Wednesday, 24 February 2016

দেশপ্রেম না হ য ব র ল



জেএনইউ ও তারপর

প্রবুদ্ধ বাগচি 

জেএনইউএর ঘটনাটি নিয়ে গত পক্ষকাল ধরে নানারকম সমালোচনা পাল্টা সমালোচনার যে ধারাবাহিক স্রোত চলেছে তাতে মুখ ও মুখোশের নানা ভঙ্গিমা আমরা ইতিমধ্যেই দেখে ফেলেছি। একটি ছাত্র সংসদের সম্পাদকের কোনও একটি বিশেষ দিনের বক্তব্যকে ঘিরে এত বড় মাপের টালমাটাল, এত সুতীব্র রাজনৈতিক চাপান উতোর স্মরণকালের মধ্যে ঘটেছে, এমন মনে পড়ে না। পাশাপাশি, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভিতরের ঘটনা জাতীয় রাজনীতির উত্তাপকে বাড়িয়ে তুলে সংসদ অবধি গড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশ অভাবনীয়। এইসব আলোচনা ও প্রতিক্রিয়া থেকে আমরা দেশপ্রেমের নানা হ য ব র ল সংজ্ঞা যেমন জানার সুযোগ পেলাম তেমনই একটি ছকে বাধা দেশপ্রেমের বিরুদ্ধে জোরে কন্ঠ তুললে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কোন পর্যায়ে যেতে পারে তার একটা মগজহীন আদলও দেখতে পেলাম। এবং নিয়ত দেখতে পাচ্ছি। সবটাই একটা পুতুলনাচের ইতিকথা, যার সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা দখলের অগোপন সংযোগ রয়েছে। এটা বুঝতে কোনও অসুবিধে নেই যারা আদালতে গিয়ে ছাত্র পেটাচ্ছে এবং সোস্যাল মিডিয়ায় নানা প্ররোচনামূলক বক্তব্য অনায়াসেই রাখছে এবং ফতোয়া দিচ্ছে দেশপ্রেমের নামে, আর যাই হোক তারা এই দেশটাকে চেনেন না এবং প্রেম শব্দটা তাঁদের অভিধানে নেই। অথচ এই দুটি শব্দকে গ্লুস্টিক দিয়ে জুড়ে তারা একটা ধাঁচা বা খাঁচা তৈরি করেছে এবং যার বাইরে সবাইকে একই ব্র্যাকেটে ফেলে নিজেদের উগ্রতাকে উলঙ্গ করছে। হ্যাঁ, এমনটাই কথা ছিল। এবং এই ছকটা যে আমাদের খুব অচেনা তা নয়। মার্কিন দেশের কোন এক রাষ্ট্রপ্রধান বলেছিলেন যে যারা আমাদের ইরাক নীতি সমর্থন করেন না তারা আমাদের বিরুদ্ধের লোক এবং দেশবিরোধী। বিহার নির্বাচনে গোহারা হেরে যাওয়ার আগে ভাজপার দশাসই সর্বভারতীয় সভাপতি বলেছিলেন এখানে যারা তাঁদের ভোট দেবেন না ধরে নেওয়া হবে তারা পাকিস্তানের সমর্থক। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালেও এমন একটা সাদাকালো ধারণার ভাবনা সুকৌশলে ছড়ানো হয়েছিল, যদিও আসন সংখ্যার হিসেবে ভাজপার জয়জয়কার তাঁদের প্রাপ্ত ভোটের শতাংশের সঙ্গে মেলে না। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভোটার এই দলটিকে ভোট দিয়েছেন, অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ ভোটার এঁদের বিরুদ্ধেই মত দিয়েছেন। তার মানে কি এরা সকলে পাকিস্তানের সমর্থক?  এই ভয়ংকর বক্তব্যের মধ্যে একটা সলতে পাকানোর ব্যাপার ছিল এবং ভাজপা বিহারে হেরে ভূত না হলে সেই বোমাটা বিহারেই হয়তো ফাটত। কিন্তু, বাস্তবে তেমন ঘটল না কিন্তু বারুদের জড়ো হওয়া স্তুপ তো আর নিস্তেজ করা  হয়নি।  দাদরি থেকে পান্সার হত্যা, কালবুরগি নিধন এগুলো আসলে সব ওই জমাট বাধা বোমাটার ফেটে যাওয়া একেকটা টুকরো ছিল। আমরা কেউ কেউ বুঝেছি কেউ বুঝিনি। বুঝলাম, যখন রোহিত ভামুলার ঘটনা হল, যখন কানহাইয়া গ্রেফতার হল। এটা সেই বোমার বারুদ যা ভাজপা ও তার ছোট বড় মেজ শরিক ফাটিয়েই ফেলল, না ফাটিয়ে উপায় ছিল না। বোমা, যা নাকি ঘৃণার বারুদ আর আগ্রাসী মৌলবাদের স্প্রিন্টার দিয়ে বানানো  হয় তা তো ফাটানোর জন্যই তৈরি হয়, আলমারিতে সাজিয়ে রাখার জন্য নয়। তবে উপলক্ষ লাগে। প্রয়োজনে তা তৈরি করে নেওয়া যায়। জেএনইউএর ঘটনা সেই প্রকল্পের অংশ যাকে এখনও কোনও আরএসএস মতধারী নেতার নামে চিহ্নিত করা হয়নি। কিন্তু তাতে বোমা ফাটাতে অসুবিধে কী?
ব্ব দশকের শেষে যখন ভাজপা এনডিএ জোটের নেতৃত্ব নিয়ে ক্ষমতায় আসে তার আগে তাঁদের মূল ইসু ছিল রাম মন্দির। সরকারে এসে পাঁচ বছর কাটিয়ে রাম মন্দিরের একটা ইটও গাঁথা হয়নি। বিলগ্নিকরণের নামে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্পগুলিকে জলের দামে দেশি বিদেশি শিল্পপতিদের হাতে তুলে দিয়ে ‘ফিল গুড’ আর শাইনিং ইন্ডিয়া স্লোগান দিয়ে ভাজপা ক্ষমতা থেকে সরে যায়। এবং ২০০৪এর লোকসভা নির্বাচনের পর ভাজপার কোমর ভাঙা অবস্থায় তাঁদের কেন্দ্রীয় প্রতাপও বেশ নিভু নিভু হয়ে আসে কারণ অটল বিহারীর রাজনৈতিক সন্ন্যাস, আদবানির প্রধানমন্ত্রী হতে না পারার হতাশা,  প্রমোদ মহাজনের হত্যা, উমা ভারতীর হাটে হাঁড়ি ভাঙা নানা মন্তব্য ইত্যাদি উপরন্তু ছিল সরকারে এসেও রাম মন্দির না গড়তে পারা, ৩৭০ ধারা বিলোপের পথে এক