Monday, 24 April 2017

Wednesday, 12 April 2017

ক্যানসার কথা

ক্যানসারের সত্যি মিথ্যে


বিশিষ্ট  শিক্ষাবিদ  যতীন্দ্রনাথ গোস্বামী স্মরণে আয়োজিত এবারের স্মারক বক্তৃতার বিষয় ছিল 'ক্যানসার: বিজ্ঞান ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া'। বালি সাধারণ  গ্রন্থাগার আয়োজিত ৮ এপ্রিলের এই সভায় বিষয়টি সম্পর্কে ক্যানসার চিকিৎসক স্থবির দাশগুপ্ত এবং ক্যানসার অ্যাক্টিভিস্ট যদুনাথ মুখোপাধ্যায়কে বক্তব্য  রাখার জন্য আমন্ত্রণ  করা হয়েছিল। ঠিক  সন্ধ্যা ৬.৩০ মি. সভা সঞ্চালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন গ্রন্থাগারের সম্পাদক গৌতম  দত্ত। আমন্ত্রিত  দুই বক্তার সংগে শ্রোতাদের পরিচয় করানো, তাঁদের পুষ্পস্তবক, পুস্তক এবং বিশিষ্ট  শিল্পীর ছবি উপহার  দেওয়ার পর যতীন্দ্রনাথ সম্পর্কীয় স্মৃতিচারণ করেন গ্রন্থাগারের দুই সন্মাননীয় পদাধিকারী। এর পর মূলপর্ব শুরু হয় প্রয়াত ক্যানসার গবেষক ডাঃ মনু কোঠারির মাত্র চার মিনিটের অনবদ্য একটি বক্তৃতার রেকর্ড বাজিয়ে। রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের পবিত্রতা রক্ষার তাৎপর্য বোঝানোর জন্য মনুভাই চিকিৎসকদের প্রায় প্রতিটি সভায় এই চার মিনিটের গানটি  শোনাতেন । এরপর যদুনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে প্রচলিত ক্যানসার চিকিৎসার অবৈজ্ঞানিকতাকে আড়াল করার জন্য প্রযুক্তিগত উন্নতির ঢ়োল পেটানোর কথা দিয়ে  শুরু করেন।

তিনি বলেন, ঝাঁ-চকচকে প্রযুক্তির জৌলুস সত্ত্বেও গত ৫০ বছরে সামগ্রিকভাবে পৃথিবীর কোথাও ক্যানসারের প্রকোপ বা তার মৃত্যুহার একচুল কমেনি। কেউ এই দাবি করেনি যে ক্যানসার আজকাল দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে, চিকিৎসিত ক্যানসার রোগীরা মধুর জীবনযাপন করছেন। বাস্তব হল, ক্যানসারের কারণে উপসর্গ যখন অনুভূত হতে শুরু হয় তখন ক্যানসারটি তার  শিশু অবস্থা অনেক কাল আগেই পার হয়ে গেছে। সেই অনেক কালের অর্থ ৫ থেকে ১৫ বছর হয়ে থাকে। ঘটনা হল, হলিউড অভিনেত্রী জোলি স্তনে BRCA-1 জিনের উপস্থিতির খবর শুনেই তাঁর দুটি স্তন কাটাবার পর ওভারিও কাটিয়ে নিয়ে আসলে এটাই বুঝিয়েছেন যে ক্যানসার হলে চিকিৎসায় লাভ হবে না। বরং, অঙ্গ দুটি না থাকলে ক্যানসার হবে না। অর্থাৎ, ক্যানসার চিকিৎসার প্রতি ঘোর  অনাস্থার কারণেই জোলি স্তনোচ্ছেদন করিয়েছেন। সম্ভাব্য ক্যানসারের প্রতি সমাজের সব  থেকে বিত্তবানদের এই প্রতিক্রিয়া আধুনিকতম ক্যানসার  চিকিৎসার বাস্তবিকতাকে স্পষ্ট করে।

