অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
একুশ শতকে মিডিয়ার পরিবর্তন নিয়ে ‘একক মাত্রা’ কতকগুলি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা
প্রকাশ করেছিল। আজ সেই পরিবর্তনের মাত্রা ও অনুষঙ্গ এতটাই তীব্র, বিবিধ ও আচম্বিত
যে তা নিয়ে কিছু একটা ভাবতে ভাবতেই নতুনতর কোনও পরিসরে আমরা প্রবেশ করে যাচ্ছি। কারা
একে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, নব কলেবরের দিশারীই বা কে- এইসব ভাবনারও যেন ফুরসত মিলছে
না। আমরা এসে পৌঁছে গিয়েছি এমন এক বাতায়নে যেখানে মিডিয়ার নতুন নতুন আঙ্গিকের
উদ্ভব সময়ের অপেক্ষা মাত্র, আর তাতে সংযোগ-সওয়ারী হয়ে বার্তা, বিষয় অথবা সংবাদ
আদানপ্রদান করছি।
একুশ শতকের গোড়ায় আশঙ্কা ছিল, টেলিভিশন আমাদের মনকে হরণ করছে। টিভি’র মন যেন হয়ে উঠছে আমাদের স্বপ্ন। আমরা তখন সবে এক দশক পার করেছি উদারিকরণের হাওয়ায়। নানা কিসিমের ভোগ্যবস্তুতে ভরে উঠছে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত এমনকি নিম্ববিত্ত-গরিব মানুষের ঘরদোর। আয়ের থেকে ব্যয় বেড়ে গেলে আছে ‘সহজ কিস্তিতে’ নানাবিধ ঋণ-প্রকল্প। ইএমআই’এর ভরসায় ঝকঝকে দোকানের চকচকে ভোগ্যবস্তুগুলি এসে ঘরের স্থান দখল করে নিচ্ছে। টেলিভিশনের সিরিয়ালের চরিত্রগুলি হয়ে উঠছে আরাধ্য দেবতার মতো। তাদের নাম-মাহাত্ম্য, পোশাকের বাহার হয়ে উঠছে জীবনধারণের অতি-প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন বাস্তব। খবরের কাগজের দিকে তরুণ প্রজন্ম যেন আর ফিরে তাকাতে চাইছে না। ভিজ্যুয়াল-ধর্মই হয়ে উঠছে মুখ্য। ক্যামেরা হাতে অনেকেই বেরিয়ে পড়ছে রাস্তাঘাটে আর টিভি’র দুনিয়ায় হরেকরকম দৃশ্য-বিষয় ছেয়ে ফেলছে নাগরিকের মন-মেজাজ।
ঠিক এই সন্ধিক্ষণেই এসে এবার প্রবেশ নেবে সোশ্যাল মিডিয়ার অবতারদ্বয়- প্রথমে অর্কুট (২০০৪) ও পরে ফেসবুক (২০০৮)। গোটা পটটাই যেন এবার উলটে গেল। যা এতদিন ছিল একমুখি- আপনি শ্রোতা, পাঠক অথবা দর্শক- এবার তা হয়ে উঠল দ্বিমুখি, যেখানে আপনি বক্তা, লেখক ও কুশীলবও। এমন এক উন্মুক্ত, বিনি পয়সার প্ল্যাটফর্ম যে সামাজিক পরিসরে আদপে গড়ে উঠতে পারে, তা দশ বছর আগে গড়পড়তা মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি। আর তা হতেই শুরু হয়ে গেল তুলকালাম কাণ্ড- দেশে ও বিদেশে। ফেসবুকের দেওয়াল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল মানুষের আপন আত্মিক বার্তা- জন্ম নিল ঐতিহাসিক তাহরির স্কোয়ার, কিছুদিন পরে শাহবাগ। এ দেশেও ‘লোকপাল’এর দাবিতে দিল্লিতে আন্না হাজারের আন্দোলন, রাজ্যে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঐতিহাসিক কালজয়ী পর্ব। তখনও সোশ্যাল মিডিয়ার নেতিবাচকতা ততটা প্রকাশ পায়নি, বহু সরকারও তাদের অবজ্ঞা করছে। শুরু হয়েছে টেলিভিশনের পিছিয়ে পড়ার কাল। খবরের কাগজ আগেই স্তিমিত হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্মগুলি হয়ে উঠল লেখা, পড়া, দেখা ও শোনার এক চণ্ডীমণ্ডপ। ইমেল, অর্কুট, ফেসবুক’এর পিছু পিছু ধেয়ে এল হোয়াটসআপ, ইন্সটাগ্রাম, ট্যুইটার ও ইউটিউব’এর দঙ্গল।