মিলিমিটারও এগোতে না পারা, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি শিকেয় তুলে রাখা এইসব বাবরি মসজিদ ধবংসের প্রায় ষোলো সতেরো বছর পর যেদিন বাবরি মসজিদ মামলা নিয়ে আদালতের রায় বেরোয় সেইদিন সরকারি প্রশাসন তটস্থ হয়ে ছিল, কী জানি কী হয়; ওই ঘটনার চব্বিশ ঘণ্টা আগে থেকে সারা দেশে এসএমএস আদানপ্রদান নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় কিন্তু দেশের মানুষের আগ্রহ যে ইতিমধ্যে অনেকটাই মন্দির মসজিদ থেকে সরে গেছে সেদিন সারা দেশ বিষয়টায় একরকম উদাসীনতা দেখিয়ে তা প্রমাণ করে দেয় সম্ভবত সেই সময় ভাজপা নেতৃত্ব বুঝতে পারেন রাম এর নাম নিয়ে আর ক্ষমতায় ফেরা সম্ভব নয় অতঃ কিম!
কিন্তু সেই সময় ইউপিএ সরকারএর ব্যাটিং গড় মন্দ নয় উদারনীতি অর্থব্যবস্থা তাঁদের বরাবরের পছন্দ সংস্কারের নামে তাঁদের জিভ দিয়ে জল পড়ে এগুলোর কোনোটার সঙ্গেই তো ভাজপার তেমন কোনো বড় বিরোধ নেই ফলে কেন কংগ্রেস নয়, তারাই সেরা এটা বলার পরিসর তখন ছিল না, বললেও কেউ শুনত না
এই সুযোগ এল দুভাবে এক, একটি অস্পষ্ট নীতিগত কারণ দেখিয়ে ইউপিএ থেকে বামেদের সমর্থন প্রত্যাহার আর ইউপিএ ২ বেশ সন্তোষজনক ভাবে লোকসভায় ফিরে এলেও প্রথমত ধারাবাহিক দুর্নীতি ও নানা চাপে আর্থিক সংস্কারের শ্লথ গতি ইউপিএকে কিছুটা ব্যাকফুটে ফেলে দেয় আর্থিক সংস্কারের ফলে লাভের কলাটা মুলোটা যারা সব থেকে বেশি পান তাতে এঁদের খুশি হওয়ার কথা নয় হনওনি কিন্তু দেশে যাই হোক একটা সংসদীয় ব্যবস্থা আছে, যখন তখন সরকার পালটে দেওয়ার সুযোগ সেখানে কম এই শূন্যতাটা পূরণ করতে আসরে নামে ভাজপা এবং তাঁদের নয়া ব্রিগেডের বিকাশপুরুষ মোদীভাই যার নিজের রাজ্যে কাজের থেকে প্রচার বেশি শিল্পের নামে উন্নয়নের ঢাক বাজানোয় যার জুড়ি নেই আর জুড়ি নেই নিজেকে প্রোমোট করায় ( হ্যাঁ একদম নিজেকেই, অনেকটা আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মতো ঘটনাচক্রে যার প্রিয় কোটেশন আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার তলে) সুতরাং মোদি, অতএব মোদি, অগত্যা মোদি ২০১৪ লোকসভা নির্বাচন মোদিময় যিনি নাকি উন্নয়নের ভগীরথ হয়ে দেশকে জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নিইয়েই ছাড়বেন তার জন্য মন কী বাত’, তার জন্য চায়ে পে চর্চা’, তার জন্য ঝাড়ু হাতে রাস্তা সাফাই এবং আমূল সংস্কারের ঢালাও প্রতিশ্রুতি একেবারে শেষের অ্যাজেন্ডায় দেশের বণিক মহলে পুলক অন্তহীন তারা মোদির ওপর বিনিয়োগে রাজি কারণ তাঁদের ধারণা এই বিনিয়োগ উপরি ডিভিডেন্ড হয়ে ফিরবে তাই ঝাঁ-চকচকে কর্পোরেট প্রচার, জনমানসে এই অবতারকে প্রায় বিগ্রহ হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং বিপুল জয়
কিন্তু ভাজপা আসলে একটা রাজনৈতিক দল হলেও তাঁদের তাত্ত্বিক সদর দফতর নাগপুর এবং ওই নাগ বাহিনীর স্বাভাবিক কিছু ফণা তোলা ইসু আছে যা ঠিক আমাদের সংবিধানসম্মত শাসনের সঙ্গে খাপ খায় না আগের বারে রাম রাম করতে এরাই এগিয়ে এসেছিলেন, ‘আউর এক ধাক্কা দো / বাবরি মসজিদ তোড় দো স্লোগান তুলেছিলেন এরা কিছু বিষাক্ত মতকে যুক্তি বুদ্ধির ওপরে লালন করেন, সংখ্যালঘু সম্বন্ধে এঁদের কিছু মনগড়া থিওরি আছে যা সরকারি পরিসংখ্যান দফতরের রিপোর্টের সঙ্গে মেলে না এবং নাগপুরজাত কিছু মেজ সেজ সংগঠনও আছে তারা কেউ মনে করেন এই দেশের উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই শেষ কথা বলবেন, কেউ ভাবেন দেশের সব ইসলাম ধর্মের মানুষরাই ভিনদেশি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সমর্থক, কেউ ভাবেন সব সংখ্যালঘুকে সংখ্যাগুরুর ধর্মে ফিরিয়ে আনাই তাঁদের একমাত্র কাজ বা ভিনদেশী পাদ্রীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার মতো পুণ্য আর হয় না ইত্যাদি এইসব তারা আগেও করেছেন কিন্তু সেবারে ভাজপা দলের ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষিত ছিল আলাদা এবারে আবার অন্যরকম মোদিভাই তার কর্পোরেট সাথীদের কাছে কথা দিয়েছেন তাঁদের যাবতীয় সুযোগ সুবিধে করে দেওয়াই তার ব্রত তাতে সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচির ভাঁড়ারে টান পড়লেও কিছু যায় আসে না কিন্তু এটা খুব অনায়াস করতে গেলে একটা আপাত শান্তির পরিবেশ থাকা দরকার, একটা গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা হওয়া দরকার আর সব থেকে আগে দরকার ওই নাগপুরের নাগ বাহিনীকে সংযত রাখা
