Saturday, 26 January 2019

প্রজাতন্ত্র

জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও নিয়মতান্ত্রিকতা
           অরুণাভ বিশ্বাস

আর‌ও একটা সাধাণতন্ত্র দিবস। সাধারণ মানুষের আর‌ও একটা ছুটির দিন। শপিং মলে যাওয়ার দিন, অনলাইনে বিশাল ছাড়ে কেনাকাটা করার দিন, চিড়িয়াখানা ইকোপার্ক জাদুঘর যাওয়ার দিন, টিভি খুলে কুচকাওয়াজ দেখবার দিন, লাউডস্পিকারে দেশাত্মবোধক গান শোনার দিন আর স্কুলে স্কুলে সাতসকালে হাজিরা দিয়ে ছাত্রছাত্রী শিক্ষকশিক্ষিকা সকলে মিলে প্রভাতফেরী সেরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করবার দিন। তবে সাধারণতন্ত্র দিবস যে আসলে ভোগবাদে গা ভাসানোর দিনে পর্যবসিত হয়েছে সে কথা এখন শুরুতেই তুলে বিতর্ক সৃষ্টি করব না। গত এক সপ্তাহ যাবৎ খবরের কাগজের পাতাজোড়া রঙচঙে বিজ্ঞাপনের আধিক্য আমার কথাকে প্রমাণ করার জন‍্য যথেষ্ট। এই মাত্র আমার ফোনে একটি বহুজাতিক জুতো কোম্পানির মেসেজ এল যে সত্তরতম সাধারণতন্ত্র দিবসে কিছু কিছু মডেলের জুতোয় নাকি ৭০% ছাড়। আমি শুধু ভাবছি শতবর্ষ পূর্তিতে জুতো ১০০% শতাংশ ছাড়ে আদৌ বিক্রি হবে কিনা!

তবে পণ‍্যসংস্কৃতি নিয়ে লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। আসলে ধান ভানতে শিবের গীত গাইবার‌ই রীতি। বলতে বরং চাইছি যে বাঙালি তথা ভারতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবস বা সাধারণতন্ত্র দিবসের তাৎপর্য আজকাল ভোগবাদের নিরিখে পরিপূর্ণতা লাভ করলেও এর একমাত্র ব‍্যতিক্রম স্কুল। স্কুলে স্কুলে এখন‌ও দিন দুটি পালিত হয় সাধ‍্যমতো। এখন মুশকিল হচ্ছে 'সাধ' আর 'সাধ‍্য' -- দুটো ব‍্যক্তি নিরপেক্ষ তো নয়‌ই, বরং আপেক্ষিক ও বোঝাপড়াভিত্তিক। আর সাধারণতন্ত্র দিবস বা স্বাধীনতা দিবস নিয়ে স্কুলে স্কুলে গন্ডগোলটা পাকিয়ে ওঠে এই বোঝাপড়ার অভাবেই যখন সাধের জাতীয় দিবস দুটি জায়গা ছেড়ে দেয় বাধ‍্যতামূলক উদ্‌যাপনের নিয়মতান্ত্রিকতাকে।

মূল বক্তব‍্যে যাওয়ার আগে তাই আর একটা কথা অল্প করে বলে নিই যে সবার উপরে মানুষ। মানুষের জন‍্য‌ই নিয়ম, নিয়মের জন‍্য মানুষ নয়। কিন্তু জাতীয়তাবোধের উগ্ৰতায় আমরা অনেক সময় এ কথা ভুলে যাই। তাই 'বন্দে মাতরম' না বলায় একেবারে নিরীহ মুসলিম চাচাকে প্রকাশ‍্যে চড় খেতে হয়। আবার সোশাল মিডিয়ার ভাইরাল ছবিতে অসমের প্রাইমারি স্কুলের ছোট্ট বাচ্চা বুকজলে দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকে স‍্যালুট করলেও বাদ পড়ে যায় NRC থেকে। এই বাচ্চাটির কাছে জাতীয়তাবাদের স্বরূপ কিরূপে উদ্‌ঘাটিত হয়ে চলেছে ভেবে দেখেছি কি আমরা? ভেবে দেখেছি কি গত বছর স্বাধীনতা দিবসের দিন সক্কালবেলায় পথ দুর্ঘটনায় নিহত অলংকৃতা মল্লিকের পরিজনের কাছে জাতীয় পতাকার তাৎপর্য কেমন?

যে কোনও ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা আমার বদ অভ‍্যাস। কী হলে কী হত, কী হয়নি বলে কী হয়েছে ইত‍্যাদি ভাবনা মাঝে মাঝেই ব‍্যতিব‍্যস্ত করে। দঃ ২৪ পরগণার কুলপি ব্লকের লক্ষ্মীনারায়ণপুর বি এইচ এম হাই স্কুলের কৃতী শিক্ষিকা অলংকৃতা মল্লিকের আকস্মিক মৃত্যুতে একটা প্রশ্ন না তুলে পারছি না। ট্রেন দুর্ঘটনার আগের রাতে কী দরকার ছিল কাকদ্বীপে তাঁর বান্ধবীর বাড়িতে থাকার? তিনি থেকে গিয়েছিলেন তার কারণ পরদিন সকালবেলাতেই তাঁর স্কুলে স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন তথা পতাকা উত্তোলন ছিল। আমাদের সবার স্কুলেই এই ব‍্যাপারটা নতুন কিছু নয়। যে যেখানেই থাকি না কেন প্রজাতন্ত্র দিবস বা স্বাধীনতা দিবসে ট্রেনবাস ধরে সকালবেলায় আটটার আগে ঠিক পৌঁছে যাই নিজের নিজের স্কুলে। যাঁরা নিজেদের স্কুল থেকে খুব দূরে থাকি তাঁরা ভোরবেলায় বার হ‌ই; আর যাঁদের তাতেও উপায় নেই তাঁরা বাধ‍্য হ‌ই অলংকৃতা ম‍্যাডামের মতো বাড়ি ছেড়ে স্কুলের কাছাকাছি কোথাও একটা থেকে যেতে। এখন আমার প্রশ্ন, এই ঝক্কি পোহানোর কোনও প্রয়োজন আছে কি?

এই পর্যন্ত পড়ে পাঠক ভাববেন না আমি স্বাধীনতা দিবসে ছুটি চাইছি। আমার বক্তব‍্য, Flag Code of India, 2002 তন্নতন্ন করে পড়লেও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের কোনও নির্দিষ্ট সময় যেখানে পাওয়া যায় না সেখানে কোন আইনের বলে শুধু শিক্ষক-শিক্ষিকাদের‌ই সকাল আটটায় পতাকা উত্তোলন করতে হয় ? কোনও কোনও স্কুলে ঐদিনে সময়ে পৌঁছনোর ব‍্যাপারটা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে স্থানীয় এবং দূরাগত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ‍্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। প্রধান শিক্ষক আর সহশিক্ষকদের মধ‍্যে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়। কিন্তু যদি Flag Code of India, 2002 ঠিকঠাক জানা থাকে তাহলে নিজেদের মধ‍্যে এই নিয়ে মনোমালিন্য, ভোরবেলায় ট্রেনবাস করার ঝক্কি, অন‍্যের বাড়িতে থাকার বিড়ম্বনা বা ট্রেন দুর্ঘটনায় এরকম অকালমৃত্যু এড়ানো যেতে পারে। (Flag Code of India, 2002, পিডিএফ ফাইলে ইন্টারনেটে সহজলভ‍্য।) এ ক্ষেত্রে যেটা করতে হবে তা হল সপ্তাহের কাজের দিনে স্কুলের প্রার্থনার যে সময় নির্দিষ্ট করা আছে তাকেই পতাকা উত্তোলনের সময় হিসেবে ধার্য করা।