বলাই বাহুল্য, এই সর্বজনীন ও সার্বিক পরিবর্তন এ তাবৎকালের সমস্ত হিসেবপত্রকে ওলটপালট করে দিল। তা শুধু মিডিয়ার খোলনলচে বদলে দেওয়াই নয়, রাজনীতি, অর্থনীতি, শাসনব্যবস্থা মায় রাষ্ট্রের ভূমিকাকেই বড়সড় প্রশ্নের মুখে ফেলে দিল। উপরন্তু, সোশ্যাল মিডিয়া ও ভার্চুয়াল দুনিয়ার কর্পোরেটকুল ক্রমশই হয়ে উঠল এমন এক সর্বংসহা যা সাবেক রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলল। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আজকের মিডিয়ার বাস্তবতাকে আমরা অবলোকন করতে পারি।
প্রথমত, ‘গোদি মিডিয়া’ বলে আমরা বিগ মিডিয়ার কুৎসিত স্বার্থবাহী মিডিয়াকুলকে যতই গাল পাড়ি না কেন, বাস্তবতা হল, এদের প্রভাব ও কার্যকারিতা প্রায় শূন্যের ঘরে এসে ঠেকেছে। অর্ণব গোস্বামী জাতীয় সঞ্চালকেরা যতই চিল-চিৎকার জুড়ে গালিগালাজ ও নৌটঙ্কি করে আমজনতার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করুন না কেন, চিড়ে আর ভিজছে না। ইতিমধ্যেই এসে গেছে নানা ধরনের ইউটিউব চ্যানেল যেখানে এক বা একাধিক ব্যক্তিরা মিলে ভিডিও-ভাষ্য বানিয়ে ও তা পেশ করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে গেছেন। যেমন, এই মুহূর্তে চোখ বুজে ধ্রুব রাঠি, সাক্ষী যোশী, আকাশ ব্যানার্জি, অজিত অঞ্জুম সহ বহু সঞ্চালকের নাম করা যায় যাদের ইউটিউব-ভিডিও’র জনপ্রিয়তা সমস্ত টিভি চ্যানেলগুলিকে রীতিমতো লজ্জায় ফেলে দেবে। কারও সাবস্ক্রিপশন ৫ লক্ষ তো কারও বা ৫০ লক্ষ। ‘The Lallantop’ বলে একটি হিন্দি ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রিপশন তো ১ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এনারা যখন কোনও বিষয়ের ওপর কোনও ভিডিও আপলোড করেন, দেখা যায়, পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেই ভিডিও’র ভিউয়িং ১০,০০০ কি ২০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। আর ভিডিও’র নিচে পড়তে থাকে অগুনতি মন্তব্য যা থেকে স্পষ্ট হয় যে এঁদের বক্তব্যকে মানুষ সমাদর করছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমালোচনা ও গালিগালাজও থাকে, যা উপাদেয় ও স্বাস্থ্যকর। এনারা মূলত দেশের সমসাময়িক রাজনীতি, অর্থনীতি, মানুষের নানাবিধ আন্দোলন, নির্বাচন এইসব নিয়েই নিজেদের মতামত রাখেন, কখনও কখনও প্যানেল-আলোচনা বা সাক্ষাৎকারও থাকে, কখনও ঘটনাক্ষেত্র থেকে বাস্তব প্রতিবেদন।