মুশকিল হল, এইখানেই একটা বড় ব্যর্থতা মোদির একে তো ক্ষমতায় আসার এক দেড় মাসের মধ্যে খোদ নয়াদিল্লি রাজ্যেই মোদি হাওয়া ফক্কা, তার ওপর বিহারেও সাঙ্ঘাতিক গর্জনের পরেও বর্ষণ প্রায় শূন্য পশ্চিমবঙ্গে ওরা অনেক সম্ভাবনা নিয়ে শুরু করেছিলেন, কী আশ্চর্য, চিড়ে এখানেও ভিজল না ওদিকে সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি, শিল্প বিকাশের যে প্রত্যাশা মোদির কাছে শিল্পমহল আশা করেছিল সে গুড়েও ক্রমশ বালি পড়ছে মাঝখান থেকে আজকে দাদরি কালকে বেঙ্গালুরু, পরশু জেএনইউ অন্যদিন অন্য কোথাও চরম ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার দাপট, হুজুগে দেশপ্রেমের রক্তচোখ বাড়ছে বর্ষার জমা জলে যেমন নানা ভাইরাস ব্যাক্টেরিয়ার জন্ম হয় ঠিক তেমন ভাজপার পৌরাণিক রাজনীতির আদর্শের বদ্ধ জলায় নানান গোষ্ঠী উপগোষ্ঠীর চাষবাস যাঁদের নাম কোথাও মোদী সেনা কোথাও হিন্দু সংহতি কোথাও বজরং সেনা আর ট্র্যাডিশনাল শিবসেনারা তো আছেনই এরা ভাজপাকে নিজেদের জ্ঞাতিভাই মনে করেন এবং দেশ জুড়ে বেআইনি কাজে একের পর এক স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন জেএনইউএর ঘটনা এই সব কিছুর একটা মিলিত প্রতিক্রিয়া যার ছাপ ঘটনাচক্রে ছড়িয়ে গেছে বিশ্বময় টিভির কল্যাণে, সোস্যাল মিডিয়ার অতি সক্রিয়তায় এই ঘটনার মূল পরিকল্পনা প্রায় উন্মোচিত যারা এইসবে যুক্ত তারা মনে করতে আরম্ভ করেছেন চাইলেই তারা যা খুশি করতে পারেন কলকাতায় বসে রাজ্য ভাজপার সর্বময় নেতা যাদবপুরের পড়ুয়া কর্মী অধ্যাপকদের কলার ধরে দেশপ্রেম শেখানোর ইজারা নিয়েছেন যাদবপুরের আচার্য নিজের পদের প্রতি অবমাননা করে তার আদি দলের পক্ষ নিয়ে পদকে কলঙ্কিত করেছেন তার জন্য কোনও ধিক্কার যথেষ্ট নয়
কিন্তু এত কিছুর পরেও কিছু কথা থাকে যে ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ক্ষমতায় থাকার কল্যাণে এইসব ক্রিমি কীটদের বাড়বাড়ন্ত তার মূল দায় কিন্তু দেশের কর্পোরেট সেক্টরের প্রতি তাঁদের ঘাড়ে চেপে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন অথচ সংস্কারের জোরালো রথ ছুটিয়ে তাঁদের জন্য এখনও বিশেষ কিছু করে উঠতে পারেননি বিভিন্ন সংস্কার বিল দুই সভায় পাশ করিয়ে শিল্প লবির প্রতি খুব জোরালো বার্তা পৌছে দেওয়া যায়নি জমি বিলে একের পর এক বেআইনি অর্ডিন্যান্স করেও তা পাশ হয়নি পড়ে আছে জিএসটি বিল এছাড়া মনমোহন সিংহের সরকারকে যে নীতি পঙ্গুতায় ভাজপা বিঁধত তার বিকল্পে ভাজপা সরকারের ভূমিকা তেমন কিছু বলার মতো নয় ভাজপা ক্ষমতায় থাকার সূত্রে নানা বিতর্ক ও কুকম্ম করে যারা নাম কুড়োতে চাইছেন আসলে তারা সোনার ডিম পাড়া হাঁসটার প্রতি সুবিচার করছেন না জেএনইউ থেকে যাদবপুর, দাদরি থেকে গুলাম আলি, পান্সার থেকে কানহাইয়া শেষ অবধি সরকারের বিড়ম্বনা হয়ে যাচ্ছে কর্পোরেট সেক্টর দেশপ্রেম, হিন্দুত্ব, নাগপুরের নাগ বাহিনীর অ্যাজেন্ডা কিছুই বোঝে না, তারা চায় মুনাফা, সরকারি প্রশ্রয়ে লুট করার লাইসেন্স, সরকারি নীতি যা তাঁদের বাণিজ্যকে গতিময় করবে, রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্কের ঋণ, যা খুশি হলে তারা শোধ করতেও পারেন নাও পারেন, রাশি রাশি সম্ভাবনাময় বিনিয়োগ ----- এখনও মোদি সরকার খুব বেশি কিছু তাঁদের দিতে পারেননি তাঁরাও খুব বেশি সময় দেবেন না প্রায় দুছর অতিক্রান্ত তেমন হলে আবার তারা কংগ্রেসের মধ্যেই বন্ধু খুজবেন যারা নির্ভরযোগ্য অন্তত এইসব ফালতু উৎপাতে সরকারের সময় ব্যয় হবে না এই জায়গায় মোদির ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা জেএনইউ নিয়ে যারা বড় বড় দেশপ্রেমের বুলি ফেসবুকের দেওয়ালে সাটাচ্ছেন তাঁরা নিজেরা গর্বিত হলেও এই দিকটা খেয়াল করছেন এমন মনে হয় না গরু যাঁদের মাতা এবং হনু যাঁদের পিতা তাঁদের থেকে এর বেশি অবশ্য আর কিছু আশা করা যায় না এবং এটাও খেয়াল রাখা দরকার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মতোই মোদিজি নিজের ক্যাবিনেটে কাউকেই দ্বিতীয় বিকল্প তৈরি করছেন না, কারণটা পরিষ্কার ইতিহাসে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে ফলে উনি থাকলে থাকবেন নইলে ভাজপা আবার ডুবো নৌকো হয়ে যাবে কান্ডারীহীন, দিশাহীন তখন এইসব হঠাৎ গজানো দেশপ্রেমিকরা পতন রুখতে পারবেন না, ইতিহাসের আস্তাকুঁড় রিসাইক্লিং বিনএর মতো সাফ না করলে এঁদের সেখানেও জায়গা পাওয়া সমস্যা হবে এটা ভাজপার ক্ষেত্রে শঙ্কা, আমাদের ক্ষেত্রে স্বস্তি

