কোন পথে যাবে গান
প্রবুদ্ধ বাগচী
মাস পাঁচেক আগে শুভেন্দু মাইতি একটি অনলাইন আলোচনা সভায় প্রশ্ন করেছিলেন, এই যে আমরা বাংলা গানের স্বর্ণযুগ নিয়ে আহা উহু করি, আপনারা ওই চল্লিশ বছরের (১৯৩০-৩২ থেকে ১৯৭০-৭২) দুশোটি ভাল গানের তালিকা করতে পারবেন কি? স্বভাবতই কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি।
সবাই স্বর্ণযুগের ঢেকুর তোলেন কিন্তু সত্যি করে স্মরণীয় গানের সংখ্যা কীরকম তার কোনও হদিশ আমাদের নেই। সব থেকে যেটা সমস্যার তা হল, ওই সময় গানের সুরের ওপর অনেক মনে রাখার মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে কিন্তু সুরের সেই আধুনিকতার পাশে গানের কথা বড্ড বেশি সেকেলে, আড়ষ্ট, প্রাণহীন ও গুরুচন্ডালি। সুরের নিয়মই হল তা কথাকে চাপা দিয়ে দেয় তাই গান শোনার সময় কথার রক্তাল্পতা সেভাবে নজরে আসে না ঠিকই, কিন্তু আলাদা আলাদা করে গান নিয়ে ভাবতে বসলে সেগুলো এড়িয়ে যাওয়ার উপায় থাকে না। ধরা যাক, ‘তোমারি পথ পানে চাহি/ আমারই পাখি গান গায়’ গানটিতে ‘চাহি’ শব্দটি গান শোনার সময় মনে আসে না। এটি আসলে সাধুভাষা যা গানটির বাকি অংশের ভাষা নয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বহুশ্রুত গান: ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’- এখানে ‘রবে’ শব্দটি খেয়াল করলেও একই অনুভূতি হতে বাধ্য। উদাহরণ ইচ্ছে করলেই বাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। আবার এও ঠিক, সমস্ত গানই এরকম নয়। মান্না দে'র গাওয়া কিংবদন্তী গান ‘ও আমার মন যমুনার অঙ্গে অঙ্গে’ এই ত্রুটি থেকে আশ্চর্যভাবে মুক্ত; ঝকঝকে গান হিসেবে মনে পড়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’ ইত্যাদি ।
তাহলে স্মরণীয় গান বলব কাকে? যার মধ্যে সুর, কথা ও বিষয়ের একটা সাম্য থেকে গেছে। এই কথা সত্যিই বলা শক্ত যে এমন গান প্রায় অনেক পেয়ে যাব আমরা। কিন্তু সব মিলিয়ে সেই সময়টাকে আমরা বাংলা গানের ইতিহাসে ফেলে দিতে পারব না। কারণ, এই সময়টাতেই বাংলা আধুনিক গান ঘোষিতভাবে শ্রম বিভাজনের আওতায় চলে এসেছিল। মূলত কাজী নজরুল ইসলামের অসুস্থতা ও তাঁর গানের জগৎ থেকে প্রস্থানের পরে এটাই ছিল বাংলা গানের রূপান্তর। একজন গানের কথা লিখবেন, অন্য একজন তাতে সুরারোপ করবেন আর অন্য আরেকজন কন্ঠশিল্পী তা গেয়ে রেকর্ড করবেন। বাংলা আধুনিক গানের ইতিহাস আসলে এই শ্রম বিভাজনের ইতিহাস ও পরম্পরা ।
প্রায় পনেরো বছর আগে (জানুয়ারি ২০০৬) কবীর সুমন বাংলা গান নিয়ে তাঁর শেষতম বইটি লিখেছিলেন যার শিরোনাম ছিল ‘কোন পথে গেল গান’। সেই বই যারা সংগ্রহ করেছিলেন, সময়ের আক্রমণ পেরিয়ে তার কপি হয়তো ইদানীং মলিন, কিন্তু প্রশ্নটা আজও জাগরূক। কোন পথে গেল গান? স্বর্ণযুগ পেরিয়ে আরও অনেক পথ পেরিয়ে এসেছি আমরা। যে আধুনিক বাংলা গানে বাঙালি মজে ছিল একসময়, যার জন্য রেডিওর ‘অনুরোধের আসর’এ চিঠি পাঠাতেন বাঙালি উন্মুখ শ্রোতা, তাঁদের অপেক্ষা ফুরিয়ে এল একটা পর্যায়ে এসে। সেই সময় তাঁরা রেডিওতে আধুনিক গানের ঘোষণা হওয়া মাত্র নব ঘুরিয়ে রেডিও বন্ধ করে দিতে আরম্ভ করলেন। এই বন্ধ্যাপর্ব থেকে সুমন চট্টোপাধ্যায় (অধুনা কবীর সুমন) নামক এক ভগীরথের হাতে নতুন বাংলা গানের ধারা শুরু হয়েছিল গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। দেখতে দেখতে তাও প্রায় তিরিশ বছরের পুরনো। সুমনের সমকালীন অনেকেই আজ অবসৃত, সুমন সরে গেছেন বাংলা খেয়ালের নবনির্মিত জগতে। খেয়াল করতে হবে, সুমন যে-ধারায় গান করতে আরম্ভ করেছিলেন তা কিন্তু শ্রম বিভাজনের ধারাবাহিকতায় আবার একটা ধাক্কা দেয়। সুমন বা তাঁর সহযাত্রীরা সকলেই নিজেরা গান লিখে তাতে সুর করে গাইতেন। কারণ, এই ধাঁচের গানে, গান লেখা থেকে তার মঞ্চ পরিবেশন অবধি সবটাই ছিল একজনের স্টেটমেন্ট- সঙ্গীত-গবেষক সুধীর চক্রবর্তী যাকে বলেছেন ‘ওয়ান পার্সন মিউজিক’।
