Pages

Wednesday, 27 March 2024

লাদাখের পথে মানুষ

ভূপ্রকৃতি পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র বাঁচানোর লড়াই

শান্তনু চক্রবর্তী



গতকাল (২৬ মার্চ) ইঞ্জিনিয়ার, উদ্ভাবক, বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী সোনাম ওয়াংচুক ও অবসরপ্রাপ্ত সুবাদার সিরিং স্তানবা (Tsering Stanba) তাঁদের ২১-দিনের অনশন সত্যাগ্রহ সমাপ্ত করলেন। ওয়াংচুক বারে বারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং গৃহমন্ত্রী অমিত শাহকে লাদাখবাসীর ন্যায়সংগত দাবি ও বিজেপির নিজস্ব প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়েছেন। কিন্তু, কেন্দ্রীয় সরকারের হেলদোলের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। 

আজ (২৭ মার্চ) থেকে শুরু হচ্ছে লাদাখি মহিলা সংগঠনগুলোর লাগাতার দশ-দিনের উপবাস। তারপরে যুবকরা উপবাসে বসবেন; তারপরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এবং বয়স্ক মানুষরা। তারপর হয়তো ওয়াংচুক আবার। অর্থাৎ, চলবে। এই পরিস্থিতিতে লাদাখবাসীর আন্দোলন সম্পর্কে যে প্রশ্নগুলোর উত্তর মানুষ খুঁজতে চাইবেন, তার কয়েকটি নীচে আলোচনা করা হল।

প্রশ্ন ১) লাদাখ আন্দোলনের লক্ষ্য কী?

উত্তরআন্দোলনের লক্ষ্য—

লাদাখের পাহাড়গুলির অবস্থা যাতে হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড ও সিকিমের পাহাড়গুলির মতো না হয়

এবং

লাদাখের প্রকৃতি-পরিবেশ-বাস্তুতন্ত্র ও তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরম্পরা যাতে সুরক্ষিত থাকে

তার জন্য

সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিল মারফত লাদাখের জনজাতি (ট্রাইবাল) অঞ্চলগুলির স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা ও অনতিদূর ভবিষ্যতে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে লাদাখ একটি স্বশাসিত রাজ্য হওয়া।

প্রশ্ন ২) ওয়াংচুক বারে বারে বলছেন যে বিজেপি লাদাখের মানুষের কাছে তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। ঠিক কোন প্রতিশ্রুতির কথা বলা হচ্ছে?

উত্তর: ২০১৯ সালের লোকসভা এবং ২০২০ সালে লাদাখের পার্বত্য পরিষদ নির্বাচনে বিজেপি লাদাখের মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে লাদাখকে ষষ্ঠ তফশিলের অন্তর্ভুক্ত করবে যাতে লাদাখের মানুষের জমিজমা, কর্মসংস্থান, প্রকৃতি-পরিবেশ সুরক্ষিত হয়। লাদাখের লোকসভা আসন ও লেহ্‌-এর পার্বত্য পরিষদে বিজেপির জয়ের পেছনে এই প্রতিশ্রুতির একটা বড় ভূমিকা ছিল। 

লাদাখবাসীর রাজ্যের দাবিটি তুলনায় সাম্প্রতিক। বিজেপির প্রকাশিত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে এটি ছিল বলে জানা যায় না। নির্বাচনী বক্তৃতায় অবশ্য এসে থাকতে পারে।      

প্রশ্ন ৩) ষষ্ঠ তফশিল অঞ্চল না হওয়ার ফলে লাদাখবাসীর কী অসুবিধা হচ্ছে এবং ষষ্ঠ তফশিল হলে লাদাখবাসীর ঠিক কী সুবিধা হবে?

উত্তর: ২০১৯ সালের অগস্ট মাস অবধি জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য ছিল সংবিধানের ৩৭০ ধারার আওতায়। এই সময়, লাদাখও ছিল জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অন্তর্গত। ফলে, লাদাখের ক্ষেত্রেও বলবৎ ছিল ৩৭০ ধারা। ৩৭০ ধারা অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের বাইরের মানুষ বা বিনিয়োগকারী সংস্থা ওই রাজ্যে জমি কিনতে পারতেন না। সেই সুবাদে লাদাখেও জমিজমা ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর স্থানীয় মানুষের নিয়ন্ত্রণ ছিল।

২০১৯-এ ৩৭০ ধারা উধাও হল। তারপর, ২০১৯-এর নতুন আইনে লাদাখ জম্মু ও কাশ্মীর থেকে বেরিয়ে হয়ে গেল স্বতন্ত্র কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। অধিকাংশ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মতো তার কোনও বিধানসভা থাকল না। ফলে, আসল ক্ষমতা লেফটেনান্ট গভর্নরের হাতে। ওদিকে ৩৭০ ধারা না থাকায় জম্মু ও কাশ্মীরে এখন বাইরের লোকেরা জমি কিনছে; বাইরের বিনিয়োগ ঢুকছে, বাইরের লোক চাকরি পাচ্ছে। লাদাখিরা তা জানতে পারল। বুঝল, ৩৭০ ধারার অনুপস্থিতিতে এখন কেন্দ্রীয় সরকার বা যে-কোনও বিনিয়োগকারী সংস্থা আঞ্চলিক মানুষের ইচ্ছা-অভিরুচি-উদ্‌বেগ-আশঙ্কার তোয়াক্কা না করে এখানে যে-কোনও পরিমাণে জমি দখল করতে পারে— কেন্দ্রীয় সরকারের ছাড়পত্র নিয়ে প্রকল্প চালু করতে পারে। পার্বত্য পরিষদ দিয়ে তা আটকানো যাবে না। শুধু পারে না, তাই হওয়ার সূচনা হচ্ছে। কারণ, পরিষদের ক্ষমতা খুব সীমিত। গোটা লাদাখের উপর নিয়ন্ত্রণ লেফটেনান্ট গভর্নরের।  

ষষ্ঠ তফশিলের আওতাভুক্ত হলে লাদাখের জমিজমা প্রাকৃতিক সম্পদ সবই লাদাখের মানুষের গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের আওতায় আসবে। ষষ্ঠ তফশিলের রেওয়াজ অনুযায়ী, লাদাখে তৈরি হবে লাদাখি জনজাতি নির্বাচিত আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদ এবং তারাই ঠিক করবে অঞ্চল ও জেলার অর্থনৈতিক বিকাশ কেমন ঢঙে ও কীভাবে হবে। তারা যেহেতু নিজেদের অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি-বাস্তুতন্ত্রকে নিবিড়ভাবে জানে ও সে সব সম্পর্কে তাদের স্বাভাবিক দরদ আছে, তাদের পক্ষে সে সবের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে অর্থনৈতিক বিকাশের পরিকল্পনা করা সহজ হবে।   

প্রশ্ন ৪) কেন, ৩৭০-এর আওতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর লাদাখে এমন কী ঘটেছে যাতে ওয়াংচুক বা অন্যান্য লাদাখবাসীর উদ্‌বেগের যথাযথ কারণ থাকতে পারে?

