Monday, 31 January 2022

দিলীপ কুমার রায় ১২৫

'প্রেম আমার সাধন জানি'

শোভনলাল চক্রবর্তী


১৯৫০ সালের ৫ ডিসেম্বর। মনের আনন্দে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করে বেড়াচ্ছেন মানুষটি। আশা, সেই অর্থ সমর্পণ করবেন গুরুর পায়ে। সেই ফাঁকে আরও একবার দর্শন ঘটবে। আরও একবার ঋষি অরবিন্দ তাঁর দিকে চেয়ে হাসবেন। প্রাণ জুড়োবে। গুরুর অসুস্থতার কথা জানা নেই তাঁর।সকালে গঙ্গাস্নানে এসেছেন কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটে। স্নান সেরে মন্দিরে প্রণাম করছেন। সকাল সাড়ে সাতটায় রেডিও'র খবরে শুনতে পেলেন অপ্রত্যাশিত সংবাদ। ঋষি অরবিন্দ দেহত্যাগ করেছেন। 

পা থেকে মাথা পর্যন্ত রক্ত চলাচল কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। তিনি কি ঠিক শুনলেন! তাঁর সাধনমার্গের পথপ্রদর্শক আর নেই? দুঃখে, অসহায়তায় তিনি আত্মহারা ততক্ষণে। কোনও মতে চেপে বসলেন পুদুচেরির (তখন পন্ডিচেরি) প্লেনে। এসে দেখলেন, গুরুর দেহ তখনও শায়িত রয়েছে আশ্রমের ঘরে। একবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন দ্রুত।মনে সেই যে নিদারুণ আঘাত লাগল, সেই ক্ষত আর কোনও কিছুতেই শুকলো না। অরবিন্দের নশ্বর দেহের অনুপস্থিতি ভুলতে পারলেন না। মন অশান্ত হল। সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটল তাঁর বিগত তিরিশ বছরের ঠিকানাস্বরূপ আশ্রমের সঙ্গে। শ্রীমার প্রতি এক নিদারুণ অভিমান থেকে দূরে সরে গেলেন। চললেন স্বেচ্ছা নির্বাসনে।

তিনি দিলীপকুমার রায়। নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র। কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। নিরাশ্রয় দিলীপকে আশ্রয়স্থলে পৌঁছে দিলেন তাঁকে গুরু হিসেবে বরণ করা ইন্দিরা দেবী। তৎকালীন মাদ্রাজে নিজের ভগিনী ও ভগ্নিপতির কাছে নিয়ে গেলেন। তারপর মহারাষ্ট্রের বিশিষ্ট ধনী চুনিলাল মেহতা দিলীপকুমারকে আহ্বান জানালেন পুনা'য় তাঁর বাংলোয় অতিথি হয়ে থাকার জন্য। ইন্দিরা, তাঁর শিশুপুত্র প্রেমলকে নিয়ে দিলীপকুমার আশ্রয় নিলেন সেখানে।‘হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা’— এ বিশ্বাসে কখনও ছেদ পড়েনি। গুরু থেকে শুরু করে শিষ্যার হাত ধরে ক্রমশ ঈশ্বরকে উপলব্ধির সাগরে পাড়ি দিয়েছেন। সে পথে বৈতরণী হয়েছে অজস্র গান, সুরধ্বনি।

দিলীপকুমারের কণ্ঠভাব আর সুরের মাদকতায় অনেক ভক্ত-অনুরাগীর দল জুটে গেল পুনা'য়। ক্রমে ক্রমে সেখানে তিনি হয়ে উঠলেন ‘দাদাজী’। বাংলার ঘরোয়া ‘মন্টুদা’ ঢাকা পড়লেন ঘন শ্মশ্রুতে। 

১৮৯৭ সালের ২২ জানুয়ারি কলকাতায় জন্ম। ছয় বছর বয়সে মা সুরবালাকে হারায় বালক দিলীপকুমার। তারপর থেকে পিতা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কাছেই বেড়ে ওঠা বালক দিলীপ আর বালিকা মায়ার। পিতা আদর করে দুই ছেলেমেয়েকে দেখিয়ে বলতেন— এই হল যথা আর এই আমার সর্বস্ব। ছোট থেকেই বাবার কাছে লেখনি আর সুরের শিক্ষা পেয়েছেন। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পারিবারিক পরিবেশ। পিতামহের মতোই ওস্তাদি হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের অনুরাগী ছিলেন। পিতার গাওয়া বাংলা গান তাঁকে আকৃষ্ট করত না। মাঝে ঘটল ছন্দপতন। দিলীপের যখন মাত্র ষোলো বছর বয়স, পিতৃবিয়োগ ঘটল। এর পরেই ধীরে ধীরে বাংলা গানকে হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের সমকক্ষ করার ঝোঁক চাপে দিলীপের মাথায়। 

প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে প্রথম শ্রেণির স্নাতক হয়ে পড়তে গেলেন বিদেশে। সেখানে গণিতের পাশাপাশি শিক্ষা নিলেন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের। শিখলেন পিয়ানো বাদন। বার্লিনে সঙ্গীতের সূত্রে ভ্রমণের পাশাপাশি জার্মানি ও ইতালিতে সঙ্গীত ও ভাষা শিক্ষা। সাক্ষাৎ হল রোমা রল্যাঁ, বার্ট্রান্ড রাসেল, হারমান হেসের সঙ্গে। সুইৎজ়ারল্যান্ডের লুনাগোতে আমন্ত্রিত হয়ে বক্তৃতা করতে গেলেন ভারতীয় সঙ্গীত বিষয়ে। তত দিনে নিজেকে গড়েপিটে মজবুত করে নিয়েছেন। এবার সিদ্ধান্ত নিলেন দেশে ফেরার। ভারতীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে আবিষ্কারের পথে পা রাখলেন গবেষক দিলীপকুমার।

দেশে ফিরে বাংলা গানের জন্য যা তিনি সংগ্রহ করলেন, তা খনি থেকে হীরে সংগ্রহের চেয়ে কম কিছু নয়। গান-পাগল তরুণ ভারতের বিভিন্ন সুরের দোরে দোরে হানা দিলেন। এমনকি বাইজীদের কাছেও গিয়েছেন গান শুনতে, তা আত্মস্থ করতে। বাংলা গানের মধ্যে কী করে মীড়, গমক, তান এনে তাকে পাশ্চাত্য সুরের মিশেলে পরিবেশন করা যায়— সেই অভিনব পরীক্ষায় মেতে উঠলেন দিলীপ। প্রয়োজনে মেশালেন কীর্তনের আখর রীতি, যা দিয়ে কথাকে ভেঙে-গড়ে পল্লবিত করা যায়। রেকর্ডে গেয়ে যাওয়া ‘বৃন্দাবনে লীলা অভিরাম’ গানটির ‘ওরা জানে না, তাই মানে না’র পল্লবিত সুর যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

দিলীপকুমার বলতেন, 'আই সিং হোয়াট আই ফিল।' এই অনুভবেই তিনি গেয়ে গিয়েছেন— ‘যদি দিয়েছ বঁধুয়া’, ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’, ‘জীবনে মরণে এসো’ গানগুলি। দিলীপকুমারের গানের এক নিজস্ব ঘরানা ছিল, যাকে সঙ্গীত বোদ্ধারা চিহ্নিত করেন ‘দৈলিপী ঢং’ নামে। তাঁর গায়নভঙ্গিকে আত্মস্থ করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। ঢেউ তোলা সুরহিল্লোল, তার সঙ্গে গানের কথার সুগভীর-অর্থবহ বিন্যাস— যার চলনে এক আধ্যাত্মিক ভাবনার ছাপ সুস্পষ্ট। দিলীপের গান যখনই পরবর্তী সময়ে গাইতে গিয়েছেন কেউ, তাঁকে নকলনবিশির দোষে দুষ্ট হতে হয়েছে। ওই তান-সমন্বিত ভাবপ্রবণ গায়কিকে অনুসরণ করে গাইতে গিয়েও খেই হারিয়েছেন অনেকে। আবার স্বকীয়তা বজায় রেখে দিলীপকুমারের গান গাওয়া অনেকটা সে গানের মূল ভাবকে হত্যা করার মতো অপরাধেরই শামিল। খুব সফল ভাবে তাঁর গান গেয়েছেন সাহানা দেবী, ইন্দিরা দেবী, উমা বসু, মঞ্জু গুপ্ত, এম এস শুভলক্ষ্মীর মতো হাতে গোনা কয়েক জন শিষ্যাই। হ্যাঁ, শিষ্যা— ছাত্রী নন। কারণ, তিনি যে সাধনপদ্ধতি দিয়ে গিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মকে, তা শুধু তাল-লয়-সুর আর কথায় নিবদ্ধ গানের অন্ধ অনুকরণ নয়। সে গানের মূল আকর তার ভাববিহ্বলতা। গানের মধ্যে গিয়ে প্রেমাস্পদকে নিজের করে পাওয়া।

কেমব্রিজে গণিতের পড়াশোনা শেষ না করেই ইউরোপে চলে গেলেন কণ্ঠস্বরের তালিম নিতে। দেশে ফিরলেন দিলীপ। পণ্ডিত ভাতখণ্ডের সঙ্গে দেখা করে তাঁর অনুপ্রেরণায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে সঙ্গীত বিশারদদের থেকে রাগের ভিন্ন রূপ এবং গানের সুর সংগ্রহ করলেন। সেগুলি লিপিবদ্ধ করলেন। এত সংখ্যক আর নিখুঁত স্বরলিপি দিলীপকুমার ছাড়া আর কেউই ভারতে রেখে যাননি।অতুলপ্রসাদ, নজরুলের বহু গান তিনিই গেয়ে পরিচিত করেন। বাংলা বেসিক রেকর্ড বার করার ক্ষেত্রে নজরুল ও দিলীপের ভূমিকা বাংলা গান ভুলবে কী করে?

এমনও একটা সময় এসেছে যখন দিলীপ স্থির করতে পারেননি— জীবন থেকে ঠিক কী চান। তাঁর মনে হয়েছে, ঈশ্বরকে পেতে গেলে কঠিন যোগ দরকার। সে পথ একমাত্র দেখাতে পারেন অরবিন্দ। সে মোক্ষপ্রাপ্তির পথে কখনও নিজের শহর ছেড়ে আশ্রমিক জীবনযাপন করেছেন, কখনও গায়ে রুদ্রাক্ষ আর গৈরিক বসন তুলে নিয়েছেন। কখনও মোহমুক্তি ঘটিয়েছেন প্রিয়জনের কাছ থেকে। প্রেম, বাসনা, কামনা থেকে দূরে থাকার চেষ্টায় ছেড়ে গিয়েছেন সম্ভাবনাময় কর্মজীবন, পৈতৃক সম্পত্তির বিলাস। কিন্তু একমাত্র যা তাঁর আত্মার উত্তরাধিকার— সেই গান, তা ত্যাগ করতে পারেননি কখনও। অরবিন্দও জানতেন প্রবল আবেগি মানুষটির প্রাণবায়ু সঙ্গীত। তাই এর মাধ্যমেই সাধনা করে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনোর পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। অরবিন্দের সঙ্গে দিলীপকুমারের পত্র বিনিময়ের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল এক অদৃশ্য সেতু, যেখানে দিলীপ ছিলেন অবাধ্য ছাত্রের মতো। কখনও ঝগড়া, কখনও অভিমান, কখনও অভিযোগ— প্রতি মুহূর্তে অরবিন্দ প্রশ্রয় দিয়েছেন দিলীপকে। ইন্দিরা দেবী এক জায়গায় লিখছেন, একবার চিঠিতে ঋষি অরবিন্দের প্রতি তাঁর দাদাজীর অভিযোগ ছিল যে, তাঁর গান সম্ভবত গুরুদেবকে আকর্ষণ করে না। তাই তাঁর গানের সময়ে অরবিন্দ ধ্যানমুদ্রিত ছিলেন। এর জবাবে অরবিন্দ দিলীপকে চিঠি লিখলেন— 'দিলীপ তোমার এই সন্দেহ সম্পূর্ণ অকারণ। তোমার সংগীতে আমার আগ্রহ নেই এমন হতেই পারে না। বরং আমার আগ্রহ এত প্রবল যে আমার ঘুমের সময়টুকুতেও আমি তোমার ‘সরস্বতী’ সংগীতটি সংশোধন করতে বসেছিলাম, যাতে অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে গানটি তৈরি থাকে।... যে বোধ কেবলই মানসিক এবং বাক্যাতীত তাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। তোমার গান সম্বন্ধে অন্ততঃ আমার এই অনুভূতিই হয়েছে আর এই জন্যই তোমার গান সম্পর্কে কিছু লেখা সবসময়েই আমার কাছে একটু কঠিন মনে হয়।' (২৩/৩/১৯৩৩)।

