Pages

Wednesday, 5 July 2023

পঞ্চায়েত নামা

পঞ্চায়েতে দলীয় প্রতীক কেন?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচার, সংঘর্ষ, বাদ-প্রতিবাদ, ঢক্কানিনাদ আপাতত তুঙ্গে। রোজই খবর আসছে, এখানে সেখানে রাজনৈতিক সংঘর্ষের। ইতিমধ্যেই বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শাসক পক্ষ বলছে, আগের তুলনায় সে খতিয়ান অনেক কম। বিরোধীদের বক্তব্য, তাও বা হবে কেন!

আমরা যারা শহরে বাস করি, বহু অর্থেই গ্রামের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ কম। লেখালিখির সূত্রে ও পাঠক পরিচয়ে গ্রামের বহু মানুষের সঙ্গে যে যোগাযোগ একেবারেই নেই, তাও আবার নয়। এমন বহু মানুষের সঙ্গেই কথা হচ্ছে, যারা পেশা ও কাজের সূত্রে গ্রামীণ এলাকা থেকে শহরে নিত্য আসেন, অথবা বসবাস করেন, কিন্তু ভোটের সময়ে গ্রামে গিয়ে ভোটটিও দেন। অন্তত কলকাতা শহরে বসে প্রত্যক্ষত গ্রামের নির্বাচনের হালহকিকত যে জানা যাচ্ছে না, তা একেবারেই নয়। হয়তো আরও দূরবর্তী জেলাগুলিতে নানারকম জনবিন্যাসের কারণে নানান জটিল যাপনের আবহে সমস্ত ছবিটা স্পষ্ট নয়। কিন্তু মোটা দাগে কতকগুলি চিত্র বেশ পরিষ্কার ভাবে ধরা দিচ্ছে।

প্রথমে এটা স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে, পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলগত ভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যে চল তা সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গ, কেরল ও ত্রিপুরা বাদে অন্যত্র অনুপস্থিত। ১৯৯৩ সালে সংবিধানের ৭৩ তম সংশোধনী মারফত যে পঞ্চায়েতী রাজ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করা হয়, সেখানে গান্ধীজীর ‘গ্রাম স্বরাজ’এর ধারণাকে প্রাণ দেওয়াটাই মূল অভীষ্ট ছিল বলে অন্তত ঘোষণায় বলা হয়েছিল। দলহীন পঞ্চায়েতী রাজকেই নীতিগত ভাবে প্রাধান্য দেওয়ার কথা নীতিকারদের ভাবনায় ছিল। কিন্তু বামপন্থীরা সে সময়ে শ্রেণি সংগ্রামের প্রেক্ষিতে দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকদের লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে পঞ্চায়েতকে ব্যবহার করার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দলের প্রতীকে পঞ্চায়েত নির্বাচনে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় এই লক্ষ্যে একটি পঞ্চায়েতী আইন লাগু হয় এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ওপর তার রূপায়নের দায়ভার দেওয়া হয়। হয়তো, তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে তার একটা নৈতিকতা ছিল। কিন্তু তার অর্থ নিশ্চয়ই এই নয় যে, পার্টির নামে জোর খাটিয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পর্যদুস্ত করে যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে হবে। সংসদীয় গণতন্ত্রের অভ্যন্তরে যদি নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে শ্রেণি সংগ্রামের ‘তাগিদে’ প্রহসনে পরিণত করা হয়, তাহলে তা একদিকে সংসদীয় গণতন্ত্রকেও যেমন লাটে তুলে দেয়, অন্যদিকে শ্রেণি সংগ্রামের চলমানতায় মানুষের মতামতকেও পদদলিত করে। যদি শ্রেণি সংগ্রামই কাম্য হবে, তাহলে সেই মতাদর্শকে জনতার মধ্যে জনপ্রিয় করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন আদায় করে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে সমস্যা কোথায়? যদি মতামত প্রকাশের স্বাধিকারকে রাষ্ট্রব্যবস্থা দমন করে, সে ক্ষেত্রে অন্য কোনও পথের কথা নিশ্চয়ই ভাবা যেতে পারে।

