শেষ প্রজাতি
সূর্য শেখর দাস
১৭ বছরের ছেলেটি একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছে। তার থুতনি রেখেছে তার প্রিয় ক্রিকেট ব্যাটে ভর
দিয়ে। চারিদিকে এক আঁশটে, অস্বস্তিকর সন্ধে নেমে এসেছে। ঘন্টা তিনেক আগেই সে ক্যান্সারে শেষ হয়ে যাওয়া মাকে দাহ করে এসেছে। বাড়িতে
আত্মীয়স্বজনরা কার্যত বোবা মানুষের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ বা চুপচাপ বসে... ছেলেটির বাবা সোফায় শুয়ে সিলিঙের দিকে
হাঁ করে তাকিয়ে আছে। বিপিন কাকা ছেলেটির পিঠে সস্নেহে হাত রেখে বলল, 'চিন্টু, কালকে অন্তত বিশ্রাম নে... কালকের ম্যাচটা না
হয় নাই খেললি!' ১৭ বছরের চিন্টু একটু সময় নিয়ে গলায়
লোহার দৃঢ়তা এনে বলল, 'পৃথিবী লোপাট হয়ে গেলেও কাল আমি খেলব।' বিপিন
কাকা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, 'কাল তুই কী করে খেলবি রে! এই অবস্থায় তুই কি বল ঠিকঠাক দেখতে পাবি? তাই বলছিলাম...।' বাবা দীর্ঘশ্বাসকে চেপে রেখে
বলল, 'ওকে আটকাস না বিপিন.. তাছাড়া ওর মা তো বারবার বলত
কোনও কিছুর জন্যই কোনও কাজকে আটকে রাখা উচিত
নয়...।'
চিন্টু বিপিন কাকার দিকে তাকিয়ে শান্ত ভাবে বলল, 'কাল তো আমাদের নক আউট ম্যাচ... হারলেই টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে
যাব...।' বিপিন পরিষ্কার
বুঝতে পারল এ ছেলের মধ্যে কিছু ইতিবাচক করার জন্য আগুন
জ্বলছে...
কাকা ছেলেটির কাঁধে
হাত রেখে বললো, 'If you are so confident, go and kiss the World. May be, tomorrow
will define your life.'
পরের দিন চিন্টু ফিল্ডিং করতে গিয়ে পায়ে চোট পেল। ও রীতিমতো
খোঁড়াচ্ছিল। টিমমেটরা হাল ছেড়ে দিয়েছে... দল ক্রমশ নিশ্চিত হারের দিকে
এগোচ্ছে... চিন্টু সেঞ্চুরি করে এক উইকেটে ম্যাচটা জিতিয়ে দিল। খেলা শেষে টিমমেটরা
ওকে কাঁধে তুলে নিয়েছে, ও আকাশের দিকে একবার
তাকালো... সাদা মেঘ সাঁতরে ওর মা ক্যান্সারে বিদ্ধ কালচে ধূসর
শীর্ণ ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে... শেষ পর্যন্ত তা ছুঁয়ে ফেলল চিন্টুর মাথা... মা যেন বলছে, 'তুই খেলে যা বাবা, আমি কিন্তু ওপর থেকে সব দেখেছি...।' ও দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা চেপে ধরল। চিন্টুর
চোখে তখন অসময়ে বৃষ্টি নেমেছে।
চিন্টু। চেতেশ্বর পূজারা। গ্ল্যামারের রঙিন আলোয় বর্ণময় ভারতীয় ক্রিকেট দলের এক ছকভাঙা সাদা-কালো ব্যক্তিত্ব। ভারতীয় ক্রিকেট, ভারতীয় ক্রিকেট