তাঁর গুরু চেয়েছিলেন এই প্রবল সম্ভাবনাময় আবেগকে একটি যথার্থ মার্গে চালিত করতে। তাই পাশ থেকে যেমন দিলীপকুমারকে যোগ সাধনা শিখিয়েছেন, তেমনই দিলীপের বাংলা ছন্দের লেখাও সংশোধন করে দিয়েছেন হাতে ধরে। উৎসাহ দিতে দিলীপের লেখা বাংলা ছন্দের মতো ছোট ছোট ইংরেজি কবিতা লিখে পাঠাতেন। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস ‘রামের সুমতি’র ইংরেজি অনুবাদ করার সময়ে তা-ও গুরুকে দিয়ে পড়িয়ে নিয়েছেন দিলীপ। কেউ কেউ মনে করেন, প্রথম দিকে দিলীপ যে কাঁচা ছন্দে গান রচনা করতেন, সেই মানুষটিই পরবর্তী কালে ছন্দে অভাবনীয় উন্নতি ঘটাতে পেরেছেন আদতে গুরুর সান্নিধ্যে এসেই। রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখেছেনও সে কথা— 'তার পর তোমার কবিতার কথা বলি। পরিণাম দেখে ভয় পেয়েছিলাম। ইতিপূর্বে পদ্যজাতীয় তোমার অনেক লেখাই দেখেচি। বারবার মনে মধুকোষের পথ তুমি পাওনি, তুমি ছন্দে পঙ্গু। তা নিয়ে আমি মাঝে মাঝে বিচার করেছি, সেটা নিশ্চয়ই শ্রুতিসুখকর হয়নি। অপ্রিয় কথা বলবার অপ্রিয় দায় তুমি আমার উপর আবার চাপাতে এসেচ মনে ক’রে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলুম। কিন্তু এ কি ব্যাপার হে? হঠাৎ ছন্দ পেলে কোথা থেকে? গুরুমশায়গিরি করবার জো রাখনি। অকস্মাৎ তোমার কান তৈরি হয়ে গেল কি উপায়ে? আর তো তোমার ভয় নেই। ...এক এক বার ভাবি তুমি আর কারোর কাছ থেকে লিখিয়ে নাওনি তো?' (দেশ, সাহিত্যসংখ্যা, ১৩৮৩, পৃষ্ঠা ২৭-২৮)।

তখন গান সংগ্রহে লখনউ, বারাণসীতে উস্তাদ, বাইজীদের দোরে দোরে ঘুরছেন। সে সময়ে তাঁর গানের সখা হলেন সাহানা দেবী। সাহানা দেবীর আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, চিত্তরঞ্জন দাশের পরিবারের মেয়ে তিনি। কাশীর একটি বড় পরিবারে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। সেখানে তাঁকে গাইতে বা নাচতে দেওয়া হত না। তাঁর প্রতিভার সমঝদার কেউ ছিলেন না। এক সময়ে তিনি অসুস্থ অবস্থায় পালিয়ে আসেন। নিজের সংসার ছেড়ে শান্তিনিকেতনে রবি ঠাকুরের কাছে আশ্রয় নেন। কিছুদিন পরে চলে আসেন পুদুচেরি আশ্রমে। সেখানে তাঁর পুরনো গানের সঙ্গী দিলীপকুমারের সঙ্গে প্রাণ খুলে গান গাইতে লাগলেন। এক নতুন আলোকপথের সন্ধান পেলেন যেন! নতুন করে গান শিখতে শুরু করলেন আসরে গাওয়ার জন্য। সাহানা দেবী এক জায়গায় লিখছেনও সে কথা— '...আমার বিয়েরও অনেক পরে দিলীপের সংস্রবে এলে তাঁর কাছে তাঁর আসরে গাইবার জন্য এবং তা ছাড়া এমনিও বহু গান শিখি। ...দিলীপের গান গাওয়া বা তোলা সহজ নয়। অনেক সহজ কারুকার্য, আলোছায়ার দোলা দরকার তার গান গাইতে হলে। সে সব একত্রে পাওয়া কঠিন।' আর দিলীপকুমারের গান সম্পর্কে বলছেন, ‘তোমাদের দিলীপদার গান শুনে মন ভরে না! তাঁর কণ্ঠ সর্বদাই গুনগুনিয়ে ওঠে। পঁচিশ বছর ধরে ওই কণ্ঠের গান সদাসর্বদা শুনছি... তাঁর গান বড় কঠিন।'

‘দিলীপকুমার জন্মশতবর্ষ’ প্রবন্ধে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখছেন— '...তবে আমার মনে হয় ওঁদের দু’জনের মধ্যে একটা গভীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সেটা অশরীরী প্রেম। যাকে বলে Platonic love। দিলীপকে আমি যতদূর জানি, বিবাহবন্ধন তাঁর জন্য নয়। তিনি চিরপলাতক। আর একনিষ্ঠতাও তাঁর হৃদয়ে ছিল কিনা সন্দেহ।' তবে প্রেমের কোনও ঘাটতি ছিল না তীর্থঙ্কর দিলীপকুমারের হৃদয়ে। যিনিই এসেছেন, তাঁকে ঈশ্বরভাবে অভিভূত হয়ে আশ্রয় দিয়েছেন তাঁর গানের সুরে, সাধনার শান্তিজলে। যেমন ইন্দিরা দেবী। ১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইন্দিরা দেবী সংসার ছেড়ে চলে এলেন শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমে। সেখানে দাদাজীর চরণে শরণ চাইলেন। ‘দিলীপকুমার রায়ের আশ্রমজীবন’ প্রবন্ধে নীরদবরণ লিখেছেন— '...ইন্দিরা দিলীপের বাড়িতে অতিথি হয়ে আসেন এবং ক্রমশ তাঁর একান্ত অনুরক্ত হয়ে পড়েন। এমনকি তাঁকে শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করবার জন্য দিলীপকে প্রায় জোর-জবরদস্তি করেন। দিলীপ সে আবেদন গুরুর কাছে নিবেদন করেন এবং বলেন যে, তাঁর নিজের গুরু হবার কোনও ইচ্ছা নেই কিন্তু ইন্দিরা নাছোড়বান্দা। একমাত্র গুরুই তাঁকে এই সংকট থেকে উদ্ধার করতে পারেন; অন্ততপক্ষে গুরুর মতামত তিনি জানতে চান। বিস্ময়ের কথা যে গুরু বিনা দ্বিধায় সম্মতি দিলেন। দিলীপ অবাক, আমরাও তাই।' জীবনের শেষ দিন অবধি ইন্দিরা তাঁর দাদাজীর হাত ছেড়ে যাননি। 

১৯৩৭ সাল। দিলীপকুমার রায় পুদুচেরি থেকে কলকাতায় এসে গ্রামোফোন রেকর্ডে দু’খানা গান গেয়ে সাড়া ফেললেন। ‘রাঙ্গা জবা কে দিল তোর পায়ে’ আর ‘ছিল বসি যে কুসুমকাননে’। গান দু’টি টপ্পা ও কীর্তনাঙ্গ ছাঁদের। দৈলিপী ঢং প্রদর্শন সে গানকে শ্রোতৃসমাজে সমাদর তো দিলই, বিপণনও মন্দ হল না। তা দেখে উৎসাহিত হয়ে দিলীপ দ্বিতীয় গানের রেকর্ড করলেন। এবারের গান দু’টি হল ‘এই পৃথিবীর পথের পরে’ এবং ‘জ্বলবার মন্ত্র দিলে মোরে’। তৃতীয় রেকর্ডে গেঁথে গেল বাংলা গানের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গান ‘সেই বৃন্দাবনের লীলা অভিরাম’।

এ সময়ে দিলীপকুমার কলকাতায় পাবলিক কনসার্ট করছেন। তখনও টিকিট কেটে গান শোনার চল ছিল না বাংলায়। দিলীপকুমারকে এই নতুন সুরদ্বীপ যাত্রার কলম্বাস বলা চলে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় কনসার্ট করে গুরুর আশ্রমের সাহায্যে প্রণামী হিসেবে টাকা পাঠিয়েছেন তিনি। অথচ মানুষটির সুর প্রতিভা, লেখনি সব ছাপিয়ে পরিচয় প্রতিষ্ঠা পেল সাধক হিসেবে। শেষের দিকে দুই দশক দিলীপকুমার সচেতন ভাবেই ভক্তিগীতি ছাড়া কিছু গাইতেন না। তাঁর বৈরাগী ভাবমূর্তি গ্রাস করল সুরকার ও গায়কের প্রাণপ্রতিষ্ঠাকে। স্মৃতিচারণায় দিলীপকুমার লিখছেন— '১৯২৮ সালে আমি যোগজীবন বরণ করি। তারপর লক্ষ করি যে, ওস্তাদি সংগীতের অজস্র তানকর্তব ও কণ্ঠের কসরতে আর আমার মন তেমন ভিজে উঠছে না। ...ওস্তাদি গানের সুখবিলাস আমাদের অন্তরে খানিকটা আবেশ জাগালেও সে-আবেশ স্থায়ী হতে পারে না এই জন্যে যে, সে কিছুতেই ভুলতে পারে না যে সমঝদার শ্রোতার সাড়া তার চাইই চাই। কিন্তু ভজনকীর্তনের বেলায় গুণী রূপান্তরিত হন পরম ভাগবতে।'

স্বরলিপি মেনে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া এবং স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার পন্থা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দিলীপকুমারের বিরোধ সর্বজনবিদিত। শেষ জীবনে দিলীপ যদিও মেনে নেন ভুল তাঁরই ছিল। প্রকাশ্যে তিনি কোনও দিন রবীন্দ্রগান করেননি, হয়তো গায়নের স্বাধীনতা পাননি বলেই। তিনি অতুলপ্রসাদ, নজরুলের গান গাওয়ায় মনোনিবেশ করেন। হিমাংশু দত্তের বহু গানের তিনিই প্রথম গায়ক। আশ্রম জীবনে কবি নিশিকান্তকে দিয়ে গান লিখিয়ে তাতে সুর করে বাংলা গানে অন্য এক স্পন্দন তৈরি করেন। দ্বিজেন্দ্রলাল ও অতুলপ্রসাদের বেশির ভাগ গানের স্বরলিপি দিলীপেরই করা। ১৯২২ সালে বিদেশ থেকে ফিরে তিনি গোটা ভারত পরিক্রমা করেন সুরের সন্ধানে। সে ইতিহাস লিপিবদ্ধ ‘ভ্রাম্যমানের দিনপঞ্জিকা’য়।

১৯৪৭ সালে হিন্দি সিনেমায় মধ্যযুগের মীরার ভজনে দিলীপকুমারের সুরে গেয়েছিলেন এমএস শুভলক্ষ্মী। পল্লবিত হল এক নতুন কুঁড়ি। স্বয়ং শুভলক্ষ্মী তাঁর গুরুদেবের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে লিখেছেন— 'গান করেন স্বতন্ত্র আত্মার আবেদন বিশ্ব আত্মায় বিলীন হবার জন্য।' তিনি এলাহাবাদে ছপ্পন ছুরি জানকী বাইয়ের কাছেও গান শিখেছিলেন। এক আসরে জানকী বাইয়ের গানের পরে বাড়ির কর্তা তরুণ মন্টুকে গাইতে বললে ভ্রূভঙ্গি করে বাইসাহেবা বলেছিলেন— 'অ্যাইসা?' অর্থাৎ, বাঙালি ভদ্রলোকের ছেলে গান গায়, এটা বিশ্বাস করতে হবে? অতঃপর গান গাইলেন দিলীপ। জানকী বাইয়ের তেরছা ভ্রূ সোজা হয়ে গেল। জানালেন শেখার আমন্ত্রণ। শোনা যায়, দিলীপকুমারের কণ্ঠে অতুলপ্রসাদের ‘রূমক-ঝুমক-ঝুম’ গানটি শুনে মোতিবাই বলেছিলেন— আমিও আপনাকে শেখাতে পারি, যদি আপনি আমাকে এই গানটি শেখান।

গানের বিষয়ে তাঁর উদার মন কোনও প্রথাগত তোয়াক্কা করেনি কোনও দিনই। তাই তো একজন উমা বসু, একজন ইন্দিরা দেবী, একজন সাহানা দেবীর সুর আমরা শুনতে পাই সে সময়ে, যখন কোনও ভদ্রবাড়ির মেয়েরা গান গাইছেন— এটা ভাবাই যেত না। নারীর ক্ষমতায়নের সোপান সেই কত যুগ আগেই রচনা হয়েছে। এমন মানুষের গানের অমূল্য সম্ভারকে আমরা আত্মস্থ করতে পারলাম না। বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি, সন্দেহ নেই।

প্রেমাস্পদের খোঁজে আজীবন পাগল হয়ে ছুটেছেন মানুষটি। যে কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে গান লিখছেন শ্রীচৈতন্যের জন্য— 'প্রেমে গড়া তনু, প্রেমে গড়া মন যা’র/ প্রেমে গড়া প্রাণ নয়নে প্রেমের ধার'— সেই প্রেম শেষ অবধি তাঁর সঙ্গে থেকে গিয়েছে। তাঁর একমাত্র প্রেম তাঁর সঙ্গীতসাধনা। সুরের মধ্য দিয়েই বারবার ঈশ্বরকে ছুঁয়ে এসেছেন। থেকেছেন জীবনে, যাপনে। তিনি সাধক। যাঁকে এই পৃথিবী সুরকার, গীতিকার, কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, অনুবাদক ও সুর সংগ্রাহক নামেও চেনে। তিনি আত্মভোলা। চরম অভিমানী। অননুমেয় এক মরুঝঞ্ঝার মতো যাঁর প্রতিভার ব্যাপ্তি। আমাদের তাঁকে মনে রাখা হয়নি, চেনা হয়নি। আমরা ভুলে গিয়েছি এই বাংলায় এমন একজন মানুষ ছিলেন, ‘বাঙালি কাঁকড়ার জাত’ এই প্রচলিত গল্পটিকে যিনি মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন প্রতি পদে। নিজের খ্যাতির জন্য নয়, নিজের নামের জন্য নয়, আজীবন খনি থেকে মণিমাণিক্য সংগ্রহ করেছেন অপরকে নতুন আলোয় প্রকাশিত করবেন বলে। আমরা হতভাগ্য! আমরা তাঁকে মনে রাখিনি। আমরা তাঁর মতো প্রাণখোলা, খেয়ালি মানুষকে ধরে রাখতে পারিনি এই বাংলায়। যে জন্মমাটি থেকে রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-আলো শুষে নিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন বাংলা সঙ্গীতাকাশের মহীরূহ, সেই বাংলায় তাঁর গায়কির পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি করা গেল না!

