Thursday, 30 September 2021

কংগ্রেস’এর ইতি!

‘কংগ্রেসি ডায়াসপোরা’র খোঁজে?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা ফেলেইরো কলকাতায় তৃণমূল দলে যোগদান করে সাংবাদিকদের সামনে এক গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, দেশের সব থেকে পুরনো দল কংগ্রেস আজ নানা শিবিরে বিভক্ত, যেমন, তৃণমূল, ওয়াইএসআর, এনসিপি, ইন্দিরা কংগ্রেস এমনতর আরও বিবিধ; বিজেপি’কে মোকাবিলা করতে হলে এই ভাঙ্গা কংগ্রেস পরিবারের একতা জরুরি। উল্লেখ্য, ঠিক তার আগের দিন কানহাইয়া কুমার কংগ্রেসে যোগদান করতে গিয়ে বলেছেন যে, কংগ্রেস যদি না থাকে তাহলে দেশ থাকবে না।

উপরের দুই নেতার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিত আলাদা হলেও অন্তঃসার এক: নতুন করে কংগ্রেস মতাদর্শের পুনর্জাগরণ। কিন্তু এটা স্পষ্ট, দু’ বছরেরও বেশি সময় ধরে সভাপতিহীন একটি দল, যা একের পর এক নির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়ে চলেছে, জাতীয় স্তরে বিজেপি’র দুর্দমনীয় শক্তির কাছে যাকে নেহাতই দুর্বল ও বিভ্রান্তিকর বলে সাব্যস্ত হয়, সেই দলের যদি সত্যি সত্যি উঠে দাঁড়ানোর কোনও আবহ তৈরি হয়, তবে তা দলের বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বারা একেবারেই সম্ভব নয়। তাহলে কি কংগ্রেসের ইতি সমাগত? এখানেই বোধ হচ্ছে, ১২৫ বছরেরও বেশি পুরনো একটি বৈচিত্র্যময় দলের ‘ডায়াসপোরা’ বলে যদি কোনও পরিসর থেকে থাকে অথবা আজকের পরিস্থিতিতে তা নতুন আলোকে নির্মিত হয়, সে ক্ষেত্রে হয়তো এক নতুন অভিযোজন অসম্ভব কিছু নয়; যা টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া সাংগঠনিক অস্তিত্বকে এক খোলামেলা মঞ্চে এনে মেলাতে পারে। যাকে আমরা আজকের পরিপ্রেক্ষিতে, পশ্চিমি বর্গ ধার করে বলতে পারি ‘সমাজ-গণতন্ত্রী’ সংহতি। এই সংহতি কি গান্ধী পরিবারের নেতৃত্বের অপরিহার্যতাকে নাকচ করেই নতুন এক কংগ্রেস দলের জন্ম দেবে, নাকি অন্য কোনও নতুনতর মঞ্চ, জোট অথবা দলে এর উত্তরণ ঘটবে, তা এখুনি বলা সম্ভব নয়।

২০২২’এর ফেব্রুয়ারিতে উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা এবং তারপর ২০২৪’এর লোকসভা নির্বাচন- এই দুটিকে আপাতত ধরা যেতে পারে ভারতীয় গণতন্ত্র তথা রাজনীতি ও অর্থনীতির এক নির্ধারক মাইলফলক। আগামী দিনে দেশ ও দশের ভাগ্যনিয়ন্তা কে হবে- চরম বিভাজনকামী, একরোখা কর্পোরেট-স্বার্থ সম্বলিত, ধর্মীয় মৌলবাদী ও উগ্র রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা সম্পন্ন একটি দল, নাকি, এক আপেক্ষিক উদার সমাজ-গণতান্ত্রিক এমন এক জোট যা সর্ব অর্থে অন্তত কিছুটা হলেও মানুষের গণতন্ত্র ও রুটি-রুজির সমস্যাকে অগ্রাধিকারে রাখবে। বলাই বাহুল্য, দ্বিতীয় পথটিকে গড়ে তুলতে হলে ‘কংগ্রেসি ডায়াসপোরা’র (কংগ্রেস দল বলছি না) সমাজ-গণতন্ত্রী হয়ে ওঠাটা যেমন জরুরি, তেমনই বাম মতাদর্শের আরও বাস্তবানুগ ও প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রপ্রিয় হয়ে ওঠাটাও সমান প্রাসঙ্গিক

বুঝতে হবে, স্বাধীনতা উত্তরকালে (গত শতকের ৯০’এর দশক অবধি) কংগ্রেসের নানা অনাচারের বিরুদ্ধে কার্যকরী বিরোধী শক্তি হিসেবে তিনটি ধারাকে আমরা দেখতে পেয়েছি: ১) বাম ধারা ২) দক্ষিণ ভারতের আঞ্চলিক শক্তি (প্রথমে তামিলনাড়ু ও পরে অন্ধ্রপ্রদেশ) এবং ৩) কংগ্রেসের সমাজতান্ত্রিক ধারা (যা জয়প্রকাশ নারায়ণের উদ্যোগে জনতা পার্টি গঠন ও পরে তার ভাঙনের মধ্য দিয়ে মূলত উত্তর ভারতে আঞ্চলিক দলে পরিণতি পেয়েছিল)। এছাড়াও স্বতন্ত্র পার্টি ও জনসঙ্ঘীদের একটা ধারা ছিল বটে কিন্তু তা কখনও শক্তিশালী হতে পারেনি ৯০’এর দশকের আগ পর্যন্ত। আজ এই পট সম্পূর্ণতই উল্টে গেছে। সারা ভারতে বিজেপি আজ মুখ্য রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং কংগ্রেস সহ কংগ্রেস-বিরোধী দলগুলি বিরোধী অবস্থানে নিমজ্জিত হয়েছে। কিছু কিছু রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে তার অতীতের বিরোধীদের নির্বাচনী সমঝোতাও সম্ভবপর হয়েছে (যেমন বিহার, অসম, তামিলনাড়ু)। কিন্তু এই বিরোধী জোটগুলির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রবণতা হল, যেখানে যেখানে কংগ্রেস মুখ্য দল হিসেবে অবস্থান করছে সেখানে সেখানে বিরোধীদের মহাজোট কার্যকরী ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে, আঞ্চলিক শক্তিগুলি যেখানে মুখ্য অবস্থানে আছে, সেখানে বরং বিরোধী জোট অনেক ভালো ফল করতে পারছে। অর্থাৎ, রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে কংগ্রেস দল বহুল পরিমাণে পরিত্যক্ত অথবা অবিশ্বাসযোগ্য হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এর নানাবিধ কারণ আছে কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণ সম্ভবত বর্তমান গান্ধী পরিবারের নেতৃত্বের অপরিণামদর্শিতা। তারা শুধুমাত্র মতাদর্শগত ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে তাই নয়, রাজনৈতিক কার্যক্রমেও তাদের তীব্র অনীহা এবং সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর এক দায়সারা গোছের দায়িত্ব পালন করা ছাড়া তারা আর বিশেষ কিছু করেও উঠতে পারছে না। যেটুকু যা সাফল্য তারা কিছু রাজ্যে পেয়েছে তা অনেকটাই সেই সব রাজ্যে কংগ্রেসের আঞ্চলিক নেতৃত্বের কৃতিত্বেই। আমার একেবারেই মনে হয় না, রাহুল গান্ধী বা প্রিয়াঙ্কা বঢড়া’র নেতৃত্বে কংগ্রেসের আদৌ কোনও ভবিষ্যৎ আছে। ইতিমধ্যে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে কপিল সিবালের নেতৃত্বাধীন জি-২৩ গোষ্ঠী এ বিষয়ে যথেষ্ট সোচ্চার।

তাহলে প্রশ্ন হল, কংগ্রেসের আদৌ কি কোনও ভবিষ্যৎ নেই? এর উত্তর দেওয়ার সময় এখনও আসেনি। গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফেলেইরো ও প্রশান্ত কিশোরের নানান বক্তব্য ও কার্যকলাপে এমন একটা মালুম হচ্ছে যে ‘কংগ্রেসি ডায়াসপোরা’র যদি সত্যিই কোনও অস্তিত্ব থেকে থাকে, তাহলে তাকে হাতিয়ার করে কংগ্রেসের এক মহামঞ্চ হয়তো আগামী দিনে পুনর্গঠিত হতে পারে। সেই মঞ্চের নাম ‘জাতীয় কংগ্রেস’ হবে নাকি ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ অথবা অন্য কোনও নতুন কিছু, তা এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে, কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে এই ক্ষেত্রে অত্যন্ত এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে চলেছেন তা কতকটা স্পষ্ট।

এর পাশাপাশি, রাজ্য ভিত্তিক আঞ্চলিক, সমাজবাদী ও বাম দলগুলির ভূমিকাও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কংগ্রেসি ডায়াসপোরা যদি বহুল পরিমাণে সমাজ-গণতন্ত্রী হয়ে উঠতে পারে (অর্থাৎ, তাকে সমাজবাদ ও গণতন্ত্র- উভয় দিকেই সদর্থক দৃষ্টি ফেলতে হবে), তাহলে বিজেপি-আরএসএস’এর বিরুদ্ধে বাম ও অন্যান্য সমাজবাদী শক্তির সঙ্গে তার স্বাভাবিক সখ্য গড়ে ওঠায় কোনও বাধা থাকার কথা নয়। কারণ, গত দু’ দশকে বিজেপি-আরএসএস এ দেশে যে শক্তি সঞ্চয় করেছে তা একটা সুদৃঢ় মতাদর্শগত ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়েই, যা উগ্র হিন্দুয়ানার বনিয়াদের ওপর স্থিত। আর ইতিহাস বলে, এই ধরনের উগ্র মতাদর্শকে মোকাবিলা করতে পারে সক্ষম সমাজ-গণতন্ত্রী ও বাম মতাদর্শ। যদি বামেরা তাদের সংগঠন, প্রভাব ও মতাদর্শের জোরে এই কাজটা করতে সক্ষম থাকতেন, তাহলে তার চেয়ে বেশি মঙ্গলজনক আর কিছু হত না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বামেরা গত দু’ দশকে দেশ জুড়ে ক্রমেই দুর্বল হয়েছেন (কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত) এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো অগ্রণী বাম রাজ্যে তাদের একটা বড় অংশ বিজেপি’কে বিপুল আকারে ভোট দিয়েছেন। শুধুমাত্র ভোট দেননি, বাম শক্তির বহু অংশ (নেতা-কর্মী সহ) বিজেপি দলে নামও লিখিয়েছেন এবং রাজ্য বাম শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে বিজেপি’র বিপদকে হাল্কা ভাবেও নেওয়া হয়েছে (‘২১’এ রাম/ ২৬’এ বাম’ বলে)। এর পাশাপাশি, তৃণমূলেরও বহু নেতা-নেত্রী হেলায় বিজেপি দলে যোগ দিয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার পরবর্তীকালে নিজ দলে ফেরত এসেছেন। অর্থাৎ, ভাবটা এমন, সব দলই একইরকম, নিজের আখের গোছাতে সুবিধামতো কোনও এক দলে গেলেই হল। অতএব, মতাদর্শগত সমস্যাটা শুধুমাত্র বামেদের ক্ষেত্রে নয়, তৃণমূল সহ অন্যান্য বিজেপি বিরোধী দলগুলির ক্ষেত্রেও সমান সত্যি। ফলে, অ-বাম দলগুলির ক্ষেত্রে সমাজ-গণতন্ত্রী মতাদর্শকে শক্ত ভাবে আত্মস্থ করাটা যেমন একটি রাজনৈতিক কর্তব্য, অনুরূপ ভাবে, বামেদের ক্ষেত্রেও বাম মতাদর্শকে যথাযথ ভাবে আয়ত্ব করাটাও সমান জরুরি।

সবটা মিলিয়ে, আজ যদি বিজেপি-আরএসএস’এর উগ্র হানাহানি থেকে দেশকে উদ্ধার করতে হয়, তাহলে সম্ভাব্য সমাজ-গণতন্ত্রী শক্তির সঙ্গে বামেদের মোর্চা অবশ্যম্ভাবী ভাবে জরুরি। অবশ্য তার আগে সমাজ-গণতন্ত্রী পরিসর সত্যি সত্যি কতটা গড়ে উঠল এবং বাম মতাদর্শ কতটা বাস্তবিক শক্ত জমির ওপর দাঁড়াতে পারল ও শ্রমজীবী মানুষের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হল, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।

Wednesday, 29 September 2021

মুখ তো বদলেছে...

