এই তাড়াহুড়োর এসআইআর কেন?
প্রশান্ত ভট্টাচার্য
প্রদীপ কর। নিছক একটি নাম নয়, বাংলায় এসআইআর (SIR)'এর প্রথম বলি। আত্মঘাতী প্রৌঢ় তাঁর সুইসাইড নোটে উল্লেখ করেছেন এসআইআর'এর আতঙ্কের কথা। সে ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই বীরভূমের ইলামবাজারে ৯৫ বছরের ক্ষিতীশ মজুমদার এসআইআর আতঙ্কে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলেন। এরপরে পানিহাটিতে এক গৃহবধূ ও কেরলে এক পরিযায়ী শ্রমিকও একইভাবে নিজেদের শেষ করেছেন এবং কোচবিহারে আরও একজন আত্মহননের চেষ্টা করে প্রাণে বেঁচে গেছেন। আমি মনে করি, এই প্রতিটি ঘটনাই রাষ্ট্র কর্তৃক সংঘটিত পরোক্ষ রাজনৈতিক হত্যা। কেন্দ্রীয় সরকারেরর পিট্টু জ্ঞানেশ কুমার পরিচালিত নির্বাচন কমিশন এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর এগজিকিউটিভ এজেন্সি। আর সে কারণেই এই আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে বিজেপি'র তথাগত রায় ও সজল ঘোষ টিভি চ্যানেলের চ্যাটবাজিতে যে ভাষায় ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করলেন তা শুধু অশ্লীল নয়, অমানবিক ও নৃশংস।
অতিবাচাল ও স্বঘোষিত ধূর্ত তথাগত রায় বললেন, এটা একটু কাঁচা কাজ হয়ে গেছে। বঙ্গ বিজেপির আধবুড়ো তরুণ তুর্কি সজল ঘোষের মত, মানুষ মরলে শকুনও এত তাড়াতাড়ি আসে না। তাই বুঝি! হিন্দি ও হিন্দুত্বর সঙ্গে ঘর করা সজল এটা জানেন না, শকুনের আগে অবশ্যই কুকুর-শেয়াল আসে। ছেঁড়ে-খোঁড়ে লাশ। তার পর শকুনের পালা। না-বাঙালি দলের বোড়ে আর কী-ই বা জানবেন!
আর তিলোত্তমা যা বললেন তা শুনে আমার একটা জিনিস পরিস্কার হয়েছে যে, ওই লেখিকা আদপে অবিদ্যার ধাড়ি! নইলে এ ভাষায় মুসলমান বিদ্বেষের কথা কোনও সংবেদনশীল মানুষ বলতে পারেন!? ওঁর ইসলামোফোবিয়া তো সংঘ সঞ্চালকদেরও লজ্জা দেবে; খোদ নেতানিয়াহুকেও কুণ্ঠিত করবে। কী বলেছেন এই আদ্যোপান্ত আবাপ পণ্যটি? সারা পৃথিবীতে মুসলমান কমিউনিটি নাকি সন্ত্রাস তৈরি করেছে। এই সন্ত্রাসবাদীরা নাকি সর্বত্র খুন করে, রক্তপাত ঘটায়। তাই ওনার ভাষায়, যারা অনুপ্রবেশকারী সেই মুসলমানদের যাদের নাকি তিনি জন্ম থেকে তাঁর পাশে দেখেননি, বাংলায় কথা বললেও তাঁদের নাকি তাঁর 'দুশমন' বলে মনে হয়। সার্থক জনম আমার তিলোত্তমার কথা শুনে!