দিলীপকুমার আত্মপরিচয়ে লিখেছিলেন— 'প্রেম আমার সাধন জানি,/ আমার জীবন মানি/ বন্ধনে মণিমুক্তোতারা প্রেম/ বিরহে প্রেম উদ্দীপন, মিলনে প্রেম উন্মাদন।'


Saturday, 29 January 2022

করোনা কালের ডায়েরি

প্রতিবেশ, শ্রমজীবী হাসপাতাল ও এই সময়

কৃশানু মিত্র


প্রথম যখন করোনা আসে তখন আমার বাবা হাসপাতালে। একই সঙ্গে আমার বন্ধুর কন্যাও অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাবার অসুখের নাম হিমাচুরিয়া। বেলুড় শ্রমজীবী হাসপাতালে বাবাকে ভর্তি করতে পেরেছিলাম। বন্ধুর কন্যাকে রেলের হাসপাতালে ভর্তি করতে হিমশিম খেতে হয়েছিল। কারণ, ওর গায়ে জ্বর ছিল। সাটল ককের মতো একবার লিলুয়া হাসপাতাল একবার বিআরসিং, আবার লিলুয়া, অবশেষে পুনর্বার বিআরসিং হাসপাতালে ভর্তি করা গিয়েছিল। ডাক্তারবাবুরা ওকে ফেলে রেখে দিয়েছিলেন, কোনও চিকিৎসা না করে। ম্যানেনজাইটিসের চিকিৎসা না পেয়ে শেষমেশ ২২ বছর বয়সী মেয়েটি মারা গেল।  ঘটনাচক্রে ১ এপ্রিল ২০২০ আমার বাবাও একই দিনে মারা গেলেন। 

মুখোশের আড়ালে ভয়ের আবহ নিয়ে করোনা আমাদের কাছে হাজির হল। ইতোমধ্যে বেলুড় শ্রমজীবী ও শ্রীরামপুর শ্রমজীবী হাসপাতালকে রাজ্য সরকার করোনা চিকিৎসার জন্য মনোনীত করেছে। প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে স্বাস্থ্যকর্মী ও ডাক্তাররা ঝাঁপিয়ে পড়লেন করোনা চিকিৎসার পরিষেবায়। মাস ছয়েক চিকিৎসার পর আমি 'মন্থন সাময়িকী'র হয়ে ডাক্তারবাবু, স্বাস্থ্যকর্মী এবং সংগঠকদের একটা ইন্টারভিউ নিই। সেই সময় বাড়ির মানুষজনদের বাধা পেরিয়ে হাসপাতালের কাজে যোগ দিতে স্বাস্থ্যকর্মীদের খুবই বেগ পেতে হচ্ছিল। শ্রমজীবী বিদ্যালয়ে পড়া একটি ছেলে ফকির মাঝি- সে এখন একজন স্বাস্থ্যকর্মী; বাঁকুড়ায় থাকে সিমলাপাল গ্রামে। প্রথম ঢেউয়ের সাথে সাথে যখন সবাই পালাতে ব্যস্ত তখন ওর মা ওকে বলেছিলেন, 'দুঃসময়ে হাসপাতালকে ছেড়ে চলে আসবে না। এই হাসপাতাল তোমায় ছোটবেলা থেকে লেখাপড়া শিখিয়েছে, দেখভাল করেছে।' ধীরে ধীরে মানসিকতা পাল্টাতে থাকে। ডাক্তারবাবুদের প্রত্যক্ষ মদতে স্বাস্থ্যকর্মীরা ধীরে ধীরে মানসিক জোর ফিরে পান। 

সেবিকা মৌসুমী দাসের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তার কথায় বুঝতে পারি, অসুস্থ রোগী যখন কম স্যাচুরেশন নিয়ে হাজির হয়, তখন প্রোটোকল মানতে গেলে বিপত্তি; রোগীকে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেওয়া যায় না। এমনও হয়েছে বহুবার- রোগীর মুখমণ্ডল থেকে শ্বাসবায়ু, বমি আমাদের উন্মুক্ত মাস্কহীন মুখমণ্ডল ছুঁয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'তোরা কি ভ্যাকসিন নিয়েছিস?' বেশিরভাগের মুখ থেকেই 'না' উত্তরটি এসেছিল। 

আমাদের যে সমস্ত ডাক্তারবাবু কোভিডের চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ডাঃ কুণাল দত্ত অত্যন্ত নিবিড় ভাবে প্রোটোকল মানা লোক। করোনা শুরুর প্রাক্কালে তিনি জানিয়েছিলেন, আমার এখন একমাত্র কাজ এই মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই করা। তারুণ্যে বলিয়ান ৭০ ঊর্ধ্ব এই বৃদ্ধ ওনার বরাবরের রোগীদের বলেছিলেন, 'আপনারা আমাকে টেলিফোনে যোগাযোগ করে আপনাদের অন্য অসুখের দাওয়াই জেনে নেবেন। এখন আমি কেবলই মহামারির সঙ্গে লড়াই করব।' দ্বিতীয়জন যার সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম তিনি ডাঃ অনিল সাহা; যাকে অচেনা কেউ বাইরে থেকে মনে করবেন একজন দুর্বল চরিত্রের মানুষ। তিনি অতশত প্রোটোকলের ধার ধারেননি। নিরলস ছ' ঘণ্টা স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে প্রতিদিন ওয়ার্ডে থাকতেন। তিনি আজও ভ্যাকসিনের ধারকাছ দিয়ে যাননি। সরকার মনোনীত চিকিৎসা ব্যবস্থায় সামিল হওয়ার কারণে ধীরে ধীরে আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা ভ্যাক্সিনেটেড হয়। বছরখানেক এই পরিষেবার মধ্যে জড়িত থেকে আমাদের মধ্যে জনা ৪০/৫০ জন এই  রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সঠিক চিকিৎসা হওয়ায় কোনওরকম দুর্ঘটনা ঘটেনি। 

অনলাইন পড়াশোনার মতো অনলাইন রোগী দেখার যে সংস্কৃতি পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হল, তার থেকে বহু দূর হেঁটে শ্রমজীবী বেলুড় হাসপাতাল এই সময় অন্য রোগীদের পরিষেবা চালিয়ে গেল। সারা পৃথিবী যখন বারণ করছে তখন ডাঃ অদিত দে বলছেন, 'হ্যাঁ, আমি একজন ইডিয়ট, আমি এই সময়ে অপারেশন করব।' ডাঃ অনিল সাহা আমাকে বলতেন, 'করোনার মধ্যে থাকলেই করোনার কাছ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। বাঁচার আর কোনও উপায় নাই।' এর মানে আমি করেছিলাম- রাস্তাঘাটে বেরিয়ে চলাচল করতে হবে, লকডাউনের বাঁধনে পড়ে থাকলে বাঁচা যাবে না। 

আরেক ডাক্তার গৌতম দাসকে পেলাম আমার মাসিমার চিকিৎসার প্রয়োজনে। তখন দ্বিতীয় ঢেউ সবেমাত্র এসেছে, মাসিমা ভর্তি নিউ আলিপুরের এক নার্সিংহোমে যেখানে গৌতম দাস চিকিৎসারত। বেআব্রু এই চিকিৎসককে দেখে আমার বোন অবাক হয়ে গিয়েছিল। উপসর্গ সহ অনিল সাহাকে এই রোগ না ধরলেও গৌতম দাসের কিন্তু করোনা হয়েছিল। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে উনি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন।

আমফান-যশের ধাক্কায় যখন সুন্দরবন বেহাল, আমাদের বহুবার সুন্দরবন যেতে হয়েছিল। প্রথম যেদিন রাজারহাট পেরিয়ে ভোজেরহাটে বাসন্তী হাইওয়েতে পড়ি, বেআব্রু বাজার-হাট, রাস্তাঘাট দেখে মনে হয়েছিল- করোনা রোগের কোনও অস্তিত্ব এখানে নেই। আবার বালি দ্বীপে দেখেছি, গ্রামের এক প্রান্তিক জায়গায় গ্রামের উপপ্রধান পরিযায়ী শ্রমিকদের সুন্দর ব্যবস্থাপনায় রেখেছেন। নদী টপকাতে টপকাতে আমরা ছোট মোল্লাখালির পথে। জঙ্গলের সীমান্তে হঠাৎ আমাদের রাস্তা আটকে দাঁড়িয়েছে ঝোঁপঝাড়ের ব্যারিকেড। বুঝতে না পেরে এদিক-ওদিক চেয়ে দেখি, একটি ছোট্ট কুঁড়ে ঘরের সামনে বাঁশের বেঞ্চে বসে আছেন কয়েকজন সিভিক ভলেন্টিয়ার। তাঁদের রক্তচক্ষু আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে, 'এটা পরিযায়ী শ্রমিকদের থাকার জায়গা, আপনারা এসেছেন কেন?' সত্যিই এই অঞ্চল  জনমানবহীন, খাঁ খাঁ করছিল। এর থেকে বোঝা যায়, পরিযায়ী শ্রমিকরা যে করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর, এই আবহ তৈরি করতে পেরেছিল গণমাধ্যমগুলো। কুলতলি, পাথরপ্রতিমা প্রভৃতি সব অঞ্চলগুলোয় একইরকম দেখা গেছে। যশের সময় গ্রামকে গ্রাম মানুষ জ্বরজ্বালায় আক্রান্ত। চিকিৎসার অভাবে মারাও গেছেন কেউ কেউ। 

আমার মনে হয়েছে, প্রথম পর্যায়ে যে সব স্বাস্থ্যকর্মীরা মারা গেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই রোগটাকে অমর্যাদা করেছেন। তথাকথিত বিপ্লবীদের অপপ্রচার এখানে সত্যি সত্যিই খুব খারাপ পরিণতি নিয়ে এসেছিল। ডাঃ কুণাল দত্ত 'দুর্বার' সংস্থার প্রধানকে বলেছিলেন, 'যদি অক্সিজেন সাপোর্ট তুমি না নাও তাহলে আমাদের চিকিৎসায় তোমায় রাখব না।' আমার নিজের জামাইবাবুকে গ্রামে ফিরে গিয়েও বেঘোরে প্রাণ হারাতে হল চিকিৎসার অভাবে। প্রথম পাঁচ দিন উনি বুঝতেই পারেননি শারীরিক কষ্ট। রুবি হাসপাতালে আনার পর আরএমও দেখেই বললেন, 'উনি বাঁচবেন না।' অথচ তখনও উনি বহিরাবরণে রীতিমত ভালো। 

পাড়া-প্রতিবেশী ও বেশ কিছু কম বয়স্ক মানুষকে চলে যেতে দেখলাম রোগটাকে অবহেলা করে। এদের প্রায় বেশির ভাগই হাসপাতালে ভর্তির দুদিনের মধ্যে মারা গেছেন। বেশির ভাগ বয়স্ক মানুষ যারা ঘরে নির্বাসিত ছিলেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এই রোগ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছিল। বাইরে থেকে কেউ ঘরে বয়ে এনেছেন সে রোগ, বহমানতার সাক্ষী হিসেবে বয়োজ্যেষ্ঠ জনের মৃত্যু ঘটেছে। 

ভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে মাস্ক, সাবান ও টিকাকরণ এল। তথাকথিত বিপ্লবীরা বললেন, মাস্ক'এর ভেতর দিয়ে ন্যানো পার্টিকেল আটকানো যাবে না। তথাকথিত প্রতিবিপ্লবীরা এর সঠিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না। এক পদার্থবিদের কাছে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, ছেঁদার ডাইমেনশনের উপর এটা অংশত নির্ভর করে, বাকিটা নির্ভর করে স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটির উপরে। তরল সর্দি বা বায়ু বাহিত ভাইরাস স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটির কারণে আকর্ষিত হয়ে অংশত মাস্কে আটকে যাবে। অর্থাৎ, কিছুটা শরীরে যাবে। এই কিছুটা, ইনফেকশন রেটের চেয়ে কম হলে তা অটো-ইমিউনিটি দেবে শরীরকে (ইনফেকশন রেট হল মিনিটে বা সেকেন্ডে যত ভাইরাস গেলে শরীর আক্রান্ত হতে পারে তার পরিমাণ)। অন্য অর্থে, মাস্ক এক ধরনের ভ্যাকসিনেশন। যেমন, কোনও ভাড়াটিয়া চায় না তার বাড়িওয়ালাকে মেরে ফেলতে। সে মনে মনে বাড়িটা দখল করে সারা জীবন থেকে যাওয়ার আশা পোষণ করে। বিজ্ঞানের চলমানতা যতটুকু বুঝি, ভাইরাস সেইরকমই ভাড়াটিয়া, শরীর থেকে যেতে চায় না। অর্থাৎ, নিজের মারণ ক্ষমতা কমিয়ে নিজেকে দুর্বল করে সে শরীরে থেকে যেতে চাইবে। যেমন, ওমিক্রন। তাই প্রাথমিক ভাবে বুঝে নেবার জন্য লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও নিরন্তর লকডাউনের কোনও মানে হয় বলে সাধারণ বুদ্ধিতে আমার মনে হয় না। 

একটা উদাহরণ দিই। অতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড মাটির তলায় পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য গবেষণা চলছে। এর জন্য বহু অর্থ খরচ করছে উন্নত দেশের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। পরিবেশবিদরা চান, কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপাদন কমিয়ে ফেলা হোক। তাহলে এখন উপায় কী? কমিয়ে দাও বললেই তো কমিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, যেখানে রাষ্ট্রশক্তিগুলো পুঁজিবাদের দখলে। অতএব, গবেষণা চলছে, যদি কার্বন ডাইঅক্সাইড ম্যানেজমেন্টে আপাতত একটা ব্যবস্থা আনা যায় যা ওজোন স্তরের ফাটল রোধ করতে পারে। সেই ব্যবস্থা বা আয়োজন চলুক। একই সঙ্গে চলুক প্রতিবাদী আন্দোলন যাতে কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া যায় ভবিষ্যতে। অনেকটা করোনার ভ্যাক্সিনেশনকে প্রাথমিক কাজে লাগানোর মতো। কিন্তু পুঁজিবাদ লাগামছাড়া, নিরন্তর বুস্টার ডোজ নির্মাণ করে চলেছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় তাদের দালালরা  বসে আছে। ওমিক্রন ঠেকাতে বুস্টার আসলে মশা মারতে কামান দাগা, যদি না ফের বিজ্ঞানের উল্টো দিকে হেঁটে করোনা ভাইরাস নিজের চরিত্র পরিবর্তন করে। 


Friday, 21 January 2022

ব্লকচেইন প্রযুক্তির অ আ ক খ

এক নিয়ন্ত্রণ মুক্ত বিশ্বের দিকে?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

বালিতে মুখ গুঁজে ঝড়ের হাত থেকে কি আর রেহাই পাওয়া যায়! অনুরূপ, চারপাশের বিস্ময়কর ও ‘অসহনীয়’ পরিবর্তনগুলি থেকে মুখ ফিরিয়ে বা তাদের নাকচ করে কি সমাজ বিবর্তনের প্রক্রিয়াগুলিকে আদৌ অনুধাবন করা যাবে? যদি মনে করি, গত দু’ বছরে ডিজিটাল দুনিয়ার অতি-প্রসারমানতা কোভিড ঘটিয়েই করানো হয়েছে, তাহলে বুঝতে হবে, তার আগের দশ বছরের যুগান্তকারী পরিবর্তনগুলিকে আমরা একেবারেই বুঝে উঠতে পারিনি।

প্রথমেই স্পষ্ট হয়ে নেওয়া দরকার, পুঁজিবাদ এমনই একটি প্রযুক্তি-নির্ভর নৈর্ব্যক্তিক ব্যবস্থা, যেখানে নির্দিষ্ট কর্পোরেটপতির একচেটিয়া আধিপত্য কখনই নিরঙ্কুশ নয়। তদুপরি, কোনও রাষ্ট্রনায়কের একনায়কতন্ত্রও সে বেশি দিন বরদাস্ত করে না। সময় বিশেষে অথবা নিদারুণ সংকটকালে পুঁজিবাদের চলার পথে জটিলতা তৈরি হলে কখনও কখনও স্বৈরাচার তার প্রয়োজন হয়ে পড়ে, কিন্তু তা দীর্ঘকালীন নয়। বলা ভালো, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও দর কষাকষির আবহে পুঁজিবাদ নৈর্ব্যক্তিক উপায়ে চলতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করে। কারণ, সে কতকগুলি নিয়ম দ্বারা চালিত, সে নিয়মের ব্যত্যয় হলে তারই বিপদ বেশি। ইতিহাসও সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে। হিটলার বা মুসোলিনির পতনের জন্য পুঁজিবাদের অপর দুনিয়াকে এমনকি বিশ্ব যুদ্ধে পর্যন্ত লিপ্ত হতে হয়েছে। 

পুঁজিবাদ তার চলার পথে ক্রমেই আপেক্ষিক অর্থে আরও খোলামেলা ‘গণতান্ত্রিক’ পরিসরের দিকেই এগোতে চেয়েছে। যদিও এই ‘খোলামেলা গণতান্ত্রিক পরিসর’ কখনই দারিদ্র, বৈষম্য ও শোষণের অবসান ঘটাতে চায়নি, কিন্তু এর বিরুদ্ধে বহু কিছু বলার সুযোগ দিয়েছে ও সেগুলিকে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে যতটা সম্ভব নিরাময় করা যায়, তার বন্দোবস্ত রেখেছে। অর্থাৎ, একদিকে দারিদ্র ও বৈষম্য বিনা পুঁজিবাদের রথ চলে না, কিন্তু অন্যদিকে সে দারিদ্রকে কতটা সহনীয় করা যায়, সে ব্যবস্থাপনা রাখার চেষ্টা হয়েছে। আর ব্যবস্থাটা যখন নৈর্ব্যক্তিক, তখন ব্যক্তিগত পরিসরে দারিদ্র কারও চিরায়ত নয়- আজ যে গরিব কাল সে ধনী হতে পারে, আজ যে ধনী কাল সে পথে বসতে পারে। এই নৈর্ব্যক্তিক প্রতিপালনই পুঁজিবাদকে চোখের আড়ালে ঠেলে মানুষে মানুষে প্রতিযোগিতা, অবিশ্বাস, অনৈক্য ও সংঘাতকে বেঁচে থাকার আবশ্যিক শর্ত হিসেবে মেনে নিতে প্ররোচিত করেছে। ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থের তিনটি খণ্ডে মার্কস সাহেব আড়ালে থাকা চালক-পুঁজিবাদের এই নিষ্ঠুর ব্যবস্থাপনাকেই তাঁর মুনাফার হার ও উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বে উন্মোচিত করেছেন। তারপর প্রায় দেড়শো বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আজ নবতর পুঁজিবাদ সদ্য সদ্য এসে উপস্থিত হয়েছে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ও ক্রিপ্টো ব্যবস্থাপনার দুয়ারে।

মুনাফার হারের ক্রমবৃদ্ধিই পুঁজিবাদের চলার মন্ত্র। সেই বৃদ্ধির তৃষ্ণাতেই উৎপাদনের এক ক্ষেত্র থেকে অপর ক্ষেত্রে পুঁজির গতায়াত। নতুন নতুন প্রযুক্তির উন্মেষই অর্থনীতির নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে পুঁজি তথা পুঁজিবাদকে নিয়ে চলে উচ্চতর মুনাফার তৃষ্ণা মেটাতে। যে কারণে, কৃষি থেকে পর্যটন, খেলাধুলো থেকে বিনোদন, মায় ব্যক্তিগত সম্পর্কও হয়ে ওঠে পণ্য এবং মুনাফার উৎস। এ এক অসীম যাত্রা। এই একুশ শতকের বিশের দশকে এসে দেখা যাচ্ছে, বহু মানুষ নিজের যা কিছু তাকে পণ্য করে উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছে কখন তা বাজার পাবে। আর সে সুযোগ করে দিয়েছে অনলাইন প্রযুক্তি। আর সেই অবকাশেই এসে পড়েছে ব্লকচেইন প্রযুক্তি, ক্রিপ্টো ও non-fungible token (এনএফটি)’এর এক অভাবনীয় দুনিয়া যা হয়তো আগামী দিনে এক সুদূরপ্রসারী বাঁক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। কেউ কেউ বলছেন, ইত্যবসরে আমরা পা রেখেছি 'মেটাভার্স'এর অজানা ভুবনে।

বিটকয়েন নিয়ে এখন প্রায়-সর্বত্র আলোচনা প্রসারিত হওয়ায় অনেকেই ব্লকচেইন প্রযুক্তি ও ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে কিছুটা অবহিত হয়েছেন। কিন্তু প্রথমেই এই কথাটা বলে নেব যে, বিটকয়েন একমাত্র ক্রিপ্টোকারেন্সি নয় এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি ক্রিপ্টো দুনিয়ার অন্যতম একটি অংশ মাত্র। অর্থাৎ, ব্লকচেইন প্রযুক্তি থেকে উদ্গত ক্রিপ্টো দুনিয়া ও এনএফটি এমন একটি ব্যবস্থাপনার সূত্রপাত করতে চাইছে যা হয়তো আগামী দিনে পুঁজিবাদের নতুন এক মোড়ক ও সংজ্ঞা হাজির করতে পারে। এই প্রবণতাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই অথবা এর থেকে মুখ ফিরিয়ে বদ্ধ কল্পনার জগতে বসে থাকারও কোনও অবকাশ নেই।

আমরা সকলেই জানি, ব্লকচেইন প্রযুক্তি হল এমন এক ব্যবস্থাপনা যা ক্লাউড সার্ভার ভিত্তিক একমুখি প্রক্রিয়া নয় যেখানে সার্ভারে তথ্যমালা জমা পড়বে; এখানে কোনও পরিচালক কেন্দ্রীয় সংস্থাও নেই। অল্প কথায় বলা যায়, এ হল এমন এক distributed ledger বা বিতরিত হালখাতা যা এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত সকলের কম্পিউটারে অবস্থিত এবং যেখানে প্রতিটি লেনদেন বা তথ্য সংকলিত হয়ে জমা পড়ছে। এই জমা পড়া তথ্যগুলি ব্লক হিসেবে সুগঠিত হয়ে একটা চেইন বা শৃঙ্খল গড়ে তোলে যেখানে অভ্যন্তরস্থ তথ্যরাশিগুলিকে আর বদলানো যায় না। কারণ, একবার একটা এন্ট্রি হয়ে গেলে তা যেহেতু ব্লকচেইনে শৃঙ্খলিত অন্য সকলের কম্পিউটারেও নথিবদ্ধ হয়ে যায়, তাই একে বদলানোর আর কোনও উপায় থাকে না। তবে তত্ত্বগত ভাবে উপায় একটি আছে- ব্লকচেইন ব্যবস্থাপনায় যদি ৫০ শতাংশের বেশি অংশীদার কোনও বদলের পক্ষে সম্মতি দেয় তবে তা হতে পারে। কিন্তু তা একপ্রকার অবাস্তব। কারণ, লক্ষ লক্ষ কম্পিউটার Node’এ যুক্ত অংশীদারদের ৫০ শতাংশের সম্মতি আদায় করা এক দুরূহ ব্যাপার।

