ওরা থাকে ওপারে
সোমেন চক্রবর্তী
ভারত-বাংলাদেশ
সীমান্ত নির্দিষ্টকরণ সংক্রান্ত কানুনটিতে লোকসভা এবং রাজ্যসভার পরিপূর্ণ সম্মতি
প্রাপ্তির সাথে সাথে ছিটমহল সম্পর্কিত আড়াইশো বছরেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা
মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক লজ্জাজনক অধ্যায়ের অবসানের সম্ভাবনা তৈরি হল। প্রবাদ আছে, ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়,
উলুখাগরার প্রান যায়’। ব্যাপারটা
সেরকমই। মোগল আমলে যুদ্ধ সাঙ্গ হলে সম্রাটের সঙ্গে কোচবিহারের মহারাজার কী এক
চুক্তি হয়েছিল ১৭১৩ সালে। সন্ধি একটা হল
বটে, কিন্তু কোন রাজার ভাগ্যে কোন গ্রাম, খসরা আর মৌজা রইল সেটা পরিষ্কার
নির্ধারিত হল না। ‘ছিটমহল’ নামক অপমানিতের ইতিহাসের শুরু এখানেই। প্রাকৃতিক
বিপর্যয় এবং স্থানীয় নদ-নদীর গতিবিধি পরিবর্তনও ভূখণ্ডকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে
বারবার। ভারত-পাকিস্তানের সোজা-সাপ্টা আন্তর্জাতিক সীমারেখা তৈরি করতে গিয়ে
ছিটমহলের যেটুকু সম্ভাবনা বেঁচে ছিল, সিরিল র্যাডক্লিফ অবশেষে তারও বারোটা বাজিয়ে
দিলেন।
মোগল সাম্রাজ্যের
পতন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গোড়াপত্তন, দুই বাংলা জুড়ে স্বাধীনতার আন্দোলন এবং অনিঃশ্বেষ
আর্থ-সামাজিক পট পরিবর্তন এই পরিচয়হীন, অবয়বহীন এবং রাষ্ট্রহীন মানুষগুলোকে অপাংক্তেয়
করে রেখে দিয়েছে দীর্ঘ্ কয়েক শতাব্দী। পরবর্তীকালে কোচবিহার
আর রংপুরের মহারাজার লড়াই আর বন্ধুত্বের টানাপোড়েন সমস্যাকে আরও গভীর করে তুলল।
ছিটমহলের সংখ্যা আর জটিলতা বাড়ল বই কমল না।
১৯৪৭’এ কোচবিহার
ছাড়া ভারত আর রংপুরকে বাদ দিয়ে পাকিস্তান স্বাধীন হল। কিছু পরে রংপুর
পূর্ব-পাকিস্তানের সঙ্গে মিশে গেলেও, কোচবিহার ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত হল অনেক পরে,
১৯৪৯ সালে। সেই সঙ্গে দুই রাজ্যপাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছিটমহল বিদীর্ণ হয়ে গেল
রাষ্ট্র, ধর্ম, ভাষা এবং সম্প্রদায়ের অমানবিক কৃত্রিম বেড়াজালে। বিছিন্ন দ্বীপের
মতো পাকিস্তানের মধ্যে জেগে রইল ভারতের গ্রাম, অনাগরিক জনসমাজ। অসীম ঘৃণা, বিদ্বেষ
এবং অসহনীয় অপমান সহ্য করে ভারতের সীমানায় টিঁকে থাকল পাকিস্তানের অনাহূত জনবসতি। সুদীর্ঘ
ঔপনিবেশিকতার ভয়াভয় স্মৃতি, দেশভাগের ক্ষোভ ও যন্ত্রণা, সাম্প্রদায়িক ঘৃণা আর
মুক্ত দেশ গড়ে তোলর আশু দায়িত্ব না সমাজকে ছিটমহল নিয়ে ভাববার অবকাশ দিয়েছিল, না
রাষ্ট্রনেতাদের কাছে সেই সন্ধিক্ষণে ছিটমহলের কোনও প্রাধান্য ছিল।
ক্রমশ সংগঠিত হল
প্রতিবাদ। সমূহের গর্জন প্রতিধ্বনিত
হল। অন্তরাষ্ট্রীয় সমস্যার স্বীকৃতি পেল ছিটমহল। ১৯৫৮’এ জহরলাল নেহেরু এবং
ফিরোজ খান নুন ছিটমহল নিয়ে এক চুক্তি স্বাক্ষর করলেন বটে কিন্তু বাঁধ সাধল ভারতের
সর্বোচ্চ আদালত। সংবিধান ভারতের ভূখণ্ডকে দ্বিখণ্ডিত বা হস্তান্তরিত করবার কোনও
সুযোগই দেয়নি। ইচ্ছে থাকলেও ছিটমহল ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’ অবস্থায় থেকে গেল। বাংলাদেশ
স্বাধীন হবার পরে ১৯৭৪’এ ইন্দিরা গান্ধী এবং মুজিবর রহমান নতুন করে চুক্তি
সাক্ষরিত করে আরও একবার চেষ্টা করলেন। মুজিবর হত্যার সঙ্গে সেই প্রচেষ্টারও অকাল
মৃত্যু ঘটল। সাক্ষী হয়ে টিঁকে থাকল যন্ত্রণাদগ্ধ, বিতর্কিত, অর্ধসমাপ্ত প্রায় ৬
কিলোমিটার দীর্ঘ্ ১৭৮ x ৮৫ মিটার চওড়া ‘তিন বিঘা’
করিডর।
বাংলাদেশ এবং
ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরবর্তী সময়ে জটিল সব ঘটনার মধ্যে দিয়ে
এগোতে থাকল। অন্যদিকে, ছিটমহল
রাষ্ট্রীয় মর্যাদা হারিয়ে, কয়েকটি রাজ্যের আঞ্চলিক সমস্যা হিসাবে ধুকুধুকু বেঁচে
