West Bengal Doctors' Forum Leaflet for the People of West Bengal
ডাক্তারদের কাছ থেকে খোলা চিঠি
সংবাদপত্রের খবর, বিগত সাত-আট মাসে পশ্চিমবঙ্গে চিকিৎসকের ওপর শারীরিক আক্রমণের সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। অবশ্য অধিকাংশ নিগ্রহ খবরের কাগজ-টিভিতে আসেনা, তাদের ধরলে অবস্থা আরও অনেক খারাপ, এক বছর আগের তুলনায় তিনগুণ তো বটেই।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস’ ফোরাম আপনাকে শুধু দেখাতে চাইছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ঠিক কতটা লাভ হল।
এবছর ফেব্রুয়ারিতে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বেসরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তাদের খুব ধমকালেন, টিভিতে তা সরাসরি সম্প্রচার হল। বেসরকারি হাসপাতালের ত্রুটি তাতে কতটা কমল সে ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রক কোনো পরিসংখ্যান পেশ করে নি, কিন্তু সেদিন থেকে আজ ডাক্তারদের ওপর আক্রমণ ঘটেই চলছে। শুধু বেসরকারি ডাক্তাররা মার খাচ্ছেন তা নয়, সরকারি ডাক্তাররা সংখ্যার বিচারে বেশিবার আক্রান্ত হয়েছেন।
কারা মারছেন ডাক্তারদের? ক্ষুদ্ধ রোগী নেই যে তা নয়, কিন্তু প্রায় প্রতিটি ঘটনার পরে দেখা যাচ্ছে, তাঁদের ন্যায্য বা অন্যায্য বিক্ষোভের পর যখন ভাঙ্গচুর মারধোর শুরু হচ্ছে তখন রাশ চলে যাচ্ছে অন্য লোকেদের হাতে। আর আক্রমণ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না রোগীরাও—সেদিন জোকা-র সরকারি হাসপাতালে রোগীমৃত্যুর পরে একদল আক্রমণকারী আইসিইউ-তে চড়াও হয়ে এক বয়স্কা রোগিণীর অক্সিজেন-স্যালাইন খুলে তাঁকে মেরে ফেললেন। অতএব ডাক্তারের ওপরে রোগী ক্ষেপে গেছে, কেবল এমনটা নয়। একবার ভাঙ্গচুর শুরু হলে গুণ্ডা আর রাজনীতিতে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে আগ্রহীরা আসছেন, তোলাবাজরাও বাদ নেই। বর্বর আক্রমণ হচ্ছে ডাক্তার-নার্স থেকে অন্য রোগীদের ওপরেও। সরকারি জিনিসপত্রের ক্ষতি হচ্ছে, সরকারি কর্মীরা কাজে বাধা পাচ্ছেন, রোগীরা হয়রান হচ্ছেন—সরকার ফিরে দেখছেনও না্। বেসরকারি হাসপাতাল হোক আর সরকারি, অপরাধীরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে, পুলিশ তাদের নামে কেস নিচ্ছে না, নিলেও ধরছে না। সন্দেহ হয়, প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে কী নির্দেশ আছে? অন্যদিকে, বড় মিডিয়া দিনের পর দিন অপরাধীদের হিরো বানিয়ে দিচ্ছে, আর ডাক্তারদের ভিলেন।
