Friday, 27 June 2014

একক মাত্রা - জুলাই ২০১৪ সংখ্যা প্রকাশ পেল






প্রকাশ পেল ‘একক মাত্রা’র জুলাই ২০১৪ সংখ্যা। ৩০ জুন থেকে সমস্ত স্টলে পাওয়া যাবে।
এবারের প্রচ্ছদ বিষয় – ‘এই সময় নেই সময়’। এই বিষয়ে যারা লিখেছেন –
১) আশীষ লাহিড়ী ২) অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় ৩) প্রজিত জানা ৪) মন্দার মুখোপাধ্যায় 
৫) সঞ্জয় মুখার্জি ৬) সব্যসাচী মিত্র ও ৭) শৌভিক দে সরকার।
এছাড়া রয়েছে অন্যান্য কলাম।
সূচিপত্র নিচে দেওয়া রইল।
প্রচ্ছদ ও ভেতরের ছবি এঁকেছেন – পার্থ দাশগুপ্ত।

আমাদের পরিবেশক- 
The Earth, ৩০ সূর্য সেন স্ট্রিট, কলকাতা- ৯। চলভাষ- 9830241857।
 স্টলে পত্রিকা না পেলে তা সংগ্রহ করার জন্য সরাসরি পরিবেশকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

ঘরে বসে পেতে হলে এখানে বলুন – http://grasshoppers.in/

যারা online’এ পড়তে চান তাঁদের জন্য এই লিঙ্কগুলো –
1) Ekak Matra is now available on Web from your Computer on this link below:
http://www.magzter.com/IN/Ekak-Matra/Ekak-Matra/Art/

2) Ekak Matra is also available on iphone/ipad as well here below:
iphone/ipad:
https://itunes.apple.com/us/app/ekak-matra/id793752350?ls=1&mt=8

3) For Ekak Matra's availability on Android phone/ Tablet click here below:
Android phone / Tablet:
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.magzter.ekakmatra
 
 

Thursday, 19 June 2014

কথার ওপারে


কই কোথাও যাচ্ছি না তো!

