তথ্য নিছক তথ্য নয়
অরুণাভ বিশ্বাস
'একক মাত্রা'র নভেম্বর সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে 'তথ্য নিছক তথ্য নয়' নিয়ে বলছেন আশীষ লাহিড়ী
২০১৮র কলকাতা বইমেলা মিলনমেলা প্রাঙ্গণ থেকে স্থানচ্যুত। নন্দন চত্বরের লিট্ল ম্যাগাজিন মেলারও নিয়তি একই। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের বদান্যতার মুখাপেক্ষি না হয়ে বা গিল্ড-অ্যাকাডেমির দিকে অভিযোগের অসহায় আঙুল না তুলে লিট্ল ম্যাগাজিনগুলির উচিত পাঠকের কাছে পৌঁছনোর নানা বিকল্প কৌশল উদ্ভাবন করা। বছরে একবার সরকারি মেলার ওপর নির্ভরশীল না হয়ে প্রচার ও বিক্রি বাড়ানোর জন্য লিট্ল ম্যাগাজিনগুলিকে জনসংযোগের বিভিন্ন উপায় বার করতেই হবে। বস্তুত এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য 'একক মাত্রা' এ বছরের গোড়া থেকেই নানান জায়গায় আড্ডা-আলোচনা সভা বা সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান আয়োজন করে আসছে। গত ৪ নভেম্বর কফি হাউসের বই-চিত্র গ্যালারিতে শুরুতে প্রয়োজনীয় এই কটি কথা স্মরণ করে সম্পাদক অনিন্দ্য ভট্টাচার্য 'একক মাত্রা'র নভেম্বর'১৭ সংখ্যা (প্রচ্ছদ বিষয়ঃ তথ্য নিছক তথ্য নয়)'র মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের সূচনা করেন।
রাজ্যের ডেঙ্গি পরিস্থিতি নিয়ে বলছেন ডাঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য
১) রাজ্য সরকার ডেঙ্গি সম্পর্কিত তথ্যকে গোপন করছে বলে যদি মেনে নেওয়া হয় তাহলে বুঝতে হবে 'চিকিৎসা' নামক disciplineটিকে রাজ্য সরকার নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইছে। তাই চিকিৎসকরা কী লিখবেন ঠিক করে দিচ্ছে প্রশাসন।
২) এডিশ মশা ২০০ মিটার ব্যাপী ক্ষেত্রের মধ্যেই বিচরণ করে। এখানেই শেষ নয়। ঐ ব্যাপ্তির মধ্যে কোনও রুগীর ডেঙ্গি ধরা পড়লে আবারও ২০০ মিটার। এভাবে ডেঙ্গির ক্ষেত্র প্রসারিত হতেই থাকে। এরই মাঝে কেউ নিজের বাড়ি নিজের ফ্ল্যাট পরিচ্ছন্ন রাখলেই বা জমা জল দূর করলেই ডেঙ্গি নির্মূল হবে এমনটা নয়। গোটা এলাকাকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে বা জমা জল দূর করতে হবে। সরকারি প্রচারে ব্যক্তিবিশেষকে তার নাগরিক কর্তব্য পালনে সচেতন করা হয়, কিন্তু আস্ত communityর প্রতি সরকারের দায়িত্বর বিষয়টি উহ্য রয়ে যায়। অর্থাৎ, ডেঙ্গির মতো একটি community disease এর মোকাবিলায় ব্যক্তিকে ঠেলে দেওয়া হয়। এটি একটি paradigmatic shift।
৩) দ্বিতীয়টির অনুষঙ্গেই তৃতীয় paradigmatic shift পরিলক্ষিত হয় যখন ডেঙ্গিকে জনস্বাস্থ্যের আওতা থেকে সরিয়ে clinical health বা ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যে পর্যবসিত করা হচ্ছে যা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।
জয়ন্তবাবুর অভিমত এই paradigmatic shiftগুলির ফলে আখেরে লাভ বেসরকারি পুঁজির। কারণ, এর সাথে দানবীয় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলির স্বার্থ জুড়ে স্বাস্থ্য বা ক্লিনিক্যাল হেল্থ পাঁচতারা ক্লিনিকের খাঁচায় অনিবার্যভাবে ঢুকে পড়ছে। নতুন নতুন স্টেট ক্লিনিক্যাল অ্যাক্ট'এর পথ পরিষ্কার হচ্ছে। Tropical neglected disease এবং আলমা-আটা কনফারেন্সের comprehensive primary healthcare স্বাস্থ্য পরিষেবার বাণিজ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে। এখানে মানুষ নেই, মানুষের দেহ আছে শুধু। Geoffrey Rose দেখিয়েছেন কোনও এলাকায় ১০০০টি risk factors থাকা মানেই ঐ এলাকার বাসিন্দাদের অন্য লোকেদের থেকে রোগে পড়ার সম্ভাবনা ১০০০ গুণ বেশি রয়েছে এমনটা নয়। অথচ ডেঙ্গি নিয়ে আতঙ্ক যেভাবে ছড়াচ্ছে তাতে লক্ষ লক্ষ টাকার বিজ্ঞাপনে প্রভাবিত হয়ে লক্ষ টাকার মশা নিরোধক বিক্রি হলেও সরকারের তরফে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, ভাইরোলোজিস্ট, মলিকুলার বা সেল বায়োলজিস্ট, ফার্মাসিস্ট এদের পারস্পরিক সমন্বয়ের ভিত্তিতে কোনও গবেষণাকে বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয় না। অবস্থার সামাল দেন শত শত নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসকরা।
প্রসঙ্গক্রমে জয়ন্তবাবু আক্ষেপ করেন চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণায় dengue heomeregic syndrome যতটা চর্চিত dengue shock syndrome ততটা চর্চিত নয়। এ ক্ষেত্রে প্লেটলেট কাউন্ট না কমলেও ক্যাপিলারি ওয়ালের integration বিনষ্ট হয়ে রুগীর মৃত্যু হয়। আসলে dengue shock syndromeএর কোনও ইঁদুর বা খরগোশ মডেল কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা যায়নি বলেই এ নিয়ে গবেষণা বিশেষ এগোয়নি।
শেষে জয়ন্তবাবু আফ্রিকার গরিব দেশ রোয়ান্ডার উদাহরণ দিয়ে দেখান সরকারের সদিচ্ছা থাকলে কী অসাধ্যসাধন সম্ভব। জনস্বাস্থ্যের জন্য সে দেশের সরকার আগে মাথাপিছু ০.৫$ খরচা করত এবং life expectancy ছিল ৪২ বছর। এখন সেখানে মাথাপিছু ৫০$ খরচ করে সরকার life expectancy ৬৬ বছরে নিয়ে যেতে পেরেছে। রোয়ান্ডার সরকার বুঝতে পেরেছে স্বাস্থ্যক্ষম জনসংখ্যা জন্ম দেয় সক্ষম অর্থনীতির। রোয়ান্ডার স্বাস্থ্য মন্ত্রী ডাঃ Agnes Binagwaho (MD) বলেন, 'Investment in health has stimulated shared economic growth as citizens live longer and with greater capacity to pursue lives they share.'
আশীষ লাহিড়ীর হাতে স্মারক তুলে দিলেন দেবপ্রিয়া রায় চৌধুরী
'একক মাত্রা'র নভেম্বর সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করলেন (ডানদিক থেকে) - তুষার চক্রবর্তী, অমিত চৌধুরী,
অচিন চক্রবর্তী, আশীষ লাহিড়ী, জয়ন্ত ভট্টাচার্য ও অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
প্রবন্ধের প্রথম লাইন লিপিকা কাব্যগ্ৰন্থের যে কোনো লাইনকে মনে পড়াবে -- 'পৃথিবীর রাত্রিটি যেন তার এলোচুল, পিঠ-ছাপিয়ে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত নেমে পড়েছে।' কিন্তু পরের লাইনেই বোঝা যায় কবিতা লেখা তাঁর উদ্দেশ্য নয়। স্পষ্ট ভাবেই তিনি বলেন রাত্রি কেবল পৃথিবীরই এলোচুল -- এমন পৃথিবী যা সৌরজগতে অতি ক্ষুদ্র ও অকিঞ্চিতকর।
কিন্তু সৌরজগৎলক্ষ্মীর শুভ্রললাটে একটি কৃষ্ণতিলও সে নয়। ঐ তারাগুলির মধ্যে যে-খুশি সেই আপন শাড়ির একটি খুঁট দিয়ে এই কালিমার কণাটুকু মুছে নিলেও তার আঁচলে যেটুকু দাগ লাগবে তা অতি বড়ো নিন্দুকের চোখেও পড়বে না।
অর্থাৎ, সৌরজগৎলক্ষ্মীর রাজত্বে রাত্রির বিশেষ কোনও দ্যোতনা নেই। অথচ তার সকল কর্মকাণ্ড নিয়ে এই পৃথিবীতেই থাকে মানুষ যার ভালো নাম হোমো সেপিয়েন্স। প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে এই প্রসঙ্গে তাই কার্ল সাগানের সুবিখ্যাত উক্তিটি পুরোটা তুলে দেওয়ার লোভ সংবরণ করা গেল না:
The earth is a very small stage in a vast cosmic arena. Think of the rivers of blood spilled by all those generals and emperors so that in glory and in triumph they could become the momentary masters of a fraction of a dot. Think of the endless cruelties visited by the inhabitants of one corner of the dot on scarcely distinguishable inhabitants of some other corner of the dot. How frequent their misunderstandings, how eager they are to kill one another, how fervent their hatreds. Our posturings, our imagined self-importance, the delusion that we have some privileged position in the universe, are challenged by this point of pale light. Our planet is a lonely speck in the great enveloping cosmic dark. In our obscurity -- in all this vastness -- there is no hint that help will come from elsewhere to save us from ourselves. It is up to us. It's been said that astronomy is a humbling, and I might add, a character-building experience. To my mind, there is perhaps no better demonstration of the folly of human conceits than this distant image of our tiny world. To me, it underscores our responsibility to deal more kindly and compassionately with one another and to preserve and cherish that pale blue dot, the only home we've ever known.
