যুক্তরাষ্ট্রীয় ও বহুদলীয় ব্যবস্থার উপর আঘাত
বর্ণালী মুখোপাধ্যায়
বিজেপি'র ফ্যাসিস্ট রাজ কায়েমের সব থেকে বড় বাধা হল বহু দলের অস্তিত্ব। ইডি-সিবিআই'কে দিয়ে বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেফতার করে দলগুলির মাজা ভাঙার চেষ্টা করেছিল তারা। কিন্তু জনগণ প্রত্যাঘ্যাত করলেন, নরেন্দ্র মোদী বেনারস থেকে মাত্র এক লাখের কিছু বেশি ভোটে জিতলেন। এখন অরবিন্দ কেজরিওয়াল, অনুব্রত মন্ডল, সেন্থিল বালাজি সহ অনেকেই একে একে বেলে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন। তাই এবার বিজেপির নতুন ফন্দি হল ‘এক দেশ এক ভোট’। পুঁজিবাদের বৃদ্ধ বয়সের (যদিও বার্ধক্যের বয়সও দেড়শো বছর হতে চলল) সন্তান ফ্যাসিবাদ আবার যুবক পুঁজিবাদের গণতন্ত্রকে সহ্য করতে পারে না। হিটলার থেকে বাজপেয়ী হয়ে মোদী আদ্যপান্ত ভোট বিরোধী। বাজপেয়ী আমলেও এই চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু তখন পরিস্থিতি আলাদা ছিল। আজ মোদী শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
রামনাথ কোভিন্দের সভাপতিত্বে অমিত শাহ, গুলাম নবি আজাদ, এন কে সিং, সুভাষ কাশ্যপ, হরিশ সাল্ভে, সঞ্জয় কোঠারি, নীতিন চন্দ্র এবং আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে আইন মন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘওয়াল— এই কমিটি সুপারিশ করেছে ‘এক দেশ এক ভোট’ (One Nation One Election- ONOE) আইন। ৩২২ পাতার রিপোর্ট এটি, যা ১৮ সেপ্টেম্বর মন্ত্রীসভায় গৃহীত হয়েছে। প্রস্তাবটি সংসদে পেশ হবে শীতকালীন অধিবেশনে। রিপোর্ট অনুযায়ী, পাঁচ বছর অন্তর ৪ মাস ধরে ভোট চলবে। প্রথমে বিধানসভা আর লোকসভা ভোট একসঙ্গে হবে, তারপর তিন মাসের মধ্যে পঞ্চায়েত ও পৌরসভা ভোট। রিপোর্টটি তৈরি করা হয়েছে ১৯১ দিনে। অন্তত একজন সাংসদ আছে এমন ৪৭টা রাজনৈতিক দলের মতামত নেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের মতামত জানায়। এছাড়া ভারতের তিনটি বৃহৎ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ফিকি-অ্যাসোচেম-সিআইআই'এর থেকে নেওয়া হয়েছে পরামর্শ। পরামর্শ নেওয়া হয়েছে উকিল এবং বিচারপতিদের থেকেও। এই সুপারিশ গঠনে বিশেষ ধন্যবাদ জানানো হয়েছে আইন মন্ত্রক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের উচ্চপদস্থ দু-চারজন আমলাকে। যদিও যে নামগুলো আছে সেগুলো বাছাই করা তাতে সন্দেহ নেই। সুপ্রিম কোর্টের চারজন বাছাই করা প্রাক্তন বিচারপতি, কিছু বাছাই করা হাই কোর্টের বিচারপতি, আবার অখিল ভারতীয় অধিভক্ত পরিষদ অর্থাৎ আরএসএস'এর উকিল সংগঠনের প্রতিনিধি, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনের প্রাক্তন আধিকারিক- এদের থেকেও মতামত নেওয়া হয়েছে। আর জনগণ? হ্যাঁ তাও আছে বৈকি!! ১৪০ কোটির এই দেশে ২১,৫৫৬ জন নাগরিক তাদের মতামত জানিয়েছেন; যাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ, অর্থাৎ, ১৭ হাজার মানুষ এই সুপারিশের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। যথেষ্ট নয় কী?! ৩২টি রাজনৈতিক দল এই প্রস্তাবের পক্ষে রায় দিয়েছে, ১৫টি দল বিরুদ্ধে মত দিয়েছে। তবে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, শিবসেনা পক্ষে মত দিয়েছে আর আরজেডি নীরব থেকেছে। অন্তত বিরোধিতা করেনি।