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় 



মোবাইল ফোনটা বাজছে। বৃষ্টি পড়ছে ঝমঝমিয়ে, তাই প্রথমে শোনা যায়নি।
হ্যালো?
চেনা গলা। “কী করছ?”
“কিছুই না, এই এমনি...”। শেষ হয় না কথাটা। বরং অবিরল বর্ষার ধারার মতোই কথার শেষ শব্দগুলো ধুয়ে যায়। জীবনের ঝাঁঝরি গলে ঝরে পড়ে নীচে। ভাবতে ভাল লাগে যে ছোট ছোট কথার স্রোত এরপ নালা বেয়ে গিয়ে পড়ে নদীতে, নদী থেকে সাগরে...। আসলে কিন্তু কথারা কোথাও যায় না। পাঁকে, আবর্জনায় দম বন্ধ হয়ে থাকা নর্দমার মধ্যে, থকথকে ঘোলা কালো দুর্গন্ধ জলে মুখ ডুবিয়ে পড়ে থাকে। তা ছাড়া যে কথা কোনও সমাপ্তির দিকে যায় না, তার আবার দাম কী! মনে রাখতে হবে, শেষ করা দরকার। খুব যদি নির্বোধ, অসার কথা হয়, তা হলেও। কথা শেষ করতে হবে এবং এমনভাবে শেষ করতে হবে, যাতে মনে হয় যে ওটাই শেষ কথা ছিল। এর পর আর একটা শব্দ খরচ করাও জরুরি নয়। ‘কখুকগ’-র বচ্চন সাহেবের মতো, “ক্যাহ দিয়া না! বস, ক্যাহ দিয়া!”
কিন্তু ফোনের প্রান্ত বোধহয় শেষ না হওয়া নিয়ে অত কিছু ভাবে না। পরের প্রশ্ন, “বাড়িতেই আছ তো?”
উত্তরে একটা নির্জীব ‘হুঁ’ ছাড়া বিশেষ কিছু বলার নেই। বাড়ি ছাড়া আর কোথায়। আর যাওয়ার নেই তো কোথাও! অথচ একটা সময় ছিল, যখন সকালে বৃষ্টি নামলে মনে হতো, উফ, আজকের দিনটাও কেন রেহাই পাওয়া যায় না! এমন একটা চমৎকার দিনে কেন বাড়িতে থাকা যায় না। অথচ সেই সময়টা সত্যিই যখন একদিন না বলে কয়ে চলে এল, তখন আর কেন ভালো লাগে না! অথচ বৃষ্টি তো ঠিক সেই আগের মতোই। বারান্দার রেলিংয়ে বসে ডানা ঝাড়তে ব্যস্ত ভেজা কাক, টবের ফুল গাছেদের বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নেচে ওঠার ছটফটানি, পাশের বাড়ির ছাদে মেলে রাখা শাড়ির ভিজতে ভিজতেই হঠাৎ দমকা হাওয়ায় ফুঁসে উঠে উড়ে যাওয়ার ইচ্ছে – সব আগের মতো। আসলে তাদেরও কোথাও যাওয়ার নেই। গেরস্থের উচ্ছিষ্টে অভ্যস্ত কাক, বাহারি টবের শেকড় বেঁধে রাখা ফুল গাছ, বা ছাদের তারে আটকে পড়া শাড়ি - ওরাও কেউ কোথাও যাবে না।
সবই ওই শেষ না হওয়া কথার মতোই। অথচ শেষ হওয়াটা খুব জরুরি। নাকি শেষ পর্যন্ত কোথাও না পৌঁছতে পারাই একমাত্র সত্যি, বাকি সব বিভ্রম! সেই কারণেই, “কী, কোথায় যাচ্ছেন?” প্রশ্নটা শুনলে বোধহয় এত অস্বস্তি হয়। কই, কোথাও যাচ্ছি না তো! বাজার যাচ্ছি, অথবা মুদির দোকান, কিন্তু ফিরে আসব। ব্যাঙ্কের কাজ, এক্ষুনি ফিরে আসব। বেড়াতে যাচ্ছি, ফিরতে তো হবেই। সান্ধ্যবাসরে ডেকেছে বন্ধু, কিন্তু সময়ের মধ্যে ফিরতেই হবে। আসলে সবাই ফেরে। কিন্তু যার কোথাও যাওয়ার নেই, সে পড়ে লজ্জায়। কোথায় যাচ্ছেন শুনলে সিঁটিয়ে গিয়ে বিব্রত হেসে বলে, “এই একটু...। কথা শেষ হয় না। কারণ ঠিকমতো শেষটা তো আর হয় না। অথচ ওটাই জরুরি। শেষটা।

Thursday, 12 June 2014

সখী কথা


সংসার দিয়া কী হইব!

