Monday, 30 May 2022

পরিবেশ বিপর্যয়

ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা?

শোভনলাল চক্রবর্তী


'পুঁজিপতিরা নিজেদের কবর, নিজেরাই খুঁড়ে থাকেন', মার্কস বলেছিলেন। আজ কথাগুলো সম্পূর্ণ অন্য এক প্রেক্ষিতে অক্ষরে অক্ষরে ফলে যেতে চলেছে। পৃথিবীর অগ্রণী জীবাশ্ম জ্বালানির কোম্পানিগুলি তাদের ভবিষ্যৎ উৎপাদন প্রসারণের যে পরিকল্পনা সামনে এনেছে, তা দেখে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের চোখ কপালে উঠেছে। বিজ্ঞানীদের মতে, এই সব প্রকল্প রূপায়িত হলে কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে ঠিকই, কিন্তু পাশাপাশি কার্বন উৎপাদন এত বেশি বেড়ে যাবে যে সেটা একটা বিস্ফোরক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। বিজ্ঞানীরা এর নামকরণ করেছেন 'কার্বন বোমা'। বর্তমানে প্রায় ১৯৫টি প্রকল্প চিহ্নিত হয়েছে, যার প্রতিটি এক-একটি 'কার্বন বোমা'। এই প্রকল্পগুলো বর্তমানে চালু হয়েছে, কিন্তু যখন উৎপাদন সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছবে তখন এদের কার্বন উৎপাদন হয়ে পড়বে মাত্রাছাড়া। 

এটা আমরা সবাই প্রায় জানি যে, জীবাশ্ম জ্বালানির প্রধান দু’টি পদার্থ কয়লা আর ডিজেল। এ দু’টি পদার্থের ব্যবহার বর্তমানে পৃথিবীতে সব থেকে বেশি। ফলে, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ বেড়ে গেছে মারাত্মক ভাবে। কার্বনের এই নিঃসরণ যদি কমিয়ে আনা না-যায় তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে ৩০ কোটি মানুষের বসবাসের বিশাল এলাকা সমুদ্রের জলের তলায় তলিয়ে যাবে। এ অঞ্চলগুলোর মধ্যে আছে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বড় বড় শহর। দেড় শতাধিক দেশের ১১ হাজারের বেশি বিজ্ঞানী সতর্কবার্তা  জারি করে আরও জানিয়েছেন যে পরিবেশ প্রশ্নে প্রচলিত পথ না-পালটালে মানব জাতির ওপর নেমে আসবে ভয়াবহ বিপর্যয়। 

এই খবর বিশ্ববাসীর জন্য রীতিমতো উদ্বেগজনক ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মানে, কয়লা আর ডিজেলের সর্বাধিক ব্যবহারের ফলে আজ ভয়াবহ এই দুর্যোগ বিশ্ববাসীর সামনে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। অথচ বিষয়টিকে আমরা এখনও তেমন গুরুত্ব দিচ্ছি না। যেন কিছুই ঘটছে না- এরকম ভাব বজায় রেখে আমরা আছি দিব্যি। এই মানসিকতা দুঃখজনক বৈ আর কিছু নয়। প্রশ্ন উঠছে, কয়লা ও ডিজেলের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ না করে গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে গৃহীত পদক্ষেপ কীভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব?

আজকের পৃথিবীতে মার্কিন সেনাবাহিনী জীবাশ্ম জ্বালানির বৃহত্তম ব্যবহারকারী এবং কার্বনের বৃহত্তম নির্গমনকারী। তাদের  চলমান যুদ্ধগুলো সম্পদ ও শক্তির জন্য পরিচালিত। মানুষ, জীবন ও পরিবেশ ধ্বংসযজ্ঞের কথা যুদ্ধের সময়ে উল্লেখ না করেই তারা ইতিপূর্বে যুদ্ধ চালিয়েছে। কয়েক দশক ধরে মার্কিন সামরিক বাহিনী তেল সংস্থার সুরক্ষার জন্য যুদ্ধ করছে এবং এই প্রক্রিয়ার মধ্যে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ পৃথিবীর অন্য কোনও সংস্থার চেয়ে অনেক বেশি শক্তি ব্যবহার ও আরও কার্বন নির্গমন করেছে। ২০০৩'এ মার্কিন সেনাবাহিনী ইরাক আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি হিসাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত জোট বাহিনীগুলির চেয়ে মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আরও বেশি পরিমাণ গ্যাসোলিন ব্যবহার করেছে। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেছেন যে সমগ্র ইরাকের যুদ্ধে, মার্কিন সামরিক বাহিনীর কার্বন পদচিহ্নটি ছিল ২৫ থেকে ৬০ কোটি টন। 

আমরা জানি, বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে পালটে যাচ্ছে জলবায়ু। দক্ষিণ ও উত্তর মেরুর বরফ গলে সমুদ্রের জলের পরিমাণও গেছে বেড়ে। তার ওপর আবার বহু গুন বেশি দেখা দিয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ সব কারণ চিহ্নিত করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির হার বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় শিল্পোন্নত দেশগুলো মাত্রাতিরিক্ত ভাবে ব্যবহার করছে কয়লা, ডিজেল। এতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের উদ্গীরণ বেড়ে গেছে ভয়াবহরকম ভাবে। এই কার্বন-ডাই-অক্সাইডই পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বাড়িয়ে দিয়েছে, পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত ওজোন স্তরকে। আমরা জানি, পৃথিবীর চারদিক ঘিরে থাকা বায়ুমণ্ডল বেশ কিছু গ্যাসের সমন্বয়ে গঠিত। এইসব গ্যাস মশারির মতো পরম যত্নে ঘিরে রাখে এই পৃথিবীকে। হ্যাঁ, প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, কোন কোন গ্যাসের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বায়ুমণ্ডল? বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, সেই গ্যাসগুলো হল অক্সিজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন, হিলিয়াম ইত্যাদি। 

এ কথা স্বীকার না-করে উপায় নেই, জীব জগতের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে বায়ুমণ্ডলের গুরুত্ব সীমাহীন। কিন্তু দুশ্চিন্তার কারণ, পৃথিবীকে আবৃত করে থাকা বায়ুমণ্ডল দিন দিন তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছে। মানুষ তার অপরিণামদর্শী কৃতকর্মের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলকে দিন দিন অনিরাপদ করে তুলছে। তারপরও পরিবেশ ও প্রকৃতিকে রক্ষার জন্য প্রাকৃতিকভাবেই কিছু রক্ষাকবচ আছে। তার মধ্যে একটি হল ওজোন স্তর। বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত ওজোন আবার দুটি স্তরে বিভক্ত। প্রথম স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০-১৬ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত- এই অংশকে বলা হয় ট্রপোস্ফিয়ার- সেখানে মাত্র ১০ শতাংশ ওজোন বিরাজ করে। আর দ্বিতীয় স্তর ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার উচ্চতা থেকে শুরু করে ৫০ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত- এই দ্বিতীয় অংশকে বলা হয় স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার। সাধারণভাবে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের অংশটাই হল প্রকৃত ওজোন স্তর। সেখানে ৯০ শতাংশ ওজোন বিরাজ করে। এই দ্বিতীয় স্তরটি ওজোন গ্যাস দিয়ে তৈরি এক ধরনের বিশেষ আচ্ছাদন, যাকে বলা যায় ছাঁকনি। এর মধ্য দিয়ে সূর্যের রশ্মি পরিশোধিত হয়ে পৃথিবীতে এসে পৌঁছয়। ফলে, ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে জীব জগৎ। তাই গুরুত্বপূর্ণ এই ওজোন স্তর যাতে কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে দিকে খেয়াল রাখার পবিত্র দায়িত্ব আমাদেরই। 

ওজোন গ্যাস যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের শৃঙ্খলিত নিয়ম ভেঙে পড়বে। মানুষের ত্বকে ক্যান্সার, চোখে ছানি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস ইত্যাদির ঝুঁকি বেড়ে যায়। শ্বেতবর্ণের মানুষের ত্বকে ক্যান্সারের জন্য অতিবেগুনি রশ্মি দায়ী। সামুদ্রিক প্রাণিকুলও অতিবেগুনি রশ্মির কারণে মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হতে পারে। সে অবস্থা যদি সত্যিই দেখা দেয়, তাহলে মানুষের জন্য প্রকট হয়ে দেখা দেবে প্রোটিন ঘাটতি। সমুদ্র থেকে আহরিত খাদ্যশৃঙ্খলাও পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।শুধু কি তাই, সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি উদ্ভিদের বংশ বৃদ্ধিতেও বাধা দান করে। ফলে, শস্যের উৎপাদন হ্রাস পায় এবং বনাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা জানি, বৃক্ষরাজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোধন করে। যদি উদ্ভিদ ও বনাঞ্চল ছোট হয়ে আসে তবে বায়ুমণ্ডলে ভেসে বেড়ানো কার্বন-ডাই-অক্সাইড পুরোটা শোধন হয় না, অবশিষ্ট কিছু অংশ অপরিশোধিত অবস্থায় থেকে যায়। এভাবে অপরিশোধিত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে বায়ুমণ্ডলকে ক্রমশ করে তুলছে অনিরাপদ, বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে করছে ত্বরান্বিত। আজ আমরা বাস্তবিক সেই মারাত্মক ঝুঁকির মুখোমুখি এসে পড়েছি। পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে ওজোন স্তরকে তার আগের অবস্থায় যে কোনও মূল্যে ফিরিয়ে আনতেই হবে। এর জন্য প্রয়োজন গ্লাসগো প্রোটোকলের বাধ্যবাধকতাগুলো অনুসরণ করা। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এটা যদি ঠিকমতো পালন করা হয় তাহলে চলতি শতাব্দীর মাঝামাঝি ওজোন স্তরকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। তাই আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ওজোন স্তরে ক্ষয়কারী বাকি যে সব দ্রব্য রয়েছে সেগুলোর উৎপাদন ও ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। রেফ্রিজারেশন ও এয়ারকন্ডিশনিং সেক্টরে ক্ষতিকর গ্যাস সিএফসি বা ক্লোরোফ্লুরোকার্বনের  ক্রমবর্ধমান ব্যবহার বন্ধ করার জন্য উন্নত বিশ্বের সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ঠিক করবার কাজটি নিয়ে যত সময়ক্ষেপণ হবে, মতানৈক্য থাকবে, তত বেশি মোকাবিলা করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি এড়াবার পথ হল শিল্পোন্নত রাষ্ট্রসমূহকে এক টেবিলে বসিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছনো। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রাকে প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে বাড়তি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে অবশ্যই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।