একটি বিজ্ঞাপন ও কয়েকটি কথা

শোভনলাল চক্রবর্তী


একটি চকোলেট নির্মাতা সংস্থার বিজ্ঞাপন এখন মুখে মুখে। কেউ বলছেন 'রোল রিভার্সাল', কারও মতে মুক্ত চিন্তার প্রতীক, কারও কাছে আবার শুধুই স্মৃতিমেদুরতা, কেউ বলছেন রিমেক। অনুষঙ্গ যাই হোক না কেন, বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়েছে, একজন মহিলা ক্রিকেটার সেঞ্চুরির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। গ্যালারিতে টেনশনে তাঁর বয়ফ্রেন্ড চোখ বুজে ফেলেছেন। মেয়েটি ৬ মেরে সেঞ্চুরি করেন। তা দেখে তিনি নাচতে নাচতে মাঠে ঢুকে ক্রিজের সামনে চলে যান। 

আর এই বিজ্ঞাপন বাজারে আসতেই নয়ের দশকের আরেকটি বিজ্ঞাপন দারুণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। তাতে দেখানো হয়েছিল পুরুষ ক্রিকেটারটি একই ভাবে সেঞ্চুরি করেছিলেন, সেখানে মেয়েটি নাচতে নাচতে মাঠে ঢুকেছিলেন। ১৯৯৪ সালের সেই বিজ্ঞাপন আর আজ ২০২১-এর এই নতুন বিজ্ঞাপন- প্রায় তিন দশকের ব্যবধানে এই দুটি বিজ্ঞাপন কী বার্তা দিচ্ছে? ১৯৯৪ সালে কী বলতে চেয়েছিল, আর এখনই বা কী বলছে? 

আমজনতা এই বিজ্ঞাপনকে মূলত 'রোল রিভার্সাল ও রিমেক' হিসেবে দেখলেও, বিজ্ঞাপন প্রস্তুতকারকরা দাবি করছেন এই বিজ্ঞাপন দু'টো কিন্তু মোটেই শুধু নারী-পুরুষ চরিত্র বদলে দেওয়া নয়। খুব নির্দিষ্ট বার্তা আছে এর মধ্যে। ১৯৯৪ সালে ভারত তখন সদ্য সদ্য মুক্ত অর্থনীতির দিকে যাচ্ছে। সেই সময়ে একজন মহিলার স্বতঃস্ফূর্ত নাচ ছিল তাঁর ক্ষমতায়নের প্রতীক। নতুন বিজ্ঞাপনে রয়েছে আজকের নারীর সাফল্যের উদযাপন। মহিলারা সেই উচ্চতায় পৌঁছেছেন, যেখানে পুরুষরা গ্যালারিতে বসে তাঁদের জন্য গলা ফাটাচ্ছেন। এটা বর্তমান ভারতের সমাজ বদলের একটা লক্ষণ। 

বিজ্ঞাপন প্রস্তুতকারক যে কথাই বলুন না কেন, সমাজে কতটা পরিবর্তন সত্যিই এসেছে, তা নিয়ে রীতিমতো প্রশ্নচিহ্ন রয়েছে। আজ বিজ্ঞাপনগুলি তৈরি হয়েছে যখন মেয়েরা সফলতা অর্জন করেছে। যদি ক্রিকেটের কথাই ধরি, তবে মহিলা ক্রিকেটারদের ছবি দেখলে কতজন তাঁদের চিনতে পারবেন? তাঁদের রেকর্ড মুখস্ত বলা তো অনেক দূরের কথা! খেলাকে কেরিয়ার হিসেবে ভারতের কতজন নারী আজকের দিনে ভাবতে পারবেন? আজ একজন সাধারণ ভারতীয় নারীর প্রেক্ষিতে সামাজিক পরিবর্তন কি হয়েছে বলে বলা চলে? যদি তাই হত, তবে নুসরত জাহানের সন্তানের পিতার পরিচয় নিয়ে যা হল, তা কেন? কাজেই মহিলাদের সম্পর্কে ভাবনা কিন্তু বিশেষ বদলায়নি। 

এই বিজ্ঞাপন হোক বা একটি গয়না প্রস্তুতকারক সংস্থার বিজ্ঞাপনে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে মহিলার দ্বিতীয় বিবাহ বা বৃহন্নলার প্রতি সমাজের মনোভাব বদলানো, বয়স্কা বিধবা মহিলার পুরুষ-সঙ্গী খুঁজে পাওয়া- সবই বিশেষ বার্তা দিচ্ছে। কিন্তু কোনওটাই সমাজে খুব প্রচলিত নয়। বা সমাজ তা সহজে স্বীকারও করবে না। সন্তানকে নিয়ে মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে- এটা কিন্তু এখনও সমাজের একটা বড় অংশের কাছে অস্বাভাবিক। তেমনই বিধবা মহিলা নিজের জীবনসঙ্গী নিজেই খুঁজে নিচ্ছেন, এটাও সমাজে আজও খুব ভালো চোখে দেখা হয় না। আসলে এই বিজ্ঞাপনগুলো একটা বিশেষ সচ্ছল শ্রেণিকে তুলে ধরছে, হতে পারে সেখানে সেই শ্রেণিতে এই পরিবর্তনগুলো আসছে। আমাদের দেশের একটা বিরাট অংশে তার কোনও প্রতিফলন নেই। যে কারণে এই শেষ দু'টো বিজ্ঞাপন নিয়ে সমাজে তেমন কোনও হাইপ হয়নি। 

ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মিতালি রাজ পেরিয়ে চলেছেন একের পর এক মাইলফলক। সম্প্রতি তিনি কুড়ি হাজার রান সম্পূর্ণ করেছেন। তাঁকে নিয়ে সিনেমা হচ্ছে। সেই সাফল্যের ছায়াই এই চকোলেটের বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে। তবে বিজ্ঞাপনী ছবি সত্যিই সামাজিক বিবর্তন ও পরিবর্তনের প্রতিফলন নাকি বিজ্ঞাপন এই পরিবর্তনের সূত্রটা ধরিয়ে দিচ্ছে- তা নিয়ে বিতর্ক চলবেই। তবে একটা কথা ঠিক, এই ধরনের বিজ্ঞাপন ইতিবাচক। সেই ইতিবাচক দিকটা যতটা ছড়িয়ে পড়ে ততই ভালো। তাই এ ধরনের 'প্রতীকী ব্যঞ্জনা' স্বাগত। 

সদ্য প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষ কবিতায় লিখেছিলেন, 'মুখ বদলে যায় বিজ্ঞাপনে'। ২৭ বছরের ফারাকে বিজ্ঞাপনে সত্যিই মুখ বদলেছে। কিন্তু বাস্তবের অবস্থা? সেই প্রশ্নের উত্তর আপাতত হাওয়ায় উড়ছে।


Monday, 27 September 2021

ভারত বনধ

'প্রয়োজন হলে আন্দোলন দশ বছর চলবে'

সোমনাথ গুহ


'এই কৃষক আন্দোলন রাজনীতির এক নতুন আখ্যান তৈরি করেছে যেখানে ব্যক্তি নয়, মানুষের দাবিদাওয়াই হচ্ছে গণ-রাজনীতির মূল ভরকেন্দ্র'- গাজিপুর সীমান্তে এক কৃষক নেতা ইউটিউবার অজিত অঞ্জুমকে আজ ভারত বনধের দিন বললেন। তিনটি কৃষি আইন সংসদে অনুমোদিত হওয়ার এক বছর পূর্তিতে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা এই বনধ ডেকেছিল। ভারত কিষাণ ইউনিয়নের এক নেতা বললেন, উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে বিজেপি যদি জেতেও, তাতে আন্দোলন কমজোরি হয়ে যাবে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। আখের ন্যূনতম মূল্য পঁচিশ টাকা কুইন্টাল প্রতি বাড়িয়ে (৩২৫ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা) কেউ যদি ভাবে কৃষকদের সংহতিতে চিড় ধরাবে, তাঁদের আনুগত্য কিনে নেবে, তাহলে তারা ভুল করছে। বাস্তবে পাঁচ বছরে মাত্র পঁচিশ টাকা বৃদ্ধি ভিক্ষা দেওয়ার সামিল। এটা কৃষকদের প্রতি কোনও সহমর্মিতা নয়, বরং তাঁদেরকে অপমান করা। আদতে আখের ন্যূনতম মূল্য কুইন্টাল প্রতি অন্তত ৫০০ টাকা হওয়া উচিত।

একটি গোদি মিডিয়ার ইংরেজি চ্যানেল দুপুর আড়াইটায় বলছে, বনধের কারণে ভারত স্তব্ধ (Bandh Collapses Bharat)। এরপর তারা জবরদস্তি রাস্তা অবরোধের অভিযোগ জানাচ্ছে, সপ্তাহের প্রথম দিনে মানুষের হয়রানির কথা বলছে, বলছে বেঙ্গালুরু এবং নয়ডায় কৃষকরা নাকি হিংসা ছড়িয়েছে; কিন্তু অস্বীকার করতে পারছে না যে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বনধ সফল। দিল্লি থেকে নয়ডা, গুরুগ্রাম, অমৃতসর, দেহরাদুন, পঞ্জাব-হরিয়ানা সড়ক সব স্তব্ধ। দিল্লি ও উত্তরপ্রদেশের মধ্যে যান চলাচল সম্পুর্ণ বন্ধ। দিল্লি, পঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে বনধ পুরোপুরি সফল। রাজস্থান, গুজরাত, মহারাষ্ট্রের সরকারি অফিস বাদে প্রায় সব কিছু বন্ধ। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে অন্ধ্রপ্রদেশ, যেখানে বিজেপি'র মিত্র ওয়াইএসআর রেড্ডির সরকার, তাঁরা বনধকে সম্পূর্ণ সমর্থন করেছে। তামিলনাড়ুতে ডিএমকে এবং কেরালায় বাম সরকার বনধকে সমর্থন জানানোয় ঐ তিনটি রাজ্যেই জনজীবন স্তব্ধ। 

গুরুগাও-দিল্লি সীমান্তে স্তব্ধ জনজীবন
 

সমস্ত বিরোধী দল বনধকে সমর্থন তো করেইছে, বহু জায়গায় তারা রাস্তায় বিক্ষোভ সমাবেশে সামিল হয়েছে। বিহারে তেজস্বী যাদবের নেতৃত্বে মহাগঠবন্ধন বনধ সফল করতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। মধ্যপ্রদেশে দিগ্বিজয় সিং'এর নেতৃত্বে কংগ্রেস বহু জায়গায় ধর্ণায় বসেছে। রাকেশ টিকায়েত রবিবারই বলে দিয়েছিলেন যে এই তিনটি কালা আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রয়োজন হলে দশ বছর চলবে, কিন্তু কৃষকরা পিছু হঠবে না। 'সরকার যদি কৃষকদের আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত হত তাহলে তারা কোনওদিন এই সব আইন প্রণয়ন করত না। আমরা এই মাটির সন্তান এবং প্রয়োজন হলে সরকারের মুখ ঘষে দিয়ে এই আইনগুলি বাতিল করতে তাদের বাধ্য করতে পারি।'