সাগান মানুষের অস্তিত্বকে অসহায় অবনত ভেবে মানুষকে পৃথিবীর উপর নির্ভরশীল বলে মনে করেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় পৃথিবীর মানুষ গোটা জগতসংসারকে নির্মাণ করে চলেছে। তাই বীথিকা কাব্যগ্ৰন্থের সংযোজিত কবিতা 'বাণী'তে তিনি লেখেন
অস্তিত্বের গহন তত্ত্ব ছিল মূক বাণীহীন
অবশেষে একদিন
যুগান্তের প্রদোষ আঁধারে
শূন্য পাথারে
মানবাত্মার প্রকাশ উঠিল ফুটি
চিৎপদ্মের আবরণ গেল টুটি।
শতদলে দিল দেখা
অসীমের পানে মেলিয়ে নয়ন
দাঁড়ায়ে রয়েছে একা
প্রথম পরম বাণী
বীণা হাতে বীণাপাণি।
সুতরাং আকাশভরা সূর্য তারা শুধু নয় বিশ্বভরা প্রাণও চাই। তবেই ব্রহ্মাণ্ডের পরিপূর্ণ এবং সার্থক রূপটি পরিস্ফুট হবে। কাজেই অনন্ত মহাবিশ্বের একপ্রান্তে এক ক্ষুদ্র গ্ৰহের আশ্রয়ে ক্ষণস্থায়ী প্রাণের যে ধারা প্রবাহিত হয়ে আসছে তার ভূমিকা নগণ্য নয়, মহৎ। আশীষবাবুর বক্তব্যে ফেরা যাক। তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথ বোঝাতে চেয়েছেন যে হোমো সেপিয়েন্স নামক প্রাণীটির ইন্দ্রিয় ও মন দিয়ে দেখা জগতের সঙ্গে সৌরজগতের, কিংবা সৌরজগত-অতিক্রান্ত মহাবিশ্বের ব্যাপ্ত-সুদূর বাস্তবতার সম্পর্ক নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সে-সম্পর্ক একমাত্রিক নয়, দ্রষ্টা-নিরপেক্ষ নয়। প্রশ্ন এই যে বিশ্বজগৎ সম্পর্কে মানুষ যে অবধারণা (perception) গঠন করে তা কতদূর objective (নৈর্ব্যক্তিক)? নেহাৎই খেলার ছলে রবীন্দ্রনাথ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন কয়েকটি উপমার আশ্রয়ে:
[রাত্রি] যেন আলোক মায়ের কোলের কালো শিশু, সবে জন্ম নিয়েছে। লক্ষ লক্ষ তারা অনিমেষে তার এই ধরণী-দোলার শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে। তারা একটু নড়ে না। পাছে ঘুম ভেঙ্গে যায়।
তারারা নড়ে না এটা নেহাৎই চোখে-দেখা একমাত্রিক উপরি-বাস্তবতা। আসলে যে তা নয় তা ততদিনে রবীন্দ্রনাথ জেনে গিয়েছেন। মনে রাখতে হবে আলোচ্য প্রবন্ধের রচনাকাল ১৯১৪ এবং ১৯০৫ সালের পর থেকে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব নিয়ে বিশেষজ্ঞ-অবিশেষজ্ঞ মহলে বিস্তর আলোড়ন শুরু হয়ে গিয়েছে। গতিবেগ, দূরত্ব বা সরণ, দ্বি বা ত্রি-মাত্রার অবধারণা যে পরম নয়, আপেক্ষিক, ততদিনে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথও কখনও প্রাচ্যের উপনিষদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, আবার কখনো ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণকালে পাশ্চাত্য মনীষা ও অনুসন্ধিৎসার সংস্পর্শে আসার ফলে, নিজের মিস্টিক কবি বা সাহিত্যিক ভাবমূর্তিটি অতিক্রম করে নিজস্ব দর্শন গড়ে নিতে চাইছেন।
বিজ্ঞানের জগতের সমসাময়িক পশ্চিমি যুগান্তকারী ভাবনার দার্শনিক তাৎপর্যটুকু সম্বন্ধে মোটের ওপর অবহিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রকৃতিকে বোঝার প্রচলিত পথগুলো যে বদলে যাচ্ছে সে সম্পর্কে না জানলে বিশ্বপরিচয়'এর মতো বই তাঁর পক্ষে লেখা সম্ভব হতো না। আশীষবাবুর মতে নিছক চোখে দেখা পর্যবেক্ষণ ও তার বিশ্লেষণ, যার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল বনেদি নিউটনীয় পদার্থবিদ্যা, তা যে আসল বাস্তবতার হদিশ নাও দিতে পারে, সেই বিপরীত প্রসঙ্গটা টেনে আনবার উদ্দেশ্যেই রবীন্দ্রনাথ তারারা 'একটুও নড়ে না' কথাগুলো ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তা তাঁর কল্পিত বৈজ্ঞানিক বন্ধুর সইল না। বন্ধুটি বললেন,
তুমি কোন সাবেককালের ওয়েটিং রুমের আরাম-কেদারায় পড়ে নিদ্রা দিচ্ছ, ওদিকে বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের রেলগাড়িটা যে বাঁশি বাজিয়ে ছুট দিয়েছে। তারাগুলো নড়ে না এটা তোমার কেমন কথা? একেবারে নিছক কবিত্ব!
'নিছক কবিত্ব' বলে বিদ্রুপ করায় রবীন্দ্রনাথ জুতসই উত্তর দেওয়ার জন্য তৈরি হলেন। পরবর্তীকালে যদিও তিনি মত পরিবর্তন করেন, তবুও এই প্রবন্ধ লেখার সময় কবির ধারণা ছিল বিজ্ঞান আর কাব্যের বৈসাদৃশ্য বুঝি অনপনেয়: যা বিজ্ঞান তা কাব্য হতে পারে না এবং উল্টোটাও তাই। এই প্রতিবেদনের পাঠক এই প্রসঙ্গে গ্যেটের উক্তি স্মরণ করতে পারেন:
The worthiest professor of physics would be one who could show the inadequacy of his text and diagrams in comparison to nature and the higher demands of the mind.
সাধারণ ভাবে মানুষের মনে এই ধারণাই বলবৎ আছে যে বিজ্ঞানের প্রতি কবিরা সহানুভূতিশীল নন, কারণ কবিরা মনে করেন না যে জগৎচরাচর সম্পর্কে বিজ্ঞান প্রকৃত সত্য পুরোপুরি তুলে ধরতে পারে। বরং তাঁরা ভাবেন বিজ্ঞানের দৌড় শুধু বিমূর্ত ধারণা তৈরীতে। জ্বলজ্যান্ত মূর্তিমান phenomenon বা প্রপঞ্চকে ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে তাকে বিশ্লেষণের নামে বহুলাংশে খণ্ডিত তথা প্রাণহীন করে ফেলে। তবে সব কবিরাই বিজ্ঞানের এই empirical knowledgeকে খাটো চোখে দেখেন এমনটা নয়। যেমন ব্লেক, লাভ পিকক বা শেলীর অনেক কবিতায় বিজ্ঞানের অনুষঙ্গ সরাসরি এসেছে। বিজ্ঞানের এই খণ্ডত্ববাদ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধে আরও পরে আসবেন। আশীষবাবু বোঝান বিজ্ঞান আর কবিতার সহাবস্থান অসম্ভব, আপাতত (কেননা পরবর্তীতে তিনি এই ধারণা থেকে অনেকটাই সরে আসেন) এই ধারণার বশবর্তী হয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাল্পনিক বৈজ্ঞানিক বন্ধুর সাথে পাল্টা যুদ্ধে নামলেন: 'তারাগুলো যে নড়ে এটা তোমার নিছক বৈজ্ঞানিকত্ব।' কিন্তু শেষমেশ এ কথা তাঁর বন্ধুকে বলা হয়ে ওঠে না, কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন সেই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে 'নিছক বৈজ্ঞানিকত্ব'র (ব্যবহারিক) গুরুত্ব কবিত্বের চেয়ে অনেক বেশি। তিনি জানেন তথাকথিত অব্জেক্টিভ সত্যের আঙিনায় কাব্যর প্রবেশ নিষিদ্ধ। তাই যখন তিনি বলেন,
এই কবিত্বের কালিমা পৃথিবীর রাত্রিটুকুরই মতো। এর শিয়রের কাছে বিজ্ঞানের জগজ্জয়ী আলো দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু সে এর গায়ে হাত তোলে না। স্নেহ ক'রে বলে, আহা স্বপ্ন দেখুক।...
