Friday, 30 April 2021

জোটের রাজনীতি

ভোটের হিসেবে সাবেক বামেরা 

কি আরও দুর্বল হবে?

প্রবুদ্ধ বাগচী


এ কথা ঠিক যে, একজিট পোলের সব তথ্য সব সময় মেলে না। আবার কিছুটা কিছুটা মিলেও যায়। বিষয়টা পরিসংখ্যানবিদ্যার একটা শাখা, সব বিষয়ের মতোই তার একটা গাণিতিক ভিত্তি আছে। সমস্যাটা হয় প্রাপ্ত তথ্যকে কে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন। বিশেষ করে, নিছক অ্যাকাডেমিক আগ্রহের বাইরে একজিট পোল বেশ কয়েক দশক ধরেই টিভি চ্যানেলগুলির একটা টিআরপি বাড়ানোর উপকরণ। ফলে, আজ এই গোদি মিডিয়ার রমরমার যুগে কোন একজিট পোল কতদূর তার গাণিতিক সতীত্ব রক্ষা করতে পারে সেই প্রশ্নটাও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। কারণ, সব চ্যানেলই আজ কোনও না কোনও কর্পোরেট সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং এদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও কম নয়। এবিপি আনন্দের মতো জনপ্রিয় চ্যানেলকেও তার অনুষ্ঠান দেখবার জন্য আনন্দবাজার পত্রিকায়  আজকাল বিজ্ঞাপন দিতে দেখা যাচ্ছে। 

কিন্তু, এই মেলা না মেলার মধ্যে একটা ন্যূনতম সামঞ্জস্য আছে। তাই গতকাল সন্ধ্যে জুড়ে যে সব একজিট পোল দেখানো হয়েছে তার মধ্যে যত ভুল ও রাজনৈতিক পক্ষপাতই থাকুক, একটা বিষয় খুব স্পষ্ট যে, রাজ্যের ভোটে আর যাই হোক সংযুক্ত মোর্চার ক্ষমতায় আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। প্রকাশিত সমীক্ষার মধ্যে তাদের সর্বোচ্চ আসন সংখ্যা দেখানো হয়েছে ২৫টি। এই হিসেব ভুল হতে পারে, তারা এর দু' গুন আসন পেতেও পারে, কিন্তু ২৫ সংখ্যাটা বেড়ে ১৫০ হবে এই সম্ভাব্যতা শূন্য। 

একদিক দিয়ে দেখতে গেলে এই তথ্যই তো উঠে এসেছিল প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষাতেও। কোনও সমীক্ষাই সংযুক্ত মোর্চাকে ক্ষমতায় আসতে পারে এমন দেখায়নি। কিন্তু না দেখালে কী হবে, বাম, কংগ্রেস ও আইএসএফ'এর সংযুক্ত মোর্চা গত দু' মাস ধরে প্রচার করেছে তারাই নাকি সরকার গড়বে। কীসের ভিত্তিতে এই দাবি করা হয়েছিল? 

গত লোকসভা ভোটে প্রতিটি বাম প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল, তাঁদের ভোট শতাংশ নেমে এসেছিল ৭ শতাংশে। অনেকে মনে করেছিলেন, বাম-কংগ্রেস সুষ্ঠু জোট হলে তাদের মোট ভোট ২০ শতাংশের কাছাকাছি যেতে পারে। এই শতাংশ ভোট নিয়ে সরকার গড়া যায় না। আব্বাস সিদ্দিকি'র জোটে যোগ দেওয়াকে বামফ্রন্ট বিশেষত সিপিআইএম একটা ইতিবাচক দিক বলে প্রচার করেছিল। কিন্তু এর ফলে কংগ্রেস একটু আড়ষ্ট হয়ে যায়। যদিও শেষ অবধি একটা কাজ চালানো মিলমিশ হতেই দেখলাম আমরা। কিন্তু ভোটের যে শতাংশ একজিট পোলে দেখা যাচ্ছে তাও খুব আশাব্যঞ্জক নয়। আবারও বলি, একজিট পোল না মিললেও ১৫ শতাংশ ভোট ৪০ শতাংশে পৌছে যাওয়া সম্ভব নয়। আসলে পুরো বিষয়টার মধ্যেই একটা ভাবের ঘরে চুরি ছিল, সেটা বামফ্রন্ট স্বীকার করল না। আমরা অনুমান করছি, ২ মে ভোটের ফল বেরনোর পর বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে একটা দায়সারা কৈফিয়ত সাংবাদিক সম্মেলনে খাড়া করা হবে। সেটা ঐতিহাসিক ভুল বা পরিস্থিতি বুঝতে ব্যর্থতা এমন একটা কিছু হলেও হতে পারে। ২০১১ সালেও তাদের অনেক নেতা বুক বাজিয়ে বলেছিলেন অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার হচ্ছেই। 

আসলে রাজ্যের বাম শক্তি, সিপিআইএম বলাই ভাল (কারণ বামফ্রন্টের শরিক দল ফরোয়ার্ড ব্লক, আরএসপি বা সিপিআই এখন কার্যত সাইনবোর্ড), এইবারের ভোটটাকে সত্যি করে সিরিয়াসলি নেয়নি। তাত্ত্বিকভাবে ও অবস্থানগতভাবে ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়ার যে দায় তাদের ছিল তারা সেটা থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছে প্রথমেই। বিজেপি ও তৃণমূলকে একই সারিতে রেখে তারা বারবার প্রকাশ করে ফেলেছে তৃণমূল সুপ্রিমোর প্রতি ব্যক্তিগত ক্রোধ যা কোথাও কোথাও রুচি ও শালীনতার সীমা অতিক্রম করেছে। প্রচারের সূচিমুখ তারা তীব্র করেছে তৃণমূলেরই দিকে, দাবি করেছে যে তাদের না সরাতে পারলে নাকি বিজেপি'র মোকাবিলা করা যাবে না। এরই সূত্রে তারা আমদানি করেছে 'বিজেমূল' নামক এক কল্পিত তথ্য যা আসলে নিজেদের নীতি-পঙ্গুত্বকে আড়াল করার চেষ্টা। তৃণমূল থেকে কিছু নেতা-কর্মী বিজেপিতে গেছে মানেই তাদের মধ্যে বোঝাপড়া আছে- এই তত্ত্ব কারওরই সাধারণ বুদ্ধিতে মেনে নেওয়ার কথা নয়। বরং লোকসভা ভোটে যে তাদের সমর্থকদের বড় অংশের ভোট বিজেপিতে গেছে এই সহজ পরিসংখ্যান তারা বিবেচনায় আনেনি। যদি একজিট পোলের কিছুটাও সত্যি হয় তাহলেও এটা স্পষ্ট যে বিজেপিতে যাওয়া ভোট এইবারেও বাম বা সংযুক্ত মোর্চার ঘরে ফিরে আসছে না। ব্যাপারটা আদপে যে এমন যান্ত্রিক নয়, এটা পোড় খাওয়া বাম নেতারা কেন যে বুঝলেন না! অন্যদিকে, প্রশান্ত কিশোর কিন্তু তাঁর একটা সমীক্ষায় দেখেছেন, গ্রামে বুথ স্তরে বিজেপির যে সংগঠন তার নেপথ্যে আছে বাম দলের কর্মীরা (টেলিভিশনে এই বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে)। 

আরেকটা হাস্যকর প্রয়াস হল, এই প্রথম সিপিআইএম তাদের তরুণ প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ফলাও করে প্রচার করেছে। যেন মনে হল, এটা বিধানসভার নির্বাচন নয়, কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট বা সিন্ডিকেটের নির্বাচন। কম শিক্ষিত বা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত নয় এমন প্রার্থীরা কি বাম দলের কাছেই অচ্ছুত হয়ে গেল? এই শিক্ষার ঘোষণা এক ধরনের এলিট উঁচু জাতের মানসিকতাকেই মনে করিয়ে দেয়। আরেকটা কথাও বলা হয়েছে, আমফান বা লকডাউনের সময় বাম কর্মীরা মানুষের আপদে বিপদে পাশে থেকেছেন, এটাও নাকি তাঁদের একটা বড় অ্যাডভান্টেজ। তাঁরা যে পাশে ছিলেন বা এখনও 'রেড ভলান্টিয়ার্স' তৈরি করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন, এটা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজনৈতিক সমাজে, যে সমাজ গড়ে ওঠার পেছনে বামপন্থীদের ভূমিকা আছে, সেখানে এই জনসেবা দিয়ে রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড পাওয়া কি সত্যি সম্ভব? বিশেষ করে বিধানসভার ভোটে? পাড়ার কাউন্সিলার নির্বাচনে তবু এর একটা প্রভাব থাকে কিন্তু রাজ্যের সরকার গঠনের প্রশ্নে এই বিচার কতটা কার্যকরী হতে পারে? হাতের কাছে তো কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের উদাহরণ আছেই। মজার কথা হল, অতীতে বিভিন্ন পৌরসভা বা পঞ্চায়েত নির্বাচনে কিন্তু বাম দলগুলি স্থানীয় ইস্যুর থেকে অন্যান্য বড় ইস্যুকে সামনে আনতেন। পৌরসভার নির্বাচনে গ্যাট চুক্তি বা পঞ্চায়েত ভোটে মার্কিন আগ্রাসন এইসব ইস্যু হতে দেখেছি আগে। আর তরুণ প্রার্থীই হোন বা প্রবীণ, রাজ্যের নির্বাচনে ভোট হয় দল দেখে, দলের নীতি দেখে, প্রার্থীর বয়স বা ডিগ্রি দেখে নয়। বাম দলের ভোটে লড়ার নীতিটাই কি সঠিক ছিল এবার? তৃণমূলের বিরুদ্ধে তাদের আনা অভিযোগগুলির সঙ্গে বিজেপির প্রচার করা বিষয়গুলির কি আদৌ কোনও তফাত ছিল? কখনও কখনও মনে হয়েছে, বিজেপিই যেন তাদের ইস্যুগুলোকে সংযুক্ত মোর্চাকে দিয়ে বলিয়ে নিয়েছে! আর তৃণমূলের তথাকথিত 'পপুলিস্ট' কর্মসূচিকে তারা যেভাবে সমালোচনায় বিদ্ধ করেছে অথচ নিজেদের ম্যানিফেস্টোতে প্রায় একই ধরনের কাজের ঘোষণা করেছে, তাতে আসলে গুলিয়ে গেছে আদপে তারা কী চায়।

আসতে পারে কংগ্রেস দলের সঙ্গে জোটের প্রসঙ্গও। এতদিন ধরে যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন বাম কর্মীরা তাদের হাত ধরে চলা কি এত সোজা? কার্যত সেই একই অজুহাতে তো তাঁরা তৃণমূলকেও বিরোধিতা করছেন, কারণ, তৃণমূল বাম কর্মীদের ওপর দশ বছর নির্যাতন করেছে বলে অভিযোগ। সেই একই ধারাবাহিকতা কংগ্রেসেরও। তাছাড়া আজ বিজেপির বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ তার অনেকগুলোই তো কংগ্রেসের অবদান। রাম মন্দিরের তালা খুলে দিয়েছিলেন রাজীব গান্ধী, অসম চুক্তি করে সেই রাজ্যে এনআরসি'র ভিত্তিভূমি তৈরি রাজীবের জমানায়। এছাড়া  দুর্নীতি, কর্পোরেট-তোষণ, সরকারি সংস্থার বেসরকারিকরণ, ইউএপিএ'এর মতো নিবর্তনমূলক আইন তৈরি- এসবের সঙ্গে কংগ্রেসের নাম যুক্ত। এমনকি যে কৃষি আইন নিয়ে আজ দেশ জোড়া বিক্ষোভ তার প্রাথমিক প্রস্তাব কংগ্রেস আমলেই তৈরি। মার্কিন দেশের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি করার প্রতিবাদে বামেরা ইউপিএ-২ সরকারের ওপর সমর্থন তুলে নিয়েছিলেন। সেই কংগ্রেস দলকে তাঁরা বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ার সহায় কী বিচারে ভাবলেন সে এক ধাঁধা। এমনকি যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁরা এককাট্টা হয়ে 'নো ভোট টু বিজেপি' মঞ্চ বা 'সংযুক্ত কিসান মোর্চা'র আবেদনকেও সন্দেহের চোখে দেখে নিজেদের তাঁদের থেকে সরিয়ে রাখলেন ও প্রকাশ্যে তাঁদের টিএমসি-র প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট বলে দাগিয়ে দিলেন, সেই তৃণমূল যখন ২০১১'তে বামফ্রন্টকে সরিয়ে দেয় তখন তো কংগ্রেসও তার জোটসঙ্গী ছিল। 

