Wednesday, 11 March 2020

করোনা'র সত্যি মিথ্যে

করোনা_কথা
ডাঃ সব্যসাচী সেনগুপ্ত
এই মুহূর্তের দুনিয়া কাঁপানো ঘটনাটার শুরুয়াৎ হয়েছিল ২০১৯-এর নিউ ইয়ার্স ইভ-এ। অর্থাৎ, দিনটা ছিল, দু হাজার উনিশ সালের ক্যালেন্ডারের শেষ দিনটি।

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৯।

চিন দেশের উহ্হান ( Wuhan) শহরের মিউনিসিপাল হেল্থ কর্পোরেশন ঘোষণা করল একটি নতুন তথ্য। ২৭ জন রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে হঠাৎ করে, যাঁরা নিউমোনিয়া জাতীয় রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এবং যাঁদের নিউমোনিয়া রোগটি ঠিক কোন্ জীবাণুর কারণে হয়েছে, এখনও ধরা যায়নি। এঁদের মধ্যে সাতজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

তথ্যটি চমকপ্রদ। তবে তার চাইতেও চমকপ্রদ হল, আরেকখানি লেজুড় ইনফর্মেশন। এই সাতাশ জনের প্রায় সকলেই উঁহ্হানের সী ফুড হোলসেল মার্কেটের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িত। হয় তাঁরা সেখানে কাজ করেন, না হয় তাঁরা সেই মার্কেটের খরিদ্দার, আর নয়তো এইরকম কোনও মানুষের আত্মীয় পরিজন। এ কয়টি তথ্য স্বাস্থ্য বিশারদদের কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। হোক না রোগীর সংখ্যা মোটে সাতাশ। কিন্তু, ১) তাঁদের রোগের জীবাণুটিকে এখনো চেনা যায়নি; ২) সক্কলেই একটি কমন লিংক/সোর্স দেখাচ্ছেন ( সী ফুড হোলসেল মার্কেট)।
পদক্ষেপ নেওয়া হল তড়িঘড়ি। নতুন বছরের প্রথম দিনেই তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হল মার্কেটটিতে। 'আইসোলেশন' অর্থাৎ জনগণের থেকে আলাদা করে দেওয়া হল সাতাশ জনকেই। রাখা হল হাসপাতালের স্পেশাল ওয়ার্ডে। এবং তারই সাথে জোরদার ভাবে খোঁজ শুরু হল, এই জাতীয় আর কোনও নতুন রোগীর সন্ধান পাওয়া যায় কি না।

সন্ধান মিলল দ্রুত। পাঁচই জানুয়ারির হিসাব বলছে, আরও বত্রিশ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। যাঁদের রোগের উপসর্গ (কাশি, জ্বর, নিঃশ্বাসের কষ্ট) শুরু হয়েছে ১২ থেকে ২৯শে ডিসেম্বর ২০১৯ নাগাদ। অর্থাৎ, এই রোগীরা এতদিন ঘাপটি মেরে বাড়িতে বসেছিলেন। মোট রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো ৩২+২৭=৫৯। যাঁদের কারওরই রোগের জীবাণুটি ধরা যাচ্ছে না এখনও। এবং এই ছয়দিনে স্বাস্থ্যকর্মীরা মোটামুটি নিশ্চিত যে, এটি অজানা, অদেখা কোনও ভাইরাস অথবা ব্যাকটেরিয়ার কান্ড।

প্রথম জয় এল নয় তারিখে। ৯ জানুয়ারি, ২০২০। সিডিসি ( সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন) সারা পৃথিবীর সামনে ঘোষণা করল, ৫৯ জনের মধ্যে ১৫ জনের শরীরে পাওয়া গেছে নতুন প্রজাতির করোনা ভাইরাস (2019 -nCoV )। ২০১৯ নোভেল করোনা ভাইরাস। দশই জানুয়ারি- যে ভাইরাসের 'জিনোম সিকুয়েন্স' তুলে ধরা হল সমগ্র বিশ্বের সামনে। আর সমস্ত স্বাস্থ্যবোদ্ধারা অবাক হয়ে দেখলেন নতুন শত্রুর খোলনলচে।

এর ঠিক একদিনের মাথায় ঘটল প্রথম পরাজয়। প্রথম মৃত্যু ঘটল এই নতুন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। তারপর ষোলই জানুয়ারি, আরও একজনের। এবং শেষ খবর পাওয়া অবধি, এই রোগ আর শুধু চিনের উঁহ্হান শহরে সীমিত নেই। সারা পৃথিবী জুড়ে মোট এক লক্ষ দু হাজার একশো বত্রিশ জন আক্রান্ত হয়েছেন করোনা ভাইরাসে। ভারতবর্ষে ৩১ জন (ব্লগে লেখাটি প্রকাশের সময় ৫২)। বারোই জানুয়ারিতে নামকরণ করা হয়েছে যে ভাইরাসের --
SARS-CoV-2। সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম করোনা ভাইরাস ২।

কেন ২? কেন ১ নয়? সে সবে আসছি পরে।

দুই

বিশ্বজিৎদা আমার বড্ড প্রিয় একজন মানুষ। ডঃ বিশ্বজিৎ রায়। প্রথমত, এরকম টগবগে, চনমনে, উৎসাহী, কর্মোদ্যমী মানুষ আমি খুব একটা দেখিনি। দ্বিতীয়ত, এই ভদ্রলোকই আমাকে এক প্রকার জোর করে তুলে এনেছিলেন জলপাইগুড়ি টিবি হাসপাতালে। প্রায় তিন বছরের প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের একঘেয়ে জীবন ফেলে, শহর জলপাইগুড়ির স্বাদ চাখবার সুযোগ মিলেছিল আমার।

সময়টা তখন দু হাজার দশের শেষাশেষি। এক হাড় কাঁপানো ঠান্ডার সন্ধ্যাতে সাপ্টিবাড়ি প্রাইমারি হেলথ সেন্টার সংলগ্ন কোয়ার্টারের বারান্দাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছি। সামনের মাঠে ঠাসা কুয়াশা। কুয়াশা আমার ওই ব্যালকনিতেও। কপাল, ঠোঁট, নাকের আগা আর হাতের আঙুল ভিজে ভিজে যাচ্ছে হিমশীতল কুয়াশা পরশে। বাদবাকি অংশ গরম জামা কাপড়ে ঢাকা। সহসা, চরাচর ব্যাপী নিস্তব্ধতা খানখান করে বিচ্ছিরি শব্দে আর্তনাদ করে উঠল আমার নোকিয়া (মডেল নাম্বার ২৩০০) । চমকে উঠে, চায়ের কাপ মাটিতে নামিয়ে, পকেট থেকে ফোনটা বের করতে করতে আবিষ্কার করলাম, আমার হাতগুলো অবশ হয়ে গেছে প্রায় পুরোপুরিই। আর ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট স্ক্রিনে ব্লিংক করছে: ডিটিও। অর্থাৎ, ডিস্ট্রিক্ট টিবি অফিসার।

