Wednesday, 8 October 2025

উত্তরবঙ্গে এই বিপর্যয় কেন?

প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান বিনা রাস্তা নেই 

আবু সঈদ আহমেদ

অকুতোভয় ডাঃ ইরফান মোল্লা নাগরাকাটায় নিজের জীবন বাজি রেখে দড়ি ধরে ঝুলে ঝুলে চলেছেন ভূমি ধস ও বন্যায় আটকে পড়া বিপন্ন রোগীদের শুশ্রূষায়


এই প্রতিবেদনটি যখন লিখতে বসেছি, খবরে প্রকাশ, মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) সন্ধ্যে ৬-৩০ নাগাদ হিমাচল প্রদেশের বিলাসপুর জেলায় বার্থি গ্রামের কাছে যাত্রীবাহী একটি চলন্ত বাসের উপর প্রবল ভূমি ধসে অন্তত ১৮ জনের প্রাণ গেছে। বলাই বাহুল্য, বর্ষাকালে উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, সিকিম ও ভুটানে ভূমি ধস, ক্লাউড বার্স্ট, ভূমিকম্প ও তুষার ধস নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৩ সালের কেদারনাথ বিপর্যয়, ২০২৩ সালের মাণ্ডি জেলার বন্যা এবং সিমলার ভবন ধস — এসব ঘটনা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ভয়াবহতাকে তুলে ধরে। পাশাপাশি, হিমালয় অঞ্চলে টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে আর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ভয়াবহ বিপদের কারণ হয়ে উঠছে।

এবারের এই সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের পার্বত্য-তরাই অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা ও ভূমি ধস গত কয়েক দশকের মধ্যে অন্যতম ভয়াল প্রাকৃতিক বিপর্যয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ৪-৫ অক্টোবরের মধ্যে মাত্র ১২ ঘণ্টায় ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে দার্জিলিং, কালিম্পং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ার জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। দার্জিলিং জেলার মিরিক, সুকিয়াপোখরি, জোরেবাংলো ও নাগরাকাটা এলাকায় প্রায় ১০০টি ভূমি ধস হয় এবং বালাসন নদীর উপর দুধিয়া লোহার সেতু ভেঙে পড়ে, ফলে, মিরিক ও কার্শিয়াং-এর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জাতীয় সড়ক ১০ ও ৫৫ সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়, সিকিম কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ৩২ জনের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে নেপাল ও ভুটানের নাগরিকও ছিলেন। শতাধিক পর্যটক দুর্গাপূজার ছুটিতে আটকে পড়েন। এই বিপর্যয়ের জন্য ভুটানের তালা জলবিদ্যুৎ বাঁধ থেকে অতিরিক্ত জল ছেড়ে দেওয়া এবং তিস্তা নদীর জলস্তর হঠাৎ বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা হয়েছে। তরাই অঞ্চলের জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, এমনকি উত্তর দিনাজপুর জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়; তিস্তা, তোর্সা ও কালজানি নদীর জলস্তর বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গিয়ে বহু গ্রাম প্লাবিত করে, ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, ফালাকাটা, দিনহাটা ও তুফানগঞ্জ এলাকায় শতাধিক বাড়ি ধ্বংস হয় এবং হাজারও মানুষ ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। ইসলামপুর ও চোপড়ায় অতিবৃষ্টির ফলে রেল ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, স্কুল ও সরকারি ভবন জলমগ্ন হয়, বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের সরবরাহ ব্যাহত হয় এবং কৃষি ও স্থানীয় ব্যবসা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

দু-তিনদিনের এই ব্যাপক বিপর্যয়ে অন্তত ৩৬ জন মারা গেছেন বলে খবরে প্রকাশ। জল যত নামছে আরও লাশ মিলছে। প্রশাসন জরুরি ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করলেও অপর্যাপ্ত নিকাশি ব্যবস্থা ও ভাঙাচোরা রাস্তার কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগছে, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপ সৃষ্টি করে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ, অস্থায়ী সেতু নির্মাণ, পর্যটকদের বিনামূল্যে হোটেল ও পরিবহন সুবিধা এবং জলে ভেসে যাওয়া নথিপত্র পুনরায় ইস্যুর জন্য বিশেষ ক্যাম্প ঘোষণার মাধ্যমে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

উত্তরবঙ্গ, নেপাল, সিকিম ও ভুটানের পার্বত্য অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে ধস, তুমুল বৃষ্টিপাত, আকস্মিক বন্যা এবং প্রাণহানির ঘটনা এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে। এই বিপর্যয়গুলো কি শুধুই প্রকৃতির রুদ্ররূপ, নাকি আমাদের অতি উন্নয়ন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং বনভূমি ধ্বংসেরই প্রতিফলন? গত ২৫ বছরে ভারতের পার্বত্য অঞ্চলে প্রায় ৩০ শতাংশ বনভূমি হারিয়ে গেছে। কলকারখানা, রিসর্ট, আবাসন প্রকল্প, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও পর্যটনের চাপ পাহাড়ি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। জোশীমঠ শহরে ভূমি ধসের ফলে তা 'সিঙ্কিং টাউন' হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে, যা মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের জ্বলন্ত উদাহরণ।