এবার একটু পিছনে তাকানো যাক। ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি। দিল্লি জুড়ে প্রচন্ড কুয়াশা। রাজপথে সমারোহ তথা কুচকাওয়াজ শুরুই হতে চায় না। শেষমেশ সকাল ১০টায় তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় পতাকা উত্তোলন করলেন। হ‍্যাঁ, টাইপে ভুল হচ্ছে না। সকাল ১০টা'তেই। সেবারেই খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম আইনত ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই। সকাল ৮টা'র ব‍্যাপারটা অলিখিত প্রথামাত্র। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের মধ‍্যে পতাকা তুলতে হবে এবং অবশ‍্য‌ই সূর্যাস্তের পরে নামিয়ে নিতে হবে। এরপরেও তথ‍্য কিছু বাকি রয়ে যায়।

বিশিষ্ট শিল্পপতি ও সাংসদ নবীন জিন্দাল ৭ বছর মামলা লড়ে ২০০২ সালে তাঁর কারখানায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার অধিকার অর্জন করেন। এই প্রেক্ষিতে পি ডি শেনয়ের নেতৃত্বে একাধিক মন্ত্রককে জড়িয়ে যে কমিটি গঠিত হয় তার সুপারিশে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় পতাকা সংক্রান্ত ১৯৫০ সাল থেকে চালু থাকা অধিকাংশ বিধিনিষেধ তুলে দিয়ে নতুন যে বিধি প্রণয়ন করেন সেটিই Flag Code of India, 2002। এর পরে ২০০৯ সালে নবীন জিন্দালের আর একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার ভারতীয় নাগরিকদের রাতের বেলাতেও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অধিকার মেনে নেয়। তবে তা হতে হবে কমপক্ষে ১০০ ফুট উঁচুতে এবং সর্বক্ষণের জন‍্য আলোকিত। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এই নবীন জিন্দাল‌ই প্রায় এক দশক মামলা লড়ে ১৯৯৬ সালে ভারতীয় নাগরিকদের হয়ে পতাকা উত্তোলনের মৌলিক অধিকার আদায় করেন। কাজেই সকাল ৮টায় পতাকা তোলার বাধ‍্যবাধকতা আদৌ রয়েছে কিনা সুধী পাঠক বিচার করবেন।

সব শেষে আর একটি অপ্রিয় প্রসঙ্গ বলতেই হবে। উক্ত Flag Code of India, 2002'এর Part II Section ii'তে কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা কেমনভাবে উত্তোলিত হবে তা কিন্তু সুস্পষ্টভাবে বলা আছে এবং সেখানেও কোনও সময় নির্দিষ্ট করা নেই। অথচ যা বলা নেই তা মানতে স্কুলে স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মানতে বাধ‍্য করা হয়। আর যা বলা আছে তা বিন্দুমাত্র মানা হয় না অধিকাংশ স্কুলে। ছাত্রছাত্রীরা কেমন দাঁড়াবে, প্রধান শিক্ষক ও সহশিক্ষকেরা কোথায় দাঁড়াবেন, কখন কে কাকে স‍্যালুট করবে, কী শপথ নেওয়া হবে ইত‍্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যা যা বলা আছে তার প্রায় কিছুই ঠিকঠাক পালন হয় না। শুধু নিয়ম কেবল সকাল ৮টার আগে স্কুলে হাজিরা নিয়ে। অথচ সেটা বলা নেই !

একজন অত‍্যন্ত জনপ্রিয় শিক্ষিকার প্রাণ অকালে ঝরে গিয়েছে কয়েক মাস আগে। সোশাল মিডিয়ায় দায়সারা শোকবার্তা লিখে দায় না সেরে যদি শিক্ষক সংগঠনগুলির সাধারণ সম্পাদকেরা স্কুলে স্কুলে চালু থাকা এই একুশে আইনের বিরুদ্ধাচরণ করতেন তাহলে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পাশে দাঁড়ানোয় শিক্ষক সংগঠনের যে মূল দায়িত্ব তা পালন হত। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। একজনের প্রাণ চুরি গিয়েছে। সংগঠনগুলির বুদ্ধি বাড়বে কী ?

Tuesday, 22 January 2019

ফিরে দেখা

#একক মাত্রা ২০
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 ১)
ফিরতে হবে গত শতকের আশির দশকের প্রায় শেষ পাদে। যখন বাংলার পরিমণ্ডলে একাডেমিক ঘরানা এক পরিপুষ্ট বাম পরিচিতি অর্জন করেছে। সত্তর দশকের নকশাল যুবকেরা ও অন্য বাম ঘরানার বহু জনেই তখন একাডেমিক ঘরগুলির অধিকার নিয়েছে। ভারত-মুক্তির সশস্ত্র লড়াই ঠাঁই পেয়েছে একাডেমির সেমিনার, রচনা ও এমনকি ক্লাশঘরেও। রাজ্যে অধিষ্ঠিত বামফ্রন্ট, যাদের প্রতিনিধিরাও তখন সীমিত ক্ষমতায় রাজ্য চালানোর পরীক্ষা-নিরীক্ষার আলাপে সরগরম করে রাখছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-বিদ্যায়তনের করিডোর ও ক্লাশরুম। সেই আবহেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে আয়োজিত হল একটি কূট ও উত্তপ্ত বিতর্কঃ বামফ্রন্ট কতটা বাম! সরকার পক্ষে একদিকে বললেন অসীম দাশগুপ্ত, বিপ্লব দাশগুপ্ত ও সত্যব্রত সেন; বিরুদ্ধ পক্ষে অশোক রুদ্র, রতন খাসনবিশ ও দীপঙ্কর চক্রবর্তী। সেই বিতর্কের বাক-উত্তাপ সেদিন কলকাতার রাজপথে ছড়িয়েছিল।

সেই নরম গরম সময়ে, বামপন্থার উত্তুঙ্গ তরঙ্গে তখন কে বাম কে নয় সেই হদিশ করাই ছিল দুষ্কর। বামপন্থার তখন যত মত তত পথ। তখনও বহু যুবকের চোখে বিপ্লবের স্বপ্ন মলিন হয়নি। সত্তর দশকে ঘরছাড়া বহু যুবকেরা তখনও রাজনীতির ময়দানে হোলটাইমার। সমসাময়িক কিছু বন্ধুরাও পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে বা মধ্যবর্তীতেই হোলটাইমার হচ্ছে। এমনকি উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম স্থানাধিকারী ছেলেও আয়েসি, মসৃণ কেরিয়ারের পথ ছেড়ে গোপন বামপন্থী বিপ্লবী পার্টিতে যোগ দিচ্ছে।

