Tuesday, 29 June 2021

স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ড স্কিম

উচ্চশিক্ষাকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার কৌশল নয়তো? 

বশির আহমেদ


‘স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড স্কিম’এর মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে উচ্চশিক্ষাকে হতদরিদ্র ও গরিবের ঘরে পৌঁছে দেওয়া হবে- এমন একটা আবরণ আছে সম্প্রতি ঘোষিত রাজ্য প্রকল্পটির মধ্যে। দেখতে শুনতে বেশ ভালো লাগছে। ছাত্রছাত্রীরা ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের কথা শুনে উজ্জীবিত; যেন তাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এই স্কিমের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলে মনে হতে পারে, গরিব ছাত্রদরদের আড়ালে যেন রয়েছে একটি অন্য প্রয়াস। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, 'ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার জন্য আর ঘরবাড়ি বেচতে হবে না, তারা ১০ লাখ টাকা অবধি ঋণ পাবে।' কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি, একটি গণতান্ত্রিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। অন্তত কাগজেকলমে এই অধিকার এখনও বিবেচনা করা হয়। কেন তাকে তা ঋণ নিয়ে কিনতে হবে? ফলে প্রশ্ন উঠছে, ‘স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড স্কিম’ সেই অধিকারকে খর্ব করার একটা সুচিন্তিত কৌশল নয়তো? 

এতদিন সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীকে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও ডিগ্রি অর্জনের জন্য কোনওরকম ঋণ নিতে হত না। বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যের নানা ধরনের ছাত্র-সহায়ক আর্থিক সাহায্য সরকার দিত। তার সঙ্গে ছিল আরও বিভিন্ন ধরনের স্কলারশিপ। তাহলে এত ঘটা করে ছাত্রছাত্রীদের ঋণ দেওয়ার কারণ কী? চারিদিকে সমস্ত ক্ষেত্রে যে বেসরকারিকরণের হিড়িক পড়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে, তারই কি সূচনা হতে চলেছে শিক্ষাক্ষেত্রেও, যার শুরুয়াত হচ্ছে এই রাজ্যে? রাজ্যের সরকার মুখে বেসরকারিকরণের বিরোধিতা করলেও তাদের প্রশাসনিক অবস্থান দাঁড়াচ্ছে আদতে এই বেসরকারিকরণের পক্ষেই। শিক্ষাকে ‘মৌলিক অধিকার’এর তালিকা থেকে সরিয়ে মুনাফা কামানোর ‘পণ্যে’র দিকে ঠেলে দিচ্ছে নাকি এই স্কিম? ১৯৯১ সালে গ্যাট চুক্তির মাধ্যমে ভারত সরকার স্বাক্ষর করেছিল বিশ্ব জোড়া তাবড় কর্পোরেটদের সমষ্টি WTO (World Trade Organization)-এর সঙ্গে। সেই চুক্তির রূপায়ণের স্বার্থেই কি দেশ জুড়ে শিক্ষাসত্রকে বেসরকারিকরণ করার প্রচেষ্টা জারি হয়েছে? যা ইতিমধ্যে বহু রাজ্যে শেকড় গেঁড়ে ফেলেছে? এই প্রশ্নটা কিন্তু ঘরপোড়া নিন্দুকদের খুব ভাবাচ্ছে। 

প্রাথমিক থেকে উচ্চতর শিক্ষা রাষ্ট্র দ্বারা সুরক্ষিত রাখার সাংবিধানিক দায়টি বাস্তবে অকার্যকর করে দেওয়ার কৌশল হিসেবেই এই ধরনের ঋণ প্রকল্প চালু করে রাষ্ট্র কি হাত ধুয়ে ফেলতে চাইছে? এমনই সব প্রশ্ন শিক্ষক মহলের অনেকেরই মনে উঠছে। যা ছিল এতদিন প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার- এই স্কিমের মাধ্যমে সেই অধিকারও মুনাফাদারী পণ্যে পরিণত হবে। অন্যান্য রাজ্য এ বিষয়ে অনেক অগ্রসর হলেও পশ্চিমবঙ্গে এতদিন শিক্ষার বেসরকারিকরণের দাপট এতখানি ছিল না। এবার এই রাজ্যেও শিক্ষা কেনাবেচার বাজার তৈরি হবে; যা ইতিমধ্যে অনেকটাই শুরু হয়ে গিয়েছে। খুব স্বাভাবিক কারণে শিক্ষাও চলে যাবে কর্পোরেট হাঙর-কুমিরদের পেটে। তখন প্রচুর অর্থ ব্যয় করেই কিনতে হবে সব ধরনের শিক্ষা— প্রায়োগিক-প্রযুক্তিগত শিক্ষা থেকে সাধারণ শিক্ষা- সব তখন হয়ে যাবে চাল-ডাল-তেল-নুনের মতো একটি বাজারি পণ্য। যেভাবে পেট্রোল-ডিজেল ও ভোজ্য তেলের দাম বাড়ছে, সেভাবেই বাড়বে ‘শিক্ষা’ নামক পণ্যেরও দাম। গরিব ছাত্রছাত্রীরা ঋণ নিয়ে পড়তে যাবে বড় বড় চোখ ধাঁধানো বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। খুব সহজেই ঋণের জালে জড়িয়ে পরিণত হবে কর্পোরেট সংস্থারই স্বল্প বেতনের চাকুরে। যাকে আধুনিক দাস বলাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। এভাবেই ভোগ্যপণ্যের মতো শিক্ষাও হয়ে যাবে স্বাভাবিক একটি বাজারজাত পণ্য। মানুষ ভুলে যাবে তাঁর অধিকারের কথা। 

বিপরীত দিকে ঋণ পেয়ে অসচেতন ছেলেমেয়েরা নিজেদের মেধায় ক্রাশ খেয়ে এবং অভিভাবকগণও সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আর কল্পনা নয় একেবারে বাস্তব মনে করে ছুট লাগাবে জেলার প্রান্তস্থ কলেজ ছেড়ে মহানগরের আশেপাশে গড়ে ওঠা ঝাঁ-চকচকে বেসরকারি শিক্ষালয়ের দিকে। সরকারি ও সরকার পোষিত মধ্য-উচ্চ-উচ্চতর বিদ্যায়তনগুলি রুগ্ন হতে হতে ধীরে ধীরে লকআউট হয়ে যাওয়া কারখানাগুলির মতো বসে যাবে বা ধুঁকবে। ঋণের গ্যারান্টার বলে সরকার সহজেই পরিকাঠামো উন্নয়নের খাতে টাকা না ঢালার ঢালাও অজুহাত পেয়ে যাবে। সবচেয়ে ঋণাত্মক প্রভাব পড়বে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে। নামমাত্র শিক্ষক নিয়োগ করে এবং যৎসামান্য অ্যালটমেন্ট দিয়ে কোনওরকমে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বাঁচিয়ে রেখে সরকার তার সাংবিধানিক দায় মেনে নেবে। অন্যদিকে গড়ে উঠবে শিক্ষার খোলা বাজার। নিলাম হাঁকবে হাঙর কুমিরের দল।

অন্যদিকে অতি সহজেই কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষা হয়ে যাচ্ছে। নানা কারণে ও আইনি জটিলতায় বহু বছর শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ। দুর্নীতির কথা বাহুল্য। যে সংখ্যার শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে তা নদী ও ডোবার অনুপাত মাত্র। প্রকারান্তরে করোনা মহামারিকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষা বেসরকারিকরণের নতুন পদ্ধতি হিসেবে অনলাইন/ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার পুরোদমে শিক্ষার মেধা প্রক্রিয়াকরণটিকে তুলে দিচ্ছে কর্পোরেটের হাতেই। এই কারণেই ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া হয়েছে ট্যাব। এখন দিচ্ছে ঋণ। বিজনেস ওয়্যার নামক একটি নিউজ পোর্টালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে ‘অনলাইন এডুকেশন ইন্ডাস্ট্রি’ ২০২৪-এর মধ্যে ৩৬০ বিলিয়ন টাকার বাজার তৈরির টার্গেট নিয়েছে কর্পোরেটরা। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার হয়ে উঠছে সেই কর্পোরেটদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মাত্র। এই ম্যানেজারি পাওয়ার জন্য নাচছে অনেক বাম দলও। 

এই পরিস্থিতিতে এখনই যদি আমরা যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাভাবিক শিক্ষাদান প্রক্রিয়া চালু করার দাবি না তুলি, তাহলে বিরাট মাপের ক্ষতি হয়ে যাবে। যে ক্ষতির ক্ষত সারাতে হয়তো তিন-চারটে প্রজন্মকে ভুগতে হতে পারে। যাঁরা চাকরি পেয়ে গিয়েছেন, আগামী দিনে হয়তো তাঁদের চাকরিটুকুই থাকবে; অদূর ভবিষ্যতে সরকারি স্কুল-কলেজের চাকরি ক্রমশ সংকুচিত হতে হতে এক সময় অবলুপ্ত হয়ে যাবে। আমাদের ভবিষ্যৎ সেই দিকেই যাচ্ছে মনে বলে করছেন অভিজ্ঞ শিক্ষক মহল। শিক্ষাঙ্গনের যে চারটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে বিদ্যার্জনের প্রক্রিয়া, তার অন্যতম স্তম্ভশক্তি হল শিক্ষক ও পড়ুয়া। উভয় স্তরে সচেতন পদক্ষেপের মাধ্যমে এখনই যদি এই শিক্ষাবিরোধী কূট কৌশলটিকে প্রতিরোধ করতে না পারি তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের কোনওদিন ক্ষমা করবে না।


Monday, 28 June 2021

ফ্লয়েড হত্যার রায়

অতীতের আয়নার মুখোমুখি আমেরিকা

সোমনাথ গুহ


বর্ণ বৈষম্য নির্মূল করার লক্ষ্যে এক কদম এগলো আমেরিকা। গত বছরের ২৫ মে সারা বিশ্ব দেখেছে ডেরেক শভিন নামে এক দুর্বৃত্ত পুলিস অফিসার কীভাবে জর্জ ফ্লয়েডের গলা ৯ মিনিট ২৯ সেকেন্ড ধরে হাঁটু দিয়ে পিষে রেখেছিল। সারা সময়টা হতভাগ্য মানুষটি মিনতি করেছিলেন যে তিনি  শ্বাস নিতে পারছেন না। নির্দয় শভিন মুমূর্ষু মানুষটির কথায় কোনও কর্ণপাত করেনি, তার তিন সঙ্গী পাশে দাঁড়িয়ে মজা দেখেছে। 

ফ্লয়েডের এই নৃশংস মৃত্যুর কারণে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে সারা আমেরিকা জুড়ে। প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ সহ বিশ্বের আরও নানা দেশে। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন পুনর্জীবিত হয়। নভেম্বরে দেশের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দোষীদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবি করেন এবং অশ্বেতাঙ্গ মানুষদের বিপুল সমর্থন পান। ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর বাইডেনের এজেন্ডায় প্রথমেই এই বিষয়টি ছিল। তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল আমেরিকার মজ্জাগত এই বর্ণ বৈষম্যকে উপেক্ষা করা। 

এই বছরের মার্চে শভিনের বিচার শুরু হয়। এপ্রিলে রায় ঘোষণা হয়। তাকে সেকেন্ড ডিগ্রি অনিচ্ছাকৃত হত্যা, থার্ড ডিগ্রি হত্যা এবং সেকেন্ড ডিগ্রি নরহত্যায় অভিযুক্ত করা হয়। গত শনিবার তাকে সাড়ে বাইশ বছর কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়। এই ঘটনার পুরো ভিডিও রেকর্ডিং ছিল। মনে হতে পারে এর থেকে মোক্ষম প্রমাণ আর কী হতে পারে? আরও বহু কৃষ্ণাঙ্গ মৃত্যুর ক্ষেত্রেও অতীতে সে সব ছিল, প্রত্যক্ষদর্শীরাও ছিল, কিন্তু দোষীদের কোনও সাজা হয়নি। 

১৯৯১'এ রডনি কিংকে বেধড়ক মেরে মৃতপ্রায় করে ফেলে রাখে চার অফিসার। সেটারও ভিডিও রেকর্ডিং ছিল। তা সত্ত্বেও দোষীরা বেকসুর খালাস হয়ে যায়। বিভিন্ন এলাকায় হিংসা ছড়ায়, দাঙ্গা হয়। এবারও অনেকে সন্দিহান ছিলেন, আদৌ দোষীদের শাস্তি হবে কিনা। পুনরাবৃত্তি যে হয়নি, তার পিছনে কিছু কারণ আছে। প্রথমত, ফ্লয়েডের হত্যা এত নির্মম ছিল এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এত জোরালো হয়ে উঠেছিল যে তা আমেরিকার বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে নগ্ন করে দেয়। শাস্তি না দিলে বিশ্বের সর্বোত্তম গণতন্ত্রের কৌলীন্য রক্ষা হত না। দ্বিতীয়ত, জুরির এগারো জনের মধ্যে ছ' জন ছিলেন অশ্বেতাঙ্গ। যদিও রায় সর্বসম্মতিক্রমে হয়েছে, অভিজ্ঞ আইনজীবীরা বলছেন, শ্বেতাঙ্গরা সংখ্যাগরিষ্ঠ জুরি হলে শভিন খালাস হলেও হতে পারত। তেমন সম্ভাবনা ছিল। শভিনকে শাস্তি প্রদান করলেও জুরির মনোভাব ছিল, এটি একজন ব্যক্তির অপরাধ মাত্র, ব্যবস্থার কোনও গলদ নয়। ব্যবস্থাটাই যে বৈষম্যমূলক এটা স্বীকার না করতে পারার মধ্যেই বোঝা যায় সমস্যাটা কত গভীরে। তৃতীয়ত, যেটা অভুতপূর্ব, অন্য পুলিস অফিসাররা বিভাগের প্রধান সহ শভিনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। ইতিপূর্বে প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে তাঁরা তাঁদের সহকর্মীর হয়ে ওকালতি করেছেন।  

ফ্লয়েডের হত্যার বিচার এবং তার সাজার মধ্যে দুটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। ১৯ জুন জুনটিন্থ দিবস আমেরিকায় ফেডারাল ছুটি হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। জুনটিন্থ অর্থে জুন প্লাস নাইন্টিন্থ। ১৮৬৫ সালে ঐ দিনে ক্রীতদাস প্রথার বিলোপ ঘোষণা করা হয়। সারা দেশ জুড়ে মানুষ, বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ এই দিনটি অত্যন্ত সমারোহের সাথে উদযাপন করেন। অনেক রাজ্যে ছুটি পালিত হয়। এই দিনটিকে ঘিরে আমেরিকায় একটি বিশেষ ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে। বাইডেন সরকারের এই পদক্ষেপ অবশ্যই একটি জনমোহিনী সিদ্ধান্ত, কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে তাদের জনভিত্তি এর ফলে আরও প্রসারিত হবে। একই সাথে আমেরিকান গণতন্ত্র কিন্তু এই সিদ্ধান্তের ফলে বর্ণ বৈষম্য নির্মুল করতে নতুন করে অঙ্গীকারবদ্ধ হল। 

দ্বিতীয় ঘটনাটি আরও গুরুত্বপূর্ণ: পুলিস রিফর্ম, যা দেশে একটি বহু বিতর্কিত বিষয়। ফ্লয়েডের মৃত্যুর পরে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন পুলিসের কাজকর্মের ওপর বিধিনিষেধের প্রয়াস আমেরিকার কংগ্রেসে ধাক্কা খায়। রিপাবলিকানদের বিরোধিতায় সেই বিল আটকে যায়। মার্চের শুরুতেই হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ'এ ‘জর্জ ফ্লয়েড জাস্টিস ইন পুলিসিং অ্যাক্ট’ মাত্র ২২০-২১২ ভোটে পাস হয়। এখন বিলটি সেনেটে পাস করতে হবে যেখানে সেটি অবশ্যই প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হবে। বিলটি আইন হলে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হবে। এর ফলে পুলিসের ওপর যে সব বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে তা হল: 

(১) Qualified Immunity বা যোগ্য অনাক্রম্যতার সুযোগ পুলিস আর নিতে পারবে না। এর অর্থ কোনও ব্যক্তির অধিকার হরণ করার জন্য তখনই তুমি কোনও অফিসারকে দায়ী করতে পারো যদি সেই অধিকার অতীতের কোনও মামলায় প্রশ্নাতীত ভাবে স্বীকৃতি পেয়ে থাকে। এই কথাটির সুবিধা হচ্ছে, এটি বহু ভাবে ব্যাখ্যা হতে পারে যার সুযোগ নিয়ে অতীতে বহু বর্ণবিদ্বেষী, পাশবিক শ্বেতাঙ্গ অফিসার পার পেয়ে গেছে। অধিকাংশ রিপাবলিকান এবং কিছু ডেমোক্রাটও এই ধারা বিলোপ করার বিরুদ্ধে।

(২) গলায় প্যাঁচ বা শ্বাসরোধ করা নিষিদ্ধ।

(৩) নো-নক ওয়ারেন্ট বাতিল। এর অর্থ, জানান না দিয়ে পুলিস কারও বাড়ি, অফিস ইত্যাদিতে প্রবেশ করতে পারবে না।

(৪) পুলিস এনকাউন্টারের তথ্য সংরক্ষিত রাখতে হবে।

(৫) বর্ণ, ধর্ম, জাতি অনুযায়ী অভিযুক্তদের বর্ণনা বা তালিকাভুক্ত করা বন্ধ করতে হবে।

সেনেটে এই বিল পাস হবে কিনা বলা দুষ্কর। মূলত প্রথম ধারাটি নিয়ে সেনেটারদের মধ্যে তুমুল দরাদরি চলছে। শ্বেতাঙ্গরা কোনওভাবেই Qualified Immunity ছাড়তে রাজি নন। অতীতের পাপক্ষালনের জন্য পুলিস রিফর্ম আবশ্যক। এছাড়া কৃষ্ণাঙ্গদের যে ভাবে ভোট দিতে বাধা দেওয়া হয় তা নিয়ে তারা সরব। পিউ চ্যারিটেবিল ট্রাস্টের একটি সমীক্ষায় বলা হচ্ছে, এটা বিভিন্ন ভাবে করা হয়- কৃষ্ণাঙ্গ এলাকায় বুথ কমিয়ে দিয়ে অন্যত্র বাড়িয়ে দেওয়া; জনগণনায় কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা কম করে দেখানো; পোস্টাল ব্যালট তাঁদের কাছে সময় মতো পৌঁছয় না ইত্যাদি। এটা করে কংগ্রেসে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিনিধিত্ব কম করে রাখার চেষ্টা হয়। তাঁরা অতীতের অত্যাচার  নিপীড়নের ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। আমেরিকার ইতিহাসে ক্রীতদাস প্রথার যে এক তরফা শ্বেতাঙ্গ-বান্ধব বয়ান তা সংশোধন করার দাবিও তাঁরা তুলেছেন। 