সুচিত্রা সরকার


অপেক্ষা করছি কখন কাননবালা, মানে বড় সখীর একটু অবসর মিলবে! যখন মিলল, তখন তিনি বিধ্বস্তপ্রায়! তবু কথা রাখলেন। বললেন তাঁর কৈশোর আর যৌবনের কথা।
‘সত্যিকারের বিয়াই তো আমার। খালি ঢাক বাজাইছে না আর পুরিত আইছে না। বিয়া না কি এইড্যা? সাত পাকও ঘুড়ছি কুঞ্জতে। আবার সিন্দুরও পড়ছি!’
এতোটুকু বলতেই আমার সাংবাদিক সত্তাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। প্রশ্ন করলাম, ‘বয়স কতো তখন আপনার?
‘কি কইতাম। এক্কেরে ছুট! সবই তো বুঝোছ এহন! বুক উঠছে মালা চন্দনের দুই বছর পর। আর মাসিক হইছে পাঁচ বছর পরে।’
‘এতো ছোট বয়সে...?’
‘ছোটই তো। তয় বাবায় বিয়া দিতে চায় নাই। গুসাইর বাড়িত বাবার লগে আইতাম। গুসাই আমারে দেইখ্যা পছন্দ করছে। আগে তো আরো সুন্দর আছিলাম। বাবারে কইছে মালাচন্দন করনের কথা। বাবায় কইছে, আমি কি কইতাম, ওর মামাগোরে জিগাই।’
জিজ্ঞেস করার কারণও ছিলো। কাননবালার মামাদের কোনো সন্তান ছিলো না। এদিকে কাননবালাও তাঁর বাবার এক সন্তান। আর, তারা সকলেই জানতেন, গুসাই যে বিয়ের কথা বলছেন, তাতে করে আপাত সংসার, যাকে বলে ভর-ভরন্ত সংসার, সেটা তাদের মেয়ের করা হবে না।
কিন্তু গুসাই বাবা, মহা মহা প্রভু সে সময়টুকু কাননবালার বাবাকে দেননি। তারপর মালাবদল আর কপালে সিঁদুর!
মহাপ্রভু গত হয়েছেন অনেক বছর। তবু কাননবালা রঙিন শাড়ী আর দু’ হাতে দু জোড়া শাখা!
প্রশ্নটা আমার ভ্রুতে জায়গা করে নিতেই তিনি বললেন, ‘মহাপ্রভু কইছে, ‘আমার প্রভুর মরণ নাই। আমি দেহত্যাগের পরেও তোমরা শাখা-সিঁদুর পরতে পারবা’’! আগে সিন্দুরও পরতাম! কুনখানে বেড়াইতে গেলে সিন্দুর পইর‌্যা, শাখা পইর‌্যা যাইতাম। তারপর দেখি, আর সিঁদুর পরতে ভাল্ লাগে না। গোসাই থাকতেই সিঁদুর পড়া বন্ধ দিছি। আমার দেখাদেখি অন্যরাও সিন্দুর পরতো না।’
হায় হায়! কেমন সৃষ্টিছাড়া কথার ছিরি! বিয়ে করা বউ, সেও নাকি আবার মাথায় সিঁদুর পরে না। তাও বর বেঁচে থাকতেই? মহাপ্রভু কি তবে উত্তর আধুনিক ছিলেন? আচ্ছা, আচ্ছা দিদিমা, বলেন তো, ওনার বউ, মানে মা গোসাই উনিও কি আপনাদের মতোই সিঁদুর পরতো না? স্বামীর কল্যানের কথা ভাবতো না?
‘ মা পড়ত। আমরা পড়ি নাই। কেউ কিছু কয় নাই। কিন্তু ক্যান জানি  আর মন চাইত না সিন্দুর পড়তে!
স্বামী-স্ত্রীতে আর বাকি যেসব হয়, সেসব?
‘নাহ্, সেসব কিছু হয় নাই। প্রভুর ওইসব ভাব আসে নাই। আমরা শুধু আলিঙ্গন করছি!’
হুম! শুধুই আলিঙ্গন! মহাপ্রভুর শরীর আর আশ্রমের এক পাহাড় সমান কাজকে! অসম্মান আর অপমানকে।
পদ্ম’র মা ওদের সঙ্গেই রান্নার কাজ করতো। তিনি পাশে শুয়ে ছিলেন। ফোঁড়ন কাটলেন, ‘এক ঘরে থাকছে গোসাইর লগে, কি করছে, না করছে আমরা কি দেখছি নি?’ বলেই হিহি হাসি!
এরকম কত কত হাসি আর টিটকিরি প্রাপ্তি ঘটেছে ওদের জীবনে, কে জানে!

