বিহারের ভোটের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে
সুমন সেনগুপ্ত
অবশেষে বিহারের নির্বাচনে বিরোধী জোটের আনুষ্ঠানিক সাংবাদিক সম্মেলন হল। মহাগঠবন্ধনের এই সাংবাদিক সম্মেলন (২৩ অক্টোবর) থেকে রাষ্ট্রীয় জনতা দলের তেজস্বী যাদব এবং বিকাশশীল ইনসান পার্টির মুকেশ সাহানির নাম যথাক্রমে মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যতম উপমুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যদিও মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তেজস্বী'র নাম নিয়ে খুব বেশি দ্বিমত ছিল এমনটা নয়, তবুও এই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছিল না বলে কিছু যে অসুবিধা হচ্ছিল, তা তাদের অতি বড় সমর্থকেরাও হয়তো অস্বীকার করবেন না। তবে, এনডিএ'কে পরাজিত করে মহাগঠবন্ধন বা সেই অর্থে ইন্ডিয়া জোট যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলে মুকেশ সাহানির মতো একজন অতি পিছড়ে জাতের নেতাকে যে অন্যতম একজন উপমুখ্যমন্ত্রী করা হবে, এই ঘোষণার একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে।
যে সময়ে বিহারে বিরোধীদের ১৮ দিন ব্যাপী ‘ভোট চোর/ গদ্দি ছোড়’ শ্লোগানকে সামনে রেখে ১৬০০ কিলোমিটার পদযাত্রা হচ্ছিল, তখন রোজকার দৃশ্যের মধ্য দিয়ে বোঝাই যাচ্ছিল এবারে বিজেপি বিরোধী শক্তি যথেষ্ট ঐক্যবদ্ধ। এও স্পষ্ট হচ্ছিল, রাহুল গান্ধী, তেজস্বী যাদব, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য ও মুকেশ সাহানি'রা বিজেপি বিরোধী একটা হাওয়া তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন এবং মানুষ তাঁদের ওপর এবার ভরসা করতে রাজি। যেন, ২০ বছরের নীতিশকুমার সরকারকে পরাস্ত করতে মানুষ নীচের তলায় একটা অলিখিত ঐক্যমত্যে পৌঁছে গেছে। শুধু ‘ভোট চোর গদ্দি ছোড়’ নয়, মানুষের মুখে মুখে সেই সময় থেকেই আরও একটা শ্লোগান ঘুরছিল-- ‘বদলো বিহার, বদলো সরকার’, অর্থাৎ, বিহারকে বদলাতে গেলে বিহারের সরকারকে বদলাতে হবে। ওই যাত্রার বিভিন্ন সমাবেশে দেখা যাচ্ছিল, কখনও রাহুল গান্ধী ও তেজস্বী যাদব বাইকে সওয়ারি হয়েছেন, কখনও দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে রাহুল কথা বলছেন, কখনও মুকেশ সাহানিকে মাইক এগিয়ে দিচ্ছেন তেজস্বী যাদব। এই সমস্ত দৃশ্য গোদি মিডিয়াতে না দেখালেও সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে মূহুর্তে কিন্তু ছড়িয়ে পড়ছিল সারা দেশ জুড়ে। বিরোধী ঐক্যের এই ছবিই তো সারা ভারত দেখতে চায়।
যে বিজেপিকে মানুষ ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ‘অব কি বার চারশো পার’ থেকে ২৪০ আসনে আটকে দিতে পেরেছিলেন, তাঁরা হয়তো এও ভাবছিলেন, এই ঐক্যবদ্ধ বিরোধী জোটের শক্তির ওপর ভরসা করে বিহারে নিশ্চিত বিজেপিকে পরাজিত করা সম্ভব হবে। কিন্তু নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার পরে সেই বিরোধী দলগুলো যখন আসন বন্টন নিয়ে সমঝোতায় আসতে পারছিল না, তখন সাধারণ মানুষ কিন্তু হতাশই হচ্ছিলেন। প্রায় সব বিরোধী দলের উচ্চতর নেতৃত্বের থেকে যখন আশা করা হচ্ছিল যে তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে সুষ্ঠুভাবে আসন বন্টন করতে পারবেন, তখন কোথাও কংগ্রেসের প্রদেশ সভাপতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় জনতা দল প্রার্থী দিচ্ছে, কখনও মুকেশ সাহানি'র ভাইয়ের বিরুদ্ধে কংগ্রেস প্রার্থী দিচ্ছে বা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কংগ্রেসের আসন নিয়ে সমস্যা হচ্ছে।
