সেই পরম্পরাই চলেছে
কুশল দেবনাথ
শেষ হল পঞ্চায়েত নির্বাচন। প্রায় ৬০ জনের জীবনহানির মধ্য দিয়ে হিংসাদীর্ণ ও রক্তাক্ত এই নির্বাচন প্রক্রিয়া চলল।
২০১৮ সালের সন্ত্রাস কবলিত পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রেক্ষিতে এই বছর বহু আগে থেকেই নাগরিক সমাজের বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছিল- হিংসামুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত, মৃত্যুহীন পঞ্চায়েত নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু দেখা গেল, এবারেও পঞ্চায়েত নির্বাচন সন্ত্রাস মুক্ত হল না।
বস্তুত, এই রাজ্যে ভোট সন্ত্রাস কোনও নতুন ঘটনা নয়। লোকসভা, বিধানসভা, পঞ্চায়েত সহ বিভিন্ন স্বায়ত্বশাসনের ভোটে সন্ত্রাস হয়েই চলে। ১৯৭২ সালে বিধানসভা নির্বাচনে পুলিশের মদতে কংগ্রেসি গুন্ডাদের তাণ্ডব ভয়ংকর রূপ নিয়েছিল। নব-কংগ্রেসের নেতৃত্বে বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট, লোককে ভোট দিতে না দেওয়া, সশস্ত্র গুন্ডাদের তাণ্ডব সমস্ত সীমারেখা অতিক্রম করেছিল। আবার বাম সরকারের ৩৪ বছরের সময়ে বিভিন্ন জায়গায় এই ভোট সন্ত্রাস মাত্রাতিরিক্ত অবস্থায় পৌঁছেছিল। বিরোধী শক্তিকে কোনও জায়গা দেব না, মানুষকে ভোট দিতে দেব না- এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সিপিআই(এম) কর্মীরা প্রশাসনের সহযোগিতায় ব্যাপক সন্ত্রাস চালিয়েছিল। ভোট সন্ত্রাসের পরিচালক হিসেবে অনিল বসু, সুশান্ত ঘোষ, লক্ষণ শেঠ প্রভৃতিদের নাম সংবাদের শিরোনামে ছিল। ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই রাজ্যে ৭৪ জনের মৃত্যু ঘটেছিল। কিন্তু এটাও ঘটনা, এই ভোট সন্ত্রাস যে মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে আটকানো যায়, তার প্রমাণ ছিল ১৯৭৭ ও ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচন; যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভোর থেকে লাইন দিয়ে, নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে ভোট সন্ত্রাস রুখে দিয়েছিলেন।
২০১১ সালে তৃণমূল সরকার তৈরি হবার পর ১২ বছর কেটে গেছে। এই ১২ বছরে আমরা দেখেছি, ভোট সন্ত্রাস অব্যাহত আছে। তবে এই সময়ের ভোট সন্ত্রাস প্রধানত স্বায়ত্বশাসনের ভোট অর্থাৎ পঞ্চায়েত বা পৌরসভা নির্বাচনের সময় মারাত্মক রূপ নিয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবনায় হয়তো আছে- ক্ষমতার কোনও পরিসরে সংসদীয় বিরোধীদের স্থান দেওয়া হবে না। ফলে, ভোট সন্ত্রাসের সাথে সাথে জিতে যাওয়া বিরোধী পক্ষকে ভাঙ্গানো বা বিভিন্ন কেসে ফাঁসিয়ে দিয়ে জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি, গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পৌরসভা তৃণমূলের হাতে রাখার এক প্রয়াসও অব্যাহত থেকেছে। পাশাপাশি, আরও একটা বৈশিষ্ট্য হল- এই স্বায়ত্বশাসনের ভোটে সরকারি যন্ত্রকে কাজে লাগানো। নির্বাচন কমিশন থেকে পুলিশ ও বিডিও- এদেরও ভোট সন্ত্রাসে কাজে লাগানো হয়েছে। আগে ছিল- রাজনৈতিক দল সন্ত্রাস চালাত, পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকত। এখন পুলিশ থেকে বিডিও সবাই ভোট সন্ত্রাসে যুক্ত হয়েছে। প্রত্যক্ষ ভাবে তারা শাসক তৃণমূলের পক্ষালম্বন করছে। আরও নতুন বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়েছে- আগে প্রধানত ভোটের দিন সন্ত্রাস হত, এখন মনোনয়ন পর্ব থেকে ভোট দান ও ভোট গণনা- পুরো পর্যায় জুড়ে সন্ত্রাস চলে। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পুরো পর্যায়ে ভোট সন্ত্রাসের এই সমস্ত প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। মৃত্যু, রক্তপাত, হিংসার সাথে সাথে প্রশাসনের সন্ত্রাসকে কাজে লাগানো- সমস্ত কিছুই আমরা এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রত্যক্ষ করেছি। এই প্রেক্ষিতেই এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচন ও তার পরবর্তী পর্যায়ে রাজ্যে কী অবস্থা তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে দু-এক কথা বলা যেতে পারে!