একইভাবে আইএসএফ'এর সংসর্গ নিয়েও কথা আছে। নিজেদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ঐতিহ্য সরিয়ে রেখে বাম নেতারা যেভাবে আব্বাস সিদ্দিকিকে আগামী বাংলার কারিগর বা মসীহা হিসেবে প্রচার করেছেন তা শুধু হাস্যকর নয় বিস্ময়করও বটে। যিনি কিছুকাল আগেও একজন ধর্মগুরু ছিলেন ও প্রকাশ্যে মৌলবাদী কথা বলতেন, বামপন্থীদের কোন পরশপাথরে তিনি সেকুলার ও বঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে দেখা দিলেন এই রহস্য অনেকেই এখনও ভেদ করতে পারেননি। তাছাড়া, বাম নেতারা দীর্ঘদিন ধরে বলে এসেছেন সমমনস্ক বাম দলগুলির সঙ্গে তাঁদের দীর্ঘদিনের গণ আন্দোলনের ফলেই বামফ্রন্টের  সৃষ্টি এবং সেই সংহতি নিয়ে তাঁরা সাড়ে তিন দশক রাজ্য শাসন করেছেন। আইএসএফ দলটি তৈরি হল জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে, ইতিপূর্বে তারা কোনও গণ আন্দোলনে অংশ নেয়নি, তাদের ভাবনার নাগাল পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা রাজ্যবাসীর ছিল না। অথচ সেই তারাই সিপিআইএম দলের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল যে এবারের ভোটে দীর্ঘদিনের শরিক দলগুলির তুলনায় তাদের বেশি আসন দিয়ে দেওয়া হল! নির্দিষ্টভাবে কত আসনে তারা জেতে বা কত ভোট পায় সেটা আমরা আর দুদিন বাদেই দেখতে পাব, কিন্তু সিপিআইএম'এর এইসব নীতি ও কৌশল নিয়ে বারবার প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে।

আমরা খুব নির্দিষ্টভাবেই চেয়েছি, রাজ্যের ক্ষমতায় আসতে না পারলেও অন্তত বিধানসভায় বামেরা যেন একটা যোগ্য বিরোধী স্বর তুলতে পারে। গণতন্ত্রের পক্ষে এটা সুস্থতার সূচক। কিন্তু একজিট পোলের তথ্য বলছে, ক্ষমতায় আসা তো দূরের কথা বিধানসভায় বিরোধী দলের মর্যাদাও আর তাঁরা পাচ্ছেন না। অবশ্য গত বিধানসভাতেও বামেরা নন, বিরোধী দলনেতা ছিলেন কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান। এবারও বামদের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা শূন্য। কাজেই তৃণমূল আর বিজেপির গট আপ থিওরিকে সামনে রেখে আর 'বিজেমূল'এর কাল্পনিক গরুকে গাছে তুলে তাঁরা রাজ্য বিধানসভায় নিজেদের বিরোধী মর্যাদাটুকুও যে খুইয়ে ফেলতে চলেছেন এটা প্রায় নির্ধারিত। ক্ষমতায় না এলেও বিধানসভায় প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিজেপির উঠে আসা, সেটা মোটেই শুভ লক্ষণ নয়। এমনকি হয়তো তৃণমূল আবার ক্ষমতায় ফিরলে বিধানসভায় বিজেপির সঙ্গে তাদের ফ্লোর অ্যাডজাস্টমেন্টেও যেতে হতে পারে কোনও সময়, যেমনটা হয়েছিল কেন্দ্রে ভি পি সিং সরকারের আমলে। কার্যত কি তবে বামেরা নিজেদের প্রাসঙ্গিকতাটুকুও হারাতে চললেন এইবার?   

খুব খুশি হব,  যদি আগামী ২ মে সন্ধ্যেবেলা এই প্রশ্নের উত্তরটি নেতিবাচক হয়।


Thursday, 29 April 2021

সত্যজিৎ ১০০

প্রান্তিক চরিত্রগুলিই তাঁর ছবির পরমাত্মা

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 


সৃজনশীল মানবজনেরা প্রজন্ম ধরে ধরে ক্রমে ক্রমে স্পষ্টতর হন। তাঁদের রেখে যাওয়া কাজ ও বোধ সমূহকে বারবার অবলোকন করে তবেই ধীরে ধীরে তাঁদের নাগাল পাওয়া যায়; যে কাজ ব্যাপৃত তাঁদের সৃজন ও যাপনের প্রতিটি মুহূর্তে। আমরা এইভাবেই প্রতি প্রজন্মে ও সময়ের উজানে শনাক্ত করতে থাকি এ তাবৎ কাল অবধি সেই সব অজস্র অনুক্ত মূর্ছনাগুলি। সে এক আবিষ্কারের আনন্দ- বলা ভালো, ‘দৃষ্টি মোদের যায় যতদূর/ সৃষ্টি তোমার ছড়ানো’। আসলে, অনন্ত মহাকাশকে জানার জন্যই প্রতিনিয়ত দৃষ্টিকে প্রসারিত রাখতে হয়।

তাই, সত্যজিৎ কখনও ফুরোন না। তাঁকে বারবার দেখে, পড়ে, ভেবে, স্মরণে-বিস্মরণে নিয়েও, তিনি বহু আলোকবর্ষ দূর হতেও সতত পরিস্ফুটমান। তাঁর প্রায় প্রতিটি ছবির মধ্যে তিনি শুধু বর্তমানের হদিশ দেন না, এমন ভাবে সেগুলিকে গ্রথিত করেন যে তা ভবিষ্যতের গর্ভেও অম্লান হয়ে ওঠে। এই কাজটা তখনই সম্ভব যখন প্রধান চরিত্রগুলির আশেপাশে অন্যান্য কম সময়ের চরিত্রগুলিও সমান গুরুত্ব ও ওজন নিয়ে বিরাজ করে। বলাই বাহুল্য, তাঁর সৃজনশৈলীতে প্রধান চরিত্রের ওপর ফোকাসটাকে খানিক আলগা করতেই এই পার্শ্বচরিত্রগুলির অবস্থান; প্রধান চরিত্রের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাকে ভাঙতেই আরও এমন কিছু চরিত্রের সমাবেশ, যা গল্পের অভিকর্ষকে নিয়ে যায় বহমান সময়ের দিকে। আর সে ভাবেই তা হয়ে ওঠে এক অম্লান সৃজন।

অর্থাৎ, গল্প ও তার দৃশ্যায়নের এমন এক সাবলীল ছন্দ তৈরি হয় যে অপ্রধান বা প্রান্তিক চরিত্রগুলি সত্যজিতের গোটা ছবিতে খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও বেশ সমুজ্জ্বলে প্রতিভাত হয়ে এক নির্ণায়ক ছাপ রেখে যায়। এখানেই তাঁর ছবির অনন্যতা। কারণ, গল্পের একটি সমগ্রতা ও বুনোটকে তখনই আয়ত্বাধীন করা সম্ভব যখন তার ছোট ছোট মুহূর্তগুলো বিচিত্র-কোলাহলে সপ্রাণ হয়ে ওঠে। কারণ, মনুষ্য-জীবন তো আর অমন নিপাট ভালোমানুষের মতো নয় যে সমীকরণগুলি খুব সহজেই মিলে যাবে, বরং, জনকোলাহলে পড়েই তার নানান অনিশ্চিত চলন-বলন তৈরি হয়।  

অতএব, তেমন তেমন প্রাসঙ্গিক জনকোলাহল-আবহ গড়ে তোলা ছিল সত্যজিতের ছবির মূল আকর্ষণ। তাই, গোটা ছবিকে ছাপিয়ে উঠে সেই তথাকথিত অপ্রধান টুকরোগুলিই কখনও কখনও যেন চোরাস্রোতের মতো কালের শরীরে চিরবহমান, যা বিনে ছবির নির্মাণ খানিক অস্ফূট হয়ে পড়ার কথা।



ধরা যাক, ‘পথের পাঁচালী’র প্রসন্ন গুরুমশাইয়ের কথা। মুদির দোকানে পাঠশালা চালানো এই গুরুমশাই কিন্তু কচি ছাত্রদের প্রতি মোটে সদাশয় নন, বরং তাদের পেলব হাতে বেত্রাঘাতে বেশ তৎপর; তদুপরি, পাড়ার মাতব্বরদের হাতে রাখতে দস্তুরমতো সেয়ানা। গোটা ছবিতে এই পাঠশালা দৃশ্যের অবতারণা সম্ভবত অপু’র জীবনে লেখাপড়ার অনুষঙ্গকে বোঝাতে। কিন্তু সেটুকুও সবটা নয়। সে সময়ের গ্রামীণ জীবনের চলমান বৈচিত্র্যকে উপস্থিত করাটাও ছিল অবধারিত, না হলে বালক অপু’র চোখে বড়দের জগতের অজানা বিস্ময় ধরা দেবে কীভাবে? অধিকন্তু, পাঁচালী যখন পথের তখন এক পয়সার মুড়ি থেকে নাট্যশালার তামাশা, নিদেনপক্ষে যাত্রাপালার বায়নায় নিশ্চিন্দিপুরের বদ্যি মজুমদারের ক্ষমতা- সবই তো অপুর চোখে উন্মীলিত হওয়ার কথা!


অথবা, ‘মহানগর’ ছবিতে সুব্রত’র বাবা প্রিয়গোপালবাবুর নিম্ন-মধ্যবিত্ত গ্লানিটুকুকে না ধরে ছবিটিকে কি বহমান রাখা যেত? ইংরেজি স্কুল মাস্টারের চাকরি থেকে অবসর নেওয়া প্রিয়গোপালবাবু খবরের কাগজের ক্রসওয়ার্ড ধাঁধাঁ সমাধান করে নিজ প্রতিবেশীর কাছে সুপ্ত অহং’এর বড়াই দেখান বটে, কিন্তু তাঁর চশমাটি দীর্ঘদিন ধরে ছেলের ‘অবহেলায়’ অচল হয়ে থাকায় তার বিরুদ্ধে জমে ওঠা মনের সুপ্ত জ্বালাটিও মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁর পুরনো ছাত্রদের দোরে দোরে ঘুরে তিনি অসহায়ের মতো জানাতে থাকেন তাঁর প্রতি ছেলের অবহেলার কথা। ভঙ্গুর সময়ের এই মাত্রা ব্যতীত ষাটের দশকের নব-নির্মিত ‘মহানগর’ সম্পূর্ণ হয় না। এক ঝটকায় সত্যজিৎ শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সাজানো আত্ম-অহঙ্কারকে চূর্ণ করে দেন।

 

‘অপুর সংসার’এ অপু’র বন্ধু পুলু ছাড়া ছবিটি কি আদৌ এগোতে পারে? অপুর অনিশ্চিত সাবেকি জীবনে হঠাৎ করে কলেজ-বন্ধু পুলুর উদয়, তার সঙ্গে অপর্ণার বিয়েতে যাত্রা, কিছুটা পুলুর ধমকেই নিরুপায় অপর্ণাকে বিয়ে তারপর অপর্ণার মৃত্যু ও অপু’র হারিয়ে যাওয়া। অবশেষে সেই সুদূর অরণ্যপ্রান্তর থেকে অপর্ণা-শোকে বিধ্বস্ত অপুকে পুলুর ফিরিয়ে আনা। কাজলের সঙ্গে মোলাকাত। বলা যায়, পুলুই এ ছবির গাড়োয়ান। এক অত্যাশ্চর্য মানুষ। সে সময়ে এমন মানুষের দেখাও মিলত আর তাঁদের বেশ কদরও ছিল। তাই, এ ছবি শুধু নিছক এক ট্র্যাজিক গল্প বলে না, সে সময়ের মূল্যবোধকে এনেও হাজির করে। রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে অপু আর পুলুর বাক্যালাপ এ ছবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ দৃশ্য ও অনবদ্য নির্মাণ। গোটা ছবির সঙ্গে এ দৃশ্যের যোগ হয়তো অপু’র সংবেদনশীলতাকে বোঝানোর জন্য। কিন্তু পুলুর মতো কারও উপস্থিতি ছাড়া অপু’র সে আত্মপ্রকাশ আর কোনওভাবেই সম্ভব ছিল না।

 

‘World Wide Will Workers’ (wwww)’এর কর্ণধার জনৈক স্বামীজী ‘নায়ক’ ছবির একদম শেষে গিয়ে মুখ খুললেন। ছবি তখন আগের দৃশ্যেই ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে গেছে। নেশাগ্রস্ত অরিন্দম তাঁর ভালো লাগা অদিতিকে অকপটে যা বলার বলতে চেয়েছেন। পারেননি। অদিতি শুনতে চাননি। পরের দিন সকালে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন যখন দিল্লি স্টেশনে পৌঁছবে, ছবির গতিও স্তিমিত হয়ে এসেছে, ঠিক তখনই আত্মপ্রকাশ তাঁর। তথাকথিত একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা তিনি, নীরব অবলোকনে তাঁর সহযাত্রী প্রীতিশ সরকারের পেশাগত পরিচয় পেয়ে গেছেন, এবার তাঁর কাছে বিজ্ঞাপন বানিয়ে দেবার আর্জি। এ দৃশ্যে মজা আছে, আবার অসহায়তাও। অসহায়তা দু’ পক্ষেরই- একদিকে রাতের সফরে স্ত্রী ও এক শাঁসালো খদ্দেরের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে গিয়ে নাজেহাল বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্তা প্রীতিশবাবু, অন্যদিকে, ধর্মীয় বাবাজীর শখ তাঁদের সংগঠনের ব্র্যান্ড ‘উইল পাওয়ার’ টোটকার বিজ্ঞাপন বানাবার; কিন্তু সে সব যেন ততটা বিজ্ঞাপনের জগতে আদৃত নয়। গোটা ছবিতে স্বামীজীর স্বল্প উপস্থিতি একেবারে নীরব, কিছুটা আলগোছে ও নিভৃতে। হঠাৎ করে ছবির গুমোট ভাবটা কাটাতেই যেন চরিত্রটির বাক্য নিঃসরণ। এক অতুলনীয় দৃশ্যপট। রসিকতার এই মাত্রাযোগটি ট্রেনের গতি ও সময়ের চলার সঙ্গে কী নিবিড় আয়েসে ছন্দোময়। যেন বিধ্বস্ত ‘নায়ক’কে ঘুম থেকে তোলার এক হাল্কা প্রাক-মুহূর্ত।

