Saturday, 23 June 2018

৫ মে 'একক মা'ত্রা'র প্রকাশ অনুষ্ঠান

সংস্কৃতির বহুত্ব বনাম বিশ্ব বাজারের সংস্কৃতি
অরুণাভ বিশ্বাস

সমাবেশের ছবি
 
'একক মাত্রা'র মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান পাঠক-সম্পাদক-লেখকের ত্রিবেণী সঙ্গম। বিগত কয়েকটি সংখ‍্যার মতোই ৫মে বিকেলে পত্রিকার মে'১৮ সংখ‍্যা (প্রচ্ছদ বিষয় : লোকাচার লোকধর্ম)-র আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হয় কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের তিনতলায় ব‌ই-চিত্র সভাঘরে। ছিল একজোড়া বক্তৃতার আয়োজন।
বলছেন অচিন চক্রবর্তী

মার্কসের দ্বিশততম জন্মদিনে আজকের প্রেক্ষাপটে তাঁর রাজনৈতিক-অর্থনীতির প্রাসঙ্গিকতার পুনর্বিচার করতে গিয়ে অচিন চক্রবর্তী বলেন ২০০৮ পরবর্তী বিশ্বসঙ্কটের পর থেকে সর্বত্রই মার্কসকে নতুন করে পাঠ করার প্রবল আগ্রহ দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে মার্কস ফিরে আসছেন। অন‍্যদিকে যেসব অল্পবয়সীরা ক্লাসে মার্কসকে পড়তে আসছে তারা শুধু দাস ক‍্যাপিটালের কোন পাতায় কী লেখা আছে তার চর্চা করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, তারা এটাও বুঝে নিতে চাইছে কিভাবে মার্কসকে ব‍্যবহার করে সমসাময়িক সমাজকে ব‍্যাখ‍্যা করা যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নম্বর পাওয়ার পড়াশোনার অ্যাকাডেমিক ঘেরাটোপে মার্কসের মূল‍্যতত্ত্ব ‌ও সারপ্লাস ভ‍্যালু ব‍্যবহার করে সমাজ বোঝার প্রয়াস সত‍্যিই নতুন। এর পাশাপাশি হালফিলের মার্কস চর্চার আরেকটি নতুন দিক হল দাস ক‍্যাপিটালের প্রথম খণ্ডের সাথে দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডের উপরেও জোর দেওয়া। এর ফলে মার্কসের রাজনৈতিক-অর্থনীতির চর্চায় শ্রেণি কাঠামোর ধারণার পাশাপাশি শ্রেণি প্রক্রিয়ার ধারণাটিও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

অচিনবাবু বোঝান যদি শ্রেণি প্রক্রিয়ার জায়গা থেকে পুঁজিবাদকে চিহ্নিত করা হয় তাহলে দেখা যাবে মালিকানা এবং বাজার দুটি আলাদা বিষয়। আমরা সচরাচর উৎপাদন প্রক্রিয়া বলতে এক বিশেষ ধরনের পুঁজিবাদী প্রক্রিয়া বুঝি যেখানে উপকরণ ও উৎপাদিতের মালিকানা বিশেষ প্রাসঙ্গিক। কিন্তু এক‌ই জিনিস শ্রেণি প্রক্রিয়ার ধারণা থেকেও বুঝতে হবে। পুঁজিবাদী শ্রেণি প্রক্রিয়ার দুটি পর্যায়। প্রথমটি চরিত্রে মূলগত বা fundamental যেখানে উৎপাদন (production) হল মূল বিষয় এবং দ্বিতীয়টি চরিত্রে অন্তর্গত বা subsumed যেখানে গ্ৰহণ (appropriation) এবং বন্টন (distribution) হল মূল বিষয়। উৎপাদন প্রক্রিয়া শ্রমিক শ্রেণির নিয়ন্ত্রণে থাকলেও কোনও অর্থনৈতিক ব‍্যবস্থা তার পুঁজিবাদী চরিত্র হারাবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত উৎপাদিত পণ‍্যের গ্ৰহণ ও বন্টনে শ্রমিক শ্রেণির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। আর ঠিক এই কারণেই টিমটিম করে টিকে থাকা সমবায়গুলিকে অচিনবাবু পুরোপুরি অপুঁজিবাদী প্রক্রিয়া বলতে রাজি নন। অনেক সময়েই দেখা যায় কোনও সমবায়ে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রমিক শ্রেণি পরিচালকের ভূমিকায় থাকলেও উৎপাদিত পণ‍্যের গ্ৰহণ ও বন্টনে সুবিধাভোগী রাজনৈতিক নেতা বা দুর্নীতিপরায়ণ আমলাদের কথাই শেষ কথা। অন‍্যদিকে, শ্রেণি প্রক্রিয়ার দৃষ্টিতে শ্রেণি অবস্থান ব‍্যক্তি-কেন্দ্রিক নয়, বরং একজন ব‍্যক্তির একাধিক শ্রেণি অবস্থান থাকতে পারে। তা নির্ভর করছে উৎপাদন-গ্ৰহণ-বন্টন এই তিনটি স্তরের প্রতিটিতে ঐ ব‍্যক্তির ভূমিকা কীরকম। যাই হোক, অচিনবাবুর কথায়, সময় খারাপ হলে ভাবনার জগৎ খুলে যায়। তাই হয়তো বিশ্বমন্দা পরবর্তী সময়ে পুঁজিবাদের চেহারা কেমন হবে তা নিয়ে নিরন্তর চর্চা চলছে। সেই চর্চায় অসাম‍্য বা বৈষম‍্যের ধারণাটিও গুরুত্ব পাচ্ছে। অন‍্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ভারী শিল্প নিয়ে যে সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল তার‌ও বাস্তবায়নের কোনও আশা দেখা যাচ্ছে না। বুঝতে হবে যে রাষ্ট্রীকরণ কখন‌ই একটি অপুঁজিবাদী প্রক্রিয়া নয়, কারণ সেখানে গ্ৰহণ ও বন্টনের ভার শ্রমিক শ্রেণির হাতে থাকে না। এই সব মিলিয়ে মার্কসের রাজনৈতিক-অর্থনীতি পুনরায় চর্চিত হচ্ছে।
কুমার রাণা