মার্কিন সমাজে যা প্রায় অনতিক্রম্য হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হল এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বৈষম্য। ৭৫ শতাংশ মানুষ মনে করেন, বর্ণ বৈষম্য সমাজের প্রধান সমস্যা, ৫৭ শতাংশ মনে করেন কালো মানুষেরা বেশি পুলিসি অত্যাচারের শিকার। তাঁরা জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ কিন্তু পুলিসের হাতে মৃত্যুর হার ২৪ শতাংশ। গড়পড়তা একটি শ্বেতাঙ্গ পরিবারের সম্পত্তি কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের চেয়ে দশ গুণ বেশি। শ্বেতকায় একজন স্নাতক সাত গুন বেশি ধনী একজন কৃষ্ণকায়ের থেকে। প্রসবকালীন মৃত্যু এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলার ক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গ মহিলার চেয়ে তিন থেকে চার গুন বেশি। বিনামূল্যে সরকারি স্কুলে শিক্ষার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু এই স্কুলগুলির মান বেসরকারি বিদ্যালয়ের চেয়ে যথেষ্ট নিম্নমানের। ‘ফেয়ার হাউসিং অ্যাক্ট’ আছে কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় কোনও এলাকায় কৃষ্ণাঙ্গদের বাড়ি থাকলে সেখানে স্থাবর সম্পত্তির মূল্য কমে যায়। ব্যাঙ্ক ও ব্যবসায়ীরা চায় না কোনও ভাল এলাকায় তাঁরা বাড়ি করুক। ব্যাঙ্ক নানা অজুহাতে ঋণ দিতে অস্বীকার করে। এই কারণে পয়সা থাকলেও তাঁদের মহল্লাতে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। সেখানে অসুস্থ পরিবেশ, প্রবল দূষণ, নাগরিক পরিষেবা ক্ষীণ, নেশাড়ু ও চোরাচালানকারীদের স্বর্গরাজ্য। কোভিড মহামারিতে ট্রাম্পের হঠকারী মনোভাবের জন্য কৃষ্ণাঙ্গদের সবচেয়ে বেশি খেসারত দিতে হয়েছে। সাদা মানুষদের চেয়ে তাঁদের অন্তত দ্বিগুন মারা গেছেন।

বিশ্বের ‘উৎকৃষ্টতম’ গণতন্ত্রের থেকে সবচেয়ে জনবহুল গণতন্ত্র কী শিক্ষা নিতে পারে? ২০১৫ সালে মহম্মদ আখলাখ নামক একজন মানুষ ফ্রিজে ‘গোমাংস’ রাখার অপরাধে খুন হন। পরবর্তীকালে যতটুকু তদন্ত হয়েছে তাতে আদৌ সেটি গোমাংস ছিল কিনা তা প্রমাণিত হয়নি। গ্রামের বহু মানুষ এই হত্যা প্রত্যক্ষ করেছেন, হত্যাকারীরাও অঞ্চলের পরিচিত লোক কিন্তু কেউ গ্রেফতার হয়নি। উলটে তদন্তকারী অফিসার সুবোধ সিং বুলন্দশাহরে দক্ষিণপন্থী মব দ্বারা প্রহৃত হয়ে মারা যান। অভিযোগ, আক্রমণকারীদের মধ্যে আখলাকের হত্যার চার্জশিটে অকুতোভয় ঐ অফিসার যাঁদের নাম উল্লেখ করেছিলেন তাঁরা ছিলেন। এরপরে অগুন্তি সংখ্যালঘু মানুষ ধর্মান্ধ জনতার হাতে প্রাণ দিয়েছেন। কেউ গ্রেফতার হয়নি, কারও বিচারও হয়নি। উলটে হত্যাকারীদের মালা পরিয়ে বিজয় মিছিল হয়েছে। 

আমেরিকা কিন্তু বছর ঘোরার আগেই শভিনকে জেলে পাঠিয়ে দিল। এনকাউন্টার হত্যা বস্তার, দান্তেওয়াড়ায় প্রতিনিয়ত হচ্ছে। কোন থানা হিসাব রেখেছে? বিনা ওয়ারেন্টে ঘরবাড়ি তল্লাশি তো সামান্য ব্যাপার, যত্রতত্র গ্রেফতার হচ্ছে। পরিবার, পরিজনদের না জানিয়ে বেঙ্গালুরু থেকে দিল্লি উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, উদাহরণ দিশা রবি। তবুও বলব, গণতন্ত্র চলছে? উত্তর হাওয়ায় ভাসছে! 


Saturday, 26 June 2021

জরুরি অবস্থার ৪৬তম বর্ষপূর্তি

প্রধানমন্ত্রীর ট্যুইট

'এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে'

শোভনলাল চক্রবর্তী


১৯৭৫ সালের ২৫ জুন মধ্যরাতের কয়েক মিনিট আগে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফাকুরুদ্দিন আলি আহমেদ সংবিধানের ৩৫২ নম্বর ধারায় সারা ভারত জুড়ে জ্রুরি অবস্থা'র ঘোষণা করেন। এই ধারা প্রয়োগের মূল কারিগর ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচর। শ্রীমতী গান্ধীর সরকার জানায় যে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ (১৯৭১), খরা (১৯৭২) এবং বিশ্ব জুড়ে গড়ে ওঠা তেলের সংকটের (১৯৭৩) কারণে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি, ফলে ভারতের অর্থনীতি মন্দার মুখে। এই অবস্থায় দেশ জুড়ে চলতে থাকা বিরোধীদের প্রতিবাদ, ধর্মঘট, হরতাল সরকারের কাজকে আরও বিলম্বিত করছে। দেশের ভিতরে চলতে থাকা এই অস্থিরতার কারণে শত্রুপক্ষ যে কোনও সময়ে আক্রমণ করে বসতে পারে। 

ইন্দিরা গান্ধীর অনুচরদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায়। পেশায় তিনি ছিলে দুঁদে আইনজীবী। তিনি এবং ইন্দিরা পুত্র সঞ্জয় গান্ধী মিলে এই মর্মে একটি চিঠির বয়ান তৈরি করেন, যেখানে তাঁরা পূর্বে উল্লিখিত কারণগুলি দর্শিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন জানান যে এমতাবস্থায় একটি 'অভ্যন্তরীণ ইমারজেন্সি' ব্যতীত ভারত এক চরম বিপদের মুখে পড়তে পারে। সিদ্ধার্থশংকর আইন বাঁচিয়ে এমন একটি বয়ান তৈরি করেন, যা ছিল 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' গোত্রের। ফলে, রাষ্ট্রপতি তাতে অসম্মত হতে পারেননি। 

আজ আমরা সবাই জানি যে এসবই ছিল সরকারের তরফে বিরোধীদের দমন করার অজুহাত। ইন্দিরা গান্ধীই ভারতের প্রথম স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী যিনি দেখিয়েছেন কীভাবে সংবিধান দিয়েই সংবিধানের টুঁটি চেপে ধরা যায়। জরুরি অবস্থা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ইন্দিরা হয়ে ওঠেন সর্বেসর্বা, সংসদ পরিণত হয় তাঁর হাতের পুতুলে। সেখান থেকে নেওয়া হতে থাকে একের পর অসাংবিধানিক সিদ্ধান্ত। ইন্দিরা সমস্ত নির্বাচন বাতিল বলে ঘোষণা করেন, কেড়ে নেন নাগরিক সমাজের সমস্ত স্বাধীনতা, সমস্ত বিরোধী নেতাদের গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানো হয়, সংবাদপত্রের ওপর নেমে আসে সেন্সরশিপ, চলতে থাকে ব্যাপক হারে মানবাধিকার হরণের ঘটনা। 

ইন্দিরা পুত্র সঞ্জয় গান্ধী হয়ে ওঠেন মূর্তিমান দানব। তিনি হিটলারের কায়দায় বস্তিতে বস্তিতে মহিলাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চালাতে থাকেন গণ বন্ধ্যাত্বকরণ কর্মসূচি, পুরুষদের জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্বিজকরণ করা হয়। শুরু হয় দিল্লির আশপাশ থেকে বস্তি উচ্ছেদের কাজ। ভারতের স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাসে ইমার্জেন্সি এক কলঙ্কিত অধ্যায়, যার অবশেষে অবসান ঘটে ১৯৭৭ সালের ২১ মার্চ তারিখে। এরপর, নির্বাচনে স্বাভাবিকভাবেই পরাজিত হন ইন্দিরা গান্ধী। মানুষ বিপুল রায়ের মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে ইমার্জেন্সি তাঁদের কতটা অপছন্দের ছিল। পরবর্তীকালে ইন্দিরা জনসমক্ষে স্বীকার করেন যে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল ইমার্জেন্সি। 

নাগরিক সমাজের সকল অধিকার হরণ করে নেওয়া সেই কুখ্যাত ইমার্জেন্সির ৪৬তম বর্ষপূর্তিতে একটি ট্যুইট করেছেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ওই টুইটে তিনি লিখেছেন, 'ইমার্জেন্সির কালো দিনগুলির কথা কোনও দিনই ভোলা সম্ভব নয়।' ঠিক কথা। কিন্তু এ কথাও কি ঠিক নয় যে মোদিজী এবং তাঁর সরকার আমাদের প্রতিদিন ইমার্জেন্সির কথা নতুন করে স্মরণ করতে সাহায্য করছেন তাঁদের কাজের মাধ্যমে? প্রধানমন্ত্রী ওই টুইটে আরও লিখেছেন, '১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭-এর মধ্যে আমরা দেখেছি কীভাবে এক একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর আঘাত নেমে এসেছে। আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি যে ভারতের গণতান্ত্রিক উদ্দীপনা রক্ষা করার জন্য এবং ভারতের সংবিধানের আবশ্যকতা রক্ষা করার জন্য আমরা সব কিছু করব।' মোদিজীর এই ট্যুইটের প্রেক্ষিতে মনে পড়ছে, 'এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে।' 'আমরা সব কিছু করব' বলতে মোদিজী স্মরণাতীত অতীতে ঠিক কী কী করেছেন একবার দেখা যাক। 

তিনি এবং তাঁর সরকার ধরে ধরে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা ধ্বংস করেছেন। বিচারালয়ের নিরপেক্ষতা তলানিতে এসে ঠেকে যখন আজ থেকে আড়াই বছর আগে সুপ্রিম কোর্টের চারজন শীর্ষ বিচারপতি সাংবাদিক সম্মেলন করে জানান যে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সংবেদনশীল মামলাগুলিকে তাঁর পছন্দের বেঞ্চকে প্রদান করেছেন, যা গুরুতর বেনিয়ম। তাঁরা সেদিন যা বলেছিলেন, তা পরবর্তী সময়ে রাম মন্দির রায়ে প্রমাণিত হয়। রাম মন্দির রায় ঘোষণার পর সেই বিচারপতিকে পুরস্কার স্বরূপ শাসক দলের এমপি করে রাজ্যসভায় পাঠানো হয়। এতে বিচারালয়ের নিরপেক্ষতার যে অন্তর্জলী যাত্রা ঘটে তা বলাই বাহুল্য। 

আজ থেকে দেড় বছর আগে দিল্লির বুকে কিছু গরিব মুসলমান মহিলা জোট বাঁধেন এবং তাঁরা সোচ্চার হন নয়া নাগরিক বিলের বিরুদ্ধে। বিলটিকে সংবিধান বিরোধী আখ্যা দিয়ে তাঁরা বলেন যে এই বিল মানুষকে জাতি ও ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত করছে যা মেনে নেওয়া অসম্ভব। তাঁদের সেই প্রতিবাদে কান দেয়নি সরকার, উল্টে তাঁদের কপালে জোটে দেশদ্রোহীর তকমা। বিভিন্ন সাজানো মামলায় সমাজ কর্মীদের গ্রেফতার করা বর্তমান সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি। বহু বয়স্ক, হেঁটে চলে ফিরে বেড়াতে অক্ষম সমাজ কর্মীদের জেলবন্দী করে তাঁদের সমস্ত নাগরিক ও সাংবিধানিক অধিকার হরণ করে এক অদ্ভুত আনন্দ উপভোগ করে বর্তমান সরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের উপর লাঠি চালাতে, তাঁদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার অভিযোগ এনে, বিরোধীদের মুখ থেকে টুঁ শব্দ বেরলে তার গলা টিপে ধরায় যে সরকার সিদ্ধহস্ত, তারাই পারবে বটে গণতান্ত্রিক উদ্দীপনাকে রক্ষা করতে! 

আজ প্রায় এক বছরের কাছাকাছি (৩২০ দিন) কৃষকরা বসে রয়েছেন দিল্লির উপকণ্ঠে। এত বড় কৃষি বিক্ষোভ ভারত আগে কখনও দেখেনি। কিন্তু সেই কৃষকদের প্রতি সরকারের ভূমিকা লৌহ প্রশাসকের। কৃষকদের দাবি খুব স্পষ্ট- তিনটি কৃষি বিল প্রত্যাহার করে নিতে হবে। এই বিলে ভারতীয় কৃষকদের এক কথায় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে কর্পোরেট পুঁজির হাতে। এই বিলগুলি যে ভাবে সংসদে প্রায় পেছনের দরজা দিয়ে পাস করা হয় তা আমাদের সকলের জানা। সংবিধানের সাংবিধানিকতা রক্ষা করা ও নাগরিক সমাজের কথা কানে তোলার অভ্যাস যাদের নেই, তাদের কি ইমার্জেন্সি নিয়ে ট্যুইট করা সাজে? 

পরিবেশকর্মী দিশা রবিকে যখন টুলকিট কাণ্ডে আবার সেই দেশদ্রোহীতার কারণে গ্রেফতার করে তিহার জেলে নিক্ষেপ করা হয়, তখন দিশার জামিন দিতে গিয়ে বিচারপতি বলেছিলেন, 'দিশার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ২৬ জানুয়ারি (২০২১) তারিখে দিল্লি জুড়ে যে বিক্ষোভ হয়েছে তার সামান্যতম সংযোগ পুলিশ আমাকে দর্শাতে পারেনি। এই গ্রেফতার সম্পূর্ণ অবৈধ।' পুলিশ আসলে এই সব গ্রেফতারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হুকুমে, সেখানে বসে আছেন গণতন্ত্র ও সংবিধানের একনিষ্ঠ পূজারী অমিত শাহ, থুড়ি, শাহেনশাহ! আজ থেকে নয় মাস আগে বিচারপতি মদন লকুর সাবধান করে বলেছিলেন, কীভাবে সরকার বিভিন্ন অছিলায় সোশ্যাল মিডিয়ার পায়ে বেড়ি পরিয়ে আসলে চাইছে গণতন্ত্রের কন্ঠরোধ করতে। তাঁর সেই কথা আজ অক্ষরে অক্ষরে ফলতে চলেছে। সেই কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টার এক জ্বলন্ত উদাহরণ সাংবাদিক সিদ্দিকী কাপ্পান। যাঁকে গত অক্টোবরে আটক করা হয় যখন তিনি দিল্লি থেকে উত্তরপ্রদেশে এক দলিত মেয়েকে ধর্ষণ করে হত্যা করার একটি খবর কভার করতে যাচ্ছিলেন। যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ ওই সাংবাদিককে মথুরা জেলে খাটের সঙ্গে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখে দেয়। তাঁর পরিবার অনেক কষ্টে করোনায় আক্রান্ত, মল-মূত্রের মধ্যে পড়ে থাকা ওই সাংবাদিককে দিল্লির এআইআইএমএস-এ স্থানান্তরিত করার আদেশ পায় আদালত থেকে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে কোর্ট কাপ্পানের বিরুদ্ধে আনা শান্তিভঙ্গের অপরাধ সম্পূর্ণ অমূলক বলে ঘোষণা করে। 

এই কিছুদিন আগে মাত্র নাগরিক বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অজুহাতে যে তিনজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে আটক করে তিহার জেলে রেখে দেওয়া হয়েছিল, তাদের জামিনের বিরুদ্ধে চলতে থাকা মামলায় বিচারপতি দিল্লি পুলিশকে জানান যে, 'ওই তিনজনের জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করে, দিল্লি পুলিশ এবং তারা যে উচ্চতর কর্তৃপক্ষের আদেশ পালন করছে, উভয়ই নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ বিচারের সমস্ত সীমারেখা লঙ্ঘন করেছে, যা অত্যন্ত লজ্জার ও চিন্তা উদ্রেককারী।' 

কোনও সন্দেহ নেই, কেন সুইডেনের ভি-ডেম ইনস্টিটিউট তাঁদের সমীক্ষায় জানিয়েছে যে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারত আজ এক  নির্বাচনী স্বৈরাচারে পরিণত হয়েছে। ভারতবাসী হিসেবে আমরা আজও এক অঘোষিত ইমার্জেন্সির মধ্যে রয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর ট্যুইট আদতে সেই কথাই স্মরণ করালো।


Thursday, 24 June 2021

বাংলা ভাগ?

আসলে ঠিক কী চাইছে ওরা?

প্রবুদ্ধ বাগচী


মণিভূষণ ভট্টাচার্য তাঁর এক কবিতায় বিদ্রূপ করে লিখেছিলেন, কেন্দ্রের সঙ্গে পরিধি, পরিধির সঙ্গে ব্যাস ও ব্যাসার্ধের সূক্ষ্ম যোগ থাকে আর এই যোগাযোগগুলি কখন কীভাবে একটার সঙ্গে একটা মিলেমিশে কঠিন এক ধাঁধা হয়ে যায় সে এক রহস্য। বহুদিন আগে পড়া এই কবিতা মনে এল গত কয়েকদিন ধরে বাংলা বাজারে ভেসে বেড়ানো কিছু কথাবার্তাকে সামনে রেখে। সম্প্রতি বিজেপির এক সাংসদ উত্তরবঙ্গকে পৃথক কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল করার দাবি জানিয়ে শিরোনামে এসেছেন। অবশ্য এই বক্তব্যকে তাঁর দল সমর্থন করে না বলে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ আপাতত জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁর কথা জীবন্ত আলোচনার চর্চায় থাকতে থাকতেই বাঁকুড়া জেলার এক সাংসদ আবার দাবি করে বসেছেন জঙ্গলমহলকেও তিনি আলাদা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হিসেবে দেখতে চান। 

সদ্য নির্বাচন হয়ে যাওয়া এই রাজ্যে আচমকা এমন দাবি কেন উঠে আসছে, তা এক গভীর কৌতূহলের বিষয়। কারণ, বিগত রাজ্য নির্বাচনে বিজেপির পক্ষে এমন কোনও দাবি ওঠেনি। বরং তারা গোটা রাজ্যটাকেই তাদের মতো করে ‘সোনার বাংলা’ বানাতে চায়- এই ছিল তাদের সোচ্চার প্রতিশ্রুতি। 

কেউ কেউ এমন কথা বলতেই পারেন- ভোটে গো-হারা হেরে যাওয়ার পর রাজ্যের এবং কেন্দ্রীয় বিজেপি দলটার এক ধরনের পাগল-পাগল দশা হয়েছে। তারা কীভাবে এই মস্ত পরাজয়কে সামলাবে তার কূল কিনারা পাচ্ছে না। ফল বেরনোর পরের দিন থেকেই তার নানা রকম উদাহরণ আমরা দেখতে পেয়েছি। কখনও কেন্দ্রীয় দল পাঠিয়ে নির্বাচন-উত্তর ‘সন্ত্রাস’ খুঁজে বেড়ানো, আদালতে মামলা ঠোকা, রাজ্যে তাদের বিশ্বস্ত সহচর রাজ্যপালকে দিয়ে নানা রকম বিবৃতি দেওয়ানো ও এলাকায় এলাকায় ঘুরতে পাঠানো থেকে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিবের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন ‘চার্জশিট’ তৈরি- সবই এসবের মধ্যে পড়ে। বুঝতে অসুবিধে হয় না, সাম্প্রতিক কালে এমন তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক পরাজয় তারা হজম করতে পারছে না। তার ওপরে জাতীয় রাজনীতিতে মোদী-শাহ জুটি যে অপ্রতিরোধ্য- এই মিথ ভেঙে যাওয়া তাদের দলীয় অস্তিত্বের পক্ষে সুবিশাল এক চ্যালেঞ্জ। এর সঙ্গে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা পড়েছে রাজ্য বিজেপিতে ঘনিয়ে ওঠা বিদ্রোহে। অনেকেই দল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, অনেকে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর প্রকাশ্যেই অনাস্থা প্রকাশ করেছেন। এই অবস্থায় রাজ্যে দলের ভবিষ্যৎ কিছুটা হলেও জিজ্ঞাসার মুখে। এইসবই সত্যি। কিন্তু উত্তরবঙ্গ ও জঙ্গলমহল নিয়ে এই বিচিত্র দাবিকে এতটা সহজ ব্যাখায় মেনে নিতে কিছু খটকা থাকছে। 

সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে কর্পোরেট-আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জমি আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের নেতৃত্বে। পরে তৃণমূল নেতৃত্ব অনেকটাই সেই ক্ষোভ নিজেদের পক্ষে এনে নিজেদের রাজনৈতিক শক্তিকে সংহত করে ও পরিণামে বাম সরকারকে আক্ষরিক অর্থেই উৎপাটিত করে। পরের দশ বছরে বিধানসভায় যথেষ্ট শক্তি থাকলেও সরকার এমন কিছু করেনি যা থেকে তাদের কর্পোরেট–বান্ধব চেহারা প্রকাশ্যে আসে। ভাঙড়ে যে জমি আন্দোলন তা মূলত সরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানির জমি নেওয়াকে কেন্দ্র করে, সেখানে কোনও কর্পোরেট-পুঁজির স্বার্থ ছিল না। কার্যত গত দশ বছরে সরকারি কর্মসূচি মূলত জনকল্যাণমুখি নানা প্রকল্পে সীমাবদ্ধ রয়েছে। রাজনৈতিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কর্পোরেটকে মাথায় তুলে নাচার মতো কোনও কাজ আমরা দেখিনি। বলা বাহুল্য, এর ফলে তৃণমূলের একটা জোরালো গণভিত্তি তৈরি হয়েছিল যা এই ভোটে তাদের ডিভিডেন্ড দিয়েছে। বিজেপির আগ্রাসী রাজনীতিকে সে  কল্যাণকামী কাজ দিয়ে প্রতিহত করতে পেরেছে। 

কিন্তু ‘সোনার বাংলা’র আড়ালে ভিন্ন কর্মসূচি ছিল বিজেপির। বাংলার বন্দর, জমি, জঙ্গল নির্বিচারে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া ছিল তাদের গোপন এজেন্ডা। তারা ভেবেছিল দুশো আসন জিতে সরকারে এলে সরকারি ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে এই অবাধ লুন্ঠনের ছাড়পত্র হাতে ধরিয়ে দিতে পারবে নিজেদের স্বজন-পুঁজিকে। ঠিক যেমন তারা করেছে গুজরাতে, মধ্যপ্রদেশে, উত্তরপ্রদেশে, উত্তরাখন্ডে, হরিয়ানায়। আর এই সূত্রেই যে একমুখি অসাম্যের উন্নয়ন, তাকেই আসলে বলা হবে ‘সোনার বাংলা’। তাদের বাড়া ভাতে ছাই পড়েছে। কিন্তু যারা কর্পোরেটের নির্ভরযোগ্য প্রতিনিধি তাদের আশাবাদের অভাব নেই। তাদের হাল ছাড়লে চলে না, তাদের যে কোনও উপায়ে বেড়ে উঠতে হয়। মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত বক্তৃতার কথা- ‘রবারিজ অফ সয়েল’- যেখানে তিনি বলছেন লোভের তাড়নায় কীভাবে সদ্য মাথা-তোলা তরুণ ঘাস মাড়িয়ে মাড়িয়ে এগিয়ে চলে ভূমি-দস্যুরা, নিষ্ঠুর, নির্লিপ্ত, একবগগা।

সদ্য ভেসে-বেড়ানো এই দুই কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের প্রস্তাবে আসলে তারই ইশারা। খেয়াল করা দরকার, উত্তরবঙ্গ ও জঙ্গলমহল এমন দুটো অঞ্চল যেখানে বিজেপি প্রথমেই তাদের প্রভাব বাড়িয়ে নিতে পেরেছিল। যার ছাপ পড়েছিল লোকসভা নির্বাচনে (২০১৯)। সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা ভোটেও উত্তরবঙ্গে তাদের তেমন ক্ষয় হয়নি, কিছুটা ফাটল ধরেছে জঙ্গলমহলে। যদিও দল বদল করে বিজেপিতে আসার পরেই আজকে রাজ্যের বিরোধী দল নেতা বিজেপিকে জঙ্গলমহলের সব আসন উপহার দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শুধু আসন জেতা নয়, তার সঙ্গে এলাকার দখল নেওয়ার বিষয়ও যে একেবারে ছিল না, তা কি এতটা নিশ্চিত হয়ে আমরা বলতে পারি? পাশাপাশি, আজ যদি কেউ ভাবেন রাজ্যের বিধানসভায় জয়ী দলকে দুর্বল করার রাজনৈতিক লক্ষ্যে এই প্রস্তাবনা, তাও ঠিক নয়। কারণ, তৃণমূল যে সব জেলা থেকে বিপুল আসনে জিতে এসেছে তার অনেকটাই উত্তরবঙ্গ বা জঙ্গলমহলে নয়। ফলে, ওই অঞ্চল দুটি তর্কের খাতিরেও রাজ্য থেকে আলাদা হলে আসন সংখ্যায় বেশি ক্ষতি বিজেপির। তাহলে ঘটনাটা কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে?

এখানে স্পষ্ট দুটো বিষয় আছে। সেই মনমোহন সিংহের আমল থেকেই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দিকে দেশের কর্পোরেট লবির একটা নজর আছে। যাকে আদর করে নাম দেওয়া হয়েছিল ‘লুক ইস্ট’ নীতি। ভৌগোলিকভাবে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের তুলনায় পূর্বে শিল্পের পরিসর অনেক দিন ধরেই কম। অথচ ঠিক এই মুহূর্তে বড় মাপের ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প বিপুল ভাবে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে, পরিস্থিতি মোটেও তেমন নয়। কিন্তু শিল্পের পরিবর্তে ট্রেডিং করার জন্য উত্তরবঙ্গ একটা বিরাট সম্ভাবনা। উত্তরবঙ্গের সব থেকে বড় শহর শিলিগুড়ি প্রায় একটা কসমোপলিটান চরিত্র নিয়েছে, যার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল। একে কেন্দ্র করে বিরাট একটা ট্রেডিং হাব তৈরি করার সুযোগ আছে। সুদূর পূর্বের সিঙ্গাপুর বা হংকং'এর মডেল এখানে অনায়াসে অনুসরণ করা যায়। ওই দুই জায়গাতেই শিল্প নেই কিন্তু ট্রেডিং'এর মস্ত কেন্দ্র হওয়ায় তাদের একটা আন্তর্জাতিক চকচকে চেহারা আছে। আর এই কাজ করতে গেলে জমি লাগবে, লাগবে আরও নানা পরিকাঠামো- যা গড়ে দেওয়ার জন্য লাগবে তেমনই আগ্রাসী একটা প্রশাসন। তৃণমূল সরকার অবশ্যই এই বিতর্কে নিজেদের জড়াতে চাইবে না। তাই চাই কেন্দ্রীয় শাসন। সুবিধে হল, এতে নির্বাচিত বিধানসভা নেই, তাই রাজনৈতিক বিরোধ এড়িয়ে যাওয়া যায়। 

একই কথা প্রযোজ্য জঙ্গলমহলের ক্ষেত্রেও। সেখানে এক বিপুল জঙ্গল তার খনিজ সম্পদ সহ এখনও অরক্ষিত আছে। সেই জমি জঙ্গল আর সম্পদের দখল নিতে গেলে সব থেকে আগে দরকার কর্পোরেট-বান্ধব প্রশাসন। কারণ, ওড়িশার পস্কো বা নিয়মগিরিতে বক্সাইট পাহাড় দখলের ক্ষেত্রে মস্ত সহায় ছিল স্থানীয় সরকার। গণআন্দোলনের চাপে ওইসব প্রকল্প বাধা পেয়েছে বা পরিত্যক্ত হয়েছে- সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু প্রাথমিকভাবে সরকারি সাহায্য চাই, চাই তার সামনে একটা উন্নয়নের রঙিন পতাকা। প্রস্তাবিত জঙ্গলমহল বা উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রেও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের প্রভুরা খুব সহজে সেই উন্নয়নের ফুলঝুরি বিলোবেন। মনে রাখতে হবে, দুই এলাকাতেই অনেক প্রান্তীয় মানুষ থাকেন যাদের কাছে সরকারি প্রকল্প পৌঁছলেও তা হয়তো যথেষ্ট নয়। ফলে, আগামী উন্নয়নের জন্য তাঁদের সামনে নানা রঙের গাজর ঝোলানো তুলনায় সহজ। ফলে সম্ভাবনা অপার। 

অবশ্য কেউ বলতেই পারেন, কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হয়ে যদি ‘উন্নয়ন’ হয় তাতে আপত্তি কী? আপত্তি নেই। কিন্তু এই ধরনের কর্পোরেট-নির্ভর উন্নয়ন আসলে যে বৈষম্য বাড়িয়ে দেয়, গত তিরিশ বছরের নিও-লিবারালবাবুদের কাজেকর্মে এখনও কি আমরা বুঝে নিতে পারিনি? টাটার গাড়ি কারখানা হলে স্থানীয় মানুষ কী করবেন- এই প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছিল, তারা এলাকায় চায়ের দোকান, ক্যান্টিন করবেন, প্রকল্পের পাহারাদারের কাজ করবেন, মহিলারা কারখানার বাবুদের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করবেন। তিন ফসলি জমির মালিক থেকে দারোয়ান যদি উন্নয়ন হয়, তাহলে অবশ্য অন্য কথা। সিঙ্গাপুরে বা হংকং'এর ওপরটা খুব ঝলমলে- তার হোটেল, বার, ম্যাসাজ পার্লার, সেক্স শপ এইসব নিয়ে। কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের মানবিক উন্নয়ন কতটা হয়েছে? যেটুকু ক্ষীর তা চলে যায় কর্পোরেট দানবের পকেটে। 

আরেকটা কথা এখানে গভীরভাবে ভেবে দেখার আছে। ইতিপূর্বে বিভিন্ন জাতিসত্তা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য নিজেরা আলাদা রাজ্য দাবি করেছে। গোর্খাল্যান্ড থেকে কামতাপুরী এইসব তার মধ্যে পড়ে। এইসব দাবিকে বিজেপি নানা সময় তোল্লাই দিয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থে। দার্জিলিং'এর বিজেপি সাংসদ এক সময় গোর্খাল্যান্ড সমর্থন করে ভোটে জিতেছিলেন। এবারের দাবিগুলির সঙ্গে কিন্তু আলাদা রাজ্যের দাবি নেই। দাবিটা পৃথক কেন্দ্রীয় শাসনাধীন এলাকার। অর্থাৎ, আলাদা রাজ্য হলে সেখানকার রাজনীতি কী হবে, কতটা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকবে, তার ঝুঁকি নেওয়ার আর সময় নেই। চাই কেন্দ্রীয় শাসন। 

রাজ্যে বিজেপির পরাজয় আসলে দেশের শক্তিশালী কর্পোরেট লবির বাংলা বিজয়ের রথকেও আটকে দিয়েছে। কিন্তু লোভ, মুনাফা এগুলো তো আসলে কোনও বাধা মানতে চায় না- সে কেবলই হাত বাড়াতে চায় নিত্যনতুন এলাকায়, তার প্রকাণ্ড জিহ্বা দিয়ে লেহন করতে চায় সম্পদের স্বাদ। তাই আজ জনপ্রতিনিধির মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে তাদের সেই অবদমিত আকাঙ্ক্ষার লেলিহান শিখা। 

হয়তো খুব হাল্কাভাবে এগুলোকে না নেওয়াই ভাল।    


Tuesday, 22 June 2021

জি-৭ রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈঠক

ভ্যাকসিন প্রস্তাব

পর্বতের মূষিক প্রসব

শোভনলাল চক্রবর্তী


নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জী এবং এস্থার ডুফলো 'গার্ডিয়ান' পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে সম্প্রতি মত প্রকাশ করে জানান যে, বিশ্ব জুড়ে চলতে থাকা জলবায়ুর সংকটকে অতিক্রম করার জন্য সবার আগে দরকার কোভিডের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বব্যাপী গণটিকাকরণ। ওই প্রবন্ধে তাঁরা স্পষ্ট করে বলেন যে, ধনী দেশগুলি যদি গরিব দেশগুলোকে টিকাকরণে সাহায্য করতে এগিয়ে না আসে, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ধনী দেশগুলির জেহাদ নেহাতই কথার কথা হয়ে থেকে যাবে। 

এই বছরের শেষে বিশ্বের ৪০ শতাংশ এবং বাকি ৬০ শতাংশ নাগরিককে ২০২২'এর প্রথম ছয় মাসের মধ্যে টিকাকরণ করতে খরচ পড়বে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। টাকার পরিমাণটি এমন কিছু বড় নয়। কারণ, ভুলে গেলে চলবে না, আমেরিকার সামরিক খাতে বার্ষিক বাজেট ১৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অতিমারির শুরুতে সবাই মিলে গলা মিলিয়ে যেমন 'আমরা করব জয়' বলছিলেন, সেই তালের আচমকা ছন্দপতন ঘটল বাজারে টিকা এসে যাওয়ার পর। তখন সবাই মিলে করোনা যুদ্ধ লড়ার প্রতিশ্রুতি ভুলে, যার-যার তার-তার নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে উঠল। এর ফল হল এই যে, ধনী দেশগুলি যাদের জনসংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ, তারা সবাই মিলে মোট উৎপাদিত টিকার ৫০ শতাংশ কিনে নিল। এদিকে গরিব দেশগুলোতে যেখানে ২ বিলিয়ন টিকা লাগবে সেখানে জুটল মাত্র ৮০ মিলিয়ন। 

অতিমারির বিরুদ্ধে লড়তে গেলে সবার টিকা লাগবে- এ ব্যাপারে কারওর দ্বিমত নেই। ধনী দেশগুলি এগিয়ে এসে যদি গরিব দেশগুলির পাশে না দাঁড়ায়, তবে সার্বিক টিকাকরণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। টিকাকরণ প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ না করতে পারলে ভাইরাস তার রূপ বদলে এমন একটি গঠনতন্ত্র তৈরি করতে পারে যখন এই টিকায় আর কাজ হবে না। এমন একটা প্রেক্ষাপটে এবারে গ্রেট ব্রিটেনে অনুষ্ঠিত জি-৭'এর শীর্ষ বৈঠকের দিকে অনেকে নজর রেখেছিলেন। কিন্তু হতাশ করল ওই বৈঠক। সাতটি ধনী দেশের ওই সংযুক্ত মঞ্চ থেকে গরিব দেশগুলোকে ১ বিলিয়ন টিকা দেওয়া হবে এই ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু স্পষ্টতই এই ঘোষণায় না আছে কোভিডের বিরুদ্ধে লড়বার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, না আছে টিকাকরণ প্রক্রিয়ায় গতি আনার কোনও প্রয়াস। দেখাই যাচ্ছে, পশ্চিমের নেতারা কোভিড মোকাবিলায় এখনও নিজেদের মানসিকতাকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারেননি। যদি গড়ে তুলতে পারতেন, তবে শুধু ১ বিলিয়ন টিকা দেওয়া হবে বলে তাঁরা থেমে থাকতেন না। কীভাবে এই টিকা বিতরণ হবে, কোন উপমহাদেশের কোন কোন দেশ এই টিকা পাবে- সে সমস্ত রূপরেখা আমরা দেখতে পেতাম। কিন্তু সে সবের কোনও খোঁজ আপাতত নেই। এই টিকাকরণ যে একটা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় হওয়া দরকার, তার কোনও ইঙ্গিত জি-৭ নেতৃত্ব দিতে পারেননি। সবচেয়ে বড় কথা, এই ১ বিলিয়ন টিকা প্রয়োজনের তুলনায় নস্যি। 

শোনা যাচ্ছে, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জো বিডেন এবং ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ব্যক্তিগত উদ্যোগে আরও ৬০০ মিলিয়ন টিকার বন্দোবস্ত করছেন। কিন্তু এ সবই সিন্ধুতে বিন্দু। বরিস জনসন সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছেন যে তাঁরা সারা দুনিয়াকে প্রায় ৮ বিলিয়ন টিকা দিতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু কীভাবে? কাকে দেবেন সেই টিকা? ধনী দেশগুলি যে বাড়তি টিকা মজুত করে রেখেছে তার কী হবে? এসবের উত্তর কেউ জানেন না। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে গরিব দেশগুলিতে টিকাদান নিশ্চয়ই একটি সঠিক পদক্ষেপ, কিন্তু পরিস্থিতির বিচারে এই পদক্ষেপ একেবারেই নাবালক। ভাইরাসকে হারাতে গেলে যে তৎপরতা এই মুহূর্তে প্রয়োজন তার ধারেকাছেও নেই জি-৭'এর উদ্যোগ। প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন বহুদিন ধরেই বলে আসছেন যে টিকা বৈষম্য দূর করতে গরিব দেশগুলির পাশে দাঁড়াতে হবে ধনী দেশগুলোকে। জি-৭'এর টিকা বিলির ঘোষণাকে তিনি বলেছেন, এ যেন ভিক্ষাপাত্রকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে রাস্তায় দুটো পয়সা ফেলা। ইউএন'এর তরফে বলা হয়েছে, আগামী দু' সপ্তাহের মধ্যে যদি আমাদের হাতে একটি 'কোভিড প্ল্যান' না এসে পৌঁছয় তবে এই অতিমারি এক অন্য বিপর্যয়ের চেহারা নেবে। 'কোভিড প্ল্যান' বলতে তাঁরা বোঝাতে চেয়েছেন একটি বিশ্বব্যাপী টিকাকরণের সূচি এবং সুনির্দিষ্ট সময়ের উল্লেখ, যে সময়ের মধ্যে ওই কর্মসূচি শেষ করা হবে। 

আশা করা গিয়েছিল, জি-৭ বৈঠক এই অভিমুখে কিছু পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু তেমন কিছুই হল না। যে অতিমারিতে ২১০টি দেশের ১৭৫ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত, বিশ্ব অর্থনীতি জেরবার, তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ জি-৭ শীর্ষ বৈঠক। টিকাকরণ কর্মসূচির সঙ্গে যে ধনসম্পদ এমন ভাবে যুক্ত হয়ে পড়বে তা কেউ কল্পনাতেও আনতে পারেননি। তাই এই মুহূর্তে দিশেহারা পরিস্থিতি, বিশেষ করে গরিব দেশগুলোতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, ইজরায়েল এবং বাহারিন টিকাকরণের দৌড়ে অন্যান্য দেশের তুলনায় বহু গুন এগিয়ে। এখনও পর্যন্ত বিশ্ব জুড়ে ২.২ বিলিয়ন মানুষকে টিকাকরণের আওতায় আনা গেছে। যেহেতু প্রতি ব্যক্তিকে এ ক্ষেত্রে দুটি করে টিকা দিতে হবে এবং পরবর্তীতে বুস্টার ডোজ দেওয়ার দরকার পড়তে পারে, সেই জন্য অক্সফামের মতে, এই অতিমারি শেষ করতে প্রয়োজন আরও ১১ বিলিয়ন ডোজের টিকা। শুধু যে এই টিকা উৎপাদন করলেই কাজ হবে তা নয়, যেটার সবচেয়ে আগে প্রয়োজন তা হল সমস্ত দেশে টিকার সুষম বন্টন। এই বন্টনের পেছনে একটি বড় অন্তরায় মেধাস্বত্ব সংক্রান্ত আইনকানুন। জি-৭ বৈঠকে মেধাস্বত্ব আইন অতিমারি পরিস্থিতিতে শিথিল করার আবেদন করেছেন মার্কিন ও ফরাসি রাষ্ট্রপতি। তাঁদের এই আবেদনে কোনও কাজ হয় কিনা সেটাই দেখার। 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী এই বৈঠকে অনলাইনে বক্তব্য রেখেছেন। তিনি অনেক কথা বলে আসলে কিছু না বলাকে প্রায় একটি শিল্পকলায় পরিণত করেছেন। সেই কলার এক ঝলক তাঁর বক্তব্যে আমরা দেখলাম। দেখলাম বলছি কারণ, শুনে কিছুই বুঝিনি। সংবাদে প্রকাশ, তিনি নাকি ওই বক্তৃতায় বলেছেন, ভারতের গণতান্ত্রিক ভিত্তির এমন জোর যে স্রেফ সেই জোরেই ভারত অতিমারি অতিক্রম করবে। প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্র সম্পর্কে বিশ্ববাসীর সামনে বলেছেন শুনে সেই ঢাকাই কুট্টির কথা মনে পড়ল, 'আস্তে কন কত্তা, ঘোড়ায় হাসব।'


