Pages

Monday, 24 July 2023

INDIA: যুক্তরাষ্ট্রের কন্ঠস্বর?

জোট রাজনীতির অগ্নিপরীক্ষা

মালবিকা মিত্র



আজ (২৪ জুলাই) INDIA জোটের প্রথম ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ আন্দোলন প্রত্যক্ষ করলেন দেশবাসী। সংসদের উভয় কক্ষে মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি ও বক্তব্য দাবি করে INDIA জোটের শরিকেরা দিনভর সংসদের ভেতরে ও বাইরে সোচ্চার হলেন। এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ কি আগামী দিনে সত্যিই এক নতুন রাজনীতির সূত্রপাত করতে পারবে? আমাদের রাজ্যে এই জোটের সমীকরণই বা কীভাবে এগোবে? 

খানিক ইতিহাস থেকে শুরু করা যাক। 

১৯২৭-৩৬ সালে চিন দেশের অভ্যন্তরে চলছে গৃহযুদ্ধ। কুয়োমিনতাং ও কমিউনিস্ট লাল ফৌজের মধ্যে লাগাতার সংঘর্ষ। তখনও রোম-বার্লিন অক্ষশক্তি সুদৃঢ় হয়নি। Israel Epstain লিখেছেন, 'Nazi Germany and Fascist Italy were using Chiang's civil war against the people to establish their influence in China in preparation for their later bid for world power. The Germans penetrated deeply into the fabric of the Kuomintang army and police force.'। ভাবুন একবার, নাৎসি জার্মানি ও ফ্যাসিস্ট ইতালি সুকৌশলে চিনা জনগণ ও কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে কুয়োমিনতাং'কে সাহায্য করার মাধ্যমে চিনের অভ্যন্তরে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। এমনকি কুয়োমিনতাং সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর কাঠামোর অভ্যন্তরে জার্মানি জাঁকিয়ে বসেছিল। স্পষ্টতই কুয়োমিনতাং'এর কাছে ফ্যাসিস্ট বিরোধিতা, দেশ বা জাতীয় স্বার্থ অপেক্ষা দলীয় স্বার্থ ছিল প্রধান। 

অপর পক্ষে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ঘোষিত বিবৃতিতে প্রশান্ত মহাসাগরে শান্তি রক্ষা, চিনের অখন্ডতা রক্ষা, জাপানের আগ্রাসন প্রতিহত করার কথা বলা হলেও, কার্যক্ষেত্রে জাপানকে পেট্রোলিয়াম জ্বালানি, ইস্পাত রফতানি অব্যাহত রাখে। এগুলো ছাড়া জাপানের যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্ভব হত না।

এইসব কথার অবতারণা এই জন্য যে, কুয়োমিনতাং'এর এই বিশ্বস্ততার অভাবের কথা জেনেও মাও সেতুং জাপান বিরোধী দেশপ্রেমিক যুক্তফ্রন্টে কুয়োমিনতাং'এর সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। এমনকি মাও তার 'শ্রমিক কৃষকের প্রজাতন্ত্র' প্রতিষ্ঠার শ্লোগান মুলতুবি রেখে সমগ্র দেশের 'শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, পেটি বুর্জোয়া, জাতীয় বুর্জোয়াদের' সংহতি গঠন করে 'সংযুক্ত জাতীয় বিপ্লবী ফ্রন্ট' গঠনের আহ্বান জানান। মাও কুয়োমিনতাং'এর সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি আপস মীমাংসার আবেদন প্রচার করেন: আভ্যন্তরীণ পারস্পরিক শান্তি ও সহযোগিতা এবং জাপ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যৌথ সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা। সেখানে সরাসরি বলা হয়: Chinese must not fight Chinese! Resist Japan! 

অক্ষশক্তি বিরোধী জোট, জাপ বিরোধী জোট সবই কত ক্ষণস্থায়ী ও দ্বন্দ্ববিদীর্ণ। স্তালিন বা মাও এটা জানতেন, বুঝতেন। কিন্তু আন্তরিক ভাবে জোটের পক্ষে সওয়াল করে গেছেন। এর ফলে, পশ্চিমী পুঁজিবাদ অন্তত খোলামেলা প্রত্যক্ষ সোভিয়েত বিরোধী কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে, কুয়োমিনতাং সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি বৃহৎ অংশ চিয়াং কাইশেক'এর দেশ বিরোধী ও জাতীয়তাবাদ বিরোধী রূপটি বুঝতে পারে। তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। কুয়োমিনতাং জাপ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যতটা যুদ্ধ প্রয়াস চালায় তার চেয়ে ঢের বেশি আক্রমণাত্মক ছিল কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে। কয়েক লক্ষ কমিউনিস্টকে হত্যা করে কুয়োমিনতাং। এটাই কুয়োমিনতাং সেনাবাহিনী ও জনসাধারণের মধ্যে চিয়াং কাইশেক'কে নগ্ন ভাবে উন্মোচিত করে দেয়। জাপ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদের দোসর চিয়াং কাইশেকের পতন ঘটায়। 

জোট বা ফ্রন্টের রাজনীতি অত্যন্ত ভারসাম্য দাবি করে। জোটের সিদ্ধান্ত মেনে চলা, আবার নিজস্ব দলীয় স্বাধীন কর্মধারা বজায় রাখার সূক্ষ্ম ভারসাম্য। কাজটি কঠিন। আমি কখনও বলতে পারি না যে, 'বেঙ্গালুরু আমাদের দলের গাইড লাইন ঠিক করে দেয় না'। তাহলে আমি বেঙ্গালুরুতে জোটের সভায় কি পেঁয়াজ ছাড়াতে গিয়েছিলাম? ওই গাইড লাইন আমাকেও মানতে হবে! একটু খোলসা করে বলি, ধরুন এই বাংলায় সিপিএমের জোট সঙ্গী কংগ্রেস। তা হল কি, কেরালায় কংগ্রেসের হাতে দুজন ডিওয়াইএফআই কর্মী খুন হলেন। কেরালা রাজ্যের পার্টি, কেন্দ্রীয় কমিটি এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া দেখাতেই পারে। সেটাই স্বতন্ত্র কর্মধারা। কিন্তু এই বাংলায় অলিতে গলিতে যেভাবে শহীদ বেদী, পোস্টার, কংগ্রেসি গুণ্ডা, রক্তঋণ শোধ করার ডাক- এটা ছিল কংগ্রেসের সাথে সিপিএমের জোট বিরোধী কার্যকলাপ। 

বেঙ্গালুরু বিরোধী জোটের সভায় INDIA নামকরণ স্বীকৃত হবার পর ২১ জুলাইয়ের সভায় বক্তৃতায় এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বেশ সংযমের পরিচয় রেখেছেন। একবার মাত্র ২০০৩ ও ২০০৮'এ পঞ্চায়েত নির্বাচনে মৃত্যুর প্রসঙ্গ এনেছেন। এটা ছাড়া INDIA জোটের কথাই বারংবার উল্লেখ করেন। লক্ষণীয়, মণিপুরে INDIA জোটের প্রতিনিধিদের যাবার কথা বলেন। বলেন কেরলে INDIA, কর্নাটকে INDIA, বিহারে INDIA, বাংলায় INDIA: বিজেপি বিরোধী জোটটাকে খুব গুরুত্ব দিয়েছেন। এমনকি মমতা ও রাহুল দুজনেই স্পষ্ট করে ঘোষণা করেছেন, কে প্রধানমন্ত্রী হবে সেটা বড় কথা নয়। বিজেপি আর নয়- এই মেজাজটা ধরে রাখা জরুরি। 

বিজেপিকে এ রাজ্যে স্থান করে দিয়েছে মমতা- এ বিতর্কে ঢুকলে ১৯৭৭'এ জনসঙ্ঘ, ভিপি সিং সরকারের মাধ্যমে বিজেপির অনুপ্রবেশ, রাজীব গান্ধীর হাতেই রামলালা মূর্তির প্রতিষ্ঠা, এ বিতর্ক চলবেই। জরুরি অবস্থা পরবর্তীতে রাজনৈতিক দাবি সিপিএমকে জনসঙ্ঘের হাত ধরিয়েছিল। একই ভাবে ৩৪ বছরের বাম শাসনের বাস্তবতায় পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে তৃণমূল বিজেপির হাত ধরেছিল। আবার ২০২১ সালে তৃণমূলই তাকে প্রতিরোধ করেছে। কারণ, 'আগে রাম পরে বাম' তত্ত্ব কার্যত বিজেপিকে সেফ প্যাসেজ ছেড়ে দিয়েছিল। 'তুই বিড়াল না মুই বিড়াল' কাজিয়া জোট শক্তিকে দুর্বল করবে। পুরনো কাসুন্দি না ঘাঁটাঘাঁটি শ্রেয়। 

জোটের স্বার্থে এই রাজ্যে কংগ্রেসকে একটা আসন ছাড়া যেতে পারে, আবার ছাড়তেই হবে এমন বায়না ধরাও হবে জোট বিরোধী। কেরলে মমতা আসন চাইলে সেটাও হবে জোটের নাশকতা। জোটের জয়ী প্রার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই প্রথম পছন্দ। যেখানে জোট বিরোধী প্রার্থী জিতেছিলেন সেখানে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী হবে স্বাভাবিক পছন্দ। বহুমাত্রিক বহুদলীয় যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামোতে ছোট ছোট আঞ্চলিক বিরোধকে সরিয়ে রাখতে হবে। দলীয় সংকীর্ণতাকে বর্জন করতে হবে। এক একটা সময়ের কিছু দাবি থাকে। সেটা বুঝতে হবে। না বুঝলে রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে হবে। 