পঞ্চসখীর সর্বকনিষ্ঠ সখী মঞ্জু। বাকিদের পেলেও হয়তো বলতাম। কিন্তু বিধি বাম। একজনের ভবতরী সাঙ্গ হয়েছে। আর বাকি দুজন ভেগেছে! হুম! স্রেফ ভেগেছে! দুজনেই নিজের পছন্দ করে পরে বিয়ে করেছে। আশ্রমে কি তাদের জায়গা মেলে?
মঞ্জু দিদি একটু ঠোঁটকাটা। বলেই ফেললেন, ‘আমার তো সস্তার বিয়া হইছে। কিছু দেওন- থুওন লাগছে না! এমন বিয়া আছে নি আর জগতে?
মঞ্জু দিদির বিয়ে হয়েছে ১৯৭১ সালে। মুক্তিযুদ্ধ চলছে। এদিকে সবাই বর্ডার পাড় হচ্ছে। বারো বছরের কিশোরীকে নিয়ে তার বাবা পড়লেন বিপদে। এক্ষেত্রেও উদ্ধারে এগিয়ে এলেন জগতের ত্রাতা মহাপ্রভু! চিন্তা কি, আমার সঙ্গে মালা চন্দন করা তোর মাইয়ারে!
তাই সই! আসলেই সস্তার! সেসময় হিন্দুরা ভিটে-ঘটি-মাটি সব সস্তায় বিকিয়ে দিয়েছে! এমনকি মঞ্জু দিকেও।
মঞ্জু দিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার মা গোসাইর তো ছেলে- পুলে হলো! আর আপনার যে কিছুই হলো না?
‘প্রভুর না হইলে জগত চলবো ক্যামনে? আর আমার?’ মঞ্জু দি প্রশ্নের মতো করে উত্তর দেয়! ‘ আমার সংসার নাই ভালই হইছে। সংসার দিয়া কি হইব। প্রভু কতো বড় সংসার দিয়া গেছে। এইখানে কতো দায়-দায়িত্ব!’
দায়িত্ব, না ছাতা! তাদের মহাপ্রভু যে বিনে পয়সায় পাঁচজন দাসী কিনেছে, এটা এখনো ঠাওরাতে পারেনি মঞ্জু দিরা! অথবা পারলেও প্রতিবাদের সাহস নেই। যদি ক্ষতি হয়! অথবা নরকবাস! বাপরে! এর চেয়ে এই নরকও অনেক ভালো!
নরক নয়? মালা চন্দনের পরপরই তাঁরা ঘরের কাজ সামলেছে ! একদিনে তিন-চার মন চালের ভাত রাধা! লোক খাওয়ানো। আশ্রমে ভক্তরা এলে, তাদের দেখাশোনা। পুকুরে মাছ পাহারা! আবার জমিতে চাষ-বাস!
কিন্তু খাওয়ার বেলা?  সেখানে বুড়ো আঙ্গুল! সবাইকে খাইয়ে খেতে বসলে, দেখা যেতো তাদের জন্য কিচ্ছুটি বাকি নেই। তবুতো পেটে দানা দিতে হবে। নইলে যে শরীর চলবে না। ওদের খাওয়ার আগ মুহূর্তে কোনো অতিথি এসে পড়লে, ভাগের ভাতটা অতিথির পাতেই উঠতো!

