'কোথায় বা কি ভূতের ফাঁকি...'
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
আজ (৩০ অগস্ট ২০১৭) রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রকাশিত একটি
রিপোর্ট থেকে জানা গেল যে, বিমুদ্রাকরণের ফলে কালো টাকা উদ্ধারের যে ঘোষণা মোদি
সরকার দিয়েছিল তা গুড়ে বালি! রিপোর্টে প্রকাশ, বাতিল হওয়া ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটের প্রায়
৯৯ শতাংশ টাকাই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘরে ফেরত এসেছে। তাহলে ‘কালো টাকা’গুলি সব গেল
কোথায়? হিসাব মোতাবেক, ১৫ হাজার কোটি টাকা ফেরত আসেনি। ধরে নেওয়া যাক, এইগুলি সব কালো টাকা। এদিকে নোট ছাপানোর খরচ পড়েছে ২১
হাজার কোটি টাকা। তাহলে দাঁড়াল এই, ১৫ হাজার কোটি টাকার কালো টাকা উদ্ধার করতে নেট লোকসান ৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি শাক দিয়ে
মাছ ঢাকার মতো করে সাংবাদিকদের আজ জানিয়েছেন, আসলে সরকারের উদ্দেশ্য ছিল নগদ
লেনদেন কমিয়ে ডিজিটাল লেনদেন বাড়ানো। ‘কালো টাকা’ উদ্ধারের বাহানায় এটাই যে আসল
উদ্দেশ্য, তা ‘একক মাত্রা’র মার্চ সংখ্যায় ‘অর্থনীতির সাতপাঁচ’ কলামে স্পষ্টতই
লিখেছিলাম। আর কেন, তাও পরিষ্কার ভাবে বলেছিলাম। তাহলে মশা মারতে কামান দাগা কেন?
সে কথাও এই ব্লগেই বিমুদ্রাকরণ অভিযান শুরুর দ্বিতীয় রাতেই লিখেছিলাম। ভেবে ভাল
লাগছে যে সেই আশঙ্কা ও অনুমানগুলি মিথ্যা হয়নি।
এই ব্লগেই ‘কালো টাকার রহস্য’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ও তারও আগে
আরেকটি লেখায় পরিষ্কার জানিয়েছিলাম, অর্থনীতিতে ‘কালো টাকা’ বলে কিছু হয় না। আসলে ‘কালো
টাকা’ বলতে যে টাকাগুলির দিকে ইঙ্গিত করা হয় তা হল, বেআইনি পথে টাকা আদায়, যার
কোনও হিসাব আইনি ভাবে এই টাকার মজুতদারেরা রাখে না, সরকারের কাছেও থাকে না। কীভাবে
এই বেআইনি টাকা আদায় করা হয়? মূলত, ঘুষ মারফত, তোলাবাজি, ডাকাতি ও স্মাগলিং করে,
কমিশন খেয়ে, বেআইনি ব্যবসা ও লেনদেন চালিয়ে, ধর্মীয় বাবা ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে
বেআইনি পথে আদায় করা টাকা গচ্ছিত রেখে ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ, টাকা টাকাই থাকে,
কিন্তু বেআইনি পথে সমান্তরাল অর্থনীতি তৈরি করে সে টাকা বহাল তবিয়তে ঘোরে এবং পেশি
ও রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে তা মুষ্টিমেয় এক শ্রেণির মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। এই
বেআইনি পথে টাকা লুঠ রুখতে সরকারের নানান নজরদারি ও আইনি সংস্থা আছে – যেমন, ইডি,
সেবি, সিবিআই ইত্যাদি ইত্যাদি। সবাই জানেন, এদের রাজনৈতিক ভাবে অকেজো করে রেখেই
সমান্তরাল অর্থনীতির ধারা প্রবহমান।
তাহলে, বিমুদ্রাকরণ করে তথাকথিত কালো টাকা উদ্ধারের ফন্দিটা
কোন ভূতের মাথা থেকে গজালো? সে কথাগুলোও আমার আগের লেখাটায় গুছিয়ে বলা আছে। আবারও
অল্প করে বলি, বিমুদ্রাকরণের সঙ্গে কালো টাকা উদ্ধারের কোনও সম্পর্কই ছিল না।
কারণ, কালো টাকা বলে কিছু নেই; বেআইনি পথে বিপুল টাকা মুষ্টিমেয় ও তার বশংবদদের
হাতে কেন্দ্রীভূত করার পথ ও উপায়গুলিকে যদি রুদ্ধ করা যায় তবেই তথাকথিত ‘কালো টাকা’
আর তৈরি হতে পারে না। কিন্তু, এতদিনকার সঞ্চিত যে ‘কালো টাকা’গুলি, সেগুলির কী
হবে? মোদি সাহেব তো সেগুলোকেই উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন নাকি! ‘কোথায় বা কী ভূতের
ফাঁকি মিলিয়ে গেল চট করে’। আসলে, ছিল রুমাল হয়ে গেল বেড়াল, এ তো হামেশাই হচ্ছে!!