 

বলাই বাহুল্য, ‘জনঅরণ্য’ ছবিতে বিশুদা ছাড়া ছবিটির গতিমুখই তৈরি হয় না। মুক্তির দশকের রাজনৈতিক আবহে উত্তপ্ত বাংলায় এক মধ্যবিত্ত ঘরের যুবক সোমনাথ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের গোলকধাঁধায় যখন হাতড়ে বেড়াচ্ছে বেঁচে থাকার রসদ, তখন কলকাতার জনপদে কলার খোসায় আছাড় খেয়ে খেলার মাঠের দোসর বিশুদার সঙ্গে তার হঠাৎ দেখা: সোমনাথের সামনে আচম্বিতে জীবনের এক সম্পূর্ণ নতুন পাঠ, কিছুটা দ্বিধাচিত্তে কল্পনাতীত সে জগতে নিঃশব্দ প্রবেশ। তারপর অর্ডার সাপ্লাই, নতুন মানুষজন, অচেনা পরিসর; চাকুরি মানসিকতায় অভ্যস্ত ভেতো বাঙালির ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’তে সুমতি। সে এক বিচিত্র সংঘাত ও দ্বন্দ্বাকীর্ণ আকস্মিক মোড়। কিন্তু বিশুদা তো এলেন, বললেন, চলে গেলেন। হাতে ফোলিও ব্যাগ, আঙুল মুঠোকৃত সিগারেট-পায়ী, ধুতি-পরিহিত রসিক মানুষটি বাঙালের হাইকোর্ট দর্শন সমাপন করে ডালহৌসি পাড়ায় তখন জাঁকিয়ে বসেছেন। তিনিই সোমনাথের পথ-প্রদর্শক। যে সোমনাথ এক কোম্পানির বড় ‘অর্ডার’ পেতে নিজের প্রিয় বন্ধুর বোনের শরীর নিয়ে বেসাতি করতে গোড়ায় দ্বিধান্বিত থাকলেও পরে মনের কালিমা ধুয়ে বাড়ি ফিরে বিভ্রান্ত পিতাকে বলতে কসুর করেনি যে ‘অর্ডার’টা সে পেয়ে গেছে।

 

আর উত্তর কলকাতার বনেদী পরিবারের উড়ুক্কে মানুষ রমেন মল্লিক ছাড়া তো 'চিড়িয়াখানা' ছবিতে একাধারে রহস্যের জট খোলা আর রস আস্বাদন- একই অঙ্গে দুই রূপ- সম্ভবই ছিল না। পয়সার জোর ও দিলদরিয়া মন- রমেন মল্লিকের এই দুই রসায়ন যোগে ছবিটি এগিয়েছে তাঁর কাঁধে চেপেই। সে সময়ের কলকাতার চরিত্র-চিত্রণেও এই মানুষটির উপস্থিতি সার্থক। শুষ্ক সমালোচক ব্যতীত অমন নিপাট চলচ্চিত্র রসিকই বা আজকাল আর তেমন মেলে কোথায়?

এইভাবে সত্যজিতের আরও অজস্র ছোট ছোট চরিত্রগুলিকে সময়ের বিচিত্র-সম্ভারে এনে উপস্থিত করা যায়। এমত প্রান্তিক চরিত্রের সমাগম তাঁর ছবিকে এক কালিক অনন্যতায় পৌঁছে দিয়েছে। তারাই ধরে থাকে ছবির রাশ। ফলে, ছবিগুলি কখনও পুরনো হয় না, মনে হয় না যে তাদের বুঝি আজ কোনও দায় নেই আর। বরং, বলতে ইচ্ছে করে, তাঁর ২০০ বছরেও একই ভাবে সমকালীন থেকে যাবে তাঁর প্রায় সমস্ত ছবি। কারণ, তিনি অমরত্বের যাদু জানতেন- কীভাবে স্বল্প সময়ের নানান চরিত্রগুলির মধ্য দিয়ে ছবিকে নিয়ে যেতে হয় সময়ের কন্দরে, যেখানে অন্তর্লীন থাকে মানুষের সর্বজনীন আশা-আকাঙ্ক্ষা, বোধ ও পরমাত্মা; জানতেন, যে এই অনন্ত ভুবনে সময়ের কোনও পরিমাপ নেই। তাই, তিনি তাঁর ছবির মতোই চিরভাস্বর, চিরন্তন। আলোকবর্তিকা।

     

Wednesday, 28 April 2021

'অন্তরে উপলব্ধ সত্য'

আমার মায়ের শিল্পচর্চা

তন্ময় সাঁতরা


খুব কাছের মানুষ সম্পর্কে লেখা বোধ করি একদমই সহজ কাজ নয়। তবু যে কথা আজ আমার কিঞ্চিৎ বোধগম্য হচ্ছে, সে কথা আমি না বললে আর কে-ই বা বলবে! যাঁর শিল্পচর্চা নিয়ে দু' কথা এখানে লিখতে চলেছি, তিনি কোনও প্রথিতযশা শিল্পী নন। শাস্ত্র ও চিরাগত প্রথা-প্রকরণের সঙ্গে যোগসাজস রাখার বিশেষ প্রয়াস না-করে আপন মনে তিনি আঁকেন। কোনও প্রথাগত শিক্ষা নেই। ‘কাজের চশমা-পরানো দৃষ্টি’ ঝেড়ে ফেলে রেখে ‘অফুরন্ত আনন্দ আর খেলা-দিয়ে-ভরা শিশুকালের দিনরাতগুলো’য় ফিরে যাওয়ার জন্য তিনি আঁকেন। ছিয়াশি বছর বয়স্ক যে মানুষটির অবিচল এই পথচলার কথা এখানে বলার চেষ্টা করছি, তিনি আমার মা। বিদ্যুৎলতা সাঁতরা।

 

ছোটবেলায় দেখতাম, আমাদের লিখবার স্লেটখানা হাতে নিয়ে মা দ্রুত রেখার টানে এঁকে ফেলতেন চঞ্চল কাঠবেড়ালির গাছে ওঠার দৃশ্য। আমি দেখে তাজ্জব বনে যেতাম। মা আঁকবার পদ্ধতি শেখাতেন না। হাজার কাজের ফাঁকে আঁকার ইচ্ছে হল, তাই এঁকে ফেললেন।

 

আপন মনে আঁকার এই অভিরুচি মা কোথা থেকেই বা পেলেন? জানতে ইচ্ছে হয়, কোন শেকড় থেকে উদ্গম হল এই ঘরোয়া ইচ্ছে বা বাসনার। দ্বিধাহীনভাবে বলা যাবে, মা’র এই গুণটি তাঁর বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। আমার দাদু ছিলেন ভারী শৌখিন স্বভাবের এক মানুষ। ঘরদোর, উঠোন, বাগান, তুলসীমঞ্চ— সবখানেই তাঁর সুরুচির ছাপ দেখতে পাওয়া যেত। দাদু নিজে তাঁর মাটির বাড়ির দেওয়ালগুলিকে ছবি এঁকে ভরিয়ে তুলতেন। কোনও এক অজানা রহস্য বা টান তাঁকে সে সব ছবি আঁকায় উদ্বুদ্ধ করত। স্থানীয় গ্রামীণ দোকান থেকে কেনা রং আর নিজের হাতে বানানো তুলি নিয়ে তিনি মেতে উঠতেন তাঁর আঁকাআঁকিতে। শিশুর ধুলোবালি নিয়ে খেলার মতো সেই মেতে ওঠা ছিল নির্মল আনন্দের। সে সব ছবির আঙ্গিক ও ভাষা ছিল সহজ ও অনাড়ম্বর। দাদুর বাড়ির খুব কাছাকাছি ছিল কয়েক-ঘর পটুয়ার বাস। দাদু তাদের শিল্পকর্মের খুব কদর করতেন।

 

এখন আসি আমার মায়ের আঁকাআঁকির কথায়। দেখে নিই কেমন করে মায়ের সেই ‘সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার’ তাঁর প্রত্যহকে অতিক্রম করে যাওয়ার প্রেরণা হয়ে উঠল। তাঁর বাধা-সংঘাতময় পারিবারিক ও ব্যক্তি-জীবনের আবিলতা অবসাদ থেকে মুক্তির উপায় হয়ে উঠল। এই লেখায় তাঁর শিল্পচর্চা সম্পর্কে আমার কিছু দেখা বোঝা ও অনুভব ঘরোয়া কথার ছাঁদে পরিবেশন করার চেষ্টা করব। এখানে তাঁর শিল্পকর্মের মূল্যায়নের পরিবর্তে সামান্য বিশ্লেষণ ও বর্ণনার প্রয়াস থাকবে।

 

বিশ্বশিল্প তো দূরের কথা, এ দেশের তাবড় শিল্পীদের নাম-ধাম তাঁর তেমন জানা নেই। তবু ‘উতলা মনের দৃষ্টি ও সৃষ্টিকে’ বেঁধে রাখার অদম্য ইচ্ছে। কম বয়স থেকে আর পাঁচটি মেয়ের মতো আমার মায়েরও সেলাই উল বোনা আসন বোনা ও গয়না বড়ি দেওয়ায় উৎসাহ ছিল। সংসারের প্রয়োজনে তাঁকে সে সব করতেও হয়েছে প্রচুর। কিন্তু কেবলই পুরনোর পুনরাবৃত্তি না করে নতুন নকশা উদ্ভাবনে তাঁর প্রায়ই আগ্রহ দেখেছি। চটের উপর সুতোর স্টিচে করা আসন, গয়না বড়ি কিংবা নকশি কাঁথার সৃজনে সে ছাপ স্পষ্ট পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে সুতোর ক্রস-স্টিচে করা একটি চটের আসনে বেড়ালের আকার-আকৃতি ও রংয়ের কথা মনে আসে। বেড়ালটির অবয়বে সবল জ্যামিতিক বিভাজন ও পট জুড়ে অভিব্যক্তিময় উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। অনাড়ম্বর কিছু নকশি কাঁথার কথাও মনে আসে। যেমন রৈখিক চলন সমৃদ্ধ গণেশ। দূরত্বের অধ্যাস নেই, ছবিগুলি দ্বিমাত্রিক গুণবিশিষ্ট। 

 

১৯৯০-এ আমার বাবার হঠাৎ প্রয়াণ ঘটল। সংসার টালমাটাল হল। দু’-এক বছর বাদে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে মা চলে এলেন কলকাতায় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থাকতে। আমরা যে-যার মতো বেরিয়ে যেতাম; কিংবা হয়তো ব্যস্ত থাকতাম কোনও কাজে। মা’র হাতে তখন অনেক সময়। অনেক অবসর। আমরা ভাই-বোনেরা মা’র জন্য কখনও কখনও খাতা পেন রং এনে দিতে শুরু করেছিলাম। খাতার সাদা পাতায় মা’র নিয়মিত আঁকিবুকি তখন থেকে শুরু হয়। মাঝে মাঝে কোনও কারণে ছেদ পড়লেও, আবার মা ফিরে যেতেন তাঁর প্রিয় কাজটিতে। কোনও উপর-চাপানো দায় নেই। দর্শকরা পছন্দ করবে কিনা, সেরকম কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। এই সহজ খেলায় মেতে ওঠার এক অনন্য আকর্ষণই হয়তো মায়ের এই শিল্পচর্চার চালিকাশক্তি। সুন্দরের নেশায় এই পথ চলায় জীবনের প্রসারণ ঘটে সন্দেহ নেই। তাছাড়া এতে বোধহয় রয়েছে এক ধরনের ‘হিলিং এফেক্ট’, নিরাময়ের শক্তি। প্রায় একঘেয়ে ‘শুকনো জীবন’ থেকে নিষ্কৃতি। আর ‘রূপের রাজত্বে প্রবেশ’-এর এক অদম্য হাতছানি।

 


বিষয়বস্তু ও অভিব্যক্তির দিক থেকে দেখলে মায়ের আঁকা এই ছবিগুলিতে কয়েকটি বিশেষ ধরন লক্ষ করা যাবে। বাস্তব ঘটনা অনুসারী, কল্পনা-আশ্রিত, কৌতুক বা হেঁয়ালি ও স্থির বস্তু। দেখা যায়, অন্যান্যগুলির তুলনায় স্থির বস্তুর ছবি বা ড্রয়িংগুলি বেশি বাস্তবানুগ। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বস্তুটিকে খুব কাছ থেকে দেখে আঁকা হয়েছে। যেমন, একটি ড্রয়িং-এ দেখি পাশাপাশি রাখা দুটি অবজেক্ট— একটি ফুলদানি, আরেকটি পাত্রে রাখা কিছু ফল। দুটি দু’ ধরনের বস্তুর অনবদ্য সম্মেলন! ওয়াশ বেসিনের ড্রয়িং-টিতে একসঙ্গে অনেকগুলি বস্তুর সমাহার। মানুষ, পশু-পাখির বেলায় কিন্তু ইম্প্রেশান ও ছন্দই প্রধান।

 