উত্তর: আজকাল বাইরের মানুষ লাদাখে অনেক বেশি সহজে পৌঁছতে পারলেও, মালপত্র-যন্ত্রপাতি লাদাখে পৌঁছনো কাশ্মীরের তুলনায় এখনও অনেক বেশি কঠিন। কিন্তু, ৩৭০ ধারার আওতা থেকে লাদাখ বেরিয়ে যাওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকার লাদাখে যোগাযোগ ব্যবস্থা বাড়ানোর ব্যাপারে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। কোভিড অতিমারীর জন্য সব কিছু দেরি হওয়া সত্ত্বেও, লাদাখে ৭৫০.২১ কিলোমিটার রাস্তা নতুন নির্মাণ হয়েছে কিংবা পুরনো রাস্তা সারানো হয়েছে, ২৯টি নতুন ব্রিজ তৈরি হয়েছে এবং ৩০টি নতুন হেলিপ্যাড বসেছে। পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে শ্রীনগর থেকে কারগিলে সহজে পৌঁছনোর লক্ষ্যে জোজি লা সুড়ঙ্গ (Zoji La Tunnel), সহজে সীমান্তে পৌঁছনোর উদ্দেশ্যে তৈরি হচ্ছে কারগিল-জানস্কার রোড, এবং গতকাল সন্ধ্যাতেই সম্পূর্ণ হল লাদাখে পৌঁছনার তৃতীয় এবং সবচেয়ে কম কঠিন রাস্তা— ২৯৮ কিমি দীর্ঘ নিম্মু-পদম-দরচা রোড, যা লাদাখকে যুক্ত করল হিমাচল প্রদেশের সঙ্গে।

শুধু সীমান্তের সঙ্গে উন্নততর সংযোগ আর পর্যটন উৎসাহিত করা নয়, আরও ব্যাপার আছে। ২০০৭ সালেই উত্তর লাদাখের নুবরা-শিওক উপত্যকার ভূপ্রস্তরে পাওয়া গিয়েছে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম-থোরিয়াম ডিপোজিটের হদিশ। চিনের সঙ্গে সীমান্ত অঞ্চল। তার উপরে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। তাই, ২০০৭-৮ সালের পর এই নিয়ে আর কোনও কথা মিডিয়াতে বা জনপরিসরে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে অনুপস্থিত।

এখানেই শেষ নয়!

ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি নির্মাণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত মূল্যবান যে প্ল্যাটিনাম গোষ্ঠীর ধাতু— যথাক্রমে প্ল্যাটিনাম, প্যালাডিয়াম, রোডিয়াম, রুথেনিয়াম, ইরিডিয়াম ও অসমিয়াম— সেই ধাতুগুলির আকরের সন্ধান মিলেছে লাদাখে। সবগুলোই দুষ্প্রাপ্য ও দামি। তার মধ্যে রোডিয়াম সোনার চেয়েও দামি।   

তাই, কেন্দ্রীয় সরকার ও নানা বিনিয়োগকারী যে লাদাখের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপনে উৎসাহী হবেন তাতে আশ্চর্য কিছু নেই। আর, লাদাখের বিভিন্ন কোণে পৌঁছে যাওয়ার যোগাযোগ আরও সহজ হলে পর্যটন ও হোটেল ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারীদের আটকে রাখা মুশকিল হবে। বাড়বে যোগাযোগ, হু হু করে বাড়বে গাড়ি, বাস, লরির যাতায়াত, বাড়বে হোটেল, রিসর্ট ও নানা কিসিমের পর্যটনকেন্দ্র। জলের মতো টাকা ঢুকলে পরিবেশ, স্বাস্থ্য, জননিরাপত্তা-সংক্রান্ত প্রাথমিক সুরক্ষা ও সাবধানতার নিয়মগুলো লঙ্ঘিত হতে থাকবে— যেমন হয়েছে উত্তরাখণ্ড, হিমাচল ও সিকিমে। পাহাড়ের সর্বনাশ হবে, হবে লাদাখবাসীর সর্বনাশ।

প্রশ্ন ৫) ওয়াংচুক বারে বারে বলছেন হিমবাহের কথা। সে সব কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে?

উত্তর: হিমালয় ও কারাকোরাম রেঞ্জের মধ্যে গুঁজে রয়েছে লাদাখ। জলবায়ু বদলের ফলে পৃথিবী জুড়ে হিমবাহ গলছে। বিপন্ন হচ্ছে এই গ্রহের নদীগুলি। সুমেরু ও কুমেরু অঞ্চলের বাইরে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি হিমবাহ আছে হিমালয় ও কারাকোরোম রেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলে। লাদাখের নদীগুলি এবং লাদাখবাসীর জলের জোগান হিমালয় ও কারাকোরাম রেঞ্জের হিমবাহগুলির উপর নির্ভরশীল।  

কিন্তু শুধু গ্রহের জলবায়ু বদলের জন্যই হিমবাহ গলছে তা নয়। আঞ্চলিক কাণ্ডকারখানার একটা বিরাট ভূমিকা আছে। যেমন, আপনার আশপাশের তাপমাত্রা যতটা গ্রহের জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল ততটাই নির্ভরশীল আপনার আশপাশে কী ঘটছে তার উপর (যেমন আপনি ঘরের মধ্যে উনুনের কাছে আছেন নাকি পুকুর পাড়ে গাছের ছায়ায় আছেন), তেমনই হিমবাহের স্বাস্থ্যও নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক কাণ্ডকারখানার উপর। হিমবাহের কাছাকাছি যদি নগরায়ন ঘটে, শয়ে শয়ে বা হাজারে হাজারে গাড়ি যায়, বড় নির্মাণকার্য হয়— স্বাভাবিকভাবেই পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা বাড়বে এবং হিমবাহ আরও বেশি বেশি করে গলবে। সাম্প্রতিক গবেষণা দেখাচ্ছে যে ২০০১ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে, লাদাখের পাংগং এলাকার হিমবাহগুলি বেশ খানিকটা গলেছে। লাদাখের ব্যাপক ‘উন্নয়ন’ শুরু হলে সে সব হিমবাহর দশা কী হবে তা নিয়ে সন্ত্রস্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। ওয়াংচুক এসব প্রসঙ্গ এনেছেন।

প্রশ্ন ৬) ধরা যাক যষ্ঠ তফশিল হল। এমনকী লাদাখ একটি স্বতন্ত্র রাজ্য হল এবং নিজের বিধানসভা পেল। তাতেই কি এই সমস্যাগুলো উধাও হবে?