পশ্চিমবাংলায় ছবিটা আলাদা। এখানে তৃণমুল সরকার বনধকে সমর্থন করছে না, যদিও তারা বলছে যে কৃষকদের দাবি তারা সমর্থন করে। এ এক অদ্ভুত দ্বিচারিতা। স্মরণ করা যেতে পারে যে কৃষক আন্দোলনের নেতারা বাংলায় নির্বাচনের আগে বারবার রাজ্যে এসেছেন এবং বিজেপিকে পরাস্ত করার জন্য মানুষের কাছে আবেদন করেছেন। তবুও এখানে জনজীবন সচল রাখতে পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অতিরিক্ত পুলিশ নিয়োগ করা হয়েছে। উত্তরবঙ্গে বনধ দক্ষিণের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভাবে বেশি সফল। কোচবিহারে বাস চলেনি, জলপাইগুড়িতে জনজীবন ব্যাহত। রায়গঞ্জে দোকানপাট খোলেনি। শিলিগুড়িতে দিনভর মিছিল সমাবেশ হয়েছে। ব্যারাকপুরের শিল্পাঞ্চলে বনধ মিশ্র সাড়া ফেলেছে। নৈহাটি এক্সপ্রেসওয়েতে অবরোধ হয়েছে, শ্যামনগর স্টেশনে ট্রেন অবরোধ করা হয়েছে। কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে, বিটি রোড ইত্যাদি জায়গায় বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। একটি জায়গায় বনধের সমর্থনকারীদের আবেদনে সাড়া দিয়ে কর্মচারীরা অফিস ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন। মালদহ শহরে কংগ্রেস পিকেটিং করেছে, ধুবুলিয়া ব্লক ও নদীয়ার নাকাশিপাড়ায় সিপিআই(এমএল)-লিবারেশন অবরোধ করেছে। দুর্গাপুর রেল স্টেশনে সিপিএম রেল লাইন অবরোধ করেছে, মেদিনীপুর শহরে বাস আটকে দিয়েছে। বারাসতে বনধ আংশিক সফল হয়েছে। 

কলকাতায় মৌলালি মোড় থেকে বিভিন্ন বাম সংগঠনের যৌথ মিছিল হয়েছে। যাদবপুর ৮বি বাস স্ট্যান্ড ও যাদবপুর রেল স্টেশনে বাম কর্মীরা দীর্ঘ সময় অবরোধ করেছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে রাস্তায় ছাত্রছাত্রীরা দিনভর অবরোধ করেছেন। শ্যামবাজার ও গড়িয়াহাট মোড়ে অবরোধ হয়েছে। 

এই তিনটি আইন উদ্ভুত সমস্যাগুলো শুধু যে কৃষকদের নয় ব্যাপক মানুষের, সেটা এই বনধের মধ্যে দিয়ে মানুষ অনেকটা উপলব্ধি করেছেন; না হলে বনধ এত সাড়া ফেলত না। বিপদটা মাথার একদম ওপরে এটা বোধগম্য হওয়া প্রয়োজন। কারণ আজকে ঠিক এই দিনটাতেই প্রধানমন্ত্রী তাঁর ‘আয়ুষ্মান ভারত ডিজিটাল ভারত মিশন’ ঘোষণা করলেন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার প্রতিটি নাগরিকের শরীর স্বাস্থ্যের সুলুকসন্ধান পেয়ে যাবে। আমার হার্টের ব্যামো আছে না ডায়েবেটিস, তা থাকবে সরকারের নখদর্পণে। মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরে এত বড় আগ্রাসন ইতিপূর্বে আর কখনও হয়েছে কী? 


Saturday, 25 September 2021

জলযন্ত্রণা

কলকাতার ভেঙ্গে পড়া নিকাশি

সুপ্রতিম কর্মকার 


বৃষ্টি পড়ল আকাশ থেকে। জল জমল শহরে। এই শহরটার নাম কলকাতা। নিজেই সে তিলোত্তমা। তার পরে নোংরা জমা জল খাল পেরিয়ে রাজপথে আসল। আর রাজপথ পেরিয়ে ঘরে ঢুকল। বৃষ্টির জলের তো এটা জায়গা ছিল না! তার ঘর ছিল পুকুর খাল বিল আর নদীরা। অল্প সময়ের জন্য জল জমা শহর কলকাতাকে দেখতেই আমরা মোটামুটি অভ্যস্ত ছিলাম। গঙ্গার বুকের জলে সাগর থেকে জোয়ারের জল ঢুকলে সেই সময় কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ত। ভাটার টান আসলেই জল নেমে যেত খুব তাড়াতাড়ি।

ফি বছরগুলোতে এই চেনা ব্যাপারটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। মেলানো যাচ্ছে না কলকাতার জল ছবি। প্রাকৃতিক বিপর্যয় যে আসবে সে কথা আমরা জেনেছি আগেই। আইপিসিসি সেই সতর্ক বার্তা আমাদের আগেই দিয়েছে। তারপরেও নিকাশি সমস্যা নিয়ে আমাদের এত কেন গা-সওয়া ভাব? প্রশ্নটা চটপট করে ফেলতে পারলেও উত্তরটা কিন্তু এত সহজে পাওয়া যাবে না। তার থেকে বড় প্রশ্ন হল, উত্তরটা দেবে কে? 

কলকাতার নিকাশি পরিকাঠামোর ভেঙ্গে পড়া চেহারাটা কিছুদিন হল খুব বেশি করে সামনে উঠে আসছে। কারণ, কলকাতার বুক থেকে নিকাশি পথগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। না, নষ্ট হয়ে যায়নি। বলা ভালো, নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কেন করে দেওয়া হল? একটু তলিয়ে দেখুন- স্বাভাবিক নিকাশি ব্যবস্থাটাকে নষ্ট করতে না পারলে ড্রেনেজ ডেভলপমেটের নামে অর্থ ঢালা যাবে না। বড় বড় ডেভলপমেন্ট ব্যাংকগুলো টাকা ঢালার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

কলকাতা শহরের এই জলবন্দী অবস্থাটাকে দেখে চেন্নাই'এর বন্যার কথা খুব মনে হচ্ছিল। চেন্নাই শহরের পুরো নিকাশিটা আডিয়ার আর কুভম নামে দুটো নদী করত। সাথে থাকত শহরের বুকে থাকা বড় বড় সব মন্দিরের পুকুরগুলো। নদী আর পুকুরগুলোকে নষ্ট করে দেবার পর হাতেনাতে প্রমাণ পেল চেন্নাই। কলকাতাতেও তাই হল। শহরের বুকে ছিল দুটো নদী। এক দিকে বিদ্যাধরী অন্য দিকে গঙ্গা। আর  ছিল একের সাথে আরেকজন জুড়ে থাকা খালেরা আর ছোট বড় পুকুরের দল। সবার প্রথমে কলকাতা শহরের মাজা ভাঙ্গা হল খালগুলোর। সেটা সংখ্যায় কতগুলো? সরকারি হিসেব বলছে ২৭টি। এমন ঘটনাও সংবাদ মাধ্যমে এসেছে, যেখানে বেহালা অঞ্চলের একটা পুরো খালকে মাটির তলা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সহজ ভাবেই প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই বোঝা যায়, খালের বিকল্প কোনওদিন পাইপলাইন হতে পারে না।  

সাহেবরা যখন কলকাতা শহরে বসতি স্থাপন করেছিলেন, সেই সময় পুরো নিকাশি ব্যবস্থাটার দুটো ভাগ ছিল। একটা ছিল স্ট্রম ওয়াটার ফ্লো আর দ্বিতীয়টি ছিল ড্রাই ওয়েদার ফ্লো। সহজ ভাবে বুঝতে গেলে, বৃষ্টির জল আর নোংরা জলকে আলাদা করে ভাবা। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না, স্বাধীনতার পর থেকে যে ভাবে জনসংখ্যার চাপ বেড়েছে কলকাতায়, তাতে নোংরা জল উৎপাদনের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। পুরনো আমলের পরিকাঠামো দিয়ে সেই জল ম্যানেজমেন্ট সম্ভব হচ্ছিল না। কাজেই সম্পূর্ণ  নিকাশি সিস্টেমটাকে তৈরি করা হল হিউম পাইপের ভেতর দিয়ে। এটা করে আরও বিপদ বেড়ে গেল। বাড়ল কেন? ছোট ছোট ড্রেনগুলোকে আগে ঢাল বরাবর যুক্ত করে দেওয়া যেত। এখন সেটা সম্ভব হল না। এখান থেকে একটা জল জমার অবস্থা তৈরি হওয়া শুরু হল।

এখানে একটি খাল ছিল- চুরি গিয়াছে

সাহেবেরা কলকাতার নিকাশি সমস্যাটাকে বুঝেছিলেন। কাজেই যেটা দরকার ছিল তা হল, সাহেবদের তৈরি পরিকাঠামোর ক্যাপাসিটি বা ধারণ ক্ষমতাকে বাড়ানো। আর তার সাথে কলকাতার ওয়াটার পকেটগুলোকে ঠিক করা। কলকাতার ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা হল জবরদখল। বাগজোলা, চড়িয়াল,  সুতিখাল, সব খালগুলো আজ সংস্কারের অভাবে বিপন্ন। কোথাও কোথাও ৩০ ফুটের খাল দখল হয়ে ৫ ফুটে চলে এসেছে। আবার কোথাও সরকারি নথিতে খালের নাম আছে কিন্তু বাস্তবে সেখানে হাউজিং কমপ্লেক্স গড়ে উঠেছে। কাজেই প্রশাসনের প্রথম দ্বায়িত্ব হওয়া উচিত খালগুলোকে দখল মুক্ত করা।

তাহলে কী করণীয়? প্রথমে দরকার স্বচ্ছ ম্যাপিং'এর। যেখান থেকে ধারণা স্পষ্ট হবে, কোথায়, কেন, কী কারণে ও কতক্ষণ ধরে জল জমে থাকছে। আর ম্যাপিং'টা ঠিক ভাবে করতে পারলেই খুঁজে পাওয়া যাবে কারণ। এতে সমাধানের পথ বের করা সহজেই সম্ভব। দ্বিতীয় কাজে কলকাতার পুকুরগুলোর দিকে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। বর্ষার  জল ধরে রাখতে এদের কোনও দ্বিতীয় বিকল্প হয় না। আর প্লাস্টিকের ব্যবহার কলকাতায় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।


Friday, 24 September 2021

যা দেখেছি

কিউবা: নরক এবং স্বর্গ!