মহাপ্রভু। তারপর তাঁর ছেলে। তারপর তার ছেলে। তিন পুরুষের কাজ করছে সখীরা। আরেক প্রজন্মও বড় হতে চলেছে। যারা সখী-ফখীর চাল বোঝে না। যারা মঞ্জু আর কাননবালাকে শুধু কাজের লোক মনে করে!
রাতে খেতে বসে দেখলাম, মাছ ভাজা হয়েছে। কিন্তু আমার পাতে পড়লো না! কি কারণ?
ওগুলো গোসাইর পরিবারের। বাইরের কেউ খেতে পাবে না। সে যত বড় ভক্তই হোক!
আপনারা খান এগুলো?
মঞ্জু দি হাসলো, ‘না আমরা, ভক্তবৃন্দ যা খায়, তাই খাই। গুসাইগো সেবার পদ আলাদা!
কি বলি আমি?
সকাল হতেই আমার শহর, আমাকে তাড়া দিতে শুরু করলো। ব্যাগ গুসিয়ে নিলাম! মঞ্জু’দি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, লুকিয়ে! ফিসফিস করে বলল, একটা শাড়ি দিবি আমারে?
হুম! কেন নয়?
‘তাইলে চকলেট রঙের একটা ছোট ফুলওলা শাড়ি দিস!
মঞ্জুদির চোখের দিকে তাকালাম! এক ফোঁটা আবেগ নেই। জল নেই ওতে! সব জল আমার চোখে!

Friday, 6 June 2014

বাঁচার উপযুক্ত পরিবেশ চাই


পরিবেশের অবক্ষয় কতদিন? 