পরবর্তী কথোপকথনটা ছিল নিম্নরূপ:

- সব্যসাচী...
- হ্যাঁ বলুন স্যার।
- তোকে ভাবছি সদরে তুলে নিয়ে আসব। টিবি হাসপাতালে।
- স্... সদরে? জলপাইগুড়ি?
- হুম! মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবির জন্য এই হাসপাতালটা সিলেক্ট হয়েছে। নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজেই হওয়ার কথা ছিল। শিলিগুড়িতে। ওদের মুখের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি আমি। ইট উইল বি অ্যান অনার অ্যান্ড প্রাইড ফর জলপাইগুড়ি। অ্যান্ড... আই ওয়ান্ট ইউ দেয়ার। তোকে চাই আমার এখানে।
- জ্.. জলপাইগুড়ি টাউন? সো... সত্যি বলছেন? স্যার?
- হুম। সিএমওএইচ-এর সাথে কথা হয়ে গেছে। বণিক স্যার তোকে চেনেন। খোঁজ খবর রাখি আমরা সবাই। ইউ আর দা ম্যান। চলে আয়। অর্ডার হাতে পাবি শিগগিরই।
- স্যার...
- অনেক আশা নিয়ে তুলে আনছি সব্যসাচী। আমার নাক কাটাস না। চাপ আছে। প্রচুর চাপ আছে কাজের এখানে। নতুন ইনফ্রাস্ট্রাকচার গড়ে তোলা চাট্টিখানি কথা না কিন্তু! রাজি আছিস?
- হ্যাঁ.. হ্যাঁ স্যার
- গুড। চেপে রাখ খবরটা। কেউ কাঠি করতে পারে। রাখছি। বাই।

এর ঠিক দেড় মাসের মাথায় জলপাইগুড়ির রাণী অশ্রুমতী টিবি হাসপাতালের দায়িত্ব নিই আমি। একা। সিঙ্গল হ্যান্ডেড। পশ্চিমবঙ্গে তখন সদ্য শুরু হয়েছে মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবির চিকিৎসা। দক্ষিণে যাদবপুর কেএসরয় হাসপাতালে। আর উত্তরে, এই আমার এখানে। নির্দিষ্ট কোনও গাইডলাইন তৈরি হয়নি তখনও এমডিআর টিবির চিকিৎসার। যেটুকু যা আছে, সবটাই ফ্লেক্সিবেল। নমনীয়। পরিস্থিতি বুঝে পরিবর্তন ঘটানোর সুযোগ আছে চিকিৎসা পদ্ধতির। পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, সমগ্র ভারতবর্ষ তখনও শিখছে এ রোগের চিকিৎসা। শিখছে, এবং আবারও নতুন করে শিখছে, দৈনিক নিত্য নতুন 'কেস স্টাডি' করে। সেই যুদ্ধের প্রথম দফা থেকে যোগদান করলাম আমিও।

যেহেতু তখন জাস্ট শুরুয়াৎ, সেইহেতু বিবিধ প্রশ্ন আর বহুবিধ অজানা ভয় কাজ করত আমাদের মনে। বিশেষত, রোগটি যখন প্রাণঘাতী। বিশেষত, রোগটি যখন সংক্রামক। ছড়িয়ে যায় একজনের থেকে অন্যজনের মধ্যে।
আর ঠিক এইরকম একটা সময়েই ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন (WHO) আর ইউনাইটেড স্টেটস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (USFDA)-এর যৌথ উদ্যোগে একটা ভিজিট কাম ট্রেনিং হল আমার হাসপাতালে। যাঁরা এসেছিলেন এবং যাঁরা ট্রেনিং দিয়েছিলেন, সকলেই 'এয়ারবোর্ন ইনফেকশন কন্ট্রোল'/ 'বাতাসে ছড়িয়ে পড়া অর্থাৎ বায়ুবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ' দফতরের আন্তর্জাতিক দিকপাল। প্রথম ট্রেনিংটা পেলাম হাসপাতালেই। আর দ্বিতীয়টার জন্য যেতে হল কলকাতা। সেইবারেই প্রথম ফাইভ স্টার হোটেলে থাকবার সুযোগ পাই আমি। বদান্যতায় ওই WHO এবং USFDA।
যা শিখেছিলাম ঠিক তাই তাই দরকার এই করোনা ভাইরাস আটকাতে হলেও। বস্তুত, যে কোনও রোগ, যা হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে ছড়ায়, সে রোগ টিবি হোক বা করোনা, নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি একই।

আমরা সে সব মেনে চলি না। আমরা... সেসবেরই মূল্য চোকাচ্ছি।

তিন

ট্রেনিং-এর মূল বক্তব্য ছিল খুব সিম্পল। ভালো করে মন দিয়ে পড়বেন। এই কয়টি মেনে চললেই আপনাদের 'অধুনা আতঙ্ক' করোনা ভাইরাস তো নিয়ন্ত্রিত হবেই, সাথে সাথে থেমে যাবে টিবি রোগও।

জানেন কি যে, করোনা ভাইরাসে এ যাবৎ সব মিলিয়ে মারা গেছেন ৩৪৮৮ জন?  আর টিবি রোগে প্রতিদিন, প্রত্যেকটি দিন মারা যান প্রায় ৪৩২০ জন ?

