ভারতের ইতিহাস ও নীরদ সি চৌধুরী
শোভনলাল চক্রবর্তী
নীরদ চৌধুরী এক বহুলালোচিত চরিত্র। সুনিপুণ গদ্যকার ও স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন ইতিহাসবেত্তা রূপে দেশে-বিদেশে প্রচুর সম্মান ও প্রশংসা যেমন পেয়েছেন, তেমনি স্ববিরোধী, উন্নাসিক, আত্মশ্লাঘাবিশিষ্ট বলে নিন্দাও পেয়েছেন অনেক। নীরদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর The Guardian লিখেছিল, 'Nirad Chandra Chaudhuri, …was one of the most remarkable products of the encounter between India and European culture.'
এই কথাগুলি পড়ে আমাদের মনে হবে যে, ইঙ্গ ও ভারতীয় সংস্কৃতির মিলন সাধন করে তিনি এক অভূতপূর্ব সুরুচিসম্পন্ন সংস্কৃতি যাপনের দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন। আবার বহু সমালোচকই তাঁর জীবনধারা, তাঁর বিভিন্ন স্ববিরোধী বক্তব্য, দৌর্বল্য পরিচায়ক বিবিধ কার্যকলাপ প্রভৃতির মাধ্যমে এটা প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন যে, তাঁর আগাগোড়া সমস্ত কাজই একটা প্রদর্শনপ্রিয় মানসিকতার দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। তাই আমাদের আলোচনার মূল লক্ষ হবে, প্রশস্তি ও নিন্দার মধ্য থেকে নিরপেক্ষ ভাবে একটি সিদ্ধান্তে উত্তীর্ণ হওয়ার চেষ্টা করা ও সেই আলোকে নীরদবাবুর ভারতেতিহাসের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিটিকে বিচার করা।
নীরদবাবুর ইতিহাস-দর্শনের প্রসঙ্গ অবতারণার আগে তাঁর লিখনশৈলী ও পাণ্ডিত্য নিয়ে কয়েকটি কথা না বললে অন্যায় হবে। তাঁর লেখা পড়লেই বোঝা যায় যে, তিনি যা লিখেছেন, তা আবেগের উপর নির্ভর করলে ও লঘুভারচিত্ততা জাত তাৎক্ষণিক বিশ্লেষণ প্রবণতায় চালিত হলে এত গভীর ও সুচারু ভাবে তাঁর মত তিনি প্রকাশ করতে পারতেন না। অন্তঃসারহীন কোনও বিষয়কে ভাষার কৌশলে, বর্ণনা-চাতুর্যে মোহনীয় করে কতকটা উপস্থাপন করা যায় বটে, কিন্তু যত্নশীল পাঠকের কাছ থেকে তার কঙ্কালটা বেশিক্ষণ আড়াল করে রাখা যায় না। তাঁর সমালোচকেরা যত নিন্দাই তাঁর করে থাকুন না কেন, পাণ্ডিত্যর প্রসঙ্গ যখনই এসেছে, কেউ তা স্বীকার করতে তেমন কুণ্ঠাবোধ করেননি। সত্যজিৎ রায় সহ আর যে-ক’জন বাঙালি সুঠাম, সুললিত ইংরেজি গদ্য লেখার নিদর্শন রেখে গিয়েছেন, নীরদবাবুকে সেই তালিকায় অসংশয়ে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তাঁর লিখনশৈলীর একটি বিশিষ্ট দিক এই যে, শব্দচয়নের ব্যাপারে তিনি আদ্যন্ত ‘পারফেক্ট।’ এই অভেদ্য গাঁথনির, ‘এলিট’রীতিয় স্বাদু গদ্য অবলীলায় প্রথম থেকে শেষাবধি পড়ে ফেলা হয়তো যায় না; মাঝে মাঝে ক্ষণিকের বিরাম নিয়ে অর্থটুকু সম্যকরূপে উপলব্ধি করে নিতে হয়।