তিলোত্তমা সাহিত্যিক হিসাবে কী ছাইপাশ লেখেন তা আমি জানি না, জানার ইচ্ছেও নেই। শুধু এটা বুঝেছি, এক অতল অবিদ্যার ধাড়ি বলেই তিনি জানেন না, সব ধর্মেরই কিছু লোক ধর্মের নামে সন্ত্রাস করে মুখ্যত ধনী থেকে ধনীতরদের হাতিয়ার হয়ে আরও শোষণের ব্যবস্থা করতে। এ সম্পর্কে তিলোত্তমার হয় স্পষ্ট ধারণা নেই, নয় তিনি নিজেই এমন এক হাতিয়ার হয়ে উঠতে চান তাঁর প্রভুদের তুষ্ট করতে। আর গত ১১ বছর ধরে ভারতে যা ঘটে যাচ্ছে? পুশব্যাকের নামে বাঙালিদের জেসিবি'তে উঠিয়ে বাংলাদেশ সীমান্ত পার করে ছুঁড়ে ফেলে দিলেও তিলোত্তমা দেখতে পান না। বীরভূমের অন্তঃসত্ত্বা সোনালি বিবিকে দেশছাড়া করা মোদী-শাহর শাসন নিয়ে তাঁর মাথাব্যথাও নেই। প্রদীপ কর বা ক্ষিতীশ মজুমদারের আত্মহত্যা বা খাইরুল শেখের আত্মহত্যার চেষ্টা তাঁকে ভাবায় না, বিচলিত করে না, কারণ এদের কাউকে তিনি জন্ম থেকে পাশে বেড়ে উঠতে দেখেননি। তিনি দেখতে পান না তথাকথিত বর্ণ হিন্দুদের নিম্নবর্গের ওপর অত্যাচার। তিনি কোনওদিন প্রশ্ন করেননি, কেন তথাকথিত হিন্দু উচ্চজাতের সঙ্গে হিন্দু 'ছোটজাত' একত্রে থাকতে পারে না। কেন নগরে ও গ্রাম-মফস্বলের একই অঞ্চলে মিলেমিশে হিন্দু-মুসলমানরা থাকে না। কেন সব আলাদা আলাদা ঘেটো করে বাঁচে। এসব প্রশ্ন করলেই তো তিলোত্তমার বর্তমান গুরুকলের হিন্দু মৌলবাদী সন্ত্রাসবাদীদের কথা চলে আসবে, আসবে তাদের ভূমিকার কথা। তাই তিনি এড়িয়ে যান বা তিনি এতটাই অশিক্ষিত যে দেশের ইতিহাস-ভূগোলও পড়েননি ঠিক করে। উনিশ-বিশ শতকের রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দর যে ভাবধারা, তা-ও তিনি অনুধাবন করতে চাননি। ৫০০ বছর আগে চৈতন্যর জাগরণের বার্তাও তিনি পড়েননি। তিনি এও জানেন না যে, তৎকালীন বাংলার সুলতান হুসেন শাহের হস্তক্ষেপেই চৈতন্যদেব নবদ্বীপে তাঁর নগর সংকীর্তন করতে পেরেছিলেন, যা উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। আসলে, তিলোত্তমা'র কোনও চোরাগোপ্তা অ্যাজেন্ডা আছে অভিজিৎ গাঙ্গুলির মতো।
আমরা তো জানি, সংসদের ভিতরে ও বাইরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বহুবার এনআরসি করার হুমকি দিয়েছেন। ভারতীয় উগ্র দক্ষিণপন্থার সবচেয়ে জঙ্গি নেতা শাহ বলেন, 'ভারতের সব নাগরিকের জন্য এনআরসি তালিকা হবে। সবার নামই যুক্ত হবে এনআরসি তালিকায়। কোনও ধর্ম বা বিশেষ অঞ্চলের ভিত্তিতে এনআরসি করা হচ্ছে না।' কী নিদারুণ মিথ্যেবাদী এই লোকটা! তেমনই ওঁদের এখানকার নেতারাও। বঙ্গ বিজেপির নেতা সহ বহু তথাকথিত সেলিব্রিটিই বলছেন, ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) হচ্ছে। ২০০২ সালেও হয়েছিল। এর সঙ্গে এনআরসি-র কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু এসআইআর'এর গর্ভে যে এনআরসি আছে, সে বিতর্ক তো উসকে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ স্বয়ং। তাঁর ভাষ্যের পর এবারের এসআইআর'কে ২০০২ সালের মতো নির্বিষ বলে ভাবা