Pages

Friday, 14 July 2023

জলের তলায় উত্তর ভারত

এই বিপর্যয় থেকে বাঁচার পথ আছে?

শোভনলাল চক্রবর্তী



রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ঋতু ছিল বর্ষা। বর্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের যত গান, কবিতা আছে, অন্য কোনও ঋতু নিয়ে তা নেই। তবে আজ বেঁচে থাকলে তিনি বর্ষা নিয়ে কাব্য রচনা করতে পারতেন বলে মনে হয় না। বিগত দুই সপ্তাহ জুড়ে সমগ্র উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে বর্ষা যে ভয়াবহ আকার নিয়েছে, তা দেখে মানুষ আতঙ্কিত। তবে এই প্রথম নয়, এর আগেও বর্ষায় ভেসেছে উত্তর ভারত সহ হিমাচল ও উত্তরাখণ্ড। তাই প্রশ্ন উঠছে, বারংবার উত্তর ভারতকে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে কেন? 

প্রথমত, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বর্তমানে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রায় ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলস্বরূপ, সমগ্র বিশ্বের পার্বত্য ও মহাদেশীয় হিমবাহগুলির গলন শুরু হয়েছে। তেমনই উত্তর ভারতের হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল ও কারাকোরাম পর্বতের পার্বত্য হিমবাহগুলির গলনও শুরু হতে থাকে। উল্লেখযোগ্য ভাবে গাড়োয়াল হিমালয় এবং গঙ্গোত্রী হিমবাহের পার্বত্য হিমবাহের গভীরতা ও পুরুত্ব কমতে থাকে এবং তাদের পশ্চাদপসরণ ঘটতে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৩৫ সাল থেকে এই সময় পর্যন্ত প্রায় কুড়ি কিলোমিটারেরও বেশি হিমবাহগুলির পশ্চাদপসরণ হয়েছে। তাছাড়া বরফের চাদর পাতলা হয়েছে, যার ফলস্বরূপ পার্বত্য উপত্যকায় হিমবাহগুলিতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়ে যাচ্ছে, যে কারণে সেখানে ফাটল, ভাঙ্গন হতে থাকে এবং এই ধরনের বিপর্যয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়।

দ্বিতীয়ত, উত্তরাখণ্ড হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের গাড়োয়াল অঞ্চলটি নব্য ভূগাঠনিক আলোড়নের কেন্দ্রস্থল। এই অংশে ভূ-অভ্যন্তরীণ নানা শক্তি তথা আলোড়নের কারণে ও গঠন ক্রিয়ার ফলে প্রতিনিয়ত মৃদু থেকে অতি প্রবল ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। আমরা জানি, এই এলাকাটি দুটি পাতের কেন্দ্রমুখি সীমান্তে অবস্থিত। উত্তর আঙ্গারাল্যান্ড এবং দক্ষিণে গন্ডোয়ানাল্যান্ড পাতের সীমান্ত অঞ্চল। অপেক্ষাকৃত ভারী পাত হালকা পাতের নিচে অনুপ্রবেশ ঘটায়। যার ফলে ভূমিকম্প সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে সাম্প্রতিক গবেষকদের মতে বর্তমানে এভারেস্টের উচ্চতা প্রায় ৮৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পায়, অর্থাৎ, হিমালয় পর্বত গঠন প্রক্রিয়া এখনও চলছে। উত্তরাখণ্ডের গাড়োয়াল অঞ্চলটি এই পর্বতের অংশ হিসেবে থাকায় ভূতাত্ত্বিক গঠনগত অবস্থান থেকে প্রতিনিয়ত একটি আলোড়ন তৈরি করে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা তৈরি করে।  

তৃতীয়ত, এই অঞ্চলটিতে প্রাক মৌসুমি ও মৌসুমী সময়ে মেঘের বিস্ফোরণ, অতি প্রবল বর্ষণ ইত্যাদি আবহাওয়া জনিত প্রাকৃতিক ঘটনা প্রায়শই দেখা যায়। এই মেঘভাঙা বৃষ্টির ফলে হড়পা বান, ভূমি ধস এবং তুষার ধসের মতো ঘটনা ঘটে থাকে। যার ফলে বিপর্যয় সম্ভাবনা তৈরি হয়। সেই দিক থেকে উত্তরাখণ্ডের এই অংশটি একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বহুদিন যাবৎ।    

চতুর্থত, মনুষ্য কার্যাবলী, যেমন, বৃক্ষচ্ছেদন, পাহাড় কেটে চাষাবাদ, হোটেল নির্মাণ, পর্যটন শিল্পের অগ্রগতি, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলা, পাহাড় কেটে রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং অন্যান্য অবৈজ্ঞানিক ও অসচেতন মূলক পরিবেশ অসামঞ্জস্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে এই ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা আরও বেশি করে বেড়ে যায়। সেই কারণে উত্তরাখণ্ডের এই পার্বত্য উপত্যকার ভৌগোলিক অঞ্চল একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই বিপর্যয় থেকে মুক্তি লাভ করতে গেলে পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের পথে হাঁটতে হবে। তবে শুধু উত্তর ভারত নয়, এ বছরের প্রথমার্ধে তীব্র তাপদাহ এবং ভারী বন্যায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া। প্রাকৃতিক এই বিপর্যয়ের সর্বশেষ শিকার উত্তর-পূর্ব ভারত এবং অসম, উত্তরবঙ্গ সহ বাংলাদেশ, যেখানে ব্যাপক বন্যায় কয়েক হাজার বাসিন্দা বাস্তুচ্যুত হওয়ার পাশাপাশি হারিয়েছেন তাঁদের জীবন-জীবিকা। 