হ্যাঁ, আমরা মানছি, এই মহাবিপদ সত্যিই কোনও একটি দেশের পক্ষে একা মোকাবিলা করা যাবে না। বিষয়টি যেহেতু বৈশ্বিক, তাই একে মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ। মানব জাতি সহ জীবজগতের অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়টি এখন সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়ার বিষয়। একে হাল্কাভাবে দেখা মানে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিকে আহ্বান করা। তাই সময়ক্ষেপণ না করে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে এনে কার্বনমুক্ত বিশ্ব গড়ার যে আহ্বান বিশ্বের ১৯৭টি দেশ গ্লাসগো চুক্তির মাধ্যমে করেছিল তাকে বাস্তব রূপ দিতে হলে প্রথমে পরিবেশ প্রশ্নে প্রচলিত ধারণা পালটাতে হবে। সুখবর হল, গ্লাসগো সম্মেলনের পর পরিবেশগত ঝুঁকির বিষয়টি ধীরে ধীরে অধিকাংশ দেশই গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে, কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে এনে এর বিকল্প উপায়ও বেছে নেওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে। এই  প্রবণতা অব্যাহত থাকলে একদিন না একদিন সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গড়ে তোলা সম্ভব হবে বাসযোগ্য সুন্দর এক পৃথিবী। কিন্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে বড় অর্থনীতির দেশগুলো কার্বন পদচিহ্ন রোধ করতে পারবে কিনা, তা সময়ই বলবে। তেল কোম্পানির শেয়ারের দর যখন ধরে রেখেছে প্রায় গোটা বিশ্বের অর্থনীতি, তখন কাজটা ততটা সহজ হবে না। বিশ্বের যারা আজ অন্যতম বড় শক্তি তারা যে নিজেরা পরিবেশ বান্ধব তা বলা যাবে না। পরিবেশের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতাও তাই প্রশ্নের মুখে। হালের রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এই যুদ্ধ পরিবেশের বিরুদ্ধে মানুষের যুদ্ধকে অনেকটা পিছিয়ে দিল- এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। বিশ্বের তেল ও গ্যাস রাজনীতির চাবিকাঠি যাদের হাতে তারা যতদিন না  'কার্বন বোমা'র বিপদ সম্পর্কে অবগত হচ্ছে, ততদিন সাধারণ মানুষের কাজ হবে প্রতিরোধ, প্রতিবাদের দ্বারা তাদের কানে জল ঢোকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।


Wednesday, 25 May 2022

দুর্নীতির শিখরে

এক অনড় অচল ব্যবস্থার সন্ধানে

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

গত কয়েক দিনে এ রাজ্যে এসএসসি নিয়োগে দুর্নীতি, কলকাতা হাইকোর্টের ভর্ৎসনা ও যুগান্তকারী রায়, অর্জুন সিং’এর দলবদল, নার্স নিয়োগেও যথেচ্ছাচার, বালি পাচার, মাটি পাচার ইত্যাদি বিবিধ দুর্নীতি, অনিয়ম ও পালাবদলে মিডিয়া ও রাজনৈতিক মহল একপ্রকার অগ্নিগর্ভ। এর মধ্যেই জ্ঞানবাপী থেকে কুতুব মিনার- দিকে দিকে প্রায় সমস্ত মসজিদের নিচেই নাকি শিবলিঙ্গের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ক্ষমতা দখলের সাতকাহনে দিকবিদিক এখন সরগরম।

যদি কেউ বলেন, দুর্নীতি তো সব সময়ই ছিল, এ আর এমন কী, এসব কীর্তি আগেও ঘটেছে, এইভাবেই তো দেশ চলছে- এসব বলে ভাবের ঘরে খানিক চুরি করা যায় বটে, কিন্তু আদপে তা যে শেষমেশ আমাদের ঘরেই আগুন জ্বালে, তা বোঝার পরিণতমনস্কতা অনেকেরই বোধকরি হয়নি। ‘চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ো ধরা’- আজ রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী প্রায় অনেকটাই আপাত ভাবে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছেন বলে আগে কোনও মন্ত্রীরা চুরি করেননি তেমনটা যেমন যথেষ্ট ভাবে প্রতিপাদ্য হয় না, তদুপরি, ধরা পড়ে যাওয়া ‘বেচারা’রা মন্ত্রীত্বের ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে যে চরম অপরাধ করেছেন, তারও কোনও ক্ষমা হয় না। আইন অবশ্যই আইনের পথে এগোবে এবং যতক্ষণ না পর্যন্ত তদন্তে ও বিচারে তাঁরা দোষী সাব্যস্ত হচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা বেনিফিট অফ ডাউটও পাবেন, কিন্তু এর জন্য যে সোরগোল ওঠার দরকার ছিল, বিচার ব্যবস্থার যে তৎপরতা ও নিখুঁত রায়ের প্রয়োজন ছিল, তা প্রদান করে বিচারপতিরা অবশ্যই সুকাজ করেছেন।

২০১৯ সালেও একটা বিচার হয়েছিল, তবে তার বিচারক ছিলেন জনগণ। লোকসভা নির্বাচনে এ রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে তুমুল ভোট দিয়ে তারা দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একপ্রকার সবক শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। অনুমান, তাতে কাজ হয়েছিল। ব্যাপক ভাবে চল হয়ে যাওয়া কাটমানির বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং মুখ খুলেছিলেন, নির্বাচনী কৌশলবিদ প্রশান্ত কিশোরকে এনে সে ভুল শুধরোনোর একটা বাহ্যিক প্রচেষ্টা (সমালোচকদের ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য করে) দেখা গিয়েছিল। অবশ্য, কিছু সত্যিকারের পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তা যেন মিলিয়েও মেলায় না, কিছুদিন হয়তো আড়ালে থাকে, আবার তেমন তেমন ‘সুদিন’ এলে দেখা যায় সেই পুরনো ঘোড়ারোগ আবার স্বমহিমায় বহাল হয়েছে। বলার কথা এই, তার অবশ্যই একটা সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আছে।

বর্তমান সরকারের একদম শুরুতেই এসএসসি’র চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন মণ্ডল মহাশয়। তাঁর দাবি মোতাবেক, তিনি সুষ্ঠুভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়ার একটা ব্যবস্থাপনা চালু করেছিলেন, পরীক্ষায় ডুপ্লিকেট ওএমআর শিটের ব্যবস্থা রেখেছিলেন, যেখানে ছাত্র-ছাত্রীরা ওএমআর’এর শিটের একটি কপি বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন এবং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত উত্তরপত্রের সঙ্গে নিজেদের দেয় উত্তর মিলিয়ে নিজেরাই বুঝে নিতে পারেন যে তিনি উত্তীর্ণ কিনা। কিন্তু কিছুদিন পরেই ক্ষমতার বিভিন্ন অলিন্দ থেকে তাঁর ওপর চাপ আসতে থাকে, ক্ষমতাবানদের পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ করার জন্য তাঁর ওপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা হয়। তিনি সে চাপের কাছে নতি স্বীকার না করায় তাঁকে প্রভাবশালী এক দলীয় নেতা পদত্যাগ করতে বলেন। ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে তিনি পদত্যাগ করেন। এই ঘটনার উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, ক্ষমতা দখলকে যখন অসৎ উপায়ে ব্যবহার করতে কোনও দল প্রায় দায়বদ্ধ হয়ে পড়ে, তখন স্বভাবতই সজ্জন ব্যক্তি ও নিয়মনিষ্ঠ ব্যবস্থা সেখানে অকেজো সাব্যস্ত হয়।

এই লেখা যখন লিখছি, তখনই খবর পেলাম দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা ও তার সপক্ষে কিছু প্রাথমিক প্রমাণ মেলায় পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত মান তাঁর স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছেন। অর্থাৎ, প্রায় সারা দেশ জুড়ে দুর্নীতি যখন একটি অন্যতম বৃহৎ ও জ্বলন্ত সমস্যা, তখন এমন একটি পদক্ষেপ এই বার্তাই দেয় যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক প্রবণতা দেশ জুড়ে ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। এর নজির আমরা আগেই দিল্লির রাজ্য সরকারের কার্যক্রমে পেয়েছি। পঞ্জাবেও নতুন সরকার শপথ নেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত মান একটি মোবাইল নং চালু করে সকলকে যে কোনও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা চালু করেছেন। অথচ এ রাজ্যে চিত্রটা সম্পূর্ণ উলটো। আদালতের নির্দেশে প্রতিমন্ত্রীর মেয়ের যখন বেআইনি চাকরিটি খোয়া গেছে এবং তিনি নিজেও অভিযুক্ত ও বিচারপতি রঞ্জিত বাগের তদন্ত রিপোর্টে তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়মের তথ্য নথিবদ্ধ হয়েছে, তখন দেখা গেল, তিনি তাঁর শহর কোচবিহারে ফিরে গেলে তাঁকে তাঁর দল ধুমধাম করে সম্বর্ধনা দিচ্ছে। এত কিছুর পরেও এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, এ রাজ্যে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের সম্ভবত একটি সামাজিক গ্রাহ্যতা তৈরি হয়েছে।