সার কথায়, অংশীদারদের পরস্পরের সম্মতিতে যা লেনদেন হচ্ছে, তা নথিবদ্ধ হয়ে সকলের দৃষ্টিগোচরে থাকছে ও এইভাবে লেনদেনের একটি অপরিবর্তনীয় ধারা বয়ে চলেছে। এখানে অংশীদারেরা যেহেতু পরস্পরের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করে (হয়তো প্রযুক্তিগত ভাবে কিছুটা বাধ্যত) সম্পূর্ণত স্বচ্ছ ও দৃশ্যমান লেনদেন করছে, তাই এখানে তৃতীয় কোনও আস্থাভাজক কর্তৃত্বের প্রয়োজন নেই। যেভাবে দেশে দেশে মুদ্রা ব্যবস্থার নিরাপত্তা ও তার ওপর আস্থা বজায় রাখার জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ধরনের তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন পড়ে, অথবা পণ্য লেনদেনে কারচুপি, মজুতদারি, কালোবাজারি রুখতে সরকারি সংস্থা নজরদারির কাজ করে, ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে তার কোনও দরকার পড়ে না; কারণ, এখানে প্রযুক্তিটাই এমন যে অংশীদারদের পরস্পরের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করেই এই ব্যবস্থাপনাটিকে চালাতে হয়। এই যে তৃতীয় পক্ষের অনুপস্থিতি, এটা এমন এক দিকনির্দেশ যা এ তাবৎকাল চলে আসা লেনদেন এবং অর্থনীতির যাবতীয় আঙ্গিক ও মর্মবস্তুকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। এর সঙ্গে এনএফটি’র প্রচলন এমন এক অনন্য অধিকার যুক্ত লেনদেন ও মালিকানার ধারণা নিয়ে আসছে যে, ভবিষ্যতে তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতিহীন এ হেন অর্থনৈতিক ক্রিয়াই প্রধান পথ হয়ে উঠবে।

উদ্ভুত এই পরিস্থিতি সমাজ-অর্থনীতিকে কোন দিকে নিয়ে যাবে, তা বলার সময় এখনও হয়নি। কিন্তু প্রবণতাগুলি বেশ স্পষ্ট। গত অক্টোবর ২০২১’এ প্রকাশ যে আমাদের দেশে ১০ কোটিরও বেশি মানুষ ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করছেন। দেশের সরকারও বিভ্রান্ত যে- ক্রিপ্টোকারেন্সিকে সম্পূর্ণত বেআইনি ঘোষণা করবে নাকি তাকে শুধুমাত্র সম্পদ হিসেবে (মুদ্রা নয়) ব্যবহার হতে আংশিক অনুমতি দেবে। ক্রিপ্টোকারেন্সি’র মতো অন্যান্য সব লেনদেন ও কর্মপ্রক্রিয়াই যদি ব্লকচেইন প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে যায়, তবে নিঃসন্দেহে তা হবে এক অকল্পনীয় পরিবর্তন। কারণ, তা হবে এক মুক্ত দুনিয়ায় চরে বেড়ানোর মতো। সেখানে কর্পোরেট মহারথীদের আলাদা কোনও কর্তৃত্বের সুযোগ মিলবে কিনা তা যদিও বা এখনও স্পষ্ট নয়, কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন অথচ সম্মতিসূচক এই গণ লেনদেন ব্যবস্থা যে এক নতুন বিশ্বকে আবাহন করছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সাবেক ভূ-রাজনৈতিক-সামরিক রাষ্ট্রের শৃঙ্খল মুক্ত হয়েই কি আগামী বিশ্বের পদচারণা?

Sunday, 16 January 2022

সোভিয়েত পতনের ত্রিশ বছর

দিনের পরে যে দিন এল

অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়


আরেকটা ২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যে ৭টা বেজে ৩২ মিনিট– একদম তিরিশটা বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯১ সালে এই দিনেই– অবিভক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল-পতাকা ক্রেমলিনের শীর্ষদেশ থেকে ধীরে-ধীরে নেমে গিয়েছিল। ঠিক তার পরের দিন ২৬ ডিসেম্বরে ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’-এর মৃত্যু হয়েছিল আর জন্ম নিয়েছিল এক অন্য ভবিষ্যৎ। বিশ শতকের ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল এটা। তাই এই নিয়ে বিস্তর চর্চা, আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। হাজার-হাজার পাতা লেখা হয়েছে তথ্য-যুক্তি-প্রতিযুক্তির বিশ্লেষণে। কেন সোভিয়েত দেশের পতন হয়েছিল, মার্কসবাদ কি চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়নি, সমাজতন্ত্র কি সেখানে সংঘবদ্ধ অপরাধের প্রতিভূ হয়ে ওঠেনি, সাংস্কৃতিক বিপ্লব কি সেখানে গড়েই ওঠেনি, কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত ‘কমান্ড ইকোনমি’ কতটা দায়ী, শ্রমিক শ্রেণির গণতন্ত্র ও দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতান্ত্রিকতার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দ্বন্দ্ব কীভাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল, স্ট্যালিন-ক্রুশ্চেভ-গর্বাচেভ কার ঘাড়ে বন্দুক রাখা যুক্তিযুক্ত, সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ-সংশোধনবাদ-প্রোপাগান্ডা কী ভূমিকা পালন করেছিল, গর্বাচেভ-ইয়েলৎসিন-শুশকেভিচ-ক্র্যাভচুককে ইতিহাস কোন্‌ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবে ইত্যাদি বহু প্রশ্নে এই তিরিশটা বছর জর্জরিত হয়েছে। তার চেয়েও বেশি স্তূপীকৃত হয়েছে নানা মুনির নানা মতামতের দলিল-দস্তাবেজ। পিছন ফিরে সে সব পাতা ওলটানো যেতেই পারে কিন্তু আজ বরং কিছুটা সামনের দিকেই তাকানো যাক, অর্থাৎ, কী লেখা হয়েছে সেই পতনের ভবিষ্যতে। 

এ কথা মনে রাখতে হবে যে, পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদ আফ্রিকা-এশিয়ার সম্পদ ও বাজারের প্রতি চিরকাল লোলুপ। তারা এককালে ‘ধর্মযুদ্ধের’ আড়ালে ইসলামের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে নষ্ট করেছে, তারপর থেকে ভারত সহ নানা দেশ দখল করে ধর্মান্তকরণ করেছে ও সম্পদ চুরি করে নিজেদের দেশে নিয়ে গিয়েছে, হিরোশিমা-নাগাসাকি ঘটিয়েছে, আফগানিস্তান-প্যালেস্তাইন সর্বত্র অশান্তি ছড়িয়েছে, তৈলখনি দখল করেছে, ভিয়েতনামে অত্যাচার চালিয়েছে, আফ্রিকাকে নিজেদের আস্তাকুঁড়ে পরিণত করেছে এবং এইসব করে নিজেদের বানিয়েছে ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রি। হু-ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক ইত্যাদি সর্বত্র আজও নিজেদের প্রভাব বজায় রেখেছে। এসব করার ক্ষেত্রে তাদের কাছে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। তাই তার পতনের জন্য তারা বহু প্রচেষ্টা চালিয়ে উন্মুখ হয়ে বসেছিল। সাফল্য আসতেই সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার শবদেহের পাশে তাদের পৈশাচিক নৃত্য শুরু হয়েছিল যা আজও চলছে। ফলে, তাদের স্বাভাবিক ধর্মই তারা পালন করেছে – অন্যান্য দেশগুলি শুধু নিজেদের সময়ে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে ও এখন অনুতাপ করছে। তবে এইখানে আছে একটি প্রবল ব্যতিক্রম, যারা ওই মৃতদেহটিকে পোস্ট-মর্টেম করে জেনেছিল মৃত্যুর প্রকৃত কারণটিকে। তার নাম হল চীন। 

এখন চীনের নামেও যথেষ্ট বদনাম আছে। আমরা প্রকৃতার্থে জানি না সেই দেশের মানুষের অভিমত কিংবা সেই দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থার কথা। কেন না সেখান থেকে সরাসরি প্রায় কিছুই প্রকাশিত হয় না। এমনকি এই করোনা অতিমারির সময়েও প্রায় কোনও তথ্য সর্বজনে তারা প্রকাশ করেনি। কিন্তু বাহ্যিক ইঙ্গিতে-প্রতিফলনে কিছু বিষয় স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়। এ কথা কি জলের মতো স্বচ্ছ নয় যে, কেন ২০২৮ সালের মধ্যে চীন বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতি হতে চলেছে বলে অনুমান, অতিমারির মধ্যেও চীনের অর্থনীতিতে কেন প্রায় কোনও প্রভাব পড়েনি, কী করে দক্ষিণ চীন সাগর থেকে অন্যান্য নানান প্রান্তে চীন ক্রমশ নিজের ক্ষমতা বিস্তার করছে ইত্যাদি। কোন্‌ মন্ত্রবলে কোন্‌ জাদুবলে চীন এটা করতে পারছে যা আজ থেকে পনেরো বছর আগেও মানুষ ভাবতে পারেনি– তা একবার অনুধাবন করে দেখতেই হয়।

সহজ কথাটি হল, চীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেছে। এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় মানবেন্দ্রনাথ রায়ের চীনের নেতা মাও-সে-তুং সম্বন্ধে বলা কিছু কথা। তিনি ও বরোদিন তখন চীন দেশে গিয়েছেন সেখানকার বিপ্লবকে পথ দেখাতে। তখন সেখানে কৃষক অভ্যুত্থানের টালমাটাল সময়। মাও তখন বড় কোনও নেতাস্থানীয় না হলেও চীনের কৃষক সমাজকে চেনেন খুব ভালো করে। মানবেন্দ্রনাথ লিখছেন, 'আমরা দেখলাম একজন লম্বা কাষ্ঠল মানুষ ঝড়ের গতিতে ঐতিহাসিক সমাবেশটিতে প্রবেশ করল। এই সেই মানুষ যে আগে আমাদের সঙ্গে দেখাটুকু করতে রাজি হয়নি। এখন এসেও একবারের জন্য বসল অবধি না, এমনকি আমাদেরকে প্রায় কোনো পাত্তাই দিল না। বরোদিন তখন চাপা কণ্ঠে আমাকে বলল, বুঝলে তো এই সেইই, অপেক্ষা করো দেখবে এইবারে একটি চীনা বোমা ফাটবে। আমি বুঝলাম এর নামই হল মাও-সে-তুং। মাও চেনের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলল এবং তারপর অত্যন্ত উষ্ণ কন্ঠে বক্তৃতা করতে উঠল, বলল, ‘বিদেশিরা এসে চীনের বাস্তবকে বুঝে ফেলবে এ কথা আমি মানি না। আমি হুনান থেকে সরাসরি আসছি; আর এসে দেখছি এরা আমাদের কৃষকদের ভুলভাল যা-তা বোঝাচ্ছে। আমার স্পষ্ট কথা এই যে, গ্রামে-গ্রামে ঘটানো অপরিপক্ক সমাজ বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর হয়ে যেন আমরা এই মুহূর্তে জাগ্রত আমাদের দেশের জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দুর্বল করে না দিই। পার্টি কংগ্রেস ইতিমধ্যেই অনেক ভুল করেছে। আর যেন তা না করে। এইসব রেজোলিউশন-টেজোলিউশন আপাতত মুলতুবি থাকাই জরুরি।’ আমি শুধু বুঝলাম, এ কোনো সাধারণ মানুষ হতে পারে না।' 

এখন একুশ শতকে দাঁড়িয়ে মনে হয় মাও-এর সেই উত্তরাধিকারকেই চীন হয়তো বহন করছে।

আজ সোভিয়েতের থেকে তিন বছর বেশি সময় ধরে চৈনিক কমিউনিস্ট পার্টি সেখানে রাজত্ব করছে। এর মূল কারণ বোধহয় সোভিয়েতের পতনের পরে চীনের চুপচাপ বসে না থাকা। তারা প্রায় উন্মাদের মতো এই পতনের কারণ অনুসন্ধান করেছিল। চীন বিশেষজ্ঞ ডেভিড শ্যাম্ভো একবার লিখেছিলেন যে, 'তারা (চীনারা) শয়নে-স্বপনে-জাগরণে যেন শুধু এই নিয়েই চিন্তা করছে। আর এই চিন্তা তাদের প্রত্যেকটি বড় সিদ্ধান্তকে প্রভাবিতও করছে।' এই ২০১২ সালেও জিনপিং পার্টি কর্মীদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'বলো কেন সোভিয়েত পড়ে গেল?' এবং বলেছিলেন, 'আসলে আদর্শ ও তার বাস্তবায়নের মধ্যে সেখানে দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল, এমন একজন সত্যিকারের মানুষ পাওয়া যায়নি যে এটাকে আটকাতে পারত।' এটাকে চীন উপলব্ধি করেছিল বলেই হয়তো তারা মূলত তিনটি দিকে নিজেদের ভিত শক্ত করেছিল। এক, তারা পুঁজিবাদকে গ্রহণ করেছিল ঠিকই কিন্তু চৈনিক নৈতিকতার ভিত্তিতে অর্থাৎ, রাশিয়ার আর্থনীতিক অবনতি থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা নিজেরা অন্য কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মাথা গলায়নি, যুদ্ধে অংশ নেয়নি। বরং নিজেদের পরিকাঠামো-পরিষেবাকে উন্নততর করেছিল। তারা রাশিয়ার ‘সোশ্যালিস্ট কমান্ড ইকোনমি’-কে প্রত্যাখ্যান করে চৈনিক মাটির দ্বারা নির্মিত পুঁজিবাদকে গ্রহণ করেছিল। তারা বিদেশি পুঁজির জন্য দরজা বন্ধ করেনি। এমনকি তারা ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনে যোগদান অবধি করেছিল ও ‘বিশ্বের কারখানায়’ নিজেদের পরিণত করেছিল। তারা সরকারি সহযোগিতায় বিরাট বিরাট কারখানা তৈরি করে নিজেদের ধীরে-ধীরে উৎপাদন ক্ষমতার দৈত্যে পরিণত করেছিল। তারা জনগণকে চৈনিক সংস্কৃতির অন্তর্গত রেখে উদার-অর্থনীতির বিলাসিতার দরজা খুলেছিল। তারা পশ্চিমের সংস্কৃতিকে নিজেদের গায়ের চাদর করেছিল ঠিকই কিন্তু মূল পোশাক হয়ে উঠতে দেয়নি। 