আসুন, নিয়মগুলি বলি।

১) হাঁচি বা কাশির সময়, তালু নয়, বাহু ঢেকে হাঁচুন/ কাশুন (নিচে ছবি দ্রষ্টব্য), দৈনন্দিন কাজের সময় করতল বারবার ব্যবহার হয়, তাতে সংক্রমণ ছড়ায়।


২) হ্যান্ডশেক পরিত্যাগ করে, মেক ইন ইন্ডিয়া এবং সত্যজিৎ খ্যাত 'কেমন আছেন নমস্কার' করুন।

৩) যেখানে সেখানে কফ থুথু ফেলা বন্ধ করুন।

৪) কথায় কথায় নাকে মুখে কিংবা চোখে হাত দেওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করুন। এতে ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।

৫) খামোখা সিঁড়ির হাতল ধরে ওঠা নামা করবেন না।

৬) সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক পরে লাভ নেই খুব একটা। এমনকি N 95 জাতীয় মাস্ক পরেও নয়। কারণ, যদি সঠিক পদ্ধতিতে আপনি N 95 পরেন, অর্থাৎ টেনে ব্যান্ড বেঁধে এবং নাকের ব্রিজ চেপে, তবে এই মাস্ক পরে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। দম আটকে আসে। দ্বিতীয়ত, এই মাস্ক পরলেও সংক্রমণ আটকানোর সম্ভাবনা ৯৫ শতাংশ। টিবি কিংবা করোনা 'ড্রপলেট'এর মাধ্যমে ছড়ায়। সেই ড্রপলেট আটকাতে হলে বরং উল্টে, যারা হাঁচি বা কাশিতে ভুগছেন, মাস্ক পরা উচিত তাঁদেরই। সেটা সাধারণ সার্জিকাল মাস্ক হলেও চলবে।

৭) চেষ্টা করুন খোলামেলা আবহাওয়ায় থাকতে। বিশেষত, যাঁরা স্বাস্থ্যকর্মী। যাঁদের প্রতিনিয়ত দেখতে হয় হাঁচি কাশিওয়ালা রোগীদের। এয়ার কন্ডিশন্ড চেম্বার এড়িয়ে চলুন। দরজা জানালা হোক খোলামেলা। বাতাস যেন চলাচল করতে পারে এপাশ থেকে ওপাশে। তথ্য বলছে, কোনও ঘরের বাতাস যদি প্রতি ঘন্টায় দশ থেকে পনেরো বার ফ্রেশ হাওয়া দিয়ে রিপ্লেসড হয়, তবে সেই ঘরে বাতাস বাহিত রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। আর তার জন্য চাই খোলামেলা আবহাওয়া। এই একই নিয়ম মেনে চলুন যাঁরা বদ্ধ কামরায় কাজ করেন। আপনার রুমটিতে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিন। এখনই। আজ্ঞে হ্যাঁ। এই ক্ষণেই। দেখুন, আলমারি বা কোনও চেয়ার টেবিল জানালা ব্লক করছে কিনা। করলে, সেগুলো সরিয়ে অন্যত্র রাখুন। দুর্ভাগ্যবশত, আমরা যত আধুনিক হচ্ছি, ততই আমাদের এসি প্রীতি বাড়ছে। যদি সম্ভব হয়, সংশ্লিষ্ট দফতরে আবেদন করে এসি হঠিয়ে জানালা দরজা খুলে রাখার চেষ্টা করুন। এতে গরম লাগবে। ঠান্ডাও। তবে, প্রাণে বেঁচে যাবেন। করোনা ভাইরাস তো নস্যি বিষয় দাদা। টিবিতে মরে যাবেন নয়তো।

৮) খাওয়ার আগে হাত ধুয়ে নিন সাবান দিয়ে কচলে কচলে। অন্তত কুড়ি সেকেন্ড ঘড়ি ধরে। যদি সাবান না থাকে 'হ্যান্ড স্যানিটাইজার' ব্যবহার করতে পারেন। তবে দেখে নেবেন তাতে যেন মিনিমাম ৬০ শতাংশ অ্যালকোহল থাকে।

৯) মোটামুটি ৪০ বছরের পর থেকে বছরে একবার করে সুগার টেস্ট করান। সুগার নরমাল হলে কেয়াব্বাত! চলুন ফাটিয়ে মস্তি করি। কিন্তু সুগার/ডায়াবেটিস ধরা পড়ে যদি, তবে অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। ডায়াবেটিস নিঃশব্দ ঘাতক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধরা পড়ে বেশ দেরিতে। এবং ডায়াবেটিস রোগীদের শুধু করোনা কেন, যে কোনও সংক্রামক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

১০) (এটা ট্রেনিং-এ ছিল না। আমি জুড়েছি। বর্তমান পরিস্থিতির বিচারে) এইটি, সম্ভবত বর্তমান দুনিয়াতে, সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টের একটা। তাই শেষ পাতে দিলাম। নলেন গুড়ের টাটকা মিষ্টি লাস্টেই দেওয়া নিয়ম। হোয়াটসঅ্যাপে বা মেসেঞ্জারে অনেক মেসেজ পাবেন। করোনা বা অন্যান্য বিষয় নিয়ে। সেইটে চারপাশে 'ফরোয়ার্ড' করে দেওয়ার আগে একটু খতিয়ে দেখুন। জেনে নিন বিষয়টা গুজব কিনা। ঠিক যেমন গুজব ছড়ায় দাঙ্গা নিয়ে। কিংবা ইউনিসেফ-এর নামে যেসব গুজব ছড়াচ্ছে করোনা ভাইরাস ঘটিত।


চার

দু হাজার দুই-তিন সালে ঠিক এইরকমই একটি ঘটনা ঘটেছিল। সেটিরও শুরুয়াৎ চিন দেশে। অনেকেই তাকে চেনেন সার্স নামে। সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম (SARS)। মজার বিষয় একটাই। প্রায় সকল সাধারণ জনতাই ভুলে মেরে দিয়েছেন যে, এই সার্স রোগটিও হয়েছিল করোনা ভাইরাসের কারণেই। তবে সেই ভাইরাসের 'জিনোম'-এর গঠন (খোলনলচে) ছিল কিছুটা আলাদা। এই ভাইরাসটি ছড়িয়েছিল বাদুড়ের মাধ্যমে। বাদুড় থেকে রোগ ছড়ায় ভাম জাতীয় বিড়ালে। তারপর সেখান থেকে অন্যান্য জীব জন্তুতে। যেমন বীভার বা রেকুন। চিনে বীভার এবং রেকুন নামের প্রাণীরা খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সেখান থেকেই ছড়িয়ে যায় মানুষের মধ্যে। ছড়ায়, এই সব প্রাণীদের কাটাকুটি করতেন যাঁরা, সেইসব কসাইদের মাধ্যমে। মাংসের মাধ্যমে নয়। হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে ছড়াত এই রোগ। এই করোনা ভাইরাসের নাম দেওয়া হয়েছিল SARS-CoV-1। এ যাত্রায় তাই নাম দেওয়া হলো SARS-CoV-2। কারণ, এই করোনা ভাইরাসের গঠন পূর্বতন ভাইরাসের থেকে পৃথক।

দয়া করে চিন দেশকে গালি দিতে বসবেন না। চিৎকার শুরু করবেন না, 'শালারা যা খুশি খায়।' মাথায় রাখবেন আপনাদের প্রিয় গরু/ গাউমাতা-র শরীরেও টিবি ব্যাকটেরিয়া (অ্যাটিপিক্যাল) বসবাস করে।

পাঁচ

কতকগুলি প্রশ্নোত্তর সেরে নেওয়া যাক শেষপাতে।

প্রঃ কী ভাবে এই রোগ ছড়ায়? মানুষ থেকে মানুষে?

