ভূপ্রকৃতি পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র বাঁচানোর লড়াই
শান্তনু চক্রবর্তী
গতকাল (২৬ মার্চ) ইঞ্জিনিয়ার, উদ্ভাবক, বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী সোনাম ওয়াংচুক ও অবসরপ্রাপ্ত সুবাদার সিরিং স্তানবা (Tsering Stanba) তাঁদের ২১-দিনের অনশন সত্যাগ্রহ সমাপ্ত করলেন। ওয়াংচুক বারে বারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং গৃহমন্ত্রী অমিত শাহকে লাদাখবাসীর ন্যায়সংগত দাবি ও বিজেপির নিজস্ব প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়েছেন। কিন্তু, কেন্দ্রীয় সরকারের হেলদোলের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
আজ (২৭ মার্চ) থেকে শুরু হচ্ছে লাদাখি মহিলা সংগঠনগুলোর লাগাতার দশ-দিনের উপবাস। তারপরে যুবকরা উপবাসে বসবেন; তারপরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এবং বয়স্ক মানুষরা। তারপর হয়তো ওয়াংচুক আবার। অর্থাৎ, চলবে। এই পরিস্থিতিতে লাদাখবাসীর আন্দোলন সম্পর্কে যে প্রশ্নগুলোর উত্তর মানুষ খুঁজতে চাইবেন, তার কয়েকটি নীচে আলোচনা করা হল।
প্রশ্ন ১) লাদাখ আন্দোলনের লক্ষ্য কী?
উত্তর: আন্দোলনের লক্ষ্য—
লাদাখের পাহাড়গুলির অবস্থা যাতে হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড ও সিকিমের পাহাড়গুলির মতো না হয়
এবং
লাদাখের প্রকৃতি-পরিবেশ-বাস্তুতন্ত্র ও তার নিজস্ব
সাংস্কৃতিক পরম্পরা যাতে সুরক্ষিত থাকে
তার জন্য
সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিল
মারফত লাদাখের জনজাতি (ট্রাইবাল) অঞ্চলগুলির স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা ও অনতিদূর
ভবিষ্যতে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে লাদাখ একটি স্বশাসিত রাজ্য হওয়া।
প্রশ্ন ২) ওয়াংচুক বারে বারে বলছেন যে বিজেপি লাদাখের
মানুষের কাছে তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। ঠিক কোন প্রতিশ্রুতির কথা বলা
হচ্ছে?
উত্তর: ২০১৯ সালের লোকসভা এবং ২০২০ সালে লাদাখের পার্বত্য পরিষদ নির্বাচনে বিজেপি
লাদাখের মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে লাদাখকে ষষ্ঠ তফশিলের অন্তর্ভুক্ত
করবে যাতে লাদাখের মানুষের জমিজমা, কর্মসংস্থান, প্রকৃতি-পরিবেশ সুরক্ষিত হয়।
লাদাখের লোকসভা আসন ও লেহ্-এর পার্বত্য পরিষদে বিজেপির জয়ের পেছনে এই
প্রতিশ্রুতির একটা বড় ভূমিকা ছিল।
লাদাখবাসীর রাজ্যের দাবিটি তুলনায় সাম্প্রতিক। বিজেপির
প্রকাশিত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে এটি ছিল বলে জানা যায় না। নির্বাচনী
বক্তৃতায় অবশ্য এসে থাকতে পারে।
প্রশ্ন ৩) ষষ্ঠ তফশিল অঞ্চল না হওয়ার ফলে লাদাখবাসীর কী অসুবিধা হচ্ছে এবং ষষ্ঠ তফশিল হলে লাদাখবাসীর ঠিক কী সুবিধা হবে?