এর ফল ফলতে শুরু করেছে। কিছু ডাক্তার চাকরি ছেড়েছেন, কিছু ডাক্তার বিশেষ দায়িত্ব ছেড়েছেন। আজ ডাক্তারদের জন্য সরকারি চাকরি দেবার বিজ্ঞপ্তিতে সাড়া কম, চাকরিতে যোগদান আরও কম। সরকারি স্বাস্থ্যপরিষেবায় ডাক্তারের অভাব চিরকালের, কিন্তু এবার তা সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবার উপক্রম। সরকার বয়স্ক ও রোগগ্রস্ত ডাক্তারদের রিটায়ার না করিয়ে আর বন্ড দিয়ে সদ্য-পাশকরা ডাক্তারদের তিনবছর গ্রামে পাঠিয়ে ডাক্তারের অভাব কমিয়ে দেখাচ্ছেন। কিন্তু এঁদের দিয়ে দায়ঠেলা হয়, মানুষের জীবন বাঁচানোর কাজটা দায়ঠেলা করে হয় না।
কিন্তু এ হল সমস্যার চূড়া, আরও গভীরে তার ডালপালা, শিকড়। আসল কথাটা হল, ডাক্তার এখন চিকিৎসা করতেই ভয় পাচ্ছেন। মনোযোগ না দিয়ে রোগী ঠিকভাবে দেখা যায় না। এতদিন বেশ কিছু ডাক্তার ছিলেন যাঁরা পয়সাটাকেই মুখ্য করে দেখতেন, রোগীর কাছ থেকে কেমন করে পয়সা হাতানো যায় তাই ভাবতেন। তাঁরা ডাক্তারি পেশাটাকেই জনমানসে অনেক হেয় করেছেন। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে সবথেকে রোগীদরদী ডাক্তারও রোগী দেখার সময় পুরো মনোযোগ সেদিকে দিতে পারছেন না; ভাবছেন, কী করলে আক্রমণ আসবে না, প্রেসক্রিপশনে কী লিখলে পরে রোগীর শুভার্থী-ভোটপ্রার্থী হঠাৎ-আপনেরা তাঁর দরজায় হানা দেবে না, আদালতে কোন কথাটা মান্য হবে। এমন পরিবেশে ভাল চিকিৎসা অসম্ভব। রাতবিরেতে শহরে-মফস্বলে ডাক্তার আর বাড়ি গিয়ে রোগী দেখছেন না, কেন না যথাসাধ্য চেষ্টার পরও যদি খারাপ কিছু ঘটে তবে রোগীর বাড়ির লোক হয়তো ছেড়ে দেবেন, কিন্তু পাড়ার দাদারা ছাড়বেন না—জনদরদী সাজার সহজ রাস্তা এখন ডাক্তার পেটানো, আর পুলিশ এব্যাপারে ঠুঁটো জগন্নাথ।
টাকাকড়ি যত বেশি মানুষের মূল্যবিচারের মাপকাঠি হয়ে উঠেছে, লোকের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেবা করার মতো ডাক্তার ততো কমেছে। তারপর এল ডাক্তারের জন্য ক্রেতাসুরক্ষা আইন, বাড়ল চিকিৎসা-গাফিলতির মোকদ্দমা। ডাক্তারকে বাধ্য হয়েই সতর্ক হতে হল। সামান্য উপকরণে রোগীর সাধ্যমত চিকিৎসা করার দায় নেওয়া আর সম্ভব হল না। বিজ্ঞানের নিয়মেই সব রোগী ভাল হবে না, তাঁরা যদি আদালতে অভিযোগ করেন তো ডাক্তার রোগীর কথা ভেবে কম পয়সায় চিকিৎসা করিয়েছেন এমন কথা জজসাহেব মানবেন না। শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত চিকিৎসা না-করানোর অভিযোগে ডাক্তারের সাজা হবে। ফলে ডাক্তারদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করিয়ে, দামী ওষুধ না দিয়ে, চিকিৎসার উপায় রইল না। আর সাধারণ লোক ভাবলেন, নির্ঘাত ল্যাবরেটরির কমিশন খেয়ে বেশি পরীক্ষা করছে, ওষুধ কোম্পানির পয়সা নিয়ে দামি ওষুধ লিখছে! যেহেতু কিছু ডাক্তার (যাদের অনেকেই ভূয়ো ডাক্তার বলে ধরাও পড়েছেন) এসব করেন, সেহেতু গোটা পেশাটাই কালিমালিপ্ত হল। এভাবে রোগী আর ডাক্তার—উভয়েরই ক্ষতি বেড়ে চলল, পাল্লা দিয়ে বাড়ল অবিশ্বাস।