রইল। উন্নয়নের অবহেলায়, পরিষেবার অনুপস্থিতিতে এক কোণে পড়ে রইল ১০৬টি ভারতীয় এবং
বাংলাদেশের ৯২টি ছিটমহল। আর সেখানকার রাষ্ট্রহীন, নাগরিকতাহীন, অসহায় এবং বিপন্ন লক্ষাধিক
মানুষ। ছিটমহলবাসীদের শিক্ষা,
স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, এবং জীবিকার ব্যাপারে কোনও রাষ্ট্রেরই দায়বদ্ধতা থাকল না। আইন-শৃঙ্খলা
রক্ষক, রাজনৈতিক নেতা এবং সমাজবিরোধীরা কখনও একক শক্তিতে, অন্য সময়ে দলবদ্ধভাবে এই
অনিশ্চিত অবস্থার সুযোগ নিল। নগ্ন পাশবিকতায় নারী সম্মান লুণ্ঠিত হতে থাকল। কৃষকের
ফসল, গাই-বাছুর বেদখল হয়ে গেল বিনা বাধায়। সাম্প্রদায়িক অত্যাচার, জমি-জায়গার জবরদখল
সেখানে নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা মাত্র। রাষ্ট্রের সীমারেখা ছাড়িয়ে মানবাধিকারের এই
বর্বরোচিত উল্লঙ্ঘন চলতেই থাকল ছিটমহলের অন্দরমহলে - নিঃশব্দে, নীরবে।
বিতারিত, সব ছেড়ে
চলে যাওয়া মানুষগুলোকে কেউ কোথাও আপন করে নেয়নি। পালিয়ে আসা ভারতীয়দের ‘বাংলাদেশী’
আখ্যা দিয়ে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একই ছবি ভেসে উঠেছে বাংলাদেশের
সীমান্তে। তারা নাগরিকত্বের সম্মান পায়নি। আবার তাদের উদ্বাস্তুর স্বীকৃতিও দেওয়া
হয়নি। ত্রিশঙ্কু অবস্থার অন্য কারণও ছিল। রাষ্ট্র যদি মেনে নেয় যে এই মানুষগুলো
নিজের দেশের এক ভূখন্ড থেকে অন্য ভূখন্ডে নিজেকে স্থানান্তরিত করেছে, তবে তারা ভ্রাম্যমান
নাগরিক কিংবা বিস্থাপিত
সম্প্রদায়। নয়তো উদ্বাস্তু। তাদের প্রাপ্য হয় সংবিধান প্রদত্ত নাগরিক অধিকার অথবা আন্তর্জাতিক
আইনানুগ উদ্বাস্তু সুরক্ষা ও স্বীকৃতি। এই সত্যিকে মেনে নেওয়াটাই ভারত এবং
বাংলাদেশের কাছে অসম্ভব হচ্ছিল।
নাগরিকত্বের
স্বীকৃতি তো দূরের কথা, কোচবিহারের মহারাজার দেওয়া প্রজা পরিচিতি আর পাট্টার কাগজকেও
কেউ মূল্য দিল না। নাগরিকত্ব নেই, তাই নেই রেশন কার্ড। ভোট নেই, তাই নেতা নেই।
নাগরিক নয়, তাই জনগণনায় তারা নেই। দায়বদ্ধতা নেই, সুতরাং তাদের প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থের
কোনও সুব্যবস্থা নেই। ‘নেই জগতের’ এই বাসিন্দাদের
পুনর্বাসনের ঝক্কি নিতে কোনও গনতান্ত্রিক দেশ এবং সরকারই রাজি হয়নি বিগত ৬৮ বছর। এই অনিশ্চয়তার অবসান
ঘটাতে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সীমান্ত রেখা পুনর্বিচারের এবং ছিটমহল লজ্জার
অবসানের উদ্দেশ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। প্রায় চার বছর বাদে, গত ৭
মে দলমত নির্বিশেষে লোকসভা এবং রাজ্যসভার পরিপূর্ণ সম্মতিতে সেই চুক্তিই আইনে
পরিণত হয়েছে।
স্বাধীনতা হীনতায়
কেউ বাঁচতে চায় না। ছিটমহলের মানুষও চায়নি। এখন তারাই ঠিক করবে কোন ভুখন্ডে থাকবে,
কোন দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করবে। সংরক্ষণশীল মানসিকতা এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এই
পরিবর্তনকে হয়তো সহজে এগোতে দেবে না। এটাও সত্যি যে অভাব এবং দারিদ্রের অবসান অনেক
লম্বা এবং কঠিন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসে। মানুষই মানুষের ইতিহাস গড়ে তোলে। উন্নয়নের
রাস্তা তারা নিজেরাই খুঁজে নেবে। সেখানে রাষ্ট্রের ভুমিকা যদিও সীমিত, তবুও এই
প্রেক্ষিতে তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই আইন অবশ্যই মুক্তির রাস্তাটা খুলে দিল। মানুষের মর্যাদা
দিল তাদের। নব্য নাগরিক এবার সামাজিক,
অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় গড়ে তুলবে নিজস্ব নিয়মে, সামূহিক অধিকারে। ‘ছিটমহলের মানুষ’ যে এখন
সন্মানিত নাগরিক।
(c_somen@yahoo.com)