কিন্তু সময়টা যেহেতু আশির দশকের শেষভাগ, গোটা বিশ্ব জুড়ে এ দেশেও ঘটে যাচ্ছে কিছু যুগান্তকারী পরিবর্তন। ইউরোপে দুর্বল হয়ে পড়ছে ইউরো-কমিউনিজম, সোভিয়েত ইউনিয়নে শুরু হয়েছে গ্লাসনস্ত-পেরেস্ত্রৈকা, পূর্ব ইউরোপের বহু সমাজতান্ত্রিক দেশে শুরু হয়ে গেছে জনবিক্ষোভ, চীনে দেংজিয়াওপিং'এর 'সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে পুঁজিবাদের সীমিত প্রয়োগ' মান্যতা পেয়েছে। এ দেশে প্রবল হয়েছে জাতপাতের রাজনীতি, আসছে শঙ্কর গুহ নিয়োগীর 'সংঘর্ষ ও নির্মাণ'এর বাস্তব অভিঘাত, মহারাষ্ট্র কেঁপে উঠছে দত্ত সামন্তের নয়া শ্রমিক আন্দোলন ও শ্বেতকারী সংগঠনের কৃষি সংঘর্ষে, রাজ্যে রাজ্যে সংহত হচ্ছে নতুন নতুন আঞ্চলিক দল। এই আবহে পালটে যাচ্ছে বিষয়াদির উপাদানগুলিই। একাডেমিক ঘরানায় এসে গেছে সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ, পোস্ট-মডার্নিজম ও পোস্ট-কলোনিয়ালিজম, আলোচিত হচ্ছেন রোজা লুক্সেমবার্গ, গ্রামসি, আলথুজার, ফুকো, দেরিদা। যাঁদের খোলা মন, নির্দিষ্ট ভাবে কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে চলেন না, জানার আগ্রহ ষোলআনা, তাঁরা নানা উপচারে একাডেমিক এই কর্ষণ ও বাস্তব চলাচল দুটোকেই বোঝার চেষ্টা করছেন। তৈরি হচ্ছে একাডেমিক গবেষণা ও কেরিয়ারেরও নানা খাত, উপখাত।

এ যেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যখন সদ্য অর্থনীতি পাশ দেওয়া পাঁচ যুবকের মনে হল, মেলাতে হবে এই কর্মযজ্ঞকে। প্রতিষ্ঠানের গবেষণাকে যেতে হবে বাস্তব ময়দানে, আর বাস্তবতার কঠিন আগলকেও জানতে হবে একাডেমির থেকে। তবেই তো সমাজবিজ্ঞানের সফলতা। তত্ত্ব ও প্রয়োগের বুঝি বা মেলবন্ধনের প্রয়াস। জন্ম নিল ত্রৈমাসিক 'সমাজবিজ্ঞান' পত্র (পরে রেজিস্ট্রেশন জনিত কারণে নাম হয়েছিল 'সমাজবীক্ষণ')। এক নীরব সূত্রপাত।

তবে সে ভাবনাতে বেশ গোলযোগ ছিল। সে স্পষ্ট হবে চলার পথে। কিন্তু তখন আর উপায়ই বা কী!

২)
তো শুরু হল 'সমাজবিজ্ঞান' (পরে নাম পরিবর্তে 'সমাজবীক্ষণ')। যতদূর মনে পড়ে, প্রথম বছরে চারটে সংখ্যা বেশ হৈ হৈ করে বেরিয়ে গেল। বেশ সাড়াও পড়ল। কিন্তু গণ্ডগোল একটা ছিল, সেটা ধীরে ধীরে প্রকট হল। এক, যারা উদ্যোক্তা, তাদের তখন কেরিয়ার গড়ার পালা, এদিক সেদিক চাকরি-বাকরি ফলত স্থানচ্যুতি ও ব্যস্ততায় অচিরেই ঘনিয়ে এল 'সমাজবীক্ষণ'এর আয়ু। তবুও দু-একজন থেকে গেল একে টেনে চলার দায়ে।। দুই, বলা হল বটে তত্ত্বে-প্রয়োগে বা হাতেকলমে এ এক সমাজ অন্বেষণের প্রয়াস কিন্তু আখেরে এতে একাডেমির গবেষকদেরই পোয়া বারো হল; তাদের রিসার্চ পেপার লেখার গরজ ও দক্ষতা দুইই উৎসাহ পেল, যে পেপারের উৎপাদনে আদতে আমজনতার কিছুই এল গেল না। 'সমাজবীক্ষণ' হয়ে পড়ল মূলত একাডেমিক লোকজনদের হাত পাকানোর আখড়া, যদিও অন্যরকম চেষ্টা যে হয়নি তা নয়। আসলে, সেই পরিবর্তনকামী সময়ে গবেষণার এত উপচার এসে পড়েছে যে তা নিয়ে তখন কেরিয়ার গড়ার সোপান অনেক চোস্ত। দেশের সমাজমন্থনের রক্ত ঘাম জল করা বাস্তব উপাদানগুলি - যা নির্মিত হচ্ছে লড়াইয়ের ময়দানে - আমেরিকা, ইউরোপের একাডেমিক্সের পাদস্পর্শে মহিমান্বিত হয়ে চালান হচ্ছে এ দেশের প্রতিষ্ঠানাগারে। সুনিশ্চিত হচ্ছে স্থায়ী চাকরি আর মোটা মাইনে। আর তা আঁকড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়াম কাঁপাচ্ছেন অধ্যাপক-গবেষকেরা। ফ্রি মলিকিউলের মতো সারসত্য তখন ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে বাতাসে। অতএব, চার-পাঁচ বছর অনিয়মিত টেনে নব্বই দশকের প্রথম ভাগে বন্ধ হয়ে গেল 'সমাজবীক্ষণ'। কিছুতেই হদিশ পাওয়া গেল না কীভাবে একে একাডেমিক চর্বিত-চর্বণ থেকে বের করা যায়, কারণ তখন একটা ধারণা ছিল এই যে মূলত একাডেমিক্সের লোকজনেরাই তো সমাজ নিয়ে নতুন কিছু লেখেন! সে ভ্রম ভাঙ্গবে আরও কিছু বছর বাদে।

ইতিমধ্যে তিয়েনমেন স্কোয়ারে গুলি চলেছে। সোভিয়েত পতন সুনিশ্চিত হয়েছে, পূর্ব ইউরোপ ছারখার। অথচ, এ রাজ্যে সংহত হয়েছে বামফ্রন্টের শাসন, যেন এক অপ্রতিরোধ্য মূর্তিমান অমরত্ব। পাশাপাশি, অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং দেশে এনেছেন উদার অর্থনীতির প্রস্তাব। এই টালমাটাল আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেই এসে পড়বে ইন্টারনেট ও তথ্য প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য বিস্ফোরণ।

তখন ১৯৯৫।

৩)
১৯৯৫ সাল ছিল এক সন্ধিকাল। আমেরিকা-সোভিয়েত ইউনিয়নের ঠাণ্ডা যুদ্ধের কালে সামরিক প্রয়োজনে যুদ্ধ গবেষণার ফলিশ্রুতিতে যে ইন্ট্রানেট ও ইন্টারনেট প্রযুক্তির উদ্ভাস হয়েছিল, তার আগল ভেঙ্গে গেল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর। মার্কিন অধিপতিরা এবার মনে করলেন, আগামী একমেরু বিশ্বে আমাদেরই রাজ হবে, অতএব খুলে দাও ইন্টারনেট প্রযুক্তির দ্বার। শুরু হল এক নতুন ভুবনায়নের অধ্যায়। এ দেশেও তার ছাপ পড়ল। বোঝা গেল, আমরা প্রবেশ করছি তথ্য প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার এক অভিনব পরিসরে।

ইতিমধ্যে সত্তর দশক থেকেই পরিষেবা ক্ষেত্রের বাড়বাড়ন্ত বদলে দিচ্ছিল কর্মক্ষেত্র, শ্রেণি ও অর্থনীতির আদল। ক্রমেই যেন অর্থনীতিতে ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সংখ্যাগত আধিক্য কমে আসছে, জায়গা করে নিচ্ছে পরিষেবা ক্ষেত্রের কর্মীবর্গ। কর্মজগতে কায়িক শ্রম থেকে মানসিক শ্রমের বৃদ্ধির হার যেন ক্রমান্বয়েই বাড়ছে। ১৯৮২ সালে ইপিডব্লু'তে একটি বিতর্কিত লেখাও প্রকাশ পেল: Where have all the Workers Gone?