উত্তর: উধাও হবে এমন দাবি করা হচ্ছে না। কিন্তু এগুলো হলে কেন্দ্রীয় সরকার বা বাইরের কর্পোরেট সংস্থার পক্ষে ‘উন্নয়ন’-এর নামে আস্তিন গুটিয়ে লাদাখের ভূপ্রকৃতির বারোটা বাজানোর বন্দোবস্ত করা কঠিন হবে। এই কারণে অন্ততপক্ষে ষষ্ঠ তফশিলটুকু দরকার। রাজ্য হলে তো লাদাখবাসীর স্বনিয়ন্ত্রণের আরও সুবিধা।

তারপর বেশ খানিকটা লাদাখবাসীর হাতে থাকবে। জনজাতি গোষ্ঠীগুলির বহু শতাব্দী ধরে অর্জিত আঞ্চলিক পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র সংক্রান্ত কাণ্ডজ্ঞান এবং সোনাম ওয়াংচুক ও তাঁর দ্বারা প্রভাবিত মানুষজনের বুদ্ধি ও বিদ্যা যদি নির্বিচার লোভ ও মুনাফামুখী অর্থনীতি ও সংস্কৃতির প্রভাবকে অনেকটা লাগামে রাখতে পারে তাহলে লাদাখের ভূপ্রকৃতি-পরিবেশ-বাস্তুতন্ত্র অনেক দূর সুরক্ষিত হবে। মুসলমানপ্রধান কারগিল জেলা ও বৌদ্ধপ্রধান লেহ্‌ জেলার মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহের খানিকটা আবহাওয়া ছিল। গত দু-তিন বছরে তা অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। কারগিল ও লেহ্‌ একজোট হয়ে ষষ্ঠ তপশিল ও স্বতন্ত্র রাজ্যের দাবি জানাচ্ছে। ফলে, বিজেপি কোণঠাসা এবং কেন্দ্রীয় সরকার বিপদে পড়েছে। যদি এই সৌহার্দ্য টিকে থাকে ও ভবিষ্যতে আরও বাড়ে তাহলে লাদাখবাসীর সুবিধা। আর, রাজ্যের প্রশাসন ও ষষ্ঠ তফশিলের প্রশাসনের মধ্যে দ্বন্দ্বের যে সম্ভাবনা তার নিষ্পত্তির ফর্মুলা যদি তাঁরা বার করতে পারেন তাহলে তো সোনায় সোহাগা।

বুক ভরে আশা করতে দোষ কি?


Wednesday, 20 March 2024

প্রোমোটারের দাপট

নগর যখন ভেঙ্গে পড়ে!

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

কলকাতা পৌরসভার ১৩৪ নং ওয়ার্ডে অবৈধ ভাবে নির্মীয়মাণ একটি বহুতল ভেঙ্গে এখন পর্যন্ত দশজনের মৃত্যুতে তুমুল সোরগোলের পর প্রোমোটার মহঃ ওয়াসিম ও জমির মালিককে গ্রেফতারি কতটা ক্ষতে মলম দেবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। কারণ, শহরতলির অলিতে গলিতে চলমান যে অবৈধ হাইরাইজের নির্মিতি তা একদিনের ঘটনাক্রম নয় এবং ভবিষ্যতে যে এর ইতি ঘটবে তার তেমন কোনও ইঙ্গিতও নেই। সস্তার মালমশলায় ছোট ছোট খুপরিতে নাগরিকদের মাথা গোঁজার ঠাই করে দিতে যে ‘সামাজিক ব্যাধি’ (মেয়রের ভাষায়) আজ শহরের আনাচে কানাচে ডানা মেলেছে, তার রসদ বহু গভীরে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যোগও যথেষ্ট সুবিদিত।

যদিও কাউন্সিলর অতীন ঘোষ এই দুষ্ট চক্রে রাজনৈতিক যোগের কথা স্বীকার করেছেন, এমনকি রাজ্যের শাসক দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষও অন্তর্নিহিত গভীর অন্যায়ের তদন্তের দাবিকেও মান্যতা দিয়েছেন, কিন্তু মহানাগরিক বিষয়টিকে ঠেলতে চেয়েছেন শুধুমাত্র প্রশাসনিক অকর্মণ্যতার দিকেই। বলাই বাহুল্য, এই ব্যাধি সাম্প্রতিক নয়, গত ২০-২৫ বছর ধরেই প্রোমোটার-দাপটে বহু অঞ্চলে সাধারণ নাগরিক যাপনে এক অস্থিরতা শুধু বিরাজই করেনি, উত্তরোত্তর তার ক্রমবৃদ্ধি এক তীব্র সংকটেরও জন্ম দিয়েছে। পুকুর ও জলাভূমি বুজিয়ে, নাগরিক পরিসরের সুস্থিতিকে তছনছ করে এর প্রকোপ দিনের পর দিন প্রবলতর হয়েছে। ‘টক টু মেয়র’ অনুষ্ঠানে সাহস করে বহু মানুষ এই তাণ্ডবের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছেন, তৎক্ষণাৎ প্রশাসনিক আধিকারিকেরা ঘটনাস্থলে ছুটেও গিয়েছেন, কিন্তু কোনও এক যাদুবলে আবার তা কিছুদিন পরে ধামাচাপাও পড়ে গিয়েছে। বহু জায়গায় মানুষ নালিশ জানাতে ভয়ও পেয়েছেন। অর্থের জোর ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ‘সব ঠিক হ্যায়’ গোছের এক ভারসাম্য বজায় থেকেছে। বাইক নিয়ে সপার্ষদ এই প্রোমোটারেরা এমন মেজাজে এলাকায় ঘুরে বেড়ায় যে নিরীহ জনতার কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে তাদের বিরুদ্ধে কোথাও অভিযোগ জানানোর।