মনের স্ফূর্তি আর শুদ্ধসত্ত্ব নান্দনিকতার খোঁজে আমার মায়ের এই অভিযাত্রার প্রেক্ষাপটে কোনও অ্যাকাডেমিক শিক্ষার আঁচ নেই। তবে ছোটবেলায় দেখা পটের ছবির সহজ ভাষা বোধকরি তাঁর মনকে আকর্ষণ করত। সেই টান এবং মুগ্ধতা আজীবন তাঁর জীবনযাপনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী হয়ে রইল। যেখানে অনুশীলনের চেয়ে অন্তরের বেগকে বাহ্যিক রূপের আশ্রয়ে মূর্তিমান করার নেশাই প্রধান। সেই রূপাঙ্কনের পথ-পরিক্রমায় স্বশিক্ষার ছাপ খুবই স্পষ্ট। সেই পথে ‘অন্তরে উপলব্ধ সত্য’ ছাড়া আর কোনও দায় নেই। কেবল যে প্রিয় কাজটির মাঝখানে তাঁর চিত্ত হারিয়ে যায় তাকে প্রাণপণে ভালবাসাই সারকথা।

 

Monday, 26 April 2021

বিজেপি'র মগজ ধোলাই

শেখানো হচ্ছে দুই আর দুইয়ে পাঁচ

শোভনলাল চক্রবর্তী


দুই আর দুইয়ে যে চার হয়, সে আমরা সকলেই জানি। তাহলে দুই আর দুইয়ে পাঁচের প্রশ্ন উঠছে কোথা থেকে? দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর বুকে যেখানে যখনই একনায়কতন্ত্র জেগে উঠেছে, তারা মানুষকে এই উল্টো হিসাব শিখিয়েছে। এবং ইতিহাস সাক্ষী, মানুষ তা বিশ্বাস করেছে এবং অনেক পরে নিজেদের ভুল যখন বুঝতে পেরেছে তখন তারা সব হারিয়ে খাদের কিনারে। 

মার্টিন হুইটক তাঁর বিখ্যাত 'এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ দ্য থার্ড রাইখ' গ্রন্থে সর্বপ্রথম বর্ণনা করেছিলেন কীভাবে মানুষকে ক্রমাগত দুটি বিপরীতধর্মী বক্তব্যে ডুবিয়ে রাখতে পারলে তাদের দিয়ে যা খুশি তাই বিশ্বাস করানো যায়। যেমন, হিটলার বলতেন যে তিনি পুঁজিবাদ এবং মার্কসবাদ দুটিকেই সমান ঘৃণা করেন। অথচ এই দুটি মতবাদ একেবারে বিপরীতধর্মী। মানুষকে বোঝানো হয়েছিল যে ইহুদীরাই বিশ্বের পুঁজিবাদকে চালনা করছে, অন্যদিকে স্বয়ং মার্কস ছিলেন ইহুদী এবং ইহুদীরাই জার্মান জাতীয়তাবাদের মূল শত্রু। অতএব, দুটি বিপরীত মেরুর ধারণাকে স্রেফ ইহুদী বিদ্বেষ দিয়ে যুক্ত করে দেওয়া গেল এবং মানুষ এই ইহুদী ষড়যন্ত্র মেনে নিল। 

এই যে মানুষকে দিয়ে মানিয়ে নেওয়া, এই সর্বাধিপত্যকামী একনায়কতন্ত্রের অস্ত্রের নাম জার্মান ভাষায় 'স্বওই ট্রাই' যার বাংলা করলে হয় 'দ্বিভাগ বিশিষ্ট ভাবনা' বা ইংরেজিতে 'ডবল থিংক'। হিটলার যেটা সর্বদাই করতেন- একই সঙ্গে জানা এবং না-জানা, একই সঙ্গে সত্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন থেকেও মিথ্যার জাল বোনা, পরস্পর বিরোধী কথাকে একই সঙ্গে উচ্চারণ করে চলা এটা জেনেও যে কথা দুটি পরস্পর বিরোধী এবং একই সঙ্গে দুটো কথাতেই বিশ্বাস করে চলা। নৈতিকতার দাবি করা, অথচ কাজে নৈতিকতাকে পায়ের নিচে পিষে ফেলা, একই সঙ্গে মনে করা যে গণতন্ত্র অসম্ভব এবং এই শাসকেরাই গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী। প্রয়োজন অনুসারে কোনও কথা ভুলে যাওয়া এবং প্রয়োজন পড়লে ফের তাকে স্মরণে নিয়ে আসা। সোজা কথায়, একনায়কের মনমতো একটি 'বাস্তব' নির্মাণ করে চলা। 

উপরের প্রতিটি বাক্য যে আমাদের আজকের ফ্যাসিস্ট হিন্দুত্ববাদীরাও অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে তা একটু চোখ, কান খোলা রাখলেই বোঝা যাবে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে ধর্মীয় মেরুকরণের উদ্দেশ্যে বিজেপি'র আইটি সেল সোশ্যাল মিডিয়া ছেয়ে দিয়েছে একটি তথ্য দিয়ে। তা এই, মুসলমানদের মধ্যে জন্মের হার এতটাই বেশি যে বছর তিরিশের মধ্যে ভারতের কোনও রাজ্যে আর কোনও হিন্দু মুখ্যমন্ত্রী পাওয়া যাবে না। বহু শিক্ষিত মানুষ এই মেসেজটি শেয়ার করছেন, অথচ কেউ একবার হিসেব করে দেখছেন না যে বর্তমান জন্মের হারে ভারতের মুসলিম জনসংখ্যা হিন্দুদের সমান হতে কম করে ২২০ বছর লাগবে। সেটাও বাস্তবে সম্ভব নয়, কারণ ভারতে হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই জনসংখ্যার হার ক্রমশ নিম্নগামী। এই বাস্তব পরিস্থিতি গুলিয়ে দেওয়াই দ্বিভাগ বিশিষ্ট ভাবনার প্রধান কাজ। এর জন্য দুটো জিনিস দরকার: 

প্রথমত, একটা জোরালো শত্রুপক্ষ; হিটলারের ছিল ইহুদীরা, আজকের হিন্দুত্ববাদীদের রয়েছে মুসলমানরা। 

দ্বিতীয়ত, মানুষের মনে একটা ভয় জাগিয়ে রাখা, শত্রুপক্ষ যে কোনওদিন তোমার দখল নিতে চলেছে। হিন্দুত্ববাদীরা তাই সকাল সন্ধ্যা আউরে চলেছে 'হিন্দু খতরে মে হ্যায়'। এই ভয় থেকে জন্মায় 'ফুয়েরার' বা নেতার প্রতি অগাধ আস্থা, যে ইনিই পারবেন আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করতে। নেতা তখন হয়ে ওঠেন বাঁশিওয়ালা, তার পেছনে পেছনে ছোটেন জনগণ, সেই জনগণ তখন সম্মোহিত। 

তাই প্রধানমন্ত্রী হুকুম করলে সেই সম্মোহিত জনগণ নির্দিষ্ট সময়ে বারান্দায় সমবেত হয়ে থালা পেটাতেও রাজী। চার ঘন্টার নোটিসে নোট বাতিল করে দিলে, ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন চুপ করে ব্যাংকের লাইনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সিয়াচেনের সৈন্য ভাবে সেই জনতা। রান্নার গ্যাসের দাম আগুন হলেও তারা নির্বিকার। এসবই কি অকারণে? একেবারেই নয়। সর্বাধিপত্যকামী রাজনীতি তাদের বুঝিয়েছে যে 'ফুয়েরার' নরেন্দ্র মোদির অনেক বড় কিছুর পরিকল্পনার তারা ভাগীদার হতে চলেছে, তাই এই সামান্য বলিদান স্বীকার করা। মানুষকে এই কথাটা বোঝনো যে, এই কাজের সাফল্যই দ্বিভাগ বিশিষ্ট চিন্তার অস্ত্র প্রয়োগের ফলে। মানুষের ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাই এই হাতিয়ারের প্রধান উদ্দেশ্য। 

এই আধিপত্যের সুবিধা অনেক। এখানে নেতা জনগণের চোখে আঙুল দিয়ে চিনিয়ে দেন কাদের থেকে সাবধান থাকতে হবে। দাড়ি, টুপিওয়ালা, লুঙ্গিপরা 'ওদের' থেকে, সরকারি বিলের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা 'আন্দোলনজীবীদের' থেকে, আর যারা নেতার কাজের সমালোচনা করেন সেই 'দেশদ্রোহীদের' থেকে, 'গণশত্রুদের' থেকে। এই চিনিয়ে দেওয়া আর চিনে নেওয়ার কাজে জনগণকে ব্যস্ত রাখতে পারলে সুবিধা এই যে, পেছনের দরজা দিয়ে 'নিজেদের লোকেদের' পাইয়ে দেওয়ার কাজটা সহজ হয়ে যায়, ওই লোকগুলোই তখন বাজারের মালিক। তখন প্রধানমন্ত্রী বলতেই পারেন যে ব্যবসা করা সরকারের কাজ নয় তাই রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলো বেচে দেওয়া খুব জরুরি। প্রধানমন্ত্রী যেটা জানেন কিন্তু বললেন না সেটা হল এই যে, রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলো ব্যবসা করে লাভের মুখ দেখবে বলে তৈরি করা হয়নি। হয়েছিল জনসেবা করার জন্য। ভারতীয় রেলের উদ্দেশ্য ছিল বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান করে, রেলপথে সাধারণ মানুষের যাতায়াত সুলভ করা। বিএসএনএল'এর উদ্দেশ্য ছিল যত বেশি সম্ভব মানুষের কাছে টেলিফোন পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া, কোনও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে মুনাফার লড়াইয়ে নামা নয়। এই কথাগুলো সুবিধা মতো ভুলে গেলে এবং জনগণকে ভুলিয়ে দিতে পারলে এই সংস্থাগুলোকে 'নিজেদের লোকেদের' কাছে বেচে দিতে আর কোনও নৈতিক আপত্তি থাকে না। 

ঠিক যেমন হরিদ্বারের কুম্ভ মেলা। মেলাকে চালু করে হাজার হাজার মানুষকে সংক্রমিত করে অবশেষে মেলা বন্ধ হল প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে। গত বছর দিল্লির নিজামুদ্দিনে মুসলমানদের একটি সভা ঘিরে করোনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হয়েছিল। বিজেপি'র আইটি সেল তাকে মুসলমানদের ভারতে করোনা জেহাদের পরিকল্পনা বলে বর্ণনা করে। কুম্ভ মেলায় যা হল সেটা তবে কী? নাকি নরেন্দ্র মোদির ভারতে করোনারও হিন্দু-মুসলমান বিভাজন আছে? প্রশ্নটা অমূলক নয়, কারণ, উত্তরপ্রদেশের মন্ত্রী করোনা পজিটিভ হওয়া সত্ত্বেও হাজির হয়েছিলেন হরিদ্বারে, তিনি মনে করেন যে মা গঙ্গা ভারতের হিন্দুদের করোনা মুক্ত করবেন। এই বক্তব্য যখন তিনি রাখছেন তখন চারপাশ থেকে উঠছে বিপুল জয়ধ্বনি। তাঁদের জয়ধ্বনি, যারা বিশ্বাস করেন ওই মন্ত্রীর কথায়। নাগরিকের সর্বনাশ হোক কিন্তু ভোটের স্বার্থ অনেক বেশি। ওই মন্ত্রীর চোখে এখন শুধুই উত্তরপ্রদেশের ভোট। কোনও কুম্ভস্নান কি ওই মন্ত্রীর পাপ মুছে দিতে পারবে? জানা নেই। 

নাগরিকের সর্বনাশ করে ভোট আমাদের রাজ্যেও হচ্ছে। শেষ দু' তিনটি দফার নির্বাচন একসঙ্গে করানোর অনুরোধ বিফলে গেছে। মোদি-শাহ'রা রাজি নন, থুড়ি, ইলেকশন কমিশন রাজি নয়। কেন গররাজি? কারণ, হিন্দুত্ববাদী একনায়কতন্ত্রকে ভারতে যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোর ওপরে শেষ আঘাত হানা থেকে ঠেকিয়ে রেখেছে যে তিনটি রাজ্য তারা হল পাঞ্জাব, কেরল ও পশ্চিমবঙ্গ। তাই যেন তেন প্রকারেণ পশ্চিমবঙ্গ চাই, নইলে দুই আর দুই পাঁচের অঙ্ক শিখবে কে?


Sunday, 25 April 2021

বাঙালির অধুনা যাপন

এখন জীবন বেঁধেই চরিতার্থ

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত


 

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে পেয়ে বাংলার সংস্কৃতির ওপর কিছু রাজনৈতিক দল যেন নামিয়ে এনেছে এক বিধ্বংসী আক্রমণ। অথচ আমরা চিরকাল বলে এসেছি যে আমাদের সংস্কৃতি আমাদের গর্ব, যা আমরা হারাতে চাই না; শুনে এসেছি, শহর মুম্বই যদি বাণিজ্য-রাজধানী তো আমাদের এই কলকাতা নিশ্চিত ভাবে দেশের সংস্কৃতি-রাজধানী। শুনেছি, একজন প্রধানমন্ত্রী নাকি তা স্বীকারও করেছেন এবং এও বলেছেন– কলকাতা মিছিল নগরী। তাতেও আপত্তির কিছু পাইনি। কেবল মাথায় রেখেছি যে কেবল কলকাতা নয় সারা বাংলাই তার সংস্কৃতির জন্য গর্ববোধ করে। সত্যি তো, আমরা বাঙালিরা মিছিলে, আন্দোলনে, বিক্ষোভে আছি এবং থাকতে ভালবাসি। কেউ কখনও বলেছেন: What Bengal Thinks Today... গর্বে আমাদের বুক ফুলেছে। পেটও। তাই সব্বাইকে ডেকে ডেকে প্রায়ই সে কথা কানে কানে আর প্রাণে প্রাণে বলেছি। এই সেই বাংলা– আমরা এখানে সন্ত্রাস দেখেছি, গান্ধিবাদী অহিংস আন্দোলন দেখেছি, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, দেখেছি উদ্বাস্তু স্রোত, দেখেছি ‘গ্রেট কলকাতা কিলিং’, আমফান বা সুনামির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু সংস্কৃতি? তাকে ম্লান হতে দিইনি, ‘সংস্কৃতি আমার’ উচ্চে তুলে নেচেছি কত, কতজনকে নাচিয়েছি। সাম্প্রদায়িকতা নেই, এই রাজ্যে সকলে স্বাগত, উত্তরপ্রদেশ থেকে ভিয়েতনাম হোক বা ওয়াশিংটন বা তিয়েন-আন-মিয়েন– যেখানে দেখেছি মানবতার ওপর কোনও আক্রমণ আমরা প্রতিবাদ করেছি। আমাদের কী হল যে আজ সংস্কৃতি, অন্তত আমাদের বোধে, এমন বিপন্ন?