উঃ যে যা খুশী বক্কা মারুক, এ রোগের মোড অফ ট্রান্সমিশন (ছড়ানোর পদ্ধতি) সঠিক ভাবে জানা যায়নি এখনও। যথেষ্ট তথ্য নেই। তবে, এ যাবৎ প্রাপ্ত তথ্য থেকে অনুমান করা হচ্ছে, এই রোগটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে। আর তাই, উপরিউক্ত নিয়মগুলি মেনে চলুন।

প্রঃ এ রোগে মরে যাওয়ার সম্ভাবনা কতখানি?

উঃ সে বিষয়ে মন্তব্য করার মতো যথেষ্ট তথ্যও এখনও হাতে আসেনি। এটা বিজ্ঞান। এটা স্ট্যাটিসটিক্স। যা খুশি একটা বকে দিলেই হল না হোয়াটসঅ্যাপে।

প্রঃ তাহলে কি এ রোগে লোক মরে না?

উঃ অবশ্যই মরে। তবে এ যাবৎ প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা গেছে যে, এটি ২০০৩-এর করোনা ভাইরাসের থেকে কম ক্ষতিকর। এই করোনা ভাইরাসে মরে সাধারণত বুড়ো বুড়িরাই। মরে প্রধানত তারাই, যাদের ইমিউনিটি কম। এগারোই জানুয়ারি যিনি মারা গিয়েছিলেন তাঁর বয়স ছিল একষট্টি বছর। ভদ্রলোকের ক্যানসারও ছিল। ষোলই জানুয়ারি যিনি মারা গিয়েছিলেন তাঁর বয়স ছিল ঊনষাট বছর। এই ভদ্রলোকের সম্ভবত টিবিও ছিল।

প্রঃ কতদিন সময় লাগে এই রোগটি হতে?/ ইনকিউবেশন পিরিয়ড কত?

উঃ এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে দুই থেকে চৌদ্দ দিন।

প্রঃ তেরই ফেব্রুয়ারি এবং তার পর থেকে হঠাৎ করে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেল কেন? তার মানে কি আমরা হেরে যাচ্ছি?

উঃ আজ্ঞে না। এ কথা সত্যি যে তেরই ফেব্রুয়ারিতে ১৫১৪১ জনের নতুন সন্ধান পাওয়া গেছে। যেটা আশ্চর্যই বটে। তবে তাতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এর আগে স্রেফ ল্যাবরেটারিতে যাঁদের নমুনাতে করোনা ভাইরাস পাওয়া গেছে, তাঁদেরই রোগী ধরা হত। তেরই জানুয়ারি থেকে যে কোনও নিউমোনিয়া রোগীকেই সম্ভাব্য করোনা ধরা হচ্ছে চিন দেশে। চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে বলা হয় 'চেঞ্জ অফ কেস ডেফিনেশন'। এই 'কেস ডেফিনেশন'-এর আরও একবার পরিবর্তন হয় ২০শে ফেব্রুয়ারি। ফলত, সেইদিন রোগীর সংখ্যা কমে যায় ফট করে। এসব মেডিক্যাল কচকচি। এসবের উপর ভিত্তি করে সাধারণ মানুষের আতঙ্কিত/ উল্লসিত হওয়া অনেকটা ফ্লাইটে বসে 'প্লেনটা খুব জোরে উড়ছে মনে হচ্ছে' বলার মতো। অর্থাৎ, বালখিল্য।

প্রঃ এই রোগ আটকে দেওয়ার কি কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়েছে?

উঃ জি নেহি হুজুর। আজ্ঞে না সাহিবাঁ। ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে আপনি অনেক গুজবই পাবেন। যথা, গরুর পেচ্ছাপ খেলে/আয়ুষ বা হোমিওপ্যাথি আবিষ্কৃত বড়ি খেলে, করোনা ভাইরাসের মূর্তি বানিয়ে পূজা করলে (সৌজন্যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ), তেলাপিয়া মাছ বা মুরগি না খেলে, চায়নার আবির না মাখলে করোনা হবে না। এগুলো সবই... আই রিপিট সবই... ঢপের চপ।

প্রঃ মাংস খাওয়া কি এ সময়ে বিপজ্জনক?

উঃ না। যদি রান্না করে মাংস খান, কোনও বিপদের সম্ভাবনা নেই। চাইলে আমাকে নেমন্তন্নও করতে পারেন। তবে হ্যাঁ, রান্না সুসিদ্ধ, সুপক্ক হওয়া চাই। আধাখ্যাঁচড়া রান্না হওয়া মাংস যাঁরা খান সাহেবি কেতাতে, তাঁদের শুধু এখনই নয় ভবিষ্যতেও বহুবিধ রোগ হতে পারে। এ মুহূর্তে পাওয়া তথ্য মোতাবেক, কাঁচা মাংস নিয়ে নাড়াঘাঁটা, যেমন ম্যারিনেশন/ নুন হলুদ মাখিয়ে রাখা অথবা মাংস ধোয়া, এসবে করোনা ছড়াচ্ছে কিনা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে এটুকু নিশ্চিত তথ্য যে, কাঁচা মাংস নাড়া ঘাঁটার পর যদি ভালো করে সাবান জল দিয়ে হাত ধুয়ে নেন, তবে আজ আপনার করোনাও হবে না, ভবিষ্যতেও অনেক রোগ থেকে মুক্তি পাবেন।

মোটমাট কথা, শুধু আজকের জন্য নয়, সারা জীবনের জন্য এগুলো মেনে চলুন। এগুলো 'সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি'।

প্রঃ দশ সেকেন্ড নিঃশ্বাস ( পড়ুন প্রশ্বাস) আটকে রাখতে পারেন না যাঁরা, তাঁরাই কি এ রোগে আক্রান্ত?

উঃ দাদারা/ দিদিরা, হাসাবেন না। হাসাতে হলে কমেডি সার্কাস দেখুন।

প্রঃ হাঁচি বা কাশি হলে কি ভয়ের ব্যাপার?