এর পরে ব্যান্ডের গান। তার যতটা কিছুটা যুগের হাওয়া ততটা গান বিষয়ে নিবিড় ভালবাসা নয়, অন্তত বাংলা গানের ট্র্যাডিশন থেকে ব্যান্ডওয়ালারা প্রথম থেকেই দূরে দূরে। দু' একটা উজ্জ্বল ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। আর এই পর্বে আবার বাংলা গান চলে গেল শ্রম বিভাজনের আওতায়। ব্যান্ডগুলো যেহেতু একেকটা দলবদ্ধ সংস্থা, তাঁদের মধ্যে গান লিখিয়ে, সুরকার ও পরিবেশক আলাদা। কিন্তু গান কি হচ্ছে? খুব মনে রাখার মতো কিছু যা অবসর সময়ে মানুষ গুনগুন করবে নিজের মনে? অথচ এক শ্রেণির মানুষ এঁদের শুনছেন, একেকটি গানের দল বিদেশে অবধি শো করতে যাচ্ছে, তাঁদের বাজার দর বেজায় রকম বেশি। এগুলো কি বাংলা গানের ধারাবাহিক অগ্রগমন ?
পাশাপাশি একটা অন্য প্রসঙ্গ। গান শোনার ও গানের প্রচার করার জগতে এর মধ্যে ঘটে গেছে একটা বিরাট পরিবর্তন। গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি (১৯৮৫) এইচএমভি তাদের কোম্পানিতে গ্রামোফোন রেকর্ড উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। ততদিনে বাজারে এসে গেছে ক্যাসেট। কয়েক বছর ক্যাসেটের পর্ব পেরিয়ে সিডির যুগ এল তার পরে। আবার কয়েক বছর চলার পরে অচিরেই সিডি যুগের অবসান। এই শতকের গোড়ার থেকে মোবাইল ফোন ও মাইক্রোচিপের বহুল ব্যবহার গান শোনার ধারণাকে বদলে দিতে থাকে। উদারনৈতিক অর্থনীতির হাওয়ায় বেসরকারি এফএম চ্যানেলের প্রতিষ্ঠা আকাশবাণী কলকাতার একচ্ছত্র অবস্থানকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয় তার অল্প আগে থেকেই। পাশাপাশি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের আমদানি রেডিওর অবস্থাকে আরও গুরুত্বহীন করে দেয়। টেলিভিশনের চ্যানেলে চ্যানেলে আয়োজিত হতে থাকে গানের আসর, প্রতিযোগিতা। গান শোনার থেকে গান দেখার ব্যাপারটা দর্শকদের মনে ধরে বেশি। যদিও বাংলা আধুনিক গানের ধারাবাহিকতার সঙ্গে এইসব আয়োজনের কোনও নাড়ির যোগ ছিল না। এক ধরনের চর্বিতচর্বণ জাতীয় অনুষ্ঠানেই মজিয়ে রাখা হত দর্শকদের।
কিন্তু আজ যেখানে আমরা এসে দাঁড়িয়েছি, সেখানে বাংলা গানের আসলে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক অভিভাবক নেই, যারা বাংলা গানকে বাণিজ্যিক ভাবে বিপণন করতে পারে। এইচএমভি কোম্পানির হাত বদলে সারেগামা হয়ে যাওয়ার পরেও সেই প্রতিষ্ঠান আজ মৃত। এই দুনিয়ায় আর যে সব বাণিজ্যিক সংস্থা বিনিয়োগ করেছিল, পুরনো মেগাফোন, ইনরেকো বা পরের সাউন্ড উইং, কসমিক হারমোনি ইত্যাদি সেগুলোরও আজ আর কোনও অস্তিত্ব নেই। কলকাতা ও শহরতলিতে ক্যাসেট বা সিডি বিক্রির নামজাদা বিপণিগুলি বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ, স্মার্টফোন আর ইন্টারনেটের সুবিধে হয়ে যাওয়ায় কেউ আর গান কিনতে আগ্রহী নন; ইউটিউব, গানা, আমাজন মিউজিক বা অন্য ধরনের অ্যাপলিকেশন ব্যবহার করে মুফতে বা নামমাত্র মূল্যে শোনা যাচ্ছে গান- নতুন, পুরনো, বাসি, টাটকা সব রকম। কলকাতার বেসরকারি এফএম রেডিও স্টেশনগুলোতে বাংলার সবরকম গানই বাজানো হয় তবে সারাদিনের মধ্যে তাঁদের হিন্দি অনুষ্ঠানেরও কমতি নেই। আর যেহেতু কোনও সিডি প্রকাশ হয় না, ফলে, নতুন গান নতুন অ্যালবাম এই ধারণাটা আজ একদম ধূসর অতীত। এমন কি ক্যাসেট রেকর্ডার, সিডি প্লেয়ার এইসব যন্ত্রগুলোও আজ আর উৎপাদন হয় না, পুরনো যন্ত্র সারিয়ে নেওয়ার মতো দোকান বিরল। তাহলে কি নতুন গান হচ্ছে না?