ফ্রেই বেট্টো

অনুবাদ: সমর বাগচী

 (ফ্রেই বেট্টো ব্রাজিলের এক সুবিখ্যাত লেখক ও দার্শনিক)


কিউবার বিপ্লবের প্রতি আমার যে সংহতি তা কারওরই অজানা নয়। গত ৪০ বছর ধরে আমি মাঝে মাঝেই কাজের জন্য অথবা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে কিউবায় গিয়েছি। বহুদিন ধরে ক্যাথলিক বিশপদের সঙ্গে কিউবার সরকারের আলোচনায় মধ্যস্থতা করার কাজে নিযুক্ত ছিলাম, যা আমার লেখা ‘
Fidel and Religion’ (Fontanar/Companhia das Letras) এবং ‘Paradise Lost, Journeys to the Socialist World’ নামে দুটি গ্রন্থে বর্ণনা করেছি।

সম্প্রতি, FAO-এর সঙ্গে এক চুক্তিতে আমি কিউবার সরকারকে খাদ্য সুরক্ষা ও পুষ্টি শিক্ষা পরিকল্পনার কাজে উপদেশ দেওয়ার কাজে নিযুক্ত আছি। আমি কিউবার অধিবাসীদের দৈনন্দিন জীবনযাপন এবং তারা যে অসুবিধা ভোগ করছে, বিপ্লবের যে চ্যালেঞ্জ, বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীদের যে সমালোচনা, তার সঙ্গে পরিচিত। আমি জেল পরিদর্শনে গিয়েছি, কিউবার যাজক এবং সাধারণ মানুষ যারা সমাজবাদের বিরোধী, তাদের সঙ্গে বসবাস করেছি। তারা যখন আমাকে, অর্থাৎ, একজন ব্রাজিলের অধিবাসীকে বলে যে কিউবায় কোনও গণতন্ত্র নেই, তখন আমি শব্দের বিমূর্ততা থেকে বাস্তব অনুধাবন করার চেষ্টা করি। প্রশ্ন করি- কতগুলো ছবি বা খবর দেখা গেছে যে কিউবানরা কষ্টে আছে, রাস্তার ধারে ভিখারিরা সার দিয়ে বসে আছে, শিশুরা রাস্তায় পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে বা পরিবারগুলি দীর্ঘ সেতুর নিচে অবস্থান করছে? যেমন দেখা যায় স্পেনের বড় শহরে দীর্ঘ লাইনে বছরের পর বছর চিকিৎসার জন্যে অপেক্ষারত দুঃস্থ মানুষদের!

আমি বন্ধুদের সাবধান করছি:

  • তুমি যদি ব্রাজিলের ধনী মানুষ হও এবং কিউবায় বসবাস করতে যাও তোমার মনে হবে তুমি নরকে এসেছ। তুমি প্রতি বছর তোমার গাড়ি বদলাতে পারবে না, দামী দামী কাপড়জামা কিনতে পারবে না, ছুটিতে বারে বারে বিদেশ ভ্রমণে যেতে পারবে না এবং অন্যের কাজকে শোষণ করতে পারবে না, কর্মীদের লেখাপড়ায় বঞ্চিত রাখতে পারবে না। মেরিয়া নামে যে মেয়েটি তোমার বাড়িতে প্রায় ২০ বছর ধরে কাজ করছে তার জন্যে ‘গর্ব’ অনুভব করবে, কিন্তু তাকে তুমি তোমার বাড়ির অন্দরে প্রবেশের, শিক্ষার এবং স্বাস্থ্যের অধিকার দেবে না।
  • যদি তুমি মধ্যবিত্ত হও তাহলে প্রেতলোকের অভিজ্ঞতার জন্য তৈরি হও, যদিও কিউবা এখন আর রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত নয়। আমলাতন্ত্র বজায় আছে, তোমাকে বাজারের লাইনে ধৈর্য বজায় রাখতে হবে; যে জিনিস আজ পাওয়া যাচ্ছে, আমদানির অনিশ্চয়তার জন্য এক মাস পরে তা হয়তো পাওয়া যাবে না।
  • কিন্তু, তুমি যদি মাইনে পাওয়া লোক হও, গরিব হও, গৃহহীন বা জমিহীন হও, তাহলে স্বর্গের অভিজ্ঞতা পাওয়ার জন্যে তৈরি হও: খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসগৃহ এবং কাজের ব্যাপারে বিপ্লব তোমাকে গ্যারান্টি দেবে। তুমি যা খেতে পছন্দ কর সেই সব খেতে না পাওয়ার জন্য অভ্যেস কর। কিন্তু, তুমি ক্ষুধার্ত থাকবে না। তোমার পরিবার শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং এমনকি নিখরচায় জটিল সার্জারির সুযোগ পাবে। তা রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং নাগরিকের অধিকার।

গ্রিসের যে গণতন্ত্রের কথা আমরা জানি তার গুণ আছে। কিন্তু, আমাদের মনে রাখা ভাল যে সেই সময়ে এথেন্সে ২০০০ মানুষকে সেবা করার জন্য ৪,০০,০০০ দাসকে কাজ করতে হত। যদি ঐসব দাসের কাউকে গণতন্ত্রের মহত্ব সম্বন্ধে জিগ্যেস করা হয় তাহলে সে কী উত্তর দেবে?

আমি কিউবার ভবিষ্যৎ’কে ব্রাজিল, গুয়াতেমালা এবং এমনকি পিউয়েরতোরিকো (যা এখন আমেরিকার উপনিবে‌শ, যাকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি)’র মতো হতে দিতে চাই না আমি এও চাই না যে কিউবা আমেরিকাকে আক্রমণ করুক এবং ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূল ভাগ দখল করুক, যেমন করেছে আমেরিকা গুয়ান্তানামাতে- যাকে একটা নিপীড়নের কেন্দ্র বানানো হয়েছে তথাকথিত আতঙ্কবাদীদের জন্য।

আমার অনুভবে গণতন্ত্র হচ্ছে ‘আমার মা বাপ’– যাকে জনসাধারণ স্বীকৃতি দিয়েছে- এবং ‘আমাদের রুটি’– প্রকৃতির দান ও মানুষের শ্রমকে ভাগাভাগি করে বাঁচা জনগণের দ্বারা নির্বাচনই গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত করে না। ব্রাজিল এবং ভারত যাদের আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলি, সেখানে দেখতে পাই গরিব মানুষের প্রকট দুর্দশা, দারিদ্র্য, বঞ্চনা, নিপীড়ন এবং দুঃখকষ্ট যারা কিউবার ১৯৫৯ সালের আগের অবস্থা জানে তারা বলতে পারবে কাস্ত্রো কেন বিপ্লবের জয়ের জন্য এত সমর্থন পেয়েছিল। বিপ্লবের আগে কিউবার পরিচিতি ছিল ক্যারিবিয়া’র গণিকাগার হিসেবে। ব্যাঙ্ক এবং পর্যটন শিল্পকে মাফিয়ারা নিয়ন্ত্রণ করত যেগুলি নিয়ে বেশ কয়েকটা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। হাভানার যে প্রধান সন্নিহিত অঞ্চল তাকে এখনও ভেলাডো বলা হয় কারণ, সেখানে কালোদের ঢুকতে দেওয়া হয় না।

তাঁবে থাকা কিউবাকে হারিয়ে আমেরিকা কখনও খুশি হয়নি। তাই, সিয়ারা মায়েস্ত্রা গেরিলাদের হাতে আসার পরে আমেরিকা ভাড়াটে সৈন্যদের সাহায্যে কিউবা আক্রমণ করার চেষ্টা করে। ১৯৬১ সালের এপ্রিল মাসে তারা পরাজিত হয়। পরের বছর প্রেসিডেন্ট কেনেডি কিউবায় অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করে যা আজও বজায় আছে।

কিউবা একটা ছোট্ট দ্বীপ যার প্রাকৃতিক সম্পদ খুবই সীমিত। তার আবশ্যিক প্রয়োজনীয় পদার্থের প্রায় ৬০ শতাংশ বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। ট্রাম্প এই অবরোধ আরও জোরদার করে (২৪৩টা নতুন কার্যকারী অবরোধ ব্যবস্থা প্রবর্তন করে যা এখনও প্রেসিডেন্ট বাইডেন তুলে নেয়নি) বর্তমান কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী মহামারির জন্য কিউবার প্রধান আয়ের উৎস পর্যটন শিল্প একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। তাই, আভ্যন্তরীণ অবস্থা খুব খারাপ হয়েছে। কিউবানদের মিতব্যয়ী হতে হয়েছে। যারা কিউবার বিপ্লবে অখুশি ও আমেরিকান স্বপ্নে বিভোর, তারা গত ২১ জুলাই CIA'এর সংহতিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করে CIA'এর প্রধান এই মহাদেশ ঘুরে গেছে কিউবার প্রেসিডেন্ট দিয়াজ-ক্যানেল ছাড়া অন্য কে আজ কিউবার বর্তমান অবস্থা বুঝতে পারবে? আর্থিক, বাণিজ্যিক এবং শক্তি উদ্যোগের বিরুদ্ধে অবরোধ শুরু হয়ে গেছে। হোয়াইট হাউস কিউবাতে একটা আভ্যন্তরীণ সামাজিক বিস্ফোরণ ঘটাতে চায় যার ফলে কিউবার মানুষ ‘মানবিক মিশন’ চাইবে। এই ছুতোয় আক্রমণ এবং সামরিক হস্তক্ষেপ করা হবে।

আমার মনে পড়ছে, ২০১৯ সালের দ্বিতীয়ার্ধে আমি বলেছিলাম যে আমরা এক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমেরিকা অর্থনীতির ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটা বাধার সৃষ্টি করে কিউবার অর্থনীতি ও শক্তি উদ্যোগকে পিষে মারার চেষ্টা করেছে। এর পরে আসে ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ২৪৩টা কার্যকরী ব্যবস্থা। ট্রাম্প কিউবাকে 'সন্ত্রাসবাদ প্রসার করছে' বলে চিহ্নিত করে। এইসব বাধানিষেধের ফলে বিদেশি মুদ্রা অর্জন করার যে সব উৎস ছিল- যেমন পর্যটন, কিউবান-আমেরিকানদের কিউবাতে ভ্রমণ বা বিদেশি মুদ্রা পাঠানো- বন্ধ হয়ে যায়। বিদেশি মুদ্রার একটা বড় উৎস কিউবান মেডিক্যাল ব্রিগেড এবং অন্য দেশের দিক থেকে কিউবার প্রতি সংহতি- তাকে বদনাম করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এইসব অবরোধের ফলে দেশে খাদ্য, ওষুধপত্র এবং কাঁচামালের অভাব দেখা দেয় যার ফলে অর্থনীতি ও উৎপাদনে খারাপ প্রভাব পড়ে। দেশের রফতানি ও সম্পদের বিনিয়োগ কমে যায়। দেশে জ্বালানি এবং স্পেয়ার পার্টস'এর অভাব দেখা দেয়। এর ফলে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হতে শুরু করে এটা হচ্ছে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯০-১৯৯৫ সালের মধ্যে কিউবার অর্থনীতিতে যে বিরাট সমস্যা দেখা দিয়েছিল তাকে সমাধান করা গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হল মিডিয়ার নিয়মিত অপপ্রচার যা এক রীতি বর্জিত যুদ্ধ, যা পার্টি, রাষ্ট্র এবং দেশের মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে মানুষকে ভুল বোঝাবার চেষ্টা করল যে কিউবা’র সরকার মানুষের কল্যাণ সাধনে অপারগ। 

এই অবস্থার মধ্যেই করোনা মহামারি সারা পৃথিবীতে দেখা দিল। এটা বলা উচিত যে আমেরিকার মতো ধনী দেশেরও এই সমস্যাকে মোকাবিলা করার সঠিক ব্যবস্থা ছিল না। প্রতি লক্ষ মানুষের হিসেবে আমেরিকায় সংক্রমণ ও মৃত্যু কিউবার চেয়ে অনেক বেশি ছিল; যেখানে আমেরিকায় প্রতি দশ লাখে ১৭২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে সেখানে কিউবায় তা মাত্র ৪৭ জন। যখন আমেরিকা ভ্যাকসিনের জাতীয়তাবাদে নিমজ্জিত তখন কিউবার ডাক্তারদের ‘হেনরি রিভ ব্রিগেড’ সবচেয়ে গরিব দেশগুলোতে কাজ করেছে। এই কাজের জন্য কিউবার নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া উচিত।