এই পরিবর্তিত আদরায় স্বভাবতই তখন এক সার্বিক সংশয় ও অন্বেষণের সময়। সমাজ ও অর্থনীতি কি এক নতুন ধারায় এগোচ্ছে? এ রাজ্যেও তখন নতুন আড়ম্বর। পাড়ায় পাড়ায় শুরু হচ্ছে সিন্ডিকেট ও প্রমোটার রাজ, লোকাল কমিটি এলাকা নিয়ন্ত্রণের সমস্ত ভার নিয়ে নিয়েছে কিন্তু নীতিগত ভাবে অর্থনীতির উপায়টা কী তা নিয়ে ঘোর সংশয়।
এই প্রখর বাস্তবতাই কতকগুলি দিক দর্শন করালো ও নতুন ভাবনাকে উস্কে দিল। রাজ্যে তখন এক আধা-নৈরাজ্য বিধিব্যবস্থা জাঁকিয়ে বসছে। লাল পতাকার ছায়ায় সরকারি অফিসে বসে আমজনতার থেকে উৎকোচের বিনিময়ে কাজ করে দেওয়া তখন একটি পুরোদস্তুর রীতি হয়ে গেছে। পার্টির জেলা কমিটি অফিসে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের প্যানেল তৈরিও একটি পাকা ব্যবস্থায় দাঁড়িয়েছে। গ্রামে পার্টির অনুমোদন ছাড়া মিলছে না গাবের চারা কি সরকারি বীজ। তাহলে রইলটা কী? রইল কিছু শুষ্ক তত্ত্ব যেগুলো আউড়ে সেমিনারে আর গবেষণাপত্রে দিন কাটত পণ্ডিতপ্রবরদের। এমতাবস্থায় গেরস্তের আর কীই বা করার থাকতে পারে।

ওই, ধর কলম, খাতা লাও, মগজে শান দাও। যারা এসব দেখছে, অনুভব করছে, শুধু মাটিতে বা চারপাশে নয়, অন্তরীক্ষেও, ভাবনাতেও, তারাই এবার সাথী হও অন্বেষণে। তিনজন মিলে বসে ভেবে ফেলল 'একক' অর্থাৎ একটি ইউনিটের কথা।

১৯৯৮ সালের অক্টোবরে প্রকাশ পেল 'একক'। পাতলা সস্তার কাগজে মাত্র ১৬ পাতার একটি পত্র। প্রচ্ছদ বিষয়: বিশ্বায়ন।

৪)
পরপর কয়েকটি সংখ্যার ভাবনা তৈরি হল। ইতিমধ্যে ১৯৯৯ সালে নন্দন চত্বরে শুরু হয়েছে লিটল ম্যাগাজিন মেলা। কবি শুদ্ধসত্ত্ব বসু এসে আপত্তি জানালেন, 'একক' নামে গত ৪০ বছর তাঁরা প্রকাশ করছেন একটি কবিতাপত্র। অতএব, 'একক' এরপর হল 'একক সাময়িকী'।

সময়টা এমনই, উল্লেখযোগ্য বাংলা ছবি আর নির্মিত হচ্ছে না, গ্রুপ থিয়েটারেরও দৈন্যাবস্থা। বিষয় ও ভাবনাগুলি যেন দোল খাচ্ছে এক সংশয়দীর্ণ মানচিত্রে। সময় চাইছে নতুন শব্দ-কথার বুনন। এসে গিয়েছেন গিটার হাতে সুমন-নচিকেতা-অঞ্জন। সুর, লয়, তালের থেকেও শব্দ-কথা-ভাব হয়ে উঠছে চলা-বলার সঙ্গী। কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী জুটি বেঁধেছেন বাংলা ভাষার অপার রহস্যের হদিশ পেতে। যেন ইতিহাস কথা বলতে শুরু করেছে। স্পষ্ট হচ্ছে, শব্দ কথা বাক্যের অন্তর্নিহিতেই লুকিয়ে রয়েছে কালের গতি ও অর্থের দ্যোতনা।

তথ্য প্রযুক্তি, আমলা ও কেরানি, এই প্রজন্ম কী ভাবছে, শিল্পায়নের ওলটপালট, শিক্ষার বাণিজ্য অথবা বাণিজ্য শিক্ষা, রাজনীতির মুখ - এইসব নিত্য নতুন বিষয়ে ভরে উঠছে 'একক সাময়িকী'র পাতা। একটা সাড়া পড়ছে, কিছু আলোড়ন যেন তৈরি হচ্ছে, খোলা মনে জগতের প্রদক্ষিণ চলছে। সমাজ জুড়ে পরিবর্তনের দিগদর্শন যেন ধরা দিচ্ছে লেখালিখির অনুশীলনে। এবার আর একাডেমিক নির্ভরতা নয়, সাধারণজন যাঁরা চিন্তা করেন, তাঁদের ভাষ্যে ধরা দিচ্ছে সমাজ বিবর্তনের পল-অনুপল। সকলে মিলে মগজে শান দেওয়ার অনুশীলন। যোগাযোগ গড়ে উঠছে বাংলাদেশের সঙ্গে, আরও আরও মানুষের সঙ্গেও, যাঁরা প্রকৃত প্রস্তাবে বেঁচে থাকার নানা লড়াই ও ভাবনার সঙ্গে জুড়ে থাকেন, হয়তো ঈষৎ কিছু কিছু বদলেরও অনুঘটক হয়ে ওঠেন।

অবশেষে ২০০০ সালের জুলাই। আরএনআই রেজিস্ট্রেশনে নাম হল 'একক মাত্রা'। এ শব্দদ্বয়ের কোনও অর্থ নেই। তবু কেউ কেউ চেষ্টা করলেন অর্থ নিষ্কাশনের। প্রকাশ পেল 'অর্থনীতির সত্যি মিথ্যা'। এই বিষয় নিয়ে এই প্রথম বসল গণ আড্ডা। বহু অর্থনীতিবিদেরা এলেন, নানান মানুষ, এক জমাটি আড্ডায় 'একক মাত্রা' যেন উত্তীর্ণ হল এক শক্তিশালী বিন্দুতে।

