে মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাঙালির যৌন জীবনে তেমন প্রকট কোনও অভাববোধ না থাকারই কথা ছিল। রবীন্দ্র জয়ন্তীতে খোকা–খুকি সেজে সারাদিন নরমসরম ঘুরে বেড়ানো, সাত সকালের রবি প্রণামে চিল-চীৎকারে ‘আফ্রিকা’ পাঠ, সন্ধ্যার পাড়ার মজলিশে ‘হাত ঘোরালে নাড়ু পাবে’ গোছের ‘চণ্ডালিকা’, ‘শ্যামা’- এইসব আমোদ আহ্লাদে বছরের একটা দিন বেশ রসে বশে গানে কবিতায় ‘নির্মল’ হবার দিন ছিল কিন্তু শনৈ শনৈ সময়ের বাতায়নে গেরো দাঁড়াল তিনটিঃ ১)বাংলা সিরিয়ালের রমরমা বাজার ২) রবীন্দ্র লেখার কপিরাইট বিদায় ও ৩) চোখে ন্যাবা পড়া সঙ্গে রইল সব আমোদের সেরা জনঃ দুঃখবাজার পত্রিকা।

ধিঙ্গিপনার এই মিলিজুলি মতলবি আসরে চোখে মনে স্বপ্নে ভাসিয়ে তোলা হল প্যাচপ্যাচে সুরসুর কূটকচালি, বেনারসি শাড়ি পড়ে চিকেন কোপ্তা রন্ধন, একান্নবর্তী পরিবারে লড়াকু নববধু সহ তিন-চারটি শ্মশান-স্বপন মার্কা খুনে ভিলেন, যত্রতত্র ভুরি ভুরি পরকীয়া, যখন তখন যেমন ইচ্ছে সুরে বেসুরে রবীন্দ্র গান (বুড়ো মানুষ হলে ‘রবীন্দ্র আশ্রয়’), রবীন্দ্র লেখাপত্তর নিয়ে নাটক, সিনেমা, গল্প, নিবন্ধে আগাপাস্তলা চটকানো ও সর্বোপরি কাদম্বরী। এই কাদম্বরীতেই এসে বোধকরি সাম্প্রতিক কালে ভদ্রজনেদের চোখে ন্যাবা পড়লকীভাবে জানি সরতে সরতে চোখের সব দৃষ্টি আপাতত এসে এই কাদম্বরীতেই আটকাল চুলোয় যাক আর সব- এই তো যথেষ্ট মেগা সিরিয়াল, এইটুকুই তো রয়েছে মনন-কাঙালের জরাজীর্ণ মগজপাত্রে, এই তো বাজারি আনন্দের হালহদিশ।

যেন অনেকটা শপিং মলের মতো- যেখানে এসে মেগা সিরিয়াল, বৌঠান, রবিবাবু, শাড়ি, গয়না, প্রতিহংসা, পরকীয়া, লোভ, লালসা, কর্পোরেট নাটক, কর্পোরেট ছবি, রকেট ক্যাপসুল, ঘণ্টাখানেক সঙ্গে সুমন সব একই ছাদের তলায় দাঁড়িয়ে পড়ল পরে চোখের ন্যাবা সরে গেলে (যদি) বোঝা যায়, ‘স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা’

গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস তো বাদ দিন; যে মানুষটা আধুনিক বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের জনক শুধু নন, তাকে ভরা যৌবনের শিখরে পৌঁছে দিয়েছেন, চিন্তা, মেধা, মননে এক যুগান্তর এনেছেন, মনুষ্যত্বের এক অনির্বচনীয় ভূমিতে আমাদের দাঁড় করিয়েছেন, রেখে গেছেন অনন্ত সুধা সাগর, যিনি দুঃখী মানুষের নিত্য পারাবার, তাঁকে ছিঁচকে চোর পেটানোর মতো করে আমরা খুবলে খুবলে তাঁর শরীর থেকে বার করছি ‘বীভৎস মজা’র সব পাপচিন্থ; তাঁর গল্প, উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলোকে তাঁর সঙ্গে জুড়ে জুড়ে তৈরি করছি নবযুগের মহাপানু। পানুশিল্পের স্বঘোষিত উমেদার যে ব্যক্তিটি ব্যবসায়ীদের পয়সা ঝেড়ে নিত্যদিন রেস্তোরাঁয় ঠেসে খেয়ে তারপর প্রতিবেদন না লেখায় কর্পোরেট সংবাদপত্রের মোটা মাইনের চাকরিটি খুইয়ে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে ফিরে শেষে ‘কাদম্বরীর সুইসাইড নোট’ ও আরও গোটাকতক লিখে নিও-পানু ব্যবসাটির পত্তন করেছিল, তাই এখন মহীরুহ হয়ে শপিং মলপন্থী বাঙালিদের ঘরদোর, আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে।