যাচ্ছে না। সম্প্রতি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে অমিত শাহ স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন, এবারের এসআইআর কার্যত এনআরসি-র প্রথম ধাপ। তাঁর বার্তা, এসআইআর'এর মাধ্যমে প্রথমে অবৈধ ভোটারদের চিহ্নিত (ডিটেক্ট)করা হবে, তারপর তাঁদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ (ডিলিট) দেওয়া হবে, পরে বিতাড়িত করা (ডিপোর্ট) হবে। অর্থাৎ, ডিটেক্ট, ডিলিট ও ডিপোর্ট-- এই থ্রি-ডি ফর্মুলার ওপর ভিত্তি করেই এবারের এসআইআর। এই বক্তব্য জাহির করে বিজেপি সমর্থকদের দেদার হাততালিও কুড়িয়েছেন পদ্ম শিবিরের নাম্বার টু। তাই এবারের এসআইআর নিয়ে বাংলা তথা দেশের নাগরিকদের একাংশ যদি আতঙ্কিত বোধ করেন, তাকে অকারণ বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কোনও গণতন্ত্রের বুলি দিয়ে চাপা দেওয়া যাবে না নাগরিকদের বেনাগরিক করার এই হীন ষড়যন্ত্র।
এই ষড়যন্ত্রমূলক আতঙ্কের জেরে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এর জন্য কে বা কারা দায়ী? এই বিচার তিলোত্তমার মতো স্পনসর্ড লেখকরা করবেন না, বিচার হবে জনতার আদালতে। মনে রাখবেন, রামমন্দির, মুসলিম জুজু, সাম্প্রদায়িকতার তাস খেলেও যখন ২০২৪ সালের ভোটে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হল না, তারপরই বিজেপি সিলেক্টেড ভোটারের লাইন নিয়েছে। কমিশনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্যে ভোটচুরি করে জিততে হচ্ছে নির্বাচন। বিধানসভার ভোটার প্যাটার্ন'এর অ্যালগরিদমটা তারা বুঝে নিয়েছে। তাই, কোথাও বাদ পড়বে কোথাও সংযোজন হবে। যেমন এখন বৃহৎ মুম্বই পুরনিগমের ভোটের কথা মাথায় রেখে ভুয়ো ভোটার যুক্ত করা হয়েছে ভোটার তালিকায়! এর প্রতিবাদে এক মঞ্চে উঠে এসেছেন দুই ঠাকরে ভাই, উদ্ধব ও রাজ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এখানেও তাই হবে। বিহারে যখন প্রথম এসআইআর শুরু হল, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম বলেছিলেন যে বিহার নামেই, এর আসল লক্ষ্য বাংলা। জ্ঞানেশ কুমারের ঘোষণার দিন তা প্রমাণ হল। সীমান্ত রাজ্যগুলোর মধ্যে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই এসআইআর চালু হল। এর মাধ্যমে ভাগীরথীর পূর্ব তীরে মূলত বলি হবেন নিম্নবর্গের হিন্দু, দলিত, মতুয়ারা। বলা যায়, তথাকথিত 'বাঙালরা'। আর বাঙালরা জব্দ হচ্ছে বলে ভাগীরথীর পশ্চিমের 'ঘটি' হিন্দু বাঙালিরা বিজেপিকে হাত খুলে ভোট দেবেন বলে পদ্ম শিবিরের আশা।