এই প্রবণতা শুধু কলকাতা শহরেই নয়, ভারতবর্ষের বহু মহানগরে আজ নাগরিক জীবনের কাছে এক ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কলকাতার অ্যাডেড এরিয়ায় যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা ফ্ল্যাট রাস্তার পরিসর, পয়ঃপ্রণালীর বহন ক্ষমতা, পানীয় জলের জোগানের নাব্যতা- কোনও কিছুকেই ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য করে না। আট-দশ ফুটের রাস্তায় দেড়-দু কাঠা জমিতেও অবাধে উঠে যাচ্ছে তিন-চারতলার ফ্ল্যাটবাড়ি। নির্মাণের শুরুতে লোকদেখানো নিয়ম মেনে আইন অনুসারে জমির কিছু অংশ রাস্তায় ছাড় দিয়ে ছোট পাঁচিল তুলে নির্মাণ সম্পূর্ণ করে তারপর সেই পাঁচিল ভেঙ্গে ছাড় দেওয়া রাস্তাকে আবার জমির অংশে ঢুকিয়ে নতুন করে পাঁচিল তুলে দেওয়া হচ্ছে। খুপরি ফ্ল্যাটের সংখ্যা বাড়াতে ও ঘরগুলিকে ঈষৎ বড় করতে নিয়মমাফিক জমির চারধারে ছাড় দেওয়ারও কোনও বালাই নেই। এইগুলি যে স্থানীয় কাউন্সিলর বা পৌরসভার আধিকারিকেরা জানেন না তেমনও নয়। কৌশলটা ভারী চমৎকার। হুড়হুড় করে ফ্ল্যাট তুলে চটজলদি তা বিক্রি করে দিলেই কেল্লা ফতে! কারণ, একবার ফ্ল্যাটবাড়িতে লোক ঢুকে গেলে ‘মানবিকতা’র স্বার্থে সে ফ্ল্যাটের অবৈধ অংশ আর নাকি ভাঙ্গা যায় না, এই যুক্তিতেই সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে যাবতীয় অপরাধ। উপরন্তু, ‘কমপ্লিশন সার্টিফিকেট’ বা ‘সিসি’ নেওয়ারও দায় প্রোমোটারদের নেই! তারা বিক্রি করেই ধা! ক্রেতারা এবার পৌরসভার দরজায় দরজায় ‘সিসি’র জন্য হন্যে হয়ে দৌড়চ্ছে মিউটেশনের জন্য।

আসলে, কলকাতা এবং মফস্বল শহরগুলিতে নগর পরিকল্পনা বলে কিছুই নেই। দু-একটি পার্ক তৈরি করে নগর পরিকল্পনার দায় ঝেড়ে ফেলা হচ্ছে। একটি পাড়া বা অঞ্চলে যেখানে রাস্তা অপ্রশস্ত, সেখানে বাড়িগুলির উচ্চতা কত দূর অবধি হতে পারে, ঘিঞ্জি পরিসরকে কতটা নিরাময় দেওয়া যায়, সে সবের কোনও দায়-ই নেই। সল্ট লেক বা নিউ টাউন যে ভাবে পরিকল্পনা করে গড়ে তোলা হয়েছিল, তার ছিটেফোঁটাও দ্রুত নগরে পরিণত হতে থাকা দূর-দূরান্তের শহরতলির ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এখানে যেনতেন প্রকারেণ জমি হাতিয়ে ফ্ল্যাট তুলে বিক্রি করে দেওয়ার মধ্যেই নগরায়নের যাবতীয় কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীভূত। ফলে, শহরতলি যেন ক্রমেই হয়ে উঠছে ইট-কংক্রিটের নতুন ‘পাকা’ বস্তি। আট কি বারো ফুটের রাস্তার ওপর দু-কাঠা জমিতে নির্মিত চার-পাঁচতলা ফ্ল্যাটের মধ্যে বাস করছেন প্রায় ৬০ থেকে ৮০ জন মানুষ। বহু জায়গায় পরিশ্রুত পানীয় জলের জোগান নেই, ফলে ডিপ টিউবেল বসিয়ে এতগুলি লোককে জল জোগাতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে পাতালপুরী। আর এ তো একটা মাত্র ফ্ল্যাটে নয়, এরকম পাড়ায় পর পর দশটা বাড়িকে গুনতি করলে তার মধ্যে ৭ থেকে ৮টা বাড়িই এখন ফ্ল্যাট। অতএব, পরিস্থিতি কতটা ভয়ানক তা সহজেই অনুমেয়।

নিম্নমানের সস্তা মশলায় তৈরি ফ্ল্যাট ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কাই শুধু নয়, বিক্রির দু-তিন বছরের মধ্যে ক্রেতারা নিজ নিজ ফ্ল্যাটের অবস্থা দেখেও কপাল চাপড়াচ্ছেন। কোথাও পিলারে ক্র্যাক তো কোথাও ছাদ ভিজে উঠছে বৃষ্টির চুইয়ে পড়া জলে; অথবা, ঘরের দেয়ালে ফাটল নয়তো মেঝে উঠছে ঘেমে। সে ফ্ল্যাট বিক্রি করে পালানোর পথও নেই। কারণ, এই অবস্থায় নতুন ক্রেতাও অমিল। সময় গড়াতে ফ্ল্যাটগুলির অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে পড়ছে যে তা একপ্রকার মনুষ্য-বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। শরীর হয়ে পড়ছে রোগের ডিপো; শিশু অথবা বাচ্চাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। ঘরে বা বারান্দায় জামাকাপড় মেলবার জায়গা নেই, ছাদে মেলতে গিয়ে সামান্য পরিসরে ফ্ল্যাট-প্রতিবেশীদের মধ্যে লেগে যাচ্ছে ধুন্ধুমার কাণ্ড। সব মিলিয়ে, স্থান সংকুলানের গোদের ওপর রোগভোগের বিষফোঁড়া।

কিন্তু কেন এই বাধ্যবাধকতা? ফ্ল্যাট বানালেই যে বিক্রি হবে তার তো কোনও মানে নেই। এখানেই একটি মজার চিত্র লুকিয়ে আছে। ছোট জমির ওপর ফ্ল্যাট তুলতে গিয়ে যদি পৌরসভার বিধি (জমি ছাড় ইত্যাদি) অমান্য করা যায়, ৪০০ থেকে ৫০০ বর্গ ফিটের অনেকগুলি ছোট ছোট ফ্ল্যাট একেকটা ফ্লোরে নির্মাণ করা যায়, বেআইনি ভাবে যতটা সম্ভব তলা (তিন থেকে পাঁচ) বাড়ানো যায়, এবং যতটা সম্ভব রড, সিমেন্ট ও স্টোনচিপে কারচুপি করে মশলা তৈরি করা যায় তাহলে এক লপ্তেই যে বিপুল মুনাফা ওঠে তা লটারিতে প্রথম পুরস্কার পাওয়ার চেয়ে কম কিছু নয়। অতএব, আপাত-দৃশ্যে ‘সস্তায়’ এই ক্ষুদ্রকায় ফ্ল্যাটগুলি নগদের বিনিময়ে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের হাতে সহজেই তুলে দেওয়া যায়। এখানে ক্রেতা ও বিক্রেতার আপাত ভারসাম্যও সাধিত হয়। বলাই বাহুল্য, এই কারবারটা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যোগ ব্যতিরেকে একেবারেই অসম্ভব। অন্যদিকে, ফ্ল্যাট তৈরির জমিগুলি আসে দুই তরফ থেকে- এক) পারিবারিক উত্তরাধিকারে একাধিক ওয়ারিশ হয়ে যাওয়ায় কারওরই যখন তেমন প্রাপ্তি কিছু নেই, প্রোমোটারের হাতে তুলে দিলে বরং ফ্ল্যাট নয়তো নগদ মিলতে পারে; দুই) অবসরের পরে বাড়ি করার উদ্দেশ্যে, ২০-২৫ বছর আগে সস্তায় কিনে রাখা ২-৩ কাঠা জমির বিনিময়ে যদি মুফতে ফ্ল্যাট ও নগদ মিলে যায় তাহলে তার থেকে সহজে কিস্তিমাত আর কী হতে পারে!

