Tuesday, 22 June 2021

জি-৭ রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈঠক

ভ্যাকসিন প্রস্তাব

পর্বতের মূষিক প্রসব

শোভনলাল চক্রবর্তী


নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জী এবং এস্থার ডুফলো 'গার্ডিয়ান' পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে সম্প্রতি মত প্রকাশ করে জানান যে, বিশ্ব জুড়ে চলতে থাকা জলবায়ুর সংকটকে অতিক্রম করার জন্য সবার আগে দরকার কোভিডের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বব্যাপী গণটিকাকরণ। ওই প্রবন্ধে তাঁরা স্পষ্ট করে বলেন যে, ধনী দেশগুলি যদি গরিব দেশগুলোকে টিকাকরণে সাহায্য করতে এগিয়ে না আসে, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ধনী দেশগুলির জেহাদ নেহাতই কথার কথা হয়ে থেকে যাবে। 

এই বছরের শেষে বিশ্বের ৪০ শতাংশ এবং বাকি ৬০ শতাংশ নাগরিককে ২০২২'এর প্রথম ছয় মাসের মধ্যে টিকাকরণ করতে খরচ পড়বে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। টাকার পরিমাণটি এমন কিছু বড় নয়। কারণ, ভুলে গেলে চলবে না, আমেরিকার সামরিক খাতে বার্ষিক বাজেট ১৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অতিমারির শুরুতে সবাই মিলে গলা মিলিয়ে যেমন 'আমরা করব জয়' বলছিলেন, সেই তালের আচমকা ছন্দপতন ঘটল বাজারে টিকা এসে যাওয়ার পর। তখন সবাই মিলে করোনা যুদ্ধ লড়ার প্রতিশ্রুতি ভুলে, যার-যার তার-তার নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে উঠল। এর ফল হল এই যে, ধনী দেশগুলি যাদের জনসংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ, তারা সবাই মিলে মোট উৎপাদিত টিকার ৫০ শতাংশ কিনে নিল। এদিকে গরিব দেশগুলোতে যেখানে ২ বিলিয়ন টিকা লাগবে সেখানে জুটল মাত্র ৮০ মিলিয়ন। 

অতিমারির বিরুদ্ধে লড়তে গেলে সবার টিকা লাগবে- এ ব্যাপারে কারওর দ্বিমত নেই। ধনী দেশগুলি এগিয়ে এসে যদি গরিব দেশগুলির পাশে না দাঁড়ায়, তবে সার্বিক টিকাকরণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। টিকাকরণ প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ না করতে পারলে ভাইরাস তার রূপ বদলে এমন একটি গঠনতন্ত্র তৈরি করতে পারে যখন এই টিকায় আর কাজ হবে না। এমন একটা প্রেক্ষাপটে এবারে গ্রেট ব্রিটেনে অনুষ্ঠিত জি-৭'এর শীর্ষ বৈঠকের দিকে অনেকে নজর রেখেছিলেন। কিন্তু হতাশ করল ওই বৈঠক। সাতটি ধনী দেশের ওই সংযুক্ত মঞ্চ থেকে গরিব দেশগুলোকে ১ বিলিয়ন টিকা দেওয়া হবে এই ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু স্পষ্টতই এই ঘোষণায় না আছে কোভিডের বিরুদ্ধে লড়বার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, না আছে টিকাকরণ প্রক্রিয়ায় গতি আনার কোনও প্রয়াস। দেখাই যাচ্ছে, পশ্চিমের নেতারা কোভিড মোকাবিলায় এখনও নিজেদের মানসিকতাকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারেননি। যদি গড়ে তুলতে পারতেন, তবে শুধু ১ বিলিয়ন টিকা দেওয়া হবে বলে তাঁরা থেমে থাকতেন না। কীভাবে এই টিকা বিতরণ হবে, কোন উপমহাদেশের কোন কোন দেশ এই টিকা পাবে- সে সমস্ত রূপরেখা আমরা দেখতে পেতাম। কিন্তু সে সবের কোনও খোঁজ আপাতত নেই। এই টিকাকরণ যে একটা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় হওয়া দরকার, তার কোনও ইঙ্গিত জি-৭ নেতৃত্ব দিতে পারেননি। সবচেয়ে বড় কথা, এই ১ বিলিয়ন টিকা প্রয়োজনের তুলনায় নস্যি। 