কেন এমন হল? এর উত্তর পেতে গেলে গত আড়াই-তিন দশকের খবরের কাগজের পাতাগুলো উলটে দেখতে হবে। ১৯৯০ সালেও কলকাতায় বড় কর্পোরেট হাসপাতাল ছিল না বললেই চলে। সেই সময় সমস্ত খবরের কাগজ সরকারি হাসপাতালগুলোর দোষ দেখাতে উঠেপড়ে লাগল। নোংরা, পরিষেবা খারাপ, ব্যবহার খারাপ। এর পুরোটা অসত্য, তা নয়। সরকার এব্যাপারে কিছু করলে, দোষ শোধরাত। কিন্তু তা হল না। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষ কষ্ট করেও নার্সিং হোমে যাওয়া অভ্যাস করে ফেললেন, একটু পয়সাওলারা গেলেন চেন্নাই-মুম্বাই-দিল্লী, আর বড়লোকেদের জন্য অল্প কিছু দামী জায়গা তো ছিলই। ক্রমে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলে সামাজিক মর্যাদাহানি হতে শুরু করল। ততদিনে একে একে অনেকগুলো বেসরকারি কর্পোরেট হাসপাতাল এসে গেছে কলকাতায়। এবার লোকে যেন বুঝে গেল, সরকারি হাসপাতাল মানে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। ঝাঁ-চকচকে হাসপাতালগুলো কোনো কাজ করেনি, কেবল পয়সা নিয়েছে, তাও নয়। কিন্তু অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যও যে মানুষের পাওনা একটা দাবি, তা না মেটানোর সংকটবোধ আর মধ্যবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্তের মননে ঠাঁই পেল না। প্রাইভেট স্কুল আর প্রাইভেট হাসপাতালের রমরমাতে অধিকার-এর ব্যাপারটা হারিয়ে গেল।
পড়ে রইলেন গ্রাম-মফস্বলের মানুষ এবং শহরের হতদরিদ্রজন। চিকিৎসাবিজ্ঞান বর্তমানে কী পারে আর কী পারে না, কতটা চিকিৎসা পরিষেবা কোথায় পাওয়া সম্ভব, সেটা তাঁরা জানেন না। ফলে এঁদের দিয়ে ডাক্তারের মুখে বিষ্ঠা মাখানো মারধর করানো সম্ভব, কিন্তু যথার্থ পরিষেবার জন্য চিন্তা করে দাবী রাখা বা আন্দোলন করা প্রায় অসম্ভব। আর এঁদের পাশে শহুরে মধ্যবিত্তের দাঁড়ানোর বাস্তবভূমি নেই, কেননা তাঁরা সরকারি পরিষেবা নেন না, তা নিয়ে তেমন ভাবিত নন। অন্যদিকে সরকারি চিকিৎসকদের হয় আজ্ঞাবহ ভৃত্যে পরিণত করা হয়েছে বা করার চেষ্টা হয়েছে, অথবা তাড়ানো হয়েছে।
আমাদের স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অধিকারের কথা বলেন সব দল, অথচ ক্ষমতায় গেলে সেসব অধিকার দেন না। তাঁদের একটা আড়াল চাই। ভারতে ধনীদের সেবা করতে চাইলেও দরিদ্র ও সাধারণ মধ্যবিত্তের ভোটেই জিততে হয়। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দায়িত্ব সরকারের কাঁধ থেকে নামাতে চাইলে, সেখানে গোপনে বড় ব্যবসাদারদের লাভের পুরো সুযোগ করে দিতে চাইলে, আর সেটা করতে গিয়ে মানুষের ক্ষোভের মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইলে মানুষের চোখের সামনে একটা কাকতাড়ুয়া-শ্রেণীশত্রু খাড়া করতে হয়। ডাক্তার সেই কাকতাড়ুয়া, কেন না তাকেই চিকিৎসাক্ষেত্রে সবচেয়ে আগে দেখা যায়। আর ডাক্তারই সেই শ্রেণীশত্রু, কেন না এই গরীবের দেশে সে তুলনায় অবস্থাপন্ন। অতএব অসুর নির্মাণ, হাতে খড়্গ, গলায় স্টেথোস্কোপ, পেশায় রক্তচোষা।
