পেরেক প্রজাতন্ত্র!
শোভনলাল চক্রবর্তী
প্রজাতন্ত্র দিবসের ভারী বুটের কুচকাওয়াজ মিটে গেছে সেই কবেই। 'বিটিং দ্য রিট্রিট'এর বিউগল বাজিয়ে ফিরে গেছেন সবাই। কিন্তু রাজধানী দিল্লি ক্রমশই যুদ্ধক্ষেত্রের রূপ ধারণ করেছে। রাস্তায় রাস্তায় পুলিশি ব্যারিকেড, কাঁটাতারের বেড়া, ট্রেঞ্চ, রাজপথে গেঁথে দেওয়া সারি সারি পেরেক- আক্ষরিক অর্থেই রণসজ্জা। ঠিক যেমনটা যুদ্ধের সময় হয় তেমনই প্রতিনিয়ত রাজধানীর বিভিন্ন 'সীমান্ত' থেকে ভেসে আসছে বিবিধ 'সংবাদ'। দেখে মনে হচ্ছে যেন ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী কোনও দেশের যুদ্ধ বেঁধেছে। এমনকি, বিদেশমন্ত্রকও 'ভারতের নামে অপপ্রচার' প্রতিরোধে তৎপর হয়ে উঠেছে, যুদ্ধের সময় ঠিক যেমনটা ঘটে! ভয় হয়, যে কোনও মুহূর্তে হাল্লার রাজা ঘুম ভেঙে উঠে বসবেন এবং 'যুদ্ধ যুদ্ধ' বলে হুঙ্কার দিয়ে উঠবেন।
আজ যদি ধৃতরাষ্ট্র আচমকা হস্তিনাপুরে হাজির হতেন, তাহলে তিনি নিশ্চয় সঞ্জয়কে সামনে বসিয়ে সবার প্রথমে জানতে চাইতেন, কী করে এমন কুরুক্ষেত্র বাঁধল? সঞ্জয় তখন তাঁকে আস্বস্ত করে নিশ্চয় বলতেন, শান্ত হন মহারাজ, এতে অবাক হওয়ার কী আছে? এই রণসজ্জা তো একদিনের প্রস্তুতিতে তৈরি হয়নি। ফ্রিজে মাংস রাখার সন্দেহে যেদিন একজন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, সেদিন অবাক হয়েছিলেন কী? উল্টে হত্যাকারীদের জাতীয় পতাকা দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছিল। না, তখনও অবাক হননি। মাথায় পাগড়ি দেওয়ার অপরাধে একটি ছেলেকে প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে খুন করল কিছু মানুষ, আর আমরা অবাক হওয়া তো দূরস্থান, দেখলাম সামাজিক মাধ্যমে পিটিয়ে মারার সমর্থনে এগিয়ে আসছেন মানুষ। আমরা কেউ কেউ গর্বিত হলাম, কেউ ভাবলাম, কী হবে ওই সাতে পাঁচে থেকে? সেনার গাড়ির বনেটে বেঁধে নিয়ে যাওয়া মানুষের ছবি দেখে আমাদের অনেকেই মনে মনে হেসেছি, কেমন টাইট দেওয়া গেল তাঁদের, যাঁরা নিয়মিত পাথর ছুঁড়তেন সেনাবাহিনীর দিকে। না, তখনও অবাক হইনি।
নোটবন্দি করে আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে আর্থিক সঙ্কট, কিন্তু আমরা হাততালি দিয়েছি আর গুণগান গেয়েছি, অবাক হইনি। কারণ সবই নাকি আমাদের ভালোর কথা ভেবে। সন্ত্রাসবাদীদের কোমর ভাঙার জন্য, মাওবাদীদের দুর্বল করার জন্য আর কালো টাকা বিনাশ করার জন্যই নাকি এইসব আয়োজন। এসবের কিছুই যখন হল না তখনও আমরা অবাক হইনি, উল্টে সবটাই আমাদের ভাগ্যদোষ বলে মেনে নিয়েছি। তারপর এল গণতন্ত্রের মাহেন্দ্রক্ষণ, বিলুপ্ত হল সংবিধানের ৩৭০ ধারা। আমরা গোটা ব্যাপারটা ভেবে দেখার, ভালোমন্দ বিবেচনার সুযোগই পেলাম না। দেশপ্রেমের ঢাকঢোলের আওয়াজে চাপা পড়ে গেল কাশ্মীরের অবরুদ্ধ কণ্ঠস্বর। আজও কাশ্মীর এক বৃহৎ কারাগার বিশেষ, আমরা কী বিশেষ অবাক হয়েছি তাতে?