শোনা যাচ্ছে, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জো বিডেন এবং ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ব্যক্তিগত উদ্যোগে আরও ৬০০ মিলিয়ন টিকার বন্দোবস্ত করছেন। কিন্তু এ সবই সিন্ধুতে বিন্দু। বরিস জনসন সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছেন যে তাঁরা সারা দুনিয়াকে প্রায় ৮ বিলিয়ন টিকা দিতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু কীভাবে? কাকে দেবেন সেই টিকা? ধনী দেশগুলি যে বাড়তি টিকা মজুত করে রেখেছে তার কী হবে? এসবের উত্তর কেউ জানেন না। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে গরিব দেশগুলিতে টিকাদান নিশ্চয়ই একটি সঠিক পদক্ষেপ, কিন্তু পরিস্থিতির বিচারে এই পদক্ষেপ একেবারেই নাবালক। ভাইরাসকে হারাতে গেলে যে তৎপরতা এই মুহূর্তে প্রয়োজন তার ধারেকাছেও নেই জি-৭'এর উদ্যোগ। প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন বহুদিন ধরেই বলে আসছেন যে টিকা বৈষম্য দূর করতে গরিব দেশগুলির পাশে দাঁড়াতে হবে ধনী দেশগুলোকে। জি-৭'এর টিকা বিলির ঘোষণাকে তিনি বলেছেন, এ যেন ভিক্ষাপাত্রকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে রাস্তায় দুটো পয়সা ফেলা। ইউএন'এর তরফে বলা হয়েছে, আগামী দু' সপ্তাহের মধ্যে যদি আমাদের হাতে একটি 'কোভিড প্ল্যান' না এসে পৌঁছয় তবে এই অতিমারি এক অন্য বিপর্যয়ের চেহারা নেবে। 'কোভিড প্ল্যান' বলতে তাঁরা বোঝাতে চেয়েছেন একটি বিশ্বব্যাপী টিকাকরণের সূচি এবং সুনির্দিষ্ট সময়ের উল্লেখ, যে সময়ের মধ্যে ওই কর্মসূচি শেষ করা হবে। 