সরাসরি কিউবা আক্রমণ করার সাফল্য লাভ না করলেও আমেরিকা তার কঠিন অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কিউবা চেষ্টা করেছে সেই অবরোধকে মোকাবিলা করার। কিন্তু, আমেরিকা সব সময় ক্যারিবিয়ান ওই দেশটিকে অধিকার করার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। ১৯৯২ সালের শুরুতে রাষ্ট্রসংঘ সর্বস্বীকৃত ভাবে কিউবার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ বন্ধ করার জন্য ভোট দেয়। কিউবার সরকার রিপোর্ট করে যে এপ্রিল ২০১৯ থেকে মার্চ ২০২০ সালের মধ্যে অবরোধের জন্য কিউবা ৫০ লক্ষ ডলারের সম্ভাব্য বাণিজ্য হারিয়েছে। গত ছয় দশকে কিউবা হারিয়েছে ১৪.৪ কোটি ডলার। বর্তমানে কিউবাতে যাতে বিদেশ থেকে তেল ঢুকতে না পারে তার জন্য আমেরিকা জাহাজ কোম্পানিগুলির ওপর অবরোধ জারি করেছে।

এই ভঙ্গুর অবস্থার জন্য রাস্তায় মিছিল হচ্ছে। কিন্তু, কিউবার সরকার রাস্তায় ট্যাঙ্ক ও মিলিটারি নামাচ্ছে না। মারতি, চে গুয়েভারা এবং ফিদেলের আদর্শে অনুপ্রাণিত কিউবার জনগণ প্রমাণ করেছে তারা অজেয়। আমরা যারা একটা ন্যায়পূর্ণ পৃথিবী চাই, তাদের কিউবার সঙ্গে সংহতিতে তার পাশে দাঁড়ানো উচিত।                          

(১ অগস্ট ২০২১ ইংরেজি সমাজবাদী সাপ্তাহিক Janata Weekly-তে প্রকাশিত)

 

Thursday, 23 September 2021

সবাই এত চুপ কেন?

গুজরাত ও নভি মুম্বইয়ের বন্দরগুলি কি 

মাদক পাচারের আখড়া হয়ে উঠেছে?

শোভনলাল চক্রবর্তী

সম্প্রতি গুজরাতের মুন্দ্রা বন্দরে ডাইরেক্টরেট অফ রেভেনিউ ইন্টেলিজেন্স (ডিআরআই)'এর আমেদাবাদ সার্কল আটক করল তিন হাজার কেজি হেরোইন; আন্তর্জাতিক বাজারে যার অর্থমূল্য একুশ হাজার কোটি টাকা। প্রথমেই বলা দরকার যে, হেরোইন অনেক ছোট ওজনের একক মিলিগ্রাম বা গ্রামে বিক্রি হয়। সুশান্ত সিং রাজপুত আত্মহত্যার তদন্তে নেমে নায়িকা রিয়া চক্রবর্তীর কাছে নাকি ১০ গ্রাম মারিজুয়ানা পাওয়া গিয়েছিল। পরে দীপিকা পাড়ুকোনের কাছেও পাওয়া কিছু মাদক নিয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলতে থাকা ব্রেকিং নিউজ আমাদের অনেকের স্মৃতিতেই আজও উজ্জ্বল। 

সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ! আজ যখন ডিআরআই জানাচ্ছে যে মুন্দ্রা বন্দরে আটক হেরোইন পৃথিবীর সব চেয়ে বড় হেরোইন আটক অভিযানের অন্যতম, তখনও কোনও হেলদোল নেই মিডিয়ার। কেন এই নিরুৎসাহ? আমরা আসব সেই প্রশ্নের উত্তরে। তার আগে একটু আন্দাজ করে নেওয়া যাক একুশ হাজার কোটি টাকা ঠিক কত টাকা? 

দুটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা হয়তো বুঝতে সুবিধা হবে। প্রথমত, সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রজেক্টের মোট ব্যয় কুড়ি হাজার কোটি টাকা; আর দ্বিতীয়ত, গোটা ভারতবর্ষে কোভিড টিকাকরণের মোট খরচ কুড়ি হাজার কোটি টাকা। ভাবুন, যে টাকায় পুরো দেশের মানুষকে টিকা দেওয়া হয়ে যেতে পারে, সেই বিপুল অর্থের হেরোইন আমদানি হচ্ছিল অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয়ওয়ারা শহরের আশি ট্রেডিং কোম্পানির নামে। কোম্পানির খাতা অনুযায়ী আফগানিস্তান থেকে তারা অভ্র দানা আমদানি করছিল এবং জাহাজটি মুন্দ্রা বন্দরে এসেছিল ইরানের আব্বাস বন্দর থেকে। ডিআরআই সন্দেহ করে যে আফগানিস্তান থেকে যেহেতু আমদানি হচ্ছে, তাই এর মধ্যে অন্য কিছু থাকতে পারে। কারণ, আফগানিস্তানের মূল রফতানি যোগ্য উপাদান এখন মাদক ও হেরোইন। ডিআরআই দল গান্ধীনগরে অবস্থিত একটি ফরেনসিক ল্যাবরেটরির বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ওই বন্দরে হানা দেয় এবং আমদানি হওয়া বাক্সগুলি খুলে পরীক্ষা করে। বাক্সের পাউডার দ্রব্যের মধ্যে হেরোইনের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার পর একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে এই বিপুল পরিমাণ হেরোইন আটকের খবর তারা প্রচার করে। তারা বিস্তারিত ভাবে জানায় যে মোট দুটি বাক্সের প্রথমটি থেকে আটক হয় প্রায় দু' হাজার কেজি হেরোইন এবং দ্বিতীয়টি থেকে এক হাজার কেজি। এর পাশাপাশি দিল্লি, চেন্নাই, আমেদাবাদ, গান্ধীধাম ও মান্ধাভি শহরেও তল্লাশি শুরু হয়। এখনও পর্যন্ত দু'জনকে এই হেরোইন কাণ্ডে আটক করা হয়েছে এবং দিল্লির দু'জন আফগানবাসীর উপর নজরদারি চলছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। 

হেরোইন আটক অবশ্য এই প্রথম নয়। গত জুলাই মাসে নভি মুম্বইয়ের নব সেবা বন্দরে, ওই সেই আফগানিস্তান থেকে ইরানের আব্বাস বন্দর হয়ে আসা তিনশো কেজি হেরোইন আটক হয়েছিল। সেবারও পাউডার গুঁড়োর মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল হেরোইন। ২০২০ সালের অগস্ট মাসে এই মুন্দ্রা বন্দরেই আটক হয়েছিল ১৯০ কেজি হেরোইন, যা বাঁশের গায়ে পাইপের রং করে সেই বাঁশের ভিতর লুকনো ছিল। সেবার অবশ্য পাকিস্তান থেকে ইরানের চাবাহার বন্দর হয়ে এসেছিল ওই হেরোইন। সেই সময়ে দু'জন কাস্টমস এজেন্ট সহ পাঁচজন ড্রাগ ব্যবসায়ীকে আটক করে পুলিশ। তারপর যা হয়, প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাবে এক সময় ছাড়া পেয়ে যান তাঁরা। 

মুন্দ্রা বন্দরে ৩০০০ কেজি হেরোইন যেদিন আটক হয়, তার ঠিক দু' দিন পরে ভারতীয় জল সীমান্ত রক্ষীরা সাতজন ইরানি মৎসজীবীকে আটক করেন। তাঁদের  উপর তল্লাশি চালিয়ে তিরিশ কেজি হেরোইন পাওয়া যায়। মৎস্যজীবীরা জেরার মুখে জানান যে এই হেরোইন গুজরাতে তাঁদের লোকেদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ছিল। এবং গুজরাত হয়ে ওই হেরোইন চলে যেত পঞ্জাব মারফত দিল্লিতে। 


এতক্ষণ এই হেরোইন পাচার আর আটকের কাহিনিতে পাঠকেরা আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করলেন যে এখানে বারবার করে ফিরে আসছে গুজরাত আর নভি মুম্বইয়ের বন্দরগুলির নাম, তার সঙ্গে পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের নাম। পাকিস্তান আফগানিস্তান আজ ভাই-ভাই। আফগানিস্তানের তালিবানদের অর্থের মূল উৎস হেরোইনের ব্যবসা। অনেকে বলছেন, সেই কোটি কোটি মার্কিন ডলারের হেরোইন ব্যবসার ভাগ না পেয়েই নাকি আমেরিকা আফগানিস্তান ত্যাগ করেছে। আমাদের দেশের ড্রাগ ব্যবসার কেন্দ্র ছিল বরাবরই মুম্বই, তবে ইদানীং ব্যাটন বদল হয়েছে। এখন গুজরাত হয়ে পঞ্জাবে ঢোকে ড্রাগ। ড্রাগের স্বর্গ রাজ্য এখন পঞ্জাব। সারা দেশ জুড়ে ড্রাগ ব্যবসার যে জাল, তার কেন্দ্র অবশ্যই দিল্লি। আগে ড্রাগ আসত প্লেনে করে বিমানবন্দর হয়ে। সেখানে নিরাপত্তার কড়াকড়িতে ড্রাগ এখন আসছে জলপথে- আফগানিস্তান, পাকিস্তান থেকে ইরান হয়ে পশ্চিম ভারতের বন্দরে। এই বন্দরগুলির মালিকানা এখন আর সরকারি হাতে নেই। সরকার এগুলিকে তুলে দিয়েছে বেসরকারি পুঁজিপতিদের হাতে। গুজরাত ও নভি মুম্বইয়ের যে কটি বন্দরের নাম এই হেরোইন চক্রে উঠে আসছে তার সবগুলির মালিকানা এখন আদানিদের হাতে। 

এখানে দুটি সম্ভাবনা আছে। এক, আদানিরা সবটা জানেন। জেনে এই মাদক পাচারে তাঁরা তাঁদের বন্দর দিয়ে বেনামে একটা সেফ প্যাসেজ দিচ্ছেন, অবশ্যই মোটা অর্থের বিনিময়ে। আর দুই, তাঁরা কিছুই জানেন না। যদি দ্বিতীয়টা হয় তবে কি ডিআরআই বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ম্যারাথন জেরায় বসবে? এক' দু টাকা নয়, একুশ হাজার কোটি টাকার মাদক আটক হয়েছে। গুজরাত ও কেন্দ্রের সরকারের সঙ্গে আদানিরা কীভাবে যুক্ত তা আমরা সবাই জানি। তবে কি এবার নির্বাচন কমিশন, সিবিআই-এর মতো ডিআরআই'কেও খাঁচার তোতা করে রেখে দেওয়া হবে? ডানা ছেঁটে দেওয়া হবে? অন্য দেশে এত বিশাল পরিমাণ মাদক আটক হলে, যাঁরা ওই মাদক আটক করলেন তাঁরা বিশেষ পুরস্কার পেতেন। এখানে ঠিক তার উল্টো, চারিদিকে শ্মশানের নীরবতা। কোন মিডিয়া হাউসের ঘাড়ে কটা মাথা আছে যে আদানিদের মাদক পাচারে নাম জড়াবে? যাদের টাকায় মাইনে হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে মাদক পাচারের অভিযোগ? তাও আবার একুশ হাজার কোটি টাকার? ছিঃ ছিঃ, কানে শোনাও পাপ! 