তখন তা প্রবোধের মতো শোনায়। বিজ্ঞান নাকি শুধু বাস্তব দেখে, স্বপ্ন দেখে না, বিজ্ঞানে কল্পনার স্থান নেই। আশীষবাবুর মতে সে সময় মানুষের সংস্কৃতির দ্বিখণ্ডন এতটাই গভীরে চলে গিয়েছিল বলে মনে করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
মনে করলেও মানতে চান না। তাই কবিতার পক্ষ নিয়ে, আসলে দ্রষ্টা সাপেক্ষ অনুভূতির পক্ষ নিয়ে দ্রষ্টানিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিকতার সঙ্গে এক ছদ্ম-তর্কযুদ্ধের অবতারণা করেন রবীন্দ্রনাথ:
আমার কথাটা হচ্ছে এই যে, স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছি তারাগুলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এর উপরে তো তর্ক চলে না।
বিজ্ঞান বলে, তুমি অত্যন্ত বেশি দূরে আছ বলেই দেখছ তারাগুলো স্থির। কিন্তু সেটা সত্য নয়।
আমি বলি, তুমি অত্যন্ত বেশী কাছে উঁকি মারছ বলেই বলছ ওরা চলছে। কিন্তু সেটা সত্য নয়।
বিজ্ঞান চোখ পাকিয়ে বলে, সে কেমন কথা?
আমিও চোখ পাকিয়ে জবাব দিই, কাছের পক্ষ নিয়ে তুমি যদি দূরকে গাল দিতে পার তবে দূরের পক্ষ নিয়ে আমিই বা কাছকে গাল দেব না কেন?
আশীষবাবু স্পষ্ট করে দেন কাছের পক্ষ মানে দ্রষ্টানিরপেক্ষ, অব্জেক্টিভ বা নৈর্ব্যক্তিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের পক্ষ, আর দূরের পক্ষ মানে দ্রষ্টাসাপেক্ষ সাব্জেক্টিভ বা আত্মগত অনুভূতির পক্ষ। কিন্তু "বিজ্ঞান বলে, যখন দুই পক্ষ একেবারে উলটো কথা বলে, তখন ওদের মধ্যে এক পক্ষকেই মানতে হয়।" এবার রবীন্দ্রনাথের মোক্ষম প্রশ্ন, বিজ্ঞান নিজেই কি সত্য নিরূপণের ব্যাপারে দ্বৈত মান প্রয়োগ করে না? কখনো খণ্ডাংশবাদী রিডাকশনিজ়ম, কখনো পূর্ণাত্মক সমগ্ৰতাবাদী হোলিজ়ম, এই দুই পথ ধরেই কি বিজ্ঞান এগোয় না?
পৃথিবীকে গোলাকার বলার বেলায় তুমি অনায়াসে দূরের দোহাই পাড়। তখন বল, কাছে আছি বলেই পৃথিবীটাকে সমতল বলে ভ্রম হয় তখন তোমার তর্ক এই যে , কাছে থেকে কেবল অংশকে দেখা যায়, দূরে না দাঁড়ালে সমগ্ৰকে দেখা যায় না।
বিজ্ঞানের এই দেখাটায় 'সায় দিতে রাজি' রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু তার পরেই তাঁর প্রশ্ন, 'দূরকে যদি এতটা খাতিরই কর তবে কোন্ মুখে বলব, তারাগুলো ছুটোছুটি ক'রে মরছে?' রিডাকশনিজ়ম-হোলিজ়মের এই দ্বন্দ্বকে আরও স্পষ্ট করে মেলে ধরে রবীন্দ্রনাথ বলেন
আমরা যখন সমস্ত তারাকে পরস্পরের সঙ্গে সম্বন্ধযোগে মিলিয়ে দেখছি তখন দেখছি তারা অবিচলিত স্থির।... জ্যোতির্বিদ্যা যখন এই সম্বন্ধসূত্রকে বিচ্ছিন্ন ক'রে কোনো তারাকে দেখে তখন দেখতে পায় সে চলছে।... এখন মুশকিল এই, বিশ্বাস করি কাকে?
সমগ্ৰ থেকে বিচ্ছিন্ন করে না-দেখলে কোনো বস্তু সম্বন্ধে তথ্য জানা যাবে না; আবার বিচ্ছিন্ন করে দেখে যে সব তথ্য পাওয়া যায়, সেগুলোকে সমগ্ৰে অন্বিত করতে গেলেই তাদের পারস্পরিক সম্বন্ধের আপেক্ষিক গুরুত্ব বদলে যাবে। ফলত বাস্তবতা সম্বন্ধে আমাদের যে ধারণা জন্মাবে, সেটাও আপেক্ষিক হয়ে পড়বে।
'ভুল' অবধারণা আর 'সঠিক' জ্ঞানের তফাত রবীন্দ্রনাথকে এবার নিয়ে আসে সংশয়ের জগতে:
সমস্ত পৃথিবী বলছে আমি গোলাকার, কিন্তু আমার পায়ের তলার মাটি বলছে আমি সমতল। পায়ের তলার মাটির জোর বেশি, কেননা সে যেটুকু বলে সে একেবারে তন্ন তন্ন করে বলে। পায়ের তলার মাটির কাছ থেকে পাই তথ্য, অর্থাৎ কেবল তথাকার খবর, বিশ্বপৃথিবীর কাছ থেকে পাই সত্য, অর্থাৎ সমস্তটার খবর।
সুতরাং, দুটি ভিন্ন বা বিপরীত পক্ষের একটিই মান্যতা পায় -- এই যুক্তি খণ্ডন করে রবীন্দ্রনাথ বলেন, তন্ন তন্ন করে পাওয়া 'তথাকার খবর'কে, অর্থাৎ তথ্যকে যখন সমগ্ৰের সঙ্গে মিলিয়ে নিই, তখনই পাই সত্য। আশীষবাবু বুঝিয়ে দেন যে নির্দিষ্ট জায়াগায় দাঁড়িয়ে আছি বা কাজ করছি সেই জায়গার খবরকেই বলে তথ্য; তা সমগ্ৰ নয়। কিন্তু খবর আর সত্যকে বা উপাত্ত আর তত্ত্বকে একসাথে চান রবীন্দ্রনাথ: 'আমাদের যে দুইই চাই।' কেজো দৈনন্দিনতার বিচারে 'তথ্য' আমাদের চাইই চাই, নইলে 'কাজকর্ম বন্ধ।' আবার 'সত্য না হলেও আমাদের পরিত্রাণ নেই।' তাঁর প্রস্তাবিত সংশ্লেষ এইরকম --
অতএব যদি বলা যায়, আমাদের দূরের ক্ষেত্রে তারা স্থির আছে, আর নিকটের ক্ষেত্রে তারা দৌড়চ্ছে তাতে দোষ কী?
