সমস্ত ভেদাভেদ মুছে যাচ্ছে
সোমনাথ গুহ
এই কৃষক আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে, যখনই তা সংকটে পড়েছে, আরও নতুন উদ্যমে তেজীয়ান হয়ে বিস্তার লাভ করেছে। আইন প্রণয়নের পরেই পাঞ্জাবের চাষিরা প্রথমে এর বিরুদ্ধে সরব হন। তখন কৃষকরা অন্তত ৩৩টি সংগঠনে বিভক্ত। এর মধ্যে ধনী চাষির সংগঠন যেমন আছে তেমনি ক্ষুদ্র, প্রান্তিক চাষি এবং ক্ষেতমজুরদের সংগঠনও আছে। বিভিন্ন মতাদর্শের সংগঠন আছে। প্রথম দিকে এঁদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করাটাই একটা সমস্যা ছিল। কিন্তু প্রায় দু' মাস ধরে চেষ্টার ফলে সেই অসম্ভবটা সম্ভব হয়েছে। দ্বিতীয় সংকট এল যখন দিল্লির দিকে জাঠাগুলোর ওপর হরিয়ানা সরকার নৃশংস আক্রমণ নামিয়ে আনল। জলকামান, কাঁদানে গ্যাস, নানা ধরনের প্রায় অলঙ্ঘনীয় ব্যারিকেডের মাধ্যমে তাঁরা কৃষকদের দিল্লি যাত্রা দুষ্কর করে তুলল। হরিয়ানা সরকার বদ্ধপরিকর যে কৃষকদের কিছুতেই দিল্লি ঢুকতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু প্রবল জনমতের চাপে এবং আন্দোলনকারীদের অদম্য মনোবলের কাছে সরকার নতি স্বীকার করল। কাতারে কাতারে কৃষিজীবী মানুষ দিল্লির বিভিন্ন সীমান্তে ঘাঁটি গাড়ল। তৃতীয় সংকট এবং এ যাবৎ সবচেয়ে গভীর সংকট বলা যেতে পারে যখন কৃষকদের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ সরকারের গুপ্ত প্ররোচনা ও মদতে ২৬ জানুয়ারি হিংসাত্মক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ল। গোদি মিডিয়া তখন উল্লসিত। তাদের উচ্চকিত প্রচারে মানুষও বিভ্রান্ত। জনসমর্থনে ভাটা পড়ার আশঙ্কায় দু-চারজন নেতা নিরাশ হয়ে পড়লেন। একটি পেটোয়া সংগঠন আন্দোলন থেকে সরে গেল। চারিদিকে গেল গেল রব, মনে হল আন্দোলন বুঝি শেষ। সংঘ পরিবারের লোকজন গ্রামবাসী সেজে আন্দোলনকারীদের ইট পাটকেল ছুঁড়ে আক্রমণ করল। মধ্য রাতে বিশাল পুলিশ বাহিনী গাজিপুর সীমান্ত থেকে তাঁদের বলপূর্বক উচ্ছেদের চেষ্টা করল।
ঠিক তখনই হাজারও কৃষক ফিনিক্স পাখির মতো অভূতপূর্ব ভাবে উঠে দাঁড়ালেন। ক্রন্দনরত রাকেশ টিকায়েতের ছবি উল্কার মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তাঁর গ্রামে মধ্যরাতের মহাপঞ্চায়েত আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। সেই থেকে গত এক মাসে প্রায় দুশোটি মহাপঞ্চায়েত এবং খাপের মিটিং পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানে সংঘটিত হয়েছে। এই সভাগুলোতে জনসমাবেশ হয়েছে গড়ে দশ হাজার থেকে পাঁচ লাখ। দক্ষিণ ভারতেও আন্দোলন ছড়িয়েছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি কর্নাটকে বেঙ্গালুরু, মাইসুরু, রাইচুর, ধারওয়ারে রেল রোকো হয়েছে। কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ুতে বিভিন্ন জায়গায় ধর্ণা ও বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়েছে। আন্দোলনে সহমর্মিতা জানাতে দক্ষিণ ভারত থেকে সমাজকর্মীদের একটি বিরাট প্রতিনিধি দল দিল্লি পৌঁছে গেছে।
সবচেয়ে যেটা লক্ষণীয়, বিভিন্ন রাজ্যের এইসব সভা-সমাবেশ জাতপাত, ধর্ম, লিঙ্গের বিভাজন ভেঙে দিয়েছে। উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে খাপ নামক সংগঠনটির প্রবল দাপট। গ্রামের বরিষ্ঠ মানুষদের দ্বারা পরিচালিত এই সংগঠনগুলি নারী স্বাধীনতা এবং জাতপাতের প্রশ্নে গোঁড়া ও রক্ষণশীল। মনে রাখতে হবে, পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায় সমাজ প্রবল ভাবে পিতৃতান্ত্রিক এবং জনসংখ্যায় নারী পুরুষের অনুপাত দেশের অন্যান্য রাজ্যের থেকে খারাপ। অথচ আন্দোলনের জোয়ারে সেই সব প্রাচীর ভেঙে গেছে। দেখা যাচ্ছে, বহু জায়গায় মহিলারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পাঞ্জাবে অধিকাংশ পুরুষেরা দিল্লি সীমান্তে চলে গেছেন। তাঁদের ঘর এবং খামার দুটোই সামাল দিচ্ছেন মহিলারা। এছাড়া পাঞ্জাবে অন্তত একশোটি বিক্ষোভে মহিলারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বিপুল সংখ্যক মহিলা মহাপঞ্চায়েতগুলিতে অংশগ্রহণ করছেন। হরিয়ানার জাঠ অধ্যুষিত অঞ্চলে এবং রাজস্থানে এঁদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