আসলে, ১৯৫৯ সালে কেরালায় ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদের নেতৃত্বাধীন প্রথম নির্বাচিত বামপন্থী সরকারকে কেন্দ্রের তরফে ফেলে দেওয়া, পরবর্তী কালে পশ্চিমবঙ্গেও যুক্তফ্রন্ট সরকারের কার্যসময়ে রাজ্যপালের নেতিবাচক ভূমিকা, ১৯৭২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ব্যাপক রিগিং করে কংগ্রেস সরকারের ক্ষমতায় আসা ইত্যাদি ঘটনাবলী এমন এক ধারণাকে জনপ্রিয় করে যে বামপন্থীদের ক্ষমতালাভকে ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা সুনজরে দেখছে না। অতএব, সংসদীয় গণতন্ত্রে বামপন্থীরা বিজয়ী হলেও তাদের ক্ষমতাচ্যুত করতে কেন্দ্রের সরকার নানাবিধ কায়দা-কৌশল এবং জোর খাটাতে দ্বিধা করবে না- এমত এক অভিমত বাম মহলে জোরদার হয়। সেই প্রেক্ষিত থেকে বামপন্থীরাও ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করে তোলার অভিপ্রায়ে অসংসদীয় পথ ও কূট কৌশলের আশ্রয় নেওয়াকে রাজনৈতিক নৈতিকতা হিসেবে গণ্য করে। কিন্তু ইতিমধ্যে সময় ও রাজনৈতিক গতিপথ বহুল পরিমাণে বদলে গেছে। সারা বিশ্বে ‘সমাজতান্ত্রিক’ দেশগুলির পতন ও উদার অর্থনীতির আবাহন এবং বিশ্বায়নের মডেল পুরনো ঘরানা ও চিন্তাকে তছনছ করে দিয়েছে।

অথচ, রাজনৈতিক পট রীতিমতো বদলে গেলেও রাজনৈতিক অনুশীলনের পুরনো অভ্যাসটা থেকে গেল। ২০০৩ সালেও আমরা পশ্চিমবঙ্গে এক রক্তাক্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সাক্ষী রইলাম। বলা যায়, সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে। এমত রক্তক্ষয়ী নির্বাচন কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা বাদে অন্য কোনও রাজ্যে হয় না। বামপন্থীদের সরিয়ে তৃণমূল দলের ক্ষমতায় আসীন হওয়াও কিন্তু এই ট্রাডিশনকে বন্ধ করতে পারল না। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনও সেই একই ক্ষমতার দম্ভ ও আস্ফালনকে দৃশ্যমান করল।

ইতিমধ্যে অনেকগুলি পরিবর্তন পঞ্চায়েত স্তরে এসে গেছে। বামফ্রন্ট’এর আমলে প্রথম দিকে পঞ্চায়েতের ক্ষমতায় রাজনৈতিক মাত্রাটি অধিক তীব্র ছিল। এখন তার সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষমতাটি যুক্ত হয়ে তাকে অন্য আরেক মাত্রা দিয়েছে। পঞ্চায়েতের হাতে স্থানীয় স্তরে কাজ করার জন্য অর্থের যে প্রভূত জোগান, তা দুর্নীতির এক মহীরূহ দুষ্টচক্রের জন্ম দিয়েছে। পঞ্চায়েতের ক্ষমতায় আসীন হওয়া মানে অর্থের সাগরে নিমজ্জিত হওয়া। সাধারণ ভাবে, কার্যত গ্রামসভাগুলিকে অচল করে দিয়ে পঞ্চায়েতের অফিসগুলি পরিণত হয়েছে পার্টি দফতরে; এবং সেখান থেকে পার্টি নেতারা একতরফা নিদান দিয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার শিখরে আরোহন করেছেন। অবশ্য, এর বিপরীত দিকটিও বহমান। শহুরে ঔদাসীন্য ও অহং দিয়ে পঞ্চায়েতকে নিছক একটি আস্তাকুঁড়ে হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াসটিও সমান বিপজ্জনক। বহু পঞ্চায়েত আছে, যেখানে নানা অর্থে যথাযথ অথবা আংশিক কাজও হয়, মানুষ সেই কাজের নানাবিধ সুযোগ-সুবিধাও পেয়ে থাকেন। বুঝতে হবে, শহরে যেমন পাড়ার রাজনীতি আছে, তেমনই গ্রামাঞ্চলেও এক বহমান গ্রাম্য রাজনীতি আছে, যেখানে নানাবিধ জটিলতা বিরাজ করে- সবটা মিলিয়ে গ্রামীণ রাজনীতির এক নিজস্ব আঙ্গিক ও ভাষা আছে। এ রাজ্যে হিংসাকে এক কঠিন বাস্তবতা হিসেবে স্বীকার করে নিলেও বর্তমান রাজনীতির ধারা কিন্তু পালটা বয়ান নির্মাণ করতে বেশ পটু। ২০১৮ সালে গ্রামবাংলায় হিংসার রাজনীতি যে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে শাসক দলের পক্ষে ব্যুমেরাং হয়েছিল, সে কথা কিন্তু এই পালটা বয়ানেরই রকমফের।