Monday, 21 June 2021

অতিমারির প্রেক্ষিত

পরিবেশ ভাবনা: ভাবের ঘরে চুরি

মৃণাল মুখোপাধ্যায়

প্রীতম কংসবণিক
 



'পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন; মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।'

সম্প্রতি আমরা ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পেরিয়ে এলাম। ২০২১ সালে পরিবেশ দিবসের মূল ভাবনা হল: ‘বাস্তুতন্ত্রের পুনর্গঠন’। এবারের পরিবেশ দিবসের মুখ্য আয়োজক আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান। পৃথিবী জুড়ে মানুষ যখন এই আয়োজনে সামিল হতে চলেছে, আইপিসিসি (২০১৯)'এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ ভূ-ভাগ এবং ৬৬ শতাংশ সমুদ্র আজ মনুষ্য জাতির নেতিবাচক আগ্রাসনে বিপর্যস্ত। আনুমানিক ১০ লক্ষ প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি মূলত তাদের বসতি ধ্বংসের কারণে অবলুপ্তির দোরগোড়ায়। কোভিড-জনিত অতিমারির প্রেক্ষিতে বিশ্ব ব্যাঙ্কের (২০২১) গবেষণামূলক তথ্য অনুযায়ী, মানুষের সংক্রামক রোগের ৭৫ শতাংশ জুনোটিক, অর্থাৎ প্রাণী প্রজাতি থেকে আসা প্যাথোজেন। 
 
মানুষের নেতিবাচক ভূমিকায় জলবায়ু-পরিবর্তন, বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যহীনতা, অবৈধভাবে বন্যপ্রাণীকুলকে খাদ্য হিসেব ব্যবহার এবং বন ধ্বংসের কারণে মানুষ-বন্যপ্রাণীর অনাকাঙ্ক্ষিত আন্তঃক্রিয়া বৃদ্ধি এই বিপদের সম্ভাবনাকে বহুলাংশে বাড়িয়ে তুলেছে। অন্যদিকে বিপন্ন হচ্ছে জৈববৈচিত্র্য। এই সামগ্রিক প্রেক্ষিতে এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল ভাবনা তাই বিপন্ন ‘বাস্তুতন্ত্রের পুনর্গঠন’।       

জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ৫ ও ৬  জুন সুইডেন'এর রাজধানী স্টকহোমে ১৯৭২ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক মানব ও পরিবেশ সম্মেলন সংঘটিত হয়েছিল। জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৭৪ সাল থেকে ৫ জুন দিনটি বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। যে পরিবেশকে মানুষ সজ্ঞানে ও অজ্ঞানে বিপন্ন করেছে, তাকে রক্ষা করার দায় ও দায়িত্ব মানুষকেই নিতে হবে। অজ্ঞতা ও ঔদ্ধত্যের সঙ্গে আমরা আমাদের আবাসভূমিটিকেই বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছি। তার বিপ্রতীপে পরিবেশ দিবস উদযাপন হল মানবিক-পরিবেশ চেতনা জাগানোর এক প্রয়াস। এই পৃথিবী মানুষের সম্পত্তি নয়, বরং আমরা ভুলতে বসেছিলাম মানুষই এই পৃথিবীর একটা ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। কোভিড-১৯ জনিত অতিমারি আমাদের অন্ধকারমুখি স্পর্ধার জয়যাত্রার সামনে একটা প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিয়েছে। আমরা ছটফট করছি, কাতরাচ্ছি আমাদের তথাকথিত স্বাভাবিকতায় ফেরার জন্য। কিন্তু সেই স্বাভাবিকতায় সব কি স্বাভাবিক ছিল? ন্যায্য ছিল? ন্যায় ছিল? নীতি ছিল? সমান অধিকার ছিল? কেবল মানুষের নয়, জীবজগতের সকলের ছিল কি? অতিমারির কারণে গোটা পৃথিবী এখনও কোথাও পূর্ণ, কোথাও আংশিক তালাবন্দি। এই থমকে থাকা আসলে ফিরে দেখবার একটা সুযোগ। হয় আমরা এই অভিজ্ঞতা থেকে শিখব অথবা প্রজাতি হিসেবে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করব। 

আমাদের এই প্রিয় বসুন্ধরার বয়স প্রায় সাড়ে পাঁচশো বিলিয়নেরও কিছু বেশি। মানব প্রজাতিকে সে বাঁচিয়ে রেখেছে। সম্পদের জোগান দিয়েছে। সমৃদ্ধ করেছে। ডারউইনের যোগ্যতমের উদবর্তনের পথ ধরে অভিব্যক্তির প্রক্রিয়ায় মানুষ হয়ে উঠেছে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজাতি। সম্পদের উপর অধিকার স্থাপন, উদ্বৃত্ত সম্পদের কেন্দ্রীভবন, পরিবার-গোষ্ঠী থেকে রাষ্ট্রের উত্তরণ। আর উন্নয়নের নামে ‘রাষ্ট্রযন্ত্র’এর এক তাণ্ডব নৃত্য। কখনও অবাধে জ্বলে গিয়েছে লাতিন আমেরিকার অ্যামাজন, খনিজ সম্পদের লোভে সবুজ আফ্রিকা হয়েছে ধূসর। ভারতবর্ষে সেই কবে আমাদের মূল নিবাসী আদিবাসী রমণীরা হাতে হাত ধরে গাছকে জড়িয়ে রেখে বাঁচাতে চেয়েছেন বৃক্ষরাজি। পারেননি। উন্নয়নের নামে উজাড় হয়েছে মাইলের পর মাইল জঙ্গল, রুদ্ধ হয়েছে নর্মদার গতি, আর যমুনা নদী তো নিছকই একটি আবর্জনাময় নালা। আর যাকে এত ভক্তি করে পুজো করা হয়, সেই গঙ্গা হয়ে উঠেছে বহু নর্দমার সমষ্টি মাত্র। ভুলে গেলে হবে না, যখন কোভিড ছিল না তখনও সদ্য ফেলে আসা শীতে, সাংহাই কি দিল্লিতে বাতাস এমন দূষিত ছিল যে মানুষকে মুখোশে মুখ ঢাকতে হয়েছিল। 
 
পৃথিবীর ওজোন স্তরে দেখা দিয়েছে ক্ষত। ডানা মেলা স্পর্ধার উন্নয়নের সঙ্গে সমহারে বেড়েছে গ্রিন হাউজ গ্যাস, বৃদ্ধি পেয়েছে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা। একদিকে সুউচ্চ পর্বতের হিমবাহ গলে যাচ্ছে আর অন্যদিকে মেরুপ্রদেশের বরফ গলে চলেছে, ওপরে উঠে আসছে সমুদ্রের জলতল। বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান হয়ে মানুষ যখন দক্ষিণ মেরুর সমুদ্রতলে রেখে আসছে তার স্পর্ধিত বিজয় পতাকা, জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে এই আধিপত্যের সময়ও পৃথিবীর প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ নীরবে-নিভৃতে কাঁদছে। খাদ্য নেই, বস্ত্র নেই, বাসস্থান নেই, শিক্ষা নেই, চিকিৎসা নেই। এ এক অসাম্যের পৃথিবী। অথচ আমাদের সুস্থায়ী উন্নয়নের পথ ধরেই চলার কথা ছিল। এই 'পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য' করে রেখে যেতে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলাম আমরা। পারিনি। পরিবেশ রক্ষার ছদ্ম অভিনয়ই করে গিয়েছি। প্রতারণা করে গিয়েছি প্রকৃতির সঙ্গে।  

১৯৯২ সালে রিও বসুন্ধরা সম্মেলনে বিশ্ব পরিবেশ রক্ষার জন্য দ্য ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি)'এর মূল কাঠামোগত চুক্তিটি নির্মিত হয়। ১৯৯৫ সালের পর থেকে অংশগ্রহণকারী দেশগুলি প্রতি বছর পরিবেশ সংক্রান্ত নীতি নিরূপণ ও প্রয়োগের জন্য বাৎসরিক সভায় মিলিত হতে থাকে যা কনফারেন্স অফ পার্টিজ (সিওপি) নামে পরিচিত। ২০১৫ সাল অবধি ১৯৭টি দেশ ইউএনএফসিসিসি'এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই বাৎসরিক সভাগুলি ছাড়াও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৃহৎ কলেবরযোগ্য ‘বিশ্ব-পরিবেশ সম্মেলন’ ইতিমধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে। পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষার সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জগুলি ছিল সামগ্রিকভাবে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করা, প্রধানত কার্বন ডাই অক্সাইডের নির্গমন মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতাকে কমিয়ে আনা। সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা। অন্যদিকে ক্লোরিন ব্রোমিন জাতীয় গ্যাস নির্গমনের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ওজোন স্তরকে রক্ষা করা। আরেকটি উল্লেখযোগ্য অভিমুখ ছিল, ক্রমশ ভঙ্গুর ক্ষয়িষ্ণু জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করা। 

রিও সম্মেলনে গৃহীত এজেন্ডা-একুশ এবং ‘বায়ো ডাইভারসিটি ট্রিটি’র মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়েছিল জীববৈচিত্র্য রক্ষার রূপরেখা । ১৯৯৭ সালে জাপানের কিয়োটো শহরে রাষ্ট্রগুলি তাদের কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ন্ত্রণের মাত্রা কমানোর উদ্দেশ্যে একটি কাঠামোগত চুক্তি প্রস্তুত করে যা ‘কিয়োটো প্রোটোকল’ নামে পরিচিত। যদিও এই আইন কার্যকর হয় ২০০৫ সালে। এই কিয়োটো প্রোটোকলের লক্ষ্য ছিল ২০১২ সালের মধ্যে উন্নত দেশগুলি তাদের কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনের মাত্রাকে এমনভাবে হ্রাস করবে যা ১৯৯০ সালের কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নির্গমনের মাত্রার সমান হবে। উন্নয়নের গতি বজায় রেখে কার্বন-ডাই-অক্সাইড কমিয়ে আনার প্রযুক্তিগত কৌশলের নাম দেওয়া হয়েছিল 'দ্য ক্লিন ডেভলপমেন্ট মেকানিজম' বা সিডিএম। তারপর থেকে গঙ্গা, ভলগা, টেমস, হোয়াংহো বা মিসিসিপি দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। এই তাবৎ পৃথিবীর মানুষের মনে আশা জেগেছিল, হয়তো ইতিবাচক কিছু ঘটবে। পৃথিবীর সমস্ত পরাক্রমী রাষ্ট্রনেতা, বরিষ্ঠ বিজ্ঞানী, পরিবেশ রক্ষায় কাজ করা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সমূহ বারংবার মিলিত হয়েছে আন্তর্জাতিক পরিবেশ সম্মেলনে। আমরা পেরিয়ে এসেছি দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ (২০০২), ইন্দোনেশিয়ার বালি (২০০৭), কোপেনহেগেন (২০০৯) এবং প্যারিস কনফারেন্স (২০১৫)। এই সময় আইপিসিসি তাদের প্রতি বছরের গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন হিসেবে প্রকাশ করে চলেছে। 

বিপুল অর্থ খরচ করে এত সভা-সমিতি, এত নীতি নির্ধারণ বাস্তবে আদৌ ফলপ্রসূ হয়েছে কী? পিছন ফিরে দেখলে মনে হয়, এ যেন এক ভাবের ঘরে চুরি। ওইসিডি'এর ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯০ থেকে ২০১৮- এই দীর্ঘকাল ব্যাপী সময়ে দেখা যাচ্ছে, কেবলমাত্র ইউরোপের কয়েকটি দেশ ও রাশিয়া বাদ দিলে চীন-জাপান, ভারত-আমেরিকা সব দেশেই কার্বন-ডাই অক্সাইড'এর নির্গমনের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও সামগ্রিকভাবে গোটা বিশ্বে কার্বন-ডাই-অক্সাইড'এর নির্গমনের মাত্রার হার ঊর্ধ্বমুখি। আইপিসিসি'এর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিল্পায়ন শুরুর পর থেকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আশঙ্কা করা হচ্ছে যে ২০৩০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। উচ্চ তাপমাত্রায় পর্বতের হিমবাহ গলনে আর মেরুপ্রদেশের বরফ গলনে যে কেবল সমুদ্রের জলতল ওপরে উঠে আসছে তাই নয়, জনবসতি ধ্বংসের পাশাপাশি এই বরফে হাজার হাজার বছর ধরে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকা অসংখ্য মারণ ভাইরাস পুনরায় সজীব পোষক পেয়ে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, গভীর সমুদ্রতল থেকে খনিজ সম্পদ খনন ও উত্তোলনের ফলেও এমন অনেক ভাইরাস নতুন করে স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের সংস্পর্শে চলে আসতে পারে যা কোভিড-১৯ এর থেকেও অনেক বেশি চ্যলেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে মানবজাতিকে। এই প্রতিবেদনে আরও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই প্রবণতা বজায় থাকলে ভূমিক্ষয়, ঝড়-ঝঞ্ঝার প্রবণতা, শুষ্ক মরু অঞ্চলের বিস্তার এবং মরুঝড়ের প্রবণতাও বৃদ্ধি পাবে। গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধির কারণেই সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র ভেঙে পড়ার মুখে। 
 
ম্যানগ্রোভ অরণ্য ধ্বংস হচ্ছে ও হবে। সমুদ্রের কাছাকাছি বিপুল সংখ্যক জনবসতিগুলি ইতিমধ্যে বারংবার জলোচ্ছ্বাসে বিধ্বস্ত। পৃথিবীর ৫০ শতাংশের বেশি প্রাণী প্রজাতির স্বাভাবিক বসতি হল চিরহরিৎ বৃক্ষের অরণ্য। অথচ রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় মাইলের পর মাইল ধরে কেটে ফেলা হচ্ছে অ্যামাজনের জঙ্গল। ভারতীয় উপমহাদেশেও ধ্বংস হচ্ছে চিরহরিৎ অরণ্য। অরণ্যের এই সমস্ত প্রাণী প্রজাতির সঙ্গে মানুষ এবং অন্যান্য গৃহ পালিত প্রাণীদের নেতিবাচক মিথষ্ক্রিয়া হচ্ছে। ফলে, মানুষ যেমন প্রজাতি হিসেবে বিপদাপন্ন, তেমনি জৈব বৈচিত্র্য ধ্বংসের সম্মুখীন হচ্ছে। ডিপ্লোম্যট অনলাইন পত্রিকায় মে মাসে সদ্য প্রকাশিত নিবন্ধে গবেষক নিকোলাস মুলার এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, ২০৫০ সালের মধ্যেই সুন্দরবনের বেশির ভাগ অংশ বিলীন হবে সমুদ্রে এবং ভারতের জনসংখ্যার ২০ শতাংশ যারা সমুদ্র উপকুলের কাছে বাস করেন, তাঁদের জীবনহানির আশঙ্কা থাকবে। অন্যদিকে ভূমিক্ষয়, মিষ্টি জলের সংকট তৈরি হবে। নষ্ট হবে স্বাভাবিক উদ্ভিদ। ব্যাহত হবে শস্য উৎপাদন, যার অনিবার্যতা হল খাদ্য সংকট। স্থলজ ও জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীববৈচিত্র্য ইতিমধ্যেই সংকটপূর্ণ অবস্থায় আছে, যা আরও বিপন্নতার সম্মুখীন হবে। আমরা এক ভয়ঙ্করের বিপর্যয়ের মুখোমুখি।


Saturday, 19 June 2021

কাকস্য পরিবেদনা

কচ্ছপের দৌড় আয়ত্ত করুন

মালবিকা মিত্র


অবশেষে সিপিএম সংবাদপত্রে ঘোষণা করল, রাজ্যপাল ওভার স্টেপ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে এই কথাটা বহু আগেই বলা উচিত ছিল। এর আগে গত ২০২০'তে অমিত মিত্র বলেছিলেন, ত্রাণ চাই না, জিএসটি'র বকেয়া অর্থটা দিন। সঙ্গে সঙ্গে সুজন চক্রবর্তী, আব্দুল মান্নান সাহেবের টিপ্পনি। অথচ ওই একই সময়ে কেরলের টমাস আইজ্যাক বকেয়া জিএসটি'র দাবি করেছেন। ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষার প্রশ্নটা গুরুত্ব পেল না। 

মুখ্যমন্ত্রী নন্দীগ্রামে ভোটে দাঁড়াবেন জানা গেল। দিলীপ ঘোষ বলতেই পারেন, 'ভবানীপুরে দিদিমণি হারবেন, তাই ঝুঁকি নিচ্ছেন না'। তাই বলে আব্দুল মান্নান বলবেন? নিজের চাঁপদানি'তে যিনি চার নম্বর। সুজন চক্রবর্তী- বাংলার কোনও আসন যার নিরাপদ নয়। এখানে বাকসংযম প্রয়োজন ছিল। আসলে এই ২০২১ অবধি সমালোচনার লক্ষ্যই যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়- তখন কে বলছে, কী বলছে না দেখেই ঘি ঢালো, হাওয়া দাও, আগুন জ্বালো। এখন দেখছে ভাঁড়ারে ঘি শেষ, হাওয়া, দম শেষ। ভেবেছিল খুব ভিত খুঁড়ছে। খুঁড়েই গেছে এতদিন। এখন দেখা গেল ছাদ খু্ঁড়েছে। মাথার উপর ছাদটাই লোপাট। ভাইজান একমাত্র সম্বল। 

একাধিক সরকারি জেলা স্কুলে শিক্ষকতার সুবাদে আমার নিজের একটা শিক্ষা লাভ হয়েছে। একটু অ্যাডভান্স শিক্ষার্থীরা পড়তে আসে। তাদের প্রায় সবাই জয়েন্ট, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, আইএসআই, আইসার, আইআইএসসি, আইআইটি এইসব স্বপ্ন মনের মধ্যে পোষণ করে। ফলে, বিদ্যালয়ের মধ্য ও নিম্ন মেধার শিক্ষার্থীরা ওই বন্ধুদের প্রভাবে, এইসব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার আঙিনায় নিজেদের সামর্থ্যের বাইরে, অজান্তেই ঢুকে পড়ে। আর পিতৃ-মাতৃকুল যদি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার অধ্যাপক গবেষক হন, অনিবার্য ফল স্বপ্নভঙ্গ ও অন্ধকার ভবিষ্যৎ। অথচ এদের যারা নিজেদের সামর্থ্যের বাইরে না গিয়ে নিজেদের সীমায় বা তার কাছাকাছি স্বপ্ন দেখেছে, তারা সীমা অতিক্রম করেছে। একটু খুলে বলি। যে শিক্ষার্থী গণিতে ২০/২৫ পায় না, সে যদি অন্য সহপাঠীর অনুকরণে ৯৫/১০০ লাভের প্রস্তুতি নেয়, কপালে জুটবে ১৫/২০; কিন্তু যদি সে ৪০/৪৫ লাভের স্বপ্ন দেখে, সহজেই ৫০/৬০ পেয়ে থাকে। টার্গেট অভিমুখ নির্দিষ্ট করাটাই জরুরি শর্ত। 

কাজের কথায় আসি। গত ২০১৯'এর লোকসভায় বাংলায় একটি আসন (যাদবপুর) ছাড়া প্রত্যেক আসনে সিপিএমের জামানত জব্দ হয়। কয়েক মাস ধরে চলল ড্যামেজ কন্ট্রোল। কংগ্রেসের সাথে সিপিএম জোট করল। রাজপথে পূর্ণ শক্তি নিয়ে সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হল। তিনটি বিধানসভার উপনির্বাচনে এই জোট আরও শোচনীয় ভাবে হারল। করিমপুরে পাঁচ মাস আগে লোকসভা ভোটে কংগ্রেস (২২০৯৭) + সিপিএম (১৭৬০৯), জোট বাঁধার পর ভোট দাঁড়াল (১৮৬২৭)। কালিয়াগঞ্জ কেন্দ্রে লোকসভা ভোটে কংগ্রেস (১৮৫৬১) + সিপিএম (১৯২৪০), জোট বাঁধার পর দাঁড়াল (১৮৮৫৪) । কেন এটা হল? কোনও পাটিগাণিতিক হিসেবে থই মেলে না।