তাই, জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা প্রোমোটার-রাজ যে আজ শুধু এক ‘সামাজিক ব্যাধি’ নয়, বরং, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যোগসাজসে এক মাফিয়া-রাজ, এবং নগর-বিধ্বংসী প্রকল্প, তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। বার বার একেকটা ইমারত ভেঙ্গে পড়বে, মানুষের মৃত্যু-মিছিল দেখা দেবে, সকলে আপাত সজাগ হবেন, কিছুটা হৈচৈ হবে। কয়েকদিন সব শান্ত থাকবে। সব মিটে গেলে আবার, নীরবে মৃত্যুসজ্জা তৈরি হবে। আমরা কখনও দাবি তুলব না যে,

১) শহরের কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চল ব্যতিরেকে কোথাও হাইরাইজ তোলা যাবে না;

২) অন্তত ১৬ ফিট প্রশস্ত রাস্তা না হলে দোতলার বেশি তল তৈরির অনুমতি দেওয়া যাবে না;

৩) প্রোমোটার ‘সিসি’ না পাওয়া পর্যন্ত ফ্ল্যাট বিক্রি করতে পারবে না;

৪) জমি প্লট করে নতুন বসতি গড়ে তুলতে গেলে অন্তত ১৬ ফিটের রাস্তা থাকাটা বাধ্যতামূলক করতে হবে, নয়তো জমির মিউটেশন অথবা বাড়ির নকশা অনুমোদন পাবে না।

এটা বাস্তব, দেশভাগ ও ১৯৭১’এর যুদ্ধের কারণে এ রাজ্যে যে বিপন্ন মানুষের বিপুল আগমন, তার ফলে জনসংখ্যার আচম্বিত বিস্ফোরণে রুটি-রুজি সহ বাসস্থানের সমস্যার কারণে শহরতলির ওপর স্থানজনিত অত্যধিক চাপ পড়েছে। কিন্তু তার থেকে নিস্তারের উপায় অপরাধপ্রবণ প্রোমোটার-রাজ নয়, সুপরিকল্পিত নগরায়ন ও যথাযথ ইমারত-নীতি। এই সুবোধ চিন্তা কি আদৌ প্রশাসন ও রাজনৈতিক মহল থেকে আশা করতে পারি? 

  

Tuesday, 12 March 2024

নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার হুমকি?

কোন ভয় থেকে সিএএ'র বিজ্ঞপ্তি জারি?

সোমনাথ গুহ



প্রায় পাঁচ বছর আগে ২০১৯-এর ১১ ডিসেম্বর ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন’ (সিএএ) সংসদে প্রণয়ন করা হয়। ছয় মাসের মধ্যে ওই আইনের নিয়মাবলী গঠিত হবার কথা ছিল। ইতিমধ্যে ওই আইনের প্রতিবাদে দেশ জুড়ে প্রবল আন্দোলন দেখা যায়, অন্তত একশো জন রাষ্ট্রের দমনপীড়নের শিকার হন। অসমে পাঁচ ছাত্র পুলিশের অত্যাচারে মারা যান। আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে প্রায় দুশো পিটিশন জমা পড়ে। সরকার এর ফলে বারবার পিছু হটে, করোনার অজুহাত দিয়ে নিয়মাবলী গঠনের জন্য বারবার সময় চায়। অবশেষে ঠিক লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে, তারা একগুচ্ছ নিয়মাবলী ঘোষণা করে ১২ মার্চ থেকে সিএএ চালু করল। তাদের এই সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যেই  দেশের বিভিন্ন অংশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। 

কেন এই সিএএ? নাগরিকত্ব সংক্রান্ত মূল সমস্যা শুরু হয় ২০০৩ সালে যখন আইনের একটি সংশোধনী অনুযায়ী জনসংখ্যাপঞ্জী (এনপিআর) এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (এনআরসি) প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত হয়। এই সংশোধনীর ১৪(এ) ধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে দেশ জুড়ে পঞ্জীকরণ চালু এবং প্রতিটি নাগরিকের ‘জাতীয় পরিচয়পত্র’ তৈরি করা বাধ্যতামূলক করতে পারে। এই সংশোধনীকে হাতিয়ার করে ২০১৬ সালে অসমে বিজেপি সরকার এনআরসি চালু করে। চূড়ান্ত এনআরসি থেকে উনিশ লক্ষ মানুষের নাম বাদ যায় যার মধ্যে প্রায় বারো লক্ষ ছিলেন হিন্দু। এটা বিজেপিকে হতচকিত করে। অসম বিজেপি পত্রপাঠ এই ফলাফল খারিজ করে দেয়। হিন্দু মানুষের নাম এনআরসি থেকে বাদ পড়ায় বিজেপির ভাবমূর্তি ধাক্কা খায়। এমনকি ২০১৯'এ পশ্চিমবঙ্গের তিনটে উপনির্বাচনেও এর প্রভাব পড়ে। মাত্র ছয় মাস আগে লোকসভা নির্বাচনে ঝড় তোলা সত্ত্বেও বিজেপি কিন্তু তিনটি কেন্দ্রেই হারে। কালিয়াগঞ্জ কেন্দ্রের ফল বিশেষ ভাবে ইঙ্গিতপূর্ণ, কেননা লোকসভায় এই কেন্দ্র থেকে তারা প্রায় ৫৬,০০০ ভোটে  এগিয়ে ছিল। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে জেতা তখন বিজেপির ‘পাখির চোখ’। কিন্তু এনআরসি থেকে এত হিন্দুর নাম বাদ যাওয়ার কারণে বাংলায় হিন্দুদের মনে বিজেপি সম্পর্কে ঘোর সংশয় তৈরি হয়। উপরন্তু, মতুয়ারা আদৌ বিজেপিকে সমর্থন করবে কিনা তা নিয়েও আশঙ্কা  তৈরি হয়।