ইতিমধ্যে বন্যার ফলে কয়েকশত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং প্রায় ৫৫ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অসমের ৩৫টি জেলার মধ্যে ২৮টি এখনও বন্যার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া অসমের শিলচর আর বাংলাদেশের সিলেটের মতো বড় শহরগুলো এখন পর্যন্ত নিমজ্জিত। অন্যদিকে উত্তর-পূর্ব ভারতের আরেক রাজ্য মণিপুরে অবিরাম বৃষ্টির কারণে ভূমিধসে কমপক্ষে ৪২ জনের  মৃত্যু ঘটেছে। দক্ষিণ এশিয়ার বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের প্রায় অধিকাংশই জুন-সেপ্টেম্বরের বর্ষার সময়ে ঘটে থাকে। চলতি বছরে, পূর্ব দিক থেকে আসা বায়ু প্রবাহের অনুপস্থিতির কারণে পরিস্থিতি আরও তীব্র আকার ধারণ করে। কারণ, এই বায়ুপ্রবাহ সাধারণত মৌসুমি মেঘকে ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমিতে ঠেলে দেয়। উত্তর-পূর্ব ভারতের কাছে যেহেতু জলভর্তি ভারী মেঘগুলো আটকে যায়, তাই এই অঞ্চলে ভারী বর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এদিকে বছরের এই সময় পূব দিক থেকে যে বায়ুপ্রবাহ চলাচলের কথা ছিল তা এখন সেভাবে হচ্ছে না। পরিবর্তে, আমরা বঙ্গোপসাগরের উপর শক্তিশালী দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমী বায়ু প্রবাহ দেখতে পাচ্ছি, যা ওড়িশা থেকে তাদের সাথে আরও আর্দ্রতা নিয়ে আসে।  

আরও একটি বিরল ঘটনা যা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে তা হল, এই বছর আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর উভয় থেকে আর্দ্রতা পূর্ণ বায়ুপ্রবাহ জুনের মাঝামাঝি সময়ে একই সময়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের দিকে চলে যায় যা সাধারণত বিভিন্ন সময়ে এই দিকে চলে আসত। এই অস্বাভাবিক ঘটনার সংমিশ্রণের কারণে খুব উচ্চ মাত্রার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যার ফলে বিপর্যয়কর বন্যা হয়েছে।

এই বছরের আবহাওয়ার ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা যেতেই পারে। উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বায়ুপ্রবাহের সঞ্চালনের ধরন পরিবর্তন হচ্ছে। যেহেতু বন্যা হয় পরিবাহী বৃষ্টিপাতের কারণে, অর্থাৎ, যখন পৃথিবীর পৃষ্ঠে উত্তপ্ত বায়ু জলীয় বাষ্পের সাথে বেড়ে যায়, তারপর ঠাণ্ডা এবং ঘনীভূত হয়, যা চাপের ধরন তৈরি করে বৃষ্টিপাত ঘটায়। বৃষ্টির তীব্রতা বৃদ্ধি পেলেও, বৃষ্টিপাতের সময়কাল সারা ভারতে ছোট হয়ে আসছে। অন্য কথায়, বেশির ভাগ এলাকায়, বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতে  সামান্য সময়ে অনেক ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে।

নয়াদিল্লি-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক পলিসি দিয়ে এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোখা শক্ত। এই বন্যার জল সব দিক থেকে নেমে গেলে এবং দুর্যোগ ও ত্রাণ পরিচালনাকারী দলগুলো চলে গেলে, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা মারাত্মক একটি অন্ধকার অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের মুখোমুখি হবেন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলি যখন একটির সাথে অন্যটি সংঘর্ষের অবস্থায় চলে যায় তখন জটিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলোর পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বহু-স্তরের শাসন এবং সহিষ্ণু পরিকল্পনা প্রয়োজন। যে প্রক্রিয়ায় সাধারণত রাজ্য সরকারগুলো দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজ করে থাকে তাতে একটি রূপান্তরমূলক পরিবর্তন হওয়া দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোর সাথে জনগণের খাপ খাইয়ে নিতে রাজ্য সরকারগুলোর শক্তিশালী কর্মপরিকল্পনা থাকা দরকার। 

পাশাপাশি আর একটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে যাতে রাজ্য সরকার এসব আইন, নীতি  ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত তহবিল বা আর্থিক সক্ষমতা পেতে পারে। উন্নয়ন পরিবেশ বান্ধব হতে হবে, পাহাড়ে ডিনামাইট ফাটিয়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ অবিলম্বে বন্ধ করে বিকল্প উন্নয়ন তত্ত্বের ভিত্তিতে কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে- এসব কথা বিজ্ঞানীরা বহুবার বলেছেন। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতারা শেষ কথা বলে থাকেন, তাঁদের ভুল অনৈতিক সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষ পথে বসছেন। পরিবেশ এক নতুন শ্রেণির উদ্বাস্তু তৈরি করছে।


No comments:

Post a Comment