সিপিএম দলটা দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর এখন ক্ষমতার বাইরে থেকে কার্যত ডাঙায় তোলা মাছ। ফলে ক্ষমতার ক্ষুধা তীব্র। ধৈর্য হারাচ্ছে। যে কোনও ইস্যু বা নন-ইস্যুকে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার সোপান ভাবছে। ভাবটা যেন 'টি টোয়েন্টি ম্যাচ' খেলছে। সব বলেই মারতে চাইছে, রান চাইছে। যে কোনও প্রস্তাবনায় 'দিদি আর মোদী'কে এক বন্ধনীতে ফেলে কার্যত নিজেরাই ক্রমাগত আণুবীক্ষণিক হয়ে চলেছে। অথচ এটাকে যদি টেস্ট ম্যাচ হিসেবে দেখত, যদি সব বল না মেরে ধৈর্য ধরে ধীরে ধীরে এগোনোর পরিকল্পনা করত, যদি পার্টিকে পশ্চিমবাংলায় যথার্থ সদর্থক বিরোধী দলের আসনে বসাতে পারত, তাহলে আজ তৃতীয়-চতুর্থ স্থানে অবস্থান করত না। সিপিএম দলকে আগে দ্বিতীয় স্থান অধিকারের লক্ষ্যে এগোতে হবে। তবেই বিজেপির বিরুদ্ধে যথার্থ লড়াই গড়ে তোলা সম্ভব। সিপিএম যদি সিঙ্গল ফেয়ারে ডাবল জার্নির শর্ট-কাট রাস্তা খোঁজে, তাহলে সাফল্য অধরা থাকবে আর তার হতাশ কর্মী-সমর্থকেরা একে একে সরে যাবে, গেছেও।

কেরলের সিপিএমের কাছে শিক্ষণীয়- কতবার রাজ্যের ক্ষমতা হারিয়েছে, কিন্তু দিশা হারায়নি। পার্টি সেখানে বিরোধী আসনে বসার ফলে 'ডাঙায় তোলা মাছের দশা' হয়নি। কখনই দ্বিতীয় স্থান থেকে চ্যুত হয়নি। এমনকি, আজকের কঠিন মুহূর্তে প্রথম স্থানাধিকারী সিপিএম নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের হাত ধরতেও দ্বিধাগ্রস্ত নয়। আর পশ্চিমবাংলার সিপিএম বিজেপি বিরোধিতা করতে গিয়েও মুহূর্তের জন্য তৃণমূলকে আক্রমণ করতে ছাড়ছে না। আর কে না জানে, তৃণমূলের বিরোধিতা করার কাজে সিপিএম'এর চেয়ে বিজেপি অনেক বেশি কম্পিটেন্ট। অতএব, পশ্চিমবাংলায় সিপিএমের রাহুর দশা কাটার সম্ভাবনা নেই। ফলে, বিজেপি দ্বিতীয় স্থান থেকে প্রথম স্থানে উঠে আসার স্বপ্ন দেখবেই। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হল প্রধান বিরোধী দল হিসেবে। 

কী বিচিত্র ভাবে মমতা বিরোধী প্রতিটি কেন্দ্রীয় পদক্ষেপে সুজন চক্রবর্তী, আব্দুল মান্নানরা মজা দেখেছেন। জগদীপ ধনখড় বাড়াবাড়ি করছেন, অথচ সুজন-মান্নান নৈতিক ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে আক্রমণ না করে মজা দেখছেন। রাজ্য সরকার যখন জিএসটি'র বকেয়া পাওনা নিয়ে সরব, সিপিএমের মুখে কুলুপ। অথচ একই দাবিতে সরব কেরলের অর্থমন্ত্রী টমাস আইজাক। তাদের একমাত্র লক্ষ্য মমতার পরাজয়। ফলে পালে বাতাস নেই, সেই বাতাস পৌঁছে যাচ্ছে বিজেপির পালে। 

আমার বাড়ির একদিকে চাঁপদানি, অন্যদিকে সিঙ্গুর আর আমি চন্দননগর বিধানসভার অন্তর্গত। বিজেপি বিরোধিতা, কৃষি আইন, সিএএ-এনআরসি বিরোধিতা, লাভজনক সরকারি ক্ষেত্র বেসরকারি হাতে বিক্রি করার বিরুদ্ধে, এক দেশ এক আইন, এক ধর্ম এক দল এক নেতা ঝোঁকের বিরুদ্ধে কোনও প্রচার নেই। আছে টেট, এসএসসি, সিঙ্গুরের শিল্প, কাটমানি, ঘুষ, সারদা, তোলাবাজি ইত্যাদির বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রচার। সংযুক্ত কিষান মোর্চা এল, মেধা পাটেকর, রাকেশ টিকায়েত এলেন। শ্লোগান উঠলো 'নো ভোট টু বিজেপি'। সিপিএমের আগ্রহ নেই। কিন্তু সিঙ্গুরে দেখলাম, মঞ্চে নয় বেচারাম মান্না রাস্তায় সবার মাঝে ভিড় ট্রাফিক সামলাচ্ছেন। কোথাও হান্নান মোল্লাকেও পাওয়া গেল না। এতটাই সংকীর্ণ ক্ষমতার লোভ। কোথাও মানিক সরকারকে আনা হল না। কারণ, তিনি বিজেপি বিরোধী মুখ। এভাবেই ১৮৫টি কেন্দ্রে জোটের ভোট ২০১৯'এর চেয়েও কমল। ১৪৪টি কেন্দ্রে বিজেপির ভোট কমল। সেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের কমল মাত্র ২৯টি কেন্দ্রে। যদিও তৃণমূলের মোট ভোট ও মোট আসন বাড়ল অনেক বেশি। 

এই অবস্থায় জানাই ছিল আত্মঘাতী সিপিএম আরও ক্ষুদ্র হবে। কিন্তু একটা অন্য ভরসা মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল- ক্ষমতা হারানোর পরবর্তী নতুন বাম ছাত্র-যুবরা বিজেপিকে ওয়াক-ওভার দেবে না। বাস্তবিকই অশোক ভট্টাচার্য, মহঃ সেলিম, তন্ময় ভট্টাচার্যের ভোটের সাথে তুলনা করলে আকালের বাজারে সৃজিত, দীপ্সিতা, ঐশী, সায়নদীপ, শতরূপ ভালোই লড়েছে, দলের বয়স্ক নেতাদের একাংশ সরাসরি বিজেপিকে ভোট দিতে বলার পরেও। রাজ্য নেতারা যে হারে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে চলেছেন তাতে এরা এর বেশি কী আর করতে পারত। এদের ওপরেই ভরসা রাখা যায়। প্রসঙ্গত মীনাক্ষী মুখার্জীর কথা আসবেই। মাত্র ৬২৬৭ ভোট বুঝিয়ে দিচ্ছে রক্তক্ষরণ নয়, ওখানে মীনাক্ষী মুখার্জীর অজ্ঞাতেই সরাসরি বিষক্রিয়া ঘটেছে। কারণ, খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারানোর সুযোগ বলে কথা। একেই বলে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ। এই কারণে বেশ কিছু বাম ভোট বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূল কংগ্রেসের ঝুলিতে এসেছে। ফলে, ফ্যাসিস্ট বিজেপিকে এত বিপুল ভাবে আঘাত হানা সম্ভব হল। 

সুতরাং, আজকের জরুরি পার্টি সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত- সার্বিক ভাবে সিপিএম ও কংগ্রেস জোটকে বিজেপি বিরোধী সংগ্রামে আন্তরিক হতে হবে। এর মধ্য দিয়ে গণভিত্তি অর্জন করতে হবে, বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। তবেই এই জোটের দ্বিতীয় স্থানে উত্তরণ ঘটা সম্ভব। সিপিএমের যে হতাশ ভোট বিজেপির ঘরে গেছে তাকে আগে ফিরিয়ে আনতে হবে তীব্র বিজেপি বিরোধী কর্মসূচির মাধ্যমে। একমাত্র তখনই সিপিএম-কংগ্রেস জোট নিজেদের তৃণমূলের বিকল্প বলে দাবি করতে পারবে। শর্ট-কাট রাস্তা খোঁজা নয়। আগে হারানো ভোটের আস্থা ফিরে পেতে হবে। নিজেদের দ্বিতীয় স্থানে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। চোখের সামনে তৃণমূল নেত্রীর উদাহরণ আছে। দীর্ঘ লড়াইয়ের ঐতিহ্য তাঁর। এমনকি ২০০৪ সালে একজন মাত্র সাংসদ হওয়া সত্ত্বেও কখনই লড়াইয়ের ময়দানে প্রথম স্থান ও গুরুত্বের বিচারে দ্বিতীয় স্থান থেকে চ্যুত হননি। এখানেই সাফল্যের সূত্র। বাম জোটকে বাংলার বিজেপিকে হারিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসতে হবে। রাজ্যপালের অতি সক্রিয়তা, যুক্তরাষ্ট্রের সুরক্ষা, তিন কৃষি আইন বাতিল, এনআরসি-সিএএ বাতিল, ভারতের বহুস্বর রক্ষা, বহুদলীয় বহুমত পরিচর্যা এই ইস্যুগুলির মধ্যে দিয়ে বামেরা উঠে আসুক এই বাংলার দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে। বিজেপি থাকুক একদা জনসংঘের মতো বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী, হরিপদ ভারতী, প্রভাত পালিত এমন অল্প কয়েকজনের মাঝে। 

আগামী পাঁচ বছর সিপিএমের এ রাজ্যে ক্ষমতা দখল করার সুযোগ নেই। প্রতি বলে রান তোলা নয়। ধৈর্য ধরে একটি ভিন্ন স্বর তৈরি করুন। এই প্রচলিত ব্যবস্থায় ইঁদুরের উৎপাত থাকবে, আবার পাশাপাশি বিড়ালের লম্ফঝম্পও থাকবে। তাই বলে ইঁদুর তাড়াতে কে কবে সাপ পুষেছি জানি না। সাপটা তাড়াতেই হবে। এই ঐতিহাসিক কর্তব্য বিস্মৃত হলে, মনে পড়ছে, ১৯৭৮ সালে হুগলিতে সিপিএমের জুলাই সংকট আলোচনা চলছে। বলা হল, মোরারজী দেশাই সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার ভুল ছিল। ভুল স্বীকার করতে কমিউনিস্টরা দ্বিধা করে না। প্রতিটি ভুল হল সাফল্যের পিলার। ঠিক তখনই উত্তরপাড়ার কমরেড নিখিলেশ গুহর উক্তি, 'কমরেড, সাকসেস'এর পিলারে পিলারে ঘর যে ভ্যইরা গ্যাসে, অহন খাড়াইবার জায়গা নাই।' সত্যিই জায়গা থাকবে না। সাধু সাবধান।


Friday, 18 June 2021

কেরালার শিক্ষা

অতিমারির ভয়ে পরীক্ষা বাতিল নয়

শোভনলাল চক্রবর্তী


সারা দেশ যখন এই মহামারি পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক অবহেলার গোলকধাঁধায় পরিণত হয়েছে, শিক্ষার্থী সমাজ যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্রগুলির দুঃখজনক পদক্ষেপের জন্য  যন্ত্রণাবিদ্ধ, তখন শিক্ষার প্রতি কেরালা সরকারের মনোযোগ এবং যথাসময়ে দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণীর অফলাইন পরীক্ষা  সুসম্পন্ন করার সাফল্যের কাহিনী অন্যদের উদ্দীপ্ত করার ক্ষমতা রাখে। শুধু পরীক্ষা নেওয়াই নয়, পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেছে তারা অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে। দশম শ্রেণীর স্তরে উত্তীর্ণের হার ৯৮ শতাংশ এবং দ্বাদশ শ্রেণীতে ওই হার ৮৫ শতাংশ। সরকারের পক্ষে জানানো হয়েছে যে তারা সবার উপরে স্বাস্থ্য এবং মানুষের জীবন ও জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে আলোর দিশা দেখাতে বদ্ধপরিকর। সত্যিই তাই। এই পরীক্ষা নেওয়া এবং ফল প্রকাশ করা কেরালার মুকুটে নতুন পালক যোগ করল সন্দেহ নেই। 

ভারতে কোভিড মহামারির প্রেক্ষাপটে শিক্ষা নিয়ে আলোচনা এবং বিতর্ক কোনও নির্দিষ্ট দিশা পায়নি, সমাধান সূত্রও মেলেনি। তার ওপর আমাদের দেশে কোভিডের ভয়ঙ্কর দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রেক্ষাপটে শিক্ষাক্ষেত্রের সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য কোনও সুচিন্তিত নীতি এবং গাইডলাইন এখনও গ্রহণ করা হয়নি। সারা দেশের স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলি অনিশ্চয়তার দোলায় দুলছে। আমাদের রাজ্যেও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বাতিল হয়েছে এবং আজ ঘোষণা হয়েছে কী পদ্ধতিতে নম্বর দিলে পরীক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হবে! এই জটিল পরিস্থিতির মধ্যেই কেরালা দশম ও দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্ত নিয়মবিধি কঠোরভাবে মেনে। 

ইতিপূর্বে কেরালা কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এবং শিক্ষার উন্নয়নের অনেকগুলি মডেল দেশকে উপহার দিয়েছে। কেরালা সরকারি এবং বেসরকারি স্কুলগুলিতে সত্যি সত্যিই ডিজিটাল  বিপ্লব ঘটিয়েছে, তা না হলে এই পরীক্ষাপর্ব সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না। একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে শিক্ষার পূর্ণতা দেওয়ার কাজে কেরালা সরকার প্রতিটি শিক্ষার্থীর কাছে হয়ে উঠেছে প্রকৃত অর্থে তাদের অভিভাবক। 

যে সব রাজ্যে শুরু থেকেই করোনা সংক্রমণ ছড়িয়েছে তার মধ্যে অন্যতম কেরালা। কিন্তু কেরালা পরীক্ষামূলক পর্যায় অতিক্রম করেছে অতি সাবধানে। কন্টেইনমেন্ট গাইডলাইনকে মান্যতা দিয়ে সব ক্লাস স্থগিত রাখা হয়। কিন্তু রাজ্য সরকার টেলিভিশন সম্প্রচারকে কাজে লাগিয়ে অনলাইন শিক্ষার একটি বিকল্প পথ উপস্থাপন করে। মার্চের শেষে যখন অপ্রত্যাশিতভাবে সারা দেশে লকডাউন জারি করা হয়, তখন পরীক্ষা এবং ক্লাস সংক্রান্ত সমস্যাগুলি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কারণ, তখন শিক্ষাবর্ষ প্রায় শেষের পথে। কেরালা সরকার খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যে তারা দশম এবং দ্বাদশ দুটি স্তরেই, আমাদের যেমন মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক, তেমনই কেরালায় পরীক্ষা দুটির নাম এসএসএলসি, সেই পরীক্ষা নেবে। প্রথম পর্বে সাবধানতা এবং কড়া পর্যবেক্ষণের মধ্যে দশম শ্রেণীর জন্য ১০ লক্ষ পরীক্ষার্থীর রাজ্যের তিন হাজার কেন্দ্রে সফলভাবে পরীক্ষা নেওয়া সম্পন্ন করে সরকার। এর জন্য পরীক্ষা কেন্দ্রগুলিতে কঠোরভাবে কোভিড প্রটোকল মানা হয়েছে। প্রত্যেকটি কেন্দ্রে আলাদা করে হাত ধোওয়ার একাধিক জায়গা এবং স্যানিটাইজার সহ স্যানিটাইজেশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের মধ্যে পরিস্থিতির গুরুত্ব সম্পর্কে বহু আগে থেকে শুরু হয়েছিল সরকারি প্রচার। সেই কারণে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক- এই আবহে পরীক্ষা দিতে পিছিয়ে যাননি, বরং এগিয়ে এসেছেন। 

সামাজিক দূরত্ববিধি কঠোরভাবে মানা হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য প্রতি পরীক্ষা কেন্দ্রে আলাদা করে লোক নিয়োগ করা হয়েছিল। এছাড়াও প্রতি পরীক্ষা কেন্দ্রে ছিলেন দু'জন করে স্বাস্থ্যকর্মী, যাঁদের কাজ ছিল অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের দেহের উষ্ণতা মাপা ও সেটা রেকর্ড করা। শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীদের মধ্যে বিলি করা হয়েছে ৫ লক্ষ গ্লাভস ও মাস্ক। পরীক্ষা কেন্দ্রে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে সামাজিক দূরত্ববিধি কঠোর ভাবে মেনে। যে সব শিক্ষার্থী কন্টেইনমেন্ট জোন থেকে পরীক্ষা দিতে গিয়েছেন, বা যাঁদের পরিবারের কেউ কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের আলাদা ঘরে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে অন্য শিক্ষার্থীদের থেকে আলাদা করে। যে সব শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে আসতে পারেনি তাঁদের জন্য অন্য দিনে পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যাতে একটি শিক্ষাবর্ষ নষ্ট না হয়। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রচুর পরিমাণে দিনমজুর নিয়োগ করে যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে ক্লাসরুম এবং স্কুল চত্বর স্যানিটাইজ করা হয়। একটি ব্যাচ পরীক্ষা দিয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় ব্যাচ ঢোকার আগে প্রতিটি শিক্ষা কেন্দ্রের প্রতিটি ঘরে নতুন করে স্যানিটাইজেশন করা হয়। 

কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গ কেরালাকেও ভয়াবহ ভাবে প্রভাবিত করেছে। তার জন্য সরকার লকডাউনের পথেও যেতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও 'শিক্ষা', সব সময়ে সরকারের মূল চিন্তার মধ্যে থেকেছে। এই কারণেই ৮ এপ্রিল থেকে সরকার দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা নেওয়া শুরু করে। এই পর্বে পরীক্ষা দিয়েছে ৯ লক্ষ শিক্ষার্থী। পরিস্থিতি বুঝে বাড়ানো হয় পরীক্ষা কেন্দ্রের সংখ্যা। এই পর্বে পরীক্ষা কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ৪৯৫১টি। বাড়তি যত্ন ও সাবধানতা অবলম্বন করা হয় করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট স্ট্রেনের কথা মাথায় রেখে। দ্বিতীয় পর্বের পরীক্ষায় ত্রিস্তরীয় মাস্ক বাধ্যতামূলক করা হয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য। সরকার প্রচুর সংখ্যায় স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করেছিল যাঁরা কঠোরভাবে কোভিড প্রটোকল প্রয়োগ করেছেন সর্বত্র। স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠন এবং গণ সংগঠনগুলি সামনের সারিতে ছিল এটা নিশ্চিত করতে, যাতে যেভাবেই হোক শিক্ষার্থীরা যেন সময় মতো পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছয়। 

কেরালা যে ভাবে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পরীক্ষা নিয়েছে তা  সম্ভব হত না সেই রাজ্যের জনগণ এগিয়ে না এলে। সারা ভারতের ১৪টি রাজ্য দশম ও দ্বাদশের বোর্ড পরীক্ষা বাতিল করেছে, আরও পাঁচটি রাজ্য এখনও সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারেনি। এই অবস্থায় যে রাজ্যটি পরীক্ষা করবে বলে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, বোঝাই যাচ্ছে তাদের মানসিকতা ভিন্ন হতে বাধ্য। 