Friday, 19 February 2016

দেশপ্রেম কাহারে কয়!

যাহা বোঝাইবেন তাহাই বুঝিব?
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
দেশপ্রেমের নামে ধেড়ে কিছু উকিল, এক এমএলএ ও আরএসএস’এর কতিপয় লোকজন  পুলিশকে সামনে পেছনে সারিবদ্ধ রেখে দিল্লির আদালত চত্বরে ছাত্র, সাংবাদিক ও শিক্ষকদের দু-তিনদিন ধরে বেধড়ক পেটাল। একজন বলল, তার হাতে বন্দুক থাকলে সে গুলি করে মারত এইসব দেশদ্রোহীদের।

ঠিক তার দুদিন আগেই আদানি ও আম্বানিদের কয়েক লক্ষ কোটি টাকার ঋণ মকুব করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত কিছু ব্যাংক। আর ওই নিরীহ মানুষদের রামক্যালানির পরই বিজেপি’র এক এমপি গোপাল শেঠি জোর গলায় জানান দিয়েছে, কৃষকরা যে আত্মহত্যা করছে সেটা নিছকই একটা ফ্যাশন। এর অর্থ- কানহাইয়া ব্যাটা মাঝে এসে গোলমাল পাকিয়েছে, তার আগে ও পরে উভয়তই দেশপ্রেমে মাখামাখি- আদানি-আম্বানি ইয়া বড় দেশপ্রেমিক তাই দেশ বিরোধী ব্যাংকের ইয়ে ফাটিয়ে দিয়েছে আর গোপাল বড় সুবোধ, ঠিক ধরে ফেলেছে দেশবিরোধী চাষিদের শয়তানি।

মনে পড়ছে, ৬০ ও সত্তর দশকে আমেরিকার রাজপথে ভিয়েতনামে বোমা বর্ষণ ও আমেরিকার যুদ্ধ ঘোষণার বিরুদ্ধে সে দেশের হাজারও মানুষের প্রতিবাদ মিছিলের কথা। এই প্রতিবাদীরা কি দেশবিরোধী ছিলেন? নাকি দেশের শাসকেরা দেশবিরোধী কাজে মেতেছিলেন?