কন্ট্রোল বোর্ড(বিসিসিআই) বিশ্ব
ক্রিকেটের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিসিসিআই পরিচালিত রঙিন,
অর্থের খনি আইপিএলে খেলার জন্য মুখিয়ে থাকেন সমগ্র ক্রিকেট বিশ্বের নামিদামি ক্রিকেটাররা।
আইপিএলের বর্ণিল উৎসবে ব্রাত্য পূজারা। নাহ্, কোনও
Franchise বা টিমই পূজারাকে ডাকে না। সত্যি কথা বলতে কী, স্পনসরদের কৃপাদৃষ্টিতে পুষ্ট, ফ্লাডলাইটের
মায়াবী আলোয় উদ্ভাসিত সীমিত ওভারের ক্রিকেটই পূজারার ওপর কার্যত ছিটকিনি তুলে দিয়েছে।
বহু মানুষের কাছেই গুজরাত হল দেশের অন্যতম প্রধান শিল্পোন্নত রাজ্য। বিগ মিডিয়ার কথায়, গুজরাত মানেই যেন
Vibrant Gujrat। ব্যবসা-বিপণনে প্লাবিত গুজরাত। হয়তো বা Colourful Dynamism- এর অন্যতম উজ্জ্বল প্রতীক হল গুজরাত। চেতেশ্বর পূজারাও গুজরাতি। ওঁর রাজকোটে জন্ম। প্রথাগত Colourful, Dynamic
Modern Gujrat-এর জিন ওঁর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। পূজারার DNA সুপ্রাচীন গুজরাতের অনন্য মৌলিকত্বকে সূচিত করে। আপনাদের মনে পড়ছে গুজরাতেরই ধোলাভিরা, লাথোলের কথা? যা
নির্ভুলভাবেই চিনিয়ে দেয় সুগভীর সিন্ধু সভ্যতার অদম্য সত্তাকে। একবার ভাবুন, গুজরাতেরই গিরনার পর্বতের কথা যা হিমালয় পর্বতের
চেয়েও প্রাচীন। পর্বতের মতো পূজারার ব্যাটিং ততটাই গ্রানাইট-কঠিন। পল্লবগ্রাহী টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে শত মাইল দূরে থেকে উনি ঘন্টার পর ঘন্টা টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাট করে
যান। এই ব্যাটিংয়ে T20-র মতো অগুন্তি চার-ছক্কা থাকে না। এ যে ফ্লাডলাইটের মায়াবী আলো, রঙিন, সহজেই নজরকাড়া পোশাক থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে থাকা টেস্ট ক্রিকেট। এখানে রঙিন
পোশাকের বদলে সাদা পোশাক... টেস্টে রং আনতে গেলে সেটা বাইরে
থেকে আনা যাবে না। নিজের performance দিয়ে আনতে হবে। হ্যাঁ, মূলত
টেস্ট ক্রিকেটই খেলেন পূজারা। প্রথম দিনে যে
পিচে ব্যাট করা সহজ, যে পিচকে মনে হচ্ছে খুব ভালো বন্ধু,
টেস্টের চতুর্থ বা পঞ্চম দিনে ওই একই
পিচে ব্যাট হাতে দাঁড়ানোই হয়তো দুষ্কর। বিপক্ষ বোলারের বল আচমকা লাফাচ্ছে বা নিচু হয়ে উইকেট ভেঙে দিচ্ছে... কখনও বা
বল লাট্টুর মতো ঘুরছে... ব্যাটসম্যান তো রীতিমতো হয়রান হয়ে
যাচ্ছে! যে পিচকে
সে খুব ভালো বন্ধু ভাবছিল, সেই পিচই তো চরম শত্রুর মতো ব্যবহার করছে! আমাদের জীবনেও কি
এইরকম ঘটনা ঘটে না বা ঘটতে পারে না!