উঃ না। ভারতবর্ষে করোনা এখনও সেভাবে হয়নি কিছুই। মহামারী/ এপিডেমিক তো দূরের কথা! তবে হ্যাঁ! হাঁচি, কাশি, জ্বর হলে ডাক্তারের কাছে যান। বাকিটা উনিই বুঝে নেবেন। প্রয়োজনে 01123978046 নাম্বারে ফোন করবেন। এটা ন্যাশানাল করোনা হেল্পলাইন নাম্বার।


ছয়

সেবার ওই কলকাতার পাঁচতারা হোটেলের 'এয়ার বোর্ন ইনফেকশন কন্ট্রোল' সেমিনার থেকে ফিরে আসা ইস্তক আমি আমূল বদলে গেছি। আমি সেই ২০১১ থেকেই মুখ ঢেকে হাঁচি কাশি। অন্যদের শেখাই। রাস্তায় কেউ থুতু ফেললে খিস্তাই। কর্মক্ষেত্রের দরজা জানালা খোলামেলা রাখি। ইনফ্যাক্ট SARS-CoV-2 পয়দা হওয়ার ঢের ঢের আগে থেকেই আমি এ বিষয়ে নাগাড়ে লিখে যাচ্ছি।

একটা গোপন কথা বলে যাই। আমার হাসপাতালের প্রতিটি দরজা জানালা খুলিয়ে রাখি আমি দিনরাত। প্রতিদিন বুঝিয়ে বুঝিয়ে এইটেই এখন জলপাইগুড়ি টিবি হাসপাতালের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তাই, আমি আর ওই বিশ্বজিৎদা ( তৎকালীন ডিটিও) মিলে ষড় করে, সরকারকে দিয়ে গরম মোজা আর মাঙ্কিটুপি কিনিয়েছিলাম। শীতের রাতের খোলা জানালায় পেশেন্টরা কষ্ট পাবে বলে।

এ হাসপাতাল বাদেও অন্যত্র মাঝে মাঝে এমার্জেন্সি ডিউটি করতে হয় আমায়। আমি ভারী আশ্চর্য হয়ে দেখি, সে সব জায়গাতে রাতের বেলা সব জানালা দরজা বন্ধ করে রোগীরা এবং সিস্টাররা বসে থাকে। আতঙ্কিত হয়ে শুধিয়েওছি আমি সিস্টার বা সে হাসপাতালের ডাক্তারদের বহুবার। সবাই মাছি নাড়ার মতো হাত করে বলেছে, 'ধুর... এরা বললে শোনে না।' তো, সারা দুনিয়া বদলানো তো আর আমার পক্ষে সম্ভব নয়! তবে অন্য কোনও হাসপাতালের ওয়ার্ডে গেলেই আমি আগে জানালা খোলাই। রোগীরা গড়িমসি করলে, খিস্তি মারি টেনে। এসব, আমার রক্তে মিশে গেছে।

সাত

লেখাটা এবার শেষ করব। ভালোই হল। সাতটা চ্যাপ্টার হল। পোয়েটিক জাস্টিস। কারণ, এই করোনা ভাইরাসটি এ যাবৎ পাওয়া সাত নম্বর করোনা ভাইরাস, যেটি মানুষকে আক্রমণ করেছে।

যাক সে কথা। এ লেখা লিখতে লিখতেই ফোন করেছিলাম এক WHO উপদেষ্টাকে। অনিকেত চৌধুরী। তো হাসছিলাম আমি ফোনে, 'অনিকেত, এতদিন ধরে আমরা বলে আসছি। কেউ শুনছে না। ভাগ্যিস করোনা এল। তাই লোকে হাঁচি কাশিতে মুখ ঢাকার কথা শুনছে। অন্তত কিছুদিন হলেও টিবি ইনফেকশন কম ছড়াবে। বলো? জয় করোনা মাইয়া কি।'
অনিকেতও হাসল। বলল, 'প্রিসাইজলি! মাই পয়েন্ট..'

প্রতি কুড়ি সেকেন্ডে একজন টিবি রোগী মারা যায় এ পৃথিবীতে। সারাদিনে প্রায় সাড়ে চার হাজার। ভারতবর্ষের তিন ভাগের এক ভাগ মানুষের শরীরে টিবির জীবাণু আছে। সে জীবাণু অপেক্ষা করছে ঘাপটি মেরে। ইমিউনিটি এতটুকু কমলেই, সুগার বা ক্যানসার হলেই তেড়েফুঁড়ে উঠবে। তবুও কারও হেলদোল নেই। সব্বাই সেই একই বুলি আউড়ে যাচ্ছে, 'ধোর শালা! টিবি হয় রিকশাওয়ালাদের।' আর টিবি বেড়ে চলেছে। এমন ভাবে বাড়ছে যে, যদি এই রেট বজায় থাকে, তবে আপনাদের সব্বার নাতি নাতনির টিবি হবে।

হাতজোড় করে বলছি, তিন নম্বর চ্যাপ্টারে বর্ণিত সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন সারা জীবন। শেখান সব্বাইকে ঘাড় ধরে। প্রয়োজনে ঝগড়া করুন। যে মানুষ প্রতিদিন দরজায় তালা দিয়ে বাইরে যায়, তার চোরের ভয় নেই। আর আপনারা যেটা করছেন সেটা হল কতকটা এইরকম--  পাড়ায় নতুন চোর এসেছে! এবার তাহলে ক'টা দিন দরজায় তালা দিই।

ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।

৮ মার্চ ২০২০।

তথ্য ঋণ: WHO

[একাধিকবার নিজের নাম উল্লেখ করেছি আমি। যেটা এর আগে কখনও করিনি। আজ করলাম। একটাই কারণ। এ লেখার সমস্ত দায়ভার আমার]

Friday, 6 March 2020

মুদ্রা যখন ডিজিটাল

ডিজিটাল জগৎ ও তার মুদ্রা
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

(দেশের শীর্ষ আদালত ক্রিপটোকারেন্সির ওপর ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিষেধাজ্ঞা বাতিল করেছে। প্রচলতি মুদ্রার পাশাপাশি ডিজিটাল মুদ্রাও এবার হয়ে উঠবে যাপনের অঙ্গ। মুদ্রার ধারণাই এবার পাল্টাতে চলেছে ব্লকচেন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সার্বিক আলোকে। সদ্য প্রকাশিত 'আশায় বাঁচে চাষা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও একুশ শতকের রাজনৈতিক অর্থনীতি' গ্রন্থে এ নিয়ে আলোচনার কিছু অংশ এখানে দেওয়া হল।)
  
