তিনি থাকুন তাঁর মতোই
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
আমরা যারা নিতান্তই
পিএনপিসি করা, সবজান্তা শিরোমণি, অকালপক্ক, খাপ পঞ্চায়েত বসানোয় ওস্তাদ, কুচুটে বাঙালি, তারা সক্কলেই অন্তত একটা
ব্যাপারে খুব পাকা মস্তিষ্ক: পুরে দেওয়া। যেমন, জেলে পুরে দেওয়াটা বেশ আমোদের। কিন্তু সে ক্ষমতা তো
আবার আমার-আপনার নেই। পুলিশ তেমন ‘নিন্দেমন্দ’ কাউকে যদি জেলে পুরে দেয় তো আমাদের
ভারী উৎসাহ। কিন্তু বাকী ‘পুরে দেওয়া’গুলোতে আমরা বেশ সিদ্ধহস্ত। কেউ যদি কম কথা
বলে, তাকে আমরা দেমাকির ঘরে পুরে দিই, কেউ যদি একটু বেশি এগিয়ে এসে কারও সাহায্যে
লাগে তো তাকে ‘নির্ঘাৎ ধান্দাবাজি’র খোপে ফেলতে আমাদের কালবিলম্ব হয় না, কেউ যদি ‘সর্বজন-স্বীকৃত’র
বাইরে অবস্থান করে সে নিশ্চিত পাগল অথবা সন্দেহজনক। আর রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক
মতামতকে সর্বাগ্রে পার্টির খোপে পুরে দিতে আমরা আরও তৎপর। সাধে কি আর রবীন্দ্রনাথ,
তাঁর নোবেল প্রাপ্তির পর কলকাতা থেকে ট্রেন ভাড়া করে শান্তিনিকেতনে সংবর্ধনা দিতে আসা
তাঁর নিন্দুকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আজ আমাকে দেয় আপনাদের সম্মাননা আমি ওষ্ঠ
অবধি তুলতে পারি মাত্র, তাকে পান করার শক্তি আমার নেই।
অভিজিৎ
বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল প্রাপ্তির পর দেখা গেল একশ্রেণি বাঙালির সেই চির অভ্যেস
আবার চাগাড় দিয়ে উঠল। রবীন্দ্রনাথ, অমর্ত্য সেন তাঁদের নোবেল প্রাপ্তির আগে যতটা বাঙালি
সমাজে পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন, অভিজিৎ তা একেবারেই নন। হঠাৎ করে এমন এক প্রায়-অজানা
বাঙালি নামের সঙ্গে নোবেল ঘোষণা জড়িয়ে যেতেই প্রাথমিক হতচকিত হয়ে পড়া একটা হল বটে
কিন্তু বাঙালি যেহেতু বড় সেয়ানা তাই জানে, হাতের মুঠোয় গুগল থাকতে ‘ফলস খাওয়াটা’ অত অস্বস্তির কিছু নয়। নিমেষে সকলে জেনে গেলেন, অভিজিৎ কাহারে কয় আর তার কত ও
কী কী প্রকার। ব্যস। শুরু হয়ে গেল পুরে দেওয়ার খেলা। এক পক্ষ তাকে পুরে দিলেন বিজেপি
বিরোধী শিবিরে, প্রায়-বামপন্থী সার্টিফিকেটও জুটে গেল তাঁর তো অপর পক্ষ সেটাই সত্য ধরে
নিয়ে তাঁর ‘ন্যায়’ নীতিকে জনগণ প্রত্যাখান করেছে ও তিনি দুইবার বিবাহিত, উপরন্তু
তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী বিদেশি, অতএব প্রকারান্তরে নীতিভ্রষ্ট, নিদেনপক্ষে কংগ্রেসি বা বামপন্থী
খোপে ফেললেন তাঁকে। কেউ কেউ আবার এক কাঠি ওপরে উঠে নিজেদের বিজ্ঞতার জানান দিতে
এমনও বললেন যে দারিদ্রই তাঁকে মহার্ঘ করেছে।
এবার যেই প্রধানমন্ত্রী
মোদির সঙ্গে অভিজিতের সাক্ষাৎ হল, বয়ানটি হয়ে যেতে শুরু করল উলটো। এবার আরেক দফা