আমাদের এক প্রতিবেশী দেশ, যার নাম উচ্চারণ করতে ভয় পান আমাদের প্রধানমন্ত্রী; তাদের সেনাবাহিনী আমাদের দেশের সীমায় ঢুকে পড়লেও আমাদের মিথ্যা বলা হয়। আমরা সেটাই বিশ্বাস করি এবং অবাক হই না। আমরা বিশ্বাস করি যে মেঘের আড়ালে রাডার ফাঁকি দিয়ে আমরা শত্রুপক্ষের ঘাঁটি উড়িয়ে দিয়ে এসেছি। আপাদমস্তক মিথ্যা প্রচারে ডুবে থাকা আমরা আর কিছুতেই অবাক হই না। যে কার্টুন আমি আঁকিনি, যে চুটকি আমি বলিনি, যে লেখা আমি লিখিনি, তার জন্য জেলে বসে পচতে আজ আমরা যেন সদাপ্রস্তুত। না না, এতে অবাক হওয়ার কী আছে? আচ্ছা, একটি মেয়েকে একাধিকবার ধর্ষণ করে, খুন করে, তার দেহ উর্দি পড়া পুলিশের পাহারায় জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনায় কি আমরা একটুও অবাক হয়েছিলাম?
এই সুবিশাল না-অবাকের সারি ডিঙিয়ে আজ আমরা দাঁড়িয়েছি সিঙ্ঘু, গাজীপুর আর টিকরি সীমান্তে যেখানে সোনার ফসল ফলানো কৃষকদের জন্য আমাদের সুমহান প্রজাতন্ত্র রাস্তায় পেতে রেখেছে লোহার পেরেকের তৈরি ব্যারিকেড। একে যদি পেরেক প্রজাতন্ত্র না বলি, তাহলে আর কাকে বলব! এইবার শুরুর অপেক্ষা কুরুক্ষেত্রের। সঞ্জয় আজ অতীত। এখন তথ্য সংগ্রহ ও সম্প্রচারের মাধ্যম অষ্টপ্রহর জাগ্রত ও সজাগ। বিদ্যুৎ সংযোগ, জল ও ইন্টারনেট বন্ধ করে, টুইটারকে ধমক দিয়ে সেই সহস্র চোখের দৃষ্টিপথ রুদ্ধ করার ক্ষমতা মহাশক্তিধর সরকার ও তার অতিপরাক্রমী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেই। অতএব, কুরুরাজ না জানতে পারেন, দেশ ও দুনিয়া বিলক্ষণ জানে কীভাবে এবং কেন দিল্লির পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ হয়ে উঠল। সাধারণ বুদ্ধিতে এই পরিণতি সত্যিই অবিশ্বাস্য। কবে কীভাবে এই পর্বের অবসান ঘটবে, তার জন্য কাকে কতটা মূল্য চোকাতে হবে, এ সবের উত্তর এখন ভবিষ্যতের গর্ভে। কিন্তু ইতিমধ্যে যা ঘটে গেছে তা ভারতের ইতিহাসের এক অন্যতম কলঙ্কিত অধ্যায়। সেই কলঙ্ক ঔদ্ধত্যের এবং অপদার্থতার।
সাধারণ মানুষের কথা শুনতে কতটা অপারগ হতে পারে কোনও রাষ্ট্র, তার নিদর্শন আজ দিল্লির রাস্তায় সারা বিশ্ব দেখছে। এই ব্যারিকেডের প্রতিটি পেরেক জানান দিচ্ছে রাষ্ট্রের সেই অনিচ্ছার। তাহলে কি এখন থেকে কথা বলতে পেরতে হবে এই বিপুল ব্যারিকেডের বাধা? রাস্তায় রাখা এই পেরেক অভিজ্ঞান হয়ে থেকে গেল আজকের ভারতের, যার মলিনতা ঘোচাতে পারবে না ক্রিকেটের ঈশ্বরের আলটপকা টুইট, বা একগুচ্ছ বলিউডি 'আমিক্যাবল' টুইট।
বুঝে এবং না বুঝে কেন্দ্রের বড় বড় মাথারা যে 'গুরুবর'এর বিভিন্ন উক্তি দুমদাম উদ্ধৃত করেন, সেই 'গুরুবর' একটি গানে লিখেছিলেন, 'তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি'। এই লাইনের অর্থ বোঝার ক্ষমতা থাকলে কেন্দ্রের নায়ক নায়িকারা বুঝতেন যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সুশাসক হওয়ার কোনও যোগ্যতাই তাঁদের নেই। তাঁদের যা বহুল পরিমাণে আছে তা হল অহঙ্কার, এবং সেই অহঙ্কারের কারণেই তাঁরা ভুলে মেরে দিয়েছেন যে ক্ষমতার সঙ্গে আসে দায়িত্ব, আর দায়িত্বের প্রধান অঙ্গ হল জনগণের কথা শোনার আগ্রহ ও ধৈর্য। অবশ্য এখানে 'ভুলে মেরে দিয়েছেন' লেখাটা ঠিক হল না, কারণ, ওই বোধ তাঁদের কোনওদিনই ছিল না। সেই কারণেই কৃষকদের সঙ্গে শাসকেরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস শুধু সময়ের অপব্যবহার করেছেন সমস্যাটাকে আরও জটিল করে তোলার অভিপ্রায়ে। আজও আক্ষরিক অর্থে দুনিয়ার হাটে চূড়ান্ত অমর্যাদার পরও সরকারপক্ষের আত্মসংশোধনের কোনও তাগিদ নেই বরং অসহিষ্ণুতার পারদ আরও চড়ছে। কৃষকদের ছলে, বলে, কৌশলে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা আরও প্রবল হচ্ছে।