আমরা জানি, যে কোনও স্বায়ত্বশাসনের ভোটে সব সময়েই রাজ্যে যারা ক্ষমতায় আছে তারা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। কারণ, এখানে একটা মনস্তত্ত্ব কাজ করে যে, রাজ্য শাসনে যারা আছে তাদের ভোট না দিলে 'কাজ' হবে না। ২০০৮ সালে নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর আন্দোলনের পর্যায়ে যখন সিপিআই(এম) সহ বামপন্থীরা খুব কোণঠাসা, তখনও পঞ্চায়েতে বেশির ভাগ জায়গায় জিতেছিল সিপিআই(এম) সহ বামফ্রন্ট। সুতরাং, এবারের নির্বাচনেও তৃণমূলের জয়ের এটা একটা অন্যতম কারণ।
দ্বিতীয়ত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তৃণমূলের ক্ষয়ের দিকটা স্পষ্ট হচ্ছে। তৃণমূলের স্বৈরাচার ও মাত্রাতিরিক্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ বেড়েছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে বিপরীত দিক থেকে তেমন কোনও সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠেনি যাতে তৃণমূলের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বিরাট বিক্ষোভে পরিণতি পায়। শুধু 'চোর ধরো জেল ভরো' বা 'নিয়োগ দুর্নীতি'র কথা বলে মিছিল করলে ক্ষয়টা বিক্ষোভে পরিণত হয় না। এমনকি 'আবাস দুর্নীতি'র মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিও এজেন্ডাতে যুক্ত করা যায়নি।
তৃতীয়ত, ভোট সন্ত্রাস। মানুষ যখন ভোট সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সমবেত ভাবে পথে নামে, তখন শাসক পরিবর্তন হয়। এবার প্রতিরোধ হয়েছে, কিন্তু তা সামগ্রিক আকার পায়নি। যে প্রতিরোধ ১৯৭৭ বা ২০১১ সালে হয়েছিল, তার ধারেকাছেও এই প্রতিরোধ পৌঁছয়নি। সংসদীয় বিরোধী দলগুলি এমন কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে পারেনি, যেখানে মানুষ তাদের ডাকে পথে নামবে। বাঙালি মুসলমানদের একটা বড় অংশ দক্ষিণ ২৪-পরগনা, মুর্শিদাবাদ, হুগলিতে প্রতিবাদী অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেছে (আইএসএফ যাদের প্রধান মুখ)। এখানে ভোট সন্ত্রাস তৃণমূল লাগামছাড়া করেছে। ফলে, এক কথায় বলা যায়, ভোট সন্ত্রাসও তৃণমূলের ক্ষমতায় ফেরার একটা উপায় হিসাবে কাজ করেছে। কিন্তু একটা উপায় একমাত্র উপায় নয়।
চতুর্থত, তৃণমূল সরকারের বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পের প্রভাবে গ্রামীণ মানুষের একটা বড় অংশ এবারেও তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে।
পঞ্চমত, একটা প্রচার হচ্ছে, বাম-কংগ্রেস জোট এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে বেশ ভালো প্রভাব ফেলেছে। বিজেপি'র প্রভাব কমেছে। আমার তা মনে হয় না। এটা বলা যায়, আগের চেয়ে গ্রাউন্ডে বাম-কংগ্রেস জোট কিছুটা প্রত্যাঘাত করার চেষ্টা করেছে। কিছু আসন প্রাপ্তিও ঘটেছে। কিন্তু বিজেপি'র বিরাট ক্ষয় হয়েছে- এটা এখনই বলার সময় আসেনি। পশ্চিমবাংলায় মানুষের মননে বিজেপি বা আরএসএস খুব শক্তিশালী অবস্থানে নেই। সঙ্ঘ পরিবার এখানে উপর থেকে মানে কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়া দিয়ে ক্ষমতা দখল করতে চায়। এমনিতে সঙ্ঘ পরিবার স্বায়ত্বশাসনের ভোটে খুব গুরুত্ব দেয় না। কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়া ছাড়া, দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামো ও নেতৃত্ব নিয়ে প্রায় সাড়ে দশ হাজারের মতো গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির আসন তারা দখল করেছে। অতীতে যা কখনও হয়নি। মানে নিচু স্তরে মানুষের মধ্যে বেশ ভালো প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। এর