ধরুন না, ২০২১'এর বিধানসভা নির্বাচন। সাধারণ একটা মেজাজ ছিল 'নো ভোট টু বিজেপি'। এনআরসি, সিএএ, হাথরাস, কৃষি আইন, শাহিনবাগ, জেএনইউ সব মিলিয়ে একটা হাওয়া। সর্বভারতীয় স্তরে এই আন্দোলনগুলির সাথে সিপিএম প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত। কিন্তু এ রাজ্যে 'নো ভোট টু বিজেপি' কর্মসূচিতে কোথাও সিপিএমের অংশ ছিল না। এমনকি হান্নান মোল্লা কোনও মঞ্চে ছিলেন না। বিপরীতে সিঙ্গুরে বেচারাম মান্না সভাস্থলে ট্রাফিক সামলাচ্ছেন, কোথায় অটো, টু হুইলার, মোটর কার পার্কিং হবে দেখভাল করছেন। মঞ্চে না থেকেই নিজের উপস্থিতি জানাচ্ছেন। কী বলবেন? আন্দোলনটা তৃণমূল হাইজ্যাক করে নিয়ে গেল? মানুষ বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলকে খুঁজে পেয়েছে। অন্যদিকে সিপিএম ও কংগ্রেসের কট্টর ভোট ব্যাঙ্ক বুঝতে পারল, তৃণমূলকে ঠেকাতে পারবে একমাত্র বিজেপি। বামের ভোট অনিবার্য ভাবে গেল রামে। বিধানসভায় সিপিএম-কংগ্রেসের কোনও অস্তিত্ব রইল না। 

দলীয় সঙ্কীর্ণতা কত দূর প্রসারিত ভাবুন একবার। কেরলে সিপিএম পরিচালিত সরকার। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী টমাস আইজ্যাক কেন্দ্রের কাছে ২৮ হাজার কোটি টাকা জিএসটি বকেয়া দাবি করছেন। আর এই রাজ্যের জিএসটি বকেয়ার দাবিকে সুজন-সেলিম ব্যঙ্গ করছেন। কেরলে রাজ্যপালের স্বেচ্ছাচার নিয়ে যখন প্রতিবাদ চলছে, এ রাজ্যের রাজ্যপালের স্বেচ্ছাচার নিয়ে পরোক্ষ মজা দেখা চলছে। 'দেশের সীমান্ত রক্ষা করাই সশস্ত্র বাহিনীর কাছ থেকে প্রত্যাশিত... শাসক শ্রেণী ক্রমশ বেশি বেশি করে সশস্ত্র বাহিনী ও আধা সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করে... জনগণকে দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়... মৌলিক অধিকারের প্রয়োগ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কেন্দ্রীয় বিধি নিষেধ জারি রেখে গোটা এলাকায় মানুষের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হয়।' এ তো সিপিএম'এর পার্টি কর্মসূচির কথা।

আজ সর্বভারতীয় স্তরে সেই একই মেজাজ। এখানে হয় জোটের পক্ষে অথবা বিজেপির পক্ষে- অন্য বিকল্প নেই। রাহুল-মমতা সেটা উপলব্ধি করতে পারছেন, কেজরিওয়াল অনেক বেশি নমনীয়। এমনকি এক সময়ে যে বিহারে আরজেডি'র শাসনকালে শাসকের হাতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন'এর বহু নেতা-কর্মীদের প্রাণ গেছে, আজ এই বিদীর্ণ সময়ে উভয় দলই কিন্তু এক জায়গায় এসেছে। এটাই জোট রাজনীতি, যা ক্ষণস্থায়ী কিন্তু এক বড় মারাত্মক বিপদের বিরুদ্ধে সময়ের দাবিতে জোটবদ্ধতা। সকলেই সময়ের ডাক শুনতে পাচ্ছেন। এ রাজ্যের বিরোধী দল শুনতে পাচ্ছে কী?


Saturday, 22 July 2023

সমর বাগচী

'বৃক্ষমূলে আমার ঘনিষ্ঠতম কথা রেখে দিয়েছি'

তুষার চক্রবর্তী



(১৯৩৩ - ২০২৩)

 

'একক মাত্রা' পত্রিকার সৌভাগ্য, একেবারে শুরু থেকে লেখক, পাঠক, আজীবন গ্রাহক ও শুভানুধ্যায়ী হিসেবে তো বটেই, অভিভাবক ও পরামর্শদাতা হিসেবেও সমর বাগচীর নিরন্তর সান্নিধ্য এই পত্রিকা পেয়ে এসেছে। পরিচালনা করেছেন 'একক মাত্রা'র বিষয়কেন্দ্রিক আড্ডা। সাহায্য করেছেন নানা ভাবে। তাঁর মৃত্যু আমাদের তাই বিশেষ ভাবে রিক্ত করে দিল।  

বয়সকে কী করে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বিভিন্ন মতামতের মানুষকে নিয়ে সামাজিক কাজে ব্যাপৃত হওয়া যায়- এই দুটো বিষয়ে সমর বাগচী ছিলেন বঙ্গসমাজে উজ্জ্বল এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। গত কয়েক বছর শারীরিক অসুস্থতায় যখন হাসপাতালে ঘনঘন যেতে হচ্ছে, তখনও তিনি মাঝের ফাঁকগুলি ভরিয়ে রাখতেন কাজ কাজ আর কাজে। বিজ্ঞান শিক্ষা, প্রকৃতি ধ্বংসের যে কোনও উদ্যোগকে প্রতিরোধ করা ও গরিব মানুষের অধিকার আদায়ের জনআন্দোলনের কোনও কাজ বা কর্মসূচিই সমর বাগচীকে বাদ দিয়ে সম্পন্ন হতে পারে, এমনটা কেউ ভাবতে পারেনি। এ ধরনের প্রায় প্রতিটি কর্মসূচির শুরুতেই তিনি হাজির থেকেছেন অর্থ ও সামর্থ্য নিয়ে। ডেকে এনেছেন নানা বয়সের, নানা ক্ষেত্রের বন্ধুদের। কর্মসূচিকে সাফল্যমণ্ডিত করেছেন। এবং যদি কোনও আর্থিক ঘাটতি থেকে থাকে, তা যথাসাধ্য পূরণ করার দায় বহন করা থেকে তাঁকে কোনওভাবেই কখনও ঠেকানো যায়নি। এমন একজন সমাজবন্ধু মানুষের অভাব এখন থেকে আমাদের তাই প্রায় প্রতিদিন পদে পদে অনুভব করতে হবে।

'একক মাত্রা' যাত্রা শুরু করেছিল বিশ্বায়নের শুরুতেই- ১৯৯৮ সালে- 'একক সাময়িকী' হিসেবে। প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ বিষয় ছিল 'বিশ্বায়ন'। নিবন্ধিকৃত হয়ে 'একক মাত্রা' নামে তা নিয়মিত প্রকাশিত হতে শুরু করল ২০০০ সাল থেকে। এই প্রথম বছরে নভেম্বর মাসে প্রকাশিত তৃতীয় সংখ্যার প্রচ্ছদ বিষয় ছিল 'প্রযুক্তি ও ভবিষ্যৎ'। সেই সংখ্যায় 'প্রযুক্তির মুক্তির সন্ধানে' শিরোনামে সমর বাগচী, কীভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে হাইজ্যাক করেছে পুঁজি ও ভোগবাদী আকাঙ্ক্ষা, তা নানা উদাহরণ দিয়ে দেখান। তিনি বিশ্বাস করতেন, এর বিপরীতে এক সাম্যপূর্ণ কল্যাণকর ও টেকসই উন্নয়নের বিকল্প পথ আমাদের বেছে নিতে হবে এবং প্রকৃতি বিধ্বংসী বর্তমান জীবন প্রণালী থেকে মানুষ মুখ ঘোরাবেই ঘোরাবে। গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ও মার্কস'এর নিবিড় পাঠ তাঁর এই বিশ্বাসকে পোক্ত করেছিল। সব থেকে বড় কথা হল, শুধু ব্যক্তিগত আবেগের প্রকাশ হিসেবে নয়, BITM'এর অধিকর্তার পদ থেকে অবসর নেবার পর তাঁর প্রতিটি কাজ ছিল এই লক্ষ্যের দিকে এগোবার একেকটি পদক্ষেপ। এই প্রবন্ধের কথাগুলি সমর বাগচী'র অনেক লেখায় ও প্রায় প্রতিটি বক্তৃতায় ঘুরে ফিরে এসেছে।

'একক মাত্রা'র বর্তমান সংখ্যার প্রচ্ছদ বিষয়, সকলেই জানেন, 'জলাভূমি'। আমাদের পরিবেশ ভাবনায় জলাভূমি এখনও অবহেলিত বিষয়। 'একক মাত্রা'য় প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধে সমরবাবু আজ থেকে দু' দশক আগেই লিখেছিলেন: 'পৃথিবীর সমস্ত জলাভূমি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পুকুর, নদী ও সমুদ্রের জল দূষিত হচ্ছে। এর ফলে জলে অবস্থান করে যে জীববৈচিত্র তা দ্রুত হারে নিঃশেষিত হচ্ছে।' আর, রোগশয্যা থেকেও আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন একটি দীর্ঘ লেখা: 'ভারতবর্ষ কোন পথে?'। দুই কিস্তিতে এই লেখাটি স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত হয় 'একক মাত্রা' ব্লগে। বিগত ৭৫ বছরের যাত্রাপথের মূল ভ্রান্তি, ১৯৬৩ সালে নেহরুর গান্ধীকে ভুল বোঝা ও ভুল পথ বেছে নেবার স্বীকৃতি, আজকের জনজীবনের সংকট অতিক্রম করার একটি সম্ভাব্য রূপরেখাও তিনি যেখানে তুলে ধরেন।

আজ মানুষের বাসভূমি এই গ্রহ আর বিশ্বের সব চাইতে জনবহুল ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ আমাদের দেশ– দুইই এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। অরুণ মিত্রের যে কবিতা সমর বাগচী কখনও বক্তব্যের শুরুতে, কখনও শেষে উপস্থাপিত করতেন, তার মধ্যেই ধরা আছে অবিস্মরণীয় এই বিজ্ঞান–দার্শনিকের মূল সঞ্জীবনী বার্তা-

'বৃক্ষমূলে আমার ঘনিষ্ঠতম কথা রেখে দিয়েছি

আমার সমস্ত আত্মীয়তার মধ্যে

কেননা আকুল জল এখানেই ঢালা হয়েছিল...'