যাকে আমরা পরম বন্ধু ভাবি, অনেক সময় সেই হয়তো বিশ্বাসঘাতকতা করে! হয়তো সেই
আমাদের বিশ্বাসের পিঠে ছুরিটা মারে! বিশ্বাসঘাতকের দাঁতে তখন
লেগে রয়েছে দুর্গন্ধ যুক্ত নোংরা হাসি... আমার আপনার জীবনেও
কি মুখোশ পরা ভয়ংকর ব্রুটাসের আবির্ভাব
ঘটেনি বা ঘটবে না! মানসিক ভাবে রক্তাক্ত হলেও আমাদের লড়াইটা
চালিয়ে যেতে হয়, জীবনযুদ্ধ থেকে পালিয়ে গেলে চলে না। কাপুরুষের
মতো পালাবার কোনও পথ নেই... সর্বকালের সেরা অন্যতম ক্রিকেট যোদ্ধা তথা অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন অধিনায়ক স্টিভ ওয়া বলেছেন, 'whether in
sports or life, we cannot retreat. If needed,
in case of emergency, we have to retaliate with our indomitable soul... The moment
we retreat, our lives will be in a shambles.'
বন্যা খরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সন্ত্রাসবাদের আস্ফালন থেকে নোটবন্দি- এ সব কিছু থেকেই আশ্চর্য রকম মুক্ত পূজারার ব্যাটিং। Grit, intensity,
resilience... এই শব্দগুলো বলা এবং লেখা সহজ কাজ, কিন্তু কেউ যদি এগুলোই কঠিন পরিস্থিতিতে সঠিক ভাবে
প্রয়োগ করেন তাহলে তো তাঁকে সাধুবাদ দিতেই হয়। মাত্র কয়েকদিন
আগেই অস্ট্রেলিয়াতে হওয়া অ্যাডিলেড টেস্টের কথা ভাবুন। তুলনামূলক
ভাবে কঠিন পিচ পরিস্থিতিতে যখন ভারত, অস্ট্রেলিয়া দুই দলের
ব্যাটসম্যানরাই ব্যাট করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন, এমনকি কিং
কোহলিও সমস্যায় পড়েছেন, পূজারার
ব্যাট দুটো ইনিংসেই দাঁড়িয়ে গেল। প্রথম ইনিংসে করলেন অনবদ্য ১২৩ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে
৭১। পূজারার ব্যাট চিনের প্রাচীরের মতো ভারতকে অস্ট্রেলীয় বোলারদের ছোঁড়া স্কাড-মিসাইলগুলোর হাত থেকে রক্ষা করল। ১৫ বছর
আগে এই অ্যাডিলেডেই রাহুল দ্রাবিড়ের ব্যাট স্থাপন করেছিল দ্রাবিড়
সভ্যতার অন্যতম সেরা মনুমেন্ট- যে মনুমেন্টে বৃষ্টিভেজা নরম রোদ্দুর মাখা সকালে লেগে থাকে ময়ূরপঙ্খীর রং। দ্রাবিড়ের ২৩৩ এবং
৭২ নট আউট অবিস্মরণীয় ক্রিকেট লোকগাথার জন্ম দিয়েছে.. সেটা ছিল হাই-স্কোরিং গেম। এই
ডিসেম্বর ২০১৮-য় লো-স্কোরিং গেমে পূজারা নির্মাণ করলেন আর এক নতুন স্থাপত্য কীর্তি। আবার প্রমাণ করলেন
উনিই হলেন রাহুল দ্রাবিড়ের যোগ্য উত্তরসূরী।
অ্যাডিলেড অস্ট্রেলিয়ার সেই বিরল শহর যেখানে এখনও সুপ্রাচীন ট্রাম চলে। সবচেয়ে বড় কথা, এই অ্যাডিলেডই ব্যাটিং সম্রাট Don Bradman-এর আবাসস্থল ছিল। পূজারার ব্যাটিংয়ে
দ্রাবিড়ের সুমহান গ্রানাইট-দৃঢ় সভ্যতা, ট্রামের দীর্ঘজীবিতা, Don Bradman-এর ইস্পাত-কঠিন মনঃসংযোগ করার ক্ষমতা- সব কিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এবং স্টিভ ওয়া, রাহুল দ্রাবিড়ের যথার্থ পূর্বসূরী। এই লেখাতেই স্টিভ ওয়া'র কথা আগেই বলেছি। অসুস্থ শরীরে ব্যাট করছিলেন, বমি করে ফেললেন- জামা নোংরা হয়ে গেল, নিন্দুকেরা পচা, বিষাক্ত হাসি হাসতে শুরু করলেন... তবু স্টিভ ব্যাটিং ক্রিজ ছাড়লেন না। স্টিভ খেলছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। অ্যামব্রোসের বিষাক্ত বাউন্সারে ডান হাতের অনামিকা থেকে রক্ত ঝরতে লাগল, ভিজে গেল
গ্লাভস, এমনকি জামা হয়ে গেল লালচে...