হতভম্ব হয়ে পড়ার পালা। যারা তাঁকে দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে খোঁটা দিচ্ছিলেন তাঁরা এবার হয়ে
পড়লেন তাঁর গুণগ্রাহী এবং ভারতীয় অর্থনীতি পরিকল্পনায় তাঁর সাহায্য নেওয়ার কথাও
ঘোষণা দিয়ে দিলেন। আর সেই প্রথম পক্ষ যারা তাঁর দারিদ্র দূরীকরণ কর্মযোগে বৈপ্লবিক
সম্ভাবনা দেখছিলেন ও মোদি বিরোধী এক প্রবল প্রতিপক্ষকে খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁরা এবার
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হয় খানিক চুপ করলেন বা আসলে তো তিনি পুঁজিবাদের পক্ষেই কাজ
করছেন এইসব যা হোক আমতা আমতা করে বলে আপাতত রণে ভঙ্গ দিলেন। আর এসবের ফাঁকেই অভিজিৎ পরিষ্কার
জানিয়ে দিলেন, তিনি একজন আপাদমস্তক পেশাদার এবং যে কোনও দল বা সংস্থা তাঁর মতামত
চাইলে তা তিনি দিতে রাজী। বিপ্লব ও হিন্দুত্ব দুইই সাঙ্গ হল, নটে গাছটিও মুড়লো।
এবার তিনি
নিশ্চিন্তে চলাচল করুন, স্বাধীন মতে কাজ করুন এবং যা মনে করেন তাইই লিখুন, বলুন।
বিমুদ্রাকরণ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে বা ভারতীয় অর্থনীতির খারাপ অবস্থা সম্পর্কে বললেই
তিনি যেমন কংগ্রেসি বা বামপন্থী হয়ে যান না, তেমনই আমলাতন্ত্রকে মোদি সবক শিখিয়ে
ভালই করছেন বললেও তিনি বিজেপি বা হিন্দুত্ববাদী হয়ে যান না। তিনি অর্থনীতির একটি
গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নতুন ভাবে কাজ করছেন, সে কাজের ভালমন্দ আছে, তিনি তাঁর
বহুমূল্য কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন। কলকাতার ছেলে, আমাদের ঢঙে চলেন, বলেন,
বাঙালিয়ানায় পুরোদস্তুর, আমাদের গর্বের কথা। তাঁর কাজে অনেক মানুষের উপকারও হয়েছে,
হচ্ছে, সেও বড় কথা। তাঁর কাজের সমালোচনাও গড়ে উঠবে, তাও খুব স্বাভাবিক। কিন্তু
তাঁকে স্রেফ আপনাদের খেয়ালে গড়া রাজনীতির খোপে পুরে দেবেন না। কারণ, আজকের
রাজনৈতিক অর্থনীতির ভুবনে অমন সাদা-কালোয় গড়া কোনও নির্দিষ্ট খোপও কিছু নেই।
বেশ ভালো হয়েছে লেখাটা। মৈত্রীশ ঘটক একটি লেখায় খুব সহজ ভাবে অভিজিৎ এর কাজ এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন ও অর্থনীতি শাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কীভাবে বিচার করতে হবে সেটাও লিখেছেন।
ReplyDeletehttps://openthemagazine.com/columns/lies-behind-abhijit-banerjees-nobel/
ReplyDeleteekdom thikthak likhechho.
ReplyDeleteএকমত। অবশ্যই।
ReplyDeleteএই সময়ের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন একটাই। এই তত্ত্বকে নির্ভীক ও পক্ষপাতহীন ভাবে প্রয়োগ শাসকেরা করবেন কি, যাতে একবগ্গা খয়রাত, আমলাতন্ত্রের ফাঁদ ইত্যাদি পেরিয়ে তলার মানুষের হাতে কিছু পড়ে!
Sahaj kotha soja sapta - bujhle hoy, ne bujhleo kheti nei
ReplyDelete