বিনয় কৃষ্ণ পাল

কয়েকদিন আগে একটা ঘটনা পড়ছিলা্ম‌ ইউরোপের কয়েকটি দেশে নাকি এমন ব্যবস্থা চালু হয়েছে যেখানে আপনি পায়ে হেঁটে, সাইকেলে বা সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে কর্মক্ষেত্রে গেলে আপনাকে ট্যাক্স কম দিতে হবে। উপরন্তু সরকারি তরফ থেকে আরও কিছু সুযোগ সুবিধা। সুইজারল্যান্ড, সুইডেন এর কিছু মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে/ প্রকৃতির পাশে গিয়ে অত্যন্ত সাধারণ ভাবে জীবন-যাপন করছে। আরে, এটাই তো হওয়া উচিত। আমার এক বন্ধু সেদিন নরওয়ে থেকে ফিরে বলল, ওখানে যে কোন শিল্পের জন্য উৎপাদন কর (Production/ Economic Tax) ছাড়াও একটা আলাদা পরিবেশ কর (Environmental Tax) নেওয়া হয়, যা সাধারন মানুষের চিকিৎসা খাতে ব্যয় হয়। কোনও কোম্পানির উৎপাদন যত বাড়বে, সেই হারে পরিবেশ করও বাড়বে।
.
আজ ফুটবলের স্বর্গ ব্রাজিলে মানুষ বিশ্বকাপের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে, "আমরা চাই না এই বিশ্বকাপ, চাই শিক্ষার বিস্তার, সুস্বাস্থ্য, সুন্দর পরিবেশ।" হ্যাঁ, তারা খবর পেয়েছে কিভাবে দিল্লিতে কমনওয়েলথ গেমসের জন্য যমুনা নদীর ওপর অত্যাচার হয়েছে। বেজিং'এ অলিম্পিকের জন্য হাজার হাজার একর সবুজ, জমি নষ্ট হয়েছে। তারা শিক্ষা নিয়েছে। প্রণাম ব্রাজিলবাসিকে। আমি ও আমার দেশবাসী এই কাজে অক্ষম।
.
তুর্কির রাজধানী ইস্তানাবুল শহরের কেন্দ্রে একটি জনসাধারনের পার্ক (Public Park)। বয়স্ক, শিশু সহ সমস্ত মানুষের সবুজ পরিবেশের সান্নিধ্যে মন ভালো করার উপাদান। জঞ্জালের শহরের মাঝে যেন একখণ্ড সবুজ দ্বীপ। তুর্কির সরকার স্থির করল এই উদ্যানকে বন্ধ করে “সাধারনের জন্য” একটি শপিং মল করা হবে। দিনটা ২৮ মে, ২০১৩ হঠাৎ যেন বন্যার স্রোতের মত হাজার হাজার মানুষ পার্ককে ঘিরে কারো বিরুদ্ধে উন্মত্ত ভাবে শ্লোগান দিতে লাগলো। বোঝা গেল, শ্লোগানটা পার্ককে রক্ষা করার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে। এল জলকামান, অত্যাধুনিকআগ্নেয়াস্ত্র, সেনা। বেশ কিছু প্রতিবাদী গুলিতে মারাও গেল... কয়েকজন তরুণীকে পুলিশ প্রায় নগ্ন করে তুলে নিয়ে গেল। প্রতিবাদীরা বুঝল, পথের পরিবর্তন দরকার। শুরু হল আরেক নতুন অধ্যায়, সমস্ত পার্ক ও তার পারিপার্শ্বিক এলাকায় আরও মানুষ এসে জড়ো হল। সবার হাতে প্ল্যাকার্ড বা ফেস্টুন। কোনও কথা না বলে, শ্লোগান না দিয়ে রাস্তায়, ফুটপাতে দাড়িয়ে টানা কয়েকদিন প্রতিবাদ। হ্যাঁ, নিঃশব্দে প্রতিবাদ। প্ল্যাকার্ডে লেখা- “আমরা শপিং মল চাই না, সাধারনের জন্য পার্ক চাই। সুন্দর পরিবেশ চাই”। খবর ছড়িয়ে পড়ল ফেসবুক, টুইটার এর মাধ্যমে। তৈরি হল বিশ্ব জুড়ে বিশাল জনমত, সরকার পিছু হটল।
.