আমার স্থির বিশ্বাস, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছাড়া প্রলয়ঙ্করী কিছুই হঠাৎ হয় না। এই বিপন্নতারও শুরু আছে, কারণ আছে। সে সব কথা অল্প হলেও স্মরণ করি পরে। আগে দেখে নিই, নিজেদের এমন বিপর্যস্ত মনে হচ্ছে কেন? আলোচনা যখন সংস্কৃতির ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে তখন তার নানা দিক বিবেচনা করা ভালো। এমন কিছু দিক বেছে আমাদের আলোচনা শুরু করা যাক।  

১) ভাষা সংস্কৃতি

ঢাকায় ওপার বাংলার বরকতরা প্রমাণ রাখলেন বাংলা ভাষার প্রতি তাদের আন্তরিক ভালবাসা– গুণ্ডা আয়ুবী সেনার গুলিতে তাঁরা প্রাণ দিয়ে শহীদ হলেন। সেই শেষ নয়, অসমের শিলচরে (বরাক উপত্যকা) ১৯৬১ সালের ১৯ মে বাংলা ভাষার ন্যায্য মর্যাদা চাইতে গিয়ে প্রাণ দিলেন আরও ১১ জন। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে পুষ্পস্তবক পাঠিয়েছিলেন উল্লাসকর দত্ত আর আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসীরা ক্ষোভে-দুঃখে মিছিল করেছি, সভা করেছি।

ওরা অসমে, ওপার বাংলায় দাবি আদায় করেছেন। ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস রূপে পালিত হয় দেশে দেশে। অসম সরকার বাংলা ভাষার দাবি মেনে নেয় সেই আন্দোলনের পর। আমরা উল্লাসে ভেসেছি। আন্তর্জাতিক গেয়েছি, ভুলেছি দেশভাগের জ্বালা। অথচ আমরাই এই রাজ্যে তার সংস্কৃতির ওপর ভিন রাজ্যের খবরদারিও মেনেছি। দোকানে-বাজারে-রাস্তায় স্বেচ্ছায় হিন্দি বা ইংরেজির আধিপত্য মেনেছি, আধিপত্য মেনেছি প্রশাসনে, শিক্ষায়, পরিবহনে। বদল ঘটিয়েছি সাহিত্যের ভাষায়। উত্তর কলকাতার নানা ঐতিহ্য হারিয়েছি দিনে দিনে।

মনে পড়ে বিধান রায় এক নির্বাচনের প্রাক্কালে কর্মীসভা করতে চেয়েছিলেন সেদিনের সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজে। মুসলমান অধ্যক্ষ তাঁর সে প্রস্তাব খারিজ করে দেন। এখন এমন সমস্যা দেখা দিলে ডাক পড়ে নির্বাচন কমিশনের।

এই সেদিনও সবাই ভয় পেতেন এই কমিশনকে ও এমনকি তার সম্ভাব্য নিষেধাবলীকেও। কোথায় কী? কে বলছে কন্ডোম বিক্রির কথা (এমন অসভ্য কথা প্রথম শুনছি এমন নয়, এক নেতা বলেছিলেন ‘গুলিতে কি নিরোধ লাগানো থাকে'। বলেছিলেন এবং তারপরও তিনি দীর্ঘকাল নির্বাচকমণ্ডলীর নয়নের মণি হয়ে থাকতে পেরেছেন। যিনি ‘কন্ডোম’ প্রসঙ্গ তুলেছেন তিনি আর তেমন কী দোষ করলেন? তবে, মহিলাদের মুখে এই প্রসঙ্গে কিছু শোনায় আমরা আজও তেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না, এই যা। তবে এ নিশ্চয় আমাদেরই দোষ!), ‘সুনার বঙ্গাল’ গড়তে চাওয়া প্রধানমন্ত্রী বলছেন পঁদে ছাপ দিন, কে বলছে খেলা হবে, কে পা দেখাচ্ছেন, হোঁদলকুতকুত বলছেন, কে কোন মহিলাকে বারমুডা পড়ার পরামর্শ দিচ্ছেন– নির্বাচন কমিশন দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না– সে যেন এক অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, সঞ্জয়ের ভাষ্য না শুনলে তার চলবে না। আমাদের সংস্কৃতিতে এসব ছিল কী? রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে?   

২) প্রশাসনের সংস্কৃতি

একটা সময় ছিল, এই তো সেদিন, যখন দেশের প্রশাসন ছিল সংবিধানের এক প্রধান স্তম্ভ, তাকে বলা হত ‘Steel Frame’।  এখন সংবিধানই তার মর্যাদা হারাচ্ছে শাসক দলের প্রতাপে, কোথায় বা সেই ‘স্টিল ফ্রেম’? এখন সর্বত্র প্লাস্টিক। বিয়েবাড়িতে দেখেন না? ‘সে সব দিন দিনে দিনে হারিয়ে কোথায় গেল কে জানে’– এখন কিছু মূর্খ সবজান্তা ভাব করে চেয়ারে বসে থাকে, ছড়ি ঘোরায় আর নিজ স্বার্থ সুরক্ষিত হওয়ার অঙ্ক কষে। তারা প্রশাসক। এরা না জানে বিষয়, না ভাষা। সংবিধানের মূল সুর এরা গ্রাহ্য করে না। নির্লজ্জ চাটুকারিতা প্রকাশে তারা প্রধানমন্ত্রী থেকে রাজ্যের কোনও ছোট মন্ত্রী চাইলে তার জন্য নিজ আসন ছেড়ে উঠে পড়ে, সৌজন্য দেখানোর নামে তারা নেতাদের আলোকবৃত্তে ঘুরঘুর করে আর অন্যদিকে গরিব, শ্রমিক-কৃষকদের দূর-দূর করে তাড়ায়। নিজেদের মধ্যেও রেখেছে জাতপাতের বেড়া। 

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে যে ভাষায় বা ভঙ্গিতে তাদের সঙ্গে কথা বলেন তাতে তারা লজ্জা পায় না। যেমন লজ্জা পায় না তারা তাদের বাংলা ভাষার জ্ঞান নিয়ে। তারা পঁদ আর পদ্মের তফাত বোঝে না, বুঝতে চায় না। কমিশন এই সব প্রশাসকের অজ্ঞতার আড়ালে প্রয়োজন মতো মুখ ডোবায়। 

যেদিন রঞ্জন গগৈ মহাশয় বসলেন প্রধান বিচারপতি পদে, সেদিন থেকে অন্তত আর এক সাংবিধানিক স্তম্ভ ভেঙ্গে পড়ল। দেশ বিক্রি হয়ে যায়, গণতন্ত্র হার মানে স্বৈরতন্ত্রের দাপটে, বিচারব্যবস্থা দেখে শুধু দেখে। দেখে প্রধান কর্তার মুখ– তিনি যেমন নড়াচড়া করতে বলেন বিচারব্যবস্থা তেমন নড়েচড়ে, সেদিকে হেলে।   

৩) রাজনৈতিক সৌজন্য ও রাজনীতির সংস্কৃতি

গণতন্ত্রের অনেক সুবিধা যেমন আছে তেমন অসুবিধাও আছে কিছু। মুখ্যমন্ত্রী যখন বিমানবাবুদের নিজ দফতরে ডেকে ‘কাটলেট’ খাওয়ান তখন তা নিশ্চয় রাজনৈতিক সৌজন্য বা তিনি যখন অসুস্থ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর বাসায় যান তা নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করি কেন? আমরা কি রাজনৈতিক সৌজন্য ভুলতে বসেছি? নিশ্চয় তাই এবং তা নির্বাচনের আগেই।

একবার মুখ্যমন্ত্রীর খাস কামরায় বসে কথা বলছি। মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র তাঁকে প্রশ্ন করলেন, মেট্রো চ্যানেলে সভা করা নিষিদ্ধ করলেন কেন? সেই  মেট্রো চ্যানেল যেখানে আমরা ‘সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম’ পর্বে এবং তার আগেও অনেক সভা করেছি। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, গান্ধিমূর্তির তলায় সভা করুন না। সুজাত বললেন, ওখানে তো আমি বললে কেবল আপনি যেতে পারেন শ্রোতা হতে, আর তো কেউ যাবে না। আলোচনা ঠাট্টা-ইয়ার্কিতে ফুরলো। কিন্তু অনুচ্চারিত সেই রাজনৈতিক সৌজন্যর প্রশ্ন  থেকেই গেল। এখন আর মেট্রো চ্যানেলে পথসভা থেকে বিতর্কসভা কিছুই হয় না। ৭ জুলাই অবশ্য নিয়মের বাইরে ছিল চিরকাল এবং তা থাকবে, রাজনৈতিক সৌজন্যর প্রশ্ন ভুলে। যখন বিজেপি রাজ্য সভাপতিও বলেন, আরও শীতলকুচি হবে তখন আসলে যে সংকুচিত হয় রাজনীতির সংস্কৃতি এ কথা বোঝায় কে?     

৪) সংবাদমাধ্যমের সংস্কৃতি

অসভ্যতা বা অসংস্কৃত আচরণে সকলকে ছাড়িয়ে গেছে সাংবাদিককুল তথা সর্বপ্রকার সংবাদমাধ্যম। মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করে চারটি যুবক– যেন এমন উদ্ধত কথা শুনেছি যৌবনে আর প্রৌঢ়ত্বে এসে দেখি রাজ্য শাসন করে চার সাংবাদিক! তাঁরা তখন অনায়াসে ঢুকে পড়েন মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে, তাঁদের কেউ চিটফান্ড কেলেঙ্কারির নায়ক, কেউ বা দলবদলু বলে খ্যাত আজ। সে সব থাক, কিন্তু সততা? এই রাজ্যরই একজন ছিলেন বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়। আমরা পেয়েছি গৌরকিশোর ঘোষ, বরুণ সেনগুপ্তদের। তাঁদের ফেলে যাওয়া স্থান এখন দখল করেছেন এমন কিছু লোকজন যারা সততা, নীতি, নিষ্ঠা, একাগ্রতার মূল্য বোঝেন না। কিন্তু তাঁদের পোশাকের মতোই আধুনিক তাদের কথা বলা বা লেখার ভঙ্গি। তাঁরা জল মিশিয়ে মিশিয়ে বাংলা ভাসাতে চান যেন। মালিক যা চান, যেমন চান, তেমনটি পরিবেশনের দায় কাঁধে তুলে নেন এই নব্য সাংবাদিককুল। প্রয়োজনে সংবাদ বিকৃত করেন তাঁরা (একই খবর পাঁচটা কাগজে পাঁচ রকম), অথবা ছাপা বা দেখানোর  চেয়ে চেপে যাওয়ার কৌশলে ব্যস্ত থাকেন বেশি, সংবাদের চেয়ে বড় জায়গা ছেড়ে দেন ভাষ্যের জন্য (নিউজের চেয়ে ভিয়্যুজ বেশি!)। তাতে কী?  আমরা তাঁদের গেলানো বা খাওয়ানো গপ্পো নিয়ে তক্কো জুড়ি অফিসে আদালতে রেস্তোরাঁয় ক্লাবে (রক তো আর নেই!)। 

৫) অর্থনীতির সংস্কৃতি

কিছু শিল্পে বাংলা দেশের অন্য প্রান্তের তুলনায় এগিয়ে ছিল। তার ঐতিহাসিক কারণগুলি আমরা এই আলোচনায় রাখতে পারছি না। কিন্তু এও তো সত্য যে, এই শিল্পগুলি গড়ে ওঠে যে সব অঞ্চলে সেখানে ভিন রাজ্যের বাসিন্দাদের আনাগোনা বেশি এবং তার প্রভাব পড়েছে সেখানকার ভাষা ও সংস্কৃতিতে। সে শিল্পগুলি অনেকাংশে ধুঁকলেও সংস্কৃতিতে তার প্রভাব মুছে যায়নি, তা যাবার নয়। বিশ শতকের শেষাংশে হাজির হয় বাজার অর্থনীতি। তার প্রভাব পড়ে সাংঘাতিক এবং তা অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে। লোভের ফাঁদ পাতা হয় বিশ্ব জুড়ে, এ কালের শহুরে যুবক-যুবতীরা অনলাইন বা শপিং মলে কেনাকাটা করে আবার তারাই আদানি-আম্বানির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখায়! তারা বিশ্বাস করে জিডিপি কমা বাড়ায়। তাদের বিশ্বাস করানো হয় কর্মসংস্কৃতির নামে। বাজার নিজেই যেন বিশ্বাস করে যে জিডিপি দিয়ে মাপা যায়! তাই বাজারে হিসেবে অন্য পাঁচটা মাপযোগ্য রাশির মতোই সংস্কৃতিও এক মাপযোগ্য রাশি মাত্র! হায় জিডিপি! হায় সংস্কৃতি!