দুই, গ্লাসনস্তের মতো ভুল তারা করেনি। তারা চীনের প্রাচীরের মতোই আরেকটি ডিজিটাল প্রাচীর তৈরি করেছে। সেখানে তারা পশ্চিমি চোরেদের ঠেকানোর সমস্ত বন্দোবস্ত করে রেখেছে। তারা আইন ও প্রযুক্তি দিয়ে পশ্চিমি দুনিয়ার নানান ওয়েবসাইট, যেমন, ফেসবুক, গুগল, ট্যুইটার ইত্যাদিকে অনুপ্রবেশ করতে দেয়নি। তারা নিজেদের সিস্টেম নিজেরা বানিয়েছে। তাই চীন দেশের কোনও তথ্যই পশ্চিমি দুনিয়ার কাছে নেই। পক্ষান্তরে চীন কিন্তু পশ্চিমি দুনিয়ার সর্বত্র নিজেদের লোক ঢুকিয়েছে, পশ্চিমের বাজার দখল করে তাদের সব তথ্য সংগ্রহ করেছে অবাধে। এই কারণে এখন মার্কিন দুনিয়া চীনের ওপর বেশ রেগে আছে। ফলে, তারা নানান প্রোপাগান্ডাও চালাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছে না। আর এর কারণ হল তিন নম্বর কথাটি। চীন তার চতুর্পার্শ্বের অঞ্চলে কড়া নজরদারি চালিয়েছে। রাশিয়া যেমন চারপাশে কিছুই দেখেনি, তাই একের পর এক অঞ্চল আলাদা হয়ে গিয়েছিল। চীন সেখানে চারপাশের অঞ্চলগুলিতে অর্থাৎ তাইওয়ান, হংকং, জিনঝিয়াং, তিব্বত ইত্যাদিতে কড়া পাহারা লাগিয়েছে যাতে পশ্চিমি দুনিয়া সেখানে গিয়ে ‘বর্ণ রাজনীতি’র পাশাখেলা, অগাধ সম্পত্তির লোভ দেখানো আর ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি লাগু করতে না পারে। এই তো ২০১৯ সালে হংকং'এ খুব আন্দোলন হল কিন্তু চীন একে চিনতে পেরেই ২০২০ সালের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছিল। এখন চীনের ক্ষমতা এতই বেড়েছে যে তারা অন্যান্য দেশকেও ধমক-চমক দিচ্ছে কিন্তু কেউই বিশেষ জোরের সঙ্গে গলা তুলতে পারছে না, মাঝেমধ্যে ফোঁস করছে ঠিকই। এই যদি চলতে থাকে তবে এ কথা অবশ্যম্ভাবী যে চীনই আগামীর সম্রাট হতে চলেছে। 

২৬ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালের তাহলে এটাই হল ভবিতব্য। মিখাইল চেলনোকভ কিছুদিন আগেই এ ব্যাপারে একমত হয়ে বলেছেন, 'চীন, আমার মতে, অপ্রতিরোধ্য উন্নতির পথেই এগোচ্ছে, চীন কী রাজনৈতিক কী আর্থনীতিক কী সামরিক সর্বদিকেই আরও আরও আরও বেশি শক্তি সঞ্চয় করে যেন একটা ঝড়ের মতো ধেয়ে আসছে।' সুতরাং, এ কথা স্পষ্ট যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে দুনিয়া যেরকম ইউনিপোলার হয়ে গিয়েছিল, একুশ শতকে সেই রাশিয়ার কারণেই আবার তা বাইপোলার হয়েছে। তখন মার্কিন দৈত্য দুনিয়াতে জাঁকিয়ে বসেছিল, এখন বসছে চীন। 

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পঞ্চাশতম বর্ষ পালনের দিনে দুনিয়ার ব্যাটন কার হাতে থাকবে সেটাই এখন দেখার– গিগ অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শাসিত নিকৃষ্ট পুঁজিবাদের হাতে নাকি অচেনা-অজানা এক অন্য সমাজব্যবস্থায় পৌঁছে যাব আমরা। দেখাই যাক ...  


Friday, 14 January 2022

হাসির বাদশা

যা কিছু করুণ তাই হাস্যকর

শোভনলাল চক্রবর্তী


দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বাংলা সাহিত্যে 'হাসির বাদশা' ছিলেন। 'To laugh and laugh all day like the kings of frolic' হিসেবেই তাঁর প্রতিভা বিচ্ছুরিত হয়েছে। তাঁর অট্টহাসির দীপ্তরোলে 'রামগরুড়ের ছানাদের'- যাদের হাসতে মানা, যারা 'হাসির কথা শুনলে বলে হাসব না-না-না'– তাদের হাসি চেপে রাখা মুশকিল। তাদের বাধ্য হয়ে বলতে হয়,

বলি তো হাসব না, হাসি রাখতে চাই তো চেপে

কিন্তু এ ব্যাপার দেখে থেকে থেকে যেতে হয় ক্ষেপে

ও হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।

বস্তুত আমাদের সামাজিক ও দৈনন্দিন ঘটনা ধর্ম ও শাস্ত্রের নাগপাশে এমনই বাঁধা যে, সেখানে হাস্যরসের স্থান সঙ্কীর্ণ। আমাদের সাহিত্যেও তাই হাসিকে খেলার পর্যায়ভুক্ত করে রাখা হয়েছে। হাসিও যে উচ্চস্তরের সাহিত্য হতে পারে তা বাঙালি পাঠক অস্বীকার করে। তাই নব রসের মধ্যে এ রসটি শুধু শিশুদেরই একচেটিয়া বলে গণ্য হয়। বড়রা সব রামগরুড়ের ছানা হয়ে থাকতে চায়। কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না যে সাধারণ লোকের মুখে হাসি আনা খুব সহজ ব্যাপার নয়। তার জন্য সত্যিকার প্রতিভার প্রয়োজন। এবং এই প্রতিভার অধিকারী ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। প্রাণখোলা হাসি দিয়ে তিনি সমগ্র বাংলা সাহিত্যকে প্লাবিত করে দিয়েছিলেন। তিনি সত্যই মনে করতেন–

কেন চটাচটি আর রেষারেষি

আর গালাগালি, ভালোবাসাবাসি

আর বসে গোঁফে দাও তা–

কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গান সম্বন্ধে কিছু বলবার আগে হাস্যরস সম্বন্ধে দু-একটা কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। এ রসের প্রধান ভূমিকা হ’ল তা সত্যকে অনায়াসে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করতে পারে। প্রকৃতি, সামঞ্জস্য ও নিয়মকে তা অনায়াসে অস্বীকার করতে পারে। এই অবাস্তবতাই হাসির খোরাক হয়ে দেখা দেয়। অনেক সাহিত্যিক আবার সমাজের গলদ, ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যাকে ব্যঙ্গ করে হাসির প্রলেপ বুলিয়ে দেন।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ঈশ্বর গুপ্ত, ইন্দ্রনাথ রায়, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, কান্তকবি, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি কয়েকজনই দ্বিজেন্দ্র-পূর্ব যুগে এ রস পরিবেশন করে সার্থক হয়েছিলেন। তবে এঁদের মধ্যে বেশিরভাগই ব্যাঙ্গাত্মক রচনায় হাত দিয়েছিলেন। তাঁদের হাসির নীচে বিদ্রূপের হুলটি সোজা হয়ে থেকেছে। কিন্তু নির্মল হাসির ফোয়ারা দ্বিজেন্দ্রলাল সৃষ্টি করলেন। পরবর্তীকালে সুকুমার রায়কে বাদ দিলে, দ্বিজেন্দ্রলালকেই এ বিষয়ে অদ্বিতীয় বলা যায়। 

শৈশব থেকেই দ্বিজেন্দ্রলাল গান বাঁধতে ও সুর দিতে পারদর্শী ছিলেন। মাত্র বারো বছর বয়সে চাঁদ দেখে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে গেয়ে উঠেছিলেন– ‘গগন ভূষণ তুমি জনগণমনোহারী।’ গান বেঁধেছিলেন তিনি স্বয়ং, এবং তাতে সুরটিও দিয়েছিলেন নিজে। পুত্রের এ গান শুনে তাঁর পিতৃদেব বিখ্যাত ওস্তাদ দেওয়ান কার্ত্তিকেয় চন্দ্র রায় পুলকিত হয়ে উঠেছিলেন এবং আশীর্বাদ করেছিলেন যে তিনি সার্থক কবিগীতিকার হবেন। পিতার এ ভবিষ্যদ্বাণী ফলেছিল। দ্বিজেন্দ্রলাল উত্তরকালে প্রথম শ্রেণির গীতিসুরকারের সম্মান দাবি করতে পেরেছিলেন।

সঙ্গীতের এই প্রতিভা এসে যোগ হল তাঁর কবিপ্রতিভার সঙ্গে। এবং এই কবিপ্রতিভা বিশেষ করে প্রকাশিত হয়েছে হাস্যরস পরিবেশনের ক্ষেত্রে। কাজেই স্বভাবতই দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গানগুলি বাংলা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দাবি করতে পেরেছে। তাঁর হাসির গানগুলিকে তিনি 'হাসির গান' এবং 'আষাঢ়ে' নামক গ্রন্থে সঙ্কলিত করেছেন। হাসির গান সম্পর্কে তিনি লিখেছেন যে– বিলেত থেকে ফিরে তিনি ইংরেজি গান খুব গাইতেন। কিন্তু 'ইংরেজি গান প্রায় কোন বাঙালি শ্রোতারই ভাল লাগিত না। তখন বাংলায় গান রচনা করিয়া গাইতে আরম্ভ করি …এবং কতকগুলি হাসির গানও রচনা করি। এই হাসির গানগুলি অবিলম্বে অনেকের প্রিয় হয় এবং কার্যোপলক্ষে কোন নগরে যাইলেই ঐ সকল গান আমার স্বয়ং গাহিয়া শুনাইতে হইত। সেগুলি একত্রে গ্রন্থাকারে বহুদিন পর প্রকাশিত করি।' 

দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গানগুলিকে মোটামুটি দু-শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে- (ক) কৌতুকসৃষ্টি (খ) বিদ্রূপ। প্রথম শ্রেণির গানে নির্মল হাসির জোয়ার আনাই ছিল কবির লক্ষ্য। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণির গান বাঁধবার সময় সমাজের গলদকে বিদ্রূপের কুঠারাঘাত করেছেন হাসির প্রলেপ দিয়ে। ইংরেজি ‘Comic Song’এর ধরনকে তিনি তাঁর রকমারি হাসির গানে চালু করেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, 'বিলাত হইতে ফিরিয়া আসিয়া ভাষায় হাস্যরসাত্মক কবিতার অভাব পূর্ণ করিবার অভিপ্রায়ে Rev. R.A. Burham রচিত Ingoldsby Legends-এর অনুকরণে কতকগুলি কবিতা লিখিয়া ‘আষাঢ়ে’ নামে প্রকাশ করি।' (নাট্যমন্দির, শ্রাবণ ১৩১৭)। তিনি শুরু করলেন ‘ননসেন্স ভার্সে’ আবোল-তাবোল রচনা করে উচ্চাঙ্গের হাস্যরূপ সৃষ্টি করতে। এখানে তার একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে–

হো বিক্রমাদিত্য রাজার ছিল নবরত্ন ন ভাই

আর তানসেন ছিলেন মহাওস্তাদ – এলেন তাঁহার সভায়।

অ-অ-অর্থাৎ আসতেন নিশ্চয় তানসেন বিক্রমাদিত্যের কোর্টে –

কিন্তু দুঃখের বিষয় তখন তানসেন জন্মান নি কো মোটে।

তা ধিনতাকি ধিনতাকি ধিনতাকি ধিনতাকি মেও- এঁও – এঁও।।

এই হাস্যকর অসঙ্গতি কি কৌশলে কি নিপুণভাবে হাসির খোরাক হয়ে উঠেছে তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। ইতরতাকে বাদ দিয়ে জীবনে কীভাবে রসদার স্ফুর্তি আনা যায় তা দ্বিজেন্দ্রকাব্যে অতি সহজে লক্ষ করা যায়। তাঁর গানগুলির প্রাণ মাতানো উৎসব সহজেই প্রাণভরা হাসির খোরাক হয়ে ওঠে।

এই প্রাণ মাতানো হাসির ভিতর দিয়ে তিনি মাঝে মাঝে আবার আমাদের সমাজের গলদকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপও করেছেন। ব্রাহ্ম, থিওসফিস্ট, নব্য হিন্দু, বিলাত ফেরতা বাঙালি সাহেব, ভণ্ড দেশহিতৈষী, রাজনৈতিক আন্দোলনকারী, বাবু, পণ্ডিত, হাকিম কেউই তাঁর ব্যঙ্গাত্মক গান থেকে বাদ যাননি। এই ব্যঙ্গের একটু পরিচয় দেওয়া যাক্‌। যে-সমস্ত আত্মম্ভরী নেতা তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাজনীতিতে অবতীর্ণ হন, কিন্তু দেখাতে চান যে তাঁরা দেশভক্ত এবং তাঁদের সব কাজের উদ্দেশ্য দেশের উন্নতি, তাঁদেরই উদ্দেশ্যেই কবির 'নন্দলাল' কবিতাটির সৃষ্টি। নন্দলাল মনে করে 'আমি না করিলে কে করিবে আর উদ্ধার এই দেশ?' প্রয়োজনের সময় তার মুখেই আমরা শুনতে পাই –

ভায়ের জন্য জীবনটা যদি দিই ---

না হয় দিলাম – কিন্তু অভাগা দেশের হইবে কি?