এই ক্ষতি সামাল দিতে বিজেপি তড়িঘড়ি বাজারে সিএএ নিয়ে আসে। শোনা যায়, অমিত শাহ'র বিখ্যাত উক্তি: 'আপ ক্রোনোলজি সমঝিয়ে'- প্রথমে সিএএ, তারপর এনআরসি। অর্থাৎ, সিএএ'র সুযোগ নিয়ে হিন্দুরা নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন এবং এনআরসি হয়ে দাঁড়াবে মুসলিম ছেঁকে তোলার কল। মতুয়া সম্প্রদায়ের একটা অংশ কেন্দ্রের শাসক দলের এই প্রতিশ্রুতিতে প্রভাবিত হন। নাগরিকত্বের কলা-মুলো ঝুলিয়ে বিজেপি ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে ফয়দা তোলে- নদীয়া, উত্তর ২৪-পরগণা এবং উত্তর বাংলার কিছু অংশে এই সম্প্রদায় অধ্যুষিত প্রায় পনেরোটা আসনে তারা জয়লাভ করে। 

বিজেপি এবার লোকসভায় ৩৭০টি আসন জয়ের লক্ষ্য নিয়ে নেমেছে। এর জন্য অসমে ও পশ্চিমবাংলায় তারা আসন সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য মরীয়া। বাংলায় মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক তাদের কাছে অপরিহার্য। তাই তারা 'নিঃশর্তে নাগরিকত্ব' নামক আরও একটি জুমলা সামনে নিয়ে এসেছে। সিএএ কি আদৌ নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দেবে?  

এই আইনের ফলে ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১৪ অবধি পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্সি ও খ্রিশ্চান ধর্মের যে সব মানুষ ভারতে এসেছেন তাঁদের অবৈধ অভিবাসী হিসাবে গণ্য করা হবে না। মুসলিমরা এই আইনের সুযোগ পাবেন না, তাই এই আইন বৈষম্যমূলক। পাকিস্তান, আফগানিস্তানে শিয়া, হাজারা সম্প্রদায়ের মানুষরাও নির্যাতিত, তাঁরা কিন্তু ভারতে আশ্রয় পাবেন না। পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমারের রোহিঙ্গারা, যাঁরা গণনিধনের শিকার হয়েছেন, তাঁদেরও এ দেশে ঠাঁই নেই। সঙ্ঘ পরিবারের যুক্তি, শ্রীলঙ্কার তামিলদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি কারণ তারা জাতিগত ভাবে নিপীড়িত, ধর্মীয় ভাবে নয়! নেপাল, ভুটানের নির্যাতিত মানুষেরাও এই আইনের সুযোগ পাবেন না। 

নাগরিকত্ব কি নিঃশর্তে পাওয়া যাবে? আদৌ নয়। আইনে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হচ্ছে, এই ছটি ধর্মের যে মানুষরা আসছেন তাঁরা কিন্তু সরাসরি নাগরিকত্ব পাচ্ছেন না, তাঁরা শুধুমাত্র ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসাবে গণ্য হবেন না; তাঁদের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে এবং তার জন্য কিছু শর্ত আছে। প্রথম শর্ত, ওই তিনটি দেশে ধর্মের কারণে নিপীড়িত ছটি ধর্মের মানুষেরাই কেবল এই আইনের সুযোগ পাবেন। দ্বিতীয় শর্ত, তাঁরা এই দেশে এসেছেন ২০১৪'র ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে। তৃতীয় শর্ত, এক বছর টানা ভারতে থেকেছেন এবং গত চোদ্দ বছরে অন্তত পাঁচ বছর এখানে থেকেছেন।

সিএএ'র জন্য ৩৯ পাতার যে নিয়মাবলী সরকার প্রকাশ করেছে সেটির প্রথম পাঁচ পাতা বিভিন্ন নিয়ম এবং বাকী নানা ধরনের ফর্ম। ধর্মীয় উৎপীড়নের কোনও প্রমাণ দিতে হবে কি না তা পরিষ্কার নয়। প্রথম ফর্মে নিজের সম্পর্কে তথ্য দিতে হবে। পিতামাতার নাম, কোন দেশ, কোন জেলা থেকে এসেছেন, কবে এসেছেন ইত্যাদি জানাতে হবে। সঠিক তথ্য জমা দিয়েছেন এই মর্মে একটি হলফনামা দিতে হবে। কোনও ভারতীয় নাগরিকের থেকে ‘ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট’ বা নিজের চরিত্র সম্পর্কে হলফনামা জমা দিতে হবে। আবেদনকারীকে অষ্টম তফসিলের যে কোনও একটি ভাষা বলতে জানতে হবে, সেটি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকাও প্রয়োজন। তাঁর আবেদন যদি মঞ্জুর হয় তাহলে আগের দেশের নাগরিকত্ব ছাড়তে হবে এবং এই মর্মেও তাঁকে হলফনামা দিতে হবে। 

কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা নিয়োজিত দুটি কমিটি যাবতীয় তথ্য যাচাই করবে। আবেদন প্রথমে যাবে জেলা কমিটির কাছে। তাঁরা সব তথ্য খতিয়ে দেখে সন্তুষ্ট হলে সেই আবেদন উচ্চতর একটি বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত কমিটির কাছে পাঠাবে। দ্বিতীয় কমিটির দুই জন সদস্য, উভয়েই হবেন সরকারের উচ্চপদস্থ আধিকারিক। কোনও আবেদনকারী যদি সঠিক নথি জমা দিতে না পারেন তাহলে প্রথম কমিটি দ্বিতীয়কে সেটি খারিজ করার পরামর্শ দিতে পারে। সমস্ত নথি ঠিক থাকলে ডিজিটাল শংসাপত্র দেওয়া যেতে পারে। 