আজ ভারতবর্ষের সমস্ত স্কুল-বোর্ড, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ বিদ্যা একটি আবশ্যিক বিষয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই বিষয়ে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী কিছু না পড়েই পাস করে যায়। আর তারপরে এই বিষয়ের নম্বরকে কেউ ধর্তব্যেও রাখে না। আর সিলেবাস ও পরীক্ষার গুণমানও বালখিল্য ধরনের। এই ছেলেমেয়েগুলো এই ভাবেই শেখে, পরিবেশ হল একটি অবজ্ঞার-অবহেলার জিনিস। ছোটবেলা থেকে পড়ে আসছি, “জলাভুমি হল প্রকৃতির বৃক্ক, বৃক্ক যেমন দূষিত রক্ত শোধন করে জলাভূমিও প্রকৃতির দূষণ শোধন করে”। তবুও আমরা তাকে বুজিয়েই ফ্ল্যাট বানাবো, কিনবো। কেও যদি শিল্প করতে চায় তাহলে তো আর কথাই নেই। উন্নয়নের নামে হরিবোল দিয়ে শাসক-দল (বিরোধী দলের সাথে রফা করে) প্রমোটার'এর সাথে নেমে পড়বে। কোথাও শিল্প হচ্ছে শুনলে তো আমাদের যেন পকেটের ঘণ্টি বেজে ওঠে। স্বাধীনতার পর এত শিল্প, উন্নয়নে আমি কী কী পেয়েছি, পাচ্ছি, পাবো আর হারিয়েছি, হারাচ্ছি ও হারাবো সে হিসাব কেউ করি না। চারিদিকে বিজয় শঙ্খনাদ-- "উন্নয়ন হচ্ছে, শিল্প হচ্ছে, প্রগতি হচ্ছে"। আমরাও দু হাত তুলে হীরক রাজার সাকরেদদের মত বলিঃ হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক ঠিক।
 .
ছোট, মাঝারি শ্রম নির্ভর শিল্প বন্ধ করে বৃহৎ শিল্প। বৃহৎ শিল্প করে সরকার দেখাচ্ছে কিভাবে উন্নয়নের রথ চালাতে হয়। ফল মারাত্মক, প্রযুক্তিকে মানুষ সহযোগী না ভেবে তার দাস হয়ে পড়েছে। দেশে দেশে তৈরি হচ্ছে হদ্দ কুঁড়ের দল। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী অভিভাবকদের কাছে অনুনয় করছেন, “ছেলেমেয়েদের বিলাসিতার মধ্যে রেখে কর্মবিমুখ করবেন না”। এই আবেদন পরিবেশ সচেতনতার দিক থেকে নয়, উন্নয়নশীল দেশের কর্মঠ লোকেরাই আজ তাদের দেশের অন্যতম প্রধান উৎপাদক। তাই, যাতে দেশের অর্থ দেশের বাইরে চলে না যায় তাই এই অনুনয়। ইতিহাস, ভূগোল, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন থেকে শিক্ষা নিতে আমাদের খুব কাঁদায়। সেই কবে চিপকো, নর্মদা বাঁচাও হয়েছে (যার মূল উদ্দেশ্য জীবিকা-বাসস্থান সহ পরিবেশ রক্ষা)। তারপর পরিবেশ নিয়ে যেন এক শ্মশানের নীরবতা। বর্তমানে কুদানকুলাম, হরিপুর, নয়াচর'এ (মানুষের জন্য পরিবেশের স্বার্থে) রাসায়নিক, পারমাণবিক শিল্পের বিরোধিতা হল আসলে উন্নয়নের বিরোধিতা। সর্বোপরি স্বাধীন দেশের “স্বাধীন সংবাদমাধ্যম” ও জনমত তৈরিতে অনীহা দেখায় ও বিশেষ প্রচার করে না। কয়েকটি সংবাদপত্র তো সমস্ত ক্ষেত্রে বৃহৎ শিল্পের বিস্তার ঘটাতে ও প্রচারে মরণপণ পণ নিয়েছে। যে সমস্ত বিদেশি সংবাদমাধ্যম জনসাধারনের ও বিজ্ঞানীদের এই প্রতিবাদ প্রচার করতে চায় তাদের আটকানো হয়, সাংবাদিকদের খুনের হুমকি দেওয়া হয়। এখন তো আবার শুনছি বিজ্ঞানীদেরও হুমকি, ভয় দেখানো হচ্ছে। নানা ধরনের প্রলোভন তো রয়েছেই। যাতে সমাজ ও পরিবেশের স্বার্থে গবেষণা না হয়, দেশ নির্বিশেষে সরকার এই ধরনের প্রকল্পে অনুমোদন বা ফান্ড দিচ্ছে না। ভারতের ২০১৩ এর “বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন নীতি (Science, Technology and Innovation Policy of India, 2013)” এর উল্লেখযোগ্য নমুনা। দুর্ভাগা এই দেশে মানবাধিকার, শ্রমিকের অধিকার, কৃষকের অধিকার, নারীর অধিকার নিয়ে অনেক প্রতিবাদ, বনধ হয়। কিন্তু পরিবেশ নিয়ে কোন বনধ হয় না। “পরিবেশের অধিকার (আজ্ঞে হ্যাঁ, Human Rights এর মত ইংরিজিতে একে বলে Environmental Rights)” তো কোন দুর অস্ত, মানুষের সুস্থভাবে বেচে থাকার জন্য ভালো পরিবেশের অধিকারের (Human Rights to live in a Safe Environment) কথা কেউ ভুল করেও ভাবে না, বলে না।