বিজেপি বিরোধীরা হয়তো ভেবেছিল যে এই আইন মন্ত্রীসভায় গৃহীত হবে না। বিজেপির আসন এবার কম তাই সেই সুযোগ নিয়ে শরিকরা এটা অনুমোদন করবে না। কিন্তু দেশে বা বিভিন্ন রাজ্যে অনাস্থা প্রস্তাব এলে মধ্যবর্তী ভোট হবে-- এই আশ্বাস দিয়েই কি কোভিন্দ কমিটির সুপারিশ শরিকদের মন জিতে নিল? ‘একসাথে বিধানসভা আর লোকসভা ভোট হলেও বহু আঞ্চলিক দল বহু রাজ্যে জিতেছিল’-- সুপারিশ থেকে এই বার্তা পেয়েও হয়তো শরিকরা সন্তুষ্ট। অথবা বিজেপি বিরোধী দলগুলো যেমন শরিকদের উপর নির্ভর করছিল হয়তো বিপরীতটাও সত্যি। শরিকরাও হয়তো ধরেই নিয়েছে যে এই আইনের বিরুদ্ধে মামলা হবেই, ফলে তারা আর অমিত শাহকে চটাতে চাইল না। কংগ্রেস দলের আমলে এই ব্যবস্থা ছিল বলে রাহুল গান্ধী নীরব থাকবেন, এমনটাও হয়তো বিজেপি আশা করেছে। তাছাড়া, বহুদলীয় ব্যবস্থা থেকে সরে এসে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা হলে কংগ্রেসের আপত্তি থাকবে না, এমন আশা বিজেপি করতেই পারে।
আসলে এই সুপারিশ মোতাবেক এই যে বহু দল থাকবে, একসাথে সব ভোট হবে, অনাস্থা প্রস্তাব এসে কোনও সরকার পড়ে গেলে আবার মধ্যবর্তী ভোটও হবে, অথচ ভোটের সংখ্যা কমবে-- এ এক সোনার পাথরবাটি। অমিত শাহ সেটা জানেন। যেমন জানেন সুভাষ কাশ্যপ (এই কমিটির সদস্য)। কমিটির প্রস্তাবে স্পষ্ট বলা আছে যে কংগ্রেস আমলে প্রথম চারটে লোকসভা ভোট বিধানসভার সাথেই হয়েছে। কিন্তু যে পরিমাণে ক্রমেই বহুদলীয় গণতন্ত্র পাকাপোক্ত হয়েছে একসাথে ভোট আর করা যায়নি। ফলে, কাশ্যপ মধ্যবর্তী সাধারণ ভোটে রাজি নন। তার বদলে বিধানসভা বা সংসদের ভেতরে ভোটের মধ্য দিয়ে পরবর্তী সরকার গঠন করার সুপারিশ করেছেন, তবে একটাই শর্তে, বিকল্প মুখ্যমন্ত্রী/ প্রধানমন্ত্রীর মুখ বেছে নিতে হবে তখনই। সারকারিয়া কমিশন আর পুঞ্চ কমিশনের নির্দেশমতো রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতি পরবর্তী সরকার গঠনের জন্য দল/জোটকে আহ্বান জানাবে আর অনাস্থা প্রস্তাব যারা এনেছে তাদের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীকে ওই হাউজেই ভোটের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত করতে হবে। অর্থাৎ, ঘোড়া কেনাবেচা হবে, অনাস্থা আসবে, হাউজের ভেতরেই বিকল্প মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী নির্দিষ্ট করতে হবে। প্রয়োজনে হাউজে ভোটও হবে। আর না হলে? তিনি আর কিছু বলেননি, কিন্তু একটাই বিকল্প হয় সে ক্ষেত্রে: রাষ্ট্রপতি শাসন। কাশ্যপবাবু কিছুতেই মধ্যবর্তী সাধারণ বিধানসভা বা লোকসভা নির্বাচন চাননি। তাঁর দিক থেকে বিষয়টা অযৌক্তিকও নয়। কোভিন্দ কমিটির যুক্তির গোড়ার অজুহাত হল ভোটের সংখ্যা কমাও, খরচ কমাও। অথচ, কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী পাঁচ বছর অন্তর সব ধরনের ভোট একসাথে করার যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সেটা আইন হলে, আবার পাশাপাশি মধ্যবর্তী ভোটও চালু থাকলে, ভোটের সংখ্যা কমার বদলে আরও বাড়বে। যেহেতু নতুন আইন চালু হলে মধ্যবর্তী সরকার পাঁচ বছর থাকবে না, লোকসভার এক বছর আগে নতুন সরকার হলেও আবার নতুন করে একসাথে ভোট হবে, ফলে, কাশ্যপ সোজাসাপ্টা রাজ্যপালের ক্ষমতা প্রয়োগের কথা বলেছেন এবং সেই হেতু এও স্পষ্ট করেছেন যে ভারত আসলে যুক্তরাষ্ট্র নয়, এখানে আমেরিকার মতো রাজ্যগুলি স্বেচ্ছায় একটি ভৌগোলিক সীমানায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