দুর্নীতি কি আসলে এক ধরনের সন্ত্রাস? অবশ্যই তাই। দুর্নীতি যখন সমাজে নিয়ম হয়ে যায়, তখন তা অতি অবশ্যই যোগ্যতা, মেধা, অধিকার, নাগরিকত্ব, মানবাধিকার এবং সর্বোপরি জীবনের অধিকারকে লঙ্ঘন করে। এটা করা হয় অর্থের জোরে, বলপ্রয়োগে অথবা ক্ষমতার অপব্যবহারে। আমাদের রাজ্য কি এমনতর ব্যবস্থাপনায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে? অর্থাৎ, এমনটাই চলবে? কাজ হাসিল করতে হলে অথবা স্বার্থসিদ্ধির জন্য দুর্নীতি ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা কি আর নেই? আর এই দুর্নীতি যেহেতু নিজেই এক ধরনের অর্থ-সন্ত্রাস, তাই অন্যান্য সন্ত্রাসের যৌক্তিকতাও অতএব মান্যতা পেয়ে যায়, কারণ, প্রতিটি সন্ত্রাস পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত ও একে অপরের জন্য অপরিহার্য; আর এই পরম্পরা আমাদের রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে বহমান। এ প্রসঙ্গে একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন আমাকে বহুদিন ভাবিয়েছে। ভারতের কোনও রাজ্যে তো নির্বাচনী হিংসা হয় না! তা শুধু এ রাজ্যেই হয় কেন (যদিও ত্রিপুরাতেও হয়, অনেকটা পশ্চিমবঙ্গের মতো বাঙালি-প্রধান রাজ্য হওয়ার কারণে)? এবং তা বহুদিন ধরেই। অর্থাৎ, তাহলে কি যে কোনও কারণেই হোক, ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা ও সন্ত্রাস আমাদের জনসমাজের বড় এক অংশের মননে পাকাপাকি ভাবে বসত গেড়ে রয়েছে? আর এই সন্ত্রাসের বাধ্যবাধকতাতেই কি দুর্নীতির অবাধ ও সংগঠিত চক্র সাবলীল ও অনুমোদিত গতিতে এখানে ক্রিয়াশীল? কারণ, যে কোনও সন্ত্রাসের সঙ্গেই অর্থের সম্পর্কটি প্রগাঢ় ভাবে যুক্ত।

মোটামুটি ভাবে দেখা যাবে, সরকারি ও আধা-সরকারি চাকরি, ঋণ, হাসপাতালে ভর্তি, কলেজে ভর্তি, দোকানঘর, সরকারি টেন্ডার, সরকারি প্রকল্পের সুবিধা ইত্যাদি আদায় করতে দুর্নীতির এক বিস্তৃত চক্র কাজ করে। যদিও গত দু-তিন বছরে ‘দুয়ারে সরকার’ বা ‘পাড়ায় সমাধান’ ধরনের উদ্যোগ মারফত একটা চেষ্টা চলেছে কিছু কিছু সুযোগ-সুবিধাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবার। এতে হয়তো কিছু সুরাহা হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে যেহেতু সরকারি চাকরির সুযোগ এ রাজ্যে কম, তাই বহুজনের চেষ্টা থাকে যে করে হোক একটা সরকারি কাজ বাগিয়ে নেওয়ার। নিরাপত্তা ও সময়ে বেতন প্রাপ্তির কারণেই এক বড় অংশের মানুষের এই চাকরির প্রতি দুর্বলতা। আর সেখানেই দুর্নীতির সব থেকে বড় বাস্তুঘুঘুর বাসা। আর এর জন্য প্রয়োজনে মোটা টাকা বিনিয়োগ করতেও অনেকেই রাজী, যদি সোজা পথে তা না জোটে। রাজী এই কারণে যে, যোগ্যতা না থাকলেও এমন পাকা চাকরি স্রেফ অর্থের বিনিময়ে লব্ধ হতে পারে- এর থেকে সহজতর পথ আর কী! অর্থ, ক্ষমতা ও সন্ত্রাসের এ এক অশুভ পরিণয়। আর এই পরিণয়ের অবয়বটা নির্মিত হয় এক বিস্তৃত চক্রজালের মাধ্যমে।

দীর্ঘদিন ধরে এসএসসি কর্মপ্রার্থীদের লাগাতার আন্দোলন, প্যানেল ভুক্ত হয়েও বেনিয়মের কারণে সেখান থেকে ছিটকে যাওয়া ববিতা সরকারের মামলা, প্রাক্তন বিচারপতি রঞ্জিত বাগের প্রায় ১৫০০ পাতার তদন্ত রিপোর্ট, আদালত কক্ষে দাঁড়িয়ে এসএসসি’র বিদায়ী চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদারের পেশ করা বিতর্কিত প্রার্থীদের প্রাপ্ত নম্বরের উল্লেখ, বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের আপসহীন নির্দেশ- এই সমস্ত মিলে উইয়ের ঢিপির মতো মজবুত সেই দুর্নীতি চক্রে মস্ত আঘাত পড়েছে। হ্যাঁ, আঘাতটা মস্ত ও সুবিপুল, এই কারণেই যে, এর ফলে টাকা খাইয়ে ইতোমধ্যে নিযুক্ত কয়েকশো 'শিক্ষাকর্মী'র (অঙ্কিতা অধিকারীর মতো) চাকরি এবার যেতে বসেছে। প্রশ্ন উঠছে, তারা ওই চাকরি জোটাতে যে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছিল, তার এবার কী হবে। সম্ভবত, এমন একটি পিছুযায়ী অভিঘাতের তরঙ্গ তৈরি হবে যার ফলে ওই চক্রে সামিল প্রায় সকলেরই নাড়ি ধরে টান উঠবে। আর সে হবে ভয়ঙ্কর!

তবে মুশকিল হল, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস যদি আমাদের যাপনে কয়েক দশকের কঠিন অভ্যাস ও পরম্পরার অঙ্গ হয়ে থাকে, তাহলে ওই পিছুযায়ী অভিঘাতের তরঙ্গ দৃশ্যত খুব সুদূরপ্রাসারী নাও হতে পারে। চারপাশে তাকালে, নিয়মিত স্কুলের পাশাপাশি, রীতিমতো আরও বেশি অর্থ ব্যয় করে, সমান্তরাল স্কুলের দৌরাত্ম যখন ঘোর বাস্তব, সরকারি দফতরে পাওনা কাজ আদায় করতে গেলে ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ যখন নিত্য দস্তুর, আদালতে বিচারপতির কক্ষে মামলা ওঠাতে গেলে যখন ‘ঢাকের দায়ে মনসা বিকোয়’ অবস্থা, তখন স্বাভাবিক যে, সুরক্ষিত চাকরি পেতে গেলেও ‘দেখলে হবে খরচা আছে’ নীতিতেই তা কার্যকর হবে। দাতা এবং গ্রহীতা- উভয়েই যদি উর্ধ্বতন শাসকের মদতে এমন একটি বিধিব্যস্থা নিজেরা কায়েম করে তাকে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে সমাজে জনপ্রিয় করে তুলতে পারে, তাহলে এর বিরোধিতা করার জন্য তো অল্প সংখ্যক যোগ্যতর মানুষেরাই পড়ে থাকে! তাদের কথায় আমল দেওয়ার কি আর তেমন প্রয়োজন থাকে?

আমাদের দেশের অবস্থা কতকটা তাই। এ রাজ্যেরও। যখন আমরা বলি, একটা ব্যবস্থা পচে গেছে, তখন তার অর্থ হল, সেই ব্যবস্থাটি আর চলছে না। যদি টাকার জোরে শিক্ষায় পর্যদুস্ত লোকেরা শিক্ষক হয়, হাতুড়ে লোকেরা চিকিৎসক হয়, অদক্ষ লোকেরা প্রযুক্তিবিদ হয়, তাহলে সে দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকের কর্মদক্ষতা কেমনতর হবে তাতে কি আর কোনও সন্দেহ থাকে? এ এক ভয়ঙ্কর অপরাধ। আর এর শিকার হন সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষেরাই, যারা অর্থের অভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কার্যকরী শিক্ষা বা চিকিৎসা পেতে অক্ষম। তাই, আখেরে আমরা সকলেই বিপন্ন। যিনি টাকার বিনিময়ে কিছু জুটিয়ে নিয়েছেন, তিনিও। কারণ, তিনিও এই অন্যায্য, নিষ্ঠুর ব্যবস্থার শিকার, অন্যত্র।

 

Wednesday, 18 May 2022

পরিবেশ-প্রভাব মূল্যায়নের রিপোর্ট কই?

দেওচা-পাঁচামির প্রস্তাবিত কয়লাখনি কি আদৌ বাস্তবোচিত 

শশাঙ্ক দেব

 

রাজ্যের অর্থনীতিতে উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানের সম্প্রসারণ হোক, সবাই চায়। দায়িত্বশীল নাগরিক অবশ্যই চায় রাজ্যে নতুন নতুন শিল্প ও প্রকল্প গড়ে উঠুক এবং রাজ্যবাসীর জীবনমানের উন্নতি ঘটুক। আবার একই সঙ্গে আমাদের বোঝা উচিত, যে ধরনের প্রকল্প পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে, সেগুলি সম্পর্কে সতর্ক পদক্ষেপ নেবার দরকার আছে। ক্ষতির সম্ভাবনা মাত্রাধিক হলে, সেই শিল্প না করাই যুক্তিযুক্ত। কারণ, সেই ধরনের প্রকল্পগুলি কিছু মানুষ বা গোষ্ঠীর সুবিধা করে দিলেও অথবা তাৎক্ষণিক কিছু কর্মসংস্থান তৈরি করলেও, শেষ পর্যন্ত তা শুধু পরিবেশের ক্ষতি করে না, সাধারণ মানুষের সার্বিকভাবে আর্থিক ও জীবনমানের ক্ষতি হয়; এবং যার মূল্য নির্ধারণ করা যায় না সেই জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। বর্তমানে যাঁরা ক্ষমতায় রয়েছেন তাঁরাও এক সময়ে বেশ কিছু কর্মসংস্থান হবে জেনেও উপকূল অঞ্চলের জল, জমি এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতির কথা ভেবে নয়াচরে কেমিক্যাল হাব প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন।

বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা জেনেছি, বীরভূমের মহম্মদবাজার ব্লকের দেওচা-পাঁচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙ্গা কয়লা ব্লকে ১৩.৭ বর্গ কিলোমিটার (৩৪০০ একর) অঞ্চল জুড়ে এশিয়ার বৃহত্তম এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা ব্লকে খনি চালু হতে চলেছে। দেশের বিভিন্ন কয়লা খনি কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা কোল ইন্ডিয়ার সরাসরি মালিকানা এবং পরিচালনায় থাকলেও, এই বৃহত্তম কয়লা ব্লকের মালিকানা কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড (CIL) প্রথমে পাঁচটি রাজ্যের জন্য বরাদ্দ করেছিল কিন্তু বাকিদের উৎসাহ না থাকায় সম্পূর্ণ কোল ব্লকটি এখন পশ্চিমবঙ্গের জন্য বরাদ্দ হয়েছে। প্রাসঙ্গিক সমস্ত সংবাদে প্রকাশ যে, ভূতাত্ত্বিক প্রতিবন্ধকতার জন্যই কোল ইন্ডিয়া এবং যাদের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল সেই রাজ্যগুলি, এই খনির ভাগ নিতে রাজী হয়নি। এই অবস্থায় ওয়েস্ট বেঙ্গল পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (WBPDCL) এই কয়লাখনি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। জানা গেছে, এখানে মাটির নীচে রয়েছে প্রায় ২১০ কোটি টন কয়লা আর তার উপরে প্রায় সমান পরিমাণ ব্যাসাল্ট পাথর। এই এলাকায় রয়েছে সরকারি দফতরের জমি, খাস জমি, ব্যক্তিগত মালিকানা ও পাট্টায় দেওয়া জমি এবং বনাঞ্চল। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে যে প্রস্তাবিত খনি অঞ্চলের বেশির ভাগ জমি আদিবাসীদের। ১১,২২২ একর জমির মধ্যে ৯১০০ একর জমি আদিবাসীদের দখলে আছে। সরকারি সমীক্ষা অনুযায়ী, ৩০১০টি পরিবার এই খনি অঞ্চলে বাস করে যার মধ্যে ১০১৩টি আদিবাসী পরিবার। আরও ১০৩৮টি পরিবারের জমি এই খনি অঞ্চলের মধ্যে আছে। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা অনেক বেশি।

এরকম কিছু কিছু তথ্য বিভিন্ন সূত্রে জানা গেলেও প্রস্তাবিত খনি সম্পর্কে কিন্তু আরও বেশ কিছু তথ্য নির্দিষ্টভাবে জানা যাচ্ছে না। এই খনিতে কয়লা কত নীচে আছে, ব্যাসাল্ট পাথরের আচ্ছাদন ভেঙ্গে কয়লা তুলতে কত সময় লাগবে, কয়লার মান কেমন হবে, সেগুলি কতটা কাজে বা ব্যবসায়ে লাগবে, কী প্রযুক্তি হবে, প্রযুক্তি কারা দেবে, দেশিয় প্রযুক্তি উপযুক্ত ও লাভজনক হবে কিনা, না হলে বিদেশি প্রযুক্তি পাওয়া যাবে কিনা– এসব কিছুই জানা নেই।

এই এলাকায় সরকারি হিসাবে ইতিমধ্যেই ৯-১০টি পাথর খাদান ও ২৮৫টি স্টোন ক্রাশার ইউনিট চালু আছে। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা প্রায় চার গুন এবং তার তিন ভাগের কোনও রেজিস্ট্রেশন নেই, বেআইনি ভাবে চলছে। পাথর খাদান ছাড়াও মহম্মদবাজার, দুবরাজপুর অঞ্চলে অনেকগুলি ইউনিট থেকে কয়লা উত্তোলন হয় যার অধিকাংশই বেআইনি। বার বার তদন্তে দেখা গেছে যে এই অঞ্চলের স্পঞ্জ আয়রন এবং ফেরো অ্যালয় কারখানাগুলির অধিকাংশই চলে এই সব বেআইনি কয়লা ব্যবহার করে। এই অঞ্চলের মানুষ, বিশেষত এই সব খনি, খাদান এবং ক্রাশার’এ কাজ করা কর্মীদের অনেকেই সিলিকোসিস, নিউমনোকোসিস ইত্যাদি অসুখে মৃতপ্রায়।         

পরিবেশপ্রেমী হিসাবে আমাদের বিশেষ ভাবে চিন্তা, এই খনি চালু হলে পরিবেশের উপর তার কী এবং কতটা প্রভাব পড়বে, কীভাবে তার ব্যবস্থাপনা হবে, তা নিয়ে জনসমক্ষে কোথাও কোনও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। কোনও বৃহৎ প্রকল্প, বিশেষ করে লাল ক্যাটেগরি প্রকল্প হলে প্রথমেই তার পরিবেশে প্রভাব নিয়ে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। এখানে তেমন কিছুর অস্তিত্ব আমরা জানতে পারিনি। এমনকি কোথাও সরকারি ঘোষণায়, ওয়েবসাইটে, বিবৃতিতে এই প্রকল্পের বিশদ বিবরণ এবং পরিবেশের ওপর প্রভাব নিয়ে মূল্যায়নের যে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে– এমন কোনও উল্লেখ পর্যন্ত নেই। অথচ ইতিমধ্যেই জমি সংগ্রহ শুরু হয়ে গেছে, ক্ষতিপূরণের রূপরেখা বেসরকারি ভাবে ঘোষিত হয়েছে, চাকরির ফর্ম বিলি হচ্ছে, সরকারি ভাবে তা নিয়ে প্রকল্পের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের বোঝানোর জন্য কমিটি তৈরি হয়েছে, কমিটির কাজ শুরু হয়ে গেছে।

মূলত পরিবেশ বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে, সবুজ মঞ্চ’র পক্ষ থেকে আমরা গত ২২ ফেব্রুয়ারি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম-

Ø  এই প্রকল্পের জন্য বিশদ প্রোজেক্ট রিপোর্ট (Detailed Project Report-DPR) তৈরি হয়েছে কী? যদি এই রিপোর্ট তৈরি হয়ে থাকে, কীভাবে তা জনসমক্ষে পাওয়া যাবে? যদি না হয়ে থাকে, কবে এই রিপোর্ট তৈরি হবে?

Ø  যদি বিশদ প্রোজেক্ট রিপোর্ট না হয়ে থাকে, প্রোজেক্টের মৌলিক কাজগুলি শুরু করা হচ্ছে কীভাবে?

Ø  পরিবেশের উপর এই প্রকল্পের কী প্রভাব পড়বে, তার মূল্যায়ন (Environmental Impact Assessment – EIA) যা এই ধরনের বৃহৎ প্রকল্পের পক্ষে বাধ্যতামূলক, তা করা হয়েছে কী? যদি হয়ে থাকে, কীভাবে তা জনসমক্ষে পাওয়া যাবে?

Ø  পরিবেশ মূল্যায়ন (Environmental Impact Assessment – EIA) করার জন্য কোনও নিরপেক্ষ সংস্থা নিয়োগ করা হবে কী?    

Ø  এই ধরনের প্রকল্পের জন্য বিশদ পরিকল্পনা জনসমক্ষে এনে, স্থানীয় মানুষের মতামত জানার জন্য কোনও জন শুনানির (Public Hearing) আয়োজন করা হয়েছে কী? 

এখনও কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে বিভিন্ন পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং সমাজকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে আমাদের ধারণা হয়েছে- 

Ø  এই প্রকল্প চালু করতে হলে, বিপুল পরিমাণ বনাঞ্চল ধ্বংস করতে হবে। বিশাল এলাকায় পাথর ভাঙ্গা এবং কয়লা উত্তোলন চালু হলে এই বনাঞ্চলের ক্ষতিপূরণের কোনও সম্ভাবনা নেই।

Ø  এই এলাকায় ভূগর্ভের এবং ভূপৃষ্ঠের জলসম্পদের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হবে। এই এলাকা এমনিতেই খরাপ্রবণ। খনি চালু হলে জলসম্পদের যে ব্যবহার হবে তা পরিপূরণের সুযোগ নেই।

Ø  খনি চালু হলে এই এলাকা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের নদীগুলির নাব্যতা ও প্রাকৃতিক জলাশয়গুলির জলের উৎসগুলির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।

Ø  যতদূর জানা গেছে, এই অঞ্চলে খোলামুখ খনি থেকে কয়লা উত্তোলন হবে। এই পদ্ধতি ভয়াবহ দূষণ সৃষ্টি করবে।

Ø  যে বিপুল পরিমাণ ব্যাসাল্ট পাথরের আচ্ছাদন কয়লার উপরে রয়েছে, কয়লা পেতে হলে আগে তা তুলতে হবে। যে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ব্যবহার করা হবে, তার মারাত্মক প্রভাব তৈরি হবে। পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি, ঘরবাড়ি বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

Ø  জানা গেছে, সরকারি ভাবে স্বীকৃত ২৮৫টি ক্রাশার ইউনিটকে ব্যাসাল্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে বিনামূল্যে জায়গা দিয়ে স্থানান্তর করা হবে। অর্থাৎ, কয়লা খনি চালু হবার পরেও এই দূষণ সৃষ্টিকারী ক্রাশারগুলি শুধু চালু থাকবে না, এমন ধরনের সরকারি ক্ষতিপূরণ পাবে, যে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হলে বিপুল পরিমাণে অতিরিক্ত পাথর ভাঙ্গতে হবে এবং পরিবহন করতে হবে। এর ফলে স্বভাবতই অতিরিক্ত পরিবেশ দূষণ ঘটবে।  

Ø  যে বিপুল পরিমাণ সাধারণ এবং বিপজ্জনক আবর্জনা তৈরি হবে, তার ব্যবস্থাপনা তৈরির কোনও পরিকল্পনা করা হয়নি।

Ø  এই খনি চালু হলে, এই বিস্তীর্ণ এলাকার জীববৈচিত্রের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। পশু, পাখি, মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হবে।

Ø  এই খনি চালু হলে ঐ এলাকার সাধারণ মানুষ এবং বিশেষ ভাবে বয়স্ক এবং শিশুদের স্বাস্থ্যর উপরে খুবই ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলবে। 

Ø  প্রকল্পের জন্য যে ব্যাপক উচ্ছেদ হবে, তার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে।

আর একটি বিষয় আমাদের উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলছে। বিষয়টি শেষে উত্থাপন করলেও তার গুরুত্ব কোনও অংশে কম নয়। বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সারা পৃথিবীতে আজ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ক্রমশ কমানোর কথা হচ্ছে, প্রতিটি দেশ তাদের কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করছে, প্রতিটি সরকার কীভাবে এই জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা করা যায়, তার দীর্ঘ এবং স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করছে। সম্প্রতি গ্লাসগোর কনফারেন্স অব পার্টিজ-এর ২৬তম সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে ১০টি তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পর প্রস্তাব বাতিল হয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানির প্রকল্পে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ক্রমশ দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাচ্ছে।  

এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক আর একটি প্রশ্ন হল, পশ্চিমবঙ্গে পুনর্নবীকরণযোগ্য বিদ্যুৎ শক্তির প্রকল্প তৈরি এবং বাড়ানোর জন্য রাজ্যে পরিকল্পনা অস্পষ্ট। এক সময়ে পুনর্নবীকরণযোগ্য বিদ্যুৎ শক্তির উৎপাদনে ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের যে অগ্রণী স্থান ছিল তা এখন অনেক পিছিয়ে পড়েছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, দেওচা-পাঁচামির এই কয়লাখনির প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের পরিবর্তে পুনর্নবীকরণযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে ও পরিকল্পনা করে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করতে পারলে তা রাজ্যবাসীর পক্ষে অনেক ভাল হত, বিশ্ব উষ্ণায়ন রোধে সাহায্য করত এবং রাজ্যর ভাবমুর্তি অনেক উজ্জ্বল হত।


Monday, 16 May 2022

দেশদ্রোহ আইন স্থগিত

কিন্তু না আঁচালে বিশ্বাস নেই

প্রবুদ্ধ বাগচী


 

বছর তিনেক আগে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ‘ঐতিহাসিক’ রায় দিয়ে রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে দেনযে বিরোধের সূচনা হয়েছিল কয়েক দশক আগে, যা নিয়ে সারা দেশে প্রচুর গোলমাল হয়েছে, উত্তেজনা দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে, তার সমাধান যে এইভাবে হয়ে যেতে পারে তা অনেকেই ভাবতে পারেননিএই বিস্ময়ের প্রধান কারণ, এই দ্বন্দ্ব আসলে সুচতুরভাবে তৈরি করা হয়েছিল একটা ‘বিশ্বাস’কে ভিত্তি করে, যে বিশ্বাসকে আদৌ কোনও আইনের সঙ্গে ন্যায্যতার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায় নাকিন্তু দশক পেরিয়ে আসা মামলার এই জাদু সমাধান যে হতে পারল তার কারণ স্বয়ং প্রধান বিচারপতির ওই বিশ্বাস যে, রামচন্দ্র ওইখানেই জন্মেছিলেন, তাই এটাকে আইনের কাঠামোর মধ্যে স্বীকৃতি দিয়ে দিলেন

ভারতীয় বিচারব্যবস্থা এর আগে এমন কোনও ‘আজগুবি’ বিচার দেখেছে বলে মনে হয় নাদেশের সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির একটা মর্যাদা আছে, সেই পবিত্র মর্যাদা রক্ষা করার দায় একেবারেই তাঁরএ ক্ষেত্রেও তেমন একটা ব্যতিক্রম ঘটে গেলরামমন্দির বানানোর ছাড়পত্র হাতে পেয়ে মন্দিরপন্থীরা যখন আহ্লাদে আটখানা ঠিক তখনই সেই বিচারপতি অবসর নিলেন আর ছ’ মাসের মধ্যে রাজ্যসভায় সাংসদ নির্বাচিত হলেন ওই মন্দিরপন্থীদের ভোটেদেশের সর্বোচ্চ আদালতের এমন নড়বড়ে অবস্থান এর আগে ভারতের গণতন্ত্র প্রত্যক্ষ করেনি

একসঙ্গে সব মানুষ তো নিজেদের বিকিয়ে দিতে পারেন না বা দেনও নারামমন্দির নিয়ে আদালতের রায়ে দেশের বিচারব্যবস্থার সঙ্গে যারা যুক্ত তাঁরা কমবেশি তাঁদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেনকেউ কেউ চুপ ছিলেনএর পরেও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার নানা গড়িমসি করেছে, কারও নাম কেটে দিয়েছে, কাউকে জুড়ে দিয়েছেঅভিসন্ধি খুব স্পষ্টতবুও, দেশের বর্তমান প্রধান বিচারপতি অনেকদিন পরে নিজস্ব একটা ব্যক্তিত্ব ও কণ্ঠস্বর দিয়ে ওই গ্লানিময় অতীতের আবর্জনা কিছুটা সরাবার চেষ্টা করেছেনদেশদ্রোহ বিষয়ক আইন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান এবার অনেকটা ইতিবাচকপ্রাক-স্বাধীনতা যুগের একটি ঔপনিবেশিক আইনের ধারা কেন আজকের স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে থাকবে এবং তা বারবার ব্যবহৃত হবে এই প্রশ্ন একদম সঙ্গত

বিষয়টা আরও গুরুত্ব পায় এই কারণে যে, ভারতীয় পেনাল কোড তৈরি করার সময় এইসব আইন বাতিল না করা হলেও এবং তার প্রয়োগ অন্যায্য হলেও ছিল সীমিতকিন্তু গত দশ বছরে কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্যে রাজ্যে তাদের ধামাধরা রাজ্য সরকারগুলি প্রায় নির্বিচারে এই আইন প্রয়োগ করে সাধারণ নাগরিক থেকে সমাজকর্মী, সংবাদকর্মীদের জীবন বিড়ম্বিত করে তুলেছেএমন সব তুচ্ছ কারণে এই আইন প্রয়োগ করা হয়েছে যাতে প্রশাসনের প্রতিহিংসার কদাকার মুখ বারবার ফুটে বেরয়এই পরিস্থিতি নাগরিক অধিকার রক্ষার পরিপন্থী এবং বলাই বাহুল্য, এই ধরনের নিবর্তন সাংবিধানিক ভাবে অনুমোদিত নয়কিন্তু এ কথা বলবে কে?

আরও উল্লেখযোগ্য তথ্য হল, আজ অবধি যত মানুষকে এই দেশদ্রোহ ধারায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তদন্ত করে তাঁদের বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া গেছে একেবারে হাতে গোনা কয়েকজনের ক্ষেত্রে, তাও এখনও তাঁদের বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়নিবুঝতে পারা যায়, ‘দেশরক্ষা’র অজুহাতে আসলে দেশের নাগরিকের অধিকার হরণ করারই এ এক কূট ছলমাত্রমজার ব্যাপার হল, আজকের বিশ্বায়িত ভুবনে খুব চুপি চুপি কিছু করে ফেলা বেশ সমস্যারসাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার নিরিখে ভারত যে গ্লোবাল ইন্ডেক্সে বেশ কিছুটা নেমে এসেছে এই খবর একেবারে সাম্প্রতিকএটাও তো তাহলে দেশের অবস্থানের নিরিখে একরকমের 'মুখ পোড়া'- তাহলে এই পরিস্থিতির কারিগররাও কি ‘দেশদ্রোহী’ নন, এদের পেছনেও তো তাহলে ১২৪ নম্বর ধারার ছুঁচোবাজি লাগিয়ে দেওয়া উচিত!

এই পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের একটা অবস্থান এইরকম যে, এই আইনের পুনরায় মূল্যায়ন ও সংস্কার দরকারঠিককিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। কেন্দ্রীয় আইন বিভাগ মুখে বলছে এই আইনের পুনর্বিবেচনা তারা করবে, কিন্তু বললেই তা কার্যকর করা তত সহজ নয়অবশ্য তাই বা বলি কেমন করে? করোনা কালে নামমাত্র সংসদ খোলা রেখে একের পর এক আইন পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে কোনও আলোচনা না করেইযে তিনটি কৃষি আইন নিয়ে সারা দেশ পরাক্রমশালী এক আন্দোলন দেখল তারও প্রস্তাবনা ও প্রবর্তনা ঘটেছিল এই পথেইএমনি ভাবেই আধার কার্ড সংক্রান্ত আইন রাজ্যসভায় অনুমোদন করানো যাবে না বিবেচনা করে নজিরবিহীন ভাবে সেটাকে অর্থ বিলের মর্যাদা দিয়ে কৌশলে পাশ করানো হয়েছিল সংসদেআবার গত নভেম্বরে (২০২১) কৃষি আইন বাতিল করার প্রকাশ্য ঘোষণা হলেও আজ পর্যন্ত সরকার সেই বিষয়ে 'রা কাড়েনি। কাজেই সবটাই ইচ্ছে, বলা ভাল রাজনৈতিক ইচ্ছের বিষয়।

আর এই রাজনৈতিক ইচ্ছের কথাই যদি বলতে হয় তাহলে এটা খুব পরিষ্কার, বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসক দল যে মনোভঙ্গিমা বা ভাবনার অনুবর্তী, তাতে তাদের এই ‘দেশদ্রোহ’ বিষয়ক আইন নিয়ে খুব বেশি নড়েচড়ে বসার ইচ্ছে থাকা সম্ভব নয়স্বাভাবিক, তারা দেশ জাতি সম্প্রদায় নিয়ে যে একমুখি কেন্দ্রীয় মতাদর্শের দাবিদার তার মধ্যে আমাদের দেশের বিপুল বৈচিত্র্যের কোনও পরিসর নেইএক ধর্ম এক ভাষা এক দেশ- এই হল তাদের কাঙ্ক্ষিত ভারতভূমিকিন্তু এই চাপিয়ে দেওয়া ‘দেশ’ ভাবনা সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য নয় সেটাও তারা বোঝে, তাই সরকারিভাবে ‘দেশ’এর সংজ্ঞার যারা বিপরীত ভাববেন তাদের বুঝিয়ে দেওয়া দরকার আসলে ‘কেষ্ট কেমন ঠাকুর’! তাই এই আইন, তাই তার এমন অবাধ প্রয়োগ!

সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রের সরকারের কাছে যে প্রস্তাব রেখেছে তাতে তারা বলতে চায়, যতদিন না এই আইনের সংস্কার হয় ততদিন এর আওতায় এফআইআর করা মুলতুবি থাকুকসাধু প্রস্তাব! সুপ্রিম কোর্ট আইন তৈরি বা তার সংস্কার করার এক্তিয়ার রাখে না কিন্তু আইন নিয়ে সুচিন্তিত মন্তব্য বা রায় দিতে পারেএর বিপরীতে কেন্দ্রীয় প্রভুদের প্রতিক্রিয়া খুব সজীব নয়তারা কত দিনে শীতঘুম থেকে জাগবেন বা আদৌ জাগবেন কিনা তা কোটি টাকার প্রশ্নকিন্তু সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনাপ্রবাহে সুপ্রিম কোর্ট যে নিজেদের মর্যাদা পুনরুদ্ধারের একটা সচেতন প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে এটা শুভ ইঙ্গিতযদিও স্বতন্ত্র মর্যাদা থাকলেও সুপ্রিম কোর্টকেও বহুলাংশে এখনও কেন্দ্রীয় আইন বিভাগের ওপর নির্ভর করতে হয়তাই পাশাপাশি সংশয় এসে জড়িয়ে ধরেসত্যিই না আঁচালে বিশ্বাস নেই!