এরপর সভার মুখ্য বক্তা  ডাঃ স্থবির  দাশগুপ্ত তাঁর  দেড় ঘন্টার বক্তৃতায় সভাগৃহে উপস্থিত সুধীজনেদের সামনে ক্যানসার সম্পর্কিত বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণাগুলি তুলে ধরেন। মুখ্যত  মিডিয়া  বাহিত  এই ধারণাগুলির কারণে জনমনে অহেতুক ক্যানসার আতঙ্ক নতুবা তা থেকে মুক্তির মিথ্যা আশ্বাসের জন্ম হয়। অত্যন্ত সহজভাবে তিনি এই সত্যটি তুলে ধরেন যে এই রোগটি হবার জন্য কোনও বাহ্যিক কারণের দরকার পড়ে না। প্রতিটি জনগোষ্ঠীর প্রতি পাঁচ  জনের একজন তার জীবদ্দশায় রোগটির শিকার হবেন এটা নিশ্চিত বটে কিন্তু ঐ একজনটি কে হবেন তা বলা সম্ভব নয়, সেটা অনিশ্চিতই থেকে যাবে। ডাঃ দাশগুপ্ত তাঁর  দীর্ঘ ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলে ক্যানসার চিকিৎসার সব থেকে করুণ সমস্যাটি তুলে ধরেন: 'আমরা  ক্যানসার চিকিৎসার পরিণতি সম্পর্কিত  কোনও ভবিষ্যৎবাণী  করতে পারি না। একই বয়সের  একইরকমের ক্যানসারের একই ধরনের চিকিৎসার ফল এতটাই ভিন্ন হয় যা ব্যাখ্যা করা যায় না।' তিনি মনে করেন প্রযুক্তিগত অবিশ্বাস্য উন্নতি এবং চিকিৎসাবিধির প্রভূত উন্নতি সত্ত্বেও উল্লিখিত সমস্যার কোনও সমাধান হবার নয়। অথচ উন্নত প্রযুক্তি আর দামি সব ওষুধ প্রয়োগ করে গবেষণাগারে পশুর ক্যানসার ১০০ শতাংশ ঠিক  হয়েই চলেছে, আর মিডিয়া  সেই সাফল্যের সাতকাহন শুনিয়েই চলেছে। কিন্তু সেই ওষুধ ক্যানসার রোগীর ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে। কেন? কারণটা হল, আমাদের ক্যানসারটার চরিত্রগত  বৈশিষ্ট্য। পশুর শরীরে যে ক্যানসার তা গবেষকদের সৃষ্ট, যাকে আমরা transplanted cancer বলি। মানুষের ক্যানসার কিন্তু স্ব-উৎপন্ন, সহজাত।


তিনি আরও বলেন, ক্যানসার  সম্পর্কে, বিশেষভাবে সচেতনতা  অভিযান চালানোর নামে  আসলে রোগটি সম্পর্কে আতঙ্কিত করা এবং তা কীভাবে কোথায়  গেলে  ঠিক  হবে, নিরন্তর  সেই প্রচার চললেও একবারের জন্যও জনমানুষকে এই সত্যটা জানানো হয় না যে প্রায় ১৪০ প্রকারের ক্যানসার পরিবারের সব কটি এক প্রকারের নয়। এর কয়েকটির চরিত্র ভাল, চিকিৎসায় সাড়া দেয়। অধিকাংশই মন্দ প্রকৃতির, চিকিৎসায় সাময়িক লাভ হয়। কিন্তু এমন কিছু ক্যানসার আছে যাকে কুৎসিত বলা যায়। কোনও চিকিৎসাতেই তা সাড়া দেবে না।

রাত ৯টা পর্যন্ত চলা এই সভায় শ্রোতারা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে ক্যানসারজনিত প্রশ্নগুলি বোঝার চেষ্টা করছিলেন।