ইতিমধ্যে হাওয়ায় খবর ভাসছে যে বুঁদির কেল্লার মতো দাঁড়িয়ে থাকা এনডিটিভি'কে কিনতে চলেছেন ওই আদানিরা। ফলে, একুশ হাজার কোটি টাকার মামলা এখন তামাদি। কথায় আছে, আপনি বাঁচলে বাপের নাম। তবে প্রিন্ট মিডিয়া খবর করেছে, ছোট করে। শুনেছি, তাদেরও বাধ্যবাধকতা আছে। পুঁজিপতিরা সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার তাগিদে মিডিয়াকে আগে হাত করেন, তারপর সেখানে শুধুই সরকার বন্দনা। আর সরকার বিনিময়ে দিয়ে থাকে অবাধ ছাড়। যেমন ধরুন, পুরো পশ্চিম ভারতের গুজরাত ও সংলগ্ন বন্দরগুলো জুড়ে যদি আজ মাদক পাচারের একটা নিরাপদ পথ গড়ে ওঠে, তবে সেখানে বিশ্বের বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীরা আসবেন। টাকার কোনও হিসেব-নিকেশ সেখানে থাকার কথা কী? ধরুন, এই যে ২১ হাজার কোটি টাকার মাদক আটকে গেল, এটা যদি বন্দর থেকে বেরিয়ে যেত তাহলে আদানিরা তার লভ্যাংশ পেতেন না, এ কথা শুনলে তো ঘোড়াও হাসবে! ওই টাকার ২ শতাংশ খরচে কেন্দ্রের সরকারকে চিরস্থায়ী করা কোনও ব্যাপার নাকি? ভারতে এখন বিরোধী দল, নির্বাচন, গণতন্ত্র সব কেমন যেন পরাবাস্তব হয়ে উঠেছে। একটি দল ও গুটিকয়েক পুঁজিপতি- এরই নাম এখন ভারতবর্ষ। যে কয়টি ব্যবসায় লাভের কোনও উর্ধ্বসীমা হয় না, তার একটি মাদক ব্যবসা। 

দেশের প্রধানমন্ত্রীর রাজ্যের এবং পেয়ারের এক শিল্পপতির অধীনে থাকা বন্দর দিয়ে হেরোইন পাচার হচ্ছে এটা এখন আলোর মতো স্পষ্ট। এত বিপুল পরিমাণ হেরোইন আটকা পড়ে গেল কী করে তা নিয়ে বরং তদন্ত হোক! ডিআরআই সংস্থাটি দেখা যাচ্ছে রীতিমতো 'দেশদ্রোহী'- কোনও তালজ্ঞান নেই, মাদক আটকে দিলেই হল! এই সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠলে হয়তো আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্যাঘ্রচর্মাবৃত শেয়ালরা একসঙ্গে হুক্কা-হুয়া করে ডেকে উঠতে পারে।


Tuesday, 21 September 2021

এনএসএসও'র সমীক্ষা

বাংলার কৃষকের আয় এত কম কেন?

সোমনাথ গুহ

কেন্দ্রীয় সংস্থা এনএসএসও (ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অর্গানাইজেশন)'র সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের কৃষক পরিবারের গড় মাসিক আয় ৬৭৬২ টাকা; যেখানে দেশের কৃষক পরিবারের গড় মাসিক আয় ১০,২১৮ টাকা। এই সমীক্ষা ২০১৮ ও ২০১৯ সালের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে। কৃষক পরিবার বলতে বোঝায়, যাঁরা বছরে অন্তত ৪০০০ টাকা মূল্যের ফসল উৎপাদন করেন এবং যে পরিবারের অন্তত একজন কৃষিকাজে যুক্ত। আরও তাৎপর্যপূর্ণ, এই মাসিক আয়ের মাত্র ২২.৮ শতাংশ, অর্থাৎ ১৫৪৭ টাকা আসে চাষ থেকে; দিনমজুরি, এনরেগায় কাজ, বেসরকারি চাকরি, লোকের বাড়ি বিবিধ কাজ ইত্যাদি থেকে আসে ৫৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩৭২১ টাকা। অন্যান্য পেশা থেকে আয় আরও প্রায় ১৪ শতাংশ। এর অর্থ, পশ্চিমবাংলার অধিকাংশ কৃষক আংশিক চাষি। এটা অস্বাভাবিক নয়, যখন আমরা দেখি রাজ্যের ৯৬ শতাংশ কৃষক ছোট ও ক্ষুদ্র।

২০১৩ সালে এনএসএসও'র সমীক্ষা অনুযায়ী দেশের চাষির গড় মাসিক আয় ছিল ৬৪২৬ টাকা। ছয়টি রাজ্যের গড় মাসিক আয় ছিল ৫০০০ টাকার নীচে- বিহার, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবাংলা, উত্তরাখণ্ড, ওড়িশা ও উত্তরপ্রদেশ। বিহারের আয় ছিল নিম্নতম: ৩৫৫৮ টাকা, পশ্চিমবাংলার আয় ঠিক তার ওপরে: ৩৯৮০ টাকা। হরিয়ানার আয় ছিল সবচেয়ে অধিক: ১৪,৪৩৪ টাকা। 

নাবার্ড'এর সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৬ সালে দেশের চাষির গড় আয় বেড়ে হয় ৮৯৩১ টাকা, অর্থাৎ, পাঁচ বছরে বৃদ্ধি মাত্র ২৫০৫ টাকা। যদি মুদ্রাস্ফীতিকে ধরা হয় তাহলে আয়বৃদ্ধি যৎসামান্য, বরং বলা যায় অধোগামী। বিভিন্ন রাজ্য অনুযায়ী পাঁচ বছরে বৃদ্ধির খতিয়ান দেখা যেতে পারে: বিহারের ৩৫৫৮ থেকে বেড়ে হয় ৭১৭৫, পশ্চিমবাংলায় ৩৯৮০ থেকে ৭৭৫৬, উত্তরপ্রদেশে ৪৯২৩ থেকে ৬৬৬৮, অসমে ৬৬৯৫ থেকে ৯৮৭৮, মহারাষ্ট্রে ৭৩৮৬ থেকে ১০,২৮৬, তামিলনাড়ু'তে ৬৯৮০ থেকে ৯৭৭৫ টাকা। সবুজ বিপ্লবের গড় পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায় বৃদ্ধি যথাক্রমে ১৮,০৫৯ থেকে ২৩,১৩৩ টাকা এবং ১৪,৪৪৩ থেকে ১৮,৪৯৬ টাকা। 

এই দুটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৬'র পরে পশ্চিমবাংলার চাষির আয় পরবর্তী দু' বছরে কমে গেছে ৭৭৫৬ টাকা থেকে ৬৭৬২ টাকায়। ২০১৯'এর বাজেটের পর 'পিএম কিষাণ' এবং 'কৃষকবন্ধু' প্রকল্পের কারণে কৃষকের আয় তাঁর জমির পরিমাণ অনুযায়ী বর্তমানে কিছু বেড়ে থাকতে পারে। 

এই রাজ্যের কৃষকের আয় এত কম কেন? ২০১১'এর সেন্সাস অনুযায়ী, পশ্চিমবাংলার জনঘনত্ব প্রতি স্কোয়ার কিমিতে ১০২৮, শুধুমাত্র বিহারের আরও বেশি- ১১০৬; সারা ভারতে এটা হচ্ছে ৩৮২। পশ্চিমবঙ্গে জমির ওপর প্রবল চাপ, যার ফলে কৃষক প্রতি জমির পরিমাণ অতি অল্প: ০.৭৭ হেক্টর, অর্থাৎ ৫.৭০ বিঘা। পাঞ্জাবে এটা ৩.৬২ হেক্টর, অর্থাৎ ২৬.৮২ বিঘা। বোঝাই যাচ্ছে, আয় এবং জমির পরিমাণ- এই দুটি মূল ক্ষেত্রে সারা দেশের চিত্রটা প্রবল ভাবে অসমান। এর ফলে কৃষি সমস্যার সর্বভারতীয় যে সমাধান সেটা বাংলার ক্ষেত্রে কার্যকরী নাও হতে পারে। 

পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় কৃষকদের জোত বড় এবং তাঁরা দেশের বাকি চাষিদের থেকে অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন। সবুজ বিপ্লবের অঞ্চল হিসাবে এই কারণে ঐ দুটি রাজ্যকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। কৃষকদের এই নতুন চাষে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সরকারি আধিকারিকরা ষাটের দশকে ঘরে ঘরে গিয়ে প্রচার করেছিলেন। এই অভিনব চাষে দীক্ষিত করার জন্য পাঞ্জাবে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। উচ্চফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, পোকামাকড় কীটপতঙ্গের ওষুধের লাগামছাড়া ব্যবহারের ফলে সাবেক চাষ লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন ব্যাংক কম সুদে, সহজ কিস্তিতে ট্র্যাক্টর কেনার ঋণ দেয়। পুরো পাঞ্জাব ট্র্যাক্টরে ভরে যায়। এই নতুন পদ্ধতিতে চাষ শুরু করার পর এত আনাজ উৎপন্ন হত যে সরকার পুরো কিনে উঠতে পারত না। প্রায় তিন দশক পর, তথাকথিত আধুনিক উপকরণ ব্যবহারের কারণে কৃষিতে যে অভাবনীয় প্রাচুর্য এসেছিল, ঠিক সেই সব কারণের জন্যই সংকট ধীরে ধীরে ঘনীভূত হল- যার বহিঃপ্রকাশ আজ আমরা দিল্লির উপকন্ঠে সমাবেশিত ঐতিহাসিক আন্দোলনের মধ্যে প্রত্যক্ষ করছি। 

খাতায় কলমে বাংলায় সবুজ বিপ্লব হয়নি, কিন্তু ঐ বিপ্লবের যাবতীয় কুফল আজ বাংলার কৃষককে ভোগ করতে হচ্ছে। যে বিষাক্ত উপকরণগুলো পাঞ্জাব হরিয়ানায় ব্যবহৃত হয়েছিল, তা এই রাজ্যেও ব্যাপক হারে প্রয়োগ করা হয়েছে। উচ্চফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, ইন্সেক্টিসাইড, পেস্টিসাইডের দাপটে সাবেক চাষ হারিয়ে যায়। পাঞ্জাবের কৃষক সম্পন্ন হওয়ার কারণে এই নতুন চাষের অত্যধিক খরচ তাঁরা বহন করতে পেরেছিলেন। অল্প জমিতে এত খরচের চাষ করতে গিয়ে বাংলার চাষি মুখ থুবড়ে পড়েন। সবুজ বিপ্লবের ফলে ঐ দুই রাজ্যে প্রায় তিন দশক ধরে কৃষকের উপার্জন উল্লেখজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। বাংলায় আয় বৃদ্ধির তো প্রশ্নই নেই, উল্টে ছোট জমিতে সবুজ বিপ্লব ধরনের চাষ করতে গিয়ে এখানে সংকট পাঞ্জাব হরিয়ানার চেয়েও আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। 

বাংলায় জনপ্রতি জমি ৫.৭০ বিঘা হলেও এক বিপুল সংখ্যক কৃষকের জমি তিন বিঘার আশেপাশে। আগে একবারই চাষ হত কিন্তু বিঘা প্রতি প্রায় ৩০০-৩৬০ কেজি ধান হত। খরচ তেমন ছিল না, কারণ গরু-ছাগলের গোবর নাদি স্বাভাবিক সার হিসাবে কাজে দিত। প্রতি গ্রামের পরম্পরাগত বীজের ভাণ্ডার ছিল তাই উচ্চফলনশীল, বীজের কোনও প্রয়োজন ছিল না। এখন একটার বদলে দুটো চাষ হয়, কিন্তু বিঘা প্রতি ফলন কম, চাষের খরচ অনেক বেশি, এর ফলে চাষির নুন আনতে পান্তা ফুরনোর অবস্থা। 