নীরদবাবু পর্বতের পাদদেশ থেকে আরম্ভ করে পাঠককে দিকনির্দেশ দিয়ে, পথ দেখিয়ে, উত্তুঙ্গ শৈলচূড়ে নিয়ে যান না; তিনি আরম্ভই করেন কোনও সুউচ্চ পর্বতসানুতে দাঁড়িয়ে। সেই অজেয় উচ্চতা থেকেই তিনি ছড়িয়ে দেন তাঁর আত্মপ্রত্যয়ী সৃষ্টির ধারাবারি; আর যখন তাঁর লেখনি থেমে যায়, আমরা দেখি, অধিত্যকা পূর্ণ করে ছড়িয়ে আছে এক অবিস্মরণীয় আবেশ। তাঁর আত্মজীবনী ‘Autobiography Of An Unknown Indian’ (১৯৫১)'এর প্রথম খণ্ডের চতুর্থ অধ্যায় Into The World'এর Prefatory Note'এ 'An Essay On The Course Of Indian History' শীর্ষকে নীরদবাবু একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। আর তার প্রায় একেবারে আদিতেই একটু ছলনাশ্রয়ী বিনয়ে সগর্বে ঘোষণা করেছেন, ইতিহাস-দর্শনের প্রশ্নে স্বদেশবাসীর সাথে তাঁর একটা দুস্তর ব্যবধান রয়েছে- যেটা, তাঁর মতে, পৃথিবী সম্বন্ধে যথাক্রমে কোপারনিসীয় ও প্রাক-কোপারনিসীয় ধারণার প্রভেদের সাথে তুল্য। সব লেখাতেই তিনি নিজের সম্পর্কে উচ্চাশা পোষণ করেছেন। এই প্রবন্ধও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গবেষণার প্রবৃত্তি, বিষয়মুখিনতা আর বৌদ্ধিক সততা একজন সাধারণের চরিত্রে দুর্লভ- এ কথা বলে আদতে তিনি নিজে যে এই গুণগুলির অধিকারী সেটিই প্রকারান্তরে ব্যক্ত করতে চেয়েছেন। সে যাই হোক, এরপরেই ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে তিনি একটি অসাধারণ মন্তব্য করেছেন, 'Indian history… presents its own synthesis'- আমাদের দেশের ইতিহাস সম্পর্কে এর চেয়ে বৃহৎ সত্য আর কী-ই বা আছে? অথচ এমন গভীর দর্শনের কথা যিনি বলেন, তিনিই আবার সমগ্র প্রবন্ধ জুড়ে, বা বলা ভাল সমগ্র আত্মজীবনীটি জুড়েই আপন শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করতে সচেষ্ট থেকেছেন। এই স্ববিরোধ তাঁর প্রায় সকল লেখাকেই কিছুটা নিম্নগামী করেছে। সে প্রসঙ্গে আমরা পরে আসব।
স্বতঃবর্ণনশীলা ভারতেতিহাসকে নীরদবাবু বিভক্ত করেছেন কালানুক্রমিক ভাবে তিনটি পর্যায়ে। ইতিহাসের এই যুগবিভাগ- এক যুগ থেকে অপরাপর যুগে সংস্কৃতির যে অনিরুদ্ধ প্রবাহ, একের সাথে অপরে মিশে সঙ্কর ও সুন্দর সংস্কৃতি বিনির্মাণের এই যে কালব্যাপী সহজাত প্রণালী, এর সাথে যেভাবে জীবের অভিযোজনের ইতিবৃত্ত, প্রজাতি থেকে পরবর্তী প্রজাত্যন্তরে বৈশিষ্ট্যের ক্রমোন্নতি প্রভৃতির সাদৃশ্য দেখিয়েছেন তিনি, তাতে তাঁর শক্তিশালী দর্শনশৈলীর পরিচয় মেলে। তিনি লিখেছেন, 'By applying the criterion of cultural character it is certainly justifiable to call the first cycle Hindu, the second Islamic, and the third the European.' তাঁর মত, ভারত এই প্রতিটি যুগেই তার সমকালীন বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী সভ্যতার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে এবং তার সকল বৈশিষ্ট্যকে আত্তীকরণ করে, বিশ্বমিলনের হোমানলে তাকে আহুতি দিয়ে, উদ্ভূত সুবাসকে দিকে দিকে পরিব্যাপ্ত করেছে। তবে স্থূলভাবে তাঁর বক্তব্য এই হলেও এর বিশ্লেষণ তিনি স্বকীয়ভাবে করেছেন। The Guardian জানাচ্ছে, 'His interpretation of Indian history as a whole - at its dottiest in The