তারপর আরও কাণ্ড, আরও হৈচৈ।
৫)
জনপ্রিয় হল একক মাত্রা'র আড্ডা। পরের আড্ডা 'ভদ্দরলোকের মুখ ও মুখোশ'। সিগাল বুক স্টোর ভেঙ্গে লোকজন এলেন। এই আড্ডার ধরনই হল, বিষয়ের ওপরে সকলেই বলতে পারেন। সঞ্চালক খানিক নিয়ন্ত্রণ করেন মাত্র। গোটা আড্ডাটা রেকর্ড করে হুবুহু ছাপা হল পত্রিকার পাতায়। আরও কিছু আড্ডা কলকাতায়, এরপর শান্তিনিকেতনের চীনা ভবনে, আইআইটি খড়্গপুরে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। যাদবপুরের আড্ডায় বাংলাদেশ থেকে চারজন এলেন। তারপর একক মাত্রা'র তরফে চারজন গেলেন ঢাকায়। দুই বাংলার আড্ডা জমে উঠল। কলকাতায় আবার এলেন তাঁরা। এবার দেখানো হল তারেক মাসুদের বিশ্ববন্দিত ছবি 'মাটির ময়না'। তারেক মাসুদ স্বয়ং উপস্থিত। ম্যাক্স মুলার হল ভেঙ্গে লোকজন দেখতে এলেন সেই অসাধারণ ছবি। কলকাতায় 'মাটির ময়না'র প্রথম পাবলিক প্রদর্শন।

'একক মাত্রা' ঠাঁই পেয়েছে প্রায় সমস্ত চিন্তাশীল বাঙালির হৃদয়ে। মানুষের উন্মুখনতা ঘিরে 'একক মাত্রা' পরিণতি পেয়েছে এক গণ আন্দোলনে, হয়ে উঠেছে এক ভাবনা চর্চার কেন্দ্র। লেখক ও পাঠকের সীমানা ভেঙ্গে গেছে। প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক গবেষকেরাই শুধু নন, আপামর সাধারণজন যাঁরাই সদর্থক ও নতুন করে ভাবছেন, তাঁরাই একক মাত্রা'র লেখক ও পাঠক। এক সুবিশাল ক্যানভাস তৈরি হতে থাকল। কিন্তু তাকে সামাল দেবে কে? যাঁরা একক মাত্রা করছেন তাঁরা তো সকলেই বিভিন্ন পেশার মানুষজন। চাকরি-বাকরি করে, ঘর সংসার সামলে তবে তো একক মাত্রার কাজ। অতএব, যেমনটা সকলে চাইলেন, তেমন হওয়াটা সাধ্যে কুললো না। তায়, অনেকেই আবার মোট বইতে নারাজ। ঘাড়ে করে স্টলে দাও, মেলায় নিয়ে চল, বসো, প্রুফ দেখ, প্রেসে ছোটো, হিসেবপত্র রাখ - এইসব হাজারটা কাজের ঝক্কি কে নেবে, তার ওপর প্রতি দু মাস নিয়মিত পত্রিকা বের করার নিত্য ঘর্মকলরব। অতএব, সেই দু-একজনের ঘাড়েই সবটা এসে পড়া। সে এক মহা আতান্তর ও অবিশ্রান্ত চাপ। বাবু বাঙালিদের কায়িক শ্রমের প্রতি মহা বিরাগ আঘাত করল 'একক মাত্রা'কেও। পায়ে যেন বেড়ি পড়ল।

তবুও, তবুও নিস্তার নেই কাজের। সকলে দেখলেন প্রতি দু মাস অন্তর 'একক মাত্রা' তার স্বভাবসিদ্ধ শৃঙখলায় প্রকাশ পেল - বিষয় ও লেখার গুণবেত্তায় কোনও কার্পণ্য নেই, মেলাতেও সময় করে হাজির, টেবিলে হুমড়ি খেয়ে পাঠক-ক্রেতার ভীড়। তা কীভাবে হল সে অন্য গল্প। রাত জাগা পাখিদের নিরন্তর স্বপ্ন দেখার গল্প।

এইভাবে পার হল একবিংশ শতকের প্রথম পাঁচটি বছর। চারপাশে তখন এক গুমোট পরিবেশ। আর সব কিছু যা শাসকের অপছন্দ, একক মাত্রা'ও তেমন নেকনজরে। অনেকে লিখতে ভয় পাচ্ছেন, পড়তেও, অপবাদ আসছে, কেউ কেউ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করছেন। এইসব ঘনঘটার মধ্যেই পাকিয়ে উঠছে সমাজের ভবিতব্য।

তখন ২০০৬।

৬)
২০০৬। ২৩৫টা আসন নিয়ে বিপুল ভোটে বামফ্রন্ট আবারও ক্ষমতাসীন হল। দু এক মাস পরেই শিল্প দফতরের আধিকারিকরা এক নির্জন দুপুরবেলায় সিঙ্গুরে গেলেন জমি দেখতে। ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণ করে গড়ে উঠবে টাটাদের ন্যানো কারখানা। সে খবর চাউড় হতেই ঘরের মেয়ে-বউরা ঝাঁটা হাতে বেরিয়ে এলেন আধিকারিকদের সামনে। বিপদ বুঝে তাঁরা চম্পট দিলেন। এই ছিল সূত্রপাত। 'কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ' - এই শ্লোগানে বামফ্রন্ট তখন খোয়াব দেখছে এক আসন্ন 'শিল্প বিপ্লব'এর।

গুমোট, দমবন্ধ সে পরিস্থিতিতে একদিকে শুরু হল সিঙ্গুরের কৃষকদের জমি রক্ষার লড়াই, পাশাপাশি খুলে গেল 'উন্নয়ন' ভাবনা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের এক সিংহদুয়ার। শাসক ও বিগ মিডিয়া একযোগে প্রচার চালাচ্ছে শিল্প এলে কর্মসংস্থান হবে তাই ন্যানো কারখানা জরুরি। কৃষিজমি অধিগ্রহণে গড়ে ওঠা আধুনিক শিল্প যে সামান্য কর্মসংস্থান তৈরি করে, তার চেয়ে বেশি কর্মচ্যুতি ঘটায় - এই ধারণাটিও তখন দানা বাঁধছে। পরে শীর্ষ আদালতও টাটার উকিলকে একই প্রশ্ন করবেন - প্রায় ২০ হাজার কৃষিজীবীর কর্মচ্যুতি ঘটিয়ে মাত্র ৪০০ (প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান) + ৮০০ (পরোক্ষ কর্মসংস্থান) = ১২০০ লোকের কর্মযোগ করে আপনারা কী ধরনের কর্মসংস্থান করতে চাইছেন? অশোক মিত্র মহাশয় একটি পত্রে জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ নিয়ে লিখলেন, কৃষকদের উৎপাদন থেকে উচ্ছেদ করে কুসীদবৃত্তিতে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
ঠিক এই ঐতিহাসিক সময়ের বাঁকে 'একক মাত্রা' সমস্ত বিপদের সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করে নিজেকে উজাড় করে দিল কৃষি, শিল্প, অর্থনীতি, উন্নয়ন নিয়ে বাক-বিতণ্ডায়। প্রকাশ পেল 'জমির লড়াই'। তারপর 'কৃষি বনাম শিল্প?', 'শিল্পায়নের গোলকধাঁধা', 'এখন গণতন্ত্র', 'নাগরিক শক্তি', 'গ্রামবাংলা', 'আলো-আঁধারে পশ্চিমবঙ্গ' ও আরও কিছু লেখা যা হয়ে উঠল তর্ক-বিতর্কের অনুষঙ্গ। বহু লেখা ফটোকপি হয়ে হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ কিছু কিছু লেখা নিয়ে ছোট পুস্তিকাও বের করে ফেললেন। বিগ মিডিয়া ও শাসকের প্রস্তাবের বিপক্ষে তখন 'একক মাত্রা'র এই লেখাগুলিই হয়ে উঠল সওয়ালের হাতিয়ার। ইতিমধ্যে অশোক মিত্র মহাশয় নিজে ফোন করে 'একক মাত্রা'র সঙ্গে জুড়ে গেলেন তাঁর মহামূল্যবান কিছু লেখা দিয়ে। আরও বহু লিটল ম্যাগাজিনও তখন একই পথের অনুসারী। 'একক মাত্রা' উদ্যোগ নিল সকলকে মেলানোর।