গত ৪মে'১৮ তারিখে জলপাইগুড়িতে আশি বছর বয়সে গলার ক‍্যানসারে ভুগে মারা গেলেন বিশিষ্ট বামপন্থী নেতা ভাস্কর নন্দী। স্মৃতিচারণায় কুমার রাণা বলেন ভাস্কর নন্দীর কাজের ক্ষেত্র ছিল অসম ও উত্তরবঙ্গ। আমৃত্যু তিনি ছিলেন সিপিআই(এমএল)-র প্রভিশনাল সেন্ট্রাল কমিটির পলিটব্যুরোর মেম্বার তথা সাধারণ সম্পাদক। ছাত্র হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিক‍্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পাশ করলেও সমাজবিদ‍্যা নিয়ে পড়তে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যান এবং সেখানে পড়াতেও শুরু করেন। এ সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভে সক্রিয় অংশ নেন। পরে উত্তাল সত্তরের দশকে নকশালবাড়ির অমোঘ আকর্ষণে সাড়া দিয়ে সস্ত্রীক গাড়ি চালিয়ে র‌ওনা দেন ইংল্যান্ড থেকে এবং সমগ্ৰ ইউরোপ আর পশ্চিম এশিয়া পার করে উত্তরবঙ্গে পৌঁছান। সেখানে বাম আন্দোলনের প্রচার ও প্রসারে বিশেষ ভূমিকা নেওয়ার পাশাপাশি রাজবংশী, চা-শ্রমিক তথা সে অঞ্চলে আগত আদিবাসীদের দুঃখ-দুর্দশা মোচনেও নানান কর্মসূচি গ্ৰহণ করেন। ১৯৮৬ সালে কলকাতায় বামপন্থী দলগুলির একটি বড় সম্মেলনে সংখ‍্যালঘু ও দলিতদের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে ভাস্কর নন্দীও জাতপাত দূরীকরণে স‌ই সংগ্ৰহ অভিযানে নেমে পড়েন। উত্তর-পূর্ব ভারতের শ্রমজীবী প্রান্তিক মানুষদের জানতে গেলে ভাস্কর নন্দীকে জানতে হবে। আমৃত্যু ফ‍্যাসীবিরোধী এই মানুষটি মার্কসবাদকে নতুন ভাবে বুঝতে চেয়েছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য তিনি বেশি লেখালিখি করে যাননি, যদিও তিনি পিসিসি, সিপিআই(এমএল)-র মুখপত্র For a New Democracy'র মুখ‍্য-সম্পাদক ছিলেন।
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