সকলেই জানেন, পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমিক্ষয় রোধ, জলধারণ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে গাছপালা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বনভূমি না থাকলে পাহাড়ি ঢালুতে মাটি ধুয়ে যায়, ঝর্না শুকিয়ে আসে এবং প্রাণী-উদ্ভিদের আবাসস্থল লুপ্ত হয়। ভারত ও বাংলাদেশের বন সংরক্ষণ নীতিমালায় পাহাড়ি অঞ্চলে অন্তত ৫০ শতাংশ বনভূমি থাকা আদর্শ বলে বিবেচিত। ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়া'র তথ্য অনুযায়ী, ভারতের মোট বনভূমির পরিমাণ বেড়েছে মূলত সমতল অঞ্চলে সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে। কিন্তু পাহাড়ি অঞ্চলে বন ধ্বংসের হার উদ্বেগজনক। এর ফলে ভূমিক্ষয়, জলধারণ ক্ষমতা হ্রাস, জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়া এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা বিপন্ন হওয়ার মতো ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিককালে উত্তরবঙ্গ ও সংলগ্ন অঞ্চলে বিতর্কিত নির্মাণ প্রকল্পগুলোর মধ্যে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণ এবং পাহাড় কেটে হোটেল নির্মাণ এইসব অঞ্চলকে আচম্বিত দুর্ঘটনা, অযাচিত প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও বিপুল প্রাণহানির আশঙ্কার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

১৯৮০-এর দশক থেকে শুরু করে ২০০৬, ২০১১ ও ২০২৩ সালে সিকিমে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে, যার ফলে ব্যাপক ভূমি ধস ও অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। ২০০৭ ও ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, কালিম্পং ও জলপাইগুড়ি জেলায় প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে শতাধিক ভূমি ধস হয়, যা বহু মানুষের প্রাণহানি ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা ঘটায়। ২০২৩ সালের অক্টোবরে সিকিম ও উত্তরবঙ্গ অঞ্চলে অতিবৃষ্টি ও জলবিদ্যুৎ বাঁধ ভেঙে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়, যার ফলে ১৭ জনের মৃত্যু এবং জাতীয় সড়ক-১০ সহ বহু রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬৮ সালের ঐতিহাসিক বন্যার পুনরাবৃত্তি হিসেবে ২০২৩ সালের বিপর্যয়কে বিবেচনা করা হয়, যেখানে তিস্তা নদীর জল বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গিয়ে বহু সেতু ও বসতির ক্ষতি করে। ২০২৩ সালে সিকিমে দক্ষিণ লোনার্ক হিমবাহ বাঁধ ভেঙে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়, যার প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং ও জলপাইগুড়ি জেলাও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ ছিল জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও অপরিকল্পিত নির্মাণ, যা নদীর স্বাভাবিক গতিপথে বাধা সৃষ্টি করেছিল। এছাড়া চারধাম প্রকল্পের অধীনে পাহাড় কেটে টানেল নির্মাণ এবং জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কাজও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। কারণ, এইসব প্রকল্প ভূমি ধস প্রবণ এলাকায় পরিবেশগত সতর্কতা উপেক্ষা করে পরিচালিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বার বার সতর্ক করেছেন যে, এইসব অঞ্চলে অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ ও পর্যটনের সুবিধা বৃদ্ধির জন্য পাহাড়ের গঠন ও নদীর নিকাশি ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি করছে।

ডঃ ইসফাক হুসেন মালিক ও ডঃ জেমস ডি ফোর্ড'এর গবেষণার বিষয় ছিল 'হিমালয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের ভঙ্গুরতা পর্যবেক্ষণ'। এই গবেষণাটি ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত একটি দীর্ঘমেয়াদী মূল্যায়ন, যা বিশেষ করে ভূমি ধস, বন্যা, গ্লেসিয়ার লেক আউটবার্স্ট (GLOF) এবং মানুষের বাস্তুচ্যুতি বিষয়ের উপর আলোকপাত করে। তাঁদের গবেষণাপত্রটি রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্সেস'এর জার্নাল Ambio'তে ২০২৪ সালে অনলাইনে প্রকাশ পায়। গবেষণায় উঠে আসে, 'জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা পরিবর্তন পাহাড়ি অঞ্চলে বিপর্যয় বাড়াচ্ছে। পর্যটন, নারী ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও বন ধ্বংস ভূমি ধসের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।' এর বিষময় ফলাফল-- স্বাস্থ্যঝুঁকি, মানসিক চাপ, অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা।

২০২১ সালে World Development Perspectives জার্নালে ডঃ প্রবীণ ভূষাল ও তাঁর গবেষক দলের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ পায় যার শিরোনাম ছিল: হিমালয় অঞ্চলে পরিবেশগত অভিবাসন। সেখানে তুলে ধরা হয় হিমালয় অঞ্চলে জলবায়ু-প্রভাবিত বাস্তুচ্যুতি ও অর্থনৈতিক সংকটের চিত্র। এই গবেষক দলে কবিরাজ অবস্থি ও জুড কিমেংসি'র মতো বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরাও ছিলেন। তাঁদের বিবরণে জানা যায়, ভূমি ধস ও বন্যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা ও কৃষি উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে। শহরমুখি অভিবাসন বাড়ছে, যার ফলে নগর এলাকায় চাপ বাড়ছে। শ্রমশক্তির অভাব গ্রামীণ অর্থনীতিকে দুর্বল করছে। ২০২২ সালের আরেকটি গবেষণা অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার ৩৪ শতাংশ ভূমি ধস ঘটে হিমালয় অঞ্চলে। অপরিকল্পিত বসতি, বন উজাড় ও ভূতাত্ত্বিক গঠন ভূমি ধসের প্রধান কারণ। জলবায়ু পরিবর্তন ও নগরায়ণ ভূমি ধসের হার বাড়াচ্ছে।

এখনই সময় প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান গড়ে তোলার, না হলে এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি আরও ঘন ঘন, আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। এই ভয়াল পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজন পরিকল্পিত বন সংরক্ষণ, স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন নীতি গ্রহণ এবং দুর্যোগ প্রস্তুতি। পরিকাঠামো নির্মাণে পরিবেশগত মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করা উচিত, যাতে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা পায়।


No comments:

Post a Comment