 

         

              ,       

Wednesday, 19 July 2023

পোস্ট মর্টেম: পঞ্চায়েত নির্বাচন ২০২৩

সেই পরম্পরাই চলেছে

কুশল দেবনাথ



শেষ হল পঞ্চায়েত নির্বাচন। প্রায় ৬০ জনের জীবনহানির মধ্য দিয়ে হিংসাদীর্ণ ও রক্তাক্ত এই নির্বাচন প্রক্রিয়া চলল। 

২০১৮ সালের সন্ত্রাস কবলিত পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রেক্ষিতে এই বছর বহু আগে থেকেই নাগরিক সমাজের বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছিল- হিংসামুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত, মৃত্যুহীন পঞ্চায়েত নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু দেখা গেল, এবারেও পঞ্চায়েত নির্বাচন সন্ত্রাস মুক্ত হল না। 

বস্তুত, এই রাজ্যে ভোট সন্ত্রাস কোনও নতুন ঘটনা নয়। লোকসভা, বিধানসভা, পঞ্চায়েত সহ বিভিন্ন স্বায়ত্বশাসনের ভোটে সন্ত্রাস হয়েই চলে। ১৯৭২ সালে বিধানসভা নির্বাচনে পুলিশের মদতে কংগ্রেসি গুন্ডাদের তাণ্ডব ভয়ংকর রূপ নিয়েছিল। নব-কংগ্রেসের নেতৃত্বে বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট, লোককে ভোট দিতে না দেওয়া, সশস্ত্র গুন্ডাদের তাণ্ডব সমস্ত সীমারেখা অতিক্রম করেছিল। আবার বাম সরকারের ৩৪ বছরের সময়ে বিভিন্ন জায়গায় এই ভোট সন্ত্রাস মাত্রাতিরিক্ত অবস্থায় পৌঁছেছিল। বিরোধী শক্তিকে কোনও জায়গা দেব না, মানুষকে ভোট দিতে দেব না- এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সিপিআই(এম) কর্মীরা প্রশাসনের সহযোগিতায় ব্যাপক সন্ত্রাস চালিয়েছিল। ভোট সন্ত্রাসের পরিচালক হিসেবে অনিল বসু, সুশান্ত ঘোষ, লক্ষণ শেঠ প্রভৃতিদের নাম সংবাদের শিরোনামে ছিল। ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই রাজ্যে ৭৪ জনের মৃত্যু ঘটেছিল। কিন্তু এটাও ঘটনা, এই ভোট সন্ত্রাস যে মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে আটকানো যায়, তার প্রমাণ ছিল ১৯৭৭ ও ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন; যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভোর থেকে লাইন দিয়ে, নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে ভোট সন্ত্রাস রুখে দিয়েছিলেন। 

২০১১ সালে তৃণমূল সরকার তৈরি হবার পর ১২ বছর কেটে গেছে। এই ১২ বছরে আমরা দেখেছি, ভোট সন্ত্রাস অব্যাহত আছে। তবে এই সময়ের ভোট সন্ত্রাস প্রধানত স্বায়ত্বশাসনের ভোট অর্থাৎ পঞ্চায়েত বা পৌরসভা নির্বাচনের সময় মারাত্মক রূপ নিয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবনায় হয়তো আছে- ক্ষমতার কোনও পরিসরে সংসদীয় বিরোধীদের স্থান দেওয়া হবে না। ফলে, ভোট সন্ত্রাসের সাথে সাথে জিতে যাওয়া বিরোধী পক্ষকে ভাঙ্গানো বা বিভিন্ন কেসে ফাঁসিয়ে দিয়ে জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি, গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পৌরসভা তৃণমূলের হাতে রাখার এক প্রয়াসও অব্যাহত থেকেছে। পাশাপাশি, আরও একটা বৈশিষ্ট্য হল- এই স্বায়ত্বশাসনের ভোটে সরকারি যন্ত্রকে কাজে লাগানো। নির্বাচন কমিশন থেকে পুলিশ ও বিডিও- এদেরও ভোট সন্ত্রাসে কাজে লাগানো হয়েছে। আগে ছিল- রাজনৈতিক দল সন্ত্রাস চালাত, পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকত। এখন পুলিশ থেকে বিডিও সবাই ভোট সন্ত্রাসে যুক্ত হয়েছে। প্রত্যক্ষ ভাবে তারা শাসক তৃণমূলের পক্ষালম্বন করছে। আরও নতুন বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়েছে- আগে প্রধানত ভোটের দিন সন্ত্রাস হত, এখন মনোনয়ন পর্ব থেকে ভোট দান ও ভোট গণনা- পুরো পর্যায় জুড়ে সন্ত্রাস চলে। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পুরো পর্যায়ে ভোট সন্ত্রাসের এই সমস্ত প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। মৃত্যু, রক্তপাত, হিংসার সাথে সাথে প্রশাসনের সন্ত্রাসকে কাজে লাগানো- সমস্ত কিছুই আমরা এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রত্যক্ষ করেছি। এই প্রেক্ষিতেই এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচন ও তার পরবর্তী পর্যায়ে রাজ্যে কী অবস্থা তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে দু-এক কথা বলা যেতে পারে!

আমরা জানি, যে কোনও স্বায়ত্বশাসনের ভোটে সব সময়েই রাজ্যে যারা ক্ষমতায় আছে তারা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। কারণ, এখানে একটা মনস্তত্ত্ব কাজ করে যে, রাজ্য শাসনে যারা আছে তাদের ভোট না দিলে 'কাজ' হবে না। ২০০৮ সালে নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর আন্দোলনের পর্যায়ে যখন সিপিআই(এম) সহ বামপন্থীরা খুব কোণঠাসা, তখনও পঞ্চায়েতে বেশির ভাগ জায়গায় জিতেছিল সিপিআই(এম) সহ বামফ্রন্ট। সুতরাং, এবারের নির্বাচনেও তৃণমূলের জয়ের এটা একটা অন্যতম কারণ।

দ্বিতীয়ত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তৃণমূলের ক্ষয়ের দিকটা স্পষ্ট হচ্ছে। তৃণমূলের স্বৈরাচার ও মাত্রাতিরিক্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ বেড়েছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে বিপরীত দিক থেকে তেমন কোনও সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠেনি যাতে তৃণমূলের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বিরাট বিক্ষোভে পরিণতি পায়। শুধু 'চোর ধরো জেল ভরো' বা 'নিয়োগ দুর্নীতি'র কথা বলে মিছিল করলে ক্ষয়টা বিক্ষোভে পরিণত হয় না। এমনকি 'আবাস দুর্নীতি'র মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিও এজেন্ডাতে যুক্ত করা যায়নি।

তৃতীয়ত, ভোট সন্ত্রাস। মানুষ যখন ভোট সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সমবেত ভাবে পথে নামে, তখন শাসক পরিবর্তন হয়। এবার প্রতিরোধ হয়েছে, কিন্তু তা সামগ্রিক আকার পায়নি। যে প্রতিরোধ ১৯৭৭ বা ২০১১ সালে হয়েছিল, তার ধারেকাছেও এই প্রতিরোধ পৌঁছয়নি। সংসদীয় বিরোধী দলগুলি এমন কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে পারেনি, যেখানে মানুষ তাদের ডাকে পথে নামবে। বাঙালি মুসলমানদের একটা বড় অংশ দক্ষিণ ২৪-পরগনা, মুর্শিদাবাদ, হুগলিতে প্রতিবাদী অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেছে (আইএসএফ যাদের প্রধান মুখ)। এখানে ভোট সন্ত্রাস তৃণমূল লাগামছাড়া করেছে। ফলে, এক কথায় বলা যায়, ভোট সন্ত্রাসও তৃণমূলের ক্ষমতায় ফেরার একটা উপায় হিসাবে কাজ করেছে। কিন্তু একটা উপায় একমাত্র উপায় নয়। 

চতুর্থত, তৃণমূল সরকারের বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পের প্রভাবে গ্রামীণ মানুষের একটা বড় অংশ এবারেও তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে। 