Continent Of Circe (1965) - was based on the notion that, because most Indians were descended from immigrants, they were not really 'auto-chthonous'. They had always absorbed the incomers' ideas, and should have done so properly with the British, instead of, as usual, 'wearing out, outraging, and degrading everything great and good' that came in.' বিশ্বের প্রতিটি সুবৃহৎ সাম্রাজ্যের প্রতিই তাঁর মোহ ছিল (সে কথা তাঁর আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড Thy Hand, Great Anarch!'এর My Faith in Empires অধ্যায়টি পড়লেই বোঝা যায়) এবং হয়তো সেই মোহাবেশই তাঁকে এই ভাবনায় ভাবিত করেছে।
হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি সম্পর্কে নীরদ চৌধুরী একটি স্বতন্ত্র মনোভাব পোষণ করতেন। তিনি বলেছেন, এই শ্রেণির অস্থিরতার কারণ যে কোনও সামাজিক পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মানসিকতা ও বিভিন্ন সমাজাচারকে নিজেদের মধ্যে সুসংহত করার অভ্যেস। ভারতে মুসলমান শাসনকালে হিন্দু মধ্যবিত্তরা মুসলমানি পোশাক পরেছে, ফারসি শিখেছে, শাসনযন্ত্রে অংশ নিয়েছে এবং শাসকশ্রেণিকে অনুকরণ করে সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জনের চেষ্টা করেছে; কিন্তু সকল ক্ষেত্রেই তাদের একটা স্বার্থ ছিল। সেই শাসনকাল যখন শেষ হয়ে গিয়েছে, সমাজ ও কালের নিয়মেই এই মানসিকতাও দূর হয়ে গিয়েছে। মধ্যযুগীয় গণসংস্কৃতির কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, সে’ সময়কার অস্থির পরিবেশে হিন্দু ও মুসলমান সমাজ অপেক্ষা উভয়ের সংমিশ্রণে তৈরি সমাজই ছিল অধিকতর স্থিতিশীল, কারণ, এই সমাজ-বিনির্মাণের মধ্যে একটা ঐক্যস্থাপনের প্রয়াস ছিল। তবে উভয় ধর্মের সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করে এরপর তিনি দু’য়ের মধ্যে সাদৃশ্যগুলি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। উভয়ের সংমিশ্রণে জাত সংস্কৃতির প্রতি কীভাবে সাধারণের মনে এক শ্রদ্ধা তৈরি হয়েছিল, সে’ সম্পর্কেও একটি মনোজ্ঞ আলোচনা তিনি করেছেন।
ইংরেজ সাম্রাজ্যকালে ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাগুলি ইংরেজি ভাষার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কীভাবে তাদের syntax পুনর্গঠিত হয়েছে, তার সম্পর্কেও কয়েকটি কথা নীরদবাবু বলেছেন। এটা উল্লেখ্য যে, ইতিহাসের সামগ্রিক আলোচনার ক্ষেত্রে ভাষার উপর তিনি বেশ অনেকটা গুরুত্ব আরোপ করেছেন। দৈর্ঘ্যের সীমার কারণে তার প্রতিটির কথা আমরা হয়তো বলতে পারব না। তবে এটা বলতেই হবে যে, আধুনিক ভারতীয় সংস্কৃতির প্রামাণ্য হিসেবে তিনি দেখেছেন আধুনিক ভারতীয় ভাষাকে, যা উৎপন্ন হয়েছে ইংরেজি ভাষার প্রভাবে, লেখ্য আঞ্চলিক ভাষা ও বিবিধ কথ্য ভাষার সংমিশ্রণে। দেশীয় সাহিত্যে গদ্যের প্রথম পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ব্রিটিশরাজকেই তিনি যাবতীয় কৃতিত্ব দিয়েছেন।