জিডিপি দিয়ে মাপা যায় না সুখ, শান্তি, অসাম্য। এসব নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই এখানে তাই ছেড়ে যেতে হয়, মানতে হয় জিডিপি দিয়ে দেশের ভালোমন্দ বিচার; ছেড়ে যেতে হয় ক্ষুধা, অশিক্ষা ও দারিদ্র চেপে, ভুলে যেতে হয় গান্ধি-রবীন্দ্রনাথের গ্রাম পুনর্গঠন বা গ্রামীণ অর্থনীতির  কথা।

৬) শিক্ষা ও সংস্কৃতি

আইআইএম ও আইএসআই কৃত সমীক্ষায় স্পষ্ট হয় (বিশ শতকের শেষ দশকের আগেই), যে এই রাজ্যের অভিভাবকরা চান তাঁদের সন্তানরা শিক্ষান্তে নিযুক্ত হন  হোয়াইট কলার বৃত্তিতে বা উন্নীত হোন ‘বাবু’ শ্রেণিতে। সে সময় সরকার বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি এই তথ্যে, উল্টে তারা বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আর ইংরেজি শিক্ষা প্রসারে মন দিয়ে সমস্যা চাপা দিতে ব্যস্ত হয়েছে। এই উল্টোপথে হাঁটা বা বাস্তবকে অস্বীকার করে এগোনোর যে চেষ্টা, তার ফল ভালো হয়নি। ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর তা চরম আঘাত হেনেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রেও কী তার প্রভাব ইতিবাচক হয়েছে? তা হয়নি। স্বাধীনতার সময় সাক্ষরতায় যে রাজ্য দেশের চতুর্থ রাজ্য বলে স্বীকৃত ছিল তা শতক শেষে ১৮-২০ নম্বরে নেমে যায়। তারপর আরও আরও নীচে। একটা কারণ নিশ্চয় এই যে, অন্য বহু রাজ্য দ্রুত লয়ে এগিয়েছে, আমরা এগোলেও সেই লয়ে চলতে পারিনি। কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ ছিল না। আমরা আধুনিকতা আর ইংরেজি শিক্ষাকে সমার্থক ধরেছি, শিক্ষা বাণিজ্যকীকরণ বা বেসরকারিকরণে আমাদের দ্বিধা ছিল স্পষ্ট। এখানে আর কিছু বলার লোভ সংবরণ করতেই হচ্ছে।

অন্যদিকে, সদ্য পেরিয়ে আসা শৈশব বা সদ্যপ্রাপ্ত যৌবনে ছেলেমেয়েদের বিশেষত ছেলেদের অশ্লীল শব্দের প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণ রোধে সমাজও তেমন জোর দেয়নি। সমাজ ও সাহিত্যের ভাষাতে তা স্পষ্ট হয়। বঙ্কিম বাংলার সেরা ঔপন্যাসিক। তিনি লিখতেন মাগী, এ কালের সমাজ ও তার অনুসারী সাহিত্য শব্দটি বাতিল করে। একটা গল্প বলি। 

এক ভদ্রলোক তার প্রিয় বন্ধুকে বললেন, কেমন আছে আপনার মেয়েছেলেরা? বিষণ্ণ বদনে তিনি বললেন, যেমন আছে আপনার বাগানবাড়ি। মারামারি লাগেনি যে তা দুজনেরই কপাল ভালো বলে বোধহয়। ভুল বোঝাবুঝির অবসান হলে বোঝা যায়, একজন জানতে চেয়েছেন কেমন আছে আপনার ছেলে মেয়েরা? প্রশ্নকর্তা যিনি তাঁর বাগানও আছে, বাড়িও। কিন্তু তাঁর নেই কোনও বাগানবাড়ি! তাঁর রাগ হবে না? হয়েছে এবং তাঁদের বন্ধু বিচ্ছেদ কেউ ঠেকাতে পারেননি। 

মেয়েছেলে, মেয়ে মানুষ শব্দগুলিও বাতিল হয়েছে শহরাঞ্চলে আর শহুর সভ্যতার অনুসারী সাহিত্যেও। আরও কিছ শব্দ বাতিল হয়েছে যথা, ঝি, চাকর ইত্যাদি সমাজে এবং সাহিত্যেও (রবীন্দ্রনাথ পূজ্য হওয়া সত্ত্বেও)। আমরা কী তাতে আরও সভ্য হয়েছি? না, আরও দীন হয়েছে আমাদের সংস্কৃতি?

৭) স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির সংস্কৃতি

একদা এই রাজ্যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হত। বিশ শতকে সেই সব নিয়ন্ত্রণ বিসর্জন দিয়ে সরকার নিজের অক্ষমতা ঢাকতে তাদের সমাদরে বুকে টেনে নিল। তারা তো সেবা করতেই চায়, সেবার জন্য অর্থ আনে দেশ-বিদেশ থেকে। বহু বেকার যুবক-যুবতী চুক্তিতে সেবা করে, অর্থও জোটে। কিন্তু সবটাই যেন শর্তসাপেক্ষে, চুক্তিতে। চুক্তিতে সেবা! শিক্ষিত, পরিশীলিত বামপন্থায় বিশ্বাসী এক সরকারও বাজারের নিয়ম মেনে চুক্তিতে সেবাকর্মে নিয়োগ শুরু করে। অসংগঠিত ক্ষেত্র বাড়তে বাড়তে তা সংগঠিত ক্ষেত্রগুলিও দখল করতে থাকে। কত চাকরি! সরকারের নাম হয়, প্রভাব বাড়ে। প্রভাব বাড়ে কারণ তাদের নিয়োগ যে চুক্তিতে! ট্যাঁফোঁ করলেই চাকরি নট। এভাবে আনুগত্য কেনা হয়। মেরুদণ্ড কেড়ে নেওয়া হয়। এমনটা ছিল নাকি আমাদের সংস্কৃতিতে?    

ভয়ংকর হয়ে উঠেছে আমাদের এপার বাংলার বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। এরা আর পথ দেখায় না, পথ চুরি করে যেন। করে নিজের জন্য। এই তো সেদিন যে দলীয় শৃঙ্খলা বা আনুগত্যের অজুহাতে ধর্ষণ বা খুনের সাফাই গেয়েছে, যাত্রাপাড়া থেকে সিনেমাপাড়ায় নেচেগেয়ে পয়সা তুলেছে, তাদেরই কেউ কেউ এখন ছবি বিক্রির এজেন্সি (ছবি আসল না নকল কে জানে? যে জানে সে এমন ব্যবসাতেই থাকে না) ব্যবসা বা আরও কাজ পাবার লোভে কর্তাদের খোশামোদ করছে। কে পুরস্কার পেতে ঘুষ দিচ্ছে, পদ আঁকড়ে থাকতে শাসকের গুণকীর্তন করছে। কে চেয়ার পেতে চেয়ার মুছছে, কে গান গেয়ে বাগিয়ে নিচ্ছে মন্ত্রীপদ (দলিত বা নিচু জাতের বিরোধী হয়েও), কে সেবা করার অজুহাতে দল বদলে ফেলছে। আসলে যে দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে মানুষের, তারা সে খবর রাখে না। মানুষের খবরই তারা রাখে না। 

পিকে ব্যানার্জি নাকি গ্যাস খাইয়ে এশিয়াডে ভালো ফল চাইতেন। ফুটবলাররা বারবার গ্যাস খেতে চায়নি, চায় না। কিন্তু আমরা চাই। সুনার বঙ্গালের লোভ দেখাতেই ছুট লাগাই অলীক সোনার হরিণের পেছনে। 

আমরা জাতপাত, ধর্ম বিচার মানি না। কিন্তু ... 

আমরা গণতন্ত্র ভালবাসি, আস্থা রাখি সংবিধানে। কিন্তু ...

আমরা কানাইলাল, ক্ষুদিরামের ভক্ত, তবু আমরা অশান্তি চাই না। কিন্তু ...

আমরা বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ'র মাটির লোক। কিন্তু ...

এমন ছিল না চিরদিন। আমরা কালোকে কালো বা সাদাকে সাদা বলতে জানতাম। তাই তো কেউ বাংলার প্রশংসা করলেই আমরা খুশি হয়ে তার কাঁধে চেপে বসতাম না। সেটাই ছিল আমাদের সংস্কৃতি। সে সব দিন দিনে দিনে হারিয়ে কোথায় গেল কে জানে? ... 

এখন জীবন বেঁধেই চরিতার্থ।


Saturday, 24 April 2021

শকুনদের দু' কান থাকে না

ওরা আসছে ভাগাড় বানাতে

আশিস দত্ত


ছবিটার কথা মনে পড়ে? ছবিটার নাম ছিল: The Vulture and the Little Girl। বহু বছর পর ছবিটা দেখতে পেলাম সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রথমবার যেমন ধাক্কা খেয়েছিলাম এবারও তেমনই হল, তবে অন্য অনুষঙ্গে। 

ছবিটিতে একটি শকুন খিদেয় মরণাপন্ন একটি ছোট্ট হাড় জিরজিরে বাচ্চা মেয়ের মরণের অপেক্ষা করছে। প্রাণবায়ু নির্গত হলেই শকুনটা উড়ে এসে খুবলে খাবে দুর্ভিক্ষ-পীড়িত বালিকাটির দেহ। আকাশ থেকে তার তীক্ষ্ণ চোখ পর্যবেক্ষণে রেখেছিল মেয়েটিকে। কাছেই মাত্র মাইল খানেক দূরে ইউনেস্কো বুভুক্ষু মানুষদের জন্য লঙ্গরখানা খুলেছিল। সেই লক্ষ্যেই অশক্ত শরীরে গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছিল বালিকা। কিন্তু শরীর আর দেয় না। বসে পড়ে সে। হয়তো আশা ছিল কেউ যদি আসে, একটু সাহায্য করে তাকে। এইটুকু পথ যদি পার করে দেয়! এই তো সুযোগ। শকুন আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসে। দূর থেকে লক্ষ রাখে। অপেক্ষা করে অন্তিম সময়ের। ক্রমশ এগিয়ে আসে পায়ে পায়ে। ক্লোজআপ ফটোফ্রেমের মধ্যে চলে আসে শকুন। ক্ষুধার জ্বালায় মরণাপন্ন বালিকা আর ঠিক তার পিছনেই ঘাপটি মেরে থাকা শকুন। বাঃ! দুর্ভিক্ষের চমৎকার বিজ্ঞাপন। লেন্স-বন্দী হয়ে যায় এই করুণ দৃশ্য।

সেও ছিল এক যুদ্ধের আবহ। সুদানের গৃহযুদ্ধ। সেও ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে দক্ষিণ সুদানের পিপলস্ লিবারেশন আর্মি'র লড়াই। কেন্দ্রীয় সরকার মুসলিম শরিয়তি আইন জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইছে অ-মুসলিম দক্ষিণ সুদানিজদের মধ্যে। এছাড়াও ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাণিজ্য ও সরকারি সুযোগের নানান ক্ষেত্রে বঞ্চনার অভিযোগ। সুদীর্ঘ বাইশ বছর (১৯৮৩-২০০৫) ধরে চলা এই যুদ্ধের ফলেই তৈরি হয় দুর্ভিক্ষের পরিমণ্ডল। বে-ঘর হাভাতে মানুষের মিছিল। এই নিঃসহায় মানুষগুলোর শুশ্রূষার জন্য ইউনেস্কো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। জায়গায় জায়গায় গড়ে তুলছিল খাদ্য ও চিকিৎসার শিবির। কিন্তু তহবিলে টান পড়ছিল। তখনই সিদ্ধান্ত হল, ত্রাণ সংগ্রহের জন্য দুর্ভিক্ষের প্রকৃত ছবি বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছতে হবে। চিত্র-সাংবাদিকদের জন্য খুলে দেওয়া হল সুদানের সীমান্ত। দক্ষিণ আফ্রিকার চিত্র-সাংবাদিক কেভিন কার্টার এই দায়িত্ব নিয়েই ১৯৯৩ সালে পৌঁছেছিলেন দক্ষিণ সুদানে। ওপরের ছবিটি তাঁরই তোলা। বাস্তবের সেই দৃশ্য কেভিনকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। যেন এক অপার্থিব মুহূর্ত। ছবিটি ক্যামেরা-বন্দী করার পর কেভিন শকুনটিকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাড়া থাকায় তারপরই তাঁকে চলে আসতে হয়। বালিকাটির (পরে জানা গিয়েছিল সে ছিল বালক) কী পরিণতি হল তাঁর জানা ছিল না। দেশে ফিরে ছবিটি তিনি 'নিউ ইয়র্ক টাইমস্'কে বিক্রি করে দেন। ১৯৯৪ সালে ছবিটি 'ফোটো জার্নালিজম' বিভাগে পুলিৎজার পুরস্কার পায়। বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে সেই ছবি- 'শকুন ও একটি ছোট্ট বালিকা' শিরোনামে।