এর থেকে এটা পরিষ্কার যে, মোটেও নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দেওয়া হচ্ছে না। এবার একটা বাস্তব পরিস্থিতি ভেবে দেখুন। ধরা যাক একজন হিন্দু মানুষ ২০০০ সালে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবাংলায় এসেছেন। সীমান্তবর্তী কোনও ছোট শহরে বাড়ি ভাড়া করে তিনি একটা ব্যবসা শুরু করেছেন। প্রভাবশালী কাউকে ধরে নথিপত্র জোগাড় করেছেন। ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়ছে। ভোটও দিয়েছেন এবং মোটামুটি থিতু হয়ে বসে তিনি একটা স্থায়ী জীবন শুরু করেছেন। এবার, কেন্দ্রীয় সরকারের এই নতুন আইন দ্বারা প্ররোচিত হয়ে তিনি সিএএ'র মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করলেন। এটা করা মাত্র যে মানুষটি স্থায়ী জীবন শুরু করেছিলেন তিনি কিন্তু নিজেকে অবৈধ ঘোষণা করলেন, নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন করে ফেললেন। এরপর, তাঁর আবেদন যে মঞ্জুর হবে তার কী নিশ্চয়তা আছে? প্রতিটি ফর্ম, হলফনামা তাঁকে ঠিকঠাক পূরণ করতে হবে, সঠিক নথিপত্র জমা দিতে হবে এবং তারপরেও তাঁকে এই দুটি কমিটির কর্মদক্ষতা, ধর্মীয়, জাতিগত নিরপেক্ষতার ওপর নির্ভর করতে হবে। অসমের এনআরসি একটা বিরাট শিক্ষা! শুধুমাত্র নাম, পোশাক বা চেহারা ‘সন্দেহ’ উদ্রেক করার কারণে অনেক আবেদনকারীকে কাগজ নিয়ে বছরের পর বছর ঘুরতে হয়েছে।

বর্তমানে সিএএ সাব-জুডিস, সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন। সেদিক থেকে দেখলে প্রশ্ন উঠবে, সরকার কি আদৌ আদালতের রায়ের আগে এই আইনের নিয়মাবলী গঠন করতে পারে? এছাড়া এই আইন সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করে, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদান করে ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শকে অস্বীকার করে। কিন্তু এই সরকার তো সংবিধান বা বিচারব্যবস্থাকে মান্যতা দেয় না। 

রমজান শুরুর পরের দিন নিয়মাবলী ঘোষণা করা হয়েছে যাতে মুসলিম জনতা প্রতিবাদ করতে দ্বিধা বোধ করেন। ‘ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগ’ আজ সুপ্রিম কোর্টে এই আইন ও এর নিয়মাবলীর ওপর স্থগিতাদেশের জন্য আবেদন জানিয়েছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন এবং তাঁদের নির্মম ভাবে দমন করা হয়েছে। অসমে এনআরসি করা হয়েছিল ২৪শে মার্চ, ১৯৭১'কে কাট-অফ ডেট ধরে; সেটা নতুন আইনের কারণে হয়ে দাঁড়াল ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১৪। মানুষ সেখানে রাস্তায় নেমে পড়েছে, বিরোধী দলগুলি বনধ ডেকেছে। কলকাতা এবং বিহার ও ঝাড়খন্ডের শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়েছে। নির্বাচনী বন্ডের জালিয়াতি, নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ, দিল্লিতে নামাজিদের ওপর অভূতপূর্ব আক্রমণ এবং এখন সিএএ'কে আবার ঠাণ্ডা ঘর থেকে তুলে আনা- এসব মিলে মো-শা সরকার দেশ জুড়ে এক তুমুল অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। 

প্রশ্ন উঠছে, শাসক এত মরীয়া কেন? তারা কি বিপন্ন, বিপর্যস্ত বোধ করছে?


Tuesday, 5 March 2024

তথ্য নিছক তথ্য নয়

জিডিপি'র ফাঁকি ও গরিবি কমার গপ্পো

দীপঙ্কর দে



জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি বৃদ্ধির হার নিয়ে প্রায়শই নানা তথ্য কানে আসে। কখনও বিতর্কও বাঁধে অর্থশাস্ত্রের পণ্ডিতদের মধ্যে। অবশ্য গড়পড়তা নাগরিকের জীবনযাপনে স্রেফ জিডিপি বৃদ্ধির হারে কোনও তফাত হয় না। জিডিপি বৃদ্ধি হলেও ক্ষেত্র বিশেষে নাগরিকের আর্থিক সংকোচন হতে পারে। যেমন ধরুন, বর্তমান অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে (অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর) ভারতের জিডিপি বেড়েছে ৮.৪ শতাংশ হারে, কিন্তু একই সময়ে কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন সংকুচিত হয়েছে। তাই অনুমান করাই যায়, কৃষি ক্ষেত্রে যুক্ত ভারতের বিশাল সংখ্যক নাগরিকের আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। মোদ্দা কথা, জিডিপি বাড়লেই হবে না, জাতীয় উৎপাদনের বন্টন সুষম হতে হবে। নইলে ভারতের মতো রাষ্ট্রে যেখানে সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য দিন দিন বাড়তে বাড়তে খুব কুৎসিত রূপ নিয়েছে, সেখানে জিডিপি বাড়লে শ্রেণি বৈষম্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা আরও বাড়ে। 

জিডিপি নিয়ে এই নিবন্ধের আলোচনা একটু খটমটে। অন্য সময় এ আলোচনা না করলেও চলত। আম নাগরিকের কী বা যায় আসে যদি সরকার জিডিপি বৃদ্ধির হার বাড়িয়ে বা দেশের গরিবের সংখ্যা কমিয়ে বলে। মিথ্যে পরিসংখ্যানে বাস্তব অবস্থার পরিবর্তন হয় না। রাজনৈতিক চাপানউতোর বাড়ে। তবে মিথ্যের জোরে অপদার্থ শাসকের পক্ষে সহমত নির্মাণ সহজ হয়। নির্বাচনের মরসুমে রাষ্ট্রের তথ্যকে যাচাই করা তাই খুব জরুরি।

সমস্যা শুরু গত সপ্তাহে, যেদিন ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকাল অফিস (NSO ) ঘোষণা করে যে বর্তমান অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৮.৪ শতাংশ। হঠাৎ এই বৃদ্ধির হার. রিজার্ভ ব্যাংকের বৃদ্ধির আগাম হিসেবের (৬.৫ শতাংশ) থেকে অনেকটাই বেশি। দেশের সংসদীয় নির্বাচনের মুখে এই বৃদ্ধির ফলে বর্তমান অর্থবর্ষে জিডিপি বৃদ্ধির আনুমানিক হার ৭.৩ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৭.৬ শতাংশে। স্বভাবতই এই তথ্য শাসক দলের সাফল্য বলে প্রচারিত হতে থাকে। 

