জোট রাজনীতির অগ্নিপরীক্ষা
মালবিকা মিত্র
আজ (২৪ জুলাই) INDIA জোটের প্রথম ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ আন্দোলন প্রত্যক্ষ করলেন দেশবাসী। সংসদের উভয় কক্ষে মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি ও বক্তব্য দাবি করে INDIA জোটের শরিকেরা দিনভর সংসদের ভেতরে ও বাইরে সোচ্চার হলেন। এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ কি আগামী দিনে সত্যিই এক নতুন রাজনীতির সূত্রপাত করতে পারবে? আমাদের রাজ্যে এই জোটের সমীকরণই বা কীভাবে এগোবে?
খানিক ইতিহাস থেকে শুরু করা যাক।
১৯২৭-৩৬ সালে চিন দেশের অভ্যন্তরে চলছে গৃহযুদ্ধ। কুয়োমিনতাং ও কমিউনিস্ট লাল ফৌজের মধ্যে লাগাতার সংঘর্ষ। তখনও রোম-বার্লিন অক্ষশক্তি সুদৃঢ় হয়নি। Israel Epstain লিখেছেন, 'Nazi Germany and Fascist Italy were using Chiang's civil war against the people to establish their influence in China in preparation for their later bid for world power. The Germans penetrated deeply into the fabric of the Kuomintang army and police force.'। ভাবুন একবার, নাৎসি জার্মানি ও ফ্যাসিস্ট ইতালি সুকৌশলে চিনা জনগণ ও কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে কুয়োমিনতাং'কে সাহায্য করার মাধ্যমে চিনের অভ্যন্তরে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। এমনকি কুয়োমিনতাং সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর কাঠামোর অভ্যন্তরে জার্মানি জাঁকিয়ে বসেছিল। স্পষ্টতই কুয়োমিনতাং'এর কাছে ফ্যাসিস্ট বিরোধিতা, দেশ বা জাতীয় স্বার্থ অপেক্ষা দলীয় স্বার্থ ছিল প্রধান।
অপর পক্ষে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ঘোষিত বিবৃতিতে প্রশান্ত মহাসাগরে শান্তি রক্ষা, চিনের অখন্ডতা রক্ষা, জাপানের আগ্রাসন প্রতিহত করার কথা বলা হলেও, কার্যক্ষেত্রে জাপানকে পেট্রোলিয়াম জ্বালানি, ইস্পাত রফতানি অব্যাহত রাখে। এগুলো ছাড়া জাপানের যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্ভব হত না।
এইসব কথার অবতারণা এই জন্য যে, কুয়োমিনতাং'এর এই বিশ্বস্ততার অভাবের কথা জেনেও মাও সেতুং জাপান বিরোধী দেশপ্রেমিক যুক্তফ্রন্টে কুয়োমিনতাং'এর সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। এমনকি মাও তার 'শ্রমিক কৃষকের প্রজাতন্ত্র' প্রতিষ্ঠার শ্লোগান মুলতুবি রেখে সমগ্র দেশের 'শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, পেটি বুর্জোয়া, জাতীয় বুর্জোয়াদের' সংহতি গঠন করে 'সংযুক্ত জাতীয় বিপ্লবী ফ্রন্ট' গঠনের আহ্বান জানান। মাও কুয়োমিনতাং'এর সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি আপস মীমাংসার আবেদন প্রচার করেন: আভ্যন্তরীণ পারস্পরিক শান্তি ও সহযোগিতা এবং জাপ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যৌথ সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা। সেখানে সরাসরি বলা হয়: Chinese must not fight Chinese! Resist Japan!
