উচ্চশিক্ষাকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার কৌশল নয়তো?
বশির আহমেদ
‘স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড স্কিম’এর মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে উচ্চশিক্ষাকে হতদরিদ্র ও গরিবের ঘরে পৌঁছে দেওয়া হবে- এমন একটা আবরণ আছে সম্প্রতি ঘোষিত রাজ্য প্রকল্পটির মধ্যে। দেখতে শুনতে বেশ ভালো লাগছে। ছাত্রছাত্রীরা ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের কথা শুনে উজ্জীবিত; যেন তাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এই স্কিমের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলে মনে হতে পারে, গরিব ছাত্রদরদের আড়ালে যেন রয়েছে একটি অন্য প্রয়াস। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, 'ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার জন্য আর ঘরবাড়ি বেচতে হবে না, তারা ১০ লাখ টাকা অবধি ঋণ পাবে।' কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি, একটি গণতান্ত্রিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। অন্তত কাগজেকলমে এই অধিকার এখনও বিবেচনা করা হয়। কেন তাকে তা ঋণ নিয়ে কিনতে হবে? ফলে প্রশ্ন উঠছে, ‘স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড স্কিম’ সেই অধিকারকে খর্ব করার একটা সুচিন্তিত কৌশল নয়তো?
এতদিন সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীকে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও ডিগ্রি অর্জনের জন্য কোনওরকম ঋণ নিতে হত না। বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যের নানা ধরনের ছাত্র-সহায়ক আর্থিক সাহায্য সরকার দিত। তার সঙ্গে ছিল আরও বিভিন্ন ধরনের স্কলারশিপ। তাহলে এত ঘটা করে ছাত্রছাত্রীদের ঋণ দেওয়ার কারণ কী? চারিদিকে সমস্ত ক্ষেত্রে যে বেসরকারিকরণের হিড়িক পড়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে, তারই কি সূচনা হতে চলেছে শিক্ষাক্ষেত্রেও, যার শুরুয়াত হচ্ছে এই রাজ্যে? রাজ্যের সরকার মুখে বেসরকারিকরণের বিরোধিতা করলেও তাদের প্রশাসনিক অবস্থান দাঁড়াচ্ছে আদতে এই বেসরকারিকরণের পক্ষেই। শিক্ষাকে ‘মৌলিক অধিকার’এর তালিকা থেকে সরিয়ে মুনাফা কামানোর ‘পণ্যে’র দিকে ঠেলে দিচ্ছে নাকি এই স্কিম? ১৯৯১ সালে গ্যাট চুক্তির মাধ্যমে ভারত সরকার স্বাক্ষর করেছিল বিশ্ব জোড়া তাবড় কর্পোরেটদের সমষ্টি WTO (World Trade Organization)-এর সঙ্গে। সেই চুক্তির রূপায়ণের স্বার্থেই কি দেশ জুড়ে শিক্ষাসত্রকে বেসরকারিকরণ করার প্রচেষ্টা জারি হয়েছে? যা ইতিমধ্যে বহু রাজ্যে শেকড় গেঁড়ে ফেলেছে? এই প্রশ্নটা কিন্তু ঘরপোড়া নিন্দুকদের খুব ভাবাচ্ছে।
প্রাথমিক থেকে উচ্চতর শিক্ষা রাষ্ট্র দ্বারা সুরক্ষিত রাখার সাংবিধানিক দায়টি বাস্তবে অকার্যকর করে দেওয়ার কৌশল হিসেবেই এই ধরনের ঋণ প্রকল্প চালু করে রাষ্ট্র কি হাত ধুয়ে ফেলতে চাইছে? এমনই সব প্রশ্ন শিক্ষক মহলের অনেকেরই মনে উঠছে। যা ছিল এতদিন প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার- এই স্কিমের মাধ্যমে সেই অধিকারও মুনাফাদারী পণ্যে পরিণত হবে। অন্যান্য রাজ্য এ বিষয়ে অনেক অগ্রসর হলেও পশ্চিমবঙ্গে এতদিন শিক্ষার বেসরকারিকরণের দাপট এতখানি ছিল না। এবার এই রাজ্যেও শিক্ষা কেনাবেচার বাজার তৈরি হবে; যা ইতিমধ্যে অনেকটাই শুরু হয়ে গিয়েছে। খুব স্বাভাবিক কারণে শিক্ষাও চলে যাবে কর্পোরেট হাঙর-কুমিরদের পেটে। তখন প্রচুর অর্থ ব্যয় করেই কিনতে হবে সব ধরনের শিক্ষা— প্রায়োগিক-প্রযুক্তিগত শিক্ষা থেকে সাধারণ শিক্ষা- সব তখন হয়ে যাবে চাল-ডাল-তেল-নুনের মতো একটি বাজারি পণ্য। যেভাবে পেট্রোল-ডিজেল ও ভোজ্য তেলের দাম বাড়ছে, সেভাবেই বাড়বে ‘শিক্ষা’ নামক পণ্যেরও দাম। গরিব ছাত্রছাত্রীরা ঋণ নিয়ে পড়তে যাবে বড় বড় চোখ ধাঁধানো বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। খুব সহজেই ঋণের জালে জড়িয়ে পরিণত হবে কর্পোরেট সংস্থারই স্বল্প বেতনের চাকুরে। যাকে আধুনিক দাস বলাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। এভাবেই ভোগ্যপণ্যের মতো শিক্ষাও হয়ে যাবে স্বাভাবিক একটি বাজারজাত পণ্য। মানুষ ভুলে যাবে তাঁর অধিকারের কথা।