এই সময়েই এগিয়ে আসেন সিপিআই(এমএল)'এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। তিনি ছোট দল এবং বড় দলগুলোর মধ্যে একটা সমন্বয় গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। গত ২০২০ সালের নির্বাচনে সিপিআই(এমএল) ১৯টির মধ্যে ১২টি আসন জিতলেও, এবারে নিজেদের ৪০টি আসনের দাবি থেকে সরে এসে ২০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও দলের কর্মী ও সমর্থকেরা এতে হতাশ হন, কিন্তু পরে বোঝেন যে বড় কিছুর জন্য অনেক ছোট কিছু ছাড়তে হয়। অবশ্য, আমাদের দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের নেতাদের মাথায় এই সাধারণ বোধের খুব অভাব। তাঁরা এখনও মনে করেন, অন্য যে কোনও দলের মতোই বিজেপিও একটি দল। অন্য যে কোনও দলের থেকে যে বিজেপি আলাদা, মতাদর্শগত ভাবে যে এক ফ্যাসিবাদী শক্তি, তা এখনও বুঝতে চাইছে না বা পারছে না বেশ কিছু দল ও তাদের নেতারা। ফলত, এখনও তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করেই চলেছে-- ‘তুই বিড়াল না মুই বিড়াল’ আর পিঠে খেয়ে চলে যাচ্ছে বান্দরে। সেই উপলব্ধি থেকে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য মুকেশ সাহানি'কে মহাগঠবন্ধনে রাখতে উদ্যোগী হন। তাদেরকেও ১৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে রাজি করান, এমনকি মুকেশ সাহানিকে আরও বড় ভূমিকা নিতে হবে, তা বোঝান। ওদিকে কংগ্রেস এবং আরজেডি’র মধ্যে বনিবনা কিন্তু কিছুতেই হচ্ছিল না। শেষমেশ কংগ্রেসের তরফ থেকে রাজস্থানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলটকে আসরে নামানো হয় এবং তিনি কংগ্রেসের উপরমহলের নির্দেশে লালু প্রসাদ যাদব, তেজস্বী কিংবা মুকেশ সাহানি সহ অন্যান্য দলের সঙ্গে কথা বলে সমস্যার সমাধান করেন।
বিরোধীদের এই সাংবাদিক সম্মেলনের অবশ্য আরও অনেক বেশি গুরুত্ব রয়েছে। ২০২০ সালে কোভিডের সময়ে বিজেপি ভেবেছিল, খুব সহজে বিহারে তারা জিতে যাবে। কিন্তু ফলাফল বেরনোর পরে স্পষ্ট হয়, বিষয়টা ততটা সহজ হয়নি। এবার যে লড়াই কঠিন, তা বিজেপি ও জেডিইউ বেশ ভালো উপলব্ধি করছে এবং সে ক্ষেত্রে 'বিশেষ নিবিড় সংশোধন' বা SIR করেও যে তাদের খুব বেশি লাভ হবে কিনা, সে বিষয়েও তারা নিশ্চিত নয়। তারা আরও একটা কথা বুঝতে পারছে, সিপিআই(এমএল) এবং তাদের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এই মহাগঠবন্ধনকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে ভালো ভূমিকা রেখেছেন এবং নতুন নতুন উপায় বার করছেন। সেই জন্যেই তারা বেছে বেছে সিপিআই(এমএল) প্রার্থী এবং সংগঠকদের পুরনো মামলায় গ্রেফতার করছে। তারা বুঝেছে, সিপিআই(এমএল)'এর বিধায়ক ও সাংসদ সংখ্যা যত বাড়বে তত শাসকশ্রেণির সামনে বুনিয়াদি প্রশ্নগুলি উঠে আসবে যা তাদের পক্ষে অস্বস্তিকর।