অক্ষশক্তি বিরোধী জোট, জাপ বিরোধী জোট সবই কত ক্ষণস্থায়ী ও দ্বন্দ্ববিদীর্ণ। স্তালিন বা মাও এটা জানতেন, বুঝতেন। কিন্তু আন্তরিক ভাবে জোটের পক্ষে সওয়াল করে গেছেন। এর ফলে, পশ্চিমী পুঁজিবাদ অন্তত খোলামেলা প্রত্যক্ষ সোভিয়েত বিরোধী কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে, কুয়োমিনতাং সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি বৃহৎ অংশ চিয়াং কাইশেক'এর দেশ বিরোধী ও জাতীয়তাবাদ বিরোধী রূপটি বুঝতে পারে। তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। কুয়োমিনতাং জাপ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যতটা যুদ্ধ প্রয়াস চালায় তার চেয়ে ঢের বেশি আক্রমণাত্মক ছিল কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে। কয়েক লক্ষ কমিউনিস্টকে হত্যা করে কুয়োমিনতাং। এটাই কুয়োমিনতাং সেনাবাহিনী ও জনসাধারণের মধ্যে চিয়াং কাইশেক'কে নগ্ন ভাবে উন্মোচিত করে দেয়। জাপ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদের দোসর চিয়াং কাইশেকের পতন ঘটায়।
জোট বা ফ্রন্টের রাজনীতি অত্যন্ত ভারসাম্য দাবি করে। জোটের সিদ্ধান্ত মেনে চলা, আবার নিজস্ব দলীয় স্বাধীন কর্মধারা বজায় রাখার সূক্ষ্ম ভারসাম্য। কাজটি কঠিন। আমি কখনও বলতে পারি না যে, 'বেঙ্গালুরু আমাদের দলের গাইড লাইন ঠিক করে দেয় না'। তাহলে আমি বেঙ্গালুরুতে জোটের সভায় কি পেঁয়াজ ছাড়াতে গিয়েছিলাম? ওই গাইড লাইন আমাকেও মানতে হবে! একটু খোলসা করে বলি, ধরুন এই বাংলায় সিপিএমের জোট সঙ্গী কংগ্রেস। তা হল কি, কেরালায় কংগ্রেসের হাতে দুজন ডিওয়াইএফআই কর্মী খুন হলেন। কেরালা রাজ্যের পার্টি, কেন্দ্রীয় কমিটি এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া দেখাতেই পারে। সেটাই স্বতন্ত্র কর্মধারা। কিন্তু এই বাংলায় অলিতে গলিতে যেভাবে শহীদ বেদী, পোস্টার, কংগ্রেসি গুণ্ডা, রক্তঋণ শোধ করার ডাক- এটা ছিল কংগ্রেসের সাথে সিপিএমের জোট বিরোধী কার্যকলাপ।
বেঙ্গালুরু বিরোধী জোটের সভায় INDIA নামকরণ স্বীকৃত হবার পর ২১ জুলাইয়ের সভায় বক্তৃতায় এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বেশ সংযমের পরিচয় রেখেছেন। একবার মাত্র ২০০৩ ও ২০০৮'এ পঞ্চায়েত নির্বাচনে মৃত্যুর প্রসঙ্গ এনেছেন। এটা ছাড়া INDIA জোটের কথাই বারংবার উল্লেখ করেন। লক্ষণীয়, মণিপুরে INDIA জোটের প্রতিনিধিদের যাবার কথা বলেন। বলেন কেরলে INDIA, কর্নাটকে INDIA, বিহারে INDIA, বাংলায় INDIA: বিজেপি বিরোধী জোটটাকে খুব গুরুত্ব দিয়েছেন। এমনকি মমতা ও রাহুল দুজনেই স্পষ্ট করে ঘোষণা করেছেন, কে প্রধানমন্ত্রী হবে সেটা বড় কথা নয়। বিজেপি আর নয়- এই মেজাজটা ধরে রাখা জরুরি।
বিজেপিকে এ রাজ্যে স্থান করে দিয়েছে মমতা- এ বিতর্কে ঢুকলে ১৯৭৭'এ জনসঙ্ঘ, ভিপি সিং সরকারের মাধ্যমে বিজেপির অনুপ্রবেশ, রাজীব গান্ধীর হাতেই রামলালা মূর্তির প্রতিষ্ঠা, এ বিতর্ক চলবেই। জরুরি অবস্থা পরবর্তীতে রাজনৈতিক দাবি সিপিএমকে জনসঙ্ঘের হাত ধরিয়েছিল। একই ভাবে ৩৪ বছরের বাম শাসনের বাস্তবতায় পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে তৃণমূল বিজেপির হাত ধরেছিল। আবার ২০২১ সালে তৃণমূলই তাকে প্রতিরোধ করেছে। কারণ, 'আগে রাম পরে বাম' তত্ত্ব কার্যত বিজেপিকে সেফ প্যাসেজ ছেড়ে দিয়েছিল। 'তুই বিড়াল না মুই বিড়াল' কাজিয়া জোট শক্তিকে দুর্বল করবে। পুরনো কাসুন্দি না ঘাঁটাঘাঁটি শ্রেয়।