আজ পশ্চিমবাংলায় এক অন্য গৃহযুদ্ধ। হিন্দু-মৌলবাদের আগ্রাসন থেকে বাংলার কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার লড়াই। ভারতের সংবিধান, ভারত-রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা বাঁচবে কি না, এ তারও পরীক্ষা। ভারতে কোভিড-সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভ্রূকুটির মধ্যেই শুরু হয়েছিল এই যুদ্ধ। এ যুদ্ধও ইচ্ছাকৃতভাবেই দীর্ঘায়িত। দীর্ঘ এক মাস ধরে আট দফায় সাজানো এই রণকৌশল। শকুনের মতোই ডানা মেলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উড়ে আসছিলেন বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা। কোভিড-সতর্কতা বিধি উপেক্ষা করেই চলছিল হাজার হাজার মানুষের বিশাল বিশাল সভা, রোড-শো। লাখো মানুষের সমাগমে মঞ্চে দণ্ডায়মান প্রধানমন্ত্রী আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলেই ফেলেন, 'ম্যাঁয় যাঁহা দেখ সকতা, মুঝে লোগ হি লোগ দেখতা, বাকি কুছ দেখতাই নেহি...।' এক বছর আগে তাঁরই করা করোনা-সংক্রমণ থেকে জনতাকে রক্ষা করার সতর্কবাণী তিনি বিস্মৃত হলেন। ছবির শকুনটির চোখ ছিল বালিকার মৃতদেহের দিকে। আর প্রধানমন্ত্রীর শকুনি-চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বাংলার মসনদে নিবদ্ধ। সেই লক্ষ্যপূরণের জন্য যদি শত শত মৃতদেহ পায়ে দলে যেতে হয় তাতেও তিনি পিছপা নন। 


ভারতবর্ষ আজ অরক্ষিত অভিভাবকহীন। কোভিড-সংক্রমণ থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করার দায়িত্ব যাদের ওপর আরোপিত হয়েছিল তারা আজ শকুন হয়ে বাংলার আকাশে ওড়াওড়ি করছে। কেভিন তবু শকুনটিকে তাড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। বুভুক্ষু মানুষদের রক্ষা করার জন্য ত্রাণ-তহবিল সংগ্রহে ছবির মাধ্যমে সাহায্য করতে পেরেছিলেন। কিন্তু কোভিড-ত্রাণকে উপলক্ষ করে গত বছর গঠিত ‘পিএম কেয়ার্স’ ফান্ডের সংগৃহীত অর্থ কী কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা জানার অধিকার ভারতের জনগণের নেই। দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, মুম্বাই, গুজরাত সর্বত্র আজ মৃত্যুর মিছিল। মরণাপন্ন রোগী নিয়ে আত্মীয়-পরিজনেরা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে অসহায় হয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন। বালিকাটির মতো তাঁদেরও আশা যদি কেউ কিছু করেন। ছবির বালিকাটি ক্ষুধার তাড়নায় চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়ছিল। আর আজ বিভিন্ন রাজ্যের হাজার হাজার মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত অক্সিজেনের অভাবে। ভারতবর্ষ আজ সত্যিই এক ভাগাড়ে পরিণত। শ্মশানে শ্মশানে জ্বলছে সারি সারি চিতা। আর শকুনেরা ঘাপটি মেরে বসে আছে। তাদের লক্ষ্য শুধু বাংলা বিজয়। মানুষের মৃত্যু-মিছিলের বিনিময়ে তাদের লালসা শুধু বাংলার মসনদ। তবেই বরাত পাওয়া যাবে ভারত শাসনের। তবেই ছবির শকুনের মতো খুবলে খাওয়া যাবে মৃত ভারতবর্ষের লাশ। অথচ সময় ছিল প্রস্তুতির। কিন্তু কথায় বলে, শকুনের চোখ থাকে ভাগাড়ের দিকে। তাই গত কয়েক মাসে ৬০ লক্ষ ভ্যাকসিনের ডোজ আর ৯৩০০ মেট্রিক টন অক্সিজেন বিদেশে রফতানি হয়ে যায়। ফলে, আজ ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সবাইকে টীকা দেবার কথা ঘোষণা হলেও প্রয়োজনের তুলনায় জোগান খুবই সামান্য। মজুত অক্সিজেনের পরিমাণও নিতান্তই অপ্রতুল। রাজ্যে রাজ্যে অক্সিজেনের সিলিন্ডার নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে গেছে। 

কেভিন কার্টার যখন সে সময় এত বড় পাওয়া সম্মান উদযাপনে ব্যস্ত ছিলেন, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে তাঁর পুরস্কার প্রাপ্তির খবর দেখানো হচ্ছিল, সে সময় ফোন-ইন্টারভিউয়ে একজন জিজ্ঞেস করেন, 'শেষ পর্যন্ত মেয়েটির কী হয়েছিল?' কার্টার বলতে পারেননি, কারণ তাঁর ফ্লাইট ধরার তাড়া ছিল। লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করেন, 'সেখানে কটা শকুন ছিল?' কার্টার বলেন, 'মনে হয় একটাই ছিল।' ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তি তখন বলেন, 'আমি বলছি, সেদিন ওখানে দুটো শকুন ছিল, তার মধ্যে একজনের হাতে ছিল ক্যামেরা।' এই কথার মর্মার্থ উপলব্ধি করে কার্টার বিচলিত হয়ে পড়েন। শেষে অবসাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেন। তাঁর সুইসাইড নোটে তিনি সেই বীভৎস স্মৃতির কথা লিখে গিয়েছিলেন। যে কোনও পরিস্থিতিতে কোনও কিছু পাওয়ার জন্য মানবিক হতে হয়। কার্টারের মনে হয়েছিল, ক্ষুধা-কাতর মৃতপ্রায় অসুস্থ বাচ্চাটিকে তিনি ইউনাইটেড মিশনের ত্রাণ-শিবিরে পৌঁছে দিতে পারতেন। শিবিরটি ছিল মাত্র মাইল খানেক দূরেই।

আজ প্রায় তিন দশক পর পশ্চিমবাংলার আকাশে মাটিতে শত শত শকুন 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি তুলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বাতাসে বিষ-বাষ্প। নির্বাচন কমিশনের হাতে ক্ষমতা ছিল এই আগুনে-শকুনদের হাত থেকে পঙ্গপালের মতো ধেয়ে আসা অসহায় জনতাকে রক্ষা করার। করোনা-আবহে নির্বাচন হতে পারত এক, দুই বা বড় জোর তিন দফায়। বন্ধ হতে পারত বিধি অমান্য করে বিরাট বিরাট জনসমাগম। পুরো প্রচার পদ্ধতিই হতে পারত ভার্চুয়াল। কিন্তু কমিশন সেই মানবিক দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার শকুনের উচ্ছিষ্ট খেয়ে উড়ে গিয়ে গোয়ার রাজ্যপাল হয়ে বসেছেন। বাকিরাও উচ্ছিষ্টের প্রত্যাশী। তাই অমানবিক হয়ে অযথা দীর্ঘায়িত করে চলেছেন এই অনৈতিক যুদ্ধ। কেভিন কার্টারের বিবেক ছিল, তাই তাঁর দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে তিনি মানসিক ভাবে অস্থির হয়ে আত্মনিধনের পথ বেছে নেন। কিন্তু বাংলা ও দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতিদের ধমক খেয়েও কমিশন ও কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও হেলদোল নেই। শকুনদের দু’ কান থাকে না।


Friday, 23 April 2021

কু-আশা

বাংলার ভোটই কি

ভারতের বুকে শেষ গণতান্ত্রিক নির্বাচন?

শোভনলাল চক্রবর্তী


পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি'র আগ্রাসী প্রচার আমরা দেখছি। সেটা একটা ওপরের স্তর, যার ভেতরে রয়ে গেছে অনেক অভিসন্ধিমূলক অলিগলি। অনলাইন মার্কেটিং-এর সারাংশ থেকে শুরু করে বিহেভিয়ারাল সাইকোলজি-  কোনওটাই বাদ নেই এই প্রচারে। কীভাবে চলছে এই প্রচার? এবারের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি'র প্রার্থীদের বড় অংশ দুই ধরনের: এক) তৃণমূল কংগ্রেসের দলবদলুরা, দুই) তারকা প্রার্থী। এ ছাড়া রয়েছেন কয়েকজন নির্বাচিত সাংসদ, যাঁরা বিধানসভার ভোটেও দাঁড়িয়েছেন। এঁরা সবাই মানুষের কাছে গিয়ে বলছেন, আমাদের একবার সুযোগ দিয়ে দেখুন আমরা কী করতে পারি। আর দিল্লির বড় নেতারা আকাশ বাতাস ভরিয়ে ফল প্রকাশের আগেই রোজ দিনে হাজারবার করে বলে চলেছেন বিজেপি জিতে গেছে, সঙ্গে উপরি হিসেবে বিলি করছেন প্রতিশ্রুতি আর বিজ্ঞাপন। 

জিতে গিয়েছি- এই প্রচারটা মানুষকে দ্বন্দ্বে ফেলার জন্য। মানুষের চিন্তাভাবনা যত গুলিয়ে যাবে ততই তাদের সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বেশি সময় লাগবে; এই মাঝের সময়টা তাদের মন জয় করতে থাকবে বিজ্ঞাপন। এই যে মানুষ সর্বভারতীয় স্তরে একটা সময়ে বিশ্বাস করল নরেন্দ্র মোদিকে আনলেই 'অচ্ছে দিন'ও আসবে গুটি গুটি পায়ে, সেটা কি এমনি এমনি করল? এই বিশ্বাসটা এল বিজ্ঞাপন দেখে। এই বিজ্ঞাপনে একটা অন্তর্নিহিত প্রতিশ্রুতি ছিল যে ক্ষমতায় এলে যদি 'অচ্ছে দিন' না আসে তাহলে পাঁচ বছর পর সরকার পাল্টে ফেলা যাবে। অর্থাৎ, বিফলে মাল ফিরিয়ে নেওয়া হবে। নির্বাচনী গণতন্ত্রের যা নিয়ম। সাধারণ মানুষ যদি জানতে পারে যে, একবার কাউকে ভোটে জিতিয়ে নিয়ে এলে তাকে আর পাল্টানোর উপায় থাকবে না, তা হলে লোকে নেতা বাছার ক্ষেত্রে আরও অনেক সাবধান হত। 

প্রচারের এই যে ভিত্তি এটা ধার করা হয়েছে অনলাইন রিটেল ব্যবসা থেকে। সেখানেও আমরা যে জিনিসটা কিনছি আসলে জিনিসটা কেমন, সেটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখার উপায় নেই। সে ক্ষেত্রে ক্রেতা ভরসা করবে কীসে? টাকা ফেরত দেওয়ার গ্যারান্টি হল সেই ভরসা। ফলে, অনেক সহজে আমরা জিনিসপত্র কিনে ফেলি। বিনা প্রশ্নে টাকা ফেরত দেয় বলেই অনলাইন রিটেলের এমন রমরমা ব্যবসা। এখানে পয়সা ফেরত দিয়ে জিনিস ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি আসলে যে জিনিস কিনছি তার গুণমান সম্বন্ধে নিশ্চয়তা দিচ্ছে। এইটাই বিহেভিয়ারাল মার্কেটিং'এর বেদবাক্য। মানুষ ক্ষতি স্বীকার করতে ভীষণ অপছন্দ করে। তার চেয়ে নিজেকে বুঝিয়ে ফেলা অনেক বেশি সহজ। গ্যারান্টি আমাদের মনকে এই বোঝানোর কাজেই সাহায্য করে- বলছে যখন পছন্দ না হলে টাকা ফেরত দেবে, তখন নিশ্চয়ই জিনিসটা ভালো। মানুষের এই মনস্তাত্ত্বিক আচরণের সদ্ব্যবহার করছে বিজেপি। 

এবার পশ্চিমবঙ্গে ভোটের বাজারে বিজেপির প্রতিশ্রুতি- সোনার বাংলা গড়ে দেব। 'সোনার বাংলা' বস্তুটা গানে ভালো, হোটেলের নামেও ভালো, কিন্তু সেটা খায় না মাথায় মাখে কেউ জানে না। ভোটারের দিকে সুবিধে হল, যে যার নিজের মতো করে সোনার বাংলা ব্যাপারটা কল্পনা করে নিতে পারে। আর রাজনৈতিক দল, যারা এই ধারণাটির বিক্রেতা, তাদের দিক থেকে সুবিধা হল, তারা যে ধারণাটি ফেরি করছে, তার গুণমান যাচাই করে দেখার কোনও উপায় যেহেতু নেই, ফলে ধারণাটি জনগণ একবার কিনে ফেললে জিনিসটায় বিশ্বাস করতেই হবে। এটা অবশ্যই ফ্যাসিস্ট, অথরিটারিয়ান রেজিমের স্বভাবধর্ম। 