প্রশ্নটা এখানে সরকার বনাম বিরোধী রাজনীতি বা সরকার বনাম কৃষকের নয়, প্রশ্ন ভারতের গণতন্ত্র রক্ষার। বর্তমানে পেরেক প্রজাতন্ত্রের রাস্তায় গণতন্ত্র মৃতদেহের মতো গড়াগড়ি খাচ্ছে, আর সংস্কারের নামে আত্মঘাতী পথে ছুটে চলেছে সরকার।
বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না,দেশের তথাকথিত প্রগতিশীল জনগণের ঘৃণার পাত্র এবং সরকার-সমর্থক বন্দিত "ভক্ত" বলতে যা বোঝায় তা নই। খোলা মনে দেশের রাজনৈতিক ও আর্থিক নিজের সীমিত বিচার-বুদ্ধি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি।
ReplyDeleteআপনার অনেক প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে আছে। মন্তব্য অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে তাই লিখছি না।
আপনি কি টিভি দেখেন? ২৬ তারিখের "শান্তিপূর্ণ"বিক্ষোভের চেহারাটা মনে করার চেষ্টা করুন--সবটা না পারলেও কিছুটা করুন।
ট্রাক্টার চাষের কাজে ব্যবহার হয়,কিভাবে তা বেপরোয়া ছুটিয়ে পুলিশদের ভয় দেখানো যায়,মেরে দেওয়া যায়,সেটা "নির্ভীক"আন্দোলনকারীদের কয়েকজন ভাল ভাবে বুঝিয়ে দিয়ে দিযেছিলেন।৩০০ র ওপর পুলিশ কর্মী কমবেশি আহত। আর বিক্ষোভকারী?একজন দুর্ভাগ্যজনক ভাবে মারা গেছেন। আশা করি জনৈক খ্যাতনামা সাংবাদিক এই বিষয়ে breaking news দিতে গিয়ে যা ভুল করে ফেলেছিলেন,তা আপনি এখনও ভুলে যান নি।
লালকেল্লায় যে ভাবে হাজার হাজার আন্দোলন কারী "কিষান ভাই" কিষান আন্দোলনের স্বরূপ চিবিয়ে দিলেন,তা দেখে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল।
এর পরও যদি আন্দোলনের নেতা ও গায়ে-পড়া রাজ-নেতাদের সাথে গলা মিলিয়ে বলেন,ও সব সরকারের পূর্ব-পরিকল্পিত/ষড়যন্ত্র,তবে আমার আর কিছু বলার নেই।
শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নামে যে বেপরোয়া হিংস্র আচরণ সেদিন দেখা গেছে,তার পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের প্রাণ ও সম্পত্তি রক্ষার তাগিদে এমন সুরক্ষা বলয় তৈরি করারই কথা। না করলেই বরং সরকারি গাফিলতি বলে আমি মনে করতাম ও করি।
আন্দোলন সম্পর্কে আগেই অনেক প্রশ্ন তুলেছি ফেসবুকে।জাস্টিস কাটজুর(অবসরপ্রাপ্ত)পোষ্টের মন্তব্য বিশদে লিখেছি।ইচ্ছে হলে দেখতে পারেন।
ট্র্যাক্টরের বেপরোয়া ছোটাছুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিছু হিসাত্মক ঘটনা নিশ্চয়ই হয়েছে। লাখো লোকের জমায়েতে 100 জন বিপথগামী হয়েছে। সেটা দিয়ে পুরো আন্দোলন কে কালিমালিপ্ত করা যায় না। লালকেল্লায় বজ্র কঠিন প্রহরা গলে এতো মানুষ কী করে ঢুকে গেল? তাদের allow করা হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে, আন্দোলনকে হেয় করার জন্য।
ReplyDeleteOhe markendaya, apnar comment to agun moshai,ke ki dekhen jani na, ami moshai roj niyom kore republic tv dekhi. Tatei dekhechi kibhabe bjp'r lokjon chasa seje golmal pakalo, je police delhi riot e musalmander dekhlei guli chalalo, jamia te birer kaj korlo, jnu te porombirer kaj korlo tader ki putul putul dosha.soboi uporolader hukum.tobee moshai sabdhane thakben.kondin oi perek diye apnar pa ta ke raster songe genthe na deai.chitkar kore lab hobe na sedin, mukhe gag kora thakbe.oi din porjonto apnar bibek jagroto thakuk.pronam neben
ReplyDelete