অর্থনীতির পণ্ডিতেরা সন্দিহান হন দুটি কারণে: ক) রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সহ বিশ্ব ব্যাঙ্ক বা আইএমএফ'ও এতটা বৃদ্ধির আগাম অনুমান করেনি; খ) উক্ত সময়ে দেশের গ্রস ভ্যালু অ্যাডেড (GVA) পরিসংখ্যানের সঙ্গে জিডিপি পরিসংখ্যানের অমিল খুব বেশি। ওই ত্রৈমাসিকে ভারতের জিভিএ বৃদ্ধির হার ৬.৫ শতাংশ, যার অর্থ, জিডিপি ও জিভিএ বৃদ্ধির হারের তফাত ১৯০ বেসিস পয়েন্ট যা গত দশ বছরে সর্বাধিক। তাই শুরু হল কাটাছেঁড়া।

নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, আমরা অনেক পণ্য কিনি যার প্যাকেটে লেখা থাকে 'কর সমেত সর্বোচ্চ মূল্য'। আমরা কিন্তু পণ্যের প্রকৃত মূল্য কত তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। ঘামালে দেখব, পণ্যের বিক্রয়মূল্য = পণ্যের প্রকৃত মূল্য + অপ্রত্যক্ষ কর - অনুদান। একই ভাবে যদি এবার জাতীয় উৎপাদনের কথা ভাবি তবে দাঁড়ায়: জিডিপি = জিভিএ + অপ্রত্যক্ষ কর -অনুদান।

বোঝা যাচ্ছে, তৃতীয় ত্রৈমাসিক জিডিপি বৃদ্ধির হার আর জিভিএ বৃদ্ধির হারের যে তফাত'টা হচ্ছে তার কারণ: ১) অপ্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধি ও ২) অনুদান হ্রাস। কর বৃদ্ধি ও অনুদান হ্রাস পেলে নাগরিকের ক্রয়ক্ষমতা কমে। তাই বলা যেতেই পারে, ৮.৪ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছে অপ্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে ও অনুদান কমিয়ে। যার ফলে জিডিপি বাড়লেও আম নাগরিকের আর্থিক দুরবস্থা বেড়েছে। অবশ্য সরকারি তথ্যও সে কথা বলছে। বর্তমান আর্থিক বছরে জিএসটি খাতে রাজস্ব আদায় বেড়েছে ১২.৫ শতাংশ। আর খাদ্য ও সারে সরকারের যে অনুদান দেওয়ার কথা, তার মাত্র ৭০-৭৫ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। তাই অঙ্কের নিয়মেই জিডিপি ও জিভিএ তথ্যে এত গরমিল চোখে পড়ছে। আর সরকার পোষিত মিডিয়া ও কতিপয় অর্থশাস্ত্রী জিডিপি বৃদ্ধির মূল কারণ লুকিয়ে সরকারের জয়গান গাইছে। 

শুধু জিডিপি বৃদ্ধির তথ্যই নয়, দেশের গরিবি মোচনের হার নিয়েও ব্যাপক কারচুপি করছে সরকার। গত সপ্তাহে বহু বছর পর ন্যাশনল স্যাম্পল সার্ভে অফিস (NSSO ) Household Consumption Expenditure Survey ( HCES ) ২০২২-২৩'এর আংশিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তার ভিত্তিতে নীতি আয়োগের কর্তা দাবি করেছেন, বর্তমানে দরিদ্র নাগরিকের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ। অর্থাৎ, ২০১১-১২ সালের সর্বশেষ HCEC তথ্যের নিরিখে দরিদ্র মানুষের অনুপাত কমেছে প্রায় ১৭ শতাংশ। কারণ, ২০১১-১২ সালে সুরেশ তেন্ডুলকরের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি  HCEC তথ্যের ভিত্তিতে হিসেব করে বলেছিল, ভারতের মোট জনসংখ্যার ২১.৯ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। এ ক্ষেত্রেও বিশেষজ্ঞ অর্থশাস্ত্রীরা সরকারি হিসেবে কয়েকটি গুরুতর ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন। (টেলিগ্রাফ অনলাইন ২ মার্চ ২০২৪)।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন: 

১) ২০১১-১২ সালে তেন্ডুলকার যে পদ্ধতিতে দরিদ্রের সংখ্যা অনুমান করেছিলেন, সেই একই পদ্ধতি ২০২২-২৩ সালে ব্যবহার করা যাবে না। কারণ, আগেরবার HCES তথ্য সংগৃহীত হয়েছিল মিক্সড রেফারেন্স পিরিয়ড (MRP ) পদ্ধতিতে; কিন্তু নতুন HCES'এর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে মডিফাইড মিক্সড রেফারেন্স পিরিয়ড (MMRP) পদ্ধতি। তাই, এ ক্ষেত্রে ভিন্ন পদ্ধতিতে হিসেব করতে হবে। কমলা ও আপেলের তুলনা সম্ভব নয়। দুটোই ফল হলেও ভিন্ন জাতের ফল।

২) ২০১১-১২'এর সমীক্ষায় পারিবারিক খরচের হদিস পেতে ৩৪৭টি পণ্য ও পরিষেবার তথ্য তালাশ করা হয়েছিল। কিন্তু ২০২২-২৩'এ সে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০৫টি পণ্য ও পরিষেবায়। স্বাভাবিক ভাবেই এ ক্ষেত্রে পারিবারিক খরচের পরিমাণ আগের তুলনায় বেশি হওয়ার কথা।

৩) অর্থনীতিবিদ সন্তোষ মেহরোত্রা হিসেব কষে দেখেছেন, ২০২৬ সালের পর দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে অবনতির ফলে প্রায় ছয় কোটি মানুষ কৃষি ক্ষেত্রে ফেরত যান। এঁদের প্রায় পাঁচ কোটি নিজেদের পারিবারিক কৃষিতে বিনা পারিশ্রমিকে যুক্ত হন, যদিও সরকারি পরিসংখ্যানে তাদের কর্মরত শ্রমিক বলেই নথিভুক্ত করা আছে। স্বাভাবিক ভাবেই অনুমান করা যায়, এই ছয় কোটি নাগরিকের আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, ২০২২-২৩'এর আর্থিক সমীক্ষাতেও স্বীকার করা হয়েছে, মুদ্রাস্ফীতির ফলে ভারতে প্রকৃত মজুরি কমেছে।

সরকারি পরিসংখ্যান যাই বলুক, মুষ্টিমেয় ধনী ও উচ্চবিত্ত ছাড়া ভারতের আম নাগরিক প্রতিদিন টের পাচ্ছেন বাস্তব পরিস্থিতি কী। সরকারি পরিসংখ্যানে নাগরিকের আস্থা দিন দিন তলানিতে এসে ঠেকেছে। মিথ্যে পরিসংখ্যানে আর চিড়ে ভিজবে না। এটাই ভরসা।