পঞ্চমত, একটা প্রচার হচ্ছে, বাম-কংগ্রেস জোট এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে বেশ ভালো প্রভাব ফেলেছে। বিজেপি'র প্রভাব কমেছে। আমার তা মনে হয় না। এটা বলা যায়, আগের চেয়ে গ্রাউন্ডে বাম-কংগ্রেস জোট কিছুটা প্রত্যাঘাত করার চেষ্টা করেছে। কিছু আসন প্রাপ্তিও ঘটেছে। কিন্তু বিজেপি'র বিরাট ক্ষয় হয়েছে- এটা এখনই বলার সময় আসেনি। পশ্চিমবাংলায় মানুষের মননে বিজেপি বা আরএসএস খুব শক্তিশালী অবস্থানে নেই। সঙ্ঘ পরিবার এখানে উপর থেকে মানে কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়া দিয়ে ক্ষমতা দখল করতে চায়। এমনিতে সঙ্ঘ পরিবার স্বায়ত্বশাসনের ভোটে খুব গুরুত্ব দেয় না। কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়া ছাড়া, দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামো ও নেতৃত্ব নিয়ে প্রায় সাড়ে দশ হাজারের মতো গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির আসন তারা দখল করেছে। অতীতে যা কখনও হয়নি। মানে নিচু স্তরে মানুষের মধ্যে বেশ ভালো প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। এর সাথে লোকসভা নির্বাচনে যেহেতু বিজেপি'র সাথে অন্যদের নির্বাচনে লড়াইয়ের বিষয় আসবে, যেখানে শক্তিশালী নেশন, মোদী-অমিত শাহ, বিভিন্ন উগ্র বিদ্বেষমুলক প্রচার, ফ্যাসিবাদী প্রকল্প, প্রচুর অর্থ ব্যয়, যে আইডেনটিটি রাজনীতির জায়গায় তাদের প্রভাব কমেছে সেগুলো মেরামত করা ইত্যাদি এই ইস্যুগুলি সামনে আসবে; এবং বিজেপি-তৃণমূল বাইনারিতেই পশ্চিমবাংলার লোকসভা নির্বাচন হবে। অর্থাৎ, সামগ্রিক ভাবে উগ্র দক্ষিণপন্থার সঙ্গে দক্ষিণপন্থার লড়াইতেই মানুষকে মত দিতে হবে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে যে ফলাফল বাম-কংগ্রেস করেছে, উল্টো কোনও পথে এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ হাঁটবে, এ কথা মনে হয় না।

ষষ্ঠত, এই পঞ্চায়েত নির্বাচন প্রমাণ করল, সংগ্রামী বামেদের শক্তি রাজ্যে খুব দুর্বল। ব্যতিক্রম ভাঙরের জমি কমিটি। মানুষের প্রতিবাদী মানসিকতাকে ময়দানের লড়াই থেকে ভোটের লড়াইতে নিয়ে যেতে ভাঙড়ের জমি কমিটি যে ভাবে ভূমিকা রেখেছে, তা শিক্ষণীয়। আগামী দিনে বাংলায় মানুষের কাছে ইতিবাচক বক্তব্য নিয়ে আন্দোলনে যদি সংগ্রামী বাম ও গণতান্ত্রিক ব্যক্তিরা ধারাবাহিক ভাবে কাজ করতে পারেন, তাহলে যে দক্ষিণপন্থার দিকে আজকের পশ্চিমবাংলা চলেছে তাকে প্রতিহত করা যায়। ভাঙড় সেই শিক্ষাই সামনে এনেছে। ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ জয়।

সব শেষে বলি, ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনে আওয়াজ উঠেছিল- 'গ্রামীণ বাস্তুঘুঘু'দের বাসা ভাঙ্গতে হবে। এ কথা স্বীকার করতেই হবে, ১৯৭৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে গ্রামের গরিব মানুষদের এক ধরনের জাগরণ ঘটেছিল। পরবর্তীতে পঞ্চায়েত আইনে গ্রাম সংসদ/ গ্রামসভার বিষয়টি যুক্ত হয়েছিল। সেখানে আইনে গ্রামীণ জনগণের অধিকার অনেকটা বিস্তৃত হয়েছিল। কিন্তু বাম সরকারের শেষের দিকে ও তৃণমূল সরকারের আমলে পঞ্চায়েতে গ্রামসভা/ গ্রাম সংসদের বিষয়টিকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া হয়। বর্তমান সরকার তো সব কাজই জেলা শাসক, কৃষি দফতর, বিডিও', অর্থাৎ, আমলাতন্ত্রের উপর ছেড়ে দিয়েছে। ফলে, গণতন্ত্রের পরিসর এখানে রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, গ্রাম সংসদ/ গ্রামসভার বিষয়টি, অর্থাৎ, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে কোনও জোরালো আন্দোলন সেই ভাবে গোটা রাজ্যে গড়ে ওঠেনি।

তাই, আগামী দিনের জন্য দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে: 

এক) পঞ্চায়েতের গ্রাম সংসদ ও গ্রামসভাকে পুনর্জীবিত করতে হবে;

দুই) পঞ্চায়েত নির্বাচনে তীব্র সন্ত্রাস যা গণতান্ত্রিক পরিসরকে রুদ্ধ করে, বন্ধ করতে হবে।

এই দুটি বিষয় নিয়ে লাগাতার কাজ করা দরকার। এই দুটি বক্তব্য প্রচারের প্রধান বিষয়বস্তু হতে পারে।

প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, জনগণের গণতান্ত্রিক পরিসরের জন্য সংগ্রাম জোরদার না হলে ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচার কারওর বিরুদ্ধেই প্রকৃত লড়াই গড়া সম্ভব নয়। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচন সেই শিক্ষাই সামনে আনল। আগামী দিনগুলিতে অবস্থার পরিবর্তনের জন্য প্রকৃত বিকল্প আন্দোলন গড়ে উঠবে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।


Friday, 14 July 2023

জলের তলায় উত্তর ভারত

এই বিপর্যয় থেকে বাঁচার পথ আছে?

শোভনলাল চক্রবর্তী



রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ঋতু ছিল বর্ষা। বর্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের যত গান, কবিতা আছে, অন্য কোনও ঋতু নিয়ে তা নেই। তবে আজ বেঁচে থাকলে তিনি বর্ষা নিয়ে কাব্য রচনা করতে পারতেন বলে মনে হয় না। বিগত দুই সপ্তাহ জুড়ে সমগ্র উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে বর্ষা যে ভয়াবহ আকার নিয়েছে, তা দেখে মানুষ আতঙ্কিত। তবে এই প্রথম নয়, এর আগেও বর্ষায় ভেসেছে উত্তর ভারত সহ হিমাচল ও উত্তরাখণ্ড। তাই প্রশ্ন উঠছে, বারংবার উত্তর ভারতকে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে কেন? 

প্রথমত, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বর্তমানে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রায় ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলস্বরূপ, সমগ্র বিশ্বের পার্বত্য ও মহাদেশীয় হিমবাহগুলির গলন শুরু হয়েছে। তেমনই উত্তর ভারতের হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল ও কারাকোরাম পর্বতের পার্বত্য হিমবাহগুলির গলনও শুরু হতে থাকে। উল্লেখযোগ্য ভাবে গাড়োয়াল হিমালয় এবং গঙ্গোত্রী হিমবাহের পার্বত্য হিমবাহের গভীরতা ও পুরুত্ব কমতে থাকে এবং তাদের পশ্চাদপসরণ ঘটতে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৩৫ সাল থেকে এই সময় পর্যন্ত প্রায় কুড়ি কিলোমিটারেরও বেশি হিমবাহগুলির পশ্চাদপসরণ হয়েছে। তাছাড়া বরফের চাদর পাতলা হয়েছে, যার ফলস্বরূপ পার্বত্য উপত্যকায় হিমবাহগুলিতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়ে যাচ্ছে, যে কারণে সেখানে ফাটল, ভাঙ্গন হতে থাকে এবং এই ধরনের বিপর্যয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়।

দ্বিতীয়ত, উত্তরাখণ্ড হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের গাড়োয়াল অঞ্চলটি নব্য ভূগাঠনিক আলোড়নের কেন্দ্রস্থল। এই অংশে ভূ-অভ্যন্তরীণ নানা শক্তি তথা আলোড়নের কারণে ও গঠন ক্রিয়ার ফলে প্রতিনিয়ত মৃদু থেকে অতি প্রবল ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। আমরা জানি, এই এলাকাটি দুটি পাতের কেন্দ্রমুখি সীমান্তে অবস্থিত। উত্তর আঙ্গারাল্যান্ড এবং দক্ষিণে গন্ডোয়ানাল্যান্ড পাতের সীমান্ত অঞ্চল। অপেক্ষাকৃত ভারী পাত হালকা পাতের নিচে অনুপ্রবেশ ঘটায়। যার ফলে ভূমিকম্প সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে সাম্প্রতিক গবেষকদের মতে বর্তমানে এভারেস্টের উচ্চতা প্রায় ৮৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পায়, অর্থাৎ, হিমালয় পর্বত গঠন প্রক্রিয়া এখনও চলছে। উত্তরাখণ্ডের গাড়োয়াল অঞ্চলটি এই পর্বতের অংশ হিসেবে থাকায় ভূতাত্ত্বিক গঠনগত অবস্থান থেকে প্রতিনিয়ত একটি আলোড়ন তৈরি করে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা তৈরি করে।  