Thursday, 18 February 2016

বিষয় মৃত্যুদণ্ড



শাশ্বতী ঘোষ এবং তাহাদের উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি
দেবব্রত চক্রবর্তী  

ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকায়কার মানবাধিকার? নৃশংস ধর্ষকের ?' এই শিরোনামে শাশ্বতী ঘোষ একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন লেখাটি কেবলমাত্র শাশ্বতী ঘোষের হলে কথা ছিল কিন্তু লেখাটি রক্তের বদলে রক্ত, চোখের বদলে চোখ ও বদলার পবিত্র কর্তব্যের সমর্থকদে আধুনিক উচ্চারণ গণতান্ত্রিক দেশে সীমিত দুই একটি ক্ষেত্র বাদ দিয়ে যে যা খুশি উচ্চারণ করতেই পারেন কিন্তু তা যদি হয় ধর্ষণের ঘটনার বাহানায় মৃত্যুদণ্ড নামক বর্বরতার সমর্থনে মত প্রচার অথবা কিছু কিছু ক্ষেত্রে ( এক্ষেত্রে ধর্ষণ এবং হত্যা ) মানবতাবাদ সুরক্ষার সপক্ষে সমর্থন আদপে অন্যায় এই বলে সদর্পে ঘোষণা, তাহলে শাশ্বতী ঘোষকে মনে করিয়ে দেওয়া উচি, সিলেক্টিভ মরালিটি এবং বিশুদ্ধ দ্বিচারিতা সমার্থক যে কোন গুরুতর অপরাধ, লুণ্ঠন, হত্যা এবং ধর্ষণ যদি নিন্দনীয় হয় তাহলে সেই মরাল জাজমেন্ট সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হওয়া উচি কামদুনির ঘটনার চরম দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করব আর আসাম রাইফেল দ্বারা মনোরমার ধর্ষণ এবং হত্যার বিষয়ে পাথরের নীরবতা অবলম্বন করব এক বিশুদ্ধ দ্বিচারিতা বই অন্য কিছু নয় যে কোনও নৈতিকতার প্রাথমিক এবং মূল শর্ত তার সার্বজনীনতা - কারও জীবন নেওয়া যদি গুরুতর অপরাধ হয়, তাহলে সর্বক্ষেত্রেই তা হওয়া উচি পেটি সমাজবিরোধীর চাকুর আঘাতে হত্যা অথবা পুলিশের গুলিতে ম্রিত্যু, ডাক্তারের হাতে সূচের ঘায়ে হত্যা অথবা রাষ্ট্রের ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে হত্যাও একই অপরাধে অপরাধী হত্যা হত্যাই এক হত্যার শাস্তি হিসাবে ফাঁসিকাঠে অথবা প্রকাশ্যে পাথর ছুঁড়ে হত্যা - সেই মরাল জাজমেন্টের প্রাথমিক এবং মূল শর্ত সর্বজনীনতাকে অস্বীকার করে

গুরুতর অপরাধের শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদণ্ডের ইতিহাস আজকের নয় বরং আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের বহু পূর্বের অনুশীলন হত্যাকারী এবং তার গোষ্ঠীকে যতক্ষণ না সমপরিমাণ পাল্টা হত্যার মাধ্যমে প্রতিশোধ নেওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ যেন শান্তি নেই হত্যার বদলে হত্যা, রক্তের বদলে রক্ত এবং আঘাতের পরিবর্তে সমপরিমাণ আঘাত এক স্বর্গীয় বিধান পূর্বপুরুষের প্রতি ধর্মীয় কর্তব্য এই অবশ্যপালনীয় কর্তব্য প্রকাশ্যে, দিবালোকে এবং সর্বজন সমক্ষে হওয়াই বাঞ্ছনীয় এই বর্বরতার পক্ষে স্বয়ং ভগবান বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন যুগে অবতীর্ণ হয়েছেন হত্যার বদলে হত্যা, রক্তের বদলে রক্ত এবং আঘাতের পরিবর্তে সমপরিমাণ আঘাত নামক জাস্টিসএর সমর্থনে বিভিন্ন এপিক লেখা হয়েছে দেশে দেশে ঊরুভঙ্গ না হওয়া পর্যন্ত পাঞ্চালী চুল না বাঁধার পণ রেখেছেন এই জাস্টিস এবং তার সাইকি বিনা প্রশ্নে চারিয়ে গেছে আমাদের রক্তে, ধর্ম, সংস্কৃতি, শিক্ষা সমাজনীতির মাধ্যমে তাই শাশ্বতী ঘোষ প্রতিশোধ স্পৃহা এবং মৃত্যুদণ্ডের সমর্থনে অন্যায় কিছু দেখছেন না বরং মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা তাঁর কাছে বিমূর্ত মানবাধিকারের সমার্থক