মাঠে ডাক্তার ছুটে এলেন। ডাক্তারের বক্তব্য পরিষ্কার... এখন আর ব্যাট করা যাবে না, চিকিৎসার প্রয়োজন,
খুবই দরকার বিশ্রামের। কিন্তু স্টিভ ওয়া মাঠই ছাড়লেন না । আবার বাউন্সারে অনামিকাটা আরও থেঁতলে
গেল.. গ্লাভস রক্তে ভিজে যাচ্ছে, টেস্টের পিচকে ভীষণরকম
খামখেয়ালি বা অচেনা ঠেকছে... নিন্দুকরা মুখে এবং কলমে শান দিচ্ছে, নির্বাচকরা পেশাদার কশাই-এর মতো ছুরিতে
শান দিচ্ছেন স্টিভের আন্তর্জাতিক কেরিয়ারটা টুকরো টুকরো করবেন বলে...
তাঁরা চাইছেন স্টিভ আর একবার ব্যর্থ হোক... টেস্টের পাল্টে যাওয়া পিচ, ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে
থাকা নিন্দুকের দল, কেরিয়ার শেষ করে দিতে চাওয়া হিমশীতল নির্বাচকরা... ক্রিকেটের
ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম সেরা যোদ্ধা
স্টিভ ওয়া কার্যত নিজের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে দেশকে জিতিয়ে
তবেই মাঠ ছাড়েন..
এই লড়াইটাই স্টিভের
নির্ভুল ব্র্যান্ড। এই রকম লড়াই তো করতেন আমাদের রাহুল দ্রাবিড়...
কিন্তু স্টিভ ২০০৪-এ অবসর নিয়েছেন। দ্রাবিড় সরে গেছেন ২০১২-য়। কিন্তু চেতেশ্বর পূজারা এখনও বুক চিতিয়ে লড়ে যাচ্ছেন এবং লড়াই চালিয়ে যাবেন। গ্ল্যামার-সর্বস্ব বিপণনের লাস্যময়ী প্রেমিকা T20 ক্রিকেট থেকে
শত হস্ত দূরে টেস্ট ক্রিকেটে.. টেস্ট ক্রিকেট... একাকীত্ব, বিষন্নতা, আচমকা গিরগিটির মতো বদলে যাওয়া
পিচ, বিপক্ষের হিংস্র বোলারের দল,... ঝরতে থাকা রক্ত-- তবু লড়াই থেকে একবিন্দুও না সরা- এ তো আমাদের জীবনেরই নির্ভুল ছবি...
মেঘের স্রোত ঠেলে ক্যান্সারে পিষে যাওয়া মায়ের হাতটা যেন
এখনও নড়ছে... মৃত্যুর গহ্বর থেকে মায়ের
গলা এখনও শোনা যাচ্ছে, 'চিন্টু, তুই ব্যাট করে যা... আমি কিন্তু তোকে দেখছি বাবা...।' হ্যাঁ, পূজারা এখনও ব্যাট করে যাচ্ছেন... আশেপাশে যেন আর কেউ নেই.. তিনি যেন একা,
একদম একা। শেষ প্রজাতি ।