তৃতীয়ত, এই অঞ্চলটিতে প্রাক মৌসুমি ও মৌসুমী সময়ে মেঘের বিস্ফোরণ, অতি প্রবল বর্ষণ ইত্যাদি আবহাওয়া জনিত প্রাকৃতিক ঘটনা প্রায়শই দেখা যায়। এই মেঘভাঙা বৃষ্টির ফলে হড়পা বান, ভূমি ধস এবং তুষার ধসের মতো ঘটনা ঘটে থাকে। যার ফলে বিপর্যয় সম্ভাবনা তৈরি হয়। সেই দিক থেকে উত্তরাখণ্ডের এই অংশটি একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বহুদিন যাবৎ।    

চতুর্থত, মনুষ্য কার্যাবলী, যেমন, বৃক্ষচ্ছেদন, পাহাড় কেটে চাষাবাদ, হোটেল নির্মাণ, পর্যটন শিল্পের অগ্রগতি, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলা, পাহাড় কেটে রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং অন্যান্য অবৈজ্ঞানিক ও অসচেতন মূলক পরিবেশ অসামঞ্জস্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে এই ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা আরও বেশি করে বেড়ে যায়। সেই কারণে উত্তরাখণ্ডের এই পার্বত্য উপত্যকার ভৌগোলিক অঞ্চল একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই বিপর্যয় থেকে মুক্তি লাভ করতে গেলে পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের পথে হাঁটতে হবে। তবে শুধু উত্তর ভারত নয়, এ বছরের প্রথমার্ধে তীব্র তাপদাহ এবং ভারী বন্যায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া। প্রাকৃতিক এই বিপর্যয়ের সর্বশেষ শিকার উত্তর-পূর্ব ভারত এবং অসম, উত্তরবঙ্গ সহ বাংলাদেশ, যেখানে ব্যাপক বন্যায় কয়েক হাজার বাসিন্দা বাস্তুচ্যুত হওয়ার পাশাপাশি হারিয়েছেন তাঁদের জীবন-জীবিকা। 

ইতিমধ্যে বন্যার ফলে কয়েকশত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং প্রায় ৫৫ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অসমের ৩৫টি জেলার মধ্যে ২৮টি এখনও বন্যার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া অসমের শিলচর আর বাংলাদেশের সিলেটের মতো বড় শহরগুলো এখন পর্যন্ত নিমজ্জিত। অন্যদিকে উত্তর-পূর্ব ভারতের আরেক রাজ্য মণিপুরে অবিরাম বৃষ্টির কারণে ভূমিধসে কমপক্ষে ৪২ জনের  মৃত্যু ঘটেছে। দক্ষিণ এশিয়ার বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের প্রায় অধিকাংশই জুন-সেপ্টেম্বরের বর্ষার সময়ে ঘটে থাকে। চলতি বছরে, পূর্ব দিক থেকে আসা বায়ু প্রবাহের অনুপস্থিতির কারণে পরিস্থিতি আরও তীব্র আকার ধারণ করে। কারণ, এই বায়ুপ্রবাহ সাধারণত মৌসুমি মেঘকে ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমিতে ঠেলে দেয়। উত্তর-পূর্ব ভারতের কাছে যেহেতু জলভর্তি ভারী মেঘগুলো আটকে যায়, তাই এই অঞ্চলে ভারী বর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এদিকে বছরের এই সময় পূব দিক থেকে যে বায়ুপ্রবাহ চলাচলের কথা ছিল তা এখন সেভাবে হচ্ছে না। পরিবর্তে, আমরা বঙ্গোপসাগরের উপর শক্তিশালী দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমী বায়ু প্রবাহ দেখতে পাচ্ছি, যা ওড়িশা থেকে তাদের সাথে আরও আর্দ্রতা নিয়ে আসে।  

আরও একটি বিরল ঘটনা যা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে তা হল, এই বছর আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর উভয় থেকে আর্দ্রতা পূর্ণ বায়ুপ্রবাহ জুনের মাঝামাঝি সময়ে একই সময়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের দিকে চলে যায় যা সাধারণত বিভিন্ন সময়ে এই দিকে চলে আসত। এই অস্বাভাবিক ঘটনার সংমিশ্রণের কারণে খুব উচ্চ মাত্রার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যার ফলে বিপর্যয়কর বন্যা হয়েছে।

এই বছরের আবহাওয়ার ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা যেতেই পারে। উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বায়ুপ্রবাহের সঞ্চালনের ধরন পরিবর্তন হচ্ছে। যেহেতু বন্যা হয় পরিবাহী বৃষ্টিপাতের কারণে, অর্থাৎ, যখন পৃথিবীর পৃষ্ঠে উত্তপ্ত বায়ু জলীয় বাষ্পের সাথে বেড়ে যায়, তারপর ঠাণ্ডা এবং ঘনীভূত হয়, যা চাপের ধরন তৈরি করে বৃষ্টিপাত ঘটায়। বৃষ্টির তীব্রতা বৃদ্ধি পেলেও, বৃষ্টিপাতের সময়কাল সারা ভারতে ছোট হয়ে আসছে। অন্য কথায়, বেশির ভাগ এলাকায়, বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতে  সামান্য সময়ে অনেক ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে।

নয়াদিল্লি-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক পলিসি দিয়ে এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোখা শক্ত। এই বন্যার জল সব দিক থেকে নেমে গেলে এবং দুর্যোগ ও ত্রাণ পরিচালনাকারী দলগুলো চলে গেলে, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা মারাত্মক একটি অন্ধকার অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের মুখোমুখি হবেন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলি যখন একটির সাথে অন্যটি সংঘর্ষের অবস্থায় চলে যায় তখন জটিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলোর পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বহু-স্তরের শাসন এবং সহিষ্ণু পরিকল্পনা প্রয়োজন। যে প্রক্রিয়ায় সাধারণত রাজ্য সরকারগুলো দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজ করে থাকে তাতে একটি রূপান্তরমূলক পরিবর্তন হওয়া দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোর সাথে জনগণের খাপ খাইয়ে নিতে রাজ্য সরকারগুলোর শক্তিশালী কর্মপরিকল্পনা থাকা দরকার। 

পাশাপাশি আর একটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে যাতে রাজ্য সরকার এসব আইন, নীতি  ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত তহবিল বা আর্থিক সক্ষমতা পেতে পারে। উন্নয়ন পরিবেশ বান্ধব হতে হবে, পাহাড়ে ডিনামাইট ফাটিয়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ অবিলম্বে বন্ধ করে বিকল্প উন্নয়ন তত্ত্বের ভিত্তিতে কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে- এসব কথা বিজ্ঞানীরা বহুবার বলেছেন। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতারা শেষ কথা বলে থাকেন, তাঁদের ভুল অনৈতিক সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষ পথে বসছেন। পরিবেশ এক নতুন শ্রেণির উদ্বাস্তু তৈরি করছে।


Sunday, 9 July 2023

ডা: সুব্রত গোস্বামী

যে বোকা বুড়ো পাহাড় সরাতে চেয়েছিল...

জয়ন্ত দাস


(১৯৬৪ - ২০২৩)


রণজয়ী নই, রণে আছি তবু মেতে

বেঁধে আছি চিমনির পাশে,

ঘর বেঁধে আছি সোনালী ধানের ক্ষেতে।

মিথ্যা কথায় আগুন জ্বলে না,

বন্ধ্যা মাটিতে ফসল ফলে না।

জননী গো এসো, পাথরের মতো নিরেট সত্যি বলি,

হিমালয় হয়ে ভোরের আকাশে জ্বলি॥


সুব্রত চলে গেল। ব্যথা দূর করার ব্রত ছিল তার। মানুষের কষ্ট কমানোর ব্রত। সে নিজেই শেষ দিকে বড় কষ্ট পেয়ে গেল। অথচ হাসিমুখে; কেউ জানতে পারেনি তার বুকের ভেতরে কী হচ্ছে। ঐ যে, অন্য কাউকে কষ্ট দেবে না, কষ্টের ভাগও দেবে না। কীভাবে যে লিখি তার কথা!