উত্তর: ২০১৯ সালের অগস্ট মাস
অবধি জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য ছিল সংবিধানের ৩৭০ ধারার আওতায়। এই সময়, লাদাখও ছিল জম্মু
ও কাশ্মীর রাজ্যের অন্তর্গত। ফলে, লাদাখের ক্ষেত্রেও বলবৎ ছিল ৩৭০ ধারা। ৩৭০ ধারা
অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের বাইরের মানুষ বা বিনিয়োগকারী সংস্থা ওই রাজ্যে
জমি কিনতে পারতেন না। সেই সুবাদে লাদাখেও জমিজমা ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর স্থানীয়
মানুষের নিয়ন্ত্রণ ছিল।
২০১৯-এ ৩৭০ ধারা উধাও হল। তারপর, ২০১৯-এর নতুন আইনে লাদাখ জম্মু ও কাশ্মীর থেকে বেরিয়ে হয়ে গেল স্বতন্ত্র কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। অধিকাংশ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মতো তার কোনও বিধানসভা থাকল না। ফলে, আসল ক্ষমতা লেফটেনান্ট গভর্নরের হাতে। ওদিকে ৩৭০ ধারা না থাকায় জম্মু ও কাশ্মীরে এখন বাইরের লোকেরা জমি কিনছে; বাইরের বিনিয়োগ ঢুকছে, বাইরের লোক চাকরি পাচ্ছে। লাদাখিরা তা জানতে পারল। বুঝল, ৩৭০ ধারার অনুপস্থিতিতে এখন কেন্দ্রীয় সরকার বা যে-কোনও বিনিয়োগকারী সংস্থা আঞ্চলিক মানুষের ইচ্ছা-অভিরুচি-উদ্বেগ-আশঙ্কার তোয়াক্কা না করে এখানে যে-কোনও পরিমাণে জমি দখল করতে পারে— কেন্দ্রীয় সরকারের ছাড়পত্র নিয়ে প্রকল্প চালু করতে পারে। পার্বত্য পরিষদ দিয়ে তা আটকানো যাবে না। শুধু পারে না, তাই হওয়ার সূচনা হচ্ছে। কারণ, পরিষদের ক্ষমতা খুব সীমিত। গোটা লাদাখের উপর নিয়ন্ত্রণ লেফটেনান্ট গভর্নরের।
ষষ্ঠ তফশিলের আওতাভুক্ত হলে লাদাখের জমিজমা প্রাকৃতিক
সম্পদ সবই লাদাখের মানুষের গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের আওতায় আসবে। ষষ্ঠ তফশিলের রেওয়াজ
অনুযায়ী, লাদাখে তৈরি হবে লাদাখি জনজাতি নির্বাচিত আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদ এবং তারাই
ঠিক করবে অঞ্চল ও জেলার অর্থনৈতিক বিকাশ কেমন ঢঙে ও কীভাবে হবে। তারা যেহেতু নিজেদের
অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি-বাস্তুতন্ত্রকে নিবিড়ভাবে জানে ও সে সব সম্পর্কে তাদের স্বাভাবিক
দরদ আছে, তাদের পক্ষে সে সবের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে অর্থনৈতিক বিকাশের পরিকল্পনা
করা সহজ হবে।
প্রশ্ন ৪) কেন, ৩৭০-এর আওতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর লাদাখে এমন কী
ঘটেছে যাতে ওয়াংচুক বা অন্যান্য লাদাখবাসীর উদ্বেগের যথাযথ কারণ থাকতে পারে?