আশীষবাবু স্পষ্ট করে দেন যে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু একবারও শঙ্করাচার্য বা জর্জ বার্কলির ঢঙে তারাগুলো আদৌ আছে কিনা, সে প্রশ্ন তুলছেন না। তারাদের বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে তাঁর কোনও মায়াবাদী সন্দেহ নেই যার বশবর্তী হয়ে তিনি তারাদেরকে শঙ্করাচার্যের মতো উড়িয়ে দেবেন। বার্কলির মতো তিনি বলেন না যে তারাগুলো মনের ভ্রম বা ইন্দ্রিয়ের perception মাত্র যেখানে চোখের স্নায়ু আমাদের কাছে ওগুলোকে তারা বলে প্রতিভাত করে। বরং বিজ্ঞানকে বাস্তব জগৎ সস্পর্কে ধারণা নিতে গেলে যে reductionist পদ্ধতিতেই এগোতে হয় তা রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেন। সেইসাথে তিনি সচেতন করে দেন ওটাই সমগ্ৰ জ্ঞান নয়। ওটাকে ছাপিয়ে একটা বৃহত্তর বাস্তবতা আছে যেটার মধ্যে ওই খণ্ডজ্ঞানকে 'place' করতে পারলেই, ওই তথাকার খবরকে সমগ্ৰের পটভূমিতে প্রয়োগ করতে পারলে তবেই ওই তথাকার খবরটি, ঐ তথ্যটি তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে। কোনও নির্দিষ্ট গান বা কবিতার নাম না করে আশীষবাবু বলেন এই ব্যাপারটিকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনেক লেখায় পৌনপুনিকভাবে সীমা আর অসীমের দ্বন্দ্বমিলন বলে চিন্থিত করেছেন। এই প্রতিবেদনের পাঠক প্রসঙ্গক্রমে পত্রপুট কাব্যগ্ৰন্থের ৩ সংখ্যক কবিতাটি পড়তে পারেন যেখানে বলা আছে
ঐ চাঁদ ঐ তারা ঐ তমঃপুঞ্জ গাছগুলি
এক হল, বিরাট হল, সম্পূর্ণ হল
আমার চেতনায়।
বিশ্ব আমাকে পেয়েছে,
আমার মধ্যে পেয়েছে আপনাকে
অলস কবির এই সার্থকতা।
এই একত্ব চিন্তার মধ্যে নিহিত থাকা দর্শন (যাকে রবীন্দ্রনাথ আলোচ্য প্রবন্ধে 'ঐক্যতত্ত্ব' বলেছেন) অনুযায়ী সৃষ্টি-পূর্ব অবস্থায় যে দ্বৈতহীন একক সত্তা ছিল তা সৃষ্টির মধ্যে নিজের উপর দ্বৈতভাব আরোপ করে বহু হল। তারপর মানুষের মনে তার উপলব্ধির ভিতর দিয়ে, খণ্ডরূপের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়ে মূলসত্তা আবার অখণ্ডরূপ ফিরে পেল। এই জন্যই মানুষের মন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এই সার্থকতাবোধ। আলোচ্য প্রবন্ধতে পরের দিকে তাই তিনি লেখেন,
অসীম যেখানে সীমাকে গ্ৰহণ করেছেন সেইটে হল মনের দিক। সেই দিকেই দেশকাল; সেই দিকেই রূপরসগন্ধ; সেই দিকেই বহু। সেই দিকেই তাঁর প্রকাশ।
তবে সময়াভাবে আশীষবাবু এই অংশটি আলোচনায় আনেননি। যাই হোক, রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের নিবিড় পাঠের এই পর্যায়ে এসে আশীষবাবু তিনটি অধিবিদ্যাগত প্রশ্ন উত্থাপন করেন। একটা বিশেষ পর্যায়ের বিজ্ঞান তার স্বীকৃত পদ্ধতিতন্ত্র অনুসারে বাস্তবতা সম্বন্ধে যে-ধারণা গঠন করে দিচ্ছে, সেটি ছাড়া অন্য সব ধারণা কি বাতিল? একটা বস্তু সম্বন্ধে মানুষের মনে বিভিন্ন স্তরের উপলব্ধি কি জাগতে পারে না? সেইসব উপলব্ধির সবগুলোই কি ব্যক্তিমানুষের ভিন্ন ভিন্ন স্তরে সত্যি হতে পারে না? এর উত্তর খোঁজার আগে আশীষবাবু রবীন্দ্রনাথের লেখনিতে যেভাবে রিডাকশনিজ়ম-হোলিজ়ম দ্বন্দ্বটিকে দাঁড় করিয়েছেন তারই ছায়ায় পজিটিভিজ়ম-রিয়েলিজ়ম দ্বন্দ্বটিকেও বিচার করে নেন।
প্রত্যক্ষবাদী বা পজিটিভিস্টরা শুধু তথাকার খবর, অর্থাৎ পর্যবেক্ষণ-লব্ধ তথ্যের মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন। সেজন্যই ওয়াল্টার কাউফমান নিখুঁত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরেও ইলেকট্রন নামক কোনও বস্তুসত্তার অস্তিত্ব মানতে পারেননি। এর্নস্ট মাখ বড় বিজ্ঞানী হলেও পরমাণু নামক কোনও বস্তু সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করতে পারেননি। জিন নামক কোনও বস্তুসত্তার অস্তিত্ব মানেননি কার্ল পিয়ার্সন। এঁরা সবাই পরীক্ষালব্ধ পরিসংখ্যানকে কতগুলো আঙ্কিক অনুপাত বলে মেনেছেন; পর্যবেক্ষণকে কতগুলি বিবরণ বা খবর বলে স্বীকার করেছেন। কিন্তু ঐসব খবর থেকে সাধারণীকরণের মারফত কোনও সামগ্ৰিক 'সত্যে' পৌঁছতে রাজি নন তাঁরা। কারণ সামগ্ৰিক সত্যকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। সরস ভঙ্গিতে আশীষবাবু বলেন সত্যিই তো অণু বা পরমাণুকে তো প্রত্যক্ষ করা যায় না। আমরা তার কতগুলো বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাই মাত্র। শ্যামল সেনগুপ্ত তাঁর বইতে তাই লেখেন যে প্রেসিডেন্সি কলেজের ল্যাবরেটরিতে একটি যন্ত্রের মধ্যে কিছু বুড়বুড়িকে দেখে তাঁকে বিশ্বাস করতে হয় ঐ বুড়বুড়িটিই নাকি ইলেকট্রনের স্রোত। কার্ল পপারের বই থেকে জানা যায় হাইজেনবার্গ যখন তাঁর অনিশ্চয়তাবাদ তত্ত্বের (Theory of Uncertainty) সপক্ষে বলেন
The more precise the measurement of position, the more imprecise the measurement of momentum, and vice versa...
(অর্থাৎ কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো একটি ইলেক্ট্রনের নির্দিষ্ট অবস্থান সাপেক্ষে তার ভরবেগ নির্দিষ্ট করে মাপা যায় না, অথবা উল্টোটা) তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে তাঁর রচিত ইলেক্ট্রনের গতিপথের গাণিতিক সূত্রটির বাস্তব তাৎপর্য তাহলে কি নেই? তখন হাইজেনবার্গ প্রত্যক্ষবাদীদের সরস উত্তর দেন -- 'It's a matter of taste' -- সেটা যার যার অভিরুচি। অর্থাৎ বিজ্ঞান সর্বদাই অকাট্য তথ্য বা সুনির্দিষ্ট খবর দেয় না। তার মধ্যে একটা সংশয়ের অবকাশ রয়ে যায়। এই সংশয়টি বিজ্ঞানের খামতি নয় বরং এটিই বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু বিজ্ঞান বলতে সাধারণ মানুষের ধারণার সাথে এটি মেলে না। তবে উপনিষদস্নাত রবীন্দ্রনাথ ঘাবড়ে না গিয়ে তথ্য-সত্য বিতর্কে এই সংশয়টির স্বপক্ষে উপনিষদেরই একটি বাক্যকে মোক্ষম ব্যবহার করেন:
তদেজতি তন্নৈজতি তদ্দূরে তদ্বন্তিকে।
তিনি চলেন এবং তিনি চলেন না, তিনি দূরে এবং তিনি নিকটে এ দুইই একসঙ্গে সত্য। অংশকেও মানি, সমস্তকেও মানি; কিন্তু সমগ্ৰবিহীন অংশ ঘোর অন্ধকার এবং অংশবিহীন সমগ্ৰ আরো ঘোর অন্ধকার।
আশীষবাবুর মতে, রবীন্দ্রনাথ খুব সচেতনভাবেই এ যুক্তি প্রয়োগ করেছেন। চলা আর থামা, অংশ আর সমগ্ৰ, ধ্রুবত্ব আর চঞ্চলতা -- এই আপাত বিপরীত binary সত্তাগুলিকে কোনও এক বৃহত্তর সত্যের কাঠামোর মধ্যে ধরানো যায় কিনা অথবা শুধু তথ্যে সন্তুষ্ট না হয়ে তথ্যকে একটা বৃহত্তর সত্যের পটভূমিতে 'place' করা যায় কিনা সেটাই তাঁর বিবেচ্য।
এখনকার কালের বিজ্ঞানীরা বলতে চান, চলা ছাড়া আর কিছুই নেই, ধ্রুবত্বটা আমাদের বিদ্যার সৃষ্টি মায়া। অর্থাৎ, জগৎটা চলছে কিন্তু আমাদের জ্ঞানেতে আমরা তাকে একটা স্থিরত্বের কাঠামোর মধ্যে দাঁড় করিয়ে দেখছি নইলে দেখা ব'লে জানা ব'লে পদার্থটা থাকতই না -- অতএব চলাটাই সত্য এবং স্থিরত্বটা বিদ্যার মায়া।
প্রচলিত পদ্ধতিতে কোনও একটি বিষয় জানতে গিয়ে কোনও পরীক্ষা করতে গেলে নির্দিষ্ট কোথাও ফেলে পরীক্ষাটা করতে হয় -- অর্থাৎ চলার মধ্যে নয় থামার মধ্যে। কিন্তু এর বিপরীতে আশীষবাবু পাভলভের কুকুর নিয়ে পরীক্ষার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। পাভলভের কুকুরের প্রসঙ্গটি হয়তো অনেক শ্রোতার কাছে সেদিন বেমানান ঠেকতে পারে। তবে এই প্রতিবেদনের সুধী পাঠক একবার খণ্ডবাদী দর্শন ও বিজ্ঞান চেতনা সম্পর্কে ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ তাঁর বিখ্যাত 'The Tables Turned' কবিতায় কী বলেছিলেন তা স্মরণ করতে পারেন:
Sweet is the lore which Nature brings;
Our meddling intellect
Mis-shapes the beauteous forms of things:--
We murder to dissect.