শুধু তাই নয়, প্রযুক্তিগত উল্লম্ফনের ফলে রাজনৈতিক অর্থনীতিতে যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, সেখানে জনকল্যাণের রাজনীতি আজ মধ্য মঞ্চে জায়গা করে নিয়েছে। জনগণের ওপর জোরজুলুম করে, তাদের বঞ্চিত করে বা ঠকিয়ে হয়তো একটা নির্বাচন পার করে দেওয়া যাবে, কিন্তু পরের নির্বাচনে তার মাশুল নিশ্চিত গুনতে হবে। আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি রাজ্যে এর ভুরি ভুরি নিদর্শন রয়েছে। সরকারি কর্মসংস্থান রুদ্ধপ্রায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভিঘাতে সাবেক শিল্প থেকে কর্মী ছাঁটাই, স্থায়ী কর্মসংস্থানের যুগ অস্তপ্রায়, যেটুকু যা নিয়োগ সব অস্থায়ী চরিত্রের- এমত অবস্থায় খুব স্বাভাবিক, জনকল্যাণের রাজনীতি আজ প্রধান অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। মোদ্দা কথায়, সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কতটা বাড়ানো গেল, সরকার তাদের প্রতি কতটা সদয় হল- এইগুলিই এখন জনগণের তরফে রাজনৈতিক দলগুলিকে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে মৌলিক বিচার্য বিষয়।

পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের টানাপোড়েন এই জনকল্যাণের রাজনীতি ও পার্টির খবরদারির (চূড়ান্ত রূপে সন্ত্রাস) এক জটিল সমীকরণের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। যদি কোথাও লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, কৃষক বন্ধু বা স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পগুলি বহু মানুষের আস্থা ও ভরসা অর্জন করে থাকে, আবার অন্যদিকে, রাস্তার বেহাল দশা, বিপর্যস্ত নিকাশি ব্যবস্থা অথবা পানীয় জলের অভাব বহু মানুষের ক্ষোভেরও কারণ হয়েছে। অর্থাৎ, নগদ হস্তান্তর অথবা ব্যক্তিগত স্তরে অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি এ রাজ্যের সরকার ও পঞ্চায়েত অনেকটাই সাফল্য দেখিয়ে থাকে, গ্রামীণ ও আধা-শহুরে এলাকায় পরিকাঠামো প্রদানের ক্ষেত্রে (রাস্তাঘাট, আলো, নিকাশি ইত্যাদি) তারা আবার অনেকটাই ব্যর্থ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতি, দলের খবরদারি ও ক্ষমতার উৎকট প্রদর্শন। এই দ্বন্দ্বমূলক ত্রিমাত্রিক পরিসরে জনসাধারণ যদি অবাধ ভোট দেওয়ার সুযোগ পান, তাহলে কোথাকার জল কোথায় গড়ায়, তা অবশ্যই দেখার আছে।