কত রকমের পরিচয় থাকে একটা মানুষের। সুব্রত ডাক্তার। সে পূর্ব ভারতে ব্যথা চিকিৎসার পথিকৃৎ। সরকারি চিকিৎসা-ব্যবস্থার মধ্যে সাধারণ চিকিৎসা করাই শক্ত। তার মধ্যে সুব্রত একটা আস্ত ব্যথা চিকিৎসার ইনস্টিটিউট গড়ে তুলল; ইএসআই-এর কাঠামোর মধ্যে, যেখানে কল-কারখানার শ্রমিকদের চিকিৎসা হয়, বা চিকিৎসার নামে যেটুকু সান্ত্বনা দেওয়া সম্ভব সেটুকুই হয়, সেখানে একটা আস্ত 'ইএসআই ইনস্টিটিউট অফ পেইন ম্যানেজমেন্ট'! অবশ্যই অনেকের সাহায্য পেয়েছিল সুব্রত, কিন্তু সে ছিল এই ইনস্টিটিউটের ধারণার স্তর থেকে তাকে দাঁড় করিয়ে দৌড় করানোর স্তর পর্যন্ত ইনস্টিটিউটের মূল স্তম্ভ। সে বলত, মানুষ ডাক্তারের কাছে আসে ব্যথা নিয়ে। ব্যথা কেবল ব্যথা নয়, ব্যথা মানুষের পূর্ব-অভিজ্ঞতাসঞ্জাত আতঙ্ক, তার ভবিষ্যৎ-ভাবনার সংকট। আমরা ডাক্তারেরা সেটাকে গুরুত্ব দিই না। বলি, ব্যথা তো হবেই, হাড় ভেঙেছে যে। ক্যান্সারের ব্যথা-পাওয়া মানুষটিকে আমরা ডাক্তারেরা বলতে শিখি, ব্যথা সহ্য করুন, আসল অসুখটা আপনার কমে আসছে। এবং তাঁকে মরফিন দেবার চেষ্টাও করি না। 

জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে মেডিক্যালে কাজ করার সময়ে সে লক্ষ করেছিল, হাসপাতালে আসা প্রান্তিক গরিবদের ব্যথাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সে মেনে নেয়নি বটে, কিন্তু কিছু করতেও পারেনি। তারপরে সুব্রত প্রাইভেট হাসপাতালে কাজ করে। সুদক্ষ অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট হিসেবে সে বেলভিউ, উডল্যান্ডে যায়। দেখে, সেখানকার রোগীদের ব্যথাকে গুরুত্ব দিতেই হচ্ছে। ডাক্তার বাড়ি থেকে দশ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে আসছেন কেবিনে-শোয়া রোগীর ব্যথা লাঘব করতে। প্রশ্নটা তার মনে উঠে যায়, তাহলে সরকারি হাসপাতালে গরিব রোগীদের ব্যথা কি ব্যথা নয়? জবাব মেলে না। আমরা জানি, সেই জবাবদিহির তাড়নাতেই তার পেইন ইনস্টিটিউটের স্বপ্ন দেখা শুরু। 

সুব্রত ছিল আমার কলেজের ভাই, আমার সাংগঠনিক ভাই। মেডিক্যাল কলেজ ডেমোক্র্যাটিক স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, এমসিডিএসএ-র ছাত্র-সংগঠক হিসেবে সুব্রতকে দেখেছি, সে চিরকাল অন্যের কথাটাই বেশি ভেবে এসেছে। কাজের দায় নিত সে, কিন্তু ক্রেডিট নেবার দিনে তাকে পাওয়া যেত না। আটের দশকের মাঝামাঝি এমসিডিএসএ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে পরাস্ত হয়, সাংগঠনিক ক্রাইসিস তীব্রতর হয়। সেই সময়ে সুব্রতই সংগঠনের আহ্বায়কের দায়িত্ব সামলেছিল।

ভালো গান গাইত সুব্রত। পল্লবের (কীর্তনিয়া) সঙ্গে গাইত, 'লড়াই করো লড়াই করো লড়াই যতদিন না বিজয়ী হও। যদি একবার হারো বারবার লড়ো...', সে লড়াইয়ে আঘাত খেয়ে পিছিয়ে পড়েনি। ভেবেছে, কোন রাস্তায় একটু এগিয়ে নেওয়া যায় মানুষের পক্ষের লড়াইকে, কেমন করে অভীষ্ট একটুও সিদ্ধ হয়। ছাত্র জীবনের শেষে সুব্রত ছিল জুনিয়র ডাক্তার মুভমেন্টের সামনের সারির নেতা। তার ইন্টার্নশিপ কমপ্লিশন সার্টিফিকেট আটকে দমিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল সেই সময়ের কর্তৃপক্ষ। একটু একা পড়ে গিয়েছিল সুব্রত তখন, কিন্তু দমে যায়নি। অন্যদের আড়াল করে নিজের কাঁধে দায় নেবার অভ্যাসও বদলায়নি সে। ডাক্তার হবার পরেও সুব্রত মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সংগঠনের সব চাইতে কাছের মানুষ হয়ে থেকে গিয়েছিল— জুনিয়রদের কাছে সে ছিল সর্বজনীন ‘টাকো’-দা। অন্যদিকে মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তনীদের অ্যাসোসিয়েশনে সুব্রত তার শেষ দিন পর্যন্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিল। 

ইএসআই-এর রাজ্য সরকারি চাকরিতে সুব্রত যোগ দেয় একটু দেরি করেই। ছাত্র জীবনে ডিএসএ করা অনেকেই সেই সব দিনে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে তাদের ছাত্র জীবনের কথা ভুলে যেত। কেউ কেউ হয়তো প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ছাত্র-রাজনীতির জীবনের কথা মুছে ফেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত, কেন না কেরিয়ারের জন্য তা ছিল অসুবিধাজনক। সুব্রত কিন্তু ডেমোক্র্যাটিক স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে থেকে গেছে চিরদিন। চাকরি করতে করতে সে ডিএসএ সংগঠনের ঘুণপোকা ছাড়ানোর কাজ করেছে অন্য কয়েকজন সিনিয়রের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে। কেরিয়ারে অসুবিধা হয়নি? হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সে কথা বলেনি কখনও। হয়তো সুব্রতর পরিবারের কেউ কেউ জানেন... জানেন কি? 

নয়ের দশকের মাঝামাঝি ছত্তিশগড়ে শংকর গুহ নিয়োগীর হত্যার পরে সেখানকার সংগঠক চিকিৎসক পুণ্যব্রত গুণ কলকাতায় ফিরে আসে। প্রথমে কানোরিয়া জুট সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে, পরে ১৯৯৯ সালে তাদের থেকে আলাদা হয়ে তৈরি হয় শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ— সাত জন মিলে এই সোসাইটি গঠন করে। তাদের অন্যতম ছিল সুব্রত। কখনও সে শ্রমজীবীর সহ-সম্পাদক, কখনও সহ-সভাপতি। আমার সঙ্গে সুব্রতর কলেজ জীবনের ঘনিষ্ঠতা এই সময় আরও বাড়ে। সুব্রত এবং আর দুজন ডাক্তার বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ের এক জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র-এর মাসিক শিবির চালানোর দায়িত্ব নেয়, নানা ব্যস্ততার মধ্যেও তাতে ছেদ পড়েনি। ২০০০ সাল আর ২০০১ সালের বন্যাত্রাণ, ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামে সাপ্তাহিক মেডিকেল টিম, ২০০৯'এর আয়লা- সবেতেই শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের দলে ছিল সুব্রত। 

এ সব কিছু করেও সে ধারাবাহিকভাবে পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। নিজের দক্ষতায় শান দিতে সে পরিশ্রমে কার্পণ্য করেনি কখনও। ইএসআই-তে তার কাজ ছিল অ্যানাস্থেসিয়ার মেডিকেল অফিসার হিসেবে, কিন্তু সুব্রত জেনারেল সার্জারি, অর্থপেডিক্স, প্লাস্টিক সার্জারি, কার্ডিওথোরাসিক সার্জারি, সার্জিক্যাল অনকোলজি, ক্রিটিকাল কেয়ারে কাজ করতে করতে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করে। কলকাতায় প্রথম যারা ক্রিটিকাল কেয়ারে দক্ষ হয়ে ওঠে, তাদের মধ্যে একজন ছিল সুব্রত। চাইলে প্রাইভেট সেক্টরে অনেক রোজগার করতে পারত, কিন্তু তাহলে প্রমাণ করা যেত না যে সরকারি ব্যবস্থাতেও কাজ করা যায়! তাহলে যে পেইন ইনস্টিটিউটের স্বপ্নও অধরা থেকে যায়! 

তবে স্বপ্নে স্রেফ মশগুল হবার সময় ছিল না তার। রাজ্য সরকারের কাজের ব্যাপারে কিছুমাত্র অভিজ্ঞতা থাকলে সবাই স্বীকার করবেন, বাঙালি কাঁকড়া যদি কোথাও থাকে তবে তা এখানেই। তার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছিল তাকে— পরে তার অফিসঘরের দেয়ালে টেস্ট টিউব বেবির জনক ডাক্তার সুভাষ মুখার্জির ছবি টাঙানো নেহাত আকস্মিক ঘটনা ছিল না। ২০০০ সালের কাছাকাছি সময়, তখন সারা বিশ্বে ব্যথা চিকিৎসা তথা পেইন ম্যানেজমেন্ট একটা নতুন বিষয়। এ দেশে তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। আমেরিকার টেক্সাসে 'ওয়ার্ল্ড ইনস্টিটিউট অফ পেইন' ব্যথা বিষয়ে বিদেশি ছাত্রদেরও প্রশিক্ষণ দেয়, তবে খরচ আছে। কয়েক বছর চেষ্টার পরে শেষে ২০১০-এ সুব্রত সেই প্রশিক্ষণ নিতে গেল। খরচ একটু কমানোর জন্য গেল বুদাপেস্ট-এ, সেখানে আমেরিকান সংস্থাটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেছিল, তাও তার পকেটের ৩ লক্ষ টাকা খরচ হয়ে গেল। প্রাইভেটে তার দক্ষতা চড়া দামে বেচতে পারত সুব্রত, কিন্তু সেই গানটা মনে পড়ে গেল তার- 'আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাখরখানি... বন্ধু তোমার লাল টুকটুকে স্বপ্ন বেচো না।' সে ইএসআই-এর সরকারি হাসপাতালে, শ্রমিকদের জন্য শ্রমিকদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থে গড়া সরকারি হাসপাতালে, তার অর্জিত শিক্ষার প্রয়োগ করতে চেষ্টা করতে লাগল। তার স্বপ্ন এখানেই সে ব্যথা চিকিৎসার কেন্দ্র গড়ে তুলবে। ঘামে ভেজা চটকল শ্রমিক, সিমেন্ট কারখানার মজদুর, সমস্ত চিকিৎসাকেন্দ্রে যারা যায় ভয়ে ভয়ে আর ফিরে আসে এক বুক হতাশা নিয়ে, তাদের ব্যথার চিকিৎসা হবে না? শুরু হল বোকা বুড়োর পাহাড় সরানো।



আমাদের ডাক্তারি পদমর্যাদা অনেকটাই ডিগ্রি-নির্ভর। এমবিবিএস ডাক্তার দেখলে আমাদের সিস্টেম বলে, শুধু এমবিবিএস? যাও, ইমার্জেন্সিতে নাইট ডিউটি দাও গে। পেন ম্যানেজমেন্ট-এর সেন্টার খুলতে চাও? বাপু হে, তোমার ট্রেনিং কই? তোমার স্বীকৃতিপত্র? কী করে বুঝব তুমি ঐ ব্যাপারে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেছ? তুমি বিশেষজ্ঞ? 