উত্তর: আজকাল বাইরের মানুষ
লাদাখে অনেক বেশি সহজে পৌঁছতে পারলেও, মালপত্র-যন্ত্রপাতি লাদাখে পৌঁছনো
কাশ্মীরের তুলনায় এখনও অনেক বেশি কঠিন। কিন্তু, ৩৭০ ধারার আওতা থেকে লাদাখ বেরিয়ে
যাওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকার লাদাখে যোগাযোগ ব্যবস্থা বাড়ানোর ব্যাপারে ভীষণ ব্যস্ত
হয়ে উঠেছে। কোভিড অতিমারীর জন্য সব কিছু দেরি হওয়া সত্ত্বেও, লাদাখে ৭৫০.২১ কিলোমিটার
রাস্তা নতুন নির্মাণ হয়েছে কিংবা পুরনো রাস্তা সারানো হয়েছে, ২৯টি নতুন ব্রিজ
তৈরি হয়েছে এবং ৩০টি নতুন হেলিপ্যাড বসেছে। পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে শ্রীনগর থেকে
কারগিলে সহজে পৌঁছনোর লক্ষ্যে জোজি লা সুড়ঙ্গ (Zoji La Tunnel), সহজে
সীমান্তে পৌঁছনোর উদ্দেশ্যে তৈরি হচ্ছে কারগিল-জানস্কার রোড, এবং গতকাল
সন্ধ্যাতেই সম্পূর্ণ হল লাদাখে পৌঁছনার তৃতীয় এবং সবচেয়ে কম কঠিন রাস্তা— ২৯৮ কিমি
দীর্ঘ নিম্মু-পদম-দরচা রোড, যা লাদাখকে যুক্ত করল হিমাচল প্রদেশের সঙ্গে।
শুধু সীমান্তের সঙ্গে উন্নততর
সংযোগ আর পর্যটন উৎসাহিত করা নয়, আরও ব্যাপার আছে। ২০০৭ সালেই উত্তর লাদাখের
নুবরা-শিওক উপত্যকার ভূপ্রস্তরে পাওয়া গিয়েছে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম-থোরিয়াম
ডিপোজিটের হদিশ। চিনের সঙ্গে সীমান্ত অঞ্চল। তার উপরে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ
আবিষ্কার। তাই, ২০০৭-৮ সালের পর এই নিয়ে আর কোনও কথা মিডিয়াতে বা জনপরিসরে
প্রকাশিত গবেষণাপত্রে অনুপস্থিত।
এখানেই শেষ নয়!
ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি নির্মাণের
ক্ষেত্রে অত্যন্ত মূল্যবান যে প্ল্যাটিনাম গোষ্ঠীর ধাতু— যথাক্রমে প্ল্যাটিনাম,
প্যালাডিয়াম, রোডিয়াম, রুথেনিয়াম, ইরিডিয়াম ও অসমিয়াম— সেই ধাতুগুলির আকরের সন্ধান
মিলেছে লাদাখে। সবগুলোই দুষ্প্রাপ্য ও দামি। তার মধ্যে রোডিয়াম সোনার চেয়েও দামি।
তাই, কেন্দ্রীয় সরকার ও নানা
বিনিয়োগকারী যে লাদাখের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপনে উৎসাহী
হবেন তাতে আশ্চর্য কিছু নেই। আর, লাদাখের বিভিন্ন কোণে পৌঁছে যাওয়ার যোগাযোগ আরও
সহজ হলে পর্যটন ও হোটেল ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারীদের আটকে রাখা মুশকিল হবে। বাড়বে যোগাযোগ,
হু হু করে বাড়বে গাড়ি, বাস, লরির যাতায়াত, বাড়বে হোটেল, রিসর্ট ও নানা কিসিমের
পর্যটনকেন্দ্র। জলের মতো টাকা ঢুকলে পরিবেশ, স্বাস্থ্য, জননিরাপত্তা-সংক্রান্ত
প্রাথমিক সুরক্ষা ও সাবধানতার নিয়মগুলো লঙ্ঘিত হতে থাকবে— যেমন হয়েছে উত্তরাখণ্ড,
হিমাচল ও সিকিমে। পাহাড়ের সর্বনাশ হবে, হবে লাদাখবাসীর সর্বনাশ।
প্রশ্ন ৫) ওয়াংচুক বারে বারে বলছেন
হিমবাহের কথা। সে সব কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
উত্তর: হিমালয় ও কারাকোরাম রেঞ্জের মধ্যে গুঁজে রয়েছে
লাদাখ। জলবায়ু বদলের ফলে পৃথিবী জুড়ে হিমবাহ গলছে। বিপন্ন হচ্ছে এই গ্রহের নদীগুলি।