বাঁচাটা আমার অতি দরকার ভেবে দেখি চারিদিক।

আবার যারা স্বদেশের স্বাতন্ত্র্য ও কৃষ্টি ভুলে গিয়ে বিদেশের অন্ধ অনুকরণে আত্মসমর্পণ করেছেন তাঁদের উদ্দেশ্যে কবি অনায়াসে বলেছেন–

আমরা হ্যাট বুট আর প্যান্ট কোট পরে

সেজেছি বিলিতি বাঁদর।

আবার তথাকথিত সমাজ সংস্কারকদের যারা ধর্মের মুখোশ পরে থাকলেও ধর্মের ধার ধারেন না তাঁদের উদ্দেশ্যেও কবির ব্যঙ্গ শোনা যায় –

করি hoot alike the Hindoos, the Buddhists,

The Mohomedans, Christian and Jews

কিন্তু ফলার ভোজে হিঁদু নই if you think

তা’লে you are an awful goose.

কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলালের ব্যঙ্গের বিশেষত্ব এই যে তাঁর ব্যঙ্গ কাউকে আঘাত করেনি, কেউ তাতে রুষ্ট হতে পারেনি; তার কারণ তিনি নিজেকেও এর মধ্যে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। তিনি যে এসব ভারতবাসীদের থেকে পৃথক নন তা তিনি স্বীকার করে বলেছেন 'চম্পটির দল আমরা সব'। তাঁর বিখ্যাত 'নন্দলাল' কবিতাটি রচিত হয়েছিল ‘সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে’ উদ্দেশ্য করে। কিন্তু, তিনিই এ কবিতাটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছিলেন। কাজেই সহজেই উপলব্ধি করা যায় কবি কী নিপুণভাবে, সহজভাবে মানুষের ভুলকে তুলে ধরতে পারতেন। এ সমস্ত কবিতার মধ্যে মনুষ্যত্বের একটা দীপ্ত আদর্শ ফুটে উঠেছে। এখানে শুধু তিনি সংসারকে কষাঘাত করেননি, সাহিত্যস্রষ্টার অন্তর্দৃষ্টি ও শিল্প একসঙ্গে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। এই ব্যঙ্গ ও শ্লেষের সঙ্গে আর একটি উপরি পাওনা আছে- তা হল কবির হৃদয়ের প্রাণঢালা দরদ। নিরপেক্ষতার তুলাদণ্ডের জন্যই বিদ্রূপকে হজম করেও পাঠক তাঁর গানের জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠত। তিনি শুধু বাঙালি পাঠককে হাসাতেই আসেননি, সেই সঙ্গে তাকে ভাবিয়ে তুলতেন। ইংরেজি শব্দের সঙ্গে বাংলা শব্দের মিল দিতেও কবি সিদ্ধহস্ত, যেমন –

From the above দেখতে পাচ্চ বেশ

যে আমরা neither fish nor flesh

আমরা curious commodities, human

Oddities denominated Baboos.

আমরা বক্তৃতায় যুঝি ও কবিতায় কাঁদি কিন্তু

কাজের সময় সব ঢুঁ ঢুঁ।

কবি নিজে কাব্য রচনার সময় ভাষা এবং ছন্দ সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন – ‘যেরূপ বিষয় সেইরূপ ভাষা হওয়া বিধেয় মনে করি।' তাই হাসির গান রচনা করবার সময় তিনি ভাষাও ব্যবহার করেছেন সে রকমই হাল্কা ধরনের। কিন্তু ছন্দের ক্ষেত্রে কবি খুব বেশি সার্থক হতে পারেননি। কবি নিজেই তাঁর ত্রুটি স্বীকার করে বলেছেন, 'এ কবিতাগুলির ভাষা অতীব অসংযত ও ছন্দোবদ্ধতা অতীব শিথিল। ইহাকে সমিল গদ্য নামেই অভিহিত করা সঙ্গত।' বস্তুত পদ্যের কাঠামোতে স্বচ্ছন্দভাবে গদ্য-উচ্চারণধর্মী স্বাভাবিক বাক্‌পর্ব ব্যবহার করতেই কবি চেষ্টা করেছেন। তবে এ কথা ভুললে চলবে না যে এগুলি সমস্তই গান। সুরের সঙ্গেই তাদের পূর্ণাঙ্গ রূপ। কাজেই সংগীতে সুর অনায়াসেই ছন্দের শিথিলতাকে ঢেকে দিতে পারে। তবে হাসির গান চেনা করবার সময় কবি বিভিন্ন প্রকারের ছন্দ ব্যবহার করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। এমন কি ইংরেজি ছন্দের সুরের আমেজের প্রভাব থেকেও মুক্ত হননি। যেমন –

হ’ল কি! এ হল কি! এতো ভারি আশ্চর্যি!

বিলাত ফের্তা টানছে হুক্কা, সিগারেট খাচ্চে ভট্টার্য্যি।

হোটেল ফের্তা মুন্সেফ ডাকছেন ‘মধুসূদন কংসারি’

চট্ট চটির দোকান খুলে দস্তুরমত সংসারি! 

কবি নিজে প্রগতিবাদী ছিলেন। পাশ্চাত্যের আদর্শকে তিনি গ্রহণ করলেও অনুকরণ এবং উচ্ছৃঙ্খলতাকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। আবার সেই সঙ্গে স্বদেশের কুসংস্কার ও গোঁড়ামিকে স্বীকার করেননি। তাই সে ক্ষেত্রে শোনা যায় তাঁর ব্যঙ্গ তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর –

যদি চোরই হও, কি ডাকাত হও –

তো গঙ্গায় দাও গে ডুব

আর গয়া, কাশী, পুরী যাও

সে পুণ্যি হবে খুব,

আর মদ্য মাংস খাও –

বা যদি হয়ে পড় শৈব,

আর না খাও যদি বৈষ্ণব হও –

এর গুণ কত কৈব।

দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গানে সাময়িক বিষয়গুলির মধ্যে চিরকালের মানুষের ভণ্ডামি, কপটতা এবং অসততা ধরা পড়েছে। কিন্তু শিল্পীর নিপুণ হাতের তুলি তাকে হাসির রঙে সজীব করে রেখেছে। এবং বহুদিন পর্যন্ত সহজ সরল প্রাণখোলা হাস্যকৌতুক আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাকে আনন্দ দান করতে পারবে আশা করি। 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় দুঃখবাদী বা অবিশ্বাসী ছিলেন না বটে কিন্তু তিনি দেখিয়েছেন যে সংসারে যা কিছু করুণ তাই হাস্যকর। মানবসুলভ হাসি-কান্না পরস্পর জড়িত- এপিঠ ওপিঠ মাত্র। কিন্তু তা বলে মানবজীবনকে তিনি কখনও নিরর্থক বলে মনে করেননি। দুনিয়ায় আনন্দকে উপলব্ধি করে তিনি বলতে পেরেছেন– ‘বাহবা দুনিয়া কি মজাদার রঙিন।’ যেমনটি চাই তেমন হয় না বটে কিন্তু তার জন্য নিরর্থক তাঁর কোন দুঃখও ছিল না। পৃথিবীর দুঃখকে স্বীকার করেও বলেছেন, 'পৃথিবীতে হাস্য ও গাম্ভীর্য যেরূপ পাশাপাশি আমি সেইরূপই চিত্রিত করিতে প্রয়াসী হইয়াছি।' ‘প্রেম’ যত গুরুতর গম্ভীর ব্যাপক হ’ক না কেন এর চিন্তা, কল্পনা, আবেগ ও অশ্রুবেদনার পাশে এর নানা অসঙ্গতি ও আতিশয্য কৌতুক সৃষ্টিও করে। দ্বিজেন্দ্রলালের ‘বসন্ত’, ‘স্ত্রীর উমেদার’, ‘প্রেমতন্ত্র’, ‘এস এস বধূ এস’, 'নয়নে নয়নে রাখি’, ‘বিরহতত্ত্ব’ প্রভৃতি গানগুলি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। এখানে পরিহাসের সঙ্গে সঙ্গে উদ্দেশ্যও ফুটে উঠেছে। এই অনাবিল হাসির দিন কী আর ফিরবে না?


Wednesday, 12 January 2022

নতুন পথের খোঁজে

চক্রান্তের তত্ত্বে নয়, নতুন দুনিয়াকে বুঝতে হবে!

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

বছর ঘুরে গেছে বেশ কয়েকদিন হল। নিজেরও লিখতে গড়িমসি, অন্যদেরও তথৈবচ। আসলে লেখাজোকা পড়ছে কে! বাড়ি বাড়ি খবরের কাগজ রাখাই যখন প্রায় উঠে যেতে বসেছে, তখন ‘কী পড়ি কেন পড়ি’ আরও একবার সচকিত করে বইকি। ‘একক মাত্রা’ সেই কবেই এমন বিষয়ের ওপর একটি সংখ্যা করেছিল। আসলে, পড়তেই হবে, অথবা এই এই বই, এই এই নিবন্ধ, এই এই উপন্যাস-গল্পগুচ্ছ না পড়লে জীবন রসাতলে- এমনতর বিধির বিধানের ‘জাঁতাকলে’ হয়রানি ও রসবোধ দুইই ছিল। যদি ‘গজাল মেরে’ বই পড়ানোর ইচ্ছে জাগে, তবে ধিক সে পণ্ডিতকুলকে। বই অনেক সময়ে আমাদের মাথাতেই থাকে- যেমন তিজন বাঈ’এর ‘মহাভারত’।

বাবা-কাকা বা তাঁদেরও আগের আমলে শুনেছি, ‘নভেল’ পড়া ছিল গর্হিত অপরাধ। নভেল পড়ে ছেলে-ছোকরার দল সব উচ্ছন্নে যাচ্ছে, এ অভিযোগ সে কালে আকছার শোনা যেত। তাই, সে সব লুকিয়ে পড়ার ছল ও কল দুইই আবিষ্কৃত হয়েছিল। কালে কালে সে সব গেছে। শনৈ শনৈ শরৎচন্দ্র পড়ে ফেলাও সহজাত হল। ‘দেবদাস’এর আকর্ষণ সারা দেশ জুড়েই প্রবল প্রভাব ফেলল। অবশ্য এই সেদিনও ‘বিবর’ অথবা ‘রাত ভোর বৃষ্টি’ নিয়ে কম আদিখেত্যা হয়নি। আইন-আদালত, জেল-জরিমানা সব ঘুচিয়ে তবুও বাঙালি সনাতনী মধ্যবিত্ত বোম্বের ছায়াছবিগুলিকে তখনও ‘লাড়ে-লাপ্পা’ বলে গাল পাড়তে ছাড়েনি। সত্যজিতের ছবি করে খ্যাতিমান শর্মিলা ঠাকুর যখন বিকিনি পরে ‘অ্যান ইভিনিং ইন প্যারিস’ করলেন, তখন ‘ভদ্দর শিক্ষিত বাঙালি’ তাঁকে ছিঃছিক্কার করতে রেওয়াত করেনি। সেই বাঙালিকুলের অংশবিশেষ আজও বহমান। কেন জানি মনে হয়, এই মহা ধুরন্ধর ‘শিক্ষিত’, ‘বইপোকা’ বাঙালির অংশবিশেষ কালিঘাট কন্যার মুখে ‘পবলেম’ শুনে যারপরনাই এতটাই ‘বিপন্ন’ বোধ করেন যে, ‘রাজাবাজারের ‘ওরা’ হেলমেট ছাড়া বাইক চালায়, তবু পুলিশ কিছু বলে না’ এই অজুহাতে এই ‘বাড়াবাড়ি’র দাওয়াই হিসেবে ‘জয়শ্রীরাম’ ধ্বনিতে আশ্বস্ত হন। এঁরাই আবার হোস্টেল জীবনে ‘র‍্যাগিং’ এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ট্রোলিং’ দুইয়েই বেশ পারদর্শী। তাঁদের হা-হুতাশ ও দীর্ঘশ্বাসের অন্ত নেই।