 .
যে মানুষগুলো এককালে বনে বাদাড়ে দুটো খাওয়ার জন্য ঘুরে বেড়াতো, লজ্জা নিবারনের জন্য গাছের ছাল পরে থাকতো, অন্য প্রাণীর আক্রমন থেকে বাঁচতে গাছের ডালে ঝুলত বা গুহাতে লুকিয়ে থাকতো, আজকের পাহারাদার নিয়োগকরা, বিলাসবহুল, পাকা বাড়িতে তার নাকি এখন অস্তিত্ব সঙ্কট। "কি গরম! উফফ আর পারছি না বাবা। এবার দেখছি AC ছাড়া চলবেই না।" হ্যা, ঠিক তাই। বাতানুকুল যন্ত্র (Air Condition Machine) ও এখন "নেসেসিটি" (ভাত, ডাল, মুড়ির মত নিত্যপ্রয়োজনীয়) হয়ে পড়েছে। "ট্রেনে/ বাসে খুব কষ্ট বুঝেছো, বাস বা ট্রেন টা AC হলে খুব ভালো হত বা এবার একটা প্রাইভেট কার না হলে আর চলছে না"। যেমন ভাবে আমরা দিনে চারবার পারফিউম ব্যবহার করি নিজের গায়ের দুর্গন্ধ ঢাকতে, অথচ জানি না কি পারফিউমে কি ব্যাপক পরিমাণে CFC(ক্লোরোফ্লুরো কার্বন, যা ওজোন ও জলবায়ুর পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর) গ্যাস থাকে ও তা অন্যভাবে আমাদের জন্যই বিপদবার্তা। রেল ষ্টেশনে/ রাস্তায় দাড়িয়ে সাহেবি ঢঙে সিগারেট জ্বালিয়ে অন্যের মুখের সামনে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে তৃপ্তি অনুভব করি। প্রকৃতির ডাককে একটু সামলে না রেখে, লাজলজ্জার মাথা খেয়ে দেওয়ালের সামনে বা ফাঁকা যায়গায় প্যান্টের চেন খুলে দাড়িয়ে পড়ি। আসলে ব্যপারটা হল আমাদের ভেতরের দুর্গন্ধ-জঞ্জালের চেয়ে বাইরের দুর্গন্ধ-কদর্যতাই আমাদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়। তাই যে মানুষগুলো হাজার হাজার বছর ধরে প্রকৃতিকে বুঝে তার সাথে খাপ খাইয়ে চাষবাস করে কৌম্য-জীবন (Community Life) যাপন করে এসেছে অতিলোভী-সভ্য মানুষের কাছে তারা হয়ে যায় গাঁইয়া, আদিম, অসভ্য। তাদের জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-অনুভুতি এগুলোকে অতিক্রম করে আমরা হয়ে যাই সভ্য-শিক্ষিত নাগরিক। সভ্যতা মানে কি স্বাভাবিক-কষ্টসাধ্য বিষয় গুলিকে এড়িয়ে নিজের সুবিধা মত সব কিছু কে চালিত করা? প্রকৃতি কে না বুঝে পরিবর্তন করা? সমাজ ও পৃথিবীকে ধংসের দিকে নিয়ে যাওয়া? নাকি কেবল সেমিনার-কনফারেন্স এ পরিবেশ সচেতনতার বুলি আওড়ানো? আর পাঁচজন মানুষের সাথে ভদ্র-সভ্য ব্যবহার, বিপদে আপদে তাদের পাশে থাকা, ও সময় মতো বুঝিয়ে দেওয়া যা হচ্ছে মেনে নিন, কী আর করবেন? আপনি আমি নিমিত্ত মাত্র। সস্তার জনপ্রিয়তাই যেন মূল লক্ষ্য। ব্যক্তিজীবনে প্রয়োগ না হলে পরিবেশ রক্ষার দাবি উঠবে কী করে??
.
তাই দাবি উঠুক, ঢেউ ছড়িয়ে পড়ুক রাস্তায়- প্রকৃত বিজ্ঞান ও পরিবেশ শিক্ষার বিস্তার চাই, সুন্দর স্বাস্থ্যের জন্য সুন্দর পরিবেশ, চাই একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বাঁচতে একটা পরিবেশবান্ধব কাজ চাই। বন্ধ হোক পরিবেশ ধংস করে মানুষকে লোভী বানানোর এই "খুড়োর কল"। তলস্তয় এর একটা উক্তি মনে পড়লো- “সব্বাই পৃথিবীকে পরিবর্তন করার কথা ভাবে, কিন্তু কেউ নিজেকে পরিবর্তন করার কথা ভাবে না।”