আশা করা গিয়েছিল, জি-৭ বৈঠক এই অভিমুখে কিছু পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু তেমন কিছুই হল না। যে অতিমারিতে ২১০টি দেশের ১৭৫ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত, বিশ্ব অর্থনীতি জেরবার, তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ জি-৭ শীর্ষ বৈঠক। টিকাকরণ কর্মসূচির সঙ্গে যে ধনসম্পদ এমন ভাবে যুক্ত হয়ে পড়বে তা কেউ কল্পনাতেও আনতে পারেননি। তাই এই মুহূর্তে দিশেহারা পরিস্থিতি, বিশেষ করে গরিব দেশগুলোতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, ইজরায়েল এবং বাহারিন টিকাকরণের দৌড়ে অন্যান্য দেশের তুলনায় বহু গুন এগিয়ে। এখনও পর্যন্ত বিশ্ব জুড়ে ২.২ বিলিয়ন মানুষকে টিকাকরণের আওতায় আনা গেছে। যেহেতু প্রতি ব্যক্তিকে এ ক্ষেত্রে দুটি করে টিকা দিতে হবে এবং পরবর্তীতে বুস্টার ডোজ দেওয়ার দরকার পড়তে পারে, সেই জন্য অক্সফামের মতে, এই অতিমারি শেষ করতে প্রয়োজন আরও ১১ বিলিয়ন ডোজের টিকা। শুধু যে এই টিকা উৎপাদন করলেই কাজ হবে তা নয়, যেটার সবচেয়ে আগে প্রয়োজন তা হল সমস্ত দেশে টিকার সুষম বন্টন। এই বন্টনের পেছনে একটি বড় অন্তরায় মেধাস্বত্ব সংক্রান্ত আইনকানুন। জি-৭ বৈঠকে মেধাস্বত্ব আইন অতিমারি পরিস্থিতিতে শিথিল করার আবেদন করেছেন মার্কিন ও ফরাসি রাষ্ট্রপতি। তাঁদের এই আবেদনে কোনও কাজ হয় কিনা সেটাই দেখার। 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী এই বৈঠকে অনলাইনে বক্তব্য রেখেছেন। তিনি অনেক কথা বলে আসলে কিছু না বলাকে প্রায় একটি শিল্পকলায় পরিণত করেছেন। সেই কলার এক ঝলক তাঁর বক্তব্যে আমরা দেখলাম। দেখলাম বলছি কারণ, শুনে কিছুই বুঝিনি। সংবাদে প্রকাশ, তিনি নাকি ওই বক্তৃতায় বলেছেন, ভারতের গণতান্ত্রিক ভিত্তির এমন জোর যে স্রেফ সেই জোরেই ভারত অতিমারি অতিক্রম করবে। প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্র সম্পর্কে বিশ্ববাসীর সামনে বলেছেন শুনে সেই ঢাকাই কুট্টির কথা মনে পড়ল, 'আস্তে কন কত্তা, ঘোড়ায় হাসব।'


1 comment:

  1. বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর সংকটকে কীভাবে "টিকা" দিয়ে অতিক্রম করা যাবে সে-ব্যাপারে কি নোবেল জয়ীরা কিছু জানিয়েছেন?
    আর জলবায়ু কেন, বিশ্বব্যাপী যেকোনও সংকট তো ধনী দেশগুলোর অবদান বলেই জানতাম। অন্যভাবে বললে, দুনিয়ার যাবতীয় কুকর্ম তো শিক্ষিত লোকেদের হাতেই ঘটে থাকে। সেই সংকট থেকে পরিত্রাণের জন্য ধনী দেশগুলো অন্য দেশগুলোকে সাহায্য করবে এ অতি দুরূহ তত্ত্ব।
    টিকা বাজারে আসার পর তার বণ্টনে যে অসাম্য থাকবে তা জানা। কিন্তু "অতিমারির বিরুদ্ধে লড়তে গেলে সবার টিকা লাগবে- এ ব্যাপারে কারওর দ্বিমত নেই", এ আবার কেমন কথা? দ্বিমত তো আছেই। তাছাড়া টিকা না-নিলে ভাইরাস তার রূপ বদলে ফেলবে, এ তো ছেলেভোলানো কথা। ভাইরাস কেন তার রূপ বদলায় তার কারণ আর ব্যাকরণ ডাক্তারি শাস্ত্রে আলোচনা করা আছে, আলোচনা চলছেও। ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা আছে বহুদিন ধরে। তাতে কিন্তু ওই ভাইরাসের রূপ বদলানো বন্ধ হয়নি!
    শুধু টিকা কেন, যেকোনও বিশ্বসম্পদের সুষম বণ্টন দরকার। ঠিক কথা। কিন্তু সেই অসাম্য নিয়ে ধনী দেশগুলোকে গাল দেওয়ার আগে নিজের দেশের দিকে তাকালে দেখব, এখানে তো অসাম্য তৈরির কারখানা!
    জি-৭-এ যা হয়েছে তার চেয়ে অন্য কিছু কি আমাদের প্রত্যাশিত ছিল? আর প্রধান জনসেবকের কাছ থেকেই বা অন্য কী আশা করতে পারি?

    ReplyDelete