১৮ ডিসেম্বর ২০০৬। ১৮টি লিটল ম্যাগাজিন একযোগে বসে তৈরি করল 'লিটল ম্যাগাজিন সমন্বয় মঞ্চ'। কাকতালীয় ভাবে, ওইদিনই মিটিং চলার সময় খবর এল, সিঙ্গুরে তাপসী মালিককে ধর্ষণ করে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। 'একটি স্ফুলিঙ্গই দাবানলের জন্ম দেয়'। ইতিমধ্যে লড়াই ছড়িয়েছে নন্দীগ্রাম, লালগড়ে। সারা রাজ্য জুড়ে কৃষক অভ্যুত্থান। তার সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছেন খেটে খাওয়া মানুষেরা। 'একক মাত্রা'র সংখ্যাগুলি হয়ে উঠল এই সার্বিক আন্দোলনের দৃশ্যপট ও যুক্তির হাতিয়ার।

২০০৭ সালের নন্দনের লিটল ম্যাগাজিন মেলায় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলনের সমর্থনে মিছিল বেরল। গ্রেফতার হলেন দুজন লিটল ম্যাগাজিন কর্মী। ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্সির মাঠে সমন্বয় মঞ্চ আয়োজন করল বিকল্প লিটল ম্যাগাজিন মেলা। বহু লিটল ম্যাগাজিন বয়কট করল নন্দনের মেলা।

'একক মাত্রা' তখন নতুন চিন্তা, বিকল্প ভাবনার পাটাতন। লর্ড সিনহা রোডের আইবি ডিপার্টমেন্ট থেকে ফোন আসছে পরবর্তী কর্মসূচির তল্লাশ চেয়ে। সমাজবিজ্ঞান চর্চা জুড়ে যাচ্ছে সমাজের বাস্তব চরিত্র ও ঘটনাবলীর সঙ্গে। আরও আরও নাগরিক উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে 'একক মাত্রা'র পথ চলা। ঘর্মাক্ত মাটির আলোড়নে নির্মিত হচ্ছে সমাজের তত্ত্ব-ভাবনা। 'টাটার কেশাগ্র স্পর্শ করতে দেব না' - শাসকের এই হুমকির বিরুদ্ধে কলম ও যুক্তির বয়ান গড়ে তুলছে প্রতিস্পর্ধা।

ইতিহাস হাসছে মুচকি করে। তারপর ২০১১।

৭)
অবশেষে দীর্ঘ ৩৪ বছর রাজ্যপাট চালিয়ে মহীরূহের পতন হল। সরকার পরিবর্তনের মামুলি কর্মকাণ্ডটিই এ রাজ্যে হয়ে উঠেছিল এক অবিশ্বাস্য প্রকল্প। সে অর্থে 'পরিবর্তন চাই' শব্দদ্বয় এক সুদূরপ্রসারী বাঙময়তায় মানুষের কল্পনায় মিশে গিয়েছিল। পণ্ডিতেরা ভাবলেন, এক মহাবিপ্লব আসন্নপ্রায়; যে কারণে ২০১১ সাল পেরতে না পেরতেই তাঁদের সবিস্ময় জিজ্ঞাসা: পরিবর্তনে কী মিলল? অথচ, সাধারণজন, খেটেখাওয়া মানুষেরা নিতান্তই বুঝেছিলেন, এ ছিল নিছকই এক সরকার পরিবর্তন, ওই তাতে সামান্য বাড়তি যেটুকু যা মেলে। সংসদীয় গণতন্ত্রে এই সামান্য সরকার পরিবর্তনের কম্মোটিই যে এ রাজ্যে এত কষ্টসাধ্য ছিল, তা 'পরিবর্তন' শব্দটিকেই দিয়েছিল এক দুঃসাধ্য মাত্রা। অবশেষে কৃষক অভ্যুত্থান ও গণজাগরণের মধ্য দিয়ে তা সম্ভবপরও হল। যে দাবিগুলিকে নিয়ে উত্তাল হয়েছিল এ রাজ্য, স্বভাবতই তার অনেকাংশ মান্যতাও পেল। 'একক মাত্রা'র এ বিষয়ে অবস্থানও ছিল খুব স্পষ্ট যা ২০১০-১১ সালের সংখ্যাগুলির বিভিন্ন লেখাগুলির মধ্যে ধরা ছিল।

পাশাপাশি, সোশ্যাল মিডিয়ার উত্থান বিগ মিডিয়াকে কার্যত কাবু করে ফেলল। পাওয়া গেল উন্মুক্ত পরিসর ও যোগাযোগের বিস্তৃত ভূমি। এখন আর বিগ মিডিয়া আপনার খবর কতটা বলবে, যার ওপর আপনার গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করতে পারে, তার দিন ফুরলো। এখন আপনিই মিডিয়া। এই বিন্যাস নির্মাণ করল একক মাত্রা'র আরও প্রসার ও জনপ্রিয়তা। গদ্য প্রবন্ধের একটি অনির্বচনীয় পরিসর হিসেবে তা হয়ে দাঁড়াল চিন্তাশীল মানুষদের একটি অঙ্গাঙ্গী জোটবদ্ধতা। চলল তর্ক, অনুসন্ধান, অন্বেষণ। আরও নতুন ও বিবিধ বিষয় জুড়তে থাকল প্রচ্ছদ কাহিনিতে। কোনও দল নয়, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির চলমান বাস্তবতার আকর হয়ে উঠল 'একক মাত্রা'। বাংলা ভাষাতেই যে এমন একটি কাজ নিরন্তর চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তারই নিদর্শন নির্মিত হল।

সেই সঙ্গে বিশ্বের অর্থনীতিতেও এসেছে আরও যুগান্তকারী পরিবর্তন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বলয়ে বদলে যাচ্ছে অর্থনীতির আঙ্গিক। কেউ কেউ বলছেন, আমরা ক্রমশ প্রবেশ করে চলেছি 'গিগ' অর্থনীতির বলয়ে যেখানে প্রায় অধিকাংশ কর্মের আর কোনও স্থায়ী কর্মীর দরকার নেই; কাজগুলি স্তরে স্তরে অর্পিত হবে স্বল্প সময়ের চুক্তির ভিত্তিতে। অর্থনীতির মূল কেন্দ্রে চলে আসছে অতিকায় কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত যন্ত্ররাজ-বিভূতি, যেখানে দৈত্যসম পুঁজি ও যন্ত্র দখল নিয়ে নিচ্ছে জগৎ সংসারের ভার। রাজনীতিকরাও পড়ছেন ফাঁপড়ে। তাঁরাও জানেন না, ঠিক হচ্ছেটা কী! যে কারণে ফেসবুক ও গুগল'এর সিইও'দের ডেকে মার্কিন কংগ্রসে খুব কড়কে দেওয়া হয়েছে। রাজনীতিকদের যেটুকু যা 'আপেক্ষিক স্বাধিকার' ছিল তাও বুঝি গেল। বিগ ডাটা, ডাটা আনালিটিকিস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অন্তরালে কী ঘটে চলেছে তা গুটি কয়েক মানুষ ছাড়া কেই বা জানে! যন্ত্ররাজ-বিভূতি এখন যেন মুখোমুখি গোটা মনুষ্যসমাজের। যন্ত্র ও অর্থনীতির এই একদেশদর্শিতা অপাঙক্তেয় করে দিয়েছে সমস্ত রাজনীতিক ও তাদের দলগুলিকে। বর্তমান সময় যেন প্রবেশ করছে এক অযাচিত অনিশ্চয়তা ও চমকের মহা গহ্বরে।

