Tuesday, 10 August 2021

'আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব'

স্বাধীনতার ৭৫ বছর 

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত


স্বাধীনতার ৭৫ বছরে আমাদের পদার্পণ। ব্যক্তি জীবনে সময়টা অনেক হলেও জাতি বা দেশের জীবনে অধিক নয়। তবে তা নিছক কমও নয়। লাল চীনের কথা নয় বাদই দিলাম, এই তো সেদিন স্বাধীন হল বাংলাদেশ। সে তো দিব্য এগিয়ে চলেছে, অনেক বিষয়ে ভারতবর্ষের চেয়েও দ্রুত তার প্রগতির হার। সুখাংকের বিচারে অনেক এগিয়ে ছোট্ট দেশ ভূটান। আমাদের জীবনে না এল সুখ, না সমৃদ্ধি, না দূর হল সম্পদের অসম বন্টন। দুর্নীতির চাকা টগবগিয়ে ছুটছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আয় সবেতেই পিছিয়ে থাকা এই মহান দেশের নাগরিকের যেন ধর্মই মহান। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া এই দেশ এখনও ভুলতে পারছে না সেই স্মৃতি, যাবতীয় শত্রুতার কেন্দ্রে তার যেন পাকিস্তান।

ক'দিন আগেই গেছে ২২শে শ্রাবণ। সেদিন এই দুনিয়া ছেড়ে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলেন আমাদের প্রিয় কবি। ফ্যাসিবাদ-বিরোধী দুনিয়ার অন্যতম সেরা এই দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ স্বপ্ন দেখেছিলেন এক মহান ভারতবর্ষের, সর্বজনবাসযোগ্য এক শান্তির আবাস। এমন স্বপ্ন দেখেছিলেন দেশের পিতা গান্ধীজীও। পেলাম কী? হিন্দু রাষ্ট্র? 

তখনও দেশের প্রধান নেতৃত্ব বা সাধারণ মানুষ পাকিস্তান বা দুই ধর্মের দুই পৃথক দেশের কথা স্বপ্নেও দেখেননি, ভাবেনওনি। যদিও এই দেশের সর্বত্র সব ধর্মের সব মানুষ পৃথক অস্তিত্ব নিয়ে শান্তিতে থেকেছেন।  সবাই সব ধর্মকে সম্মান জানিয়েছেন। আমরা দেখেছি মহাজাতি সদনের প্রতিষ্ঠা, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, দেখেছি দেশ গড়তে দুই ধর্মের মানুষের যৌথ উদ্যোগের লড়াই। দেখেছি সিপাহী বিদ্রোহ থেকে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সব ধর্মের সব মানুষের লড়াই। 

ওদিকে বিশ্বযুদ্ধ থামল। একদিকে আইএনএ অন্যদিকে 'ভারত ছাড়ো আন্দোলন'- এই দুয়ের চাপে ইংরেজরা এই উপনিবেশ ছাড়তে বাধ্য হল। দেশ স্বাধীন হল। তবে, তাদের কূট চালে ধর্মের নামে এক নয়, দুটো অঙ্গ (পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্থান) হারিয়ে, বেশ কিছু মানুষ, বেশ কিছু জমি ইত্যাদি হারিয়ে পেলাম নতুন ভারতবর্ষকে। যে ভারতবর্ষ থেকে হারিয়ে গেল ভারতীয় সংস্কৃতির মূল সুর। ভিন্ন হল দেশ, ভিন্ন হল সংস্কৃতি। বেড়ে উঠল অবিশ্বাস, ধর্মীয় সংকীর্ণতা। তারপর? খণ্ডযুদ্ধ লেগেই  রইল বা রয়েছে, যেমন লেগেই রয়েছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অসাম্যর মতো অসুখগুলো। এসব ছিল, অনুকূল হাওয়ায় যেন পল্লবিত হল। অনুকূল হাওয়া কেমন?