সমাজের বিবর্তনের সাথে সাথে মৃত্যুদণ্ডের গুরুত্ব ক্রমশ কমেছে, এমনকি তথাকথিত বর্বর সমাজও উপলব্ধি করেছে মৃত্যুদণ্ড কোনও সমাধান নয় যে হত্যা বা ধর্ষণ তাৎক্ষনিক উত্তেজনায় অথবা পরিকল্পনার ফল হিসাবে ঘটে গেছে তা পাল্টা হত্যা বা ধর্ষণের মাধ্যমে পরিপূরণ করা অবাস্তব মৃত্যুদণ্ড অপরাধীর প্রকৃত কোন সাজা বা আদৌ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নয় অনুশোচনার, পরিবর্তনের ক্ষেত্র এক লহমায় ছিনিয়ে নেওয়া, প্রতিশোধ পরিপূরণ মাত্র বর্বর সমাজ তাদের অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত জ্ঞানে ক্রমে মৃত্যুদণ্ডের অসারতা থেকে সরে এসেছে ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির রাস্তায় কোন গোবর খেয়ে বা পুরোহিত দক্ষিণায় প্রায়শ্চিত্ত করে পাপস্খালনের তঞ্চকতা নয় বরং ক্ষতিপূরণে পরিমাণ এত বেশি যা অপরাধীকে সারা জীবন ধরে শোধ করতে হবে এবং প্রত্যহ তার অপরাধের গভীরতা তাকে স্মরণ করাবে, অনুশোচিত করবে, রত্নাকর থেকে বাল্মীকিতে পরিবর্তনের সুযোগ দেবে এবং ক্ষতিপূরণের বীভৎস পরিমাণ বাকিদের অপরাধের প্রতি নিরুৎসাহিত করবে হল প্রকৃত অর্থে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হত্যার তো অপরাধের ক্ষেত্রে এই ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হত্যাকারীর সমস্ত সম্পদের কয়েক গুণ - কিছু কিছু আফ্রিকান ট্রাইবদের ক্ষেত্রে ৮০০টি গরু অথবা ১০০টি , রি আদিবাসীদের ক্ষেত্রে ৪১৬টি ভেড়া ইত্যাদি অপরাধী জানে সারা জীবনেও এই পরিমাণ ক্ষতিপূরণ তার পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব নয় - সুতরাং যে পরিবারের বিরুদ্ধে সে অপরাধ সংগঠিত রেছে সেই পরিবারের দাস শ্রমিক হিসাবে তাকে সারা জীবন খেটে যেতে হবে এমনকি এখনও ককেশাসে অপরাধ ঘটে যাওয়ার পর অপরাধী যে পরিবারের বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটিয়েছে সেই পরিবারের সব থেকে বয়স্কা মহিলার স্তন ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করে পুরো পরিবারেরমিল্ক ব্রাদারেপরিবর্তিত হয় পরবর্তীতে পরিবার তাদের সমস্ত ক্রিয়াকর্মে এবং সামাজিকতায় অপরাধীকে অংশগ্রহণের অনুমতি দেয় বিভিন্ন আফ্রিকান উপজাতিতে অপরাধী তার বোন অথবা কন্যাকে যে পরিবারের বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটিয়েছে সেই পরিবারে বিয়ে দিতে বাধ্য থাকে অথবা হত্যার কারণে পরি বিধবাকে বিবাহে বাধ্য হয় এখন আমরা তো আর বর্বর আফ্রিকান অথবা ককেশীয় আদিবাসী নয় যে অপরাধীকে সমাজে প্রতিস্থাপিত করব, অনুশোচনার সুযোগ দেব, রত্নাকর থেকে বাল্মীকিতে পরিবর্তনের জমি প্রস্তুত করার উদারতা দেখা অথবা মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে বিপুল ক্ষতিপূরণের দৃষ্টান্তমূলক রাস্তা নেব তাই শাশ্বতী ঘোষ এবং তাহারা - শিক্ষিত, সভ্য উন্নত মানব প্রজাতি আমাদের কাছে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হিসাবে উপস্থিত করেন মৃত্যুদণ্ডের যৌক্তিকতা অতি আধুনিক কেউ কেউ আবার লিঙ্গচ্ছেদের সপক্ষে উচ্চকণ্ঠ

রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, তার আধিপত্য, ক্ষমতা এবং হায়ারার্কিকাল সিস্টেমের বিস্তারের সাথে সাথে মৃত্যুদণ্ডের বিস্তার প্রাধান্য পেতে শুরু করে আইনের এবং সাজা দেওয়ার অধিকারের একচ্ছত্র অধিকার রাষ্ট্রের হাতে ন্যস্ত হতে থাকে ফিরে আসে নিষ্ঠুরতা উৎকর্ষতা গরম জলে চুবিয়ে মৃত্যুদণ্ড ক্রুশবিদ্ধ যিশু ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট করে হত্যা পাথর ছুঁড়ে অল্প অল্প করে অঙ্গচ্ছেদ করে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হাজারও উইচ হল মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ক উৎকর্ষ থিসিসের সামান্য নমুনা অভিজাত প্রতিনিধিদের রক্ত মাটিতে স্পর্শ করার পাপ থেকে বাঁচতে চেঙ্গিস খানের পুত্র 'খিলাফত'কে পার্সিয়ান গালিচায় মুড়ে তার ওপরে সমস্ত আস্তাবলের ঘোড়া ছেড়ে দিয়েছিলেন আজকে যারা যৌনাঙ্গ কর্তনের সপক্ষে, তাদের তুলনায় আমাদের পূর্বপুরুষরা মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে অনেক বেশি উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী ছিলেন বলতেই হচ্ছে আমাদের এই গণতান্ত্রিক যুগে আর যাই হোক আমরা অনেক মানবিক আমরা এখন লিথাল ইঞ্জেক্সান দিয়ে থাকি আমরা আবিষ্কার করেছি ইলেকট্রিক চেয়ার, গ্যাস চেম্বার, ফায়ারিং স্কোয়াড এবং লোকচক্ষুর আড়ালে ফাঁসি যদিও এখনও মধ্যযুগীয় কিছু কিছু দেশ মস্তক কর্তন বা পাথর ছুঁড়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে থাকে কিন্তু আমরা তো তাদের বর্বর বলে নিন্দামন্দও করে থাকি, ফেসবুকে পোস্ট করি - আহা মানবিকতা বলে একটা কথা আছে তো ?