বাংলা ভাষাতেও কতকগুলি চ্যানেল বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। যেমন, ‘হঠাৎ যদি উঠল কথা’ এবং ‘এন কে ডিজিটাল’। এরা ঘটতে থাকা নানাবিধ বাস্তবতা নিয়ে দশ-পনের কি বিশ মিনিটের ভাষ্য তৈরি করে ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করে দেন। এদেরও সাবস্ক্রিপশন লাখের ওপর। মাস দুয়েকের বেশি হল, ‘শত ফুল’ নামে নতুন একটি ইউটিউব চ্যানেল ভিন্ন আঙ্গিকে এমন এক উপস্থাপনা হাজির করেছে যার দ্রুত জনপ্রিয়তা বাংলা ভাষী দর্শকদের মধ্যে নিঃসন্দেহে এক নতুন প্রবাহের জন্ম দেবে। তা এই অর্থে যে, শুধুমাত্র বাস্তব ঘটনাবলীকে আশ্রয় করে ভাষ্য-নির্মাণ নয়, বরং ঈষৎ গভীরে প্রবেশ করে চারপাশে বদলে যাওয়া পরিসর ও নতুন চিন্তার ভূমিকে উদ্ভাসিত করা। এই কাজ নিঃসন্দেহে এক চ্যালেঞ্জ। এর সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে বাংলা ভাষী মানুষের মৌলিক চিন্তার ক্ষেত্রটির উর্বর হয়ে ওঠার প্রসঙ্গ।
দ্বিতীয়ত, একাডেমিক পণ্ডিত ও পশ্চিমমুখি নানা ধরনের আঁতেলদের ভাবনাচিন্তার পাশাপাশি সাধারণ মানুষজনও যে মৌলিক ও উন্নত ভাবনায় জারিত, তা মিডিয়ার এই নতুন পরিসরে শুধুমাত্র যে জানা গেল তাই নয়, এই মানুষেরা তাঁদের বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা ও বিচক্ষণতায় বহুজনের কাছে ভরসাযোগ্যও হলেন। এতদিন প্রভাবশালীরা ‘যত্তসব’ নচ্ছার ও ফ্যাতাড়ুদের বড় জোর কবিতা লেখা অবধি সহ্য করেছেন, এমনকি কবিতার জগৎ’টা মূলত এদেরই- এই পর্যন্ত মান্যতাও দিয়েছেন। আরও সামান্য প্রসারিত করে গল্প-উপন্যাস অবধিও আসতে বলেছেন। কিন্তু প্রবন্ধ? সমাজ নিয়ে ভাবনাচিন্তা? নৈব নৈব চ! অলিখিত বিশ্বাস হল, পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড়সড় ছাপ না থাকলে সমাজ-ভাবনায় হাত দেওয়া যাবে না! অথচ মজার ব্যাপার, সমাজ নিয়ে যারা সোরগোল ফেলেছেন, সমাজকে ওলটপালট করে দিয়েছেন, তাদের কারও পেছনে কিন্তু তেমন বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয় বা একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের ছাপ্পা নেই। বরং উল্টে, তাঁদের চিন্তাভাবনাই আজ বহু একাডেমিক পাঠ্য ও গবেষণার বিষয়। এমনতর নাম পরপর আসতেই থাকবে- স্বামী বিবেকানন্দ, গান্ধী, সুভাষচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, জয়প্রকাশ নারায়ণ, চারু মজুমদার প্রমুখ। এনারা অনেক বড় পরিধি জুড়ে ব্যাপ্ত। স্বভাবতই, ছোট পরিধিতেও এরকম নাম-না জানা বহু মানুষ ছড়িয়ে আছেন। আজকের মিডিয়া সুযোগ দিয়েছে এইসব অজানা মানুষের চিন্তাভাবনাকেও বহুজনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার, স্বীকৃতি পাওয়ার এবং গৃহীত হওয়ার। বলতেই পারি, চিন্তার একাধিপত্যের ওপর এ এক সবল আঘাত।