সংবিধান মেনে চললে নিশ্চয় মানতে হয় যে এই দেশের কাঠামোটা যুক্তরাষ্ট্রীয়, কিন্ত বাস্তব পরিস্থিতি যা তাতে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। বস্তুত এমন সংশয় অনেকেরই। তবে, এই পরিস্থিতির জন্য আমরা দোষ দেব কাকে? আমাদের ধারণাকে, আমাদের চাহিদাকে, না সংবিধানকে? আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের গঠন দেখে কিছু দেশ বুঝি উৎসাহিত হয়ে একদা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় আগ্রহী হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কী? এই ব্যবস্থার চালিকাশক্তি মূলত দু'টি: এক, রাজনৈতিক ও দুই, সামাজিক। দুয়েরই মধ্যে কখনও স্পষ্ট,  কখনও অস্পষ্ট হয়ে খেলা করে অর্থনীতি। তবু পৃথিবীর মাত্র ২০ শতাংশের সামান্য বেশি দেশ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় আছে (অবশ্য মনে রাখা দরকার যে, পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ মানুষ রয়েছে এই ব্যবস্থায়)। তাদের কতজন স্বেচ্ছায় এই ব্যবস্থা বেছে নিয়েছে সে এক ভিন্ন প্রসঙ্গ। মোদ্দা কথা: কর্তা বা দেশনায়করা বেছে নিয়েছেন তাই এই ব্যবস্থার জনপ্রিয়তা। দেশনায়করা এই ব্যবস্থা বেছে যে নিয়েছেন তা মোটেই অকারণ বা অযৌক্তিক নয়। এই ব্যবস্থায় বেশ কিছু রক্ষাকবচ আছে যা যে কোনও ধর্মের, যে কোনও বিত্তের মানুষকে বিশেষত সংখ্যালঘু, দুর্বল আদিবাসীদের কিছুটা হলেও ভরসা জোগায়। তাদের জন্য রয়েছে সংরক্ষণ বিধি, নানাবিধ কাজ, স্বাস্থ্য পরিষেবা ও শিক্ষার সুযোগ। তবুও অশান্তি, স্বার্থের সংঘাত। কেন? দেখা যাক সাম্প্রতিক ঘটনার আলোয়। বেছে নিচ্ছি ৪২তম সংবিধান সংশোধন, তাকাই আরও সাম্প্রতিক ঘটনার দিকে- জিএসটির প্রচলন, বিমুদ্রাকরণ, শ্রমবিধি ইত্যাদি। পাশে রাখি শিক্ষানীতি। 

১৯৭৬ সাল। তখনও দেশে জারি রয়েছে আপৎকালীন অবস্থা, বকলমে সঞ্জয় গান্ধির একনায়কতন্ত্র।  সে সময়ে এল ৪২তম সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব বা বিল। লোকসভা তো সম্মতি দিলই, রাজ্যে রাজ্যে বিধানসভাগুলিও প্রায় সকলে মেনে নিল সে সংশোধন। আইনে পরিণত হল সেই বিল। সংবিধান সংশোধন আগেও হয়েছে, পরেও হয়েছে, কিন্তু এমন সর্বনাশা সংশোধন কেউ আগে দেখেনি বা ভাবেনি। এই সংশোধনে কার্যত সংবিধানের চরিত্র তথা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাকেই বদলে দেওয়া হয়। কিছু রাজ্য বাধা দিয়েছিল, তবে তাদের সে বাধা উড়ে যায় সংখ্যার ধমকে চমকে। আরও বেশি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় এই  সংশোধনীর সুবাদে। জনতা সরকার সংশোধনের সুযোগ পেয়েছিল, সংশোধন  তারা করেও, কিন্তু তা তারা করে সংশোধনের মূল সুর না বদলে। এর অর্থ দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অগ্রাহ্য করা। অবশ্য সংবিধান রচয়িতারা এই দেশ যে একটা  যুক্তরাষ্ট্র তা বলেননি স্পষ্ট ভাবে; বলেছিলেন এই দেশ 'নানা প্রাদেশিক রাজ্যের সমাহার'। কিন্তু, কার্যক্ষেত্রে বলবৎ করেন এক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। বর্তমানে  প্রশ্ন তা নিয়েই।

বিমুদ্রাকরণ করে কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণা ছিল এর ফলে নাকি উদ্ধার হবে 'কালো টাকা, চাঙ্গা হবে দেশের অর্থনীতি '। হয়নি তা, অন্তত সাধারণ মানুষ তার সুবিধা পাননি কিছুই। উলটে বহু মানুষের প্রাণ গেছে, কাজ গেছে। 

জিএসটি যে কেবল মধ্যবিত্ত মানুষের বিপদ বাড়িয়েছে তা নয়, এই ব্যবস্থায় সব শ্রেণির মানুষের জীবনযাপন দুরূহ হয়ে উঠেছে। একে আমরা রাজ্যের অধিকারে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপও বলতে পারি না, কারণ এই ব্যবস্থা তো অঙ্গরাজ্যগুলির সম্মতিতেই চালু হয়েছে, কোনও রাজ্য সরকার আপত্তি জানিয়েছে বলে জানি না।  