 

Saturday, 14 May 2022

পেডাগজি অফ দ্য অপ্রেসড?

সরকারি বিদ্যালয়ে দিল্লি সরকারের অভাবনীয় সংস্কার

সোমেন চক্রবর্তী


স্বাধীনতার ৫৫ বছর বাদে ২০০২ সালে ৮৬তম সংবিধান সংশোধনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হয়েছিল। মৌলিক অধিকারে ২১এ ধারা যুক্ত করা হয়, যেখানে বলা হয় যে রাষ্ট্র আইন অনুযায়ী ৬-১৪ বছর পর্যন্ত সমস্ত শিশুর অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করবে। সাথে সাথে ওই একই সংশোধনীতে রাষ্ট্রের কর্মপদ্ধতির নির্দেশক নীতিসমূহের ৪৫ ধারাতে বলা হয় যে ছয় বছর পর্যন্ত সমস্ত শিশুর জন্য রাষ্ট্র শৈশবকালীন যত্ন ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে বাধ্য থাকবে। এরই সাথে নাগরিকের মৌলিক কর্তব্যের বিভাগে ৫১এ ধারায় যুক্ত করা হয় যে ৬-১৪ বছরের শিশুর যেন অবশ্যই শিক্ষার সুযোগ প্রাপ্তি ঘটে, বাবা-মা বা অভিভাবক তা নিশ্চিত করবেন।

এর কয়েক বছর বাদে ২০০৯ সালে প্রণীত শিশুদের অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা আইনের (The Right of Children to Free and Compulsory Education Act, 2009 ) ৩ নম্বর ধারায় আরও স্পষ্ট করে বলা হল যে, প্রতিবেশী কোনও বিদ্যালয়ে প্রতিটি শিশুর শিক্ষার ব্যবস্থা যেন অবশ্যই করা হয়। এক ধাপ এগিয়ে ধারা ৪এ আরও বলা হল, যদি কোনওরকম বাধা বিপত্তির জন্য কোনও শিশু সময়মতো স্কুলে ভর্তি হতে না পারে, সে ক্ষেত্রে বয়স অনুপাতে সে নির্দিষ্ট ক্লাসে পরেও ভর্তি হতে পারবে। বয়সের প্রমাণপত্র দাখিল কোনও অবস্থাতেই বাধ্যতামূলক করা যাবে না।

কোন শিক্ষার কথা বলা হচ্ছে এখানে? ২০০৯'এর শিক্ষা আইনে পরিষ্কার বলা আছে যে শুধুমাত্র পুঁথিগত শিক্ষা নয় বরং শিশুর সর্বাঙ্গীন বিকাশই হবে শিক্ষার লক্ষ্য। নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০'তেও এই ভাবধারাটি প্রতিফলিত হয়েছে। সুতরাং, পাঠ্যপুস্তক নির্ভর শিক্ষা যেমন থাকবে তেমনি খেলাধুলো মায় সবরকমের সৃষ্টিশীল কার্যক্রমের সঙ্গে তাকে যুক্ত করতে হবে। এইখানে এটুকুই বলা যায় যে, নীতি রূপায়ণ এবং আইন প্রণয়নের নিরিখে প্রাথমিক শিক্ষা এবং শৈশব বিকাশের জন্য যা প্রয়োজন সে ব্যাপারে আমাদের দেশের পরিকল্পনাকারীরা তেমন খামতি রাখেননি।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই নীতি রূপায়নে সরকারি বিদ্যালয়ের অবদান কতখানি। পরিসংখ্যানে গিয়ে লাভ নেই, কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাস্তবের সঙ্গে তার কোনও মিল থাকে না। তবু তারই মধ্যে কোথাও কোথাও সরকারি বিদ্যালয় অত্যন্ত ভালোভাবে শিক্ষা দেবার প্রচেষ্টা চালায়। তবে তা ব্যতিক্রম মাত্র। যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোয় যে সফলতা সরকারি উদ্যোগে আসার কথা ছিল, বাস্তব ক্ষেত্রে তা কিন্তু বিপুলভাবে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টাতেই সম্ভব হতে পেরেছে। বিপরীতে, এটা মেনে নিতে আপত্তি থাকার কথা নয় যে সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষার মান ক্রমাগত নিম্নমুখি হয়েছে এবং কমবেশি মাত্রায় সব রাজ্যেই এ এক বাস্তব সত্য।

এর ফলে ভারতবর্ষের স্কুল শিক্ষা কতকগুলো কঠিন সত্যের মুখোমুখি হয়েছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে,  স্কুলবাড়িগুলি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভগ্ন দশাগ্রস্ত। স্কুলে হয় টয়লেট অনুপস্থিত অথবা তা ব্যবহারযোগ্য নয়। শিক্ষকদের পড়ানোর মান এবং দক্ষতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। বিদ্যালয়ের পরিবেশ এবং শিক্ষা প্রক্রিয়া না ছাত্র, না শিক্ষক, না প্রশাসন, না অভিভাবক- কাউকেই উদ্বুদ্ধ করে না। সময়মতো ভর্তি হলেও পরবর্তীতে ছাত্রছাত্রীদের এক বড় অংশ স্কুল ছেড়ে দেয়।  দলিত, আদিবাসী, গরিব এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিশুদের প্রতি বৈষম্য ও অবিচার আকছার ঘটছে। প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য কোনও বিশেষ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। আজকের এই উত্তর-আধুনিক সমাজেও ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখা হয় ছাত্রছাত্রীদের। ফলে, স্কুল বা শিক্ষার প্রতি তাদের আকর্ষণ কমে বই বাড়ে না। হাজার হাজার এমন প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে যেখানে মাত্র একজন শিক্ষক কয়েকশো ছাত্র-ছাত্রীদের একমাত্র আশাভরসা হয়ে টিঁকে আছেন।

স্কুল শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে গেলে কাঠমোগত পরিবৰ্তন অবশ্যম্ভাবী। অর্থাৎ, পড়ুয়ারা স্কুল বা শ্রেণিকক্ষ দেখে যেন আকর্ষিত হয়। সেখানে প্রয়োজনীয় সুবিধাগুলো যেন উপলব্ধ হয়। একটা প্রশস্ত অঙ্গন, পরিচ্ছন্ন বিদ্যালয় ভবন, সাজানোগোছানো শ্রেণিকক্ষ না হলে কোনও শৈশবই সেখানে দিনের পর দিন হাত-পা ছড়িয়ে বা উদ্বাহু হয়ে নেচেকুঁদে সময় কাটাতে চাইবে না। এই পরিবেশটাই শৈশব সবার প্রথমে আশা করে এবং তার সাথে পাঠ্যপুস্তক নিঃসৃত জ্ঞানার্জন। সে কারণে দরকার নিয়মিতভাবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ। পড়ানোর দক্ষতার দিকেও নজর দেওয়াটা বিশেষ জরুরি। পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও বাজারমুখি দক্ষতাগুলির বিকাশ বিশেষ প্রয়োজন। শুধু ক্লাসরুম বা অফিস ঘর নয়, বিজ্ঞানের ল্যাব এবং পাঠাগার অবশ্যই থাকতে হবে। ছাত্রদের যেন এই বিশ্বাস জন্মায় যে তাদের বিকাশের জন্য একটা সঠিক প্রক্রিয়াও উপস্থিত রয়েছে।

এই প্রেক্ষিতে দেখলে দিল্লির আপ সরকারের স্কুল শিক্ষার কার্যক্রম অবশ্যই বিশেষ প্রশংসা ও স্বীকৃতি দাবি করে। এই সরকারের শিক্ষার কার্যক্রমকে সাদামাটাভাবে বিশ্লেষণ করলে যা সামনে আসে তা হল, ৮৬তম সংবিধান সংশোধনে বা বর্তমান শিক্ষা আইনে অথবা জাতীয় শিক্ষানীতিতে যা বলা হয়েছে, দিল্লির আপ সরকার তাকেই সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে প্রয়োগ করবার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। যখন কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন রাজ্য সরকার স্কুল শিক্ষার ক্ষেত্রে গতানুগতিক ভাবে কাজ করছে, তখন দিল্লির সরকার শিক্ষার উন্নতিকে রাজ্যের সামগ্রিক উন্নয়নের এক প্রধান সোপান হিসাবে দেখছে। তাদের শিক্ষা কার্যক্রমের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল:

১) শিক্ষা ক্ষেত্রে দিল্লি সরকার প্রতি আর্থিক বছরে প্রায় ২৫ শতাংশ খরচ করে (যদিও ১৫-১৭ শতাংশ পর্যন্ত কিছু কিছু রাজ্য খরচ করে);

২) বিদ্যালয় ভবন ও শ্রেণিকক্ষগুলিকে আমূল পরিবর্তন করে তাদের সুন্দর করে তুলেছে। গত ৭-৮ বছরে প্রায় নতুন ৮০০০ শ্রেণিকক্ষ বানিয়েছে। অর্থাৎ, প্রতি আর্থিক বছরে ১০০০ নতুন শ্রেণিকক্ষ অবশ্যই প্রশংসনীয়। এর ফলে স্বল্প পরিসরে গাদাগাদি করে ছাত্রছাত্রীদের বসতে হয় না;

৩) সাজানোগোছানো শ্রেণিকক্ষ বৃদ্ধি করেছে ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়ের প্রতি আকর্ষণ। অভিভাবকদের মধ্যেও তা বাড়তি প্রত্যাশা ও বিশ্বাস তৈরিতে সহায়ক হয়েছে; 

৪) এছাড়া বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে রয়েছে আকর্ষণীয় ল্যাব ও পাঠাগার। কিছু জায়গায় এ কাজ এখনও বাকী আছে;