এই যে অতীত গৌরবে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি, বিংশ শতক এর অনেক উদাহরণ দেখেছে। হিটলার বলতেন, পিতৃভূমির হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনবেন; মুসোলিনি বলতেন, তিনি নতুন করে রোমান সাম্রাজ্যের সূর্যোদয় ঘটাবেন। একেবারে হাল আমলের উদাহরণও আছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, 'মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন'। মোদিও বলেছেন, অচ্ছে দিন এই এল বলে। এটা এমন একটা প্রতিশ্রুতি যা কখনও যাচাই করে নেওয়া যাবে না। সোনার বাংলায় কী হবে বিজেপি এখনও অবধি বলেনি। কখনও বলবে বলে মনেও হয় না। তবে গত প্রায় সাত বছরে কেন্দ্রীয় সরকারকে দেখেও, উত্তরপ্রদেশ থেকে ত্রিপুরা, হরেক রাজ্য বিজেপির খেল দেখেও যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে ভোট দিচ্ছেন বা দেবেন, তাঁদের বেশির ভাগই ভোট দেবেন বিজেপি এসে মুসলমানদের টাইট দেবে এই আশায়। যদি কেউ বিজেপিকে সোনার বাংলা'র নির্মাণের সুযোগ দেওয়ার জন্য ভোট দেন, তবে তাঁর সেই প্রত্যাশা পূরণ হল কি না তা মিলিয়ে দেখা অসম্ভব। এই ঘটনা গোটা দুনিয়া জুড়ে ঘটে চলেছে। ভোটের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটার টানা এখন একটা রীতিমত বিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে। বহু সংস্থা আছে যারা বিপুল অর্থের বিনিময়ে রাজনৈতিক দলের হয়ে এই কাজটি করে দেয়। তবে এটাও একটা প্রশ্ন যে, স্রেফ একটা গ্যারান্টির ভরসায় ভোট লড়বে বিজেপি? সম্ভবত না। মানুষের আস্থার উপর যথেষ্ট ভরসা এই দলটির নেই, তাই জাতীয়তাবাদী আবেগ, তীব্র ধর্মীয় বিভাজন এই সব জাগিয়ে তোলা হবে, তাকে আরও সুতীব্র করা হবে। শীতলকুচির চেয়েও আরও ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে যেতে পারে যে কোনও সময়ে। আসলে অনলাইন রিটেলারের কাছ থেকে কোনও জিনিস কিনে তা পছন্দ না হলে তা দশ দিন বা এক মাসের মধ্যে পাল্টে নেওয়া যায়। নির্বাচনী গণতন্ত্রে অপেক্ষা করতে হবে পাঁচ বছর। বিহেভিয়ারাল মার্কেটিং-এর নিয়ম অনুযায়ী ততদিনে অনেক মানুষের মন তাদের বুঝিয়ে দেবে যে জিনিসটা কিনতে ভুল হয়নি। ফলে, সেই ভুল আরও একবার করে ফেলতে পারে মানুষ। বিফলে মূল্য ফেরত- এই প্রতিশ্রুতি যে আমাদের দিয়ে কত ভুল, অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনিয়ে নেয়, আর কত ভুল জিনিসকে ঠিক বলে ভাবায় তার ইয়ত্তা নেই। 

এইবার বাংলায় ভুল জিনিস কিনলে তার কত মূল্য চুকোতে হবে সে হিসেব নেই। বাংলার এই নির্বাচন হতে পারে ভারতবর্ষের বুকে শেষ গণতান্ত্রিক নির্বাচন। চমকে উঠবেন না, এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। বিজেপি'র বাংলা বিজয়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা আসলে এক বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ। রাশি রাশি কেন্দ্রীয় বাহিনী, নির্বাচন কমিশন, টাকা দিয়ে কিনে নেওয়া একদল সংবাদমাধ্যম, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দলের এক ডজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিয়ে দিন রাত এক করে প্রচার করছে বিজেপি। বৈদ্যুতিন মাধ্যমের সমস্ত বিজ্ঞাপন স্লট কিনে নিয়েছে তারা। যে পরিমাণ টাকা পশ্চিমবঙ্গের ভোটে বিনিয়োগ করা হয়েছে, তাতে দেশে দু' চারটে করোনা হাসপাতাল হয়ে যেতে পারত। 

ভোট জেতার জন্য কেন এই বিপুল আয়োজন? এই নির্বাচনের শেষে যদি বিজেপি'র তরীখানি তীরে পৌঁছে যায়, তবে বিজেপি'র পরের পদক্ষেপ হবে লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিল এনে নির্বাচন রদ করে আগামী ১৫-২০ বছরের স্থায়ী সরকার গঠন। প্রশ্ন উঠতে পারে, এর জন্য বাংলার ভোট জিততে হবে কেন? কারণটা সংখ্যাগত আধিপত্যের। এই মুহূর্তে সারা ভারতে বিজেপি'র পক্ষে রয়েছেন দেশের ৩৩ শতাংশ মানুষ। বাংলা থেকে যদি বিজেপি ৩০ শতাংশ মানুষের ভোট আদায় করতে পারে, তবে কেল্লা ফতে! আর কোনও অবিজেপি রাজ্য সরকারের তোয়াক্কা করবে না এই দল। দিল্লি সরকারকে যেমন করে সংসদে বিল এনে ডানা ছেঁটে দেওয়া হল, সেই একই প্রকল্পে অন্য অ-বিজেপি রাজ্যগুলিকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে রাখার ব্যবস্থা পাকা হবে। খেলাটা নতুন নয়। ইতিপূর্বে অনেক একনায়কতান্ত্রিক দেশে এমনটা ঘটেছে, যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ রাশিয়া। সেই পথেই পা বাড়িয়ে রেখেছে মোদি সরকার। তাই বাংলার এবারের ভোট ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। বাংলার মানুষের সেই উপলব্ধি আছে তো? এমন অশনি সংকেতে সাধু সাবধান।


Thursday, 22 April 2021

'সারা শহর উথালপাতাল...'

অসহায় মানুষের হাহাকার

সুমন সেনগুপ্ত


এই সময়ের প্রতিটি দিনই ঐতিহাসিক। প্রতিটি দিন বললে ভুল হবে, প্রতিটি মুহূর্ত ঐতিহাসিক। আপনি সকালে উঠে হয়তো কল্পনাও করতে পারবেন না, এমন কিছু কথা আপনাকে হয়তো সারাদিনে শুনতে হবে। গত বছর এই সময়ে লকডাউন চলছিল আর পরিযায়ী শ্রমিকেরা বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করছিলেন। দেশের নানান প্রান্ত থেকে কোভিডে আক্রান্ত মানুষের হাহাকার শোনা যাচ্ছিল। হেঁটে ফেরার খবরও আসা শুরু হয়েছিল। আর দেশের প্রধানমন্ত্রী তখন কোনও দিন থালি বা ঘণ্টা বাজানোর এক মহান দায়িত্ব দিয়েছিলেন দেশের জনগণকে। দেশের অনেক মানুষ তা অক্ষরে অক্ষরে পালনও করেছিলেন। তারপর তিনি রাত ৯টায় ৯ মিনিটের জন্য বাড়ির সব আলো নিভিয়ে মোমবাতি বা প্রদীপ জ্বালিয়ে করোনায় মৃত মানুষদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনও করতে বলেন। সেও অনেক মানুষ পালন করেন। তারপর ডাক্তারদের সম্মান জানানো হয়, সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে পুষ্পবৃষ্টি করা হয় এইমসের ওপর। সেই দিনগুলোর কথা যদি মনে করা যায়- সপ্তাহে অন্তত একবার নরেন্দ্র মোদী টিভির পর্দায় আসছেন, মুলত মধ্যবিত্ত মানুষকে কোনও না কোনও কাজ দিয়ে ব্যস্ত রাখছেন যাতে তাঁদের মনে কখনও কোনও প্রশ্ন না জাগে যে সরকার গরিব মানুষদের জন্য কী করল? কেউ যাতে রাস্তায় নেমে ঐ পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে না দাঁড়ায়, তাই দেশ জুড়ে লকডাউন এবং আতঙ্ক সৃষ্টি করে রাখা হয়েছিল। 

ঐ সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা ছিল যে, ডাক্তার, নার্স সহ যারা এই করোনার বিরুদ্ধে সামনে থেকে লড়াই করছেন তাঁদের জন্য ৫০ লক্ষ টাকার বীমা হবে। আজ এক বছর পর যখন আবার কোভিডের দ্বিতীয় সংক্রমণে চারিদিকে শ্মশানের শান্তি বিরাজ করছে, চারিদিকে চিতা জ্বলার ছবি আসছে, তখন হঠাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এই বীমা প্রকল্পটি তুলে নেওয়া হল। (অবশ্য এ নিয়ে ব্যাপক হৈচৈ শুরু হওয়ায় নতুন অন্য কোনও বীমা প্রকল্পের অধীন তাঁদের নিয়ে আসা হবে বলে স্তোকবাক্য দেওয়া হয়েছে)। কোনও কোনও মানুষ বা চিকিৎসক যারা মারা গিয়েছেন তাঁদের পরিবার যে এই বীমা প্রকল্পের সুবিধা পাননি তা নয়। কিন্তু তা কি আর এই গুজরাটি বানিয়ারা মেনে নিতে পারে? মৃত মানুষের কোনও দাম নেই তাঁদের কাছে, যদি না তাঁরা সেনাবাহিনীর কেউ হন। 

শুধু গুজরাটি বানিয়াদ্বয়েরই বা দোষ দিই কী করে, আমরাও তো নানান সময়ে এই সরকারের বিভিন্ন অমানবিক সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছি। এই যেমন সেদিন আমাদের বেশির ভাগ মানুষই ধরে নিয়েছিলেন যে করোনা মুসলমান মানুষজন ছড়ায়। সেদিনও যেমন অনেকে মেনে নিয়েছিলেন যে ‘ওরা’ নোংরা তাই ‘ওদের’ মাধ্যম দিয়েই করোনা ছড়াচ্ছে। আজও তেমনটাই হয়তো ভাবেন অনেকেই। অথচ কেউ প্রশ্ন করেন না যে আমেদাবাদে নরেন্দ্র মোদী আয়োজিত ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানে যদি ঐ রকম জমায়েত না হত, বা আজ যদি কুম্ভ স্নানে এই রকম বাড়াবাড়ি না হত, তাহলে কি প্রথম কিংবা দ্বিতীয় করোনার ঢেউ এত ভয়াবহ আকার নিত? কেউ কিন্তু জিজ্ঞেস করছেন না যে যদি এই সময়ে বাইরের লোকজন নিয়ে এসে বাংলার নির্বাচনের প্রচার না করা হত, তাহলে কি সমস্যার এতটা বাড়াবাড়ি হত? 

অদ্ভুত এক দেশে আমরা বাস করছি। যেখানে কেউ প্রশ্ন করতে ভয় পায়। সব কিছুই কত নর্মাল, কত কী অনায়াসে মেনে নেওয়া হয়েছে। বাংলায় দুটি বিধানসভায় (সামশেরগঞ্জ এবং জিয়াগঞ্জ) প্রার্থী মারা গেছেন করোনাতে। দুটো জায়গাতেই মুসলমান মানুষ সংখ্যায় বেশি সেখানে নির্বাচনের দিন ঘোষণা করা হয়েছে সম্ভাব্য ঈদের দিনে। পরে অবশ্য চাপে পরে সে তারিখ পাল্টানো হয়েছে। কাণ্ডজ্ঞানের বলিহারী! আচ্ছা, ভাবুন তো, এক মাস সংযমের রোজা করে প্রায় প্রতিটি মুসলমান মানুষ যখন ঈদ পালন করবেন, সেদিন নির্বাচন ফেলা কি সেই মানুষদের অপমান করা নয়? এই একই প্রক্রিয়া যদি ষষ্ঠী বা অষ্টমীর সকালে নেওয়া হত আপনার কেমন লাগত? আপনার উৎসবের দিনে জলপাই রঙের জামা পরা কিছু মানুষ আপনার অঞ্চলে ঘুরছে, কারণ আরও বড় উৎসব পালন করছেন আপনি।

আসলে এটাই হচ্ছে সংখ্যাগুরুর গণতন্ত্র। যে গণতন্ত্রে পাশের মুসলমান মানুষের জন্য কোনও সহানুভূতি থাকতে নেই, যে গণতন্ত্রে পাশের পরিযায়ী শ্রমিক বা রিক্সাচালককে আমরা অনায়াসে ‘ওরা’ বানিয়ে ফেলতে পারি। যে সংখ্যাগুরুর গণতন্ত্রে অনায়াসে আখলাখ, জুনেইদদের পিটিয়ে মারা যায়, যে সংখ্যাগুরুর গণতন্ত্রে আসানসোলের দাঙ্গায় ইমাম রশিদির ছেলেকে মেরে সেই স্মৃতিকে উসকে ভোট চাওয়া যায়। যে গণতন্ত্রে একজন মানুষ তাঁর প্রতিবেশী মানুষটিকে ঘেন্না করতে শেখে, সেই গণতন্ত্রে আমিও একজন অংশীদার ভাবলেই নিজের ওপর ঘেন্না হয়। যে গণতন্ত্রে ‘জয় শ্রীরাম’ না বলার কারণে একটি দশ বছরের বালকের গায়ে  ফুটন্ত গরম জল ছুঁড়ে দেওয়া হয়, সেই গণতন্ত্রের অংশীদার হয়ে আমি ভোট দিয়ে নিজের কালি লাগা আঙুলের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়েছি ভাবলে লজ্জায় মাথা নীচু করতে হয় না? 

যখন সারা দেশে আবার দ্বিতীয় করোনার ঢেউ এসেছে, যখন সারা দেশে মানুষ ‘অক্সিজেন’এর অভাবে হাহাকার করছে, তখন কোনও নেতা মন্ত্রী বলছেন বড্ড বেশি ‘অক্সিজেন’ নিচ্ছেন মানুষ, কিংবা বলছেন মানুষের বয়স হলে তো মারা যাওয়াই উচিত; তখন কি মনে হয় না এটা সংখ্যাগুরুর গণতন্ত্র? যারা সমাজের ওপর তলায় বসে সব ধরনের সুবিধা পেয়ে অভ্যস্ত সেই সংখ্যাগুরুরা এখন নিদান দিচ্ছেন মানুষের মরে যাওয়া উচিত তখন কি মনে হয় না বলি, ‘একটা কুঁড়ি বারুদ গন্ধে মাতাল করা ফুটবে কবে?/ সারা শহর উথাল পাতাল ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে।’