এবার একটু আমাদের রাজ্যের দিকে চোখ ফেরানো যাক। লকডাউনের সময়ে স্কুলে শুধু দশম ও দ্বাদশের পরীক্ষার্থীদের পঠন-পাঠন কতটা হয়েছে তার একটা হিসেব নিতে গেলে আসল ছবিটা ধরা পড়বে। ছবিটা এ ক্ষেত্রে ভীষণ মলিন। প্রথম দিকে সবাই টেলিভিশন চ্যানেলে ক্লাস শুরু করলেও অচিরেই তা বন্ধ হয়ে যায়। কেরালায় কিন্তু টেলিভিশন চ্যানেলে শিক্ষাদান সফল একটি কার্যক্রম। আমাদের এখানে যে টেলিভিশন চ্যানেলে শিক্ষা চলল না, তার একটা বড় কারণ পরিকল্পনার অভাব; দ্বিতীয়টি হল সরকারি স্তরে এই ধরনের পদক্ষেপের প্রতি অনীহা। কেরালায় যখন প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে সরকার পৌঁছে দিচ্ছে টেলিভিশন, ডিশ এন্টেনা, ইন্টারনেট, তখন তার ধারেকাছেও নেই বাংলা। এখানে বেসরকারি উদ্যোগে কিছু সাহায্য গেছে, যা অপ্রতুল। বাংলায় রেডিও মারফতও কিছু ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, কিন্তু কোনওটাই স্থায়ী হয়নি। এরপর সরকারি স্কুলে শিক্ষকরা সারা সপ্তাহে মোবাইলের গ্রূপে একটি করে 'নোট' পাঠানো শুরু করেন, যার পাঠোদ্ধার ছিল অসম্ভব। কলকাতার বুকে হাতে গোনা কয়েকটি সরকারি স্কুল নিজেদের উদ্যোগে অনলাইন ক্লাস শুরু করে, যা প্রযুক্তিগত কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে। সারা পশ্চিমবঙ্গে লকডাউনের পর থেকে কটি সরকারি স্কুলে ক্লাস হয়েছে তার উত্তর হাওয়ায় উড়ছে। আমরা যখন অনলাইন ক্লাস কীভাবে সমাজে এক নতুন শ্রেণী বিভাজন ডেকে আনছে তা নিয়ে দিস্তা দিস্তা কাগজ লিখে ভরাচ্ছি, তখন কেরালা কীভাবে অনলাইন ক্লাসে সবাইকে যুক্ত করা যায় তার জন্য ময়দানে নেমে লড়াই করছে। বেসরকারি স্কুলগুলোতে অনলাইনে ক্লাস হয়েছে স্কুলগুলির বেঁচে থাকার তাগিদে। কিন্তু বেসরকারি নামী স্কুলের অধিকাংশ সিবিএসই বা আইএসসি বোর্ডের অধীনে। ফলে, যে শিক্ষার্থীরা পড়লই না (বিশেষ করে দ্বাদশ শ্রেণী), তারা পরীক্ষা দিলে যে কেলেঙ্কারি হত, তা সহজেই অনুমেয়। 

সরকারি শিক্ষক সমিতির অবস্থান এ ক্ষেত্রে চমকপ্রদ। গোটা লকডাউনের সময়ে তারা শিক্ষকদের একবারও অনুরোধ করল না শিক্ষার্থীদের পড়াতে, আর প্রেস ডেকে সরকারকে অনুরোধ করল পরীক্ষা নিতে। দশম ও দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তাঁদের চেয়ে আর কেউ ভালো করে জানতেন না যে এবার পরীক্ষা নিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীদের কলম ভেঙে যেত। ভোটের দীর্ঘ নির্ঘন্ট পেরিয়ে পরীক্ষা হওয়া শক্ত ছিল। করোনার দ্বিতীয় প্রবাহের পর পরীক্ষা যে হবে না তা আমাদের রাজ্যে একপ্রকার ঠিক হয়েই ছিল। পরীক্ষা বাতিল ছিল সময়ের অপেক্ষা। পরীক্ষা বাতিল হতে এখন সবাই অনেকটা নিশ্চিন্ত। শিক্ষার্থীদের পুরস্কার ঘরে বসে নম্বরের ঝুলি। অভিভাবকরাও নিশ্চিন্ত, আর করোনার ভয় রইল না, পরীক্ষা দিতে গেলে যেটার ভয় ছিল। অতিমারির জুজু দেখিয়ে পরীক্ষা বাতিল আসলে যে একে এড়িয়ে যাওয়ার ছল, তা প্রমাণ করেছে কেরালা। বিদেশের অবস্থা নিয়ে না হয় আর এক নিবন্ধে আলোচনা করা যেতে পারে। আশঙ্কা হয় পরিস্থিতি ঠিক হলে সবাইকে আবার পরীক্ষা কেন্দ্রে টেনে আনা যাবে তো? মানুষ কিন্তু অভ্যাসের দাস।


Thursday, 17 June 2021

মানুষই গড়েন

ভারতের প্রাণভোমরা রাক্ষসের নখে 

শিবশংকর পাল 


ভারত অভিনব দেশ। এ দেশের মাটি, মানুষ, প্রকৃতি, ফসল, ফলন এত বিবিধতার সমাহারে সমৃদ্ধ- বিশ্বের আর কোনও দেশে এমন আছে কিনা জানা নেই। একদিকে চির মেঘবালিকার চরে বেড়াবার মেঘালয় তো অন্য প্রান্তে শুধুই মরুবালির ধুধু। দক্ষিণে সমুদ্রের জলে পা ছড়িয়ে খেলা তো উত্তরে তুষারের মুকুট পরে সম্রাজ্ঞী হিমালয়। এমন দেশের মানুষের চেহারায় হাবেভাবে তো বিভিন্নতাই স্বাভাবিক। কতরকমের পোশাক, নানা স্বাদের নানা পাকের খাবার; আর বহু ভাষা ও বহু ধর্ম তো এ দেশের সংস্কৃতিকে সব দিক দিয়েই ভরিয়ে তুলেছে।

কেবল আজ নয়, বহু কাল ধরে আমরা ঝগড়াঝাটি করেছি, মারপিট করেছি, তারপর আবার ‘আয় তবে সহচরী’ নেচে গেয়ে এক সঙ্গে থেকেছি। বিয়ে-থা, ধম্মকম্ম সবেতেই আমরা আলাদা হয়েও মিলেছি এক সুরে। শক হুন দল পাঠান মোগল— না, কোনও রণরক্ত নয়, বরং ‘আমার সকল রসের ধারা’ হয়ে সেই সুর মিশেছে আমাদের ধমনীতে। এমন দেশটি সত্যি কোথাও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ভারতবর্ষের যাপনধর্মের এটাই প্রাণভোমরা। এই প্রাণভোমরাটির রাজনৈতিক পরিভাষা হল ধর্মনিরপেক্ষতা। আর তার গলা টিপে ধরেছে দেশের দুই হুজুর। দুই হুজুরের একজন অতি নাটুকে- বিপাকে পড়লে কেঁদে ভাসান, মৌনী হয়ে গুহায় ঢোকেন, বেলাগাম হয়ে নির্বাচনের ময়দানে মুখর হন। কখনও সৈনিক সাজেন তো ভোটের বাজারে বাঙালিকে ভজাতে রবীন্দ্রনাথ সাজেন। এক্কেবারে জাত বহুরূপী। অন্যজন তো একশো ভাগ ষড়যন্ত্রী। দাঙ্গা লাগিয়ে কার্যোদ্ধার করায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। সে গুজরাট দাঙ্গা হোক বা শাহীনবাগের আন্দোলন ভাঙতে দিল্লী দাঙ্গা। যখনই দেশের মানুষ গুরুতর সমস্যায় পড়েন তখন তার থেকে চোখ ঘোরাতে এই দুই হুজুর শুরু করে দেন নানা নৌটঙ্কী- দাঙ্গাফ্যাসাদ থেকে শুরু করে এনআরসি-সিএএ অথবা সীমান্তে যুদ্ধ- এসবই এর হাতেগরম উদাহরণ।   

যেমন, দেশ যখন করোনা অতিমারীতে মৃত্যুপুরীতে পরিণত, তখন এ দেশে ভ্যাকসিনের আকাল।  জিএসটি চাপছে করোনা চিকিৎসার যাবতীয় সরঞ্জামে। দুরন্ত গতিতে বাড়ছে পেট্রল-ডিজেলের দাম। যখন সমস্ত নজর ও চিকিৎসার আয়োজন নিয়ে দেশের মানুষের শুশ্রূষা করা দরকার ঠিক তখন বিজ্ঞপ্তি জারি হয়ে গেল যে, ভারত বাংলাদেশ আফগানিস্তান থেকে যাঁরা এ দেশে রয়েছেন তাঁদের মধ্যে মুসলমান ব্যতিরেকে বাকি পাঁচটি ধর্মের লোকেদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। অভিজ্ঞজনেরা প্রশ্ন তুলছেন, এ কীরকম কথা? এখনও তো নয়া নাগরিকত্ব আইন (CAA-2019)-এর নিয়ম-কানুনই তৈরি হল না, নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রশ্ন উঠছে কেন? দুই হুজুর ও পারিষদবর্গ অমনি বলে উঠলেন, না, না, এটা তো ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে আশ্রিত ও আবেদনকারীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হচ্ছে। অভিজ্ঞ নিন্দুকেরা সংবিধান আঁতিপাঁতি করে খুঁজে দেখলেন, ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের কোথাও ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান নেই। আসলে, এ হচ্ছে ভারতকে অমুসলমান করার কুটনো কোটার কাজ। এরপর যে ভারত রান্না হবে তার রঙ রস ভাষা ধর্ম এক্কেবারে এক হয়ে যাবে। এক দেশ এক রেশন কার্ড, এক দেশ এক আইন, এক দেশ এক ধর্ম, এক দেশ এক ভাষা- হিন্দুর হিন্দুস্তান! আসলে এই দুই হুজুর মিলে দেশের আসল প্রাণভোমরাটিকে নিকেশ করতে চাইছে। ভারত যতদিন ধর্মনিরপেক্ষ থাকবে, ততদিন সাধের হিন্দুরাষ্ট্র গড়া না-মুমকিন। এটা জানে বলেই নাগরিকত্ব নিয়ে দুই হুজুরের এত তাড়াহুড়ো, তৎপরতা, আকুলিবিকুলি। 

অথচ আমরা জানি, ভারত বহুকাল ধরে তার এই প্রাণভোমরাটিকে আগলে রেখেছে। শুধু যদি বাঙালির কথা বলি সেও অমৃত সমান। আসুন, বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষতার রসরক্তসফলতা কোথায়- তার একটু শেকড়বাকড়ের সন্ধান করা যাক। আমাদের চৈতন্য গোঁসাই সেই কবেই ৫২০-২৫ বছর আগেই প্রেমধর্মই যে সেরা ধর্ম তা প্রচার করেছিলেন। প্রেমে মজলে দ্বিজ-চণ্ডাল এক আত্মা হয়ে যায়। প্রেম বিনে ব্রাহ্মণও ব্রাহ্মণ নন, আবার প্রেমভক্তিতে চণ্ডাল-যবনও ব্রাহ্মণ হয়ে যান। তিনি কাজীদের জয় করলেন প্রেম দিয়েই; গলায় জড়িয়ে ধরলেন যবন হরিদাসকে। ব্যাস, শুরু হয়ে গেল সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার লড়াই; ভারতের প্রথম নবজাগরণ। 

প্রসঙ্গ যখন উঠলই তখন যবন হরিদাসের কথাও হোক। তিনি ছিলেন চৈতন্যদেবের চেয়েও বিনয়ী ও ক্ষমাশীল। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ পুরীতে গিয়েও তিনি জগন্নাথ দর্শন করেননি। কারণ, 'হরিদাস কহে মুঞি নীচ জাতি ছার।/ মন্দির নিকট যাইতে নাহি অধিকার।।' স্বয়ং চৈতন্যদেবের জোরাজুরিতেও নয়। কাজীর নির্দেশে নির্মম পীড়নে জর্জরিত হয়েও তাঁর ক্ষমাশীলতা যিশু খ্রিস্টের তুলনায় কোনও অংশে কম ছিল না। তো পুরীতে এ হেন ভক্তের জগন্নাথ দর্শন না করা ও মন্দির থেকে দূরে থাকার ব্যবস্থা রুখতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত চৈতন্যদেব তাঁকে কাশী মিশ্রের ফুলের বাগানে ভালোভাবেই মাথা গোঁজার একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু হরিদাস নাছোড়। তিনি ঝড় জল রোদ বৃষ্টি শীত গ্রীষ্ম কোনও ছাদের নিচে আশ্রয় নেবেন না। নেনওনি। এখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। হরিনাম জপ ছাড়া তিনি আর কিছু করতেন না। জপের মালা গুণে নাম জপ করা, হরিবোল ধ্বনি ও হরির লুট দেওয়া- এসবই তাঁর প্রবর্তনা। এমনকি মৃত্যুর পর হরিধ্বনি দিয়ে কীর্তন সহকারে শবদেহ বহন করে নিয়ে গিয়ে সমুদ্রে বা নদীতে স্নান করিয়ে সমাধি দেওয়া বা দাহ করা এবং মহাপ্রসাদ সহযোগে শ্রাদ্ধশান্তির আয়োজন- এসবের রেওয়াজটি চালু হয়েছিল তাঁরই শবদেহ সৎকারকে কেন্দ্র করেই। পুরীতে এই কাজটি করেছিলেন স্বয়ং চৈতন্যদেব। পরবর্তীকালে মৃতের আত্মার শান্তি কামনায় এই শ্রাদ্ধশান্তি করার প্রথা সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। 

আশ্চর্যের কথা এই যে, প্রেমধর্মের আগেই খাদ্য সংস্কৃতির মতো বাঙালির বসন সংস্কৃতিও উদার হয়ে উঠেছিল তুর্কি শাসনের পর থেকেই। অসীবিত এক কাপড়ের বাঙালির গায়ে উঠছে সেলাই করা জোব্বা, কাবা, কুরতা, কাফতান, চোগা, চাপকান, কামিজ, পায়জামা, আলখা(খে)ল্লা, আচকান, জামা, পিরানের মতো সুদূর পূর্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি আচ্ছাদন। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের বাংলা ভাষায় তেমনভাবে কিন্তু আরবি-ফারসি-তুর্কি শব্দের প্রয়োগ ঘটেনি। কিন্তু এর পরের শতক থেকে বাংলা ভাষায় দেদার আরবি-ফারসি শব্দের প্রবেশ ঘটতে থাকে, রাষ্ট্রীয় কারণে অনেকটা, কিছুটা ভাষার নিজস্ব প্রবণতার জন্য। খেয়াল করলে দেখা যাবে, বেশ কিছু বিশিষ্ট ও মৌলিক তদ্ভব শব্দের ব্যবহার পুরোপুরি উঠে গিয়ে সেখানে  ফারসি (আরবি বা তুর্কি মাধ্যমে) শব্দ প্রচলন হতে লাগল। 

ভাষার মতো পোশাকের ক্ষেত্রেও ষোড়শ-সপ্তদশ শতকই হয়ে উঠেছিল ইসলামি বসন গ্রহণ করার কাল। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে এবং বিজয়গুপ্তের কাব্যে সেলাই করা কাঁচুলির কথা আছে। অর্থাৎ, পঞ্চদশ শতকে হিন্দু পোশাকের ইসলামিকরণ শুরু হলেও পরবর্তী দুটি শতকে তা ‘ট্রেন্ড’ হয়ে উঠেছিল। সেই যে আঠেরো জন তুর্কি বাংলার অন্দরমহলে ঢুকে পড়েছিল, আর তার পিছনে পিছনে বহু দর্জিও কি ঢুকে পড়েছিল না সুচ-সুতো-কাঁচি হাতে, সেইসঙ্গে অনুসারী শিল্পের কারিগর হিসেবে কাপড় রঙ করার রঙরেজির দল! তাছাড়া কাপড় কেটে সেলাই করার সংস্কৃতি হিন্দুদের নয়, তুর্কি বিজয় পরবর্তীকালের ইসলামি সংস্কৃতির অঙ্গ। বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল তুর্কি বিজয়ের বেশ কিছু পরে রচিত হয়েছে বলে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস সূত্র আমাদের হাতে এসেছে। 

বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ যাপনের প্রসঙ্গে একটু কবিকঙ্কণের কথা বলি। চণ্ডীমঙ্গলের কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী নিজে উদ্বাস্তু হয়েছিলেন মুসলমান শাসনের ফলে। ডিহিদার মামুদ শরিফের অত্যাচারে দামুন্যার চাষি কবিকে ভিটেমাটি ছেড়ে সুদূর প্রান্তের বাঁকুড়া রায়ের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। দেশত্যাগের কালে পথকষ্ট ও শিশুদের মুখে খাবার তুলে দিতে না পারার কষ্টও তিনি গোপন করেননি। কিন্তু সে-ই তিনিই যখন কাব্যের নায়ক কালকেতুকে রাশাসনে বসালেন, একটি আদর্শ শাসনব্যবস্থার গোড়াপত্তন হল কালকেতুর হাত ধরে। কালকেতু গুজরাট নগর গড়ে তুলছেন প্রথমেই ভর্তুকি দিয়ে, ‘আমার নগরে বৈস যত খুসি চাষ চস্য/ তিন সন বহি দিও কর’। আজকের শাসকরা তো কেবলই শুল্ক বসিয়ে চলেছেন। বিভিন্ন জীবিকার মানুষকে জমিজায়গা দিচ্ছেন কালকেতু। বাদ যাচ্ছেন না বৃহত্তর মুসলমান সমাজের মানুষও। নইলে ষোড়শ শতকের গণজীবনের অন্যতম রূপকার মুকুন্দ চক্রবর্তী এত নিপুণভাবে গুজরাট নগরপত্তনের বর্ণনায় মুসলমান সমাজের অন্তরঙ্গ ছবি বিশেষ করে দর্জি রঙরেজি কসাই মৌলবীদেরদের কথা এত ঘটা করে বলতেন না।  

বাঙালির সমন্বয়ী সংস্কৃতির অন্যতম অভিজ্ঞান বাঙালির পরনের কাপড়চোপড়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন খুব। বাঙালির জাতীয় পোশাক এবং বাঙালি পোশাকের বিবর্তন বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ চমৎকার কিছু কথা বলেছেন। ‘সমাজ’ নামের একগুচ্ছ প্রবন্ধের একটি নিবন্ধ ‘কোট বা চাপকান’-এ তিনি লিখেছেন:

'মুসলমানদের সহিত বসনভূষণ শিল্পসাহিত্যে আমাদের এমন ঘনিষ্ঠ আদানপ্রদান হইয়া গেছে যে, উহার মধ্যে কতটা কার, তাহার সীমা নির্ধারণ করা কঠিন। চাপকান হিন্দু মুসলমানের মিলিত বস্ত্র। উহা যে-সকল পরিবর্তনের মধ্য দিয়া বর্তমান আকারে পরিণত হইয়াছে, তাহাতে হিন্দু মুসলমান উভয়েই সহায়তা করিয়াছে। এখনো পশ্চিমে ভিন্ন ভিন্ন রাজাধিকারে চাপকানের অনেক বৈচিত্র্য দেখা যায়; সে-বৈচিত্র্যে যে একমাত্র মুসলমানের কর্তৃত্ব তাহা নহে, তাহার মধ্যে হিন্দুরও স্বাধীনতা আছে। 

'যেমন আমাদের ভারতবর্ষীয় সঙ্গীত মুসলমানেরও বটে হিন্দুরও বটে, তাহাতে উভয়জাতীয় গুণীরই হাত আছে; যেমন মুসলমান রাজ্যপ্রণালীতে হিন্দু মুসলমান উভয়েরই স্বাধীন ঐক্য ছিল।