সময়ের এই অবিশ্বাস্য বয়ানকে যদি 'একক মাত্রা' পড়তে না পারে তবে সে হারাবে তার কার্যকারিতা, প্রাসঙ্গিকতা ও তাৎপর্যকে। এটা একটা চ্যালেঞ্জ। তাও আবার বাংলা ভাষায়। আরও একবার প্রমাণিত হবে বাংলা ভাষার সম্পদ কোথায়!

তবু কিছু কথা থাকে শেষে বলার জন্য।

৮)
যন্ত্ররাজ-বিভূতি যখন গোটা বিশ্বের দখল নিয়ে নিচ্ছে তখন অসহায় রাজনীতিকদের আর তেমন কিছু করার নেই। যন্ত্র-পুঁজির অর্থনীতিই এখন নিয়ামক। ক্রমেই তাই জাতপাত, জাতিগত, ধর্মীয় রাজনীতির খেলায় মেতে উঠছে রাজনীতিক ও রাজনৈতিক দলগুলি। এ দেশে রাজনীতির অক্ষটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে সেইসব উপাদান। আমেরিকার শাসকও সরকারকে শাটডাউন করে এখন মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তুলতে মরীয়া।

এই হল সার্বিক প্রেক্ষাপট যখন আজকের রাজনীতি ও অর্থনীতি এক যুগ সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতি আত্মসমর্পণ করছে অর্থনীতির উদ্দামতার কাছে, তার একমাত্রিক দ্রুতগামী চলার পথের কাছে। কোনও রাজনৈতিক দলের কাছে বাস্তবিক আর কোনও পথ নেই, সকলেই যন্ত্ররাজ-বিভূতিকে আজ্ঞা মেনেছে। উপায়ন্তর না পেয়ে, সকলেই এখন খতিয়ে দেখছে ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকামের সম্ভাবনাকে। অর্থাৎ, যন্ত্রের শাসনে যখন কর্মসংস্থানেরই ঘোর অমানিশা তখন সকলের হাতে ধরিয়ে দাও কিছু অর্থ যা দিয়ে অন্তত মোটা ভাত-কাপড়টুকু জোটে। যন্ত্ররাজও তাই চায়।

এর উপায়ন্তর কী? জিজ্ঞাসু মন খুঁজে ফেরে পরশপাথর। আমাদের সকলের মধ্যে সেই 'আগুন্তুক' ছবির মনমোহন মিত্রের যে ছোট কৌতূহলগুলিও আছে, সেগুলিই আজ ভুরভুরিয়ে উঠছে। হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনওখানে।

এক দার্শনিক-রাজনীতিবিদ গত শতকে তরুণদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, 'তোমরা সকালের আটটা-নটার সূর্য।' সকাল হয়েছে। ছেড়ে দিতে হবে প্রাঙ্গণ। কুড়ি বছরের ভরা যৌবনে পৌঁছে 'একক মাত্রা'র এখন যাত্রা হল শুরু অজানা সমীরণে। বুদ্ধদেব বসু কবেই বলেছিলেন, কুড়ি বছর পর লিটল ম্যাগাজিনটির আর চলা উচিত নয়। সমর সেন 'ফ্রন্টিয়ার' চালিয়েছিলেন কুড়ি বছর। জীবনানন্দ লিখেছিলেন, 'আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার'।

তাই নতুন সময়ে নতুনদের আবাহন। যাঁরা পুরাতন, তাঁরা দাঁড়ান পিছনের সারিতে। ঘুচে যাক কায়িক ও মানসিক শ্রমের সমস্ত প্রাচীর। বাবু বাঙালি যাঁরা মোট বইতে নারাজ, বাঁ হাতে ধুলোকাদা ঘাঁটেন, তাঁদের কর্ণকুহরে অতএব এই সময়ের নিনাদ প্রবেশ করে না। সমাজের বাস্তব ভূমিতেই নির্ণীত হয় সমাজবিজ্ঞানের আকর। সেই তার পরীক্ষাগার।

যাঁরা চিন্তিত, যাঁরা ভাবেন, ভেদ করার চেষ্টা করেন সমাজের রহস্য, তাঁরা আদতে পথের মানুষ। প্রজেক্ট করে সমাজবিজ্ঞান জানা যায় না। কারণ, এ অন্বেষণ জৈবিক, ধুলোকাদা মাখা এক নিরন্তর পরিক্রমা। ইতিহাস তৈরি হয় সেই অতল থেকে। বাকী সব পেপার।

'একক মাত্রা'র ভবিষ্যৎ তাই তরুণদের হাতেই।

৯)
তবুও কিছু কথা অধরা থাকে।

খুব আয়েসে, নিশ্চিন্তে 'একক মাত্রা' করা যাবে, তেমন নয়। পুরনোরা যখন চালিয়েছে তখন তারাও নানা গোলযোগ, হুমকি, বিদ্রূপ, মিথ্যাচারের মুখোমুখি হয়েই কাজটাকে নিরলস ভাবে এগিয়েছে। বহুজনে, আরও আরও প্রসারিত বহু বহু জনে, এর বিস্তার ঘটেছে; কিন্তু কিছু জন থাকে যারা নিন্দামন্দের জন্যই থাকে। অতএব, নতুন যারা হাল ধরছে, তাদের এই অভিজ্ঞতায় পুষ্ট হয়েই আগামী দিনের পথ চলা।

যে লিখতে পারে এবং মোটও বয়, সেই একক মাত্রা'র কাজের সঙ্গী, তরুণ বন্ধুর ভাষায় 'পত্রিকা শ্রমিক'। আর কৌতূহলী মন, অদম্য মগ্নতা, লিখে-পড়ে অনন্য আনন্দ পাওয়া হল চলার দোসর। বিজ্ঞাপন নেই, আলগা অর্থের যোগান নেই, প্রাতিষ্ঠানিক অনুদান নেই, ক্ষমতাশীলের আশীর্বাদ নেই - এই হল সেইসব না-পাওয়াগুলি যা অফুরন্ত চ্যালেঞ্জের খাঁটি উৎস। পত্রিকা বিক্রি করে, গ্রাহক সংগ্রহ করে, মেলায় বসে তবে যোগাড় করতে হয় অর্থ। সেই সঙ্গে প্রতি দু মাস অন্তর লেখা তৈরি, সংগ্রহ, যথাযথ সম্পাদনা, বিন্যাস, প্রেস, সব সেরে বিষয় ও সম্ভাব্য লেখকের খোঁজতল্লাস। তার আগে পরে ঘাড়ে করে পত্রিকা স্টলে স্টলে বিলি, গ্রাহকদের ডাকযোগে প্রেরণ ও হিসাব করণ। বেলা যায়, রাত গভীর হয়, সকাল আসে।