জোটের স্বার্থে এই রাজ্যে কংগ্রেসকে একটা আসন ছাড়া যেতে পারে, আবার ছাড়তেই হবে এমন বায়না ধরাও হবে জোট বিরোধী। কেরলে মমতা আসন চাইলে সেটাও হবে জোটের নাশকতা। জোটের জয়ী প্রার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই প্রথম পছন্দ। যেখানে জোট বিরোধী প্রার্থী জিতেছিলেন সেখানে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী হবে স্বাভাবিক পছন্দ। বহুমাত্রিক বহুদলীয় যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামোতে ছোট ছোট আঞ্চলিক বিরোধকে সরিয়ে রাখতে হবে। দলীয় সংকীর্ণতাকে বর্জন করতে হবে। এক একটা সময়ের কিছু দাবি থাকে। সেটা বুঝতে হবে। না বুঝলে রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে হবে।
ধরুন না, ২০২১'এর বিধানসভা নির্বাচন। সাধারণ একটা মেজাজ ছিল 'নো ভোট টু বিজেপি'। এনআরসি, সিএএ, হাথরাস, কৃষি আইন, শাহিনবাগ, জেএনইউ সব মিলিয়ে একটা হাওয়া। সর্বভারতীয় স্তরে এই আন্দোলনগুলির সাথে সিপিএম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত। কিন্তু এ রাজ্যে 'নো ভোট টু বিজেপি' কর্মসূচিতে কোথাও সিপিএমের অংশ ছিল না। এমনকি হান্নান মোল্লা কোনও মঞ্চে ছিলেন না। বিপরীতে সিঙ্গুরে বেচারাম মান্না সভাস্থলে ট্রাফিক সামলাচ্ছেন, কোথায় অটো, টু হুইলার, মোটর কার পার্কিং হবে দেখভাল করছেন। মঞ্চে না থেকেই নিজের উপস্থিতি জানাচ্ছেন। কী বলবেন? আন্দোলনটা তৃণমূল হাইজ্যাক করে নিয়ে গেল? মানুষ বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলকে খুঁজে পেয়েছে। অন্যদিকে সিপিএম ও কংগ্রেসের কট্টর ভোট ব্যাঙ্ক বুঝতে পারল, তৃণমূলকে ঠেকাতে পারবে একমাত্র বিজেপি। বামের ভোট অনিবার্য ভাবে গেল রামে। বিধানসভায় সিপিএম-কংগ্রেসের কোনও অস্তিত্ব রইল না।
দলীয় সঙ্কীর্ণতা কত দূর প্রসারিত ভাবুন একবার। কেরলে সিপিএম পরিচালিত সরকার। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী টমাস আইজ্যাক কেন্দ্রের কাছে ২৮ হাজার কোটি টাকা জিএসটি বকেয়া দাবি করছেন। আর এই রাজ্যের জিএসটি বকেয়ার দাবিকে সুজন-সেলিম ব্যঙ্গ করছেন। কেরলে রাজ্যপালের স্বেচ্ছাচার নিয়ে যখন প্রতিবাদ চলছে, এ রাজ্যের রাজ্যপালের স্বেচ্ছাচার নিয়ে পরোক্ষ মজা দেখা চলছে। 'দেশের সীমান্ত রক্ষা করাই সশস্ত্র বাহিনীর কাছ থেকে প্রত্যাশিত... শাসক শ্রেণী ক্রমশ বেশি বেশি করে সশস্ত্র বাহিনী ও আধা সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করে... জনগণকে দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়... মৌলিক অধিকারের প্রয়োগ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কেন্দ্রীয় বিধি নিষেধ জারি রেখে গোটা এলাকায় মানুষের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হয়।' এ তো সিপিএম'এর পার্টি কর্মসূচির কথা।
আজ সর্বভারতীয় স্তরে সেই একই মেজাজ। এখানে হয় জোটের পক্ষে অথবা বিজেপির পক্ষে- অন্য বিকল্প নেই। রাহুল-মমতা সেটা উপলব্ধি করতে পারছেন, কেজরিওয়াল অনেক বেশি নমনীয়। এমনকি এক সময়ে যে বিহারে আরজেডি'র শাসনকালে শাসকের হাতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন'এর বহু নেতা-কর্মীদের প্রাণ গেছে, আজ এই বিদীর্ণ সময়ে উভয় দলই কিন্তু এক জায়গায় এসেছে। এটাই জোট রাজনীতি, যা ক্ষণস্থায়ী কিন্তু এক বড় মারাত্মক বিপদের বিরুদ্ধে সময়ের দাবিতে জোটবদ্ধতা। সকলেই সময়ের ডাক শুনতে পাচ্ছেন। এ রাজ্যের বিরোধী দল শুনতে পাচ্ছে কী?