এবার ২৫শে বৈশাখ বরং ঈষৎ নীরব থাকি।

                    

Friday, 1 May 2015

মে দিবস ২০১৫

আজকের মে দিবস
পল্লবী বন্দ্যোপাধ্যায়



বহু বছর আগের কথা লাল তখন বঙ্গজীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ রং মে দিবসে তখন ঘুম ভাঙত প্রভাতফেরীর গণসংগীতের সুরে মোড়ে মোড়ে স্টেজ বেঁধে লোকাল নেতা জ্বালাময়ী বক্তৃতায় আমাদের মনে করাতেন শ্রমিকের অধিকার তারপর অনেক জল হুগলি নদী দিয়ে বয়ে গেছে হুগলির পূব এবং পশ্চিম পাড়ের কারখানাগুলোয় একে একে তালা পড়েছে হাজার হাজার গেট মিটিং, সমাবেশ, হরতাল করেও হাল ফেরেনি নিন্দুকে বলেছে ইউনিয়ন নেতা মালিকপক্ষের সঙ্গে 'সেটিং' করে নিজের ভাগ বুঝে নিয়েছেন শ্রমিকেরা কেউ পান বিড়ির দোকান দিয়েছে, কেউ রিক্সা কিনেছে, কেউ ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে, কেউ দেশে ফিরে গেছে শ্রমিকের গৃহিণী ঠিকে ঝি হয়ে গেরস্থ বাড়ির বাসন মাজতে শুরু করেছে
তারপর ভারতে সোনার দিন এসেছে লগ্নির জোয়ার এসেছে তথ্য প্রযুক্তি শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে কয়েক লক্ষ মানুষের মোড়ে মোড়ে ঝাঁ চকচক মল হয়েছে দলে দলে ছেলেমেয়েরা দোকান রেস্তোরাঁ মাল্টিপ্লেক্সের কর্মী হবার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছে ক্রমে ভারতবর্ষ প্রথম বিশ্বের পছন্দের 'স্লেভ মার্কেটে' পরিণত হতে পেরেছে এ হেন জোয়ারের জল বাংলাকেও বাদ দেয়নি প্রচুর ছোট ব্যবসায়ী অসংখ্য ছোটখাটো অফিস খুলে বসেছে কর্মচারী রেখেছে এমপ্লয়ার হয়ে উঠেছে তারা কেউ চিটফান্ড, কেউ মন্টেসরি স্কুল, কেউ আইটি, কেউ বুটিক, কেউ রিয়েল এস্টেট সংস্থার মালিক সব মিলিয়ে, হোয়াইট কলার চাকরির সংখ্যা বিপুলভাবে বেড়েছে
কারা এই হোয়াইট কলার চাকর? এরা প্রতিদিন সকালে উঠে ধোপদুরস্ত পোশাক পরে অফিস যায় নির্দিষ্ট সময়ের বহু পরেও অফিসে বসে কাজ করে কোনও ওভারটাইম ছাড়াই, বছরের শেষে বসের/মালিকের কাছে মাইনে বাড়ানোর জন্য কাঁদুনি গায়, ছুটির দিনে বাড়িতে বসে এবং কখনও অফিসে গিয়ে কাজ করে ছোট সংস্থাগুলোর কর্মীরা অনেকে এমনকি ঠিক সময়ে মাইনেও পায় না এই সংস্থাগুলোর বেশিরভাগ আবার পিএফ গ্র্যাচুইটির ধারও ধারে না এবং মালিকপক্ষের ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ অনুযায়ী ধর্ম, জাতপাত, লিঙ্গের ভিত্তিতে যথেচ্ছভাবে কর্মীদের ডিসক্রিমিনেট করে
মজার ব্যপার হল, এই সংস্থার কর্মীদের অধিকার নিয়ে ডান বাম কোনও পক্ষেরই কোনও মাথাব্যথা নেই কারণ, নির্বাচনী ফান্ডে এই সংস্থার কর্ণধারেরা মুক্তহস্তে দান করে থাকেন এবং প্রয়োজনে নেতাদের ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধার কথা মাথায় রেখে সেইমতো সেবার আয়োজনও করে থাকেন সংস্থা যদি হয় টিসিএস-এর মতো বড় নাম, তাহলে কর্মী ছাঁটাই-এর খবর সাধারণের কর্ণগোচর হয়, অন্যথায় তাও না সব মিলিয়ে এই ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র জমানায়ও সাদা কলারের বাবু বিবিরা বেশ অসহায়
আসুন, আজকের মে দিবস আমরা India Inc-এর কর্পোরেটদের উৎসর্গ করি