আরও একটি প্রবণতা বহু কিছুর ঝুঁটি ধরে নাড়া দিতে চলেছে। তা হল সোশ্যাল মানি বা ‘সামাজিক মুদ্রা’র ধারণা। এতদিন আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার কথা আলোচনা করেছি। এখন উঠে আসছে সোশ্যাল মানি নামক এমন এক আর্থ-সামাজিক ধারণা যা ইতোমধ্যে বাস্তব রূপও ধারণ করেছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি-র একটা ধারণা আমরা পেয়েছি। বিটকয়েন-এর কথাও শুনেছি। এও শোনা যাচ্ছে, ফেসবুক অনতিবিলম্বেই আনতে চলেছে লিবরা নামক এক ডিজিটাল মুদ্রা। এর বাস্তব প্রভাব ও প্রতিপত্তি কী হবে তা দেখার আছে অবশ্যই। অবশ্য, বাঘা বাঘা কর্পোরেটরা এই লিবরা-র আগমনের পিছনে দাঁড়িয়েছে। যেমন, পেপাল, উবের, ভিসা, মাস্টারকার্ড, এমনকি ভোডাফোন-ও। কিন্তু সোশ্যাল মানি-র ধারণা কিছুটা ভিন্ন। যেমন যুগ পরম্পরায় মিডিয়ার ধারণা বদলেছে- যা আগে ছিল মালিকানা নিয়ন্ত্রণাধীন ও ওপর থেকে নির্গত এক প্রক্রিয়া, এখন এসে দাঁড়িয়েছে পরস্পর-মুখি, খোলামেলা, অংশীদারিত্ব অবয়বে, যাকে আমরা বলি সোশ্যাল মিডিয়া- ঠিক একইভাবে লক্ষ লক্ষ মুক্ত মুদ্রা অচিরেই আমাদের স্মার্ট ফোন জুড়ে চলাফেরা করবে। মুদ্রাও হয়ে উঠবে সোশ্যাল, সামাজিক। বলা হচ্ছে, এই ধরনের ডিজিটাল মুদ্রা সরকারি বা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের কব্জা মুক্ত এমন এক অস্তিত্ব যা বিবিধ বাজার ও সামাজিক কৌমের ওপর ভরসা রেখেই চলাচল করবে। দাবি, স্মার্ট ফোন ও নেট দুনিয়া মারফত এই মুদ্রা শুধু লেনদেনকে সহজতর করবে না, বরং ব্যক্তি ও নানাবিধ সামাজিক গোষ্ঠীকে নানান ভাবে সক্ষম করে তুলবে। নানা ধরনের অ্যাপ ও যোগাযোগ মাধ্যমে যেভাবে মানুষে মানুষে সংযোগ রাষ্ট্র, জাতি ও দূরত্বের বাধাকে অতিক্রম করে সর্বব্যাপী হয়ে উঠছে, তাতে খুব স্বাভাবিক, এই ধরনের বহু সামাজিক উদ্যোগ ও প্রয়াসের বাস্তব আখ্যান তৈরি হবে। ইতিমধ্যেই এই ধরনের স্থানীয় মুদ্রা, নানান উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে সচল আছে। যেমন, জার্মানিতে চলে Chiemgauer- যা স্থানীয় উদ্যোগপতিদের দ্বারা স্থানীয় ভিত্তিক কর্মসংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করে। জাপানে চালু আছে Fureai Kippu, যা এক ধরনের সহমর্মিতামূলক মুদ্রা বয়স্ক নাগরিকদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে।১০  

মুদ্রার প্রচলন ও তার ওপর আস্থা নির্ভর করে মানুষের পরস্পরমুখি সম্পর্ক ও লেনদেনের ওপর। নেপাল, ভূটান, বাংলাদেশ সীমান্তে উভয় দেশগুলিতেই সীমানা পেরিয়েও প্রতিবেশী বিদেশি দেশগুলির মুদ্রা কার্যকরী ভাবে বেশ সচল ও কার্যকর। এর কারণ, মানুষ তার লেনদেনের সুবিধার্থে ও পরস্পর-বাণিজ্যিক স্বার্থে এক ধরনের আস্থাকে ভরসা করেই এমত লেনদেনে সহমত হয়েছে। ঠিক একইভাবে বহু জায়গায় সামাজিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে নানাবিধ বিনিময় মাধ্যম বেশ চালুও আছে। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় এক সর্বব্যাপী সংযোগ ও বিনিময় এই ধরনের সামাজিক ঐক্যমতের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কোনও মুদ্রাকে যে নির্মাণ করে নিচ্ছে বা নেবে, তা অত্যন্ত স্বাভাবিক। মিডিয়া যদি সোশ্যাল হয়ে উঠতে পারে, মুদ্রাও অচিরে সেই পথেই এগোবে। আর তা হবে এক যুগান্তকারী ঘটনা। তা শুধু রাষ্ট্র ও কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের খবরদারিকেই ভাঙ্গবে না, রাষ্টের বিকল্প হিসেবে নেট দুনিয়াকে কেন্দ্র করে নব-উত্থিত কেন্দ্রীয় টেক-দৈত্যদের প্রভাবও হয়তো খর্ব করবে।  