কিছু ক্ষমতাবান ও ক্ষমতালিপ্সু মানুষ ও দল কাকতাড়ুয়া-শ্রেণীশত্রুর ওপর মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগাচ্ছে, ডাক্তারের চিকিৎসার ভুল-ঠিক বিচার করছে তারা, হাতেগরম শাস্তি দিচ্ছে, মানুষ খুশি হছেন, বা আতঙ্কে নিশ্চুপ। ক্ষমতাধরদের হিসেব সোজা। মানুষকে স্বাস্থ্যের অধিকার দেওয়া কঠিন কাজ, কিন্তু মানুষ সেটাই চায়। অতএব বানিয়ে দাও হাসপাতাল-ইমারত, টিভি-তে খবরের কাগজে ঘোষণা করে দাও চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে, রোগী বুকে বড় আশা নিয়ে যাক হাসপাতালে। হাসপাতালের দেওয়াল জুড়ে লিখে রাখো, সকল ব্যবস্থা আছে। ডাক্তারের মুখ থেকে সে যেন প্রথম শোনে, বেড নেই, ওষুধ নেই, ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের ইত্যাদিও খুব কম। সে নিজের মতো করে বুঝে নেবে সরকারের দোষ নয়, ডাক্তারের দোষ। আর রোগী যদি নাও বোঝে, আশেপাশে শুভার্থী-ভোটপ্রার্থীরা আছেন, তাঁরা গলার জোরে বা গায়ের জোরে রোগীর জন্য বেড আদায় করবেন, তাঁর সঙ্গে সুরে সুর না মিলিয়ে অসহায় রোগী করবেই বা কী?
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস’ ফোরাম মনে করে ডাক্তার ও রোগীর স্বার্থ এক ও অভিন্ন—রোগকে প্রতিরোধ করা, রোগ হলে তাকে সারানো, সারাতে না পারলে যতটা সম্ভব আরাম দেওয়া। চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনও সবকিছু নিশ্চিত করে বলে দিতে পারে না। তাই ডাক্তারকে বিশ্বাস না করে রোগীর উপায় নেই। অপরপক্ষে, ডাক্তারেরও রোগীকে সারানোর সাধ্যমতো চেষ্টা না করে উপায় নেই, নইলে সে নিজের কাছেই প্রত্যহ মরে যাবে, প্রত্যহ অর্থহীন এক জীবন টেনে নেবার গ্লানিতে তার দমবন্ধ হয়ে আসবে।
ডাক্তারকে আপনারাই বাঁচাতে পারেন। কেবল শারীরিক আক্রমণের হাত থেকে নয়, তার ডাক্তারিবিদ্যাকে নিছক টাকা রোজগারের এক যন্ত্র হয়ে ওঠার হাত থেকে।
তাই জেলায় জেলায় রোগী, তাঁর পরিজন, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সকলে ঐক্যবদ্ধ হোন। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী নিগ্রহ বন্ধ করা ও সুচিকিৎসা পাবার দাবিতে জনমত গড়ে তুলুন।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস’ ফোরাম, ২৪৫, রামকৃষ্ণ রোড, নব ব্যারাকপুর, কলকাতা ৭০০ ১৩১'এর তরফে ডা. অর্জুন দাশগুপ্ত কর্তৃক প্রকাশিত।