শাশ্বতী ঘোষেরা ভুলে যান যে অপরাধ কোন সমাজবিচ্ছিন্ন ঘটনাবলী নয় অপরাধ প্রবতা কোন বিশেষ গোষ্ঠী বা মানব সমাজের জন্মগত গু নয় কেউই অপরাধী হয়ে জন্মগ্রহণ করেন না বিভিন্ন সামাজিক পরিস্থিতি, সংস্কৃতি এবং ব্যক্তিগত ফ্যাক্টর, অর্থনৈতিক কার অপরাধের পেছনে কাজ করে রাষ্ট্র এই সমাজবিরোধী পরিবেশ, হতদরিদ্র শ্রমিক, মদের ভাঁটি, ভেড়ীর বাঁটোয়ারা, বেশ্যাপল্লী, বেআইনি আফিম চাষ এবং অপরাধের ধাত্রীভূমির সমস্ত কিছুর থেকে লাভ উপার্জন করে, অথচ এই ভয়ঙ্কর সামাজিক পরিস্থিতির কারণে যদি কোন অপরাধ সংগঠিত হয় তাহলে দিব্যি দায় ঝেড়ে ফেলে সমস্ত অপরাধের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয় ব্যক্তি অপরাধীর ঘাড়ে শাশ্বতী ঘোষও তাই করেছেন এখন যে কোন অপরাধের পেছনে যদি কেবলমাত্র শতাংশ সামাজিক কার দায়ী থাকে তাহলে অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড শোনানো যায় না সে বিচার পক্ষপাতদুষ্ট এবং সামাজিক পরিবেশের কারণে অপরাধী সৃষ্টির যে আংশিক দায় সে দায়কে অস্বীকার করা 

যেমন ধর্ষণের ক্ষেত্রটি হল ক্ষমতা প্রদর্শন, পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্যবাদী ব্যবস্থা এবং যৌনতা বিষয়ক সামাজিক বিধিনিষেধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অথচ দেখুন ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম সুমাত্রায়, পশ্চিম আফ্রিকার কিছু কিছু সমাজে ধর্ষণ পূর্ণ মাত্রায় অনুপস্থিত পাহাড়ি জনজাতি এবং আদিবাসী সমাজের মধ্যে ধর্ষণ নগণ্য এবং যে সমস্ত সমাজে এখনও পিতৃতান্ত্রিকতার প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম এবং যৌনতা বিষয়ে নৈতিকতার বাধানিষেধ কম সেই সমাজে ধর্ষণও কম ধর্ষণের সামাজিক ভিত্তি তৈরি হয় যৌনতাবিষয়ক নৈতিকতার নাগপাশে মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কুমারীত্ব হরণের অধিকারকে স্বর্গীয় মাধুর্য দেওয়ার নামে, হাজারও নিমন্ত্রিত অভ্যাগতের সমারোহে আমরা যখন তার বিয়ে দিই, সে যখন অচেনা পুরুষের জৈবিক তাড়নার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়, প্রকৃত অর্থে আমরা তখন থেকেই বলাৎকারের জমি প্রস্তুত করতে থাকি কোন জৈবিক আচরণ স্বাভাবিক আর কোনটা অসভ্যতা তার পাঠ জীববিজ্ঞানে নেই; আছে সমাজবিজ্ঞানে, মরালিটিতে আর এই নৈতিকতার শিক্ষার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সাধুতার নামে কপটতা পিতৃতান্ত্রিকতার দার্শনিকতা যে পাশবিক লিঙ্গপরায়তাকে দোষারোপ, লিঙ্গচ্ছেদের মাধ্যমে শাস্তি প্রদানের সদিচ্ছা সেই লিঙ্গমূর্তিকেই ব্রম্ভান্ডের কেন্দ্রস্থল হিসাবে স্বীকৃতি দান, পূজা পাঠ ইত্যাদি সেই কপটতার অন্যতম পুরাণ পুরুষের একটি বিশেষ স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া, স্ফিতলিঙ্গের উপরেই যাবতীয় মাহাত্ম্যপ্রদান অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে লিঙ্গের অগ্রত্বক ছেদনের অনুষ্ঠান একই মুদ্রার অন্য দিক ধর্মের মাধ্যমে এই যে নৈতিকতার শিক্ষাদান তার মাধ্যমে সমাজ উৎপাদন এবং তৃপ্তির অগ্রাধিকার পুরুষকেই দিয়ে রেখেছে তাকেই যথাসময়ে উত্তেজিত হতে হবে, উদীপ্ত হতে হবে এবং শেষ পর্যন্ত মাত্র মিনিট ৪৪ সেকেন্ডের মধ্যে শুক্র রোপণ করার দায়িত্ব নিতে হবে বদলে সে পাবে ক্ষণিক মৃত্যুর সুখ আর উৎপাদনের প্রতিশ্রুতি নারী যদি সেই সুখ উপভোগ নাও করে, তাতে কী এসে যায়? যে যৌন সঙ্গম নারী উপভোগ করে না, যেখানে তার সম্মতি নেই, প্রেমও নেই তা নিশ্চয়ই বর্বরতা এবং সময় বিশেষে নৃশংসতাও সম্মতিহীন বর্বর এই ধর্ষণ অধিকাংশ পরিবারের প্রাত্যহিকতা - শাশ্বতী ঘোষ এবং তাহারা মৃত্যুদণ্ড চাইবেন তো ? অন্তত কমপক্ষে লিঙ্গছেদ?