আশার কথা, দীর্ঘকাল ছড়ি ঘোরানো স্বঘোষিত ‘বামপন্থী’ মিশেলে এই তথাকথিত সজ্জন অথচ আদ্যোপান্ত ‘মিচকেল’ ভদ্দরলোক বাঙালির আধিপত্যের যুগের অবসান হয়েছে। কথাটা বলছি এই কারণেই যে, এঁদের দীর্ঘশ্বাস ও আক্ষেপ এখন কান পাতলেই প্রকট। কিন্তু কে শোনে কার কথা! এমন সব কল বেরিয়েছে যে ‘জয় জগন্নাথ’ বলে ভেসে পড়লেই হল। অভিভাবকগিরির দিন শেষ! রোদে পুড়ে পিঠ ঝামা হয়ে যাচ্ছে, তবু রাজামশাইয়ের অঙ্ক কিচ্ছুটি মিলছে না। তাই, চোখের ওপর ঠুলি দাও, আর মেহের আলির মতো চিল্লাও ‘সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়’।

গত শতকের বিশের দশকে কলকাতা পৌরসভায় মহিলাদের ভোটাধিকার থাকা উচিত কিনা- এই বিতর্কে মহিলাদের ভোটাধিকারের বিরুদ্ধে সব থেকে বেশি সরব হয়েছিলেন শিক্ষিত পুরুষ ভদ্দরজনেদের এক বড় অংশ। আজ একশো বছর পরেও দেখা যায়, খাতায়-কলমে এনারা নিজেদের যতটা বিদ্রোহী ও বেপরোয়া দেখানোর বাসনা রাখেন, কার্যত রুক্ষ বাস্তবে একেবারেই রক্ষণশীল। নয়তো, সত্যজিতের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিতে শেফালি অভিনীত নার্সের চরিত্রায়ন নিয়ে অত জলঘোলার আর অন্য কোনও কারণ ছিল কী! সকলেই তো জানি, গল্পে এক শ্রমিককে মাতাল দেখালে যেমন সমস্ত শ্রমিকদের মাতাল বোঝায় না, অথবা এক অর্থলোভী চিকিৎসক কখনই গোটা চিকিৎসক সমাজের প্রতিচ্ছবি নয়, সেভাবেই খানিক ‘বাঁকা পথে হাঁটা’ এক ব্যক্তি যিনি নার্সিং পেশায় যুক্ত, মোটেই গোটা নার্স সম্প্রদায়কে প্রতিফলিত করে না। সাধে কি আর স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যুর পরের দিন খোদ ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ খবর করে যে, বেলুড় মঠের এক ‘মাংসখেকো’ সাধুর জীবনাবসান হয়েছে! রবি ঠাকুরকেও এঁরা ছেড়ে কথা বলেননি। অথচ, কবির নোবেলপ্রাপ্তির পর এঁরা দল বেঁধে একটা গোটা ট্রেন ভাড়া করে কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন রওনা দিয়েছিলেন তাঁকে সম্বর্ধনা দিতে। ভাগ্যিস, কবি সে সম্মাননার ‘পানপাত্র’ নিজ ‘ওষ্ঠ স্পর্শ করা’ অবধি সম্মতি দিয়েছিলেন, ‘গলাধঃকরণ’এ নয়। খোলসা করে বললে, পত্রপাঠ বিদায়!

এখন প্রশ্ন হল, এই সমস্ত বিড়ম্বনার কতটা কী গায়ে লাগে! রামকৃষ্ণদেব দেব বলতেন, সংসারে থাকবি পাকাল মাছের মতো। অর্থাৎ, চরে বেড়াবি, কাদার মধ্য দিয়েও যাবি, কিন্তু গায়ে মাখবি না। কেউ পারেন, কেউ পারেন না! সম্ভবত না পেরে, বিদ্যাসাগর কলকাতা ছেড়ে কারমাটাড়ে আশ্রয় নিলেন। ‘পথের পাঁচালী’র শ্যুটিং’এর গোড়ায় সত্যজিতের দল যখন বোড়ালের গ্রামে ঢুকতেন তখন স্থানীয় এক ব্যক্তি (সুবোধদা- যার সঙ্গে সত্যজিতের পরে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল) হৈ হৈ করে চিল্লিয়ে উঠতেন, ‘ফিল্মের দল এয়েচে, লাঠি-বল্লম নিয়ে সব এসো’। শেষমেশ অবশ্য সত্যজিৎ পেরেছিলেন।

এখন চারপাশে সব শব্দকল্পদ্রুম! সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে কোটি কোটি শব্দের ভেলা। অথবা ছবির পর ছবির আকাশ-পাতাল। চীৎকার-চেঁচামেচি-গান-হুল্লোড়। কে কাকে কোনটা বেছে নিতে বলবে! কেই বা কার কথা শুনছে! হাতে কলম-পেনসিল পেলে শিশু যেমন যেখানে যা খুশি দাগ কাটে, সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালগুলি এখন তেমন যেমন খুশি আঁক-কাটার, আবার হাগু-হিসু দিয়ে ভরিয়ে দেবার। বঙ্কিম লিখেছিলেন, উহারা একটি পত্রিকা বার করিয়াছে, উহাদের কিছু রস দাও; এখন আরও খোলামেলা- উনাকে একটু খুশি খুশি দেখছি, উনার মুখে হেগে আসি। ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’ এমনই হয় কিনা তা পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার বিষয়, কিন্তু ‘সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়’ যে বহু পুরনো প্রবাদ! অতএব, এই ডামাডোলের বাজারে যা ঘটছে- সকলেরই মত ও মতামত প্রকাশের সুযোগ অবারিত এবং সেই সুবাদে সত্য-মিথ্যাকে কতিপয়ের পকেটস্থ রাখার আর কোনও উপায় নেই। আজ যা সত্য, আজ যা বিশ্বাসযোগ্য, আজ যা জনপ্রিয়, কাল তা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত। ‘কাহারও সমান নাহি যায়’- সত্যি সত্যি, ‘ছিল রুমাল হয়ে গেল বিড়াল’।

তাহলে আমরা কি এক সুনিপুণ নৈরাজ্যবাদের কোটরে প্রবেশ করেছি? গান্ধী নিজেকে একজন নৈরাজ্যবাদী হিসেবে ভাবতে চাইতেন। গান্ধীর কাছে নৈরাজ্যবাদের অর্থ ছিল শাসকহীন এক আত্মশাসন। যে কারণে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর তিনি কংগ্রেস দলটাকে উঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ভদ্দরজনেরা এই ধরনের নৈরাজ্যবাদ পছন্দ করেন না। কারণ, তাহলে তাদের হাতে আর ক্ষমতার রাশ থাকে না। আর তা না হলে তারা যে নিতান্তই অসহায় ও সেই হেতু অতীব হিংস্র হয়ে ওঠেন তা সুবিদিত; আজ সোশ্যাল মিডিয়ার দরুণ তা তীব্র ভাবে প্রকটমান। সেই অসহায়তা মিশ্রিত হিংস্রতা এবং তজ্জনিত আক্ষেপ ও অভাববোধ থেকেই উদিত হয়েছে ‘চক্রান্তের তত্ত্ব’। যখন ঘটনা মোটে মনের মতো এগোচ্ছে না, তখন নিশ্চিত এক চক্রান্ত চলেছে কোথাও। কিছু শক্তিধর মানুষ গোপনে কোথাও মিলিত হয়ে বসে তৈরি করেছে ভবিষ্যতের মাস্টারপ্ল্যান। তা কোভিডের নানান ভ্যারিয়েন্ট হোক কি ডিজিটাল দুনিয়ার অবিশ্বাস্য বাঁক- সবটাই পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাইই যদি হয়, তাহলে নতুন করে বোঝার আর কোনও দরকার পড়ে না। ‘সবই ব্যাদে আছে’র মতো সরল সমাধান।

এই সব মিলিয়ে এখন অতএব এক হুলুস্থুল কাণ্ড। মনে পড়বে, উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডে বস্ত্রশিল্পের একদল শ্রমিক (লুডাইট) মনে করেছিলেন, নব-উত্থিত পুঁজিবাদের গর্ভে জন্মজাত আধুনিক যন্ত্রপাতিই হল যত দুঃখকষ্ট ও বৈষম্যের হেতু, অতএব, সেগুলিকে ভাঙো ও ধ্বংস করো। কিন্তু চোরের ওপর রাগ করে তো মাটিতে ভাত খাওয়া যায় না- যন্ত্র তো নিথর, নির্বাক কিছু উপাদান মাত্র, যাকে কাজ লাগিয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে মুনাফার হারকে উর্ধ্বমুখি করে মালিক শ্রেণি। যে যন্ত্র আখেরে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে তা তো মানুষের কল্যাণেই লাগে। আসলে, যন্ত্র নয়, যন্ত্রকে কব্জা করে শোষণের হারকে বাড়ানোর মধ্যেই ছিল সংঘাতের মূল অবস্থান। তা যখন শ্রমিকেরা বুঝলেন তখন আর যন্ত্র ভাঙার কারণ থাকে না, কারণ আন্দোলনের বর্শামুখ পেয়ে গেছে রাজনৈতিক-অর্থনীতির মূল অভিমুখ শ্রেণি শোষণকে। আজও যারা ডিজিটাল দুনিয়ার অবাক কাণ্ড দেখে ক্ষিপ্ত হচ্ছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অসীম কর্মযোগ দেখে বিহ্বল হয়ে উপায় হাতড়াচ্ছেন- তাঁদের বুঝতে হবে, যা গেছে তা গেছে। যন্ত্রের ওপর গোঁসা করে পাড়ার দোকান থেকে চাট্টি মালপত্তর কিনে ফেসবুকে তার ছবি সাঁটিয়ে বড়জোর খানিক কলার তুলে সামান্য বাহবা আদায় হতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক-অর্থনীতির গতিমুখকে তাতে একটুও নাড়ানো যায় না। কারণ, আপনারও কথা জানানোর জায়গা সেই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ইউটিউব।

পুঁজিবাদের উত্থানের মধ্যে মার্কস সাহেব যেমন এক নতুন শ্রেণির উদয়কে দেখেছিলেন- সে সময়ের ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রের অ্যাসেমব্লি লাইনে কর্মরত হাজার হাজার মজুর শ্রেণি, যাদের শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার আর কিছুই ছিল না- আজও তেমনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত নতুন পুঁজিবাদের গর্ভে যে নবতর শ্রেণি বিন্যাস নিত্য নির্মিত হয়ে চলেছে, তার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে আগামী ভবিষ্যতের সম্ভাবনার বীজ। সে সম্ভাবনা কীভাবে ও কোন পথে আবারও শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন ও পরিবর্তনের স্বর্ণযুগ হয়ে উঠতে পারে তার জন্য হয়তো আরও একটি নতুন ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থের প্রয়োজন পড়তে পারে। কিন্তু কথায় বলে, পথেই হবে এ পথ চেনা- সেও কম বিস্ময়ের নয়। ভদ্দরলোকের প্রাঙ্গণ ছেড়ে শ্রমজীবী মানুষ নিজের পথ ঠিকই বেছে নেবেন। এ প্রসঙ্গে ‘ম্যানিফেস্টো অফ দ্য কমিউনিস্ট পার্টি’র একটি ভূমিকায় এঙ্গেলস স্পষ্ট করেছিলেন, কেন তিনি ও মার্কস ‘সোশ্যালিস্ট’এর বদলে ‘কমিউনিস্ট’ শব্দটিকে চয়ন করেছিলেন। আসলে, ‘সোশ্যালিস্ট’ শব্দটি সে সময়ে চিহ্নিত করত সমাজের সেই সমস্ত বুদ্ধিজীবী ও ভদ্রজনেদের যারা শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন নিয়ে কচকচি করে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। আর কমিউনিস্ট ছিলেন তাঁরা যারা বাস্তব হাতড়ে হাতড়ে সত্যিকারের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এগোতে চাইতেন।

ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্ত করে না। আজকের বার্তা লেখা হবে আগুয়ান প্রযুক্তির উত্তপ্ত গর্ভেই। এর চলমানতা ও পরিবর্তনের আঙ্গিককে বুঝেই নতুন রাজনীতির উদয় হচ্ছে ও হবে!