সাথে লোকসভা নির্বাচনে যেহেতু বিজেপি'র সাথে অন্যদের নির্বাচনে লড়াইয়ের বিষয় আসবে, যেখানে শক্তিশালী নেশন, মোদী-অমিত শাহ, বিভিন্ন উগ্র বিদ্বেষমুলক প্রচার, ফ্যাসিবাদী প্রকল্প, প্রচুর অর্থ ব্যয়, যে আইডেনটিটি রাজনীতির জায়গায় তাদের প্রভাব কমেছে সেগুলো মেরামত করা ইত্যাদি এই ইস্যুগুলি সামনে আসবে; এবং বিজেপি-তৃণমূল বাইনারিতেই পশ্চিমবাংলার লোকসভা নির্বাচন হবে। অর্থাৎ, সামগ্রিক ভাবে উগ্র দক্ষিণপন্থার সঙ্গে দক্ষিণপন্থার লড়াইতেই মানুষকে মত দিতে হবে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে যে ফলাফল বাম-কংগ্রেস করেছে, উল্টো কোনও পথে এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ হাঁটবে, এ কথা মনে হয় না।
ষষ্ঠত, এই পঞ্চায়েত নির্বাচন প্রমাণ করল, সংগ্রামী বামেদের শক্তি রাজ্যে খুব দুর্বল। ব্যতিক্রম ভাঙরের জমি কমিটি। মানুষের প্রতিবাদী মানসিকতাকে ময়দানের লড়াই থেকে ভোটের লড়াইতে নিয়ে যেতে ভাঙড়ের জমি কমিটি যে ভাবে ভূমিকা রেখেছে, তা শিক্ষণীয়। আগামী দিনে বাংলায় মানুষের কাছে ইতিবাচক বক্তব্য নিয়ে আন্দোলনে যদি সংগ্রামী বাম ও গণতান্ত্রিক ব্যক্তিরা ধারাবাহিক ভাবে কাজ করতে পারেন, তাহলে যে দক্ষিণপন্থার দিকে আজকের পশ্চিমবাংলা চলেছে তাকে প্রতিহত করা যায়। ভাঙড় সেই শিক্ষাই সামনে এনেছে। ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ জয়।
সব শেষে বলি, ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনে আওয়াজ উঠেছিল- 'গ্রামীণ বাস্তুঘুঘু'দের বাসা ভাঙ্গতে হবে। এ কথা স্বীকার করতেই হবে, ১৯৭৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে গ্রামের গরিব মানুষদের এক ধরনের জাগরণ ঘটেছিল। পরবর্তীতে পঞ্চায়েত আইনে গ্রাম সংসদ/ গ্রামসভার বিষয়টি যুক্ত হয়েছিল। সেখানে আইনে গ্রামীণ জনগণের অধিকার অনেকটা বিস্তৃত হয়েছিল। কিন্তু বাম সরকারের শেষের দিকে ও তৃণমূল সরকারের আমলে পঞ্চায়েতে গ্রামসভা/ গ্রাম সংসদের বিষয়টিকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া হয়। বর্তমান সরকার তো সব কাজই জেলা শাসক, কৃষি দফতর, বিডিও', অর্থাৎ, আমলাতন্ত্রের উপর ছেড়ে দিয়েছে। ফলে, গণতন্ত্রের পরিসর এখানে রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, গ্রাম সংসদ/ গ্রামসভার বিষয়টি, অর্থাৎ, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে কোনও জোরালো আন্দোলন সেই ভাবে গোটা রাজ্যে গড়ে ওঠেনি।
তাই, আগামী দিনের জন্য দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে:
এক) পঞ্চায়েতের গ্রাম সংসদ ও গ্রামসভাকে পুনর্জীবিত করতে হবে;
দুই) পঞ্চায়েত নির্বাচনে তীব্র সন্ত্রাস যা গণতান্ত্রিক পরিসরকে রুদ্ধ করে, বন্ধ করতে হবে।
এই দুটি বিষয় নিয়ে লাগাতার কাজ করা দরকার। এই দুটি বক্তব্য প্রচারের প্রধান বিষয়বস্তু হতে পারে।
প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, জনগণের গণতান্ত্রিক পরিসরের জন্য সংগ্রাম জোরদার না হলে ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচার কারওর বিরুদ্ধেই প্রকৃত লড়াই গড়া সম্ভব নয়। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচন সেই শিক্ষাই সামনে আনল। আগামী দিনগুলিতে অবস্থার পরিবর্তনের জন্য প্রকৃত বিকল্প আন্দোলন গড়ে উঠবে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।
পশ্চিমবঙ্গের সমসময়ের রাজনীতি নিয়ে এক অসাধারণ বিচার বিশ্লেষণ মূলক লেখা পড়ার সৌভাগ্য হলো।
ReplyDeleteএই সময়ের আমরা এই বাংলার মানুষ তার তার রাজনীতির গতিপ্রকৃতির সুলুক সন্ধানের