তৃতীয়ত, সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়াই এখন রাজ করবে, অন্তত কিছুকাল তো বটেই। এর অনেক টানাপোড়েনও আছে। কিন্তু আপাতত এর দুটি অভিঘাত অতীব তীব্র। এক, সাবেক মিডিয়ার যে ঘরানা ছিল- খবরের কাগজ-টিভি ইত্যাদি সহযোগে লেখক-পাঠক এবং কুশীলব-দর্শক প্যাটার্নে একমুখি গ্রহণের একটি সম্পর্ক- তা আজ অবসানের পথে। এটি যদি প্রথম অভিঘাত হয় তাহলে দ্বিতীয়টি হল, লেখক ও পাঠক এবং কুশীলব ও দর্শক এক দেহে লীন হয়ে এক সর্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করেছে যেখানে যে লেখক সেই পাঠক অথবা যে কুশীলব সেই দর্শক (ও তদ্বিপরীত)। নতুন সৃষ্ট এই পরিসরটি শুধুমাত্র বোধ ও চর্চার জগতেই আমূল পরিবর্তন আনেনি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতির খোলনলচে’টাকেই বদলে দেওয়ার পথ ধরেছে। তাই, গোদি মিডিয়া যতই যা হল্লা করুক, অথবা গেরুয়া আইটি সেলের মিথ্যাচার চলুক, আজ ভবী আর অত সহজে ভোলার নয়! অবশ্য, কথাগুলি যত সহজে ও অনায়াসে পেশ করলাম, বাস্তবতা তেমন নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু, প্রবণতাটি স্পষ্ট।
চতুর্থত, তাহলে কি আমাদের পাঠ, দর্শন, শ্রবণ সবই ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমেই হবে? সোশ্যাল মিডিয়াই কি আমাদের বিচরণের একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠবে? এমনটা বললে তা হবে অতি-সরলীকরণ। প্রত্যেক মিডিয়ার নিজস্বতা আছে, আকর্ষণ ও বিনোদন আছে। যখন চলচ্চিত্র এসেছিল, অনেকে ভেবেছিলেন নাট্যশালা বুঝি উঠে যাবে। ঠিক একইভাবে, টিভি’র আগমনের সময় বহুজনে চলচ্চিত্র শিল্পের অশনি সঙ্কেত দেখেছিলেন। কিন্তু অমন সরলরেখায় কিছু হয়নি। সব মাধ্যমই তার নিজ বৈশিষ্ট্য গুণেই টিকে থাকে; কিন্তু হ্যাঁ, অবশ্যই নতুন মাধ্যমের আগমনে পুরনো মাধ্যমে কিছু পরিবর্তন আসে। যেমন, রেডিও’র সেই পুরনোকালের ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ স্টেশনগুলির আর জনপ্রিয়তা নেই, কিন্তু এফএম’এর হাত ধরে রেডিও আবার পুনর্জাগরিত। এও বাস্তব, বহু ছবিঘর আজ বন্ধ হয়ে গেছে, আবার নতুন ধরনের ছবিকক্ষের উদ্ভবও ঘটেছে। আজ ভার্চুয়াল জগতে সোশ্যাল মিডিয়ার উত্থানে ও সেখানে জনবিস্ফোরণের কারণে, মনে হতেই পারে যে সাবেক মাধ্যমগুলি বুঝি অচল হয়ে গেল। কিন্তু বাস্তবতা সে কথা বলে না। এত চেষ্টা করেও তো ই-বুক এখনও মুদ্রিত বইয়ের বিকল্প হতে পারেনি। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম জনপ্রিয় হলেও ভাল ছবি দেখতে এখনও তো আমরা সেই ছবিঘরেই যাই (হতে পারে আইনক্স)! নাটকের মঞ্চও তো অদৃশ্য হয়ে যায়নি।
তাই আছে, বহু মাত্রিকতার মাধুর্য, আকর্ষণ ও বিষয়াদি আছে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া যে একমাত্রিক দাতা-গ্রহীতার কৌলিন্য হরণ করে তাকে সর্বজনীনতা দিয়েছে- গ্রামের কোণে পড়ে থাকা অজানা মেয়ের প্রতিভাকে বিশ্বের দরবারে পেশ করার সাধ্যি, দেহাতি কৃষকের ভাবনার গভীরতায় লুকোনো সমাজ-উন্নয়নের অভিনব পথকে উদ্ভাসনের সুযোগ- তাকে অস্বীকার করি কী উপায়ে?