Tuesday, 3 May 2022

বিশ্ব নাগরিক হয়ে ওঠার চেতনা চাই

অন্যথায় জলবায়ু সংকটকে মোকাবিলা সম্ভব নয়

 বিধান চন্দ্র পাল



জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি তীব্র হচ্ছে। আর এই ক্ষতির সঙ্গে এখনই বাংলাদেশের মতো দেশগুলো খাপ খাওয়াতে পারছে না। এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা দেড় থেকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে এই ক্ষতি আরও বাড়বে। ফলে, বাংলাদেশের জন্য সামনে আরও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়া সহ নানা ধরনের বিপদ অপেক্ষা করছে। আর‍ তাই জাতিসংঘের জলবায়ু তহবিল সহ নানা খাত থেকে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য তহবিল বাড়াতে হবে। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিজ্ঞানীদের প্যানেল আইপিসিসি’র গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে এসব আশঙ্কা ও সুপারিশ করা হয়েছে।

নিঃসন্দেহে আমরা উদ্বিগ্ন বর্তমান সময় এবং আমাদের ভবিষ্যতের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে। কিন্তু ইতিহাস খুঁজে দেখলে জানা যায় যে, পৃথিবীর কয়েক শত কোটি বছরের ইতিহাসে বারবারই জলবায়ুপরিবর্তন ঘটেছে। ছোট-বড় বিভিন্ন আকারে এটা ঘটেছে। এই পরিবর্তনের কয়েকটি আবার পৃথিবীকে প্রাণের উপযোগী করে তুলতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। যেমন, পৃথিবী গড়ে ওঠার সময়কালে বায়ুমণ্ডলে প্রাকৃতিক ভাবে উচ্চমাত্রার কার্বন-ডাই-অক্সাইড জলীয় বাষ্প ছিল বলে ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা ধরে রাখা সম্ভব হয়েছিল। এর ফলে সেখানে পানি তরল হিসেবে থাকতে পেরেছে। মঙ্গল গ্রহের মতো সব বরফে পরিণত হয়ে যায়নি। যদি হত, তা হলে এটিও প্রাণহীন গ্রহে পরিণত হয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল। আবার প্রাকৃতিক ভাবে বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইড মেঘ অ্যাসিড বৃষ্টি হয়ে নেমে এসে কার্বনেট শিলায় কার্বন বাধা পড়েছে বলে অতিরিক্ত উত্তপ্ত হয়ে যেতে পারেনি ভূপৃষ্ঠ। তা না হলে এটি শুক্র গ্রহের মতো প্রাণহীন উত্তপ্ত গোলকেও পরিণত হয়ে যেতে পারত। কাজেই, যে প্রক্রিয়াটির কথা নিয়ে, যে পরিবর্তনটি নিয়ে আমরা এত উদ্বিগ্ন, পৃথিবীতে সেটা আসলে নতুন কিছু নয়। 

নতুন কিছু কী তাহলে? নতুন কিছু হল আমাদের নিজেদের সৃষ্ট ঘটনা, যা সমস্যা সৃষ্টি করছে এবং আমাদের ভবিষ্যৎকে বিপর্যস্ত করছে। বিশেষভাবে আমরা আমাদের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ জীবনযাপন পদ্ধতিকে বিগত সময়গুলোতে এমন দিকে ধাবিত করেছি যে তাতে বায়ুমণ্ডলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করে ফেলছি। এর ফলে দেখা দিচ্ছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া, যা ক্রমবর্ধমান হারে জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি সৃষ্টি করে চলেছে। সব চাইতে বড় সমস্যা উদ্বিগ্ন হওয়ার বিষয় এখানেই। বর্তমান বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল- এটি মনুষ্য বা মানবসৃষ্ট।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত আইপিসিসি’র ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন, চরম খারাপ আবহাওয়া এবং ভূমি ও সাগরের যথেচ্ছ ব্যবহারের জেরে বিশ্ব জুড়ে তীব্র খরা, দাবদাহ ও ঝড়ের সংখ্যাও ব্যাপক ভাবে বেড়ে গেছে, যা মানুষ ও বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতির উল্লেখযোগ্য কারণ। আর এসব কারণে বিশ্বের ৩৩০ কোটি থেকে ৩৬০ কোটি মানুষ উচ্চ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মানুষের জীবনের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব যত দ্রুত পড়বে বলে ধারণা করেছিলেন বিজ্ঞানীরা, তার চেয়েও দ্রুত এর অভিঘাত দেখা যাচ্ছে। এমনকি দেশগুলো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমিয়ে আনা ও কার্বন নিঃসরণ কমাতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে এখনও কার্যত সফল হয়নি। এর ফলে কৃষি, বন, মৎস্য, জ্বালানি, পর্যটন সহ বিভিন্ন খাত সরাসরি ক্ষতির মুখে পড়েছে।

বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও মূল্যায়ন প্রতিবেদনে আমরা দেখেছি, এই শতাব্দীর প্রথম ২১ বছরে বিশ্বের তাপমাত্রা ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। এর মানে সামনের ৭৯ বছরের মধ্যে তাপমাত্রাকে ০.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না। এটা আসলে বেশ কঠিন কাজ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ পর্যন্ত ১ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দুর্যোগ বেড়ে গিয়েছে, সেই সাথে নানা ধরনের নেতিবাচক প্রভাবও আমরা টের পাচ্ছি। দরিদ্র দেশগুলো তো অবশ্যই, উন্নত দেশগুলোর পক্ষেও এসব দুর্যোগ সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। গত বছর (২০২১) আমরা দেখেছি জার্মানিতে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। কানাডার তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে গিয়ে অনেক মানুষ মারা গেছে, দেশটিতে তীব্র বন্যাও আমরা লক্ষ করেছি। যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে। আর বাংলাদেশ, ভারত ও চীন তো প্রতি বছর রেকর্ড ভাঙা বন্যার মুখে পড়ছে। এ সব কিছু যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে হচ্ছে, তা বিজ্ঞানীরা আগের চেয়ে আরও বেশি যুক্তি প্রমাণ সহ উপস্থাপন করতে পারছেন এখন। 

তবে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হল, এটি সরলরেখায় চলছে না। এর মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু চক্রবৃদ্ধির বিষয়। শুরুতে অল্প বৃদ্ধি অন্য আরও বড় বৃদ্ধির সুযোগ করে দিচ্ছে, যা ঠিক কী হারে তার হিসাব করা দুরূহ। কাজেই পরিস্থিতি কিছুটা অনিশ্চিতভাবেই দ্রুত বদলে যাচ্ছে, যে কোনও সময় আরও বদলে যেতে পারে। এ জন্য সাম্প্রতিকতম উপাত্ত না পেলে অবস্থার পুরো গুরুত্ব তুলে ধরা কঠিন হচ্ছে। এখন তাই এই চক্রবৃদ্ধির প্রকৃতিগুলো আরও ভালোভাবে বোঝার প্রয়াস চালানো হচ্ছে।

তবে বিভিন্ন দৃশ্যকল্প এবং জলবায়ু মডেল থেকে একটি বিষয় খুব সুস্পষ্ট যে, এ সম্পর্কে আমরা যাই করি না কেন, পুরো পৃথিবীর সবাই মিলেই করতে হবে, কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। কারণ, ব্যাপারটা পুরো পৃথিবীকে নিয়েই। আমাদের একটিই পৃথিবী, একে বাঁচাবার দায়িত্বটিও আমাদের হাতেই। সামাজিকভাবেও এটা আমাদের সবাইকেই করতে হবে। বাঁচবার পথ একটিই- গ্রিন হাউস গ্যাস উদগীরণ বহুলাংশে কমাতে হবে এবং তা যত দ্রুত সম্ভব করতে হবে। এর প্রধান গুরুত্বটি দিতে হবে কার্বন-ডাই-অক্সাইড উদগীরণের ক্ষেত্রে। তারপরেই আসে মিথেন উদগীরণের প্রশ্নটি। যদিও বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, কৃষি খাত থেকে প্রচুর মিথেন গ্যাস নির্গত হয়। কার্বন নিঃসরণের চেয়ে মিথেন গ্যাসের বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ২৪ গুন বেশি। বিশ্ব জুড়ে ধ্বংস হওয়া বন, জৈব বর্জ্য, আবর্জনা থেকে শুরু করে পানিতে ডুবিয়ে রাখা ধান বা অন্য কোনও ফসল থেকে মিথেন গ্যাস নির্গত হয়। এরপর নাইট্রোজেন অক্সাইড, সিএফসি ইত্যাদি আরও কিছু গ্রিন হাউস গ্যাসের প্রশ্নও আসে, যদিও তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বে। আর বিভিন্ন গবেষণা থেকে এটাও প্রমাণিত যে, গ্রিন হাউস গ্যাস উদগীরণ বন্ধ করার বিষয়টি আমাদের পুরো আচরণ, অর্থনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং জীবন-যাপনের ভঙ্গির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট। আর এই সব কিছুতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার মাধ্যমেই কেবল পৃথিবীকে বাঁচানোর পথটি সুপ্রশস্ত হতে পারে।

বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের দ্বারাই সৃষ্ট। এর প্রতিকার শুধু বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী কিংবা দেশের সরকারের ওপর একক ভাবে নির্ভর করে না। এখনও এর প্রতিকার করার সুযোগ আমাদের হাতে রয়েছে। পৃথিবীর সকল মানুষের দৈনন্দিন অভ্যাস ও জীবনযাত্রার উপরে তা অনেকখানি নির্ভর করে। তাই প্রকৃত অর্থেই ভবিষ্যৎ আমাদেরই হাতে। এর প্রতিকার করতে না পারার অর্থ হল নিজেদের অথবা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনিশ্চয়তা ও চরম দুর্ভোগের মধ্যে ঠেলে দেওয়া। এর প্রতিকারের পথে একদিকে জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২৬) প্রতিশ্রুতি অনুসারে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখা, প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের রূপরেখা অনুসারে কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করা, ক্লাইমেট প্যাক্টের ঘোষণার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা ইত্যাদি খুবই জরুরি। এসব ক্ষেত্রে দেশের সরকার অগ্রগামী ও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে এবং করতে সচেষ্ট থাকবে- সেটাই আন্তরিকভাবে প্রত্যাশিত।

অন্যদিকে আমাদের পথ দেখাবে, উদ্বুদ্ধ করবে এবং সাহস জোগাবে আমাদের সচেতনতা ও জ্ঞান। এ জন্যই জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতার কথা ভাসা ভাসা শুনলেই হবে না। এর পেছনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণা, নতুন নতুন উদ্ভাবন ও উদঘাটনগুলো কী, নতুন কী হচ্ছে কিংবা হতে যাচ্ছে- সে সব কিছুই আমাদের অনুধাবনের প্রচেষ্টা সবার দিক থেকেই থাকতে হবে। আর তা হলেই আমরা বুঝতে পারব আমাদের এখন কী এবং কতটুকু করতে হবে। মজার ব্যাপার হল, এই করার মধ্যে শুধু যে ত্যাগ ও বর্জনের বিষয় আছে তাই নয়, বরং পরিবেশের সঙ্গে একটি সুন্দর সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি এবং জীবনযাত্রাকে আরও সুন্দর ও উপভোগ্য করে তোলার বিষয়ও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত আছে

পরিশেষে, আমরা সারা বিশ্বের মানুষ একসাথে সম্মিলিতভাবে সকল মানুষের জীবনযাত্রাকে সুন্দর ও স্থায়িত্বশীল করার প্রয়াসে প্রয়াসী এবং তা করতে পারব- এই উপলব্ধি আমাদের ভেতরে বিশ্ব নাগরিক হয়ে ওঠার মতো একটি চেতনাবোধের জন্ম দেয়। এই চেতনাবোধ ধীরে ধীরে ব্যক্তি থেকে সমাজে, দেশ থেকে অন্য দেশে নির্বিশেষে সবার মধ্যে সম্প্রসারিত হোক এবং জাগ্রত থাকুক- সেটাই একান্ত প্রত্যাশা হবে; সেটাই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অন্যতম সহায়কের ভূমিকা পালন করবে বলেই আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি।   

 

1 comment:

  1. এই বোধ অসংগঠিত ভালো মানুষের। সংগঠিত রাজনৈতিক ঠিকাদার এবং তার চালকের নয়।

    ReplyDelete