সেই লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আমল থেকে শবব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে (মৃত) মানবশরীর সম্পর্কে যে (খণ্ড)জ্ঞান তথ্যের আকারে আহৃত হয়ে আসছে তা যে কতখানি সীমিত তা প্রমাণিত হয় যখন পাভলভ তাঁর জীবিত কুকুরের উপর বহিঃউদ্দীপনার প্রভাব সম্পর্কিত পরীক্ষার দীর্ঘ পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্যের সংশ্লেষ ঘটিয়ে কুকুরটির আচরণগত পরিবর্তন বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হন। প্রতিবেদনের এই পর্যায়ে এসে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় প্রশ্নোত্তর পর্বের একেবারে শেষ প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দেওয়া যাক। জনৈক শ্রোতার প্রশ্ন ছিল, জীবিত মানুষের আচরণ পর্যালোচনা করার জন্য DSM নির্ধারিত প্রশ্নমালার উপর ভিত্তি করে দুশ্চিন্তা এবং বেদনার মতো variableগুলির পরিমাপের উদ্দেশ্যে কোনও psychological toolkit প্রস্তুত করা রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গিতে আদৌ কতখানি যুক্তিযুক্ত, যেখানে পরীক্ষাধীন কোনো ব্যক্তি কোনো প্রশ্নের উত্তর এক এক দিন এক এক রকম দিতেই পারেন? এই প্রশ্নটির মূল সুর, আশীষবাবু উল্লেখ না করলেও, রবীন্দ্রনাথের কল্পিত বৈজ্ঞানিক বন্ধুর আপত্তির সাথে মিলে যায়। বন্ধুটি বলেন
বিজ্ঞান থেকে আমরা বহু কষ্টে বোধকে ঠেকিয়ে রাখি -- কারণ আমার বোধ এক কথা বলে, তোমার বোধ আর এক কথা বলে। আমার বোধ এখন এক কথা বলে, তখন আরেক কথা বলে।
উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বোধের এই বিচ্ছিন্নতাকে 'সৃষ্টিতত্ত্ব' বলতে চাইলে বিজ্ঞানীবন্ধুটি পুনরায় আপত্তি তোলেন যে "এক এক মন যদি এক এক রকমের সৃষ্টি করে বসে তা হলে সেটা যে অনাসৃষ্টি হয়ে দাঁড়ায়।" এতে রবীন্দ্রনাথের সপাট উত্তর, তা তো হয় না:
হাজার লক্ষ মনের যোগে হাজার লক্ষ সৃষ্টি। কিন্তু তবুও তো দেখি সেই বৈচিত্র্য সত্ত্বেও তাদের পরস্পরের যোগ বিচ্ছিন্ন হয় নি।
এর সপক্ষে ভাববাদী কবি তাঁর বিশ্বমনের 'ঐক্যতত্ত্বের' অবতারণা করেন:
মন পদার্থটা জগদ্ব্যাপী। আমার মধ্যে সেটা বন্ধ হয়েছে বলেই যে সেটা খণ্ডিত তা নয়। সেজন্যই সকল মনের ভিতর দিয়েই একটা ঐক্যতত্ত্ব আছে। তা না হলে মানুষের সমাজ গড়ত না, মানুষের ইতিহাসের কোনো অর্থ থাকত না।
অন্যদিকে, সভায় উপস্থিত জয়ন্তবাবু উত্থাপিত প্রশ্নের প্রেক্ষিতে psychological toolkitগুলির objectivity নিয়েই প্রশ্ন তোলেন। কারণ নজরদারি মেডসিনের যুগে clinical psychiatry থেকে psychology বর্তমানে বিযুক্ত হয়ে যাওয়াতে মানুষকে object of medication বানিয়ে তোলার লক্ষে বহুজাতিক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলি DSM প্রবর্তিত এই ধরনের প্রশ্নমালাগুলিকে প্রভাবিত করে চলেছে sponsorship জুগিয়ে।
প্রশ্নোত্তর পর্বে পরেও আসা যাবে, আপাতত আশীষবাবুর মূল বক্তৃতায় ফেরা যাক। 'স্থিরত্বটা বিদ্যার মায়া' বলতে রবীন্দ্রনাথ যা বুঝিয়েছেন তা সাদা বাংলায় হল জানবার সুবিধার জন্য বিজ্ঞান চলমান জিনিসকে থামিয়ে দেখে। সেই দেখাই তাকে তথ্য সরবরাহ করে। কিন্তু 'এখনকার কালের পণ্ডিতেরা' জ্ঞানপাপী, তারা জানেন আসলে চলা ছাড়া আর কিছুই নেই; তবু, ইচ্ছে করেই তাঁরা স্থিরতার একটা মায়া সৃষ্টি করেন। তারপর তথ্য জানা হয়ে গেলে সেই মায়া কাটিয়ে ফেলেন, সেই তথ্য বা খবরকে চলমানতার ব্যাপকতর কাঠামোয় স্থাপন করেন। বিজ্ঞানীদের মতে তখন সেটা হয়ে ওঠে জ্ঞান। এইভাবে চলমানতা ও স্থিরত্ব, দূরত্ব ও নৈকট্য, অংশ ও সমগ্ৰ পরস্পরের পরিপূরক হয়ে একটাই কাঠামোর অঙ্গ হয়ে ওঠে। এই কাঠামোর স্বরূপটি আশীষবাবু উপস্থিত শ্রোতাদের সামনে বিস্তারিত না বললেও এই প্রতিবেদনে এটুকু বলা চলে যে প্রকৃতিবিজ্ঞানের একটা আকারগত রূপ বা কাঠামো আছে যা মূলত গাণিতিক উপাদানসর্বস্ব। গাণিতিক পদ্ধতি হল প্রকৃতিবিজ্ঞানের সেইসব স্বতঃসিদ্ধ সূত্র প্রণয়নের পদ্ধতিসমূহ যার দ্বারা যুক্তির সাহায্যে বিভিন্ন প্রতিজ্ঞাগুলির আন্তর্সম্পর্ককে একত্র করে সঙ্ঘটিত করে প্রকাশ করা যায়। এই প্রকাশ কিন্তু সেই ব্যাবিলনীয় সভ্যতার কলনবিদ্যা থেকে মানবসমাজের ঐতিহাসিক বিবর্তনের কালভেদে নতুন রূপ পেতে পেতে একবিংশ শতকের কম্পিউটারের স্তর অবধি একই আকারে অন্তর্বস্তুতে ঘটে চলেছে। তাঁর 'Technology for Mankind' শীর্ষক গদ্যে জেকব ব্রনওস্কি তো বলেই রেখেছেন 'Basic pattern is always same'। তাই প্লেটোর সময় থেকেই বিভিন্ন দার্শনিকেরা এইসব আকারগত উপাদানগুলিকে গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। কেননা তাঁরা দেখেছেন একমাত্র গাণিতিক বর্ণনার সাহায্যেই এইসব তাত্ত্বিক প্রতিজ্ঞাগুলিকে অনেক বেশি প্রামাণিকভাবে যুক্তি-বুদ্ধিগ্ৰাহ্যতার সঙ্গে পেশ করা যায়। অবশ্য টমাস কুন বিজ্ঞানের paradigm shift বা বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনাগুলিকে অমেয় (incommensurable) আখ্যা দিয়ে বলেছেন যে সেগুলি তত্ত্ব-সূত্র মেনে তৈরি হয়নি। সে বিচারে বিজ্ঞানের এইসব ধারাবাহিক গবেষণা ও আবিষ্কারের মধ্যে সবসময় যুক্তিসিদ্ধতা খুঁজে পাওয়া যায় না এবং তা খোঁজা উচিত নয়। তবে সে বিতর্ক আপাতত তোলা থাক। বরং রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের আশীষবাবুকৃত নিবিড় পাঠে ফেরা যাক। তিনি বলেন, অক্ষয় কুমার দত্ত তাঁর বিখ্যাত ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় গ্ৰন্থে যে সংশয়বাদী ঔপনিষদিক অধিবিদ্যার সাথে বাঙালির পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তার সাথে এইভাবে একটা সাযুজ্যের সূত্র যেন রেখে যান রবীন্দ্রনাথ।
