পরিবেশের অবক্ষয় কতদিন?
বিনয় কৃষ্ণ পাল
কয়েকদিন আগে একটা ঘটনা পড়ছিলা্ম ইউরোপের কয়েকটি দেশে নাকি এমন
ব্যবস্থা চালু হয়েছে যেখানে আপনি পায়ে হেঁটে, সাইকেলে বা সরকারি গাড়ি
ব্যবহার করে কর্মক্ষেত্রে গেলে আপনাকে ট্যাক্স কম দিতে হবে। উপরন্তু সরকারি
তরফ থেকে আরও কিছু সুযোগ সুবিধা। সুইজারল্যান্ড, সুইডেন এর কিছু মানুষ শহর
ছেড়ে গ্রামে/ প্রকৃতির পাশে গিয়ে অত্যন্ত সাধারণ ভাবে জীবন-যাপন করছে।
আরে, এটাই তো হওয়া উচিত। আমার এক বন্ধু সেদিন নরওয়ে থেকে ফিরে বলল, ওখানে
যে কোন শিল্পের জন্য উৎপাদন কর (Production/ Economic Tax) ছাড়াও একটা আলাদা
পরিবেশ কর (Environmental Tax) নেওয়া হয়, যা সাধারন মানুষের চিকিৎসা খাতে
ব্যয় হয়। কোনও কোম্পানির উৎপাদন যত বাড়বে, সেই হারে পরিবেশ করও বাড়বে।
.
আজ ফুটবলের স্বর্গ ব্রাজিলে মানুষ বিশ্বকাপের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে, "আমরা
চাই না এই বিশ্বকাপ, চাই শিক্ষার বিস্তার, সুস্বাস্থ্য, সুন্দর পরিবেশ।"
হ্যাঁ, তারা খবর পেয়েছে কিভাবে দিল্লিতে কমনওয়েলথ গেমসের জন্য যমুনা নদীর
ওপর অত্যাচার হয়েছে। বেজিং'এ অলিম্পিকের জন্য হাজার হাজার একর সবুজ, জমি
নষ্ট হয়েছে। তারা শিক্ষা নিয়েছে। প্রণাম ব্রাজিলবাসিকে। আমি ও আমার দেশবাসী
এই কাজে অক্ষম।
.
তুর্কির রাজধানী ইস্তানাবুল শহরের কেন্দ্রে একটি
জনসাধারনের পার্ক (Public Park)। বয়স্ক, শিশু সহ সমস্ত মানুষের সবুজ
পরিবেশের সান্নিধ্যে মন ভালো করার উপাদান। জঞ্জালের শহরের মাঝে যেন একখণ্ড
সবুজ দ্বীপ। তুর্কির সরকার স্থির করল এই উদ্যানকে বন্ধ করে “সাধারনের
জন্য” একটি শপিং মল করা হবে। দিনটা ২৮ মে, ২০১৩ হঠাৎ যেন বন্যার স্রোতের
মত হাজার হাজার মানুষ পার্ককে ঘিরে কারো বিরুদ্ধে উন্মত্ত ভাবে শ্লোগান
দিতে লাগলো। বোঝা গেল, শ্লোগানটা পার্ককে রক্ষা করার জন্য সরকারের
বিরুদ্ধে। এল জলকামান, অত্যাধুনিকআগ্নেয়াস্ত্র, সেনা। বেশ কিছু প্রতিবাদী
গুলিতে মারাও গেল... কয়েকজন তরুণীকে পুলিশ প্রায় নগ্ন করে তুলে নিয়ে গেল।
প্রতিবাদীরা বুঝল, পথের পরিবর্তন দরকার। শুরু হল আরেক নতুন অধ্যায়, সমস্ত
পার্ক ও তার পারিপার্শ্বিক এলাকায় আরও মানুষ এসে জড়ো হল। সবার হাতে
প্ল্যাকার্ড বা ফেস্টুন। কোনও কথা না বলে, শ্লোগান না দিয়ে রাস্তায়, ফুটপাতে
দাড়িয়ে টানা কয়েকদিন প্রতিবাদ। হ্যাঁ, নিঃশব্দে প্রতিবাদ। প্ল্যাকার্ডে
লেখা- “আমরা শপিং মল চাই না, সাধারনের জন্য পার্ক চাই। সুন্দর পরিবেশ চাই”।
খবর ছড়িয়ে পড়ল ফেসবুক, টুইটার এর মাধ্যমে। তৈরি হল বিশ্ব জুড়ে বিশাল জনমত,
সরকার পিছু হটল।
.