অমিত শাহ জানতেন যে কাশ্যপের প্রস্তাব এখনই মানা যাবে না। কোভিন্দ কমিটি কাশ্যপের এই প্রস্তাব বাতিল করে শরিকদের, হয়তো বা বিরোধীদেরও সন্তুষ্ট করে বলেছে যে মধ্যবর্তী ভোট অবশ্যই হবে। কিন্তু রাজ্যপালের সাংবিধানিক ক্ষমতা আছে রাজ্য সরকার ফেলে দেওয়ার, কাশ্যপের এই মতামতকে সার্বিক সমর্থন জানাতে ভোলেনি কোবিন্দ কমিটি। রাজ্যপালকে মন্ত্রীসভার অনুমোদন নিতে হবে না এবং আদালতেও রাজ্যপালের এই কাজকে প্রশ্ন করা যাবে না। অমিত শাহ জানেন যে এই আইনের মধ্য দিয়ে আসলে তারা এই দুটো বিষয়কেই বৈধ করতে চেয়েছে--
এক) রাজ্যপাল মোটেই আলংকারিক নয়।
দুই) দেশ মোটেই যুক্তরাষ্ট্র নয়।
'যুক্তরাষ্ট্র' শব্দটার গুরুত্ব স্রেফ এইটুকুই যে সংবিধানে তিনরকম তালিকা আছে, এবং সেটাও দেশের বৈচিত্রের দিকে খেয়াল রেখে যেন বা দয়া করে কেন্দ্র দিয়েছে রাজ্যকে। আপাতত এই দুটো স্বীকৃতি পেলেই অমিত শাহের চলবে। বাকিটা দাঙ্গা করে তারা আদায় করবে। যেমন প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও জম্মু কাশ্মীরের ভোট ৬ বছর দেরিতে হল।
ভোট নাকি উন্নয়নের পথে বাধা। ভোটের খরচ নাকি আকাশছোঁয়া!! যদিও হিসেব করলে দেখা যাচ্ছে, মাথাপিছু ভোটের খরচ দেড় হাজার টাকা, অথচ মাথাপিছু দেশের ঋণ হল দেড় লাখ টাকা। এদিকে প্রস্তাবে পাবেন বালতি বালতি কুমিরের চোখের জল। ভোটের জন্য নতুন প্রজেক্টের শীলা স্থাপন করা যাচ্ছে না, অনুদান দেওয়া যায় না, ইস্কুল আর শিক্ষকদের ভোটের কাজে নিয়ে যেতে হচ্ছে, এমন কত আক্ষেপ অমিত শাহের। বাস্তব হল, বছরে একটা ভোট অসহ্য হয়ে উঠছে একাধারে বিজেপি অন্যদিকে এ দেশের বৃহৎ ব্যবসাদারদের পক্ষেই। তাদের মৌখিক যুক্তি হল, পরিযায়ী শ্রমিকরা বার বার ঘরে ফেরে ভোট দিতে, তাই পাঁচ বছর অন্তর এই বন্ডেড লেবারদের আটকাতে ভোট আর যেন বছরে একবার না হয়। এমন নির্লজ্জ বক্তব্য তারা রেখেছে ঠিকই। কিন্তু আসল কারণ আরও গভীরে। জনবিরোধী নীতিগুলি কার্যকর করার আগে তাদের প্রতি পদে হিসেব কষতে হয়। তাছাড়া বিরোধীরা থাকে সমাজতান্ত্রিক মেজাজে। পাঁচ বছর অন্তর ভোট হলে সেই বালাই নেই। প্রতি বছর ভোট না থাকলে মাঝের চার বছর বিরোধী দল সিন্দুকের ভেতর সেঁধিয়ে যাবে, এমনই আশা বিজেপির। বেলজিয়াম, দক্ষিণ আফ্রিকা, জার্মানি, ফিলিপিন্সের মতো হাতে গোনা কিছু ছোট দেশ, যাদের ভারতের মতো বৈচিত্র নেই, সেখানে চালু আছে একসাথে ভোট প্রক্রিয়া। আমাদের দেশে সেটা অসম্ভব।
ভারতের সংবিধান ঔপনিবেশিক রাজ্যপালের পদ বিলোপ করতে ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে খাপছাড়া ভাবে কার্যকর করেছে। তিনটি তালিকার মধ্যে রাজ্যের হাতে যা আছে সেটা প্রায় প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এ হেন সাংবিধানিক ফাঁকের সুযোগ নিয়ে আজ কোভিন্দ কমিটি যুক্তরাষ্ট্রকেই অস্বীকার করছে, রাজ্যপালদের ঈশ্বর বানাচ্ছে।
১৯৫০ আর ২০২৪'এর মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আজ বাস্তব ঘাড় ধরে এ দেশে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে, যার সাংবিধানিক স্বীকৃতি আমাদের চাই। আর ফ্যাসিস্টদের তরফে চাওয়া রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যপালের আলংকারিক অস্তিত্বের ন্যূনতম সাংবিধানিক স্বীকৃতিকেই অস্বীকার করা দরকার।