ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা?
শোভনলাল চক্রবর্তী
'পুঁজিপতিরা নিজেদের কবর, নিজেরাই খুঁড়ে থাকেন', মার্কস বলেছিলেন। আজ কথাগুলো সম্পূর্ণ অন্য এক প্রেক্ষিতে অক্ষরে অক্ষরে ফলে যেতে চলেছে। পৃথিবীর অগ্রণী জীবাশ্ম জ্বালানির কোম্পানিগুলি তাদের ভবিষ্যৎ উৎপাদন প্রসারণের যে পরিকল্পনা সামনে এনেছে, তা দেখে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের চোখ কপালে উঠেছে। বিজ্ঞানীদের মতে, এই সব প্রকল্প রূপায়িত হলে কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে ঠিকই, কিন্তু পাশাপাশি কার্বন উৎপাদন এত বেশি বেড়ে যাবে যে সেটা একটা বিস্ফোরক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। বিজ্ঞানীরা এর নামকরণ করেছেন 'কার্বন বোমা'। বর্তমানে প্রায় ১৯৫টি প্রকল্প চিহ্নিত হয়েছে, যার প্রতিটি এক-একটি 'কার্বন বোমা'। এই প্রকল্পগুলো বর্তমানে চালু হয়েছে, কিন্তু যখন উৎপাদন সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছবে তখন এদের কার্বন উৎপাদন হয়ে পড়বে মাত্রাছাড়া।
এটা আমরা সবাই প্রায় জানি যে, জীবাশ্ম জ্বালানির প্রধান দু’টি পদার্থ কয়লা আর ডিজেল। এ দু’টি পদার্থের ব্যবহার বর্তমানে পৃথিবীতে সব থেকে বেশি। ফলে, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ বেড়ে গেছে মারাত্মক ভাবে। কার্বনের এই নিঃসরণ যদি কমিয়ে আনা না-যায় তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে ৩০ কোটি মানুষের বসবাসের বিশাল এলাকা সমুদ্রের জলের তলায় তলিয়ে যাবে। এ অঞ্চলগুলোর মধ্যে আছে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বড় বড় শহর। দেড় শতাধিক দেশের ১১ হাজারের বেশি বিজ্ঞানী সতর্কবার্তা জারি করে আরও জানিয়েছেন যে পরিবেশ প্রশ্নে প্রচলিত পথ না-পালটালে মানব জাতির ওপর নেমে আসবে ভয়াবহ বিপর্যয়।
এই খবর বিশ্ববাসীর জন্য রীতিমতো উদ্বেগজনক ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মানে, কয়লা আর ডিজেলের সর্বাধিক ব্যবহারের ফলে আজ ভয়াবহ এই দুর্যোগ বিশ্ববাসীর সামনে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। অথচ বিষয়টিকে আমরা এখনও তেমন গুরুত্ব দিচ্ছি না। যেন কিছুই ঘটছে না- এরকম ভাব বজায় রেখে আমরা আছি দিব্যি। এই মানসিকতা দুঃখজনক বৈ আর কিছু নয়। প্রশ্ন উঠছে, কয়লা ও ডিজেলের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ না করে গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে গৃহীত পদক্ষেপ কীভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব?