আজ ভারতবর্ষের সমস্ত স্কুল-বোর্ড,
বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ বিদ্যা একটি আবশ্যিক বিষয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে
এই বিষয়ে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী কিছু না পড়েই পাস করে যায়। আর তারপরে এই
বিষয়ের নম্বরকে কেউ ধর্তব্যেও রাখে না। আর সিলেবাস ও পরীক্ষার গুণমানও
বালখিল্য ধরনের। এই ছেলেমেয়েগুলো এই ভাবেই শেখে, পরিবেশ হল একটি
অবজ্ঞার-অবহেলার জিনিস। ছোটবেলা থেকে পড়ে আসছি, “জলাভুমি হল প্রকৃতির বৃক্ক, বৃক্ক
যেমন দূষিত রক্ত শোধন করে জলাভূমিও প্রকৃতির দূষণ শোধন করে”। তবুও আমরা
তাকে বুজিয়েই ফ্ল্যাট বানাবো, কিনবো। কেও যদি শিল্প করতে চায় তাহলে তো আর
কথাই নেই। উন্নয়নের নামে হরিবোল দিয়ে শাসক-দল (বিরোধী দলের সাথে রফা করে)
প্রমোটার'এর সাথে নেমে পড়বে। কোথাও শিল্প হচ্ছে শুনলে তো আমাদের যেন পকেটের
ঘণ্টি বেজে ওঠে। স্বাধীনতার পর এত শিল্প, উন্নয়নে আমি কী কী পেয়েছি,
পাচ্ছি, পাবো আর হারিয়েছি, হারাচ্ছি ও হারাবো সে হিসাব কেউ করি না।
চারিদিকে বিজয় শঙ্খনাদ-- "উন্নয়ন হচ্ছে, শিল্প হচ্ছে, প্রগতি হচ্ছে"। আমরাও
দু হাত তুলে হীরক রাজার সাকরেদদের মত বলিঃ হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক ঠিক।
.
ছোট, মাঝারি শ্রম নির্ভর শিল্প বন্ধ করে বৃহৎ শিল্প। বৃহৎ
শিল্প করে সরকার দেখাচ্ছে কিভাবে উন্নয়নের রথ চালাতে হয়। ফল মারাত্মক,
প্রযুক্তিকে মানুষ সহযোগী না ভেবে তার দাস হয়ে পড়েছে। দেশে দেশে তৈরি হচ্ছে
হদ্দ কুঁড়ের দল। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী অভিভাবকদের কাছে অনুনয় করছেন,
“ছেলেমেয়েদের বিলাসিতার মধ্যে রেখে কর্মবিমুখ করবেন না”। এই আবেদন পরিবেশ
সচেতনতার দিক থেকে নয়, উন্নয়নশীল দেশের কর্মঠ লোকেরাই আজ তাদের দেশের
অন্যতম প্রধান উৎপাদক। তাই, যাতে দেশের অর্থ দেশের বাইরে চলে না যায় তাই এই
অনুনয়। ইতিহাস, ভূগোল, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন থেকে শিক্ষা নিতে আমাদের খুব
কাঁদায়। সেই কবে চিপকো, নর্মদা বাঁচাও হয়েছে (যার মূল উদ্দেশ্য
জীবিকা-বাসস্থান সহ পরিবেশ রক্ষা)। তারপর পরিবেশ নিয়ে যেন এক শ্মশানের নীরবতা। বর্তমানে কুদানকুলাম, হরিপুর, নয়াচর'এ (মানুষের জন্য পরিবেশের
স্বার্থে) রাসায়নিক, পারমাণবিক শিল্পের বিরোধিতা হল আসলে উন্নয়নের
বিরোধিতা। সর্বোপরি স্বাধীন দেশের “স্বাধীন সংবাদমাধ্যম” ও জনমত তৈরিতে
অনীহা দেখায় ও বিশেষ প্রচার করে না। কয়েকটি সংবাদপত্র তো সমস্ত ক্ষেত্রে
বৃহৎ শিল্পের বিস্তার ঘটাতে ও প্রচারে মরণপণ পণ নিয়েছে। যে সমস্ত বিদেশি
সংবাদমাধ্যম জনসাধারনের ও বিজ্ঞানীদের এই প্রতিবাদ প্রচার করতে চায় তাদের
আটকানো হয়, সাংবাদিকদের খুনের হুমকি দেওয়া হয়। এখন তো আবার শুনছি
বিজ্ঞানীদেরও হুমকি, ভয় দেখানো হচ্ছে। নানা ধরনের প্রলোভন তো রয়েছেই। যাতে
সমাজ ও পরিবেশের স্বার্থে গবেষণা না হয়, দেশ নির্বিশেষে সরকার এই ধরনের
প্রকল্পে অনুমোদন বা ফান্ড দিচ্ছে না। ভারতের ২০১৩ এর “বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও
উদ্ভাবন নীতি (Science, Technology and Innovation Policy of India,
2013)” এর উল্লেখযোগ্য নমুনা। দুর্ভাগা এই দেশে মানবাধিকার, শ্রমিকের
অধিকার, কৃষকের অধিকার, নারীর অধিকার নিয়ে অনেক প্রতিবাদ, বনধ হয়। কিন্তু
পরিবেশ নিয়ে কোন বনধ হয় না। “পরিবেশের অধিকার (আজ্ঞে হ্যাঁ, Human Rights
এর মত ইংরিজিতে একে বলে Environmental Rights)” তো কোন দুর অস্ত, মানুষের
সুস্থভাবে বেচে থাকার জন্য ভালো পরিবেশের অধিকারের (Human Rights to live
in a Safe Environment) কথা কেউ ভুল করেও ভাবে না, বলে না।
.