আন্দোলনের জেরে লিঙ্গ বৈষম্য যেমন কমছে তেমনি শ্রেণি ও জাতপাতের বিভাজনও মুছে যাচ্ছে। রাজস্থানের কারৌলি জেলার কারিরি গ্রামে সম্প্রতি একটি মহাপঞ্চায়েত অনুষ্ঠিত হয় যেখানে কয়েক হাজার মীনা সম্প্রদায়ের কৃষকরা সমাবেশিত হন। প্রসঙ্গত এই সম্প্রদায় তফসিলি জনজাতির অন্তর্ভুক্ত। এই রাজ্যে জাঠ, গুজ্জরদের পাশাপাশি মীনারাও কৃষি কানুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব। তাঁরা এককাট্টা যে কোনও বিজেপি বিধায়ককে তাঁদের গ্রামে ঢুকতে দেবেন না। শ্রমিক কৃষক ঐক্য সমাবেশও হচ্ছে, যেমন পাঞ্জাবের বার্ণালায়। এই সমাবেশে বিপুল সংখ্যক ক্ষেতমজুর এবং প্রায় ৮০ হাজার মহিলা অংশগ্রহণ করেন। ক্ষেতমজুররা মনে করছেন, এই কালা আইনের ফলে তাঁদের কর্মসংস্থান এবং মজুরিতে টান পড়বে। তাই ধনী কৃষকদের সাথে শ্রেণিগত দ্বন্দ্ব থাকলেও তাঁরা আন্দোলনে শামিল হচ্ছেন।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে গেছে মুজফরনগরে। ২০১৩ সালে এই অঞ্চল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় দীর্ণ হয়েছিল। সেই সময় হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি মুসলিম নিধনের জন্য জাঠদের ব্যবহার করেছিল। হিন্দু ও মুসলিম জাঠদের মধ্যে সেই বিবাদ এখনও দগদগে ঘা হয়ে আছে। আশি-নব্বইয়ের দশকে এই অঞ্চলে অবিংসবাদী নেতা ছিলেন মহেন্দ্র সিং টিকায়েত যিনি তামাম অঞ্চলে বাবা টিকায়েত নামে পরিচিত। কৃষকদের যাবতীয় সমস্যা সমাধানে তাঁর সাথে কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়াই করতেন মুসলিম জাঠ নেতা গুলাম মহম্মদ জোলা। দাঙ্গার পর মহম্মদ জোলা অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। এখন হিন্দু জাঠ নেতারা স্বীকার করছেন যে ২০১৩ সালে মুজাফরনগর দাঙ্গায় বিজেপি নেতাদের দ্বারা তাঁরা ব্যবহৃত হয়েছিলেন। তাঁরা অনুতাপ করেন যে মুসলমানদের আক্রমণ করা তাঁদের উচিত হয়নি। আশার কথা, হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্কে যে ফাটল ধরেছিল তা গত দু-তিন বছর ধরে মেরামত করার প্রচেষ্টা চলছে। এই কৃষক সংগ্রামে হিন্দু ও মুসলমান জাঠ ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়াই করছেন। মহম্মদ জোলাও আবার সক্রিয় ভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছেন। গাজিপুরে রাকেশ টিকায়েত স্বীকার করেন, বিধানসভা ও লোকসভায় তাঁরা বিজেপিকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছিলেন। সেটা তাঁদের মস্ত বড় ভুল ছিল।
মহিলা ও নিম্নবর্ণ শ্রেণির মানুষদের মতো বিপুল সংখ্যক মুসলমান আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করছেন। রাজস্থানের মেওয়াত অঞ্চলের মহাপঞ্চায়েতে বিপুল সংখ্যক মুসলমান উপস্থিত ছিলেন। এঁরা মায়ো মুসলমান হিসাবে খ্যাত। খাপ ও ধর্মীয় নেতারা এখানে ভাষণ দেন। মহম্মদ জোলা ছিলেন অন্যতম প্রধান বক্তা। বৃটিশ-বিরোধী আন্দোলনের সাথে কৃষক আন্দোলনের এটা একটা বিরাট মিল। তখনও দেখা গিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন যখনই তীব্র হয়েছে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত ভেদাভেদ কমে গেছে।
জনসমাগমের দিক থেকে এখন আন্দোলনে একটু ভাটার টান মনে হবে। এটা ফসল কাটার সময় তাই অনেককেই গ্রামে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু পালা করে যাওয়া-আসা চলবে। একদল যাবেন, আরেক দল আসবেন। এছাড়া আসন্ন গ্রীষ্মের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। কুলার, এসি, গ্রীষ্মের ভয়ানক দাবদাহ থেকে বাঁচতে যথাযথ ছাউনির ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু আবার তাঁরা ফিরে আসবেন। যেহেতু ফসল বিক্রি করতে তাঁদের মান্ডিতে যেতে হবে তাই এমএসপির দাবি আরও জোরদার হবে। দিল্লি সীমান্তে লাখো কিষাণের গগনভেদী আওয়াজ শাসকের ভিত কাঁপিয়ে দেবে।