হচ্ছে নিশ্চয়ই। তবে তার বিপণন একেবারে ব্যক্তিগত উদ্যোগ নির্ভর। যারা বা যিনি নতুন গান করছেন তিনি হয়তো নিজেই তা রেকর্ড করে ইউটিউবে বা ফেসবুকের মতো সমাজমাধ্যমে তুলে দিচ্ছেন। কেউ কেউ শুনছেন, কেউ কেউ তারিফ করছেন আর যেহেতু এই উদ্যোগ একদমই ব্যক্তিগত স্তরের, ফলে তার পরিধি নিতান্তই কম। এখনকার গান যেটুকু বিপণন হতে পারছে তা কেবল বাংলা ফিল্মে। তাও আগের তুলনায় সেই গানের সংখ্যা নিতান্তই কম। গত দশ/পনেরো বছরে খুব স্মরণীয় ফিল্মের গান কটাই বা হয়েছে ? ওই ধরুন, ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’, ‘বসন্ত এসে গেছে’ বা ‘তুমি যাকে ভালবাসো’ এইরকম হাতে-গোনা কিছু গান সেই অর্থে হিট হয়েছে, বাজারে বিক্রি হয়েছে। বেসিক আধুনিক গানের ভাঁড়ারে এইটুকু সঞ্চয়ও নেই। নতুন গান বিপণন করার কোনও মঞ্চ নেই, প্রচার নেই, শ্রোতার কাছে বাহিত হয়ে যাওয়ার কোনও উপায়ও নেই। ভরসা বলতে ওই সামাজিক মাধ্যমে ব্যক্তিগত উদ্যোগ আর মঞ্চ-অনুষ্ঠান। গত কয়েক মাসে সেই মঞ্চের গান গাওয়ার পরিসরটাও ধূলিসাৎ।
হয়তো অবস্থাটা খুব বিপন্নতার। বাংলা গানের এতদিনের ধারা কি তবে শুকিয়ে যাবে? চিন্তার কথা নিশ্চয়ই। তবে এর মধ্যে একটা অন্য সম্ভাবনার উঁকিঝুঁকি আছে। বড় এক বা একাধিক সঙ্গীত বিপণন সংস্থার আওতায় না থেকে এই প্রথম বাংলা গান এসে দাঁড়িয়েছে একদম স্বাধীন একটা পরিসরে, ইচ্ছেয় হোক বা অনিচ্ছেয়। এর মধ্যে ঝুঁকি এটাই, যে কেউ যা খুশি করার সুযোগ পেয়ে যায়, তা সে ভাল মন্দ যাই হোক। কারণ, সঙ্গীত বিপণন সংস্থা কিন্তু একটা ঝাড়াই বাছাইয়ের মাধ্যমে গান নির্বাচন করে তবেই তার পেছনে পুঁজি বিনিয়োগ করত- সে নির্বাচনের মাত্রা যেরকমই হোক না কেন। এখন সেই অবস্থাটা আর নেই। বৃহৎ পুঁজির আওতার বাইরে একটা গানের বাজার। একে ভাল খারাপ দু'ভাবেই কাজে লাগানো যায়, কিন্তু আগের পরিস্থিতির থেকে এটা গুণগত ভাবে আলাদা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে, ফিল্ম তৈরির ক্ষেত্রে এমন একটা বিকল্প পরিসর একটু একটু করে নির্মাণ হয়েছে গত কয়েক বছরে। শুধু সামাজিক মাধ্যমে আবেদন করে অর্থ সংগ্রহ করে ফিল্ম বানানো হয়েছে এবং সামাজিক মাধ্যমেই তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, এমন উদাহরণ আমাদের বেশি দূরে খুঁজতে যেতে হবে না। বাংলা গান যারা লেখেন, সুর করেন এমনকি গান, তাঁরা সকলেই এখন একটা নতুন রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছেন। সম্ভাবনা অনেক, ঝুঁকিও অনেক। কিন্তু বাংলা গানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গেলে একটা রাস্তায় তো তাঁদের এগিয়ে যেতেই হবে। কী করবেন তাঁরা? নতুন নতুন কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা নাকি গতানুগতিকতা? বাংলা গানের সঙ্গে যারা জড়িয়ে আছেন তাঁরা কীভাবে এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগান সেটাই আপাতত আমাদের অভিনিবেশের লক্ষ্য হয়ে রইল ।