আজকের পৃথিবীতে মার্কিন সেনাবাহিনী জীবাশ্ম জ্বালানির বৃহত্তম ব্যবহারকারী এবং কার্বনের বৃহত্তম নির্গমনকারী। তাদের চলমান যুদ্ধগুলো সম্পদ ও শক্তির জন্য পরিচালিত। মানুষ, জীবন ও পরিবেশ ধ্বংসযজ্ঞের কথা যুদ্ধের সময়ে উল্লেখ না করেই তারা ইতিপূর্বে যুদ্ধ চালিয়েছে। কয়েক দশক ধরে মার্কিন সামরিক বাহিনী তেল সংস্থার সুরক্ষার জন্য যুদ্ধ করছে এবং এই প্রক্রিয়ার মধ্যে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ পৃথিবীর অন্য কোনও সংস্থার চেয়ে অনেক বেশি শক্তি ব্যবহার ও আরও কার্বন নির্গমন করেছে। ২০০৩'এ মার্কিন সেনাবাহিনী ইরাক আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি হিসাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত জোট বাহিনীগুলির চেয়ে মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আরও বেশি পরিমাণ গ্যাসোলিন ব্যবহার করেছে। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেছেন যে সমগ্র ইরাকের যুদ্ধে, মার্কিন সামরিক বাহিনীর কার্বন পদচিহ্নটি ছিল ২৫ থেকে ৬০ কোটি টন।
আমরা জানি, বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে পালটে যাচ্ছে জলবায়ু। দক্ষিণ ও উত্তর মেরুর বরফ গলে সমুদ্রের জলের পরিমাণও গেছে বেড়ে। তার ওপর আবার বহু গুন বেশি দেখা দিয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ সব কারণ চিহ্নিত করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির হার বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় শিল্পোন্নত দেশগুলো মাত্রাতিরিক্ত ভাবে ব্যবহার করছে কয়লা, ডিজেল। এতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের উদ্গীরণ বেড়ে গেছে ভয়াবহরকম ভাবে। এই কার্বন-ডাই-অক্সাইডই পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বাড়িয়ে দিয়েছে, পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত ওজোন স্তরকে। আমরা জানি, পৃথিবীর চারদিক ঘিরে থাকা বায়ুমণ্ডল বেশ কিছু গ্যাসের সমন্বয়ে গঠিত। এইসব গ্যাস মশারির মতো পরম যত্নে ঘিরে রাখে এই পৃথিবীকে। হ্যাঁ, প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, কোন কোন গ্যাসের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বায়ুমণ্ডল? বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, সেই গ্যাসগুলো হল অক্সিজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন, হিলিয়াম ইত্যাদি।
এ কথা স্বীকার না-করে উপায় নেই, জীব জগতের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে বায়ুমণ্ডলের গুরুত্ব সীমাহীন। কিন্তু দুশ্চিন্তার কারণ, পৃথিবীকে আবৃত করে থাকা বায়ুমণ্ডল দিন দিন তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছে। মানুষ তার অপরিণামদর্শী কৃতকর্মের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলকে দিন দিন অনিরাপদ করে তুলছে। তারপরও পরিবেশ ও প্রকৃতিকে রক্ষার জন্য প্রাকৃতিকভাবেই কিছু রক্ষাকবচ আছে। তার মধ্যে একটি হল ওজোন স্তর। বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত ওজোন আবার দুটি স্তরে বিভক্ত। প্রথম স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০-১৬ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত- এই অংশকে বলা হয় ট্রপোস্ফিয়ার- সেখানে মাত্র ১০ শতাংশ ওজোন বিরাজ করে। আর দ্বিতীয় স্তর ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার উচ্চতা থেকে শুরু করে ৫০ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত- এই দ্বিতীয় অংশকে বলা হয় স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার। সাধারণভাবে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের অংশটাই হল প্রকৃত ওজোন স্তর। সেখানে ৯০ শতাংশ ওজোন বিরাজ করে। এই দ্বিতীয় স্তরটি ওজোন গ্যাস দিয়ে তৈরি এক ধরনের বিশেষ আচ্ছাদন, যাকে বলা যায় ছাঁকনি। এর মধ্য দিয়ে সূর্যের রশ্মি পরিশোধিত হয়ে পৃথিবীতে এসে পৌঁছয়। ফলে, ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে জীব জগৎ। তাই গুরুত্বপূর্ণ এই ওজোন স্তর যাতে কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে দিকে খেয়াল রাখার পবিত্র দায়িত্ব আমাদেরই।