কিন্তু এই সমস্ত প্রয়াসগুলি ও তাদের সম্ভাবনাসমূহ নির্ভর করছে কিছু জটিল আধারের ওপর যার ভবিষ্যৎ চলাচল সম্পর্কে অত নিশ্চিত করে বলাটা বেশ কষ্টসাধ্য। আমরা যত কিছু সম্ভাবনাময় উপাদানের কথা বলছি অথবা আয়ত্ত করার চেষ্টা করছি আগামী গতিময় পথকে, আমাদের বুঝতে হবে, এই সামগ্রিক উদ্যোগগুলি কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে এমন এক আধারের ওপর যার ভিত্তি হল বড় পুঁজি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও যোগাযোগ-প্রযুক্তি। এই আধার হল আসলে এক সুবিস্তৃত যোগাযোগের ভূমি বা বলা ভাল, এক অন্তহীন সামাজিক বাজার যেখানে অযূত ক্রেতা বা মানুষ এসে ভীড় করেছে। এ তাবৎ এত বড় ভূমি এখনও পর্যন্ত বিশ্ব ইতিহাস, দেখা তো দূর অস্ত, কল্পনা পর্যন্ত করে উঠতে পারেনি। গত দু-এক দশকের সমস্ত প্রয়াস ও কর্মোদ্যোগ কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে ওই কতিপয় বিশালাকার প্রাযুক্তিক-দৈত্য নির্মিত এক অতিকায় বাজারের ওপর ভর করেই। সে আমরা তাকে সোশ্যাল মিডিয়াই বলি বা অন্যথায় অন্য কোনও বিনিময়ের প্ল্যাটফর্মআমাদের সোশ্যাল মিডিয়ার আদিগন্ত প্ল্যাটফর্ম তো এখনও ট্যুইটার, ফেসবুক, লিঙ্কডিন বা হোয়াটসআপ, আর বিনিময়ের অন্যতম দোকানদারি অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট, তথ্য ঘাঁটার পরিসর গুগল বা উইকিপিডিয়ানিজেদের যা কিছু, তা এদের ওপর ভর করেই। অথবা, কিছু অ্যাপ, যা নির্দিষ্ট কিছু কাজ ও উদ্যোগের সম্ভাবনা বা কার্যক্রম তৈরি করে। এই সবের ওপর সওয়ারী হয়েই তবে না ভুবন জয়ের চিন্তা। তাই কেউ কেউ বলেন, যতই বাঘের পিঠে চাপুন না কেন, এর একটা অন্যদিকও আছে। তা হল, দৈত্য যত বড় হয় তার খুঁটিনাটি নজর তত সঙ্কুচিত হয়। তাই আপনি যদি এদের ঘাড়ে চড়েও বেড়ান কি দু-পাইস কামিয়েও ফেলেন, এদের কিচ্ছুটি যায় আসে না; আর আপনি আদার ব্যাপারী, জাহাজের খোঁজের আপনার প্রয়োজনটাই বা কী? কিন্তু সম্ভবত, এই কথাটি আজকের যুগে বলা যাবে না। কারণ, খুঁটিনাটি নজর করার জন্য দৈত্যের আছে সেন্সর ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যারা আপন নিয়মেই খুব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাজ করে চলে, অর্থাৎ, নজরদারি চালাতে পারে। তবুও প্রশ্নটা অন্যত্র। আরও একটু জটিল মাত্রায়। হয়তো, দৈত্য বহু কিছুকে জেনে-বুঝেও উপেক্ষা করতে পারে। কারণ, তার অন্য এক অভিলাষ রয়েছে। সে অভিলাষ হল, বিশ্বের যাবতীয় যা কিছু, বিশেষত তথ্য, তাকে নিজের আওতায় আনা, পর্যবেক্ষণে রাখা, বিশ্লেষণ করা ও তার রকমফের ফলাফলকে নিজের কাজে লাগানো বা তা নিয়ে লাগাতার এদিক-ওদিক বাণিজ্য করা এই তার আধিপত্য-বিস্তারের প্রধান সড়ক। তাই তার পক্ষে আবার কোনও কিছুকেই উপেক্ষা করাও সম্ভব নয়। সে অনায়াসে গিলে ফেলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ছোট কারবারীদের।

Monday, 2 March 2020

মধ্যবিত্ত ও সোশ্যাল মিডিয়া

ধর্ম ভেদাভেদ বিষবাষ্পে মধ্যবিত্ত আমরা কেউ কেউ ও সোশ্যাল মিডিয়া
উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়

বড় বড় রাজনৈতিক চালের ও জালের  খপ্পড়ে আমরা যারা আদার ব্যাপারী তারা পড়ব কেন! আরএসএস কী বলছে বা তাদের সামনের ও দূরের অ্যাজেন্ডা কী এটার জন্য আমাদের কোনও চুঁনোপুঁটির কাছে কেন নির্ভর করতে হবে বা কেন ওইদিকে যাব বা মন দেব। দরকারে তাদের কোনও তাত্ত্বিক লোকের কাছে যাব, তাদের কোনও লেখাপত্তর বই পত্রিকা সংগ্রহ করে নিজে জ্ঞান নেব। ইংরেজিতে ফটর্-ফটর্ শিখতে গেলে প্রজাতন্ত্রী টিভির বক্কাবাজি-ধমকবাজি  শুনব, মাওবাদীদের কথা জানতে গেলে তাদের পত্র-পত্রিকার খোঁজ করব, ইসলামী জেহাদিদের কথা কী তা জানতে হলে খোঁজ নেব কোথাও কোনও লাইব্রেরিতে তাদের কোনও পত্র-পত্রিকা থাকলে।

তো, আমরা এইসব গুরুত্বপূর্ণ লোকজন নিজেদের  মধ্যে কেন এইগুলো নিয়ে থোড়-বড়ি-খাড়া নিয়ে ঠ্যাসাঠ্যেসি করব বা ভার্চুয়াল দাঙ্গাসম দূষণ চালাব? আমরা তো কারও কোনও কাজেও লাগছি না। শুধুই খাবারের পরে মুখশুদ্দির জন্য এসব করা? নাকি কোনও স্বার্থ আছে!  তো, এবার তাহলে আমরা কী করব! সোশ্যাল মিডিয়াকে সুবিধা করে আমরা আমাদের বদামি ও ইতরামি করেই যাব, করেই যাব, করেই যাব।

কিন্তু মশাই!! সবাই সব জানতে পারছে, বুঝতে পারছে। প্রথম প্রথম বোঝা যেত না। এখন বোঝা যাচ্ছে। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কারণে অনেকেই আমরা দুনিয়াটাকে এক্সট্রাপোলেট করি। আমরা ঝগড়া করি, বা, তবু সম্পর্ক রাখি- অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কারণ বা স্বার্থ‌ে।  কিন্তু এই ব্যক্তিগত প্যারামিটারটা কয়েকজনের। স্বতঃস্বারিত নয়। তাই সেটাকে তারা সার্বজনীন করার চেষ্টা করে, কিন্তু এই অ্যাজেন্ডার কথাটা মুখে বলে না। এখন হয় কী, দীর্ঘদিন ধরে একই ধরনের ব্যবহার-ঘর্ষণে এগুলো আস্তে আস্তে উপরিতলে উঠে আসে। আসতে হবেই।
ধরুন একজন বামপার্টি ভোটদানকারী মনস্ক কোনও মানুষ। সে বামপ্রেমী, জ্যোতি বসু প্রেমী, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সদ্চরিত্র বলে স্বস্তি লাভ করেন। কিন্তু মুসলমান বিদ্বেষী। কোনও ক্ষমতাবান মুসলমান বলে নয়, সে গরিব মুসলমান হলেও। রঙের মিস্তিরি, রাজ মিস্তিরি হলেও। কেন? কারণ হিসেবে ভাবতে গেলে তখন অনেক কারণ পাবেন হয়তো। যেমন -
১) তারা (মুসলমানেরা)পূর্ববঙ্গে জোর করে হিন্দু নিধন করে বাদবাকি হিন্দু মানুষগুলোকে উচ্ছেদ করে উদ্বাস্তু করে এ দেশে পাঠিয়েছে (অথচ, অদ্ভূত দেখুন -  এই দেশের এপার বাংলার আদি বাঙালিও এমন আছেন যারা হিন্দু হলেও বাঙাল বিদ্বেষী। কেন এই মানসিকতা? যেহেতু বাঙালেরা খ্যেদানি খেয়ে এ দেশে এসে এখানে ওখানে জোর করে বেআইনি কলোনি করে বসবাস করতে শুরু করেছে এবং এ দেশের সম্পদে ভাগ বসিয়েছে, এদেশীয় ঘটিরা তাই(!) অবদমিত ও বিরক্ত হয়েছে- এই বয়ান)
২) জোর করে মুসলমানেরা ধর্মান্তরিত করেছে।
৩) তারা মন্দির ধ্বংস করেছে .... এইসব...