মৃত্যুদণ্ড কেন ? যুক্তি হিসাবে বলা হয়ে থাকে জঘন্য অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, যাতে অন্যরা এই ধরনের অপরাধ করার পূর্বে তিনবার ভাবে ১৮৫৩ সালে নিউ ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউনে মার্কস এই বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন। স্বভাবসিদ্ধ ভাবে তথ্য সহকারে দেখান যে মৃত্যুদণ্ড দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তো দূরের কথা উল্টে মৃত্যুদণ্ডের কারণে অপরাধ বৃদ্ধি পায় জঘন্য অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদণ্ড যে অকার্যকরী বিষয়ে মার্কস যে প্রথম লক্ষ করেছেন তা নয় কিন্তু মৃত্যুদণ্ডের অকার্যকারিতা বিষয়ক মতামত সৃষ্টিকারীদের মধ্যে মার্কস অন্যতম ( লেনিনের বিষয়ে দ্বিচারিতা এখানে আলোচ্য নয় ) আমেরিকায় মৃত্যুদণ্ড বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ডা: বেঞ্জামিন রাশ তথ্য সহকারে প্রমাণ করেন অষ্টাদশ শতকের মৃত্যুদণ্ড উল্টে সেই সময়ে অপরাধের বৃদ্ধি ঘটিয়েছে সম্প্রতি আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বলেছেন, ‘despite 30 years of empirical research in the area, there remains no statistical evidence that capital punishment in fact deters potential offenders.’

Amnesty International বলছে, 'during the last 20 years, the homicide rate in [US] states with the death penalty has been 48 to 101 percent higher than in states without the death penalty.’ পৃথিবীর ১০২টি দেশে মৃত্যুদণ্ড অবর্তমান কিন্তু সেই সমস্ত দেশে ধর্ষণ অথবা হত্যার বন্যা বয়ে যাচ্ছে এইরকম তথ্য তো পাওয়া যাচ্ছে না এখন সবাই তথ্যে বিশ্বাস রাখবেন আশা না করাই ভালো তাই বর্বরতাকে অবগুণ্ঠিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে বিচারের প্রহসন চলে পক্ষে এবং বিপক্ষে যুক্তি সাজানো হতে থাকে মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবীগণ সুকৌশলে বর্বরতার সমর্থক বনে যান কেউ কেউ পাঞ্চালীর মতো ঊরুভঙ্গ না হওয়া পর্যন্ত কেশ উন্মুক্ত রাখার প্রতিজ্ঞা রাখেন সেই চোখের বদলে চোখ, রক্তের বদলে রক্তের স্বর্গীয় উল্লাস অবশেষে ঠাণ্ডা মাথায় কোথাও ধনঞ্জয়, কোথাও আফজল গুরুদের ফাঁসি সাজা শোনানো হয় যদিও মৃত্যুদণ্ডের সপক্ষে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রাথমিক যুক্তি তথ্যগত ভাবে মিথ্যা - কিন্তু শাশ্বতী দেবী এবং তাহারা বর্বরতার সমর্থনে এই দ্বিচারিতা বজায় রাখেনকামু আমাদের এই সর্বত্রগামী দ্বিচারিতা বিষয়ে জানিয়েছেন,  There could be read on the sword of the Fribourg executioner the words: 'Lord Jesus, thou art the judge’… And, to be sure, whoever clings to the teaching of Jesus will look upon that handsome sword as one more outrage to the person of Christ.’

শাশ্বতী দেবী এবং তাহারা সেই ঈশ্বরতুল্য ক্ষমতাশালী কবি এজরা পাউন্ডকে মনে আছে নিশ্চয়? অনেক অনেকহোক কলরবে' উনি পথ হেঁটেছিলেন উনিই আমাদের পরিচিত করিয়েছিলেন এলিয়েট, জেমস জয়েস এবং হেমিংওয়ের সাথে একই সঙ্গে সেই বিখ্যাত কবি বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণহত্যার সমর্থনে দিনের পর দিন রেডিও ভাষণ প্রস্তুত করেছেন অর্থের বিনিময়ে ইহুদী হত্যার সমর্থনে যুক্তি সাজিয়েছেন দীর্ঘ দশ বছর ধরে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অপরাধী এজরা পাউন্ডের মৃত্যুর দাবিতে ওদেশের শাশ্বতী দেবীরা এবং তাহারা যখন গগন বিদীর্ণ করছেন তখন এই বিমূর্ত মানবাধিকারের সমর্থকরাই যাদের নাকি জীবনযাপনে কোন বিপন্নতা নেই, তাঁকে মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন পথে নেমেছিলেন আমরা এজরা পাউন্ডের সেই নির্মম অপরাধ তার কবিতার স্বার্থে ক্ষমা করে দিয়েছি প্রতিশোধের ভাষা, হত্যার সমর্থকের ভাষ্য যে কেবলমাত্র কতিপয় বর্বর ক্ষমতালোভীর, আমরা সেই সুমেরু সভ্যতার সময় থেকে জানি

পুনঃ শাশ্বতী দেবী এবং তাহাদের উদ্দ্যেশ্যে কামুর ‘Reflections on the Guillotine' প্রবন্ধটি পড়ে দেখবার অনুরোধ রইলকামু বিমূর্ত মানবাধিকারী ছিলেন কিনা !!