ওজোন গ্যাস যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের শৃঙ্খলিত নিয়ম ভেঙে পড়বে। মানুষের ত্বকে ক্যান্সার, চোখে ছানি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস ইত্যাদির ঝুঁকি বেড়ে যায়। শ্বেতবর্ণের মানুষের ত্বকে ক্যান্সারের জন্য অতিবেগুনি রশ্মি দায়ী। সামুদ্রিক প্রাণিকুলও অতিবেগুনি রশ্মির কারণে মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হতে পারে। সে অবস্থা যদি সত্যিই দেখা দেয়, তাহলে মানুষের জন্য প্রকট হয়ে দেখা দেবে প্রোটিন ঘাটতি। সমুদ্র থেকে আহরিত খাদ্যশৃঙ্খলাও পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।শুধু কি তাই, সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি উদ্ভিদের বংশ বৃদ্ধিতেও বাধা দান করে। ফলে, শস্যের উৎপাদন হ্রাস পায় এবং বনাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা জানি, বৃক্ষরাজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোধন করে। যদি উদ্ভিদ ও বনাঞ্চল ছোট হয়ে আসে তবে বায়ুমণ্ডলে ভেসে বেড়ানো কার্বন-ডাই-অক্সাইড পুরোটা শোধন হয় না, অবশিষ্ট কিছু অংশ অপরিশোধিত অবস্থায় থেকে যায়। এভাবে অপরিশোধিত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে বায়ুমণ্ডলকে ক্রমশ করে তুলছে অনিরাপদ, বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে করছে ত্বরান্বিত। আজ আমরা বাস্তবিক সেই মারাত্মক ঝুঁকির মুখোমুখি এসে পড়েছি। পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে ওজোন স্তরকে তার আগের অবস্থায় যে কোনও মূল্যে ফিরিয়ে আনতেই হবে। এর জন্য প্রয়োজন গ্লাসগো প্রোটোকলের বাধ্যবাধকতাগুলো অনুসরণ করা। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এটা যদি ঠিকমতো পালন করা হয় তাহলে চলতি শতাব্দীর মাঝামাঝি ওজোন স্তরকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। তাই আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ওজোন স্তরে ক্ষয়কারী বাকি যে সব দ্রব্য রয়েছে সেগুলোর উৎপাদন ও ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। রেফ্রিজারেশন ও এয়ারকন্ডিশনিং সেক্টরে ক্ষতিকর গ্যাস সিএফসি বা ক্লোরোফ্লুরোকার্বনের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার বন্ধ করার জন্য উন্নত বিশ্বের সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ঠিক করবার কাজটি নিয়ে যত সময়ক্ষেপণ হবে, মতানৈক্য থাকবে, তত বেশি মোকাবিলা করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি এড়াবার পথ হল শিল্পোন্নত রাষ্ট্রসমূহকে এক টেবিলে বসিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছনো। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রাকে প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে বাড়তি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে অবশ্যই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
হ্যাঁ, আমরা মানছি, এই মহাবিপদ সত্যিই কোনও একটি দেশের পক্ষে একা মোকাবিলা করা যাবে না। বিষয়টি যেহেতু বৈশ্বিক, তাই একে মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ। মানব জাতি সহ জীবজগতের অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়টি এখন সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়ার বিষয়। একে হাল্কাভাবে দেখা মানে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিকে আহ্বান করা। তাই সময়ক্ষেপণ না করে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে এনে কার্বনমুক্ত বিশ্ব গড়ার যে আহ্বান বিশ্বের ১৯৭টি দেশ গ্লাসগো চুক্তির মাধ্যমে করেছিল তাকে বাস্তব রূপ দিতে হলে প্রথমে পরিবেশ প্রশ্নে প্রচলিত ধারণা পালটাতে হবে। সুখবর হল, গ্লাসগো সম্মেলনের পর পরিবেশগত ঝুঁকির বিষয়টি ধীরে ধীরে অধিকাংশ দেশই গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে, কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে এনে এর বিকল্প উপায়ও বেছে নেওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে একদিন না একদিন সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গড়ে তোলা সম্ভব হবে বাসযোগ্য সুন্দর এক পৃথিবী। কিন্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে বড় অর্থনীতির দেশগুলো কার্বন পদচিহ্ন রোধ করতে পারবে কিনা, তা সময়ই বলবে। তেল কোম্পানির শেয়ারের দর যখন ধরে রেখেছে প্রায় গোটা বিশ্বের অর্থনীতি, তখন কাজটা ততটা সহজ হবে না। বিশ্বের যারা আজ অন্যতম বড় শক্তি তারা যে নিজেরা পরিবেশ বান্ধব তা বলা যাবে না। পরিবেশের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতাও তাই প্রশ্নের মুখে। হালের রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এই যুদ্ধ পরিবেশের বিরুদ্ধে মানুষের যুদ্ধকে অনেকটা পিছিয়ে দিল- এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। বিশ্বের তেল ও গ্যাস রাজনীতির চাবিকাঠি যাদের হাতে তারা যতদিন না 'কার্বন বোমা'র বিপদ সম্পর্কে অবগত হচ্ছে, ততদিন সাধারণ মানুষের কাজ হবে প্রতিরোধ, প্রতিবাদের দ্বারা তাদের কানে জল ঢোকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।