'তাহা না হইয়া যায় না। কারণ মুসলমানগণ ভারতবর্ষের অধিবাসী ছিল। তাঁহাদের শিল্পবিলাস ও নীতিপদ্ধতির আদর্শ ভারতবর্ষ হইতে সুদূরে থাকিয়া আপন আদিমতা রক্ষা করে নাই; এবং মুসলমান যেমন বলের দ্বারা ভারতবর্ষকে আপনার করিয়া লইয়াছিল, ভারতবর্ষও তেমনই স্বভাবের অমোঘ নিয়মে কেবল আপন বিপুলতা আপন নিগূঢ় প্রাণশক্তি দ্বারা মুসলমানকে আপনার করিয়া লইয়াছিল। চিত্র, স্থাপত্য, বস্ত্রবয়ন, সূচিশিল্প, ধাতুদ্রব্য-নির্মাণ, দন্ত্যকার্য, নৃত্য, গীত, এবং রাজকার্য, মুসলমানের আমলে ইহার কোনোটাই একমাত্র মুসলমান বা হিন্দুর দ্বারা হয় নাই; উভয়ে পাশাপাশি বসিয়া হইয়াছে। তখন ভারতবর্ষের যে একটি বাহ্যাবরণ নির্মিত হইতেছিল, তাহাতে হিন্দু ও মুসলমান ভারতবর্ষের ডান হাত ও বাম হাত হইয়া টানা ও পোড়েন বুনিতেছিল।'

শাসকরা একদিকে যখন কেবল ভাঙতে থাকেন, তখন মানুষই আবার অন্য দিক দিয়ে তা গড়ে তোলেন। এভাবেই সংস্কৃতির ধারাজল নিজস্ব গতিতে এগোয়। বাইরে থেকে ঝড়ঝাপটা এলেও তার তরঙ্গ খুব একটা ভঙ্গ হয় না। বাঙালির, শুধু বাঙালির কেন, সমগ্র ভারতের খাদ্যাখাদ্য, পোশাকআশাক, ধর্মাধর্ম, মেলাখেলা- সব মিলিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতির ভুবনে বহুত্ববাদী যাপনকলাটি কখনই খুব বেশি কেউ ভাঙতে পারেনি। তবু নিশ্চেষ্টতার ফল স্খলন। তাই, দেশের শাসক দলের দুই হুজুর যেভাবে দেশের প্রাণভোমরাটির গলা টিপে ধরছে তাতে আর চুপ থাকা যায় না। আমরা যদি এখনই এ বিষয়ে সচেতন না হই তাহলে আমাদের কপালে দীর্ঘকালীন দুর্ভোগ অপেক্ষা করে আছে।


Tuesday, 15 June 2021

যন্ত্রের মস্তিষ্ক?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌড়

সঞ্জয় মজুমদার


ভর দুপুরে কাজ নেই কম্ম নেই হাবিজাবি চিন্তার আঁকিবুঁকি কাটছিলাম। ভাবছিলাম, প্রাকৃতিক আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মধ্যে কি মারপিট লেগে গেছে? সেটা তো হওয়ার কথা নয়। ওয়াকিবহাল মহল ভালই জানে, সরলরৈখিক কোনও সম্পর্ক টানা না গেলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অবধি পৌঁছতে গেলে ডেটাবেস, নলেজবেস হয়ে আসাটাই স্বাভাবিক। এখানে মানুষের ঘিলু ছাড়া কোনও '..বেস' খাড়া করা আর বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খাওয়া একই ঘটনা। তাহলে মানুষ কি নিজের ক্ষমতাকেই হিংসে করতে শুরু করেছে? হতেও পারে। বিচিত্র কিছু নয়। অথচ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ঘিরে আমাদের এই দ্বন্দ্ব, হিংসা, ভয়, প্রশ্ন, অনিশ্চয়তার সবটাই অমূলক- এটাও তো জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।‌ এ অবস্থায় মেরেকেটে যেটুকু ভাবা যায়, বুদ্ধিমত্তা যেখানে 'কৃত্রিম', সেখানে প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তাই তার মূল চালিকাশক্তি হবে।

এ বছরের এপ্রিলের ১৮ ঝাড়গ্রাম থেকে ফিরলাম। হাওড়ায় নেমে ইদানীং খুব পরিচিত একটা দৃশ্য দেখে, বলতে নেই, কষ্টই হল। ডাউন স্টিল এক্সপ্রেস বেশ লম্বা ট্রেন। খড়গপুর ঝাড়গ্রাম জামশেদপুর থেকে অফিস যাত্রী, ব্যবসায়ী এবং পর্যটকদের ভিড় চোখে পড়ার মতো। প্রায় সবাই প্লাটফর্মে নেমে, গুটিয়ে রাখা হ্যান্ডেল উপরে টেনে, একটু কাত করে বা সোজা রেখে, যত বড় সুটকেসই হোক না কেন দিব্যি গড়িয়ে নিয়ে যেতে শুরু করলেন। চাকা লাগানো সুটকেস, ব্যাগ (যার পোশাকি  নাম 'ট্রলি..') ইত্যাদি কচিকাঁচারাও দিব্যি টানতে টানতে নিয়ে গেল। লাল পোশাকের কুলির দল নীরব দর্শক। প্যাসেঞ্জারের মালপত্র আর মাথায় ওঠে না। বাবু আর দিদিরা 'কোনও ব্যাপার নয়' ভাব নিয়ে ইয়া বড় বড় ব্যাগ সুটকেস গড়িয়ে নিয়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে চলে গেল। দু'এক জনের মাথায় মালপত্র চাপানো হল না যে তা নয়, তবে তা একেবারেই যৎকিঞ্চিৎ। 

আমার আবার ব্যাকপ্যাক। তাই নিয়েই গদাই লস্করি চালে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম ১৯৭৪-এ সত্যজিৎ রায়ের 'সোনার কেল্লা' য় কানপুর স্টেশনে রেলের ফার্স্ট ক্লাস ক্যুপে কুলির মাথা থেকে মালপত্তর নামানোর দৃশ্য আর ভরা শীতে গলা কান টাক বেড় দেওয়া মাফলার আর ঝুপো গোঁফওয়ালা জটায়ুর সংলাপ,  'এই আও আও, সামহালকে সামহালকে... উঁহু জাপানি সুটকেস হ্যায়, ইমপোর্টেড... হা ঠিক হ্যায়, উতারো... লো... তাঙ মাত ক্যারো, কাফি হো গিয়া... জাদা হো গিয়া... যাও... যাআও...'। যাই হোক, পরক্ষণেই মনে হল, ভারী ভারী ব্যাগ সুটকেসের তলায় চাকা লাগানোর বুদ্ধিটা কুলিদের চোখে অবশ্যই 'বদ' গোত্রের, কিন্তু আজকের জটায়ু এবং তাঁর সঙ্গীসাথীদের কাছে বেশ কাজের। সময় এবং টাকা দুটোই বাঁচে। এখানে বুদ্ধির উৎস অবশ্যই প্রাকৃতিক। মানুষকেই মাথা গলাতে হত এখানে। হয়েওছে। হবেও। 

ধরা যাক চাকা লাগানো স্যুটকেসটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন একটি পরিগণক যন্ত্র বা a computing machine with self learning capacity and artificial intelligence। তাহলে অবশ্যই তার মধ্যে পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে নিজেই তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা এবং সেইসব তথ্যের ভিত্তিতে নিজের চলার ধরনের উন্নতি নিজেরই করার ক্ষমতা থাকবে। কীরকম? মানে পরবর্তী পর্যায়ে সুটকেসটাকে আর ঠেলে বা টেনে নিয়ে যাওয়ার দরকার পড়বে না। সেন্সরের সাহায্যে যাত্রী-সন্নিহিত হয়ে নিজেই গড়াতে গড়াতে যাবে। বিপদ একটা অবশ্যই ঘটবে। স্টেশন থেকে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড পর্যন্ত সম্পূর্ণ মসৃণ রাস্তা কখনই হবে না এবং বিপুল জনঘনত্বের হাওড়া স্টেশনে কোনও কিছুর সাথে ধাক্কা লাগবেই। নিশ্চিত। অতএব, পপাত ধরণীতল। বুদ্ধিমত্তার কৃত্রিমতা আপাতত সেখানেই মালিকের প্রাকৃতিক বুদ্ধির কাছে আত্মসমর্পণ করে 'কমা' যতিচিহ্ন দেবে। ',' ব্যবহার করলাম কারণ, প্রাকৃতিক বুদ্ধির তেজ মাসখানেক পরে হাওড়া স্টেশনে পড়ে গিয়ে নিজে থেকে উঠে দাঁড়ানোর প্রযুক্তি ব্যবহার করবে না, এমন কথাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। ফলে, ফেলুদার ভাষায়, 'গণ্ডগোল... বিস্তর গণ্ডগোল'।

১৯৯০'এ গ্র্যাজুয়েশনের মায়াজাল কাটিয়ে এটা-ওটা-সেটার ধান্দায় মাঝেমধ্যে চেষ্টা করছি আর বাপের পয়সা ধ্বংস করে নিউ এম্পায়ার, লাইটহাউস, গ্লোব আর যমুনাতে নিয়মিত হলিউড ফিল্মে সাঁতার কাটছি। আমার অজস্র আকামের মধ্যে এই উৎপটাঙ  ইতিবৃত্তটি উল্লেখ করার একটা নির্দিষ্ট কারণ আছে। হলিউড সিনেমায় SFX (Special Effects) আর VFX (Visual Effects)'এর চোখ ধাঁধানো অথচ নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার। বিশেষত স্টিভেন স্পিলবার্গের কোনও সিনেমাই ছাড়তাম না। ফিল্ম নিয়ে উৎসাহ ছিল কিন্তু পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি। প্রায় কিছুই জানি না। কিন্তু এইসব মুভিতে কম্পিউটার প্রযুক্তির ব্যবহার আমাকে হলমুখি করত। বিশেষ করে গ্রাফিক্স আর অ্যানিমেশনের অমোঘ আকর্ষণ কিছুতেই এড়াতে পারতাম না। সেই প্রথম কম্পিউটার বস্তুটির সাথে প্রেমের শুরু, যার সাথে সংসার আজও চলছে। 

১৯৯৩'এ কমলদার কাছে dBase'এ প্রোগ্রামিং বা আজকের ভাষায় কোডিং-এর হাতেখড়ি আমার। হাতেগোনা কয়েকটি সৌভাগ্যের মধ্যে এটি অবশ্যই আমার কাছে স্মরণীয়। dBase ছিল ডেটাবেসের সামান্য কিছু বৈশিষ্ট্যযুক্ত সফটওয়্যার। তাত্ত্বিকভাবে যথার্থ ডেটাবেস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (DBMS) স্বাদ পেলাম ORACLE'এ। হয়তো অনেকেই জানেন, তবু একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা এখানে বলে রাখি। আমি যে বছরগুলোর কথা বলছি, সেই সময়ে  বাজারে Intel 80x86 series microprocessor (AMD processor ঠেলেঠুলে ভারতের বাজারে ঢোকার চেষ্টা করছে), IBM compatible Personal Computer, Microsoft'এর Single User Disk Operating System (MS-DOS - বেঢপ CRT monitorএর আবলুশ কালো স্ক্রিনে পিটপিট করতে থাকা Cursor), UNIX এর Multiuser Disk Operating System। Memory capacity তখন Giga Byte (GB)'র ধারে কাছেও আসতে পারেনি। কম্পিউটারে সিনেমা দেখা? ইন্টারনেট? সে সব তো অট্টহাসি ছিল। 

এরপর ১৯৯৫'এ ভারতে ইন্টারনেট পরিষেবার শুরু এবং সঙ্গে Microsoft'এর Windows'95 Graphic User Interface'এ আমাদের অভিষেক। অবশ্যই হার্ডওয়ার কোম্পানিগুলো, মানে Processor, Memory ইত্যাদি বসে ছিল না। তারাও সফটওয়্যারের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের উন্নত সংস্করণ বাজারে আনতে বিন্দুমাত্র দেরি করেনি, করেও না। প্রমাণ? ১৯৯০ থেকে ২০২১- একত্রিশ বছরের ব্যাবধানে আমরা  MS-WINDOWS 10, Linux, Ubuntu'র মতো অপারেটিং সিস্টেম পেয়েছি, memory capacity গিগাবাইট টেরাবাইট ছুঁয়েছে, মাইক্রোপ্রসেসর হয়েছে GHz গতি সম্পন্ন multi-core প্রযুক্তি, Cloud computing ছাড়িয়ে Platform-as-a service (PaaS) হতে চলেছে ভবিষ্যতের ওয়েব প্রযুক্তি। বলার কথা এটাই যে, কম্পিউটারের যে তিনটি স্তম্ভ, তার দুটি অর্থাৎ হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার একা বেড়ে উঠতে পারে না। একে অন্যের সাথে তাল মিলিয়ে বাজারে নিজেদের উন্নত সংস্করণের আত্মপ্রকাশ ঘটায়। এ এক নিরন্তর নিরলস প্রচেষ্টা। এত অল্প সময়ে এই অভাবনীয় উন্নতির মূল ভিত্তি মানুষের জন্মগত প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তা, যা আসলে কম্পিউটার প্রযুক্তির তৃতীয় স্তম্ভ।

এবার একটা উদ্ভট প্রশ্ন করি। আপনি কি কখনও কোনও মানুষ দেখেছেন? বেড়াল দেখেছেন? গাছ দেখেছেন? কম্পিউটার দেখেছেন? চারটি উত্তরই 'না'। দেখেননি। তাহলে কি দেখেছেন বা দেখেন? উত্তর: চারটিরই object দেখেন। ধরা যাক 'বেড়াল'। তার শারীরিক গঠন কেমন হবে, গোঁফ থাকবে কিনা, গায়ের রং কীরকম হতে পারে, ম্যাও করবে না ঘেউ করবে নাকি হালুম ডাকবে, শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলি কেমন ভাবে চলতে থাকবে, অর্থাৎ এই  চারপেয়েটির কার্যকলাপ এবং সেই সম্পর্কিত সংগৃহীত তথ্য বেড়াল প্রজাতির সংজ্ঞায় নির্দিষ্ট করা আছে।  একটা শব্দে যাকে 'class' বলে বোঝানো যেতে পারে। আমার বাড়ির পোষা মেনি-টি আদপে স্তন্যপায়ী বেড়াল প্রজাতির একটি উদাহরণ (object) ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষ, গাছ আর কম্পিউটার সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। আমরা সব সময় কোনও না কোনও class'এর object দেখি। Class'এর কোনও বিনাশ হয় না। সৃষ্টিতে সে থেকেই যায়।  ডাইনোসর class'এর সব object ধ্বংস হয়ে গেছে বলেই আমরা বলতে পারি পৃথিবীতে আর কোনও ডাইনোসর নেই। ঠিক তেমনি পৃথিবীর সব বেড়াল হঠাৎ একদিন বিলুপ্ত হয়ে গেলেও আমরা বলতে পারি 'বেড়াল' class'এর  আর কোনও object'কে আমরা দেখতে পাচ্ছি না, যদিও 'বেড়াল' classটি কিন্তু রয়েই গেল। উপযুক্ত পরিবেশ এবং প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করতে পারলেই বেড়ালের object আবার তৈরি করা সম্ভব।  ঠিক এই প্রাকৃতিক ভাবনার ভিত্তিতেই স্পিলবার্গ সাহেব 'জুরাসিক পার্ক' চলচ্চিত্রের সৃষ্টি। 

১৯৯৩'এ কমলদার হাত ধরে অত্যন্ত সাধারণ ডেটাবেস কেন্দ্রিক যে dBase coding দিয়ে শুরু করেছিলাম, তা ২০২১'এ NoSQL, NewSQL আর Big Data'র কড়া নাড়ছে। মাত্র বছর তিরিশের ব্যবধানে সাধারণ ডেটাবেসের তত্ত্ব, তথ্যের কেন্দ্রীভূত শৃঙ্খলাপরায়ণ সংগ্রহের গণ্ডি ছাড়িয়ে আজকের Object Oriented Relational Database Management System'এ পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ অবিশ্বাস্য গতিতে সঠিকভাবে করতে পারছে এবং বিশ্লেষণের উত্তরও স্মরণে রাখতে পারছে। এমনকি পরবর্তী সময়ে সংগৃহীত নতুন তথ্য এবং স্মরণে রাখা (inference engine) অতীতের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে  অভিনব উত্তর খুঁজেও এনে দিচ্ছে‌। সাধারণ ডেটাবেস ভিত্তিক কম্পিউটার সিস্টেম এখন মানুষের চিন্তাভাবনা এবং প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তা কেন্দ্রিক আচরণের অনুসরণকারী 'কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা'য় রূপান্তরিত। 

একটু অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটা কথা এখানে বলি। প্রযুক্তির উদ্ভাবন মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। একই সাথে কর্মসংস্থানের প্রশ্নে তা তুলকালাম কাণ্ড ঘটায়। কাজের সুযোগ সংকুচিত হয়, বেকারত্ব বাড়ে সেটা অতীতে বারবার দেখা গেছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এই সমস্যায় নবতম সংযোজন। যেমন ২০০১'এর কোনও এক শীতের সন্ধ্যায় পরিতোষদা'র সাথে আমার দেখা নিউ মার্কেট চত্বরে‌। ১৯৮১'তে যাদবপুরের ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার। এ কথা সে কথার পর নিজেই বললেন কাজকর্ম ছেড়ে দেবেন। কেন? Digital Electronic Design পরিতোষদার অফিসে থাবা বসিয়েছে। Computer Aided Design (CAD)'এ একটা গোটা প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড তৈরি করে ফেলা যাচ্ছে, একদম সঠিক ভাবে এবং ভীষণ তাড়াতাড়ি, যেটার অভ্যাস পরিতোষদার একেবারেই ছিল না। কাজেই সুটকেস এর নীচে চাকা লাগানোর ফলে হাওড়া স্টেশনের কুলি আর CAD'এর চোখ রাঙানিতে পরিতোষদা'র  মুখ কোথায় যেন এক হয়ে যায়। তাই বলে প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটবে না, সেটাও তো কাম্য নয়।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পক্ষে স্রষ্টাকে অতিক্রম করতে হলে মানুষের সহজাত আবেগ inference engine'এ প্রতিস্থাপন করতে হবে। চিকিৎসাশাস্ত্রে আজকের দিনে অঙ্গ প্রতিস্থাপন সাধারণ ঘটনা এবং সফলভাবে তা ঘটছে। কিন্তু যন্ত্রের মস্তিষ্কে মানুষের সহজাত আবেগ, যার উৎস আজও সম্পূর্ণ অন্ধকারে, তার প্রতিস্থাপন সম্ভব? যদি হয় তাহলে কোনওদিন সাদা দাড়িওয়ালা, লম্বা আলখাল্লা পড়া রোবট আবেগের ঠেলায় আবৃত্তি করে উঠবে:

'আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের পর...'

যদিও এই নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্য আমার কপালে কি জুটবে?


Monday, 14 June 2021

শিক্ষার হালচাল

পরীক্ষা হওয়া না-হওয়া

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত 


তুমুল হল্লা চারিদিকে। লেখাপড়া যে উচ্ছন্নে গেল, তার কী হবে? পড়ানো হয় না, মূল্যায়নের বালাই নেই। এভাবে চলে নাকি?  মূলত মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকেরা ক্ষিপ্ত। তাদের ছেলেমেয়েরা যে আর চাকরি পাবে না! যেন চাকরিই জীবনের লক্ষ্য, ধ্যানজ্ঞান। দোষ দেওয়া যায় না। কেনই বা দোষ দেওয়া, দেবেনই বা কেন? 

মূল্যায়ন নিয়েই কথা শুরু করা যাক। এই রাজ্যের মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ছেলেপুলেদের পরীক্ষা হবে না এই বছর। তা নিয়ে প্রাক্তন কর্তা সুদিনবাবুরা খুব বিরক্ত। এই বিষয় নিয়ে তাঁর একটি লেখা ভাইরাল হয়েছে। স্বীকার করতে সমস্যা নেই যে, তাঁর অভিজ্ঞতা নাকচ করার মতো যুক্তি আমার নেই। কিন্তু, তার যুক্তিগুলো? 