আশীষবাবুর মতে, রবীন্দ্রনাথের এই অধিবিদ্যা কিন্তু এক বিশেষ অধিবিদ্যা। শঙ্করের অদ্বৈতবাদী, অব্যক্ত, ব্রহ্মস্বরূপের যে অধিবিদ্যা, তাতে তাঁর বিশেষ সায় নেই। এর প্রমাণস্বরূপ স্থিরত্বকে 'বিদ্যার মায়া' বলার পরেই তিনি লেখেন, 'আবার আর-এককালের পণ্ডিত বলেছিলেন, ধ্রুব ছাড়া আর কিছুই নেই, চঞ্চলতাটা অবিদ্যার সৃষ্টি।' লক্ষ্যণীয়, শঙ্করাচার্য চঞ্চলতাকে অবিদ্যার সৃষ্টি বলে অবজ্ঞা করলেও (শঙ্করাচার্য অবশ্য ব্রহ্মকে অব্যক্ত আখ্যা দিয়ে আস্ত সৃষ্টিকেই না হওয়া কোনও ঘটনার মায়া বলে নস্যাৎ করেছেন) রবীন্দ্রনাথ স্থিরত্বের মায়াকে 'বিদ্যার মায়া' বলে নন্দিত করেছেন, কারণ তা আমাদের কাজে লাগে। কিন্তু 'এখনকার কালের পণ্ডিত'দের পদ্ধতির সাথে 'আর-এককালের পণ্ডিত'দের পদ্ধতির তুলনা টানাটা রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য নয়। 'এখনকার কালের পণ্ডিত'দের পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য এই যে, বাস্তবকে জানতে সুবিধা হবে বলে তাঁরা নিজেদের মতো করে 'স্থিরত্বে'র একটা 'কাঠামো' বানিয়ে নিয়েছেন; কিন্তু আসলে তাঁরা জানেন যে 'চলা ছাড়া আর কিছুই নেই,' আসলে বাস্তবতা স্থির নয়, সচল পরিবর্তনশীল। এটাকে যদি আত্ম-প্রবঞ্চনা বলা যায়, তো সে প্রবঞ্চনা সচেতন, জ্ঞান আহরণের একটা উপযোগী সোপান মাত্র। অপর দিকে, অদ্বৈতবাদী পণ্ডিতদের বিচারে, বাস্তবতাই অপরিবর্তনীয়, অব্যক্ত। বাস্তবতা সম্পর্কে জ্ঞান আহরণের পদ্ধতির প্রতি নয়, খোদ বাস্তবতার প্রতি তাঁদের এই ধারণার প্রয়োগ। তাই তা কখনও বিজ্ঞানের সহায়ক হতে পারে না। শেষ পর্যন্ত তিনি 'সরলবুদ্ধি'র ওপরেই অর্থাৎ অভিজ্ঞতাবাদী কাণ্ডজ্ঞানের ওপরেই ভরসা করেছেন: '...সরলবুদ্ধি জানে, চলাও সত্য থামাও সত্য। অংশ, যেটা নিকটবর্তী, সেটা চলছে; সমগ্ৰ যেটা দূরবর্তী, সেটা স্থির রয়েছে।' বহু পরিচিত কিন্তু তুলনাহীন এক উপমায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয় গানের প্রসঙ্গ টেনে এই দ্বান্দ্বিকতাকে ব্যাখ্যা করেছেন:
গাইয়ে যখন গান করে তখন তার গাওয়াটা প্রতি মুহূর্তে চলতে থাকে। কিন্তু সমগ্ৰ গানটা সকল মুহূর্তকে ছাড়িয়ে স্থির হয়ে আছে।....গানে ও গাওয়ায় মিলে যে সত্য সেই তো --
তদেজতি তন্নৈজতি তদ্দূরে তদ্বন্তিকে।
সে চলেও বটে চলে নাও বটে, সে দূরেও বটে নিকটেও বটে।
সবশেষে আশীষবাবুর অভিমত যে কোনও জটিল জিনিসকে একটু ধাতস্থ করা বা একটু রসস্থ করার জন্য যেমন রবীন্দ্রনাথের শরণ নেওয়া যায়, তেমনি যে কোনও আপাত সরল জিনিসকে গুলিয়ে বা ঘুলিয়ে দিতেও তিনি সিদ্ধহস্ত। তাই জয়ন্তবাবুর সাথে সহমত হয়ে রবীন্দ্রনাথের লেখায় precision না থাকাকে advantage বলেই মনে করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের 'আমার জগৎ' প্রবন্ধটির অনুষঙ্গে তিনি শ্রোতাদের 'তথ্য' ও 'সত্য' সম্পর্কে ধাতস্থ করালেন নাকি গুলিয়ে দিলেন সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে এখানেই তাঁর নিবিড় পাঠ বা বক্তৃতার পরিসমাপ্তি ঘটান আশীষবাবু।
আদানপ্রদান পর্বে বিনয় কৃষ্ণ পাল প্রশ্ন করেন, যা ক্ষুদ্র তা যদি চঞ্চল হয়, তবে ক্ষুদ্রর সমন্বয়ে গঠিত সমগ্ৰ স্থির থাকে কি করে? এই প্রশ্নের উত্তর সময়াভাবে দেওয়া না হলেও সেদিন রবীন্দ্রনাথের আলোচ্য প্রবন্ধের আশীষবাবুর না পড়া অংশেই এর উত্তর নিহিত ছিল। আমার মতে বিনয়বাবু যাকে চলমান ক্ষুদ্র বলেছেন তা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আসলে বিজ্ঞানের পরীক্ষানিরীক্ষায় ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈর্ব্যক্তিক পর্যবেক্ষণের ফলে প্রাপ্ত ও 'ঘড়ির কাঁটার কাল এবং গজকাঠির মাপ দিয়ে' নিখুঁতভাবে পরিমিত নানা মৌল উপাদান, যাদের হদিস প্রতীয়মান ঘটনাজগতে পাওয়া যায় না। কিন্তু বিজ্ঞান ক্রমাগত তাদের খোঁজ চালায় এবং এই কাজ করতে গিয়ে
বিজ্ঞান সৃষ্টিকে বিশ্লিষ্ট ক'রে ফেলে। অবশেষে অণু-পরমাণুর ভিতর দিয়ে এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছোয় যেখানে সৃষ্টিই নেই। কারণ সৃষ্টি তো অণু-পরমাণু নয় -- দেশকালের বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে আমাদের মন যা দেখছে তাই সৃষ্টি।
বলা বাহুল্য, এই 'দেশকালের বৈচিত্র্য' একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দবন্ধ। এর দ্বারা রবীন্দ্রনাথ reference frame বা নির্দেশ তন্ত্রের স্থানিক ও কালিক পরিবর্তনের ফলে বস্তু জগৎ সম্পর্কে মানুষের অবধারণা কতটা অধ্রুব বা অনির্দিষ্ট হয়ে পড়ে তা বোঝাতে চেয়েছেন। প্রবন্ধে একাধিক উদাহরণ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ব্যাপারটা বুঝিয়েছেন। বইয়ের পাতার অক্ষরগুলি এমনিতে 'ঘন আকাশে' সন্নিবিষ্ট। কিন্তু তাকে অনুবীক্ষণের তলায় দেখলে 'ব্যাপ্ত আকাশে' দেখা হয়। তখন অক্ষরগুলি ক্রমশ আয়তনে বাড়তে বাড়তে ঝাপসা হয়ে গিয়ে তার প্রতীতি হারিয়ে ফেলে। উল্টো দিকে, ঘাসকে আমরা খালি চোখে দেখতে পেলেও তার বৃদ্ধিকে দেখতে পাই না। কিন্তু ভিন্ন ব্যবস্থাপনায় (যাকে আমরা সুবিধার জন্য fast track বলতে পারি) 'ব্যাপক কালের' পরিসরে ঘাসের বৃদ্ধিকে সহজেই অনুধাবন করা যাবে। আবার যে ঘোড়াকে আমরা আমাদের সময়ের বিচারে দৌড়াতে দেখি তার এক মিনিটের দৌড়কে ভিন্ন ব্যবস্থাপনায় (যাকে এবার আমরা সুবিধার জন্য slow motion বলব) ব্যাপক কালের মধ্যে প্রতিস্থাপিত করলে দেখা যাবে ঘোড়াটা প্রায় দাঁড়িয়েই আছে। ট্রেনে যেতে যেতে রবীন্দ্রনাথের নিজেরই তাঁর জাগরণ কালের বিচারে পাঁচ মিনিটের স্বপ্নকে ঘুমন্ত অবস্থায় অনেকটা সময়ের ব্যবধান বলে ভ্রম হয়েছিল। মহাকাশের লক্ষ কোটি ক্রোশ পরিমাণ স্থানকে এক হাত পরিসরের মধ্যে দেখলে সেখানে তারাগুলিকে স্থির এবং কাছাকাছি মনে হয়। কিন্তু এই দেখার চোখ নিয়ে যদি একটা লৌহখণ্ডকে 'ব্যাপ্ত আকাশে' দেখা যায় তবে তা আর লোহা বলে প্রতীয়মান হবে না, লোহার পরমাণু চোখের সামনে ছোটাছুটি করতে থাকবে। এইভাবে বহির্জগৎ সম্পর্কে আমরা যে