সব টাকাই তো দেখা গেল সাদা! মাদারি-কা-খেলটা কী? তা হল, সঞ্চিত কালো টাকাগুলিকে
নানান খাতে নানান উপায়ে বিমুদ্রাকরণের নীতি ঘোষণার বহু আগে থেকেই, আইনি মোড়কে বিশ্বব্যাপী
সাজিয়ে ফেল। যারা আগাম খবর পেলেন না, তাদের একটু ল্যাজেগোবরে অবস্থা হল বটে,
কিন্তু কুছ পরোয়া নেই। কারণ, ‘কালে কো সফেদ ঔউর সফেদ কো কালে’ করতে নগদ টাকা এদিক
ওদিক পাচার করার কোনও দরকার পড়ে না। ভুবনায়িত পুঁজির জোরে তা কাগজপত্র বানিয়ে,
ডিজিটাল লেনদেনেই করে ফেলা সম্ভব। কোনও লেনদেন ব্যাকডেটে করতে হলে সফটওয়ার
নির্মাতা ও দেখভাল করা সংস্থারা ব্যাক-এন্ড থেকে অনায়াসে তা করে দেয়। এরজন্য আলাদা
রফা করা থাকে। মোদ্দা ব্যাপারটাই হল, মেলাবেন তিনি মেলাবেন। তাই, সঞ্চিত নগদ
টাকাগুলি বস্তায় বেঁধে ফেলে দিলে বা পুড়িয়ে ফেললেও কিছু যায় আসে না। যেটা ঘটল, 'কালো টাকা'গুলি 'সাদা' হয়েই ব্যাঙ্কে জমা পড়ল।
তাহলে মোদি সাহেব বিমুদ্রাকরণের পথে গেলেন কেন? এত হাঙ্গামার কী দরকার ছিল? পুরনো
কথাগুলো আবার বলব, নাকি আমার আগের লেখাগুলি এই ব্লগেই আরেকবার পড়ে নেবেন? খুব ছোট
করে আরেকবার যদি বলি, তাহলে - এক, উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে বিরোধীদের তাৎক্ষণিক
বোকা বানিয়ে সাময়িক ‘ক্যাশ অ্যাডভান্টেজ’এ থাকা; দুই, অর্থনীতির প্রায় ৯০ শতাংশ
জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংগঠিত ক্ষেত্র ও ছোট শিল্পগুলিকে শায়েস্তা করতে ডিজিটাল
লেনদেনকে বাধ্যত চালু করা, যাতে কর্পোরেটরা ব্যবসাপত্রে দেশের সিংহভাগে চড়ে বেড়াতে
পারে।
উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে উনি সাফল্য পেয়েছেন (তার অবশ্য আরও
নানা কারণ আছে আর এই ব্যাপক সাফল্য উনি আশাও করেননি) কিন্তু ভারতীয় অর্থনীতিকে সম্পূর্ণত
কর্পোরেটের লেজুড় বানাতে এই সস্তা চালে হবে না, ওনাকে গৃহযুদ্ধের পথে এগোতে হবে।
তবে কথায় বলে, অতি চালাকের গলায় দড়ি!