অনুপ্রবেশকারীদের দেশের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে, এ নিয়ে কারও কোনও আপত্তি থাকতে পারে না। কিন্তু অবৈধ ভোটার বাদ দেওয়ার অছিলায়, নানা নথির ছুতোয়, এসআইআর'এর মাধ্যমে যদি একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের নাগরিকত্ব হরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় তাহলে বিতর্ক ও সমালোচনার ঝড় উঠবেই। অন্যায় ভাবে প্রকৃত নাগরিকদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে কেউ যদি প্রতিরোধ গড়ারও ডাক দেন— তাকে অসাংবিধানিক বলা যায় না। নথি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের মনোভাব, নানা হুঁশিয়ারি, ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়ার মতো একটি স্বাভাবিক বিষয়কে কার্যত নাগরিকত্ব যাচাইয়ের পরীক্ষায় পর্যবসিত করেছে। যদিও নাগরিকত্ব যাচাইয়ের অধিকার কমিশনের নেই। গরিব, পরিযায়ী, প্রান্তিক-সমাজের পিছিয়ে পড়ারা— সংখ্যালঘু বা যে সম্প্রদায়েরই মানুষ হন না কেন, তাঁদের যথাযথ কাগজ না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারে সাধারণত কাগজ নিয়ে কারও মাথাব্যথা থাকে না। যাদের চালচুলোর ঠিক নেই, নিজের শরীরটাই যত্নে রাখতে পারে না, তারা রাখবে নথি! ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, আধার কার্ড (এসআইআর-এ যে নথিগুলোর কার্যত গুরুত্ব নেই)'এর মতো কাগজপত্র তাঁরা গুছিয়ে রাখেন। কারণ, এই নথিগুলি তাদের দৈনন্দিন জীবনে ও সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার মতো জীবিকা নির্বাহের কাজে লাগে।
যাঁরা লাফাচ্ছেন, নিজেদের সমস্ত নথিপত্র সব ঠিক আছে, তাঁরা একবার যে ফর্মটা নির্বাচন কমিশন থেকে দেওয়া হবে, সেটা দেখুন। যাঁরা আপনাদের মতো 'শিক্ষিত' নন, তাঁরা এই ফর্ম নিজেরা ভর্তি করতে পারবেন বলে মনে হয়? আমাদের বলা হচ্ছে, SIR ২০০২ সালে শেষবার হয়েছিল-- সেটা সম্পূর্ণ ভুল এবং মিথ্যা কথা। যে কোনও বছরেই যেটা হয়ে থাকে সেটা সামারি রিভিশন এবং তা করার দায়িত্বও কমিশনের। তাঁরা সেটা করেনি কেন, সেই প্রশ্ন করুন। নির্বাচন কমিশনকে স্পষ্ট করে বলতে হবে, কেন ২০০২ সালকে ধরা হচ্ছে। কেন ১৯৮৭ বা ১৯৫১ নয়? কারণ, সিএএ ২০০৩ কার্যকর করতে গেলে ২০০২-এর বেঞ্চমার্কই লাগবে। কারণ, ১৯৮৭ সালেই নাগরিকত্ব আইন প্রথম বদল হচ্ছে। জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। 'ঘুরপথে এনআরসি' নয়, এসআইআর'এ যে বিশেষ কাগজপত্র চাওয়া হচ্ছে তাতে এর মাধ্যমে সরাসরিভাবে এনপিআর-এর প্রথম ধাপের কাজ হচ্ছে। ভোটের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে এ কাজ না করলে ওরা অন্তত বাংলায় এটা করতে পারত না, এমনকি সেনসাসের সঙ্গে মিলিয়েও করতে পারত না, সেটা জেনেবুঝে ভোটের সঙ্গে মিলিয়ে করছে। বিহারে যা করা হয়েছে তা বাংলার এসআইআরের উপক্রমণিকা ছাড়া কিছু নয়। কত মানুষ বাদ যাবেন কল্পনাও করতে পারবেন না। কত প্রদীপ কত ক্ষিতীশের মৃত্যু হবে তা কেউ জানে না।
উদ্বাস্তু আন্দোলনের বিশ্বস্ত নেতা সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস ঠিকই বলেছেন, এসআইআর'এ বড়জোর পাঁচ শতাংশ মুসলিম বাদ পড়বে, আসল কোপটা আসবে গরিব, নিম্নবর্গের হিন্দুদের ওপর। এটাই এসআইআর'এর উদ্দেশ্য। তাই, গত ২৭ অক্টোবরের পর এখন পর্যন্ত যাঁরা আত্মঘাতী হলেন, সবাই হিন্দু।