বিপরীত দিকে ঋণ পেয়ে অসচেতন ছেলেমেয়েরা নিজেদের মেধায় ক্রাশ খেয়ে এবং অভিভাবকগণও সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আর কল্পনা নয় একেবারে বাস্তব মনে করে ছুট লাগাবে জেলার প্রান্তস্থ কলেজ ছেড়ে মহানগরের আশেপাশে গড়ে ওঠা ঝাঁ-চকচকে বেসরকারি শিক্ষালয়ের দিকে। সরকারি ও সরকার পোষিত মধ্য-উচ্চ-উচ্চতর বিদ্যায়তনগুলি রুগ্ন হতে হতে ধীরে ধীরে লকআউট হয়ে যাওয়া কারখানাগুলির মতো বসে যাবে বা ধুঁকবে। ঋণের গ্যারান্টার বলে সরকার সহজেই পরিকাঠামো উন্নয়নের খাতে টাকা না ঢালার ঢালাও অজুহাত পেয়ে যাবে। সবচেয়ে ঋণাত্মক প্রভাব পড়বে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে। নামমাত্র শিক্ষক নিয়োগ করে এবং যৎসামান্য অ্যালটমেন্ট দিয়ে কোনওরকমে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বাঁচিয়ে রেখে সরকার তার সাংবিধানিক দায় মেনে নেবে। অন্যদিকে গড়ে উঠবে শিক্ষার খোলা বাজার। নিলাম হাঁকবে হাঙর কুমিরের দল।
অন্যদিকে অতি সহজেই কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষা হয়ে যাচ্ছে। নানা কারণে ও আইনি জটিলতায় বহু বছর শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ। দুর্নীতির কথা বাহুল্য। যে সংখ্যার শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে তা নদী ও ডোবার অনুপাত মাত্র। প্রকারান্তরে করোনা মহামারিকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষা বেসরকারিকরণের নতুন পদ্ধতি হিসেবে অনলাইন/ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার পুরোদমে শিক্ষার মেধা প্রক্রিয়াকরণটিকে তুলে দিচ্ছে কর্পোরেটের হাতেই। এই কারণেই ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া হয়েছে ট্যাব। এখন দিচ্ছে ঋণ। বিজনেস ওয়্যার নামক একটি নিউজ পোর্টালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে ‘অনলাইন এডুকেশন ইন্ডাস্ট্রি’ ২০২৪-এর মধ্যে ৩৬০ বিলিয়ন টাকার বাজার তৈরির টার্গেট নিয়েছে কর্পোরেটরা। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার হয়ে উঠছে সেই কর্পোরেটদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মাত্র। এই ম্যানেজারি পাওয়ার জন্য নাচছে অনেক বাম দলও।
এই পরিস্থিতিতে এখনই যদি আমরা যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাভাবিক শিক্ষাদান প্রক্রিয়া চালু করার দাবি না তুলি, তাহলে বিরাট মাপের ক্ষতি হয়ে যাবে। যে ক্ষতির ক্ষত সারাতে হয়তো তিন-চারটে প্রজন্মকে ভুগতে হতে পারে। যাঁরা চাকরি পেয়ে গিয়েছেন, আগামী দিনে হয়তো তাঁদের চাকরিটুকুই থাকবে; অদূর ভবিষ্যতে সরকারি স্কুল-কলেজের চাকরি ক্রমশ সংকুচিত হতে হতে এক সময় অবলুপ্ত হয়ে যাবে। আমাদের ভবিষ্যৎ সেই দিকেই যাচ্ছে মনে বলে করছেন অভিজ্ঞ শিক্ষক মহল। শিক্ষাঙ্গনের যে চারটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে বিদ্যার্জনের প্রক্রিয়া, তার অন্যতম স্তম্ভশক্তি হল শিক্ষক ও পড়ুয়া। উভয় স্তরে সচেতন পদক্ষেপের মাধ্যমে এখনই যদি এই শিক্ষাবিরোধী কূট কৌশলটিকে প্রতিরোধ করতে না পারি তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের কোনওদিন ক্ষমা করবে না।