তিনি আক্ষেপ করেছেন শিক্ষায় স্বাধিকার লুপ্ত হচ্ছে দেখে। পরীক্ষা হবে কিনা তার সিদ্ধান্ত কেন নেবেন  মুখ্যমন্ত্রী? তাঁর আমলে তো এমনটা হত না!  তিনি গোপন করেননি জ্যোতিবাবুর আমলের ঘটনা। যদিও সেই ঘটনার বিবরণ থেকে স্পষ্ট যে, সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীই, সুদিনবাবুরা ঘোষণা করেছেন মাত্র। তারপর যে জল গড়াতে গড়াতে 'অনিলায়ন' তথা আলিমুদ্দিনের পার্টি অফিসের দিকে এগোয়, তার কথা ভুলে গেলে চলবে? সেদিন তো সুদিনবাবু প্রতিবাদ করেননি? কেন? সেদিন কেন মেনেছিলেন 'স্বশাসন' মানে দলীয় শাসন? যে কারণে সেদিন আপনি প্রতিবাদ করতে পারেননি, সেই কারণেই (আরও অন্য কারণ নিশ্চয় থাকতে পারে) এ কালের কর্তারা ( কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায়/ মহুয়া দাস) প্রতিবাদ করতে পারেননি। কিন্তু প্রতিবাদ হওয়া উচিত অবশ্যই। কেন মুখ্যমন্ত্রী বা কোনও প্রশাসনিক কর্তা এমন সিদ্ধান্ত নেবেন? 

কেউ কেউ আপত্তি তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রীর  সিদ্ধান্ত নেবার ধরন নিয়ে। কেন ছাত্র-ছাত্রীদের এত বড় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য এত কম সময় দেওয়া হল? প্রশ্নটা যে বহু ছাত্র-ছাত্রীর স্বার্থের পক্ষে না বিপক্ষে যায়, হুজুররা তা কি ভাববেন না? যারা মত দিয়েছেন (স্বেচ্ছায় দিয়েছেন তো!) অনলাইনে, তাঁরা সব শিক্ষার্থীর কত শতাংশ? বাকিদের অধিকার নেই বুঝি? যারা শিক্ষা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেন, তাঁদের কথা না হয় বাদই দিলেন। মোদ্দা কথা, স্বাধিকার আর স্বশাসন। এবং গণতন্ত্র। মুখমন্ত্রী যে পথ বেছে এগিয়েছেন, তা জনপ্রিয় পথ হলেও নিশ্চয় গণতান্ত্রিক নয়। তিনি এগিয়েছেন বটে, কিন্তু শিক্ষা অবশ্যই  পিছিয়েছে। এতে  শিক্ষা ক্ষেত্রে বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধিকার ও গণতন্ত্র আহত হল।

কিন্তু, শিক্ষা তথা তার মূল্যায়নের সঠিক পথটা কী, তা কেউ বলছেন না। সুদিনবাবুর দেশ-বিদেশের শিক্ষার হালচাল নিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও তিনি কিন্তু সম্ভাব্য সমাধানের প্রস্তাব কিছু দেননি। সে আমলে যত জন পরীক্ষা দিত, নম্বর তারা যা পেত, স্বাভাবিক নিয়মে সে সবেরই বদল ঘটেছে। এখন কাড়িকাড়ি নম্বর যারা পায়, তাদের  দোষ দিতে পারি না শিক্ষার গুণগত মান নিম্নমুখি হলেও। পরীক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে বহু গুন।

গোড়াতে বলেছি, মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকেরা কিন্তু ক্ষিপ্ত। মধ্যবিত্ত গণতন্ত্রের এমন অন্তর্জলী যাত্রায় তারা বিমূঢ়। তারা স্বাধীনতা চায় বেশি। তারা চায় তাদের সন্তানরা মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রমাণ করবে যে তারা উচ্চশিক্ষা তথা চাকরির বাজারে প্রবেশযোগ্য। পারিবারিক শিক্ষা বা শিক্ষক-শিক্ষিকারা না বলতে চাইলে না বলুক। অনেক অনেক নম্বর পেয়ে টিভি বিজ্ঞাপনে নয় তারা বলবে, 'আমার এই সাফল্যের পেছনে... '। সমস্যা সেখানেই। মধ্যবিত্ত মানসিকতার মানুষ শিক্ষার মান নিয়ে ভাবে না।

কেউ কেউ নকশাল পর্বের কথাও তুলছেন। সেই সময় বছর নষ্ট হয়েছে, কিন্তু শিক্ষার আপাত-মান বজায় ছিল, তার প্রমাণ চাকরির বাজারে (যা শিক্ষার সাফল্য বলে গৃহীত বহু যুগ ধরেই) তাদের অনায়াস  সাফল্য। শিক্ষকদের অবদানও অনস্বীকার্য। অপমান তাদেরই সইতে হয়েছে যারা প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত হয়নি, যারা প্রতিবাদ করতে শেখেনি। 

প্রশ্ন: তাহলে প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত বলতে কী বুঝি?

এমন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি আগে অনেকবার। তাতে কী? আবারও উত্তর দেব। তবে তা এই লেখায় নয়। এই লেখায় কেবল এইটুকু বলি, সুশিক্ষা যে না পায় সে যেমন সুশিক্ষিত নয়, তেমন নয় সুনাগরিক। সুশিক্ষা সুনাগরিক গড়ে দেয় যার প্রয়োজন দিন দিন বেড়েই চলেছে দেশে দেশে। সুশিক্ষা বাজারের চাহিদা পূরণের শিক্ষা  নয়।


Friday, 11 June 2021

রাখালের কথা

সুবোধ বালক গোপালের বড় হওয়ার ঝঞ্ঝাট!

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


প্রথমে কেন্দ্রীয় স্তরে, পরে রাজ্যেও, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিল ঘোষণা হওয়ায় একটা সোরগোল উঠেছে। এই বুঝি শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান সব রসাতলে গেল। ছেলেমেয়েদের অগাধ ভবিষ্যতেরও আর কিছু রইল না। এ কি ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা? বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই কবেই লিখে গেছেন:

'... গোপাল কখনই লেখা পড়ায় অবহেলা করে না। সে পাঠশালায় যাহা পড়িয়া আইসে, বাড়ীতে তাহা ভাল করিয়া পড়ে; পুরাণ পড়াগুলি দুবেলা আগাগোড়া দেখে।'

আর রাখাল?

'... লেখা পড়ায় রাখালের বড় অমনোযোগ। সে এক দিনও মন দিয়া পড়ে না; এবং এক দিনও ভাল পড়া বলিতে পারে না।'

তাহলে এখন সুবোধ গোপালদিগের কী হইবে? এই মহামূল্য প্রশ্নটি অভিভাবক ও শিক্ষা অনুরাগীদের শুধুমাত্র ব্যতিব্যস্ত রাখেনি, সমাজের প্রায় সকলেরই নানা ধরনের মাথাব্যথা অথবা ব্যথা উপশমের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনও কোনও শিক্ষাবিদ (যেমন সুকান্ত চৌধুরী) পরীক্ষা বন্ধের পক্ষে, তবুও যেন বিতর্ক আর সোশ্যাল মিডিয়ায় খিল্লিবাজী ফুরচ্ছে না। অতএব, শিক্ষা নিয়ে রাখালেরাও এখন দু' কথা পেশ 'করিতে উদগ্রীব হইয়া পড়িয়াছে'। এ হেন রাখালের তাই বিনীত জিজ্ঞাসা, শিক্ষা কাহারে কয়! এবং একবিংশ শতকের দুটি দশক পার করে শিক্ষা আজ কোন তেপান্তরের মাঠে এসে দিকশূন্য পানে দৃষ্টি মেলেছে? 

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’এ শিক্ষা’র অর্থে বলা হচ্ছে: বিদ্যাগ্রহণ, শিক্ষণ, শেখা। আবার, অভ্যাস বা উপদেশ’ও বলা হয়েছে, শাস্ত্র বা বিজ্ঞান অর্থেও ধরা হয়েছে। আরও বহু শব্দের মতো এ শব্দেরও যখন বৈভব এত সুদূর বিস্তৃত ও নানা মাত্রিক, তখন স্বাভাবিক, ‘শিক্ষা’ অঙ্গে কূপমণ্ডুকতার কোনও জায়গা নেই। হক কথায়, শিক্ষা শুধুমাত্র বিদ্যায়তনেই পাওয়া যাবে এমন কোনও বিধান নেই। অর্থাৎ, শিক্ষার আরও বহুবিধ প্রাঙ্গণ থাকতে পারে। সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, শিক্ষার সর্বজনীনতারই বা প্রয়োজন কোথায়? কেনই বা?

এইসব প্রশ্ন মাথার মধ্যে কামড়ালেও নড়াচড়ার কোনও উপায় নেই; কারণ, আজ শিক্ষা বলতে বিদ্যায়তনে শেখা ‘উদ্দেশ্যমূলক’ কিছু পুঁথিপত্রকেই বোঝায়। ‘উদ্দেশ্যমূলক’ এই অর্থে যে, শিক্ষার সঙ্গে মানবতা ও চৈতন্যের সংযোগের গুরুত্বের কথা সর্বাধিক ভাবে তুলে ধরা হলেও, আসলে, ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের পরে কলকারখানার উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে অক্ষর ও মৌলিক পাটিগণিত জ্ঞানসম্পন্ন কিছু লোকজনের বাস্তব প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, যারা নব-উত্থিত অর্থনীতির কারিগরি ও ব্যবস্থাপনার কার্যাদিকে টেনে নিয়ে চলতে পারবে। সেই সুবাদে, সর্বজনীন শিক্ষার উদ্দেশ্য এও ছিল, কিছু ‘শিক্ষিত’ মানবসম্পদ তৈরি করা যারা শিল্পের কাজে লাগবে। আর তা গুটিকয়েক নয়, অজস্র পরিমাণে। কারণ, তখন শিল্পের অতি প্রসারের যুগ। ফলত, গড়ে উঠতে থাকল অগণিত স্কুল এবং পরবর্তীকালে কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষণ প্রতিষ্ঠানও।

শিল্পের জন্য এই তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় কাজের মানবসম্পদ ছাড়াও দরকার পড়েছিল আরও দু’ রকমের শিক্ষা। শিল্প বিপ্লবের অভিঘাতে প্রযুক্তি-নির্ভর পুঁজিবাদী সমাজের বৈপ্লবিক উত্থান যখন কঠোর বাস্তব তখন স্বভাবতই বিজ্ঞান-প্রযুক্তির গবেষণা ও উদ্ভাবন হয়ে পড়ল তার দোসর। পাশাপাশি, দায় ছিল এই নব সমাজকে যুক্তিগ্রাহ্য করে টিকিয়ে রাখার, আর তার জন্যই ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন এইসব ক্ষেত্রেও শিক্ষা ও চর্চা হয়ে পড়েছিল অতীব প্রয়োজনীয়। অর্থাৎ, সামন্তবাদ ও রাজতন্ত্রের জোয়াল ভেঙে ইউরোপীয় সমাজ তখন যে নতুন রাজনৈতিক-আর্থনীতিক দিগন্তে প্রবেশ করছিল, তার গড়ে ওঠা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নানা মাত্রার এক সর্বজনীন ও সর্বাঙ্গীণ শিক্ষাব্যবস্থার আয়োজন অবশ্যম্ভাবী ছিল। বলার উদ্দেশ্য এই, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা পত্তনের জন্য যতটা না মহত্ত্ব বা পবিত্রতাকে শিরোপা দেওয়া হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি তা ছিল সামাজিক-অর্থনৈতিক চাহিদা বিশেষ; নতুবা, নতুন গড়ে উঠতে থাকা শিল্প-আধার ও ব্যবস্থাপনা বিফলে যাবে।

এ তো গেল পুরনো দিনের কথা! আজ কিন্তু সর্বজনীন শিক্ষার সে প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তাই শিক্ষা অঙ্গনেরও ভোলবদলের দিন। সে কথা বুঝছে কে!

ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম প্রকাশিত (২০২০) ‘ফিউচার অফ জবস সার্ভে’ প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে, আজকের কর্মজগতের অর্ধেক কাজই ২০৩০ সালে অচল হয়ে যাবে। তা শুধু প্রযুক্তিগত অর্থে নয়, কাজের ধরন ও মর্মবস্তুতেও। দেখাই যাচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উদ্গত নতুন যে কাজের পরিসর উঠে আসছে সেখানে সৃজনশীলতা,  যুক্তিগ্রাহ্যতা, নিখুঁত অ্যালগরিদম, সমস্যার প্রতি সংবেদনশীলতা এইসব গুণ ও দক্ষতা অতীব জরুরি; যেখানে মনুষ্য শ্রমের অভিমুখটা হল বৌদ্ধিক ও নমনীয় কাজের দিকে আর যন্ত্রের দখল গতি ও নিপুণতার দিকে। শিক্ষাব্যবস্থারও তাই অনুরূপ পরিবর্তনের অনুসরণ বিনা চলবে কেন? অতএব, গোড়ায় শিল্প বিপ্লবের উপযুক্ত যে শিক্ষাব্যবস্থার পত্তন, সেখানে কচিকাঁচাদের নিয়মানুবর্তী, বাধ্য, ভদ্র পানে নির্মাণ করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল যথাযথ শ্রমশক্তি পাওয়ার অভিলাষে। সারি সারি বেঞ্চে সারিবদ্ধ হয়ে বসে সম্মুখ পানে চেয়ে শিক্ষকের পড়ানোকে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে আত্মস্থ করার যে শিক্ষা মডেলটি তৈরি হয়েছিল, তা তৎকালীন শিল্পব্যবস্থার কাঠামোগত ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই। আজ সে সবের দিন ফুরিয়েছে। অনলাইন শিক্ষার আগমনে ক্লাসে সারিবদ্ধ বসে পাঠ নেওয়ার পুরনো ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প ঘরানার ব্যবস্থা আজ অস্তাচলে। বহু কিছু আজ অচল। অর্থনীতির মূল্য নির্মাণে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের ভাগ ক্রমশই সংকুচিত হয়ে আসায় সারিবদ্ধ, শৃঙ্খলাপরায়ণ শ্রমিক বাহিনী তেমন প্রধান প্রয়োজনীয় নয় আর। ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পেও আজ অটোমেশনের ব্যাপক চল। শিক্ষায় মুখস্থবিদ্যা ও হাতের লেখার জমানাও শেষ। বৌদ্ধিক কাজই যখন মনুষ্য শ্রমের প্রধান অঙ্গন হয়ে উঠতে চাইছে তখন গুগল হাতড়ে তথ্যের সমাহারকে বিশ্লেষণ করাটাই হবে মুখ্য; সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ ও নৈতিক বিচারের গুণসম্পন্নতাই হবে সাফল্যের চালিকাশক্তি।

এই নবশিক্ষা কীভাবে অর্জিত হবে? অর্থাৎ, এর কাঠামোগত বিন্যাসটি কেমন হবে? অবশ্যই এই শিক্ষাব্যবস্থার লাগাম চলে যাবে বড় বড় কর্পোরেটদের হাতে। মাধ্যমিক স্তর অবধি একটি সাধারণ পাঠক্রিয়া থাকবে, কিন্তু তারপরে গড়ে উঠতে থাকা কর্পোরেট স্কুলই হবে শিক্ষার মূল অভিযাত্রা। ধীরে ধীরে তিন কি চার বছরের ডিগ্রি প্রাপ্তির কাঠামোটাই হয়তো সেকেলে হয়ে যাবে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট’এও (২০১৯) এ বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা হয়েছে। সোজা কথায় বললে, কর্পোরেট স্কুলগুলি মাধ্যমিক (বা উচ্চ মাধ্যমিক) উত্তীর্ণ ছেলেমেয়েদের তাদের নিজ নিজ বিচারে বাছাই করে এনে দু-এক বছরের উপযুক্ত নির্দিষ্ট কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত করে স্ব স্ব কর্মজগতে নিয়োগ করবে। সেই স্কুলে তাদের সর্বশেষ প্রযুক্তি ও রীতিনীতিতে অভ্যস্ত করে তোলা হবে। কাজে প্রবেশ করার পরে আবারও যখন প্রযুক্তিতে বদল আসবে তখন ফের তাদের স্কুলে ফেরত পাঠিয়ে স্বল্পকালীন কোর্সে আপডেটেড করে নেওয়ার আয়োজন থাকবে। এইভাবে পুরনো শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে উঠে আসবে কর্পোরেট চালিত এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে শিক্ষার সঙ্গে কাজের একটা সরাসরি ও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক পালটে দেবে এতদিন চলে আসা শিক্ষার সামগ্রিক কাঠামোটাকেই। অবশ্য, চলতি শিক্ষাব্যবস্থার একটা ক্ষীণ অবয়ব থেকে যাবে যেখান থেকে অন্যান্য প্রয়োজনীয় মানবসম্পদের জোগান মিলতে পারে। যেমন, সরকারি বা সামরিক বাহিনীর কাজের লোক কিংবা সাধারণ স্কুল-কলেজ চালানোর জন্য শিক্ষক অথবা যারা স্বউদ্যোগী হয়ে উঠতে চান। সে কাজের এক্তিয়ারই বা আর কতটুকু। এ ব্যতিরেকে যা পড়ে থাকবে তা ঘোড়ার ডিম বই আর কিছু কী!

আসলে, শিক্ষা বলতে যে গাম্ভীর্য ও ঔদার্যে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রভূত কদর করা হয় তার কার্যকারিতা কিন্তু লাভজনক উপায়ে কর্মক্ষম হয়ে ওঠার মধ্যেই। এর সঙ্গে মানবতা, দার্শনিকতা, চৈতন্য বা পরম উপলব্ধির আশু কোনও সম্পর্ক নেই। কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ অবশ্য এই শিক্ষাব্যবস্থার কন্দর থেকেই বেরিয়ে আসেন উচ্চ চেতনার বিশেষত্ব নিয়ে। তা তাঁদের স্বগুণে অর্জিত, অন্য কোনও চৈতন্যের আলোকে, শিক্ষাব্যবস্থার অন্দর থেকে সম্ভবত নয়। মনে করে দেখুন, সত্যজিতের ‘আগুন্তুক’ ছবিতে মনমোহন মিত্রের সেই অমোঘ বাচনটিকে যেখানে তিনি বলছেন, সভ্য হল সেই মানুষ যে একটি বোতাম টিপে গোটা শহরকে নিমেষে নিঃশেষ করে দিতে পারে আর আরও সভ্য হল সে যে এই সিদ্ধান্ত নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। আধুনিক এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই তো বোতাম টিপে একটি শহরকে ধ্বংস করার বিদ্যা অর্জিত হয়েছে আর সে কাজ যারা করে তারা তো সেই শিক্ষাব্যবস্থায় সফল হয়ে নির্গত হওয়া মনুষ্যকুলই। সেই শিক্ষাব্যবস্থার প্রত্যক্ষ দায়িত্ব তো আজ তারাই (কর্পোরেট) নেবে যারা এর কর্মফলের বৃহত্তম ভাগটা আত্মসাৎ করে।

অতএব, শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্গত এই রহস্যটা বুঝে গেলে আর আক্ষেপ থাকে না যে 'শিক্ষিত মানুষ' কেন অমানবিক বা ক্রুরতম আচরণ করে; গোপাল কেন বড় হয়ে আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর 'সুবোধ' এক ধেড়ে খোকা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা তাই সব সময়েই এক সোনার পাথরবাটি বিশেষ যাকে নিয়ে বোকা মানুষের আতিশয্য এবং লাভের গুড় ঘরে তোলা কর্মপটু চালাক মানুষের স্বার্থসিদ্ধি, দুইই প্রায় সমান তালে চলে। তার রূপান্তর আসলে স্বার্থগন্ধী অর্থনীতি উদ্ভুত মুনাফার রকমফেরের কাহিনি। প্রকৃত শিক্ষার জগৎ অন্য স্তরে, অন্য লয়ে, ভিন্ন অবকাশে স্থিত। তাকে ধরার প্রক্রিয়া এক অন্য নিবিড় সাধনার প্রচেষ্টা। সে গল্প আলাদা।