সুমেরু ও কুমেরু অঞ্চলের বাইরে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি হিমবাহ আছে হিমালয় ও কারাকোরোম
রেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলে। লাদাখের নদীগুলি এবং লাদাখবাসীর জলের জোগান হিমালয় ও কারাকোরাম
রেঞ্জের হিমবাহগুলির উপর নির্ভরশীল।
কিন্তু শুধু গ্রহের জলবায়ু
বদলের জন্যই হিমবাহ গলছে তা নয়। আঞ্চলিক কাণ্ডকারখানার একটা বিরাট ভূমিকা আছে।
যেমন, আপনার আশপাশের তাপমাত্রা যতটা গ্রহের জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল ততটাই নির্ভরশীল
আপনার আশপাশে কী ঘটছে তার উপর (যেমন আপনি ঘরের মধ্যে উনুনের কাছে আছেন নাকি পুকুর
পাড়ে গাছের ছায়ায় আছেন), তেমনই হিমবাহের স্বাস্থ্যও নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক
কাণ্ডকারখানার উপর। হিমবাহের কাছাকাছি যদি নগরায়ন ঘটে, শয়ে শয়ে বা হাজারে হাজারে
গাড়ি যায়, বড় নির্মাণকার্য হয়— স্বাভাবিকভাবেই পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা বাড়বে এবং
হিমবাহ আরও বেশি বেশি করে গলবে। সাম্প্রতিক গবেষণা দেখাচ্ছে যে ২০০১ থেকে ২০১৯-এর
মধ্যে, লাদাখের পাংগং এলাকার হিমবাহগুলি বেশ খানিকটা গলেছে। লাদাখের ব্যাপক
‘উন্নয়ন’ শুরু হলে সে সব হিমবাহর দশা কী হবে তা নিয়ে সন্ত্রস্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ
আছে। ওয়াংচুক এসব প্রসঙ্গ এনেছেন।
প্রশ্ন ৬) ধরা যাক যষ্ঠ তফশিল হল। এমনকী
লাদাখ একটি স্বতন্ত্র রাজ্য হল এবং নিজের বিধানসভা পেল। তাতেই কি এই সমস্যাগুলো
উধাও হবে?
উত্তর: উধাও হবে এমন দাবি করা হচ্ছে না। কিন্তু এগুলো
হলে কেন্দ্রীয় সরকার বা বাইরের কর্পোরেট সংস্থার পক্ষে ‘উন্নয়ন’-এর নামে আস্তিন
গুটিয়ে লাদাখের ভূপ্রকৃতির বারোটা বাজানোর বন্দোবস্ত করা কঠিন হবে। এই কারণে
অন্ততপক্ষে ষষ্ঠ তফশিলটুকু দরকার। রাজ্য হলে তো লাদাখবাসীর স্বনিয়ন্ত্রণের আরও
সুবিধা।
তারপর বেশ খানিকটা লাদাখবাসীর
হাতে থাকবে। জনজাতি গোষ্ঠীগুলির বহু শতাব্দী ধরে অর্জিত আঞ্চলিক পরিবেশ ও
বাস্তুতন্ত্র সংক্রান্ত কাণ্ডজ্ঞান এবং সোনাম ওয়াংচুক ও তাঁর দ্বারা প্রভাবিত
মানুষজনের বুদ্ধি ও বিদ্যা যদি নির্বিচার লোভ ও মুনাফামুখী অর্থনীতি ও সংস্কৃতির
প্রভাবকে অনেকটা লাগামে রাখতে পারে তাহলে লাদাখের ভূপ্রকৃতি-পরিবেশ-বাস্তুতন্ত্র
অনেক দূর সুরক্ষিত হবে। মুসলমানপ্রধান কারগিল জেলা ও বৌদ্ধপ্রধান লেহ্ জেলার মধ্যে
পারস্পরিক সন্দেহের খানিকটা আবহাওয়া ছিল। গত দু-তিন বছরে তা অনেকটা স্বাভাবিক
হয়েছে। কারগিল ও লেহ্ একজোট হয়ে ষষ্ঠ তপশিল ও স্বতন্ত্র রাজ্যের দাবি জানাচ্ছে।
ফলে, বিজেপি কোণঠাসা এবং কেন্দ্রীয় সরকার বিপদে পড়েছে। যদি এই সৌহার্দ্য টিকে থাকে
ও ভবিষ্যতে আরও বাড়ে তাহলে লাদাখবাসীর সুবিধা। আর, রাজ্যের প্রশাসন ও ষষ্ঠ তফশিলের
প্রশাসনের মধ্যে দ্বন্দ্বের যে সম্ভাবনা তার নিষ্পত্তির ফর্মুলা যদি তাঁরা বার করতে
পারেন তাহলে তো সোনায় সোহাগা।
বুক ভরে আশা করতে দোষ কি?