শিশু শ্রম তথা শ্রমবিধিতে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তাতে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ, শিশু শ্রমিক বেড়েছে, উঁকি মারছে দাসপ্রথা। শিশু সুরক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। 

শিক্ষানীতি মানুষের শিক্ষার অধিকারকেই যেন হাস্যকর এক মৌলিক অধিকার বলে তুলে ধরেছে। সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘিত হয়েছে এই শিক্ষার অধিকার আইনে।

মৌলিক  বা মানবাধিকার যেন এ কালে এ দেশে দূর আকাশের তারার আলো। মানবাধিকার নিশ্চিত হয় গণতান্ত্রিক কাঠামো দৃঢ় হলে; গণতান্ত্রিক কাঠামোর নিশ্চয়তা আসে সংবিধান থেকে, যদি সংবিধানের ওয়াচডগ বিচারব্যবস্থা, সংবাদমাধ্যম যথাযথ দায়িত্ব পালন করে। তারা যে তা করে না তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলে ফাদার স্ট্যানের বিচারবিভাগীয় হত্যায়, প্রমাণ মেলে কেন্দ্রে আসীন সরকারি দলের প্রতি পক্ষপাতিত্বে। অন্য 'স্তম্ভ'গুলিও কাজ করে নিজ নিজ শিরদাঁড়া বেচে কেবল সরকারকে তুষ্ট করতে। 

সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি ছিল যে, রাষ্ট্র সুশিক্ষা ও কার্যকর শিক্ষার আয়োজন করবে। তা যে হয়নি তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আছে বহু। অপ্রত্যক্ষ প্রমাণও কিছু কম নয়। ওদের বেড়ে ওঠা লোভ, আত্মসম্মানের অভাব এই সবই তো অশিক্ষার নিশ্চিত প্রমাণ। নিজেদের দোষই বা কম কী? এই দেশে এখন যে শক্তি কেন্দ্রে সরকার চালাচ্ছে তারা এল কোথা থেকে? এরা তো আমাদেরই ভোটে নির্বাচিত। তারা সংবিধানের শর্তগুলি মানছে না কৌশলে এবং তাদের সে কৌশলে সাহায্য করছেন যারা তারা তো আমাদেরই লোক বা প্রতিনিধি। অন্য শক্তিগুলিও নির্ভরযোগ্য কী? অতীতে তারা যে যেখানে ক্ষমতা পেয়েছে সেখানেই তারা সাধ্যমতো মানুষের বাঁচার অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে। মানবাধিকার খর্ব করতে উদ্যত হয়েছে। 

মাঝে মাঝে দেখি এরা ওদের 'ব্রুট মেজরিটি'র জোরে কিছু জিনিস চাপিয়ে দেয়। যেমন এনআরসি-সিএএ বা কৃষি আইন। স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাজার তথা কর্পোরেট শক্তির সঙ্গে তাদের নৈকট্য।  কিন্তু,কর্পোরেট শক্তি যে বিরোধী শক্তিকেও যথেষ্ট তেল দেয়! আমরা কোন পথে যে চলি! কানের পাশে দিবারাত্র ঢোলক বাজায় দুর্নীতিবাজ অশিক্ষিত কিছু হিন্দুবাদী, সামনে এক স্বৈরাচারী সরকার, পেছনে পেগাসাস! এ তো আমার সেই যুক্তরাষ্ট্র নয়, নয় আমার সেই ভারতবর্ষ।


4 comments:

  1. বিরোধীরা যে আসলে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ 2004-2014 সময়ে 2003 এর CAA আইন বাতিল না করাই তার প্রমাণ। আসাম NRC র বিরোধিতা কোন দল করেনি (একমাত্র cpiml করেছিল)। যারা কাগজের ওপর ভিত্তি করে মানুষকে বেনাগরিক করার প্রকল্পে বিরোধিতা না করে, নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার পর কোন হিউম্যান রাইটস থাকবে না জেনেও, সেই বিরোধীদের ফ্যাসিবাদী বলা যাবে না কেন? সরকার বিরোধী দু পক্ষই সমান।

    ReplyDelete
    Replies
    1. একদম ঠিক বলেছেন । 👊🏼

      Delete
  2. অশোকেন্দুবাবু বেশ ভালো লিখেছেন । 👌🏼👍🏼

    ReplyDelete
  3. প্রাসঙ্গিক আরেকটি লেখা (ইচ্ছুকরা পড়ে দেখতে পারেন):
    👇🏼👇🏼👇🏼

    https://www.anandabazar.com/editorial/essays/after-70-years-of-independence-the-state-of-india-defeats-queens-government-in-term-of-opression/cid/1297742

    ReplyDelete