আমাদের এই বিশেষজ্ঞ-কেন্দ্রিক ডিগ্রি-কেন্দ্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই সুব্রত তার যোগ্যতা বুঝিয়ে দিয়েছিল, আর সার্টিফিকেট হাতে পাবার পরে তার গ্রহণযোগ্যতা আরেকটু বাড়ে। শেষ পর্যন্ত পর্বত নড়ে বসে। শুরু হয় 'ইএসআই ইনস্টিটিউট অফ পেইন ম্যানেজমেন্ট'। সময়টা ২০১৩, সেপ্টেম্বর মাস। আজও তার ওয়েবসাইটে ক্লিক করলে সুব্রত'র মুখটা বারংবার কম্পিউটারের পর্দায় আসে আর সরে যায়, আসে আর সরে সরে যায়... 

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ ২০১৩ সালে এই ইনস্টিটিউটে ‘ফেলোশিপ ইন পেইন ম্যানেজমেন্ট’-এ ডাক্তারদের জন্য এক বছরের আবাসিক স্নাতকোত্তর কোর্স চালু করার অনুমতি দেয়। এটা ভারতবর্ষে ইএসআই ইনস্টিটিউটের এক অগ্রণী ভূমিকার পরিচায়ক। সুব্রত এর কোর্স ডাইরেক্টর। এত স্বীকৃতির মধ্যেও সুব্রত জানত, এই বিশেষজ্ঞ-কেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে কাজটা চালিয়ে নিতে গেলে তাকে আরও কিছু ব্যক্তিগত স্বীকৃতি অর্জন করতে হবে। সে সমস্ত কাজের মধ্যেও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে, যাতে আরেকটু ভালোভাবে ইনস্টিটিউটের কাজ চালাতে পারে। 

২০১৯ সালের কনভোকেশনে সে পিএইচডি পেল। এবার, আরেকটু ভালোভাবে করা যাবে পেইন ইনস্টিটিউটের কাজ। শ্রমজীবীর কাজে আরেকটু মনোযোগ দেওয়া যাবে। মেয়েটা দূরে গিয়ে পড়াশুনো করে, আরেকটু কথা বলা যাবে তার সঙ্গে। স্ত্রীও ভাবেন, এইবার হয়তো মানুষটা একটু শান্তিতে কাজ করবে... 

২০২০ সেপ্টেম্বর। সুব্রতর রোগটি ধরা পড়ে- অ্যামায়োট্রপিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস। যে রোগ পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-কে বহু বছর হুইল-চেয়ারে বেঁধে রেখেছিল। তবে হকিং রোগ নির্ণয়ের পরে ৫৫ বছর বেঁচে ছিলেন, আর সুব্রত তিন বছরও বাঁচল না। 

ভালো থেকো, সুব্রত। দূরের তারাদের মধ্যে।

সুব্রত'র কথা:

https://www.youtube.com/watch?v=xPg_5Sh5RgI

 

Wednesday, 5 July 2023

পঞ্চায়েত নামা

পঞ্চায়েতে দলীয় প্রতীক কেন?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচার, সংঘর্ষ, বাদ-প্রতিবাদ, ঢক্কানিনাদ আপাতত তুঙ্গে। রোজই খবর আসছে, এখানে সেখানে রাজনৈতিক সংঘর্ষের। ইতিমধ্যেই বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শাসক পক্ষ বলছে, আগের তুলনায় সে খতিয়ান অনেক কম। বিরোধীদের বক্তব্য, তাও বা হবে কেন!

আমরা যারা শহরে বাস করি, বহু অর্থেই গ্রামের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ কম। লেখালিখির সূত্রে ও পাঠক পরিচয়ে গ্রামের বহু মানুষের সঙ্গে যে যোগাযোগ একেবারেই নেই, তাও আবার নয়। এমন বহু মানুষের সঙ্গেই কথা হচ্ছে, যারা পেশা ও কাজের সূত্রে গ্রামীণ এলাকা থেকে শহরে নিত্য আসেন, অথবা বসবাস করেন, কিন্তু ভোটের সময়ে গ্রামে গিয়ে ভোটটিও দেন। অন্তত কলকাতা শহরে বসে প্রত্যক্ষত গ্রামের নির্বাচনের হালহকিকত যে জানা যাচ্ছে না, তা একেবারেই নয়। হয়তো আরও দূরবর্তী জেলাগুলিতে নানারকম জনবিন্যাসের কারণে নানান জটিল যাপনের আবহে সমস্ত ছবিটা স্পষ্ট নয়। কিন্তু মোটা দাগে কতকগুলি চিত্র বেশ পরিষ্কার ভাবে ধরা দিচ্ছে।

প্রথমে এটা স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে, পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলগত ভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যে চল তা সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গ, কেরল ও ত্রিপুরা বাদে অন্যত্র অনুপস্থিত। ১৯৯৩ সালে সংবিধানের ৭৩ তম সংশোধনী মারফত যে পঞ্চায়েতী রাজ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করা হয়, সেখানে গান্ধীজীর ‘গ্রাম স্বরাজ’এর ধারণাকে প্রাণ দেওয়াটাই মূল অভীষ্ট ছিল বলে অন্তত ঘোষণায় বলা হয়েছিল। দলহীন পঞ্চায়েতী রাজকেই নীতিগত ভাবে প্রাধান্য দেওয়ার কথা নীতিকারদের ভাবনায় ছিল। কিন্তু বামপন্থীরা সে সময়ে শ্রেণি সংগ্রামের প্রেক্ষিতে দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকদের লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে পঞ্চায়েতকে ব্যবহার করার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দলের প্রতীকে পঞ্চায়েত নির্বাচনে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় এই লক্ষ্যে একটি পঞ্চায়েতী আইন লাগু হয় এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ওপর তার রূপায়নের দায়ভার দেওয়া হয়। হয়তো, তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে তার একটা নৈতিকতা ছিল। কিন্তু তার অর্থ নিশ্চয়ই এই নয় যে, পার্টির নামে জোর খাটিয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পর্যদুস্ত করে যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে হবে। সংসদীয় গণতন্ত্রের অভ্যন্তরে যদি নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে শ্রেণি সংগ্রামের ‘তাগিদে’ প্রহসনে পরিণত করা হয়, তাহলে তা একদিকে সংসদীয় গণতন্ত্রকেও যেমন লাটে তুলে দেয়, অন্যদিকে শ্রেণি সংগ্রামের চলমানতায় মানুষের মতামতকেও পদদলিত করে। যদি শ্রেণি সংগ্রামই কাম্য হবে, তাহলে সেই মতাদর্শকে জনতার মধ্যে জনপ্রিয় করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন আদায় করে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে সমস্যা কোথায়? যদি মতামত প্রকাশের স্বাধিকারকে রাষ্ট্রব্যবস্থা দমন করে, সে ক্ষেত্রে অন্য কোনও পথের কথা নিশ্চয়ই ভাবা যেতে পারে।

আসলে, ১৯৫৯ সালে কেরালায় ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদের নেতৃত্বাধীন প্রথম নির্বাচিত বামপন্থী সরকারকে কেন্দ্রের তরফে ফেলে দেওয়া, পরবর্তী কালে পশ্চিমবঙ্গেও যুক্তফ্রন্ট সরকারের কার্যসময়ে রাজ্যপালের নেতিবাচক ভূমিকা, ১৯৭২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ব্যাপক রিগিং করে কংগ্রেস সরকারের ক্ষমতায় আসা ইত্যাদি ঘটনাবলী এমন এক ধারণাকে জনপ্রিয় করে যে বামপন্থীদের ক্ষমতালাভকে ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা সুনজরে দেখছে না। অতএব, সংসদীয় গণতন্ত্রে বামপন্থীরা বিজয়ী হলেও তাদের ক্ষমতাচ্যুত করতে কেন্দ্রের সরকার নানাবিধ কায়দা-কৌশল এবং জোর খাটাতে দ্বিধা করবে না- এমত এক অভিমত বাম মহলে জোরদার হয়। সেই প্রেক্ষিত থেকে বামপন্থীরাও ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করে তোলার অভিপ্রায়ে অসংসদীয় পথ ও কূট কৌশলের আশ্রয় নেওয়াকে রাজনৈতিক নৈতিকতা হিসেবে গণ্য করে। কিন্তু ইতিমধ্যে সময় ও রাজনৈতিক গতিপথ বহুল পরিমাণে বদলে গেছে। সারা বিশ্বে ‘সমাজতান্ত্রিক’ দেশগুলির পতন ও উদার অর্থনীতির আবাহন এবং বিশ্বায়নের মডেল পুরনো ঘরানা ও চিন্তাকে তছনছ করে দিয়েছে।