প্রক্রিয়ায় অবধারণা লাভ করি তার উপর নির্দেশতন্ত্রের স্থানিক বা কালিক পরিবর্তন কেমন সংশয় উদ্রেককারী প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ আরও দুটি চরম উদাহরণ দেন। প্রথমে তিনি বলেন, 'জগতের যে-সব পদার্থ আমাদের কাল থেকে অত্যন্ত ভিন্ন কালে চলছে তারা আমাদের চার দিকে থাকলেও তাদের দেখতেই পাচ্ছি নে এমন হওয়া অসম্ভব নয়।' আবার তিনটি অনুচ্ছেদ পরেই তিনি বলেন, 'আমাদের মন যে কালের তালে চলছে তারই বেগ অনুসারে আমরা দেখছি বটগাছটা দাঁড়িয়ে আছে এবং নদীটা চলছে। কালের পরিবর্তন হলে হয়তো দেখতুম বটগাছটা চলছে কিংবা নদীটা নিস্তব্ধ।' রবীন্দ্রনাথের এই উদাহরণগুলিকে একসাথে উপভোগ করতে চাইলে এই প্রতিবেদনের উৎসাহী পাঠক ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত Inception নামক অসাধারণ সিনেমাটি দেখে নিতে পারেন যেখানে লিওনার্দো দি'ক্যাপ্রিও অভিনীত ডমিনিক কব্ নামক চরিত্রটি উপর্যুপরি দু-দুবার স্থানকালের ব্যবধান অতিক্রম করে মানুষের স্বপ্নের মধ্যে পরপর দুবার প্রবেশ করে। এভাবে সমান্তরাল তিনটি নির্দেশতন্ত্রে বিরাজমান তথা ক্রিয়াশীল থেকে নিজের অভীষ্ট সাধন করে নিদারুণ উত্তেজনার পর আবার সে আমাদের চেনা জগতে ফিরে আসে। যাই হোক, পূর্বোক্ত উদাহরণগুলি দেওয়ার পর আত্মবিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাববাদী সিদ্ধান্তটি নিরূপণ করেন:
আমরা যাকে জগৎ বলছি সেটা আমাদের জ্ঞানের যোগে ছাড়া হতেই পারে না। যখন আমরা পাহাড় পর্বত সূর্য চন্দ্র দেখি তখন আমাদের সহজেই মনে হয় বাইরে যা আছে আমরা তাই দেখছি। যেন আমাদের মন আয়না মাত্র। কিন্তু আমার মন আয়না নয়, তা সৃষ্টির প্রধান উপকরণ। আমি যে মুহূর্তে দেখছি সেই মুহূর্তে সেই দেখার যোগে সৃষ্টি হচ্ছে।
অর্থাৎ স্থান ও কালের ভিন্নতায় দেখার চোখ বদলে যাওয়ায় ভিন্ন সৃষ্টি সম্ভবপর হল। মনের ভিতরে ইন্দ্রিয়গ্ৰাহ্য বহিঃপ্রকৃতির যে অবধারণা গড়ে ওঠে তা আর নৈর্ব্যক্তিক রইল না। তা আদতে এমন কিছু যা আগে ছিল না, মনের সক্রিয়তায় নির্মিত হল -- এককথায় তা-ই হল সৃষ্টি। অর্থাৎ মন কেবল লক কথিত tabula rasa নয়; নিষ্ক্রিয় গ্ৰহীতা না হয়ে সে হয়ে উঠল "সৃষ্টির প্রধান উপকরণ"। তাই তো রবীন্দ্রনাথ তাঁর শ্যামলী কাব্যগ্ৰন্থের 'আমি' নামক বহুপঠিত কবিতায় বলে ওঠেন
আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে,
জ্বলে উঠল আলো
পূর্বে পশ্চিমে।
বাইবেলে যা ছিল "God said, 'Let there be light': and there was light" (Genesis 1.iv.) তা এবার পাওয়া গেল কবির নিজের মুখেই। মধ্যযুগে আলহাজেন বলেছিলেন চোখ থাকলেই দেখা যায় না, দেখার জন্য আলো চাই। রবীন্দ্রনাথ বলছেন শুধু আলো থাকলেই লাভ হয় না, তার জন্য কাউকে চোখ মেলে থাকতে হয়। অতএব রবীন্দ্রনাথের যুক্তিতে মানুষের মানসপটেই "বিশ্বশিল্প" প্রকট হয়ে উঠেছে -- "মানুষের অহংকার পটেই/ বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্প।" ঠিক যেমন চিত্রশিল্পীর কল্পনা বা মনের ভাবনা রূপ পায় ক্যানভাসে। রবীন্দ্রনাথ এখানে অনেকটাই তাঁর পূর্বসূরী ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের ভাবনার কাছাকাছি যিনি তাঁর 'Lines composed a few miles above Tintern Abbey' নামক বিখ্যাত কবিতায় বলছেন
Therefore am I still
A lover of .... all that we behold
From this green earth; of all the mighty world
Of eye, and ear,--both what they half create,
And what perceive;
আমার মতে ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের এই লাইনকটায় কান্টের প্রভাব আছে। কান্টের মতে ব্যক্তিনিরপেক্ষ বহিঃপ্রকৃতির প্রকৃত স্বরূপ (noumena) আর আমাদের অভিজ্ঞতার প্রপঞ্চ জগৎ (phenomenal world) দুটি আলাদা। মানুষ প্রথমটির ক্ষেত্রে হদিস পায় না, আর দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে বস্তুজগতের মৌল উপাদানগুলি আমাদের sensibility বা ইন্দ্রিয়ের সংবেদনশীলতায় তখনই অবধারণা (perception) হিসেবে ধরা পড়ে যখন তারা তাদের স্থান ও কালের দ্বিমাত্রিকতাসহ আমাদের intuition বা সজ্ঞায় ধরা পড়ে এবং তারপর আমাদের বোধশক্তি (understanding) ঐ বস্তু উপাদান সম্পর্কে একটি ধারণা (concept) অনুমোদন করে। কিন্তু এই অবধারণা এমনিতে লাভ করা যাবে না যতক্ষণ না স্বজ্ঞা এবং ধারণার সংশ্লষ ঘটছে। আর এই সংশ্লেষের কাজটা করে কল্পনা বা সৃজনশীলতা (imagination)। তাই ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের 'mighty world' ইন্দ্রিয়ের ("what perceive") সাথে সাথে তার সৃষ্টিশীল মনেরও ("half create") সক্রিয় অংশীদারিত্ব আদায় করে নিয়েছে; না হলে সে ধরা দিত না।
এই প্রতিবেদনের সুধী পাঠক নিশ্চয়ই ভাবছেন বিনয়বাবুর প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমি এত কথা লিখতে গেলাম কেন? এ ব্যাপারে আমার দুটো উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত, আশীষবাবুর না পড়া অংশটিকে 'একক মাত্রা'র পাঠকবন্ধুদের সাথে ভাগ করে নেওয়া। দ্বিতীয়ত, শেষ লগ্নে আশীষবাবু ও জয়ন্তবাবুর মধ্যে যে আদানপ্রদান হয়েছিল তার প্রেক্ষাপট প্রস্তুত করা। জয়ন্তবাবু রবীন্দ্রনাথ-আইনস্টাইন কথোপকথনের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের আলোচ্য প্রবন্ধের সারবস্তুকে বুঝে নিতে চান। দুজনের আলাপচারিতায় মানুষ বা বিষয়ী নিরপেক্ষভাবে বিষয়কে সম্যকভাবে বোঝা সম্ভব কিনা সে বিতর্ক যখন দানা বাধে তখন রবীন্দ্রনাথ বলেন
There can be no other conception. This world is a human world — the scientific view of it is also that of the scientific man. There is some standard of reason and enjoyment which gives it Truth, the standard of the Eternal Man whose experiences are through our experiences.