আর এ দেশের মুসলমানেরা কেন অপছন্দের হিন্দুদের কাছে? সাধারণ বয়ানগুলো কী কী!
যেমন -
১) তারা নোংরা। গা দিয়ে বোঁটকা গন্ধ বেরোয়।
২) তারা বিছানায় বসে ভাত খায়, এঁটো মানে না।
৩) তারা আইন মানে না - একটা বাইকে বা স্কুটারে চারজন যায়, হেলমেট পরে না।
৪) ইন্ডিয়া হারলে রাজাবাজারে বা খিদিরপুরে বা মেটিয়াবুরুজে পাকিস্তানের ফ্ল্যাগ ওড়ায়
৫) ওরা গরু খায়।

যেটা বলতে মুখে বাধে ও মনে মনে পোষণ করা হয় তা হল, ওরা গরিব। ওরা অশিক্ষিত। ওদের মাথা মোটা।  ওরা দুর্বৃত্ত। ওরা দুর্বিনীত। ওরা দাঙ্গাবাজ। আস্তে আস্তে এই কথাটা ঘুরপাক খায় ও নির্মাণ হয় যে ইসলাম ধর্মটাই হিংসার।
স্বাভাবিকভাবেই একটা এইরকম সংস্কৃতি বা এইরকম দীক্ষায় নিপাট ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙালি বাম ভোটার মানুষকেও এইসব সুড়সুড়িগুলো দিয়ে কাৎ করে দেওয়াটা  কঠিন ব্যাপার নয় যদি তারা তথ্য ও ইতিহাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত না হয়ে থাকেন। তারপর তো আছেই বামপার্টির ভক্ত বলে সরকারি পার্টির সায় নেই বলে লোকাল স্তরীয় খাবলাখাবলি লড়াই ও আক্রোশ ও বামেদের নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করে ভোটব্যাঙ্ক খুইয়ে ধাঁ। এ যেন এক মেটান্যারেটিভ মহাদার্শনিক সিদ্ধান্ত ও 'দ্যাখ কেমন লাগে' প্র্যাকটিশ- এখানেই হিন্দুত্ববাদীদের ইউএসপি। না হলে যেখানে তারা পোলিং এজেন্টই দিতে পারে না, যেখানে তাদের সংগঠন নেই সেখানে তারা এতগুলো সিটে জিতে গেল কী করে? মূল ক্ষেত্রটা এটাই। এই সুড়সুড়িটাই (সুবিধা ) ধর্ম নিয়ে সুড়সুড়ি দিয়ে ধর্মীয় নামি রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবহার করে। আসলে মূল কারণ কিন্তু ক্ষমতা। আর ধর্ম জিগির কিন্তু কৌশল। তাদের তাই সব থেকে বড় শত্রু কে? সেক্যুলার ও বামেরা। স্বাভাবিক ভাবেই। আবার দেখুন এই সেক্যুলার ও বামেরাও কম ভেজালের নয় - তার জন্যই তো তারা হিন্দু হিন্দু হিন্দু হিন্দু করে করেকম্মে খাচ্ছে। এই তো ব্যাপার !

আবার প্রথম কথায় আসি। আমরা এদের বা এইসব রাজনৈতিক দলগুলো বা তাদের স্বার্থের অ্যাজেন্ডা নিয়ে কেন চলব? কাদের কে বোঝাচ্ছি? বার্নাড শ বলেছিলেন,  কোন অ্যাডাল্টকে কখনও কনভিন্স করা যায় না। আমি মানবিক, বন্ধুবৎসল হব আর কিছু লোকের রাজনৈতিক বিরুদ্ধ মতবাদের জন‍্য তাকে যতটা পারি গালাগালি দেব, ভিন্নধর্মীদের সব সময় দোষ খুঁজব, নিরীহ মানুষকে নির্যাতন করার জন্য যারা তাল খুঁজব, তবুও কাউকে শান্তি দেব না।

ডেলিবারেটলি যারা জাতধর্ম ভেদাভেদ তুলে অশ্লীল কথা বলেন, তারা নিজেরা নিজেদের বাড়ীতেও সেই সম্মানটুকু রাখেন কি অন্যদের প্রতি? এটাকেই বলে ভ্যয়ারিস্টিক অ্যাটিটিউড। ম্যেসোসিস্টিক এ্যটিটিউড।

তাই ঠিক করুন এসবের মধ্যে পা না বাড়ানো। কোনও উস্কানি নয়। ভার্চুয়ালিটিরও এক কৃত্রিম দাঙ্গাক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে একদম না উস্কানো। এটাই মনে মনে ঠিক করুন।

পাঁচশ বছর আগে কোন মুসলমান সম্রাট কটা মন্দির ধ্বংস করেছে বলে বা অশোক কলিঙ্গযুদ্ধে কতো মানুষকে খুন করেছে বলে আমি আমার পাশের পাড়ার শান্তপ্রিয় কতকগুলো মুসলমান সহনাগরিকদের নমাজ পড়ার জায়গাটা 'জয় শ্রীরাম' বলে ধ্বংস করতে পারি না।

একটা কথা। এগুলো নিয়ে আলোচনা হতে দিতে চান না কেন ?
১) ভারতবর্ষে কত শতাংশ মুসলমান আছে? ২০১১ আদমশুমারি কী বলে?
২)কত শতাংশ মুসলমান কর্মসংস্থান ও ব্যবসা বৃত্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত তার জনসংখ্যার অনুপাতে? এত কম কেন ? কে দায়ী তার জন্য?

শেষ করি একটি কবিতার খন্ডাংশ সংযোজন করে -

'ধোঁয়ায় ঢাকা বসন্ত আজ
গাইছে না কেউ প্রেমের গান

মানুষ থেকে পাল্টে সবাই
হিন্দু কিংবা মুসলমান।'