কেন এই তাড়ণা? সমাজের ধমনীতে যে রক্ত চলাচল, নিত্য লড়াইয়ে যে পুষ্টি অর্জন তার আনন্দঘন মুহূর্তগুলি তো এইভাবেই সজীব রাখে সংবেদনশীল মানুষদের। নিজের অস্তিত্ব ও সত্তাকে তাই বারবার বিচার করে নিতে হয় আপাত চলমান নির্দেশমূলক যন্ত্রবৎ অনুশাসনের বিপক্ষে। যিনি পারেন না, তিনি যন্ত্র হয়ে টিঁকে থাকেন। নিছক এলগরিদম হয়েই তাঁর বাঁচা।

এখন সকাল আটটা-নটা। আলোকজ্জ্বল স্বচ্ছতোয়ায় ভেসে যাচ্ছে পথঘাট, গাছপালা, পাখিদের কলরব। আকাশ জুড়ে ভেসে উঠছে মেঘেদের ভেলা। সমুদ্র গর্জনে অকালভৈরবী সুর, তাল, লয় ছুঁয়ে ফেলছে দূরের মহাদেশ। কে দাঁড়িয়ে তোমার পিছনে? মনের চৈতন্য গভীর স্নান সেরে রৌদ্রমাখা মৃত্তিকাতে বিলীন হচ্ছে। কালের মুখোমুখি হতে দ্বিধা কীসের?

রইল কলম অথবা কীবোর্ড। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর অনুসন্ধিৎসু মন। দিগন্ত বিস্তৃত আলোকভূমি। এবার দুই কুড়িতে পৌঁছক 'একক মাত্রা'। নতুন মন, উষ্ণ হৃদয়, তারুণ্যের কল্লোল।

পরের সংখ্যার প্রচ্ছদ বিষয়: দেশান্তর (মার্চ ২০১৯)।

Wednesday, 2 January 2019

A Humble Rejoinder to Raghuram Rajan and Abhijit Banerjee


When the Doctors Largely fail to Diagnose
Anindya Bhattacharya


On the very first day of this year, economists Raghuram Rajan and Abhijit Banerjee have prescribed in an Indian daily (Times of India) an eight-point module that India must work upon in 2019 to face the economic challenges. Worth reading! The points emerged like a Doctor’s prescription and these great economists being at the helm of affairs at the top universities, nobody possibly would dare to confront them even if politely. As a common man, living through the hardship of economic realities and discerning in a very practical way, I venture to raise some discussion on what they have articulated.

First, I would only harp on their six points, as the last two proposals were very imminent and nothing fresh. Secondly, it may be taken as a rejoinder to their opinion, if not read yet, would find mention of their salient overtures in my submission.

1. Their first concern is with fiscal deficit as has been with all the mainstream economists over the last 40 years. They have agreed to FRBM-suggested 5% fiscal deficit by 2023. The hard reality is, managing the fiscal deficit has been a topic of discussion over the last 30 years in our country and never in a single year could it be claimed to have been contained. I don’t know why the economists are so keen on discussing this topic when there is a FRBM Act enacted in 2003 with a target of containing fiscal deficit to 3% of GDP by 2008 which was never achieved. The amusing part of it is, though an Act is in vogue, nobody cares to abide by it. So, let it be – the fiscal deficit will always have a higher percentage to GDP but the economists and politicians will go on discussing on how to curb it despite of impossibility. The reason lies elsewhere and everybody know that.
Comment: Rajan-Banerjee talks of a vitamin pill which has no impact on patients.

2. The three distressed sectors as identified by Rajan-Banerjee are agriculture, power and banking. I would only harp on agriculture here. They have rightly pointed out that ‘periodic export bans and large-scale imports to keep food inflation down have radically moved the terms of trade against agriculture.’ Yes, but the periodic export bans have only aggravated the terms of trade against agriculture; the core fact is, the terms of trade was always against agriculture. The problem is, the University of Chicago and MIT would never teach how the terms of trade always goes against agriculture to keep the average wages low for maximization of profit. The recent farmers’ rally in Delhi and Mumbai and the street battles in Paris and Belgium have pointed to this basic ground. The emerging reality is that the present day global economy is heading towards a fierce encounter between industry/ service and agriculture. Due to obvious reasons, Rajan-Banerjee has ignored this aspect. However, instead of loan waivers, inflated MSPs, input price subsidies they have suggested for ‘a government move towards lump sum payments to farmers for holding below a certain limit’. It is to be seen whether this prescription would really work due to prevalence of other constraints.
Comment: Let Rajan-Banerjee get a benefit of doubt.

3. Changes in labour laws and a ‘better business environment’ were always pursued by the standard economists and the corporates for long and that is also nothing new as recommended by Rajan-Banerjee. What they actually pressed for is a revival of the idea of SEZ and the accompanying flexible labour laws ‘before an all-India roll-out, to provide the evidence needed to build consensus for them’. It’s more of a tactics for a roll-out of ‘hire and fire’ labour laws.
Comment: Old wine in new bottle.

4. And as all say so they have also said ‘sustainable growth’ with ‘less burdensome regulation’. Earlier, the idea was of ‘no-regulation’ and ‘free trade’ and now that of ‘less burdensome regulation’. Why that would be less burdensome? As they have put, ‘In other areas we need more centralization: for instance, a new and technically beefed up environmental regulator’ et al. So, now the much talked ‘decentralisation’ would also go with ‘more centralisation’. That too was obvious. The global economy pervaded by digital process and Artificial Intelligence has no other option but to be centrally controlled by the big corporates and digital mechanism - calls for a political intervention in order to balance the neo politico-economic spectrum of the future. The grilling of CEOs of Facebook and Google in the US Congress points to this advent. If the entire economy goes into the hands of the big corporates through encrypted mechanism, the political may have the chance to get captive into the designs of the coded rules. Therefore, the political will try to upkeep its relative autonomy by ‘regulation’ of the economy.
Comment: Hiding the global advent of machine and thus the perspective is lost.

5. ‘Government has to provide for benefits…’ as also put by Rajan-Banerjee. This is also nothing new but the inputs, according to them, should be overhauled as ‘…government should move towards cash transfers.’ In the coming future, as the AI would dominate the neo politico-economic sphere (gig economy) in a ubiquitous way entailing a massive unemployment and widespread low wages, basic income would be the ultimate choice to contain civil unrest and provide sustenance. Rajan-Banerjee could have mentioned the inevitability of ‘basic income’ but might have not, as that may be pre-maturely judgmental at this moment in Indian context.
Comment: Open the Pandora’s Box and bring out the idea of ‘Basic Income’.

6. Skill development is also a primary concern of the policy-makers nowadays. Rajan-Banerjee are outspoken in this regard too. But they have a tangible proposal which seems to be realistic and well thought of. I would say, here only they could come up with an innovative plan. Their suggestion: ‘multi-year paid government internship at salaries comparable to entry level market wages (much less than what the government pays) for those under 26 to work as support staff in government offices/ public enterprises where needed.’
Comment: Indeed a new programme and strategy.

Excepting point (6), whatever is suggested by Rajan-Banerjee is either a little bit of extension of whatever is happening or a partial way of depicting a problem and its elucidation thereof. Thank God, interestingly, they have not spoken on GDP growth!