৫) প্রশস্ত অঙ্গনে ছেলেমেয়েরা খেলে বেড়াচ্ছে অবসর সময়ে;

৬) সব ক্ষেত্রে নয় যদিও, যেখানে সম্ভব তৈরি হয়েছে অডিটোরিয়াম। সেখানে নিয়মিত ভাবে পাঠক্রম বহির্ভূত বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চলতেই থাকে; 

৭) সরকারি বিদ্যালয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে রীতিমতো প্রচার করে অভিভাবক-শিক্ষক সভা নিয়মিত ভাবে সংগঠিত হয়। কয়েক বছর আগেও এ ঘটনা বেসরকারি বিদ্যালয়ের একচেটিয়া ছিল;

৮) শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ছাড়াও বিভিন্ন নামজাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (যেমন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইটি ইত্যাদি) তাদের নিয়ে যাওয়া হয়;

৯) স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটিতে শিক্ষক, অভিভাবকদের প্রতিনিধি, সরকারি প্রতিনিধি এবং শিক্ষার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা রয়েছেন। বিদ্যালয় কেন্দ্রিক বিষয়গুলো এই কমিটি দেখে। রাজ্য সরকার এই কমিটির সঙ্গে যৌথভাবে নতুন শিক্ষা পাঠক্রমের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয় (যেমন সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাভাবনা, মানসিক বিকাশ, সুখ ও সৌহার্দ্যমুখি পাঠক্রম, দেশভক্তি পাঠক্রম ইত্যাদি);

১০) প্রতিটি বিদ্যালয়ের জন্য ৫ লক্ষ টাকা আলাদাভাবে সংরক্ষিত থাকে যা থেকে বিদ্যালয় প্রশাসন প্রয়োজন মতো খরচ করতে পারে। এর ফলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে বিদ্যালয়গুলি অনেকটাই মুক্ত হতে পেরেছে;

১১) অঙ্গনওয়াড়ি এবং নার্সারি শিক্ষার জন্যও কিছু বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে;

১২) কিছুদিন আগে দিল্লী শিক্ষা বোর্ড তৈরি হয়েছে। পরীক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াও এই সংস্থাটি উদ্যোগ-অভিমুখি কার্যক্রম এবং শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগকে কীভাবে একসূত্রে বাঁধা যায় সেটা দেখছে;

১৩)  বিদ্যালয় শিক্ষকদের বিভিন্ন সরকারি পরিসংখ্যান সংগ্রহের কাজ ইত্যাদি থেকে অনেকটাই মুক্ত করেছে;

১৪)পাশাপাশি দিল্লিকে ২৯টি ভাগে বিভক্ত করে প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি করে বিশেষ বিদ্যালয় তৈরির প্রকল্প নিয়েছে যেখানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, বিভিন্ন কলা এবং খেলাধুলো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে।

দিল্লি সরকার শিক্ষার ক্ষেত্রে যে উদ্যোগ নিয়েছে তা বকলমে প্রতিটি সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। দিল্লির আপ সরকার প্রমাণ করেছে, সদিচ্ছা থাকলে অত্যন্ত জটিল সাংবিধানিক পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব। শুধু তাই নয়, পাওলো ফ্রেইরি'র ‘পেডাগজি অফ দ্য অপ্রেসড'কে এই সরকার দিল্লির বিদ্যালয়গুলিতে বাস্তবায়িত করে তুলছে। আজ থেকে ৮ বছর আগে দিল্লির সরকারি বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় শতকরা পাশের হার ছিল ৫০ শতাংশেরও নিচে। বাড়তে বাড়তে এখন তা ৯৭ শতাংশে এসে পৌঁছেছে। ইদানীংকালে, দিল্লির মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যেও সরকারি বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে, যা নাকি আগে নিম্নবিত্ত ও বস্তিবাসীদের শিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসাবেই পরিচিত ছিল।

তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়। যে কোনও রাজ্য সরকার সেই রাজ্যের সামগ্রিক শিক্ষার বিকাশের স্বার্থে কাজ করবে, এটাই স্বাভাবিক। যেমন ২০১৬ সালে কেরালা সম্পূর্ণ প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের কৃতিত্ব অর্জন করে যার মধ্যে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা মিলেমিশে রয়েছে। সেই তুলনায় আপ সরকারের সমস্ত প্রচারে শুধু সরকারি বিদ্যালয়ের সাফল্যকেই সামনে আনা হয়। ভোটের রাজনীতিতে এর সুদূরপ্রসারী সুফল নিশ্চয়ই রয়েছে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী এক সময় বলেওছিলেন যে ভোটে জিতলেই রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। তা একটি কঠিন সত্য বটে। তবে রাজনৈতিক দল এবং রাজ্যের সরকার দুটি আলাদা অস্তিত্ব। দুয়ের আলাদা লক্ষ্য। আশা করছি দিল্লি সরকার কোনও একদিন দিল্লি রাজ্যের সমস্ত শৈশবের শিক্ষার কাণ্ডারী হয়ে উঠবে। কেরলের মতো সেখানেও সরকারি-বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। সেই প্রত্যাশায় রইলাম।


Wednesday, 11 May 2022

রাজনৈতিক অনুশীলনের পটবদল

বদলে যাচ্ছে জীবনধারা ও রাজনীতির ভাষ্য

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

এই কথাটা গত পাঁচ বছরে বার বার বলার চেষ্টা করেছি যে, ডিজিটাল ভুবন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উদয়ে গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনীতির পটভূমিতে এক আমুল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তার প্রতিফলন যে শুধু কর্মজগৎ ও শ্রমের আঙ্গিক পরিবর্তনের মধ্যে দেখা যাচ্ছে তাই নয়, রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার মধ্যেও অতীব সুস্পষ্ট। সাবেক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাজনীতির টানাপড়েন আজ এক নতুন ভূমিতে পৌঁছতে চাইছে। তার ওপর ব্লকচেইন প্রযুক্তি ও ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্রম-রমরমা আমাদের চারপাশের খোলনলচেটাকেই এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে উদ্যত।

লক্ষণীয়, প্রায় সারা বিশ্বে সাম্প্রতিক সময়ে নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম ও অচিরে তাদের ক্ষমতা লাভ অথবা একটি শক্তিশালী প্রবণতা হিসেবে উত্থান, রাজনীতির সাবেক মডেলটিকে চ্য্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে, ২০০৮ সালের সাব-প্রাইম সংকটের পর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর যে নতুন দুনিয়ার আবির্ভাব ঘটল, তা পুরনো দলসমূহ ও তাদের ভাবনাচিন্তাকে সেকেলে সাব্যস্ত করে দিল। ফলে, কোনও কোনও দেশে উগ্র নয়া জাতীয়তাবাদী শক্তির যেমন উত্থান দেখা গেল, আবার কোথাও আরও খোলামেলা ও উদারপন্থী শক্তিরও উদয় হল। যেমন, নয়া বাম শক্তি হিসেবে স্পেনে পোডেমস বা আইসল্যান্ডে পাইরেট পার্টিকে নতুন ভাবে উঠে আসতে দেখা গেল, অনুরূপ, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডে যথাক্রমে এএফডি ও পার্টি ফর ফ্রিডমকে চরমতম রক্ষণশীল দল হিসেবে পাওয়া গেল। আমাদের দেশেও দেখা গেল, গত দশকে একদিকে উগ্র-দক্ষিণ চরমপন্থী দল হিসেবে বিজেপি’র নতুনতর অভিষেক (মোদী-শাহ’র নেতৃত্বে), অন্যদিকে, বেশ কিছু আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে সঙ্গে আপ’এর মতো একটি জাতীয় চরিত্রের নতুন ধরনের রাজনৈতিক শক্তির জন্ম ও দ্রুত বিকাশ।

ইতিমধ্যে বিভিন্ন রাজ্যে নানা ধরনের আঞ্চলিক শক্তি রাজ্যওয়ারি আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলিকে সম্বল করে ও কোনও জনপ্রিয় ব্যক্তি-নেতৃত্বের ছায়ায় সেই সেই রাজ্যে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রবণতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল, তামিলনাড়ুতে ডিএমকে, অন্ধ্রপ্রদেশে ওয়াইএসআর, তেলেঙ্গানায় টিআরএস, ঊড়িষ্যায় বিজেডি অথবা দিল্লি ও পঞ্জাবে আপ। এই দলগুলির মধ্যে নানান রকমফের আছে, কিন্তু একটি ব্যাপারে তারা সকলে এক সূত্রে বাঁধা। তা হল, জনপ্রিয় জনপ্রকল্প নির্মাণে এরা প্রত্যকেই বেশ দক্ষ এবং রাজনীতির মূল অক্ষরেখা হিসেবে জনবাদী প্রকল্পের রাজনীতিকেই তারা একপ্রকার মতাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এই যে এক সুরে এতগুলি দল একটা পথকে সাব্যস্ত করেছে, তাতে রাজনীতি ও অর্থনীতির জগতে একটা প্যারাডাইম শিফট হয়ে চলেছে- রাজনীতির গতিমুখ আজ অনেকাংশে ঘুরে গেছে ‘জনমুখি প্রশাসনি রাজনীতি’র দিকে। অর্থাৎ, কোন দল কতটা গভর্নেন্স বা প্রকৃত জনমুখি সুশাসন প্রদান করতে সক্ষম, সেই মাপকাঠিতেই আজ রাজনীতির ভাল-মন্দের বিচার এসে ঠেকেছে।

কিন্তু কেন এমনটা হল? কেন অতীতের মতাদর্শগত তর্ক-বিতর্কগুলোকে শিকেয় তুলে জনবাদী প্রকল্পগুলিকে ঘিরে রাজনৈতিক কার্যকলাপের বাতায়ন তৈরি হচ্ছে? এই প্রশ্নটিকে বুঝতে হলে পরিবর্তিত রাজনৈতিক-অর্থনীতির গতিপ্রকৃতিকে ঠিকঠাক ভাবে বুঝতে হবে। উল্লেখ্য, শ্রম ও কর্মজগতের সুদূরপ্রসারী পুনর্বিন্যাসের ফলে দুটি লক্ষণীয় পরিবর্তন গত দশ-বারো বছরে ধীরে ধীরে দানা বেঁধেছে:

এক) প্রযুক্তির অভাবনীয় ও গুণগত উত্তরণের ফলে কাজের নির্দিষ্ট রীতি ও স্থায়িত্বের অবসান হয়েছে। অর্থাৎ, আগে কাজের কোনও রীতি ও আঙ্গিক যে দীর্ঘ সময় ধরে বহমান থাকত (যেমন একটা কর্মস্থল বহুদিন ধরে অটুট থাকত), সে জমানা ফুরিয়েছে। আজ যে কাজ আছে, কাল সে কাজ বহুলাংশে নাও থাকতে পারে; অথবা কাজের রীতি-বিন্যাস সম্পূর্ণত বদলে যেতে পারে। ফলে, কর্মীদের স্থায়িত্বও স্বল্প সময়ের হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকায় আজকাল বলা হয় ‘at-will’ employment- কর্মী বা সংস্থা উভয় উভয়কে যখন-তখন পরিত্যাগ করতে পারে। এই সম্পর্কটা উভয় তরফই কার্যত মেনে নিয়েছে।

দুই) কাজের জোগান ও কর্মলাভের সম্ভাবনা আগের থেকে বহু গুনে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও সে সব কাজ অধিকাংশই অস্থায়ী চরিত্রের, তবুও একটি কাজ ছেড়ে আরেকটির প্রাপ্তির সম্ভাবনা এখন আগের থেকে অধিক। কিন্তু সে কাজে মজুরি কতটা যথাযথ অথবা কাজের নির্ঘন্ট কতটা সহনীয়, সে সব প্রশ্ন প্রবলভাবে উপস্থিত। এক কথায়, মানুষের কাজ বেড়েছে কিন্তু সোয়াস্তি কমেছে। মজুরি-দাসত্ব আজ নতুন রূপে অন্য ভাবে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।

ফলে, আজকের রাজনৈতিক-অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে কতকগুলি সমস্যা ও জটিলতা নতুন ভাবে হাজির হয়েছে। যেমন, ট্রেড ইউনিয়ন চেতনা আজ অনেকটাই বিলীয়মান। যেখানে কাজই অস্থায়ী, কাজের আঙ্গিক বিকেন্দ্রীকৃত ও এক কর্মস্থলে টিকে থাকার মানসিকতা ক্রমঅপসৃয়মান, সেখানে স্বভাবতই ইউনিয়ন গঠনের বাসনা ও যূথবদ্ধতার প্রয়োজনীয়তাও লুপ্ত হবে। কিন্তু তা বলে আত্মমর্যাদা ও সুস্থায়ী জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষা তো মরে যাবে না! সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে তাহলে কীভাবে পৌঁছনো? কার সঙ্গেই বা জীবনসংগ্রাম ও দর কষাকষি? এই প্রশ্ন ও তার উত্তরই নতুন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও মতাদর্শের জন্ম দিচ্ছে।

মার্কস সাহেব তাঁর ‘পুঁজি’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে বলেছিলেন, পুঁজিবাদ শুধুমাত্র পণ্য ও উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদন করে না, পুঁজিবাদী সম্পর্ককেও পুনরুৎপাদন করে- একদিকে পুঁজিপতি ও অন্যদিকে মজুরি-শ্রম। এই ভয়ানক সত্যকে যদি আত্মস্থ করা যায়, তাহলে এমনটা ভাবতে আর কোনও অসুবিধা থাকে না যে, পুঁজিবাদ নিজের চাকাকে নিজেই গড়িয়ে নিয়ে চলে। আর তা এই অর্থে যে, এই ব্যবস্থায় সকলেই স্বপ্ন দেখতে পারে পুঁজিপতি হয়ে ওঠার (ছোট-বড় যে মাপেরই হোক না কেন)! উনিশ ও বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত পুঁজিবাদ যতদিন ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের আধারে চলেছে, ততদিন পর্যন্ত একই কারখানার ছাদের তলায় হাজার হাজার শ্রমিকের যূথবদ্ধ কাজের মধ্য দিয়ে এমন একটা স্থায়ীকৃত বন্দোবস্ত ছিল যে পুঁজি ও শ্রম, আরও নির্দিষ্ট করে বললে, পুঁজিপতি ও শ্রমিক প্রায় সম্মুখ সমরে যুদ্ধংদেহী মনোভাবে দণ্ডায়মান ছিল। শ্রমিক ছাঁটাই, মজুরি ছাঁটাই, লক-আউট, লে-অফ ইত্যাদির বিরুদ্ধে তখন শ্রমিকের হাতিয়ার ছিল দর কষাকষি, মিছিল, মিটিং, ধর্মঘট। রাতারাতি কারখানা বন্ধ করে পুঁজি নিয়ে চম্পট দেওয়ার বিধিব্যবস্থা বা নমনীয়তা কোনওটাই তখন পুঁজির হাতে ছিল না। তাই, কর্মস্থলের বিরোধ ও সংঘাতও দীর্ঘস্থায়ী ছিল। সেই ব্যবস্থাপনার মধ্যেই আপস-মীমাংসা অথবা আপস নয়- দুই পথেই দু’ পক্ষকে অবস্থা-বিশেষে চলতে হয়েছে। ফলে, রাজনীতির অ্যাজেন্ডা ও আঙ্গিকও ছিল সেই অনুসারী।

এই অবস্থাটার বদল আসতে শুরু করে আধুনিক প্রযুক্তির আবাহনে পুঁজির গতায়াত যখন অত্যন্ত সহজ ও মসৃণ হয়ে উঠল এবং ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প ছাড়িয়ে পরিষেবা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে মুনাফার হারকে উর্ধ্বগামী করা গেল। শনৈই শনৈই তা তথ্য প্রযুক্তি, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন, ক্রিপ্টোকারেন্সি ইত্যাদির গুনফলে আজ এক দৈত্যাকার ডিজিটাল ভুবনের রূপ পেয়েছে যেখানে পুরনো আঙ্গিকের পুঁজি-শ্রমের দ্বন্দ্ব এমন এক অবয়বে এসে দাঁড়িয়েছে যে তাকে যথাযথ ভাবে উপলব্ধি না করতে পারলে রাজনীতির ময়দান থেকে স্রেফ ছিটকে যেতে হবে। এই ভিত্তিভূমিই আজ নতুন রাজনীতির উৎস। যে কারণে, গত দু-তিন বছরে, বিশেষত কোভিড অতিমারির পর, ইউরোপ জুড়ে ‘নয়া বামপন্থী’দের জনপ্রিয় উদয়। যেমন, নরওয়ে’তে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ‘নয়া বামেরা’ এক নতুনতর পথ ধরেছে।

এই পথটা কেমন? গড়পড়তায় ধরলে, তা সামাজিক সুরক্ষা মিশ্রিত জনবাদী জনপ্রকল্প গ্রহণের পথ। কেন এই পথ? অস্থায়ী কর্মজগৎ, প্রগাঢ় অনিশ্চিয়তায় ভরপুর আজকের পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এমনতর জনবাদী প্রকল্প ব্যতিরেকে দুর্বল মানুষ তো স্রেফ ভয়, আতঙ্ক ও গ্লানিতেই মরে যাবে! সে মৃত্যু দারিদ্র্য, অভুক্তাবস্থা বা অপুষ্টি জনিত হতে পারে অথবা আত্মহনন কিংবা প্রতিহংসামূলক হত্যাতেও ঘটতে পারে। জনপ্রকল্পগুলি চালু থাকলে যে এইসব আশঙ্কা থাকবে না তা নয়, কিন্তু চূড়ান্ত অসময় ও ধ্বস্ত পরিস্থিতিতে তা কিছুটা হয়তো ঠেকা দিতে সক্ষম! বর্তমানে ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ও অসম্মানজনক মজুরিতে কাজ করেও যে রাস্তায় পড়ে পড়ে এখনও লোকে মরছে না, তার কারণ গুচ্ছ গুচ্ছ নানাবিধ জনপ্রকল্প কমবেশি বহমান আছে। তাতে অন্তত ঘরে বসেও দু’ মুঠো কোনওক্রমে জুটে যাচ্ছে। আর ডিজিটাল ভুবনের সূত্রে কাজেরও এত রকমারি ও অফুরন্ত জোগান হয়েছে যে, কোনও না কোনও সময়ে কিছু না হোক কাজও জুটে যাচ্ছে। এইরকম যাদুময় কর্মজগৎ ও প্রযুক্তির দুরন্ত কর্মক্ষমতা আগে কখনও ছিল না। এই দ্বন্দ্বমুখর অভিনব রাজনৈতিক-অর্থনীতির দুনিয়াই আজ জনবাদী প্রকল্পের রাজনীতির এক নতুন ধারার উন্মেষ ঘটিয়েছে যা গত কয়েক বছরে মাথাচাড়া দেওয়া সম্প্রদায়গত ও জাতিগত বিদ্বেষের চরমপন্থী আদিম রাজনীতিকে পিছু ঠেলছে।

তাই বলা যায়, রাজনীতির এখন দুটি মূল ধারা বহমান। এক, চরম দক্ষিণপন্থী বিভাজনের রাজনীতি যা প্রতিহিংসা উসকে সমাজের এক অংশের মানুষের সঙ্গে আরেক অংশের মানুষের হানাহানি লাগিয়ে দিতে পটু; দুই, মানুষের দারিদ্র্য ও বিপন্নতা মোকাবিলায় জনবাদী জনপ্রকল্পের রাজনীতি যা আজকের চরম অনিশ্চয়তা, দারিদ্র্য ও দুর্ভোগের মধ্যে কিছুটা হলেও সুরাহা দিতে উপযোগী। গত দশকে প্রথম কিসিমের রাজনীতির বেশ রমরমা হয়েছিল। বহু মানুষ ভেবেছিলেন, জনতার অপর এক অংশকে শায়েস্তা করেই মন ও শরীরের জ্বালা জুড়োবে। তা তো হয় না। উপরন্তু, নিজেদেরও মরতে হয়। অতএব, দ্বিতীয় পথকেই বহুজনের নিরাপদ ও আপাত স্বস্তির মনে হচ্ছে। অতএব, আমাদের দেশেও আগামী কয়েক বছরে দ্বিতীয় পথের জনবাদী রাজনীতিই প্রধান ধারা হিসেবে বিরাজমান থাকবে।