অনেকের অভিযোগ, সরকার অপদার্থ, বাংলায় মান্ডিগুলো অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকে। কিন্তু ছোট, ক্ষুদ্র চাষি তাঁদের ঐ অল্প উৎপাদন নিয়ে আদৌ মান্ডিতে যেতে কি উৎসাহী? তাঁরা পরিষ্কার বলেন, গ্রামে মান্ডি থাকলেও সেখানে ফসল বেচার অনেক হ্যাপা। লাইন দাও, স্লিপ কাটো, দালাল ও নেতাদের দাদাগিরি, এর পরেও টাকা জমা পড়বে প্রায় এক সপ্তাহ বাদে। মুনিষ তো ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে, তাঁকে তো নগদ টাকা দিতে হবে। সুতরাং, কুইন্টাল প্রতি সরকারি রেট হয়তো ১৮৬০ টাকা, কিন্তু ঘরে এসে যিনি নগদ টাকা দেন চাষি তাঁকেই ১৫০০ টাকায় ধান দিয়ে দেন। যৎসামান্য লাভ হয়, লোকসানও হয়। ছোট চাষির তো সামান্য পুঁজি, সেটা তো তিনি পুরোটাই চাষে নিয়োগ করেছেন। ফসল বেচে সঙ্গে সঙ্গে টাকা না পেলে তিনি খাবেন কী? মান্ডিতে চাষির ব্যাংকের খাতায় ফসলের টাকা জমা না দিয়ে নগদ দেওয়াতেও বিরাট বিপদ, প্রবল দুর্নীতির আশঙ্কা। 

পাঞ্জাব ও বাংলার কৃষকের সমস্যা অনেকটাই ভিন্ন। শুধু মান্ডি বাড়ালে, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দিলেই কি বাংলার চাষির সমস্যার সমাধান হবে? এই কারণে ব্যাংকে এক ধরনের রিভল্ভিং কৃষি ঋণ আছে। ধরা যাক, একটা চাষের জন্য তাঁকে ২০,০০০ টাকা ঋণ দেওয়া হল, ফসল বিক্রি করে তিনি ঐ ঋণ শোধ করে দেবেন এবং পুনরায় তাঁকে ১০ শতাংশ বাড়িয়ে দ্বিতীয় চাষের জন্য ঋণ দেওয়া হবে। দেখা যায়, কৃষি এত অলাভজনক হয়ে পড়ছে যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথম ঋণটাই কৃষক শোধ করে উঠতে পারেন না, একটা অংশ পড়ে থাকে। তাতে হয় পরের চাষের ঋণ আটকে যায়, নয়তো অনাদায়ী অংশ জমতে জমতে একটা বৃহৎ অঙ্কে দাঁড়িয়ে যায়। চাষি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন।  

অন্য সমস্যার মধ্যে আছে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের মতো জেলাগুলিতে সেচের অপ্রতুলতা। আছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়- উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণায়, বিশেষ করে সুন্দরবনে। প্রতি বছর সেখানে ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়া এখন একটা রেওয়াজ হয়ে গেছে। একটা তুফান থেকে সামলে ওঠবার আগেই পরেরটা এসে পড়ে, এর ফলে সুন্দরবনের জনজীবন পুরো বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরেই দেখা যায় স্কুলছুট বেড়ে গেছে, নারী পাচার বেড়েছে, বহু মানুষ ভিটে ছেড়ে কাজের খোঁজে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। অন্য রাজ্যে কাজের খোঁজে যাওয়া মানুষের সংখ্যায় পশ্চিমবাংলা চতুর্থ, প্রথম তিনটি হল উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও রাজস্থান। ফলে, যত দিন যাচ্ছে, বাংলার চাষির মোট উপার্জনের মধ্যে কৃষিকাজ থেকে আয়ের পরিমাণ কমছে। ব্যক্তি হিসাবে তিনি ২০ শতাংশ চাষি, বাকিটা অন্য পেশার। এটা অবশ্যম্ভাবী, যত দিন যাবে এই ২০ শতাংশ কমবে- চাষি আর চাষি থাকবেন না। 

বাংলার কৃষককে বাঁচাতে গেলে কৃষিভিত্তিক শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও অন্যান্য পেশাকে লাভজনক করে তুলতে হবে। সমস্যা গভীর ও জটিল, জেলা বিশেষে, অঞ্চল বিশেষে ভিন্ন। শুধুমাত্র মান্ডি আর ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আওড়ালে এই সমস্যা আমরা ছুঁতেও পারব না। 


Sunday, 19 September 2021

‘দ্য গ্রেট রেজিগনেশন’!

চাকরি ছাড়ার হিড়িক কেন?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

এই বছরের গোড়া থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বহু দেশে ‘গ্রেট রেজিগনেশন’ বা ‘ইস্তফার মহাহিড়িক’ এক রেওয়াজ হয়ে উঠেছে। দলে দলে কর্মীরা বিভিন্ন কর্মক্ষেত্র থেকে ইস্তফা দিচ্ছেন। মার্কিন ব্যুরো অফ লেবর স্ট্যাটিসটিক্স’এর (বিএলএস) তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকায় এই বছরের শুধুমাত্র জুন মাসেই ১ লক্ষ ৬৪ হাজার কর্মী স্ব স্ব কর্মক্ষেত্র থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। মাইক্রোসফট’এর একটি সমীক্ষা বলছে, চলতি বছরে কর্মরত ৪১ শতাংশ কর্মী কাজ ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। বিএলএস’এর আরেকটি তথ্য বলছে, মার্কিন দেশে গত এপ্রিল ২০২০’তে যেখানে ৪০ লক্ষ কাজের সুযোগ ছিল তা জুন ২০২১’এ এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটিতে। অর্থাৎ, প্রাতিষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে কাজের সুযোগ অফুরান কিন্তু কাজের লোক অপ্রতুল। ব্যাপারটি অদ্ভুত হলেও বাস্তব। এমনকি কাজের লোক পেতে ম্যাকডোনাল্ড ও অ্যামাজন’এর মতো সংস্থা তাদের দেয় বোনাস ২০০ থেকে ১০০০ ডলার পর্যন্ত বাড়াতে সম্মত হয়েছে। তবুও যথেষ্ট কর্মী পাওয়া যাচ্ছে না। প্রশ্ন হল, লোকজন সব যাচ্ছে কোথায়?

বদলে যাওয়া রাজনৈতিক-অর্থনীতির আঙ্গিকের সঙ্গে এই উদ্ভুত পরিস্থিতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বহুবার বলা হয়েছে, গত এক দশকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত তথ্য-কেন্দ্রিক ভার্চুয়াল বিপ্লবের যে ধারা অপ্রতিহত গতিতে অর্থনীতির প্রায় সমস্ত আঙিনাকে ছেয়ে ফেলেছে, সেখানে কোভিডের উদয় গত দেড় বছরে এই চলমানতাকে আরও তীব্র ও ব্যাপ্ত করেছে। বাড়ি থেকে কাজ, ডিজিটাল মাধ্যমের বহুল ব্যবহার, অ্যাপ’এর ছড়াছড়ি, বাড়ি থেকে দোকানদারি, সোশ্যাল মিডিয়ার গণসংযোগ, বাড়িতে বসেই খেলাধুলো, ঘর থেকেই সেমিনার-আলোচনাসভা-সম্মেলন, ভার্চুয়াল মাধ্যমে স্কুল-কলেজের পড়াশোনা, চিকিৎসকের পরামর্শ, ব্যাঙ্কের লেনদেন, বিনোদনের রকমফের- সব মিলিয়ে এমন এক নতুন পরিসর নির্মিত হয়েছে যে কাজের বয়ান ও কর্মজগতের সম্পর্কগুলিই গেছে আমূল বদলে। মূলত পরিষেবা ও রিটেল’এর কর্মজগতে এই অভাবনীয় পরিবর্তন এক যুগ সন্ধিক্ষণের আবাহন করেছে। যেন, কর্মজগতের এ তাবৎ আঙ্গিক ও সম্পর্কগুলিই তছনছ হয়ে যেতে বসেছে। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, ব্যবস্থাটাই বুঝি ভেঙে পড়ছে।

আসলে, পরিষেবা ও রিটেল ক্ষেত্র অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্রে চলে আসায় এবং তদুপরি প্রায়-সম্পূর্ণত ডিজিটাল ও ভার্চুয়াল হয়ে ওঠায় যে কাজের পরিসর তৈরি হয়েছে তা আরও আরও নতুন কাজেরও সুযোগ সৃষ্টি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, বাড়ি বাড়ি বিবিধ পণ্য বা খাবার পৌঁছে দেওয়ার যে ব্যবস্থাপনা, তাকে কেন্দ্র করেই কাজের বহু নতুন আয়োজন তৈরি হয়েছে- যেমন, ডেলিভারি বয় নিযুক্তি থেকে স্বয়ংক্রিয় অ্যাপ’এর ব্যবস্থাদি, টাকাপয়সার অনলাইন লেনদেন থেকে পণ্যের চাহিদা-জোগানের শৃঙ্খল গড়ে তোলা ও নানাবিধ- তা শুধুমাত্র নতুন কর্মসংস্থানই জোগায়নি, এক জোরালো অর্থনৈতিক সত্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই উদ্ভুত ব্যবস্থাপনা, কোভিডে মানুষের বাধ্যত ঘরবন্দী দশায় আরও বেশি অভিনব হয়ে উঠে মানুষকে ঘরকুনো করে দিয়েছে; আর তা করতে গিয়ে তাকে আবার এমন এমন কাজের আঙ্গিক ও পরিসর নির্মাণ করতে হয়েছে যার স্থায়িত্ব স্বল্পস্থায়ী ও নিযুক্ত কর্মীবাহিনীও চুক্তিভিত্তিক। যারা নিযুক্ত হলেন, তাদের সামনে কাজের এক অপার বিচিত্র দুনিয়া খুলে গেল বটে কিন্তু সেখানে এতই অনিশ্চয়তা ও চাপ যে তারাও মানিয়ে নিতে নিতে এমন ভাবে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেন যে তাঁদের পক্ষে কাজ ছেড়ে দেওয়া ও নতুন কাজে যোগ দেওয়া রীতিমতো দস্তুর হয়ে উঠল। কর্মের এই গতিময়তায় ও কাজের অফুরান বিস্তারে, দেখা গেল, বহু ক্ষেত্রেই কর্মীর চাহিদা তাদের জোগানের থেকে অধিক হয়ে উঠছে। ফলে, কর্মীদের দরকষাকষির আপাত সুযোগও গেল বেড়ে। অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে এমন পরিস্থিতিই সর্বদা বিরাজ করবে। ভবিষ্যতে এর উল্টোটাও ঘটতে পারে। সে আলোচনায় পরে আসছি।

তদুপরি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগ্রাসী বিচরণে অন্যতর কাজেরও এমন আঙ্গিক নির্মিত হতে থেকেছে যেখানে স্বাধীন ভাবে সাফল্যের সঙ্গে কর্মরত হতে পারলে রোজগারের পথ উন্মুক্ত হয়ে যেতে পারে। যেমন, ইউটিউবার’এর সাফল্য এখন আকাশচুম্বী। সম্প্রতি, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতিন গড়কড়ি জানিয়েছেন, তাঁর বক্তৃতা ইউটিউবে জনপ্রিয় হওয়ায় তিনি সেখান থেকে রয়্যালটি বাবদ মাসে চার লক্ষ টাকা করে পাচ্ছেন। শুধু তিনি কেন, বহু বহু মানুষ ইউটিউব’এ ভিডিও আপলোড করে (যদি জনপ্রিয়তার মানদণ্ড অতিক্রম করতে পারে) যথেষ্ট রোজগারের উপায় পেয়েছেন। কিছুদিন আগে খবরে প্রকাশ, বাঁকুড়ার এক ঠাকুমা তাঁর নাতির সাহায্যে ইউটিউব’এ রান্নার নানান কলাকৌশলের ভিডিও আপলোড করে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা উপার্জনের ব্যবস্থা করেছেন। বলার কথা এই, কাজের এমনতর বহুমাত্রিক বিবিধ ধারা এসে পড়েছে যে তা মানুষের মধ্যে কাজকর্ম সম্পর্কে এক নতুন সংজ্ঞা হাজির করছে। এই কাজগুলি আচম্বিত, স্বল্পস্থায়ী কিন্তু অনেক সময়েই প্রভূত অর্থের হাতছানিতে ভরপুর। ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করে অর্থ রোজগারের আশায় যেহেতু বহু মানুষ সামিল হয়েছেন, ফলে, ভিডিও-মেকিং’এর কারুকৌশল জানাটাও এখন হয়ে উঠেছে রোজগারের অন্যতম আরেক উপায়। এইভাবে অর্থ উপার্জনের একেকটি ক্ষেত্র উন্মোচিত হচ্ছে আর তার পিছু ধরে কাজের আরও কতকগুলি প্রয়োজনীয় পরিসর নির্মাণ হয়ে যাচ্ছে যেখান থেকে আবার রোজগারের সংস্থান হচ্ছে।