নীরদবাবুর দাবি, ঊনবিংশ শতাব্দীতে যাঁদের আমরা নবজাগরণের পথিকৃৎ বলে জানি এবং মানি, প্রতীচ্যে উপযুক্ত সম্মান না পেলে আমরা দেশবাসী তাঁদের প্রতি এই সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতাম না। সপক্ষ সমর্থনে তিনি বিবেকানন্দের একটি কথাকে উদ্ধৃত করেছেন, 'I travelled twelve years all over India, finding no way to work for my countrymen, and that was why I went to America'; রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে বলে তাঁর অভিমত। তিনি আরও বলেছেন, বঙ্কিমবাবু যে এনাদের তুলনায় সমোচ্চতায় বিচার্য হন না, তার প্রধান কারণ, পাশ্চাত্যবাসীর কাছে তিনি অতটাও ‘recognition’ পাননি। রামমোহন রায় সম্পর্কে Jacquemont'এর একটি বক্তব্য তিনি উদ্ধৃত করেছেন, 'He has known this pain of isolation. He has grown in a region of ideas and feelings which is higher than the world in which his countrymen live'- নীরদবাবুর কথায় যুক্তি বা সত্য যাই থাক না কেন, রামমোহন সম্বন্ধে এ কথা যে কতখানি সত্য তা পাঠক নির্দ্বিধায় স্বীকার করবেন। প্রবন্ধের শেষের দিকে এসে নীরদ চৌধুরী লিখেছেন, '…[I]n the course of history the internal proletariat of India is being perpetually reinforced by the same foreign motive power which is keeping the country within the orbit of civilization.'
তিনি বলছেন যে এর সঙ্গে সঙ্গে এই ইন্টারনাল প্রলেটারিয়েত শ্রেণির মধ্যে একটি দ্বিস্তরীয় পরিবর্তন ঘটে যায়। প্রথমত, শ্রেণির মধ্যে আসে অধিক বিষমত্ব; আর দ্বিতীয়ত, ইতিহাসের প্রতিটি যুগেই এই শ্রেণির মধ্যে যারা নতুন আর পুরনো সংস্কৃতির বাহক ও লালনকর্তা, তাদের অনুপাতটা পরিবর্তিত হয়ে যায়। ভারতেতিহাসের একটা সুবৃহৎ অংশই, তাঁর মতে, নিয়ন্ত্রিত হয়েছে এই শ্রেণির দ্বারা। সব শেষে ইতিহাসের বর্ণনা প্রসঙ্গে খুব সুন্দরভাবে তিনি নিয়ে এসেছেন ভারতের বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূগোলের কথা।
এই গোটা প্রবন্ধটিতে নিঃসন্দেহে নীরদবাবুর অসামান্য পাণ্ডিত্যের প্রতিফলন ঘটেছে, কিন্তু The Guardian যে জানাচ্ছে, 'For a writer who showed so strong a distaste for the 'indiscipline' of the Indians’ lives, Chaudhuri was himself undisciplined in the structure of his books, though an elegant writer in detail.'- তা এই প্রবন্ধটির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বেশ কিছু স্থানে আলোচনায় কিছু পুনরুক্তি এসেছে, এসেছে আত্মম্ভরিতা, কোনও বিষয়ের প্রয়োজনের তুলনায় দীর্ঘ আলোচনা রচনাকে ভারাক্রান্ত করেছে। অবশ্য এটাও ঠিক যে, যেখানে যেখানে তিনি সাধারণ ভাবনার বিপ্রতীপে গিয়ে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়েছেন, সেখানেই এই আত্মপক্ষ সমর্থনে বিস্তার করা যুক্তিজাল একটু দীর্ঘ হয়েছে।