অথচ, রাজনৈতিক পট রীতিমতো বদলে গেলেও রাজনৈতিক অনুশীলনের পুরনো অভ্যাসটা থেকে গেল। ২০০৩ সালেও আমরা পশ্চিমবঙ্গে এক রক্তাক্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সাক্ষী রইলাম। বলা যায়, সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে। এমত রক্তক্ষয়ী নির্বাচন কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা বাদে অন্য কোনও রাজ্যে হয় না। বামপন্থীদের সরিয়ে তৃণমূল দলের ক্ষমতায় আসীন হওয়াও কিন্তু এই ট্রাডিশনকে বন্ধ করতে পারল না। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনও সেই একই ক্ষমতার দম্ভ ও আস্ফালনকে দৃশ্যমান করল।

ইতিমধ্যে অনেকগুলি পরিবর্তন পঞ্চায়েত স্তরে এসে গেছে। বামফ্রন্ট’এর আমলে প্রথম দিকে পঞ্চায়েতের ক্ষমতায় রাজনৈতিক মাত্রাটি অধিক তীব্র ছিল। এখন তার সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষমতাটি যুক্ত হয়ে তাকে অন্য আরেক মাত্রা দিয়েছে। পঞ্চায়েতের হাতে স্থানীয় স্তরে কাজ করার জন্য অর্থের যে প্রভূত জোগান, তা দুর্নীতির এক মহীরূহ দুষ্টচক্রের জন্ম দিয়েছে। পঞ্চায়েতের ক্ষমতায় আসীন হওয়া মানে অর্থের সাগরে নিমজ্জিত হওয়া। সাধারণ ভাবে, কার্যত গ্রামসভাগুলিকে অচল করে দিয়ে পঞ্চায়েতের অফিসগুলি পরিণত হয়েছে পার্টি দফতরে; এবং সেখান থেকে পার্টি নেতারা একতরফা নিদান দিয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার শিখরে আরোহন করেছেন। অবশ্য, এর বিপরীত দিকটিও বহমান। শহুরে ঔদাসীন্য ও অহং দিয়ে পঞ্চায়েতকে নিছক একটি আস্তাকুঁড়ে হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াসটিও সমান বিপজ্জনক। বহু পঞ্চায়েত আছে, যেখানে নানা অর্থে যথাযথ অথবা আংশিক কাজও হয়, মানুষ সেই কাজের নানাবিধ সুযোগ-সুবিধাও পেয়ে থাকেন। বুঝতে হবে, শহরে যেমন পাড়ার রাজনীতি আছে, তেমনই গ্রামাঞ্চলেও এক বহমান গ্রাম্য রাজনীতি আছে, যেখানে নানাবিধ জটিলতা বিরাজ করে- সবটা মিলিয়ে গ্রামীণ রাজনীতির এক নিজস্ব আঙ্গিক ও ভাষা আছে। এ রাজ্যে হিংসাকে এক কঠিন বাস্তবতা হিসেবে স্বীকার করে নিলেও বর্তমান রাজনীতির ধারা কিন্তু পালটা বয়ান নির্মাণ করতে বেশ পটু। ২০১৮ সালে গ্রামবাংলায় হিংসার রাজনীতি যে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে শাসক দলের পক্ষে ব্যুমেরাং হয়েছিল, সে কথা কিন্তু এই পালটা বয়ানেরই রকমফের।

শুধু তাই নয়, প্রযুক্তিগত উল্লম্ফনের ফলে রাজনৈতিক অর্থনীতিতে যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, সেখানে জনকল্যাণের রাজনীতি আজ মধ্য মঞ্চে জায়গা করে নিয়েছে। জনগণের ওপর জোরজুলুম করে, তাদের বঞ্চিত করে বা ঠকিয়ে হয়তো একটা নির্বাচন পার করে দেওয়া যাবে, কিন্তু পরের নির্বাচনে তার মাশুল নিশ্চিত গুনতে হবে। আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি রাজ্যে এর ভুরি ভুরি নিদর্শন রয়েছে। সরকারি কর্মসংস্থান রুদ্ধপ্রায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভিঘাতে সাবেক শিল্প থেকে কর্মী ছাঁটাই, স্থায়ী কর্মসংস্থানের যুগ অস্তপ্রায়, যেটুকু যা নিয়োগ সব অস্থায়ী চরিত্রের- এমত অবস্থায় খুব স্বাভাবিক, জনকল্যাণের রাজনীতি আজ প্রধান অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। মোদ্দা কথায়, সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কতটা বাড়ানো গেল, সরকার তাদের প্রতি কতটা সদয় হল- এইগুলিই এখন জনগণের তরফে রাজনৈতিক দলগুলিকে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে মৌলিক বিচার্য বিষয়।

পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের টানাপোড়েন এই জনকল্যাণের রাজনীতি ও পার্টির খবরদারির (চূড়ান্ত রূপে সন্ত্রাস) এক জটিল সমীকরণের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। যদি কোথাও লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, কৃষক বন্ধু বা স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পগুলি বহু মানুষের আস্থা ও ভরসা অর্জন করে থাকে, আবার অন্যদিকে, রাস্তার বেহাল দশা, বিপর্যস্ত নিকাশি ব্যবস্থা অথবা পানীয় জলের অভাব বহু মানুষের ক্ষোভেরও কারণ হয়েছে। অর্থাৎ, নগদ হস্তান্তর অথবা ব্যক্তিগত স্তরে অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি এ রাজ্যের সরকার ও পঞ্চায়েত অনেকটাই সাফল্য দেখিয়ে থাকে, গ্রামীণ ও আধা-শহুরে এলাকায় পরিকাঠামো প্রদানের ক্ষেত্রে (রাস্তাঘাট, আলো, নিকাশি ইত্যাদি) তারা আবার অনেকটাই ব্যর্থ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতি, দলের খবরদারি ও ক্ষমতার উৎকট প্রদর্শন। এই দ্বন্দ্বমূলক ত্রিমাত্রিক পরিসরে জনসাধারণ যদি অবাধ ভোট দেওয়ার সুযোগ পান, তাহলে কোথাকার জল কোথায় গড়ায়, তা অবশ্যই দেখার আছে।

ভোটের ফলাফল যেমনই হোক (শাসক দলের দিকে এখনও পাল্লা ভারী বলে অনুমান), পার্টি দিয়ে গ্রামসভাকে অকেজো করে ‘জোর যার মুলুক তার’এর রাজনীতি যে আর চলবে না, তা বাধ্যত অনেকেই আজ বুঝতে পারছেন। তৃণমূল কংগ্রেস নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এই জোরজুলুমের রাজনীতির অবসানের কথা বারবার ঘোষণা করেছেন, যদিও তার ঘোষণার কার্যকারিতা এখনও সর্বব্যাপী হয়নি, নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে তত যেন আরও রক্তাক্ত হয়ে উঠছে ভোটের প্রাঙ্গণ। বলতে দ্বিধা নেই, হিংসার রাজনীতির অধিক দায়ভাগ কিন্তু শাসক দলের ওপরই বর্তায়। যদি শাসক দল তা মনে রাখে এবং সর্বোপরি, পঞ্চায়েতী ব্যবস্থাকে এ রাজ্যে দলমুক্ত গ্রাম স্বরাজের ভাবনায় উন্নীত করতে পারে, তাহলে নিঃসন্দেহে তা হবে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

নয়তো ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এ রাজ্যে তৃণমূলকে কিন্তু মোকাবিলা করতে হচ্ছে এমন একটি বৃহৎ শাসক দলকে (বিজেপি), যারা অর্থে, ক্ষমতায়, জোরজুলুমে দেশ জুড়ে অনেক বেশি পারদর্শী ও শক্তিশালী। সেই দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানুষকে যদি পাশে না পাওয়া যায়, তাহলে কিন্তু আরও বেশি গুণাগার দেওয়ার জন্য তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। কারণ, পশ্চিমবঙ্গকে দখল করতে আরএসএস-বিজেপি এতটাই মরীয়া যে, তারা এ রাজ্যের শাসক দলের ছোটখাটো পদস্খলনগুলিকে পর্যন্ত গোদী মিডিয়ার সাহায্যে এমন এক প্রচারের স্তরে নিয়ে যাচ্ছে যে দেখেশুনে মনে হবে, আমরা যেন এক গৃহযুদ্ধের আবহে বাস করছি। কারণ তারা জানে, যদি এবারের নির্বাচনে তারা কিঞ্চিৎ ভাল ফল করে, তাহলে কিন্তু তাদের সর্বভারতীয় ক্ষমতার জোরে এ রাজ্যে ২০২৪ সাল অবধি এমন তাণ্ডব চালাবে যার উদ্দেশ্য থাকবে লোকসভা নির্বাচনে রাজ্য থেকে অন্তত ২০টি’র বেশি আসন দখল করা। আর এ কাজে তারা ইতিমধ্যেই অন্য দুটি বিরোধী দলকে একেবারে অকেজো করে দিয়ে নিজেদের পিছনে সামিল করে নিয়েছে। এমন এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে শেষমেশ সার্বিক চিত্রটি কেমন দাঁড়ায়, তার জন্য আমাদের ১১ জুলাই অবধি অপেক্ষা করতে হবে।