বলাই বাহুল্য, মহাগঠবন্ধন যে ঐক্যমত্যে পৌঁছতে পেরেছে তার জন্য অনেকটাই কৃতিত্ব দিতে হয় দীপঙ্কর ভট্টাচার্যকে। মুকেশ সাহানির বিকাশশীল ইনসান পার্টির সঙ্গে যে অতি পিছড়ে বর্গের নিষাদ ও মাল্লাদের বেশিরভাগ অংশটাই আছে, তা মহাগঠবন্ধনের সমস্ত শরিকই বুঝতে পারছিল, কিন্তু সম্মানজনক শর্তে তাদের এই জোটে সামিল করানোর কাজটা অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও তৎপরতার সঙ্গে দীপঙ্করই সম্পন্ন করেছেন। ভিআইপি ও ছোট দলের গুরুত্ব বোঝাতে তাই সাংবাদিক সম্মেলনে দীপঙ্কর বলেছেন যে গতবারের ৫টি দলের জোটের তুলনায় এবার ৭টি দলের জোট অনেক বেশি কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। কংগ্রেসও যে নতুন ভাবে ভাবছে এবং তাদের পাখির চোখ যে শুধু বিহার নয় আরও বড় কিছু, তা তারাও বোঝাতে পেরেছে। রাজস্থানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বর্ষীয়ান অশোক গেহলট তাই নিজেদের জায়গা অনেকটাই ছেড়ে দিয়ে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী ও উপমুখ্যমন্ত্রীর পদ প্রার্থী হিসেবে তেজস্বী যাদব এবং মুকেশ সাহানির নাম প্রস্তাব করেছেন। এরপরেও হয়তো কিছু জায়গায় (দুটি কি তিনটি আসনে) বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই হবে মহাগঠবন্ধনের শরিক দলগুলোর মধ্যে, কিন্তু তবুও বিহারে যদি মহাগঠবন্ধনের সমস্ত শীর্ষ নেতারা একত্রে প্রচার করেন তাহলে আবারও বিহারের মানুষের মধ্যে নিঃসন্দেহে আশার সঞ্চার হবে।
তবে অনেকে প্রশ্ন করছেন, প্রশান্ত কিশোরের 'জন সুরাজ পার্টি' কীরকম ফল করবে? এই মুহূর্তে যা বোঝা যাচ্ছে, প্রশান্ত কিশোর হয়তো এনডিএ জোটের ভোটেই ভাগ বসাবে। তাঁর কথা এবং বক্তব্য হয়তো সামাজিক মাধ্যমে অনেক চোখে পড়ছে, কারণ, সে সব কীভাবে করতে হয় তা প্রশান্ত কিশোর খুব ভালো জানেন। সামাজিক মাধ্যমের অ্যালগরিদম হয়তো দৃশ্যমানতা বাড়িয়ে তোলে, কিন্তু তা সংগঠন না থাকলে ভোটে প্রভাব ফেলবে না বলেই আমার বিশ্বাস। ৩ থেকে ৪ শতাংশ ভোট হয়তো তাঁর দল পাবে, কিন্তু আসন একটাও হয়তো পাবে না।
অনেকেরই মত, মহাগঠবন্ধন যদি তাদের ঐক্যবদ্ধ চেহারা মানুষের সামনে দেখাতে পারে, তাহলে হয়তো নীতিশকুমার পর্বের এবার অবসান হতে চলেছে। তারপরে তিনি যদি আবার তেজস্বী’র সঙ্গে এক মঞ্চে আসতে চান, তাহলেও শেষ বিচারে জোটেরই লাভ। কারণ, মনে রাখতে হবে, এই নীতিশকুমার কিন্তু ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সূচনা পর্বে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন। রাজনীতি সম্ভাবনার ক্ষেত্র, কখন কী হয় কেউই কি বলতে পারে?
এবারের বিহারের ভোটের ফলাফল কিন্তু ভারতীয় রাজনীতির চেহারা ও চলন বদলে দিতে পারে। নির্বাচন কমিশনের সমস্ত রকমের সুবিধা পেয়েও হয়তো বিজেপি পরাজিত হতে পারে, আর তারপরে দিল্লির গদিটাও না টলমল করে! ফলে, বিহারে বিজেপি কিন্তু বাধ্য নীতিশকুমারকে সমর্থন করতে, অথচ নীতিশকুমারের সে বাধ্যবাধকতা নেই।