ইতিহাসকে নীরদ চৌধুরী দেখেছেন কতকটা ‘magisterial’ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। একটা উচ্চ শাসনবেদীতে বসে তিনি যেন আপনার চাইতে নিকৃষ্ট সকলের যাবতীয় কার্যকলাপ, তাদের জীবনচর্যা আর যাপনকে কিছুটা করুণার, কিছুটা ভ্রূকুটিত আর কিছুটা ক্ষমার চোখে দেখেছেন। অনেক জায়গাতেই তিনি যা লিখেছেন, তাঁর জীবনের কথা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে তিনি আদৌ তা করেননি, বরং নিজের আদর্শের একেবারে বিপরীতে গিয়ে যা করাকে তিনি ঘৃণার চোখে দেখেছেন, তাই-ই করেছেন। কিন্তু কেন এই স্ববিরোধ? ডঃ রাধা নাগ তাঁর ‘আত্মঘাতী নীরদ চৌধুরী’ গ্রন্থে লিখেছেন, 'মনোবিজ্ঞানীরা নীরদবাবুর ন্যায় এই ধরনের ব্যক্তিত্বের নাম দিয়াছেন- Narcissistic personality'; মনোরোগবিদ ডঃ ধীরেন্দ্রনাথ নন্দীর মতে, সব বিষয়েই এরা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে, অপরের সাফল্যকে এরা ঈর্ষান্বিত চোখেই দেখে। নীরদবাবুর আত্মজীবনীটি প্রকাশিত হওয়ার পরে তিনি বলেছিলেন, 'উহা প্রকাশের পরই বিলাতে যেভাবে প্রশংসিত হইয়াছিল ও যেভাবে আলোচিত হইয়াছিল, তাহা ইহার পূর্বে কোনও ভারতীয়ের লেখা ইংরাজি বইয়ের বেলাতে দেখা যায় নাই, এমনকি জবাহরলাল নেহরুর আত্মজীবনীর জন্যেও নয়।' ইংরেজি লেখার গুণগত মানের বিচারে পণ্ডিতজী না নীরদবাবু- কার লেখা অধিক প্রশংসনীয়, সে প্রশ্নটুকু বাদ রেখেও বলা চলে, এই যে আত্মদর্প, আপনাকে সকলের চাইতে উপরে প্রতিষ্ঠিত দেখাবার এই যে উদগ্র বাসনা, তা তাঁর লেখাকেই কালিমালিপ্ত করেছে। তাই The New York Review of Books'এ Ian Buruma যখন লেখেন, 'Anyone who wishes to understand what has happened in India in the twentieth century politically and culturally must read Nirad C. Chaudhury.', আমরা তার সাথে সহমত হতে পারি না। নীরদ চৌধুরীর ভারতেতিহাসের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিকে তাই ব্যতিক্রমী বলেই শিরোধার্য হিসেবে গ্রহণ করা চলে না।
এটা অনস্বীকার্য যে, আপন বক্তব্যের সারকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে তিনি যথেষ্ট দায়িত্বশীলই হয়েছেন; কিন্তু তাঁর যুক্তিজালের মধ্যে থেকে যেগুলি সত্যই পক্ষপাতদুষ্ট নয়, সেগুলিকে আমাদের খুঁজে নিতে হবে। ‘আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ’, ‘বাঙালি জীবনে রমণী’, ‘আমার দেবোত্তর সম্পত্তি’ প্রভৃতি গ্রন্থে যে দ্বিচারিতা তিনি দেখিয়েছেন, তাতে অক্সফোর্ডের ডিলিট, সাহিত্য অকাদেমি, ডাফ কুপার স্মৃতি পুরস্কার কিংবা দেশিকোত্তম কোনওটিরই প্রতি সুবিচার তিনি করেননি। ডঃ রাধা নাথের কথায়, ব্যক্তি নীরদ আর লেখক নীরদের যে দ্বন্দ্ব আজীবন তাঁর লেখাকে কতকটা নিম্নগামী করে গেল, সেই দ্বন্দ্বটুকুকে মাথায় রেখেও ভারতের ইতিহাস, তার সমাজ, তার আবহমানকালীন সংস্কৃতি সম্পর্কে যে অতলান্ত প্রজ্ঞার নিদর্শন তিনি স্থলে স্থলে রেখে গিয়েছেন, তা যেন আমরা অস্মৃত না হই।