স্পষ্টতই রবীন্দ্রনাথ এখানে তাঁর Indian psychologized epistemology-র অবস্থান থেকে তাঁর বক্তব্য রেখেছিলেন যেখানে, বিশেষত ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনে, বিষয়ী সাপেক্ষ জ্ঞানতত্ত্বে ব্যাকরণ ও লজিককে জ্ঞান আরোহণের সোপান বলে মনে করা হয়। অন্যদিকে আইনস্টাইন এর উত্তরে যখন বলেন কোনো মানুষ না থাকলে বেলভেডিয়ারের অ্যাপোলো মূর্তিকে তারিফ করার মতো সত্যিই কেউ থাকে না, তখন তিনি নন্দনতত্ত্বের বিচারে রবীন্দ্রনাথের যুক্তিকে মেনে নেন। কিন্তু তাঁর কাছে সত্য যে আসলে বিষয়ী নিরপেক্ষ নৈর্ব্যক্তিক সত্য তা জোরের সাথে বলেন। স্পষ্টতই আইনস্টাইন এখানে European non- psychologized epistemology-র অবস্থান থেকে মত দেন যেখানে বিমূর্ত গাণিতিক সূত্র ও স্বতঃসিদ্ধের উপর ভিত্তি করে falsifiability ও testability-র বিচারে সত্যস্বরূপ নির্মিত হয়। নিজের স্বপক্ষে তিনি বলেন, "I cannot prove that my conception is right, but that is my religion"। কিন্তু আফশোস এটাই যে সময়ের নিতান্ত অভাবের জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গটি নিয়ে এর বেশী আদানপ্রদান চালানো সেদিন সম্ভব হয় নি। এই অমীমাংসিত বিতর্কটি ছাড়াও জয়ন্তবাবু আশীষবাবুর বক্তৃতার উপর আরও তিনটি আলোকপাত করেন। প্রথমত, সেদিনের বক্তৃতায় বস্তুজগৎ সম্পর্ক রবীন্দ্রদর্শন যেভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে তার উপর পূর্বসূরী রামেন্দ্রসুন্দর অক্ষয়কুমার বা ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের কোনো প্রভাব কাজ করেছিল কিনা তা জানাটা প্রয়োজন বলে মনে করেন। দ্বিতীয়ত, যে রবীন্দ্রনাথ লালন ফকিরের সংস্পর্শে বাউল বা সহজিয়া মতধারার অনুপ্রেরণায় একাধিক গানের সুরারোপ করেছিলেন তাঁর বিজ্ঞানদর্শনে 'তথ্য' ও 'সত্য' শব্দের লৌকিক ব্যবহার কোনো ছাপ ফেলেছিল কিনা তাও বিচার্য বলে মনে করেন তিনি। তৃতীয়ত, জয়ন্তবাবু খানিকটা আক্ষেপের সুরেই বলেন আলোচ্য প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ তথ্যকে scientific epistemology বা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানতত্ত্বের আধার হিসেবে দেখেছেন; আমাদের ব্যবহারিক জীবনে সমাজ সিঞ্চিত তথ্য আমাদের কোন্ জ্ঞানের অভিমুখে নিয়ে যায় সে সম্পর্কে তিনি কিছু বলে যান নি। জয়ন্তবাবুর মতে তথ্যের অভিমুখ সর্বদাই হল জ্ঞান। কিন্তু তথ্য শেষমেশ জ্ঞান হয়ে ওঠার পথে যদি রাষ্ট্রযন্ত্র এবং স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী তথ্যকে বাছাই বা গোপন করে তার অভিমুখ বদলে দেয় তাহলে অভীষ্ট জ্ঞানের অভিমুখও বদলে যায় না কি?
আর ঠিক এই জায়গাতেই সঞ্জয় মজুমদার, উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অচিন চক্রবর্তীর পারস্পরিক আদানপ্রদান প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। সঞ্জয়বাবু data বা datum এর সংজ্ঞা -- "readily available fact(s) or figure(s) about an entity which has some uniquely identifiable features" -- উল্লেখ করে প্রশ্ন করেন যে উক্ত 'identifiable features' গুলিকে যখন সংখ্যায়িত (quantify) করা যায় তখন সাধারণত উপাত্তের গ্ৰহণযোগ্যতা দৃঢ় হয়; কিন্তু ঐগুলিকে যখন শুধুমাত্র গুণান্বিত (qualify) করা যায় তখন উপাত্তের গ্ৰহণযোগ্যতা কতখানি বজায় থাকে? এর উত্তরে উত্তানবাবু বলেন ইদানিং বিভিন্ন non-parametric methods of deduction মারফত এটি সম্ভবপর হচ্ছে। অচিন চক্রবর্তী বোঝান রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে রিপোর্ট হল আদতে ইনফর্মেশন যেখানে ইনফর্মেশনকে বলা চলে উপাত্তের পরিশীলিত (refined) রূপ। কিন্তু বর্তমানে post-truth যুগে ইনফর্মেশনকে ক্রমাগত সমস্যাক্রান্ত করে তোলা হচ্ছে। যাই হোক quantificationএর জন্য নানান মাপকাঠি বিদ্যমান, যেমন ratio scale, interval scale, cardinal বা ordinary scale, ইত্যাদি। কিন্তু তথ্য সর্বদা সংখ্যাবাচক হয় না। সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তো নয়ই। সমাজবিজ্ঞানে তাই objectivity of observation ও subjectivity of perception পৃথক দুটি পরস্পরবিরোধী বিষয় নাও হতে পারে। অচিনবাবুর মতে সমাজবিজ্ঞানে বরং অমর্ত্য সেনের positional objectivity অধিক যুক্তিযুক্ত। তাঁর বিখ্যাত 'Objectivity and Position' নামক ভাষণে অমর্ত্য সেন বোঝাতে চেয়েছেন যে, পর্যবেক্ষণের কোনও নির্দিষ্ট অবস্থান থেকে কোনও বস্তু পর্যবেক্ষকের কাছে যেভাবে ধরা দেয় তা আসলে এমনই একটি নৈর্ব্যক্তিক অন্বেষণ যাতে পর্যবেক্ষণগত অবস্থানটি সূচীত হয়ে থাকে। তাই অমর্ত্য সেনের সিদ্ধান্ত:
What can be taken as a view from nowhere must, in some ways, be a constructed and scrutinized derivation based ultimately on the views from particular positions.
এখানে একটু বলে নেওয়া ভালো টমাস নাজেল তাঁর View from Nowhere নামক বইয়ের শিরোনামে যে একশ শতাংশ নৈর্ব্যক্তিকতার দাবি তুলেছেন তাকেই অমর্ত্য সেন বলেছেন "misleading"। অচিনবাবু অমর্ত্য সেনের লেখা থেকে কেরালার সাথে বিহার বা উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যের life expectancy, morbidity এবং mortality এইধরনের variable নিয়ে বোঝান তথ্যকে শুধু ওপর ওপর বিবেচনা করলে কোথায় অসুবিধা হতে পারে। কেরালার অধিবাসীদের গড় আয়ু (৭০বছর) ভারতের জাতীয় গড় আয়ুর (৫৭বছর) থেকে অনেক বেশি থাকলেও কেরালায় নথিভুক্ত রুগীর সংখ্যা অনেক বেশি। অন্যদিকে বিহারে নথিভুক্ত রুগীর সংখ্যা অত্যধিক কম হলেও সেখানে মৃত্যুহার অনেক বেশি। এবার এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আমরা যদি ধরে নিই কেরালায় মানুষ রোগযন্ত্রণা নিয়ে দীর্ঘদিন বাঁচে আর বিহারে মানুষ অল্পদিন বাঁচলেও যতদিন বাঁচে সুস্থ হয়ে বাঁচে তাহলে সাঙ্ঘাতিক গোলমাল হয়ে যাবে। এই গোলমাল মেটাতে পারে একমাত্র positional objectivityর ধারণা। কেরালা আর বিহার একই ভারতের দুটি রাজ্য হলেও এদের অবস্থান আলাদা। কেরালায় শিক্ষার হার অত্যন্ত বেশি থাকায় স্বাস্থ্য সচেতনতা বেশী। তাই রুগীরা নথিভুক্ত হন বেশি। অন্যদিকে বিহারে অশিক্ষাজনিত কারণে রোগের নথিভুক্তিকরণ হয় না। সমান্তরালে মৃত্যুহারও বেশি।
প্রতিবেদন আর দীর্ঘায়িত করব না। কিছু কিছু জায়গায় দুর্বোধ্যতা দূর করার জন্য সামান্য স্বাধীনতার আশ্রয় নিয়েছি, উৎসাহের বশে নিজস্ব অভিমত প্রকাশ করে ফেলেছি এবং এইদুটি ধৃষ্টতাকে মান্যতা দিতে গিয়ে বেশ কিছু উদ্ধৃতির সাহায্য নিয়েছি যেগুলো সেদিন উচ্চারিত না হলেও আমি প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচনা করেছি। প্রতিবেদনে আপন মনের মাধুরী মেশানো যায় কিনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিচারভার নেবেন এই আশা রাখি। তত্ত্ব হল প্রাণ, তথ্য হল তার আধার। কলিম খানের এই উক্তিকে স্মরণ করে 'একক মাত্রা'র পরবর্তী মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তৃতার অপেক্ষায় রইলাম।