ভোটের ফলাফল যেমনই হোক (শাসক দলের দিকে এখনও পাল্লা ভারী বলে অনুমান), পার্টি দিয়ে গ্রামসভাকে অকেজো করে ‘জোর যার মুলুক তার’এর রাজনীতি যে আর চলবে না, তা বাধ্যত অনেকেই আজ বুঝতে পারছেন। তৃণমূল কংগ্রেস নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এই জোরজুলুমের রাজনীতির অবসানের কথা বারবার ঘোষণা করেছেন, যদিও তার ঘোষণার কার্যকারিতা এখনও সর্বব্যাপী হয়নি, নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে তত যেন আরও রক্তাক্ত হয়ে উঠছে ভোটের প্রাঙ্গণ। বলতে দ্বিধা নেই, হিংসার রাজনীতির অধিক দায়ভাগ কিন্তু শাসক দলের ওপরই বর্তায়। যদি শাসক দল তা মনে রাখে এবং সর্বোপরি, পঞ্চায়েতী ব্যবস্থাকে এ রাজ্যে দলমুক্ত গ্রাম স্বরাজের ভাবনায় উন্নীত করতে পারে, তাহলে নিঃসন্দেহে তা হবে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

নয়তো ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এ রাজ্যে তৃণমূলকে কিন্তু মোকাবিলা করতে হচ্ছে এমন একটি বৃহৎ শাসক দলকে (বিজেপি), যারা অর্থে, ক্ষমতায়, জোরজুলুমে দেশ জুড়ে অনেক বেশি পারদর্শী ও শক্তিশালী। সেই দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানুষকে যদি পাশে না পাওয়া যায়, তাহলে কিন্তু আরও বেশি গুণাগার দেওয়ার জন্য তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। কারণ, পশ্চিমবঙ্গকে দখল করতে আরএসএস-বিজেপি এতটাই মরীয়া যে, তারা এ রাজ্যের শাসক দলের ছোটখাটো পদস্খলনগুলিকে পর্যন্ত গোদী মিডিয়ার সাহায্যে এমন এক প্রচারের স্তরে নিয়ে যাচ্ছে যে দেখেশুনে মনে হবে, আমরা যেন এক গৃহযুদ্ধের আবহে বাস করছি। কারণ তারা জানে, যদি এবারের নির্বাচনে তারা কিঞ্চিৎ ভাল ফল করে, তাহলে কিন্তু তাদের সর্বভারতীয় ক্ষমতার জোরে এ রাজ্যে ২০২৪ সাল অবধি এমন তাণ্ডব চালাবে যার উদ্দেশ্য থাকবে লোকসভা নির্বাচনে রাজ্য থেকে অন্তত ২০টি’র বেশি আসন দখল করা। আর এ কাজে তারা ইতিমধ্যেই অন্য দুটি বিরোধী দলকে একেবারে অকেজো করে দিয়ে নিজেদের পিছনে সামিল করে নিয়েছে। এমন এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে শেষমেশ সার্বিক চিত্রটি কেমন দাঁড়ায়, তার জন্য আমাদের ১১ জুলাই অবধি অপেক্ষা করতে হবে।  

        

3 comments:

  1. গ্রাম উন্নয়নের বিবিধদিক আলোচনায় এলে ভালো হতো। রাজনৈতিক দিকটি খানিকটা আলোচনা হলেও অন্যান্য কাঠামো ও তার প্রভাব আলোচনা ভবিষ্যতে হলে ভালো।

    ReplyDelete
  2. আজকে 15ই জুলাই। প্রতিদিন দু-তিন জনের মারা যাওয়ার খবর শুনতে হচ্ছে। ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। ঘেন্না ধরে যাচ্ছে। বিকেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা, সুস্থ অর্থনীতির একটা অঙ্গ। আর্থিক ক্ষমতা কেন্দ্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা তাকে কি কদর্য রূপে হাজির করেছে।

    ReplyDelete