ধরা যাক, স্বউদ্যোগী হয়ে ওঠার স্বপ্ন- যা ‘স্টার্ট-আপ’ অভিধায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে বহু মানুষকে প্রণোদিত করেছে ও এই পথে নামিয়েছে। যে কোনও পরিষেবা প্রদান বা পণ্য উৎপাদনকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন স্বউদ্যোগ গড়ে ওঠাটা আজ প্রকৃতই বাস্তব এবং তার জন্য যে খুব বেশি মূলধনের দরকার পড়ে তাও সব সময় নয়। অতীতে যে কোনও স্বউদ্যোগ গড়ে তোলার পিছনে বাজারের লভ্যতা খুব বড় বিষয় ছিল। কিন্তু আজ সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন ক্রয়-বিক্রয়ের এক সুদূরপ্রসারী আন্তর্জালের দৌলতে ব্যাপারটা খুব অনায়াস হয়ে উঠেছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, বহুজনে চাকরি অথবা চুক্তি-ভিত্তিক কাজ ছেড়ে নিজস্ব উদ্যোগ গড়ে তুলতে ব্রতী হয়েছেন। এই কারণেও ইদানীং অনেকে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন।

 

এ এক আশ্চর্য রাজনৈতিক-অর্থনীতির গলিপথে আমাদের প্রবেশ। যে গলিপথ থেকে আরও হাজারে হাজারে অলিগলি নির্গত হয়ে আমাদের নিয়ে চলেছে এক লোভনীয় অথচ অনিশ্চয়তার ভুবনে। যে গলিতে প্রবেশ করা গেল (কাজের সংস্থান হল), সে গলির পথ কিছুটা গিয়ে যদি দেখা যায় রুদ্ধ, তবে আরও কোনও গলি সে গলি থেকে নির্গত হয়েছে। এইভাবে অলিতে গলিতে ঘুরে নুড়ি কুড়িয়ে কুড়িয়ে তবেই আজকের নিত্য যাপনকর্ম। এইভাবেই শ্রম আজ যন্ত্রের অ্যালগরিদমে হন্যে হয়ে এ-কাজ সে-কাজে পরিব্যাপ্ত থেকে কিছু না কিছু রোজগারের পথ করে নিচ্ছে। তবে, চুক্তির শর্তানুযায়ী যেটুকু ব্যবসা শ্রমের অধিকারী ব্যক্তি-শ্রমিক কোম্পানিকে দিতে পারছেন তার কিয়দংশ মাত্রই তিনি ফেরত পাচ্ছেন। অন্যত্র ভাগের কড়ি যদি বেশি হয় তবে অনায়াসে তিনি সেদিকে গমন করতে পারেন। তাই গলির ভেতর গলি, অযূত গলির ভেতর দিয়ে শ্রমের অনির্দেশ্য যাত্রাপথ। আর এই যাত্রাপথের দিকনির্দেশ ক্রমেই হাতে নিয়ে নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত এমন এক ডিজিটাল যন্ত্রব্যবস্থা যা কৃষ্ণ গহ্বরের মতো প্রবল আকর্ষণে পুঁজির সিংহভাগকে টেনে নিচ্ছে নিজ কক্ষে। পুঁজির কাছে এই প্রবল আকর্ষণটি হল মুনাফার ক্রম উচ্চ হার যা অর্জিত হয় শ্রম-ব্যয়কে সংকুচিত করে। শ্রম ঘুরে বেড়াচ্ছে ফ্রি মলিকিউলের মতো, তার দায়-দায়িত্ব আর পুঁজির নেই।

কিন্তু এই ব্যবস্থাপনার অভ্যন্তরেই আবার শ্রমের চাহিদা-জোগানের নিজস্ব চালিকাশক্তিটিও সক্রিয়। যদি শ্রমের সামনে প্রভূত কাজের সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যায়, তবে শ্রমের এক নিজস্ব প্রতিরোধ শক্তি গড়ে ওঠে। তা এই অর্থে, শ্রম তখন এক কাজ ছেড়ে অন্য কাজে চলে যাওয়ার ফুরসত ও ভরসা পায়। আর যেহেতু আজ মনুষ্য শ্রমের একটা বড় অংশ বিশেষ দক্ষতা ও জ্ঞান নির্ভর, অতএব, কোনও কোনও সন্ধিক্ষণে বিশেষ দক্ষতা-জ্ঞানলব্ধ শ্রমের আকাল পুঁজির পক্ষে সমস্যাসঙ্কুল হয়ে উঠতে পারে। আজকের ‘গ্রেট রেজিগনেশন’ বা ‘ইস্তফার মহাহিড়িক’এর প্রবণতা সেই সমস্যার দিকেই ইঙ্গিত করছে। আর তা শুধু উন্নত দেশেই নয়, আমাদের দেশেও সক্রিয় হয়েছে। কারণ, আধুনিক রাজনৈতিক-অর্থনীতি কোনও দেশের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই আর। তার ভার্চুয়াল অস্তিত্ব তাকে বিশ্বায়িত করেছে বহু আগেই।

 

খবরে প্রকাশ, সম্প্রতি দেশের বড় বড় আইটি কোম্পানিগুলির (টিসিএস, উইপ্রো, ইনফোসিস ইত্যাদি) কর্মী চাহিদা প্রায় ৪০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্মীদের তারা বেশ উচ্চ হারে বেতন ও বোনাস (৭০ থেকে ১২০ শতাংশ বর্ধিত হারে) দিতে রাজী হয়েছে। অথচ, মাত্র গত বছরেই এই সময়ে তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নিয়োগের হার ৫০ শতাংশেরও বেশি পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রযুক্তির ক্রম বিবর্তনে, বিশেষত কোভিড কালে আরও উন্নত প্রযুক্তির আবাহনে, এমন সমস্ত দক্ষতা ও জ্ঞানলব্ধ শ্রমের দরকার পড়েছে যে তা না হলে বৃহৎ ডিজিটাল ও তথ্য প্রযুক্তি কোম্পানিগুলির পক্ষে পুঁজির বাজারে অগ্রণী হয়ে টিকে থাকাটা কষ্টকর। যে দক্ষতা-নির্ভর মনুষ্য শ্রমের চাহিদা সব থেকে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে: অ্যাপলিকেশন ডেভেলপার, সেলসফোর্স ডেভেলপার ও সাইট রিলায়েবিলিটি ইঞ্জিনিয়ার। এই চাহিদা ও খরচের ফলে ২০২১-২২ সালের আর্থিক বছরে মজুরি খাতে আইটি কোম্পানিগুলির প্রায় ১.৬ থেকে ১.৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। যদি শ্রমের পিছনে এই ব্যয় বৃদ্ধি করতে কোম্পানিগুলি বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত হত, তবে তারা আগামী দিনে পুঁজির বাজার থেকে ছিটকে বেরিয়ে যেত। ‘ইস্তফার মহাহিড়িকে’ তারা জেরবার হত। বা হয়তো, কিছুটা হয়েওছে।

অর্থাৎ, এক শ্রেণির দক্ষতা-জ্ঞানলব্ধ শ্রমের যে উচ্চমূল্যের বাজার তৈরি হয়েছে, তার বাধ্যত ব্যবহারের কারণেই এই উচ্চমূল্যের ধারক শ্রমিক বা কর্মীরা শ্রমের বাজারে পুঁজির সঙ্গে বেশ জোরালো দর কষাকষিতে নিযুক্ত হতে পারছেন। তাঁদের ট্রেড ইউনিয়নের কোনও দরকার পড়ছে না, নিজেদের জ্ঞানমূল্যের জোরেই তাঁরা আদায় করে নিচ্ছেন সম্ভ্রম ও উচ্চ মজুরি। এঁরাই এক অর্থে আজকের আধুনিক শ্রমিকের এক বড় অংশ। আর তা পুরনো জমানার মতো গুটি কয়েক পেশাদারি লোকজনের এক্তিয়ারভুক্ত নয়, লাখে লাখে এমনতর শ্রমিক-কর্মীর উপস্থিতি। তথ্য প্রযুক্তি ও ডিজিটাল দুনিয়ায় পুঁজির বিপুল সমাবেশ ও অপ্রতিরোধ্য গতির পক্ষেই তাই এই ধরনের উচ্চ মজুরি প্রদান করা বাস্তবে সম্ভব। কারণ, নিকট ভবিষ্যতে এই দক্ষতা-জ্ঞানলব্ধ শ্রমের কার্যকারিতা ফুরিয়ে আসবে কোনও উন্নততর যন্ত্র-প্রযুক্তিতে উত্তরণের মাধ্যমে আর তখন আবার দেখা যাবে যে মনুষ্য শ্রমের আপেক্ষিক প্রয়োজন কমে এসেছে এবং ‘গ্রেট রেজিগনেশন’এর ইতি ঘটেছে। এইভাবেই আমরা প্রযুক্তির নবতর উন্মেষের মধ্য দিয়ে আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে প্রবেশ করেছি যেখানে চেষ্টা চলেছে মনুষ্য শ্রমের ভারকে লাঘব করে মজুরি খরচ কমিয়ে মুনাফার হারকে উর্ধ্বমুখি রাখা। কিন্তু মানুষ ছাড়া যেহেতু উন্নত প্রযুক্তির নির্মাণ ও তার ব্যবহার প্রায়শই অসম্ভব, তাই নিয়ম করেই এমন এমন সময় আসে যখন মনুষ্য শ্রমের চাহিদা কিছু সময়ের জন্য বেড়ে যায়- আখেরে দীর্ঘমেয়াদে মনুষ্য শ্রমকে বাতিল, অকেজো অথবা দুঃস্থ করে দিতেই।

কিন্তু প্রশ্ন হল, আমাদের মতো দেশে এখনও যারা নিতান্তই মুটে-মজুর, গায়ে গতরে খাটা শ্রমজীবী মানুষ, যাদের দক্ষতার মূল্য প্রায় বিলীন, সাবেক কর্মক্ষেত্রে যাদের বিচরণ- তাহলে তাদের বেঁচে থাকার উপায় কী? এই প্রশ্নটির উত্তর নিয়েই সকলের এখন মাথাব্যথা। সে আবার অন্যত্র আলোচনা করা যাবে। কিন্তু গিগ অর্থনীতি যে ধীরে ধীরে সমাজ জীবনকে ছেয়ে ফেলছে, সে বাস্তবতাকে অস্বীকার করার আর কোনও উপায় নেই। কারণ, পুঁজি ও মুনাফার বৃহদাংশ এখন গুটি কয়েক কর্পোরেটের কাছেই গচ্ছিত। তারা ভার্চুয়াল ও ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে দখল নিচ্ছে বিশ্বের সমগ্র রাজনৈতিক-অর্থনীতিকে।