যে
মানুষগুলো এককালে বনে বাদাড়ে দুটো খাওয়ার জন্য ঘুরে বেড়াতো, লজ্জা
নিবারনের জন্য গাছের ছাল পরে থাকতো, অন্য প্রাণীর আক্রমন থেকে বাঁচতে গাছের
ডালে ঝুলত বা গুহাতে লুকিয়ে থাকতো, আজকের পাহারাদার নিয়োগকরা, বিলাসবহুল,
পাকা বাড়িতে তার নাকি এখন অস্তিত্ব সঙ্কট। "কি গরম! উফফ আর পারছি না বাবা।
এবার দেখছি AC ছাড়া চলবেই না।" হ্যা, ঠিক তাই। বাতানুকুল যন্ত্র (Air
Condition Machine) ও এখন "নেসেসিটি" (ভাত, ডাল, মুড়ির মত নিত্যপ্রয়োজনীয়)
হয়ে পড়েছে। "ট্রেনে/ বাসে খুব কষ্ট বুঝেছো, বাস বা ট্রেন টা AC হলে খুব
ভালো হত বা এবার একটা প্রাইভেট কার না হলে আর চলছে না"। যেমন ভাবে আমরা
দিনে চারবার পারফিউম ব্যবহার করি নিজের গায়ের দুর্গন্ধ ঢাকতে, অথচ জানি না
কি পারফিউমে কি ব্যাপক পরিমাণে CFC(ক্লোরোফ্লুরো কার্বন, যা ওজোন ও জলবায়ুর
পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর) গ্যাস থাকে ও তা অন্যভাবে আমাদের জন্যই
বিপদবার্তা। রেল ষ্টেশনে/ রাস্তায় দাড়িয়ে সাহেবি ঢঙে সিগারেট জ্বালিয়ে
অন্যের মুখের সামনে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে তৃপ্তি অনুভব করি। প্রকৃতির ডাককে
একটু সামলে না রেখে, লাজলজ্জার মাথা খেয়ে দেওয়ালের সামনে বা ফাঁকা যায়গায়
প্যান্টের চেন খুলে দাড়িয়ে পড়ি। আসলে ব্যপারটা হল আমাদের ভেতরের
দুর্গন্ধ-জঞ্জালের চেয়ে বাইরের দুর্গন্ধ-কদর্যতাই আমাদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট
দেয়। তাই যে মানুষগুলো হাজার হাজার বছর ধরে প্রকৃতিকে বুঝে তার সাথে খাপ
খাইয়ে চাষবাস করে কৌম্য-জীবন (Community Life) যাপন করে এসেছে অতিলোভী-সভ্য
মানুষের কাছে তারা হয়ে যায় গাঁইয়া, আদিম, অসভ্য। তাদের
জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-অনুভুতি এগুলোকে অতিক্রম করে আমরা হয়ে যাই সভ্য-শিক্ষিত
নাগরিক। সভ্যতা মানে কি স্বাভাবিক-কষ্টসাধ্য বিষয় গুলিকে এড়িয়ে নিজের
সুবিধা মত সব কিছু কে চালিত করা? প্রকৃতি কে না বুঝে পরিবর্তন করা? সমাজ ও
পৃথিবীকে ধংসের দিকে নিয়ে যাওয়া? নাকি কেবল সেমিনার-কনফারেন্স এ পরিবেশ
সচেতনতার বুলি আওড়ানো? আর পাঁচজন মানুষের সাথে ভদ্র-সভ্য ব্যবহার, বিপদে
আপদে তাদের পাশে থাকা, ও সময় মতো বুঝিয়ে দেওয়া যা হচ্ছে মেনে নিন, কী আর
করবেন? আপনি আমি নিমিত্ত মাত্র। সস্তার জনপ্রিয়তাই যেন মূল লক্ষ্য। ব্যক্তিজীবনে প্রয়োগ না হলে পরিবেশ রক্ষার দাবি উঠবে কী করে??
.
তাই দাবি উঠুক, ঢেউ ছড়িয়ে পড়ুক রাস্তায়- প্রকৃত বিজ্ঞান ও পরিবেশ শিক্ষার
বিস্তার চাই, সুন্দর স্বাস্থ্যের জন্য সুন্দর পরিবেশ, চাই একজন সাধারণ
মানুষ হিসেবে বাঁচতে একটা পরিবেশবান্ধব কাজ চাই। বন্ধ হোক পরিবেশ ধংস করে
মানুষকে লোভী বানানোর এই "খুড়োর কল"। তলস্তয় এর একটা উক্তি মনে পড়লো- “সব্বাই পৃথিবীকে পরিবর্তন করার কথা ভাবে, কিন্তু কেউ নিজেকে পরিবর্তন করার কথা ভাবে না।”