সদ‍্যপ্রয়াত বামপন্থী বুদ্ধিজীবী অশোক মিত্রের সাথে নিজের ঘনিষ্ঠতার দাবি করতে চান না সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। দুজনের আলাপ হয়েছিল লতিকা গুহ সম্পাদিত ব‌ইয়ে 'বুদ্ধিজীবী ও নানান প্রশ্ন' শীর্ষক একটি লেখাকে কেন্দ্র করে। পরে সে আলাপ বদলে রূপ নিয়েছে বয়োজ‍্যেষ্ঠর স্নেহে ও কনিষ্ঠের মুগ্ধতায়। সেই সম্পর্কে কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি ব‍্যক্তিগত কারণে অশোক মিত্রের 'আরেক রকম' পত্রিকায় সঞ্জয়বাবুর লিখতে অস্বীকার করা। যাই হোক, স্মৃতিচারণায় সঞ্জয়বাবু অভিমত ব‍্যক্ত করেন যে অশোক মিত্র যত‌ই "আমি ভদ্রলোক ন‌ই, আমি কমিউনিস্ট" বলে থাকুন না কেন, আদতে তিনি ছিলেন সাবেকি বাঙালি ভদ্রতাবোধের শীর্ষবিন্দু। তাই তো বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে অধ‍্যাপিকা দময়ন্তি সিংকে যথোচিত সম্মান প্রদর্শনে এতটুকু কার্পণ্য করেননি, যদিও বয়স খ‍্যাতি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায় অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন তিনি। এক‌ইভাবে প্রথম যৌবনে জীবনানন্দের স্বকৃত মূল‍্যায়নকে পরিণত বয়সে সলজ্জ ভঙ্গিতে অগ্ৰাহ‍্য করতেও তিনি পিছপা ছিলেন না। নিজে মার্কসবাদী অর্থনীতির মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাঁর চর্চার ক্ষেত্র ছিল শ্রেণি সংগ্ৰাম ও বাণিজ্য অর্থনীতি। অন‍্যদিকে মার্কসবাদের সাথে রোমান্টিক আন্দোলনের প্রাথমিক ধারণাগুলির সাযুজ্য খুঁজে পেতেন তিনি। মার্কসের লেখা ব‌ইপত্র যেমন ক‍্যাপিটালকে উঁচুদরের সাহিত‍্য বলে মনে করতেন। ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই সমান স্বচ্ছন্দ ছিলেন তিনি। তাঁর Calcutta Diary  যেমন পাঠকের সমাদর পেয়েছে তেমনি তাঁর স্মৃতিকথা আপিলা চাপিলা  শিক্ষিত বাঙালির হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন পাকা করেছে। স্বভাবে বিনয়ী হলেও ওপার বাংলা বিশেষত ঢাকা জেলার লোকের উপর পক্ষপাত তিনি আড়াল করতে পারতেন না। এ কারণেই জ‍্যোতিবাবুর সাথে তাঁর সম্পর্কের সমীকরণটি স্বকীয়তা দাবি করে। নিজের বাচনভঙ্গিও ছিল ঢাকাই। বাঙালসুলভ মানসিকতা ছিল তাঁর স্বভাব বৈশিষ্ট‍্য। এই একরোখা মনোভাবের সাথেই তিনি বামপন্থাকে মনে করতেন নোয়ার নৌকা। এ ব‍্যাপারে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কোনও সমঝোতায় রাজি ছিলেন না তিনি। বামপন্থার সাথে যাবে না এমন যে কোনও কিছুকেই মুখের ওপর 'না' বলতে এতটুকু দেরি হত না তাঁর। বলতে গেলে বামপন্থা ছিল তাঁর জীবনদর্শন যার প্রতি মুগ্ধতা তথা দায়বদ্ধতা তাঁর আমৃত্যু অটুট ছিল। সঞ্জয়বাবুর মূল‍্যায়নে অশোক মিত্র অবশ‍্য যত না মার্কসিস্ট তার চেয়েও বেশি র‍্যাডিকাল। বলা যেতে পারে, তিনি ছিলেন ব্রহ্মবান্ধব, বিপিন পাল বা সমর সেন ধারার শেষ প্রতিনিধি। বাস্তব অবস্থার সাথে যোগাযোগের অভাবে তাঁর চেতাবনি রাজ‍্যের তৎকালীন বামপন্থী শাসকদলটি উপলব্ধি করতে পারেনি। ফল যা হ‌ওয়ার তাই হয়েছে। যদিও কঠিন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও তিনি এই বিশ্বাসে অটুট ছিলেন যে সাধারণ মধ‍্যবিত্তের পরিত্রাণের পথ আছে, এবং তা বামপন্থায়।
'ক্যানসারের অন্য পরিচয়' বইয়ের প্রকাশ

অনুষ্ঠানে মূল বক্তৃতার আগে ডা মনু কোঠারি ও ডা লোপা মেহতা লিখিত The Nature of Cancer  নামক ৯৩২ পাতার আকর গ্ৰন্থটির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ The Other Face of Cancer  ব‌ইটির বাংলা অনুবাদ ক‍্যানসারের অন‍্য পরিচয়  ব‌ইটির (উপপথ প্রকাশনী)‌ আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হয়। ব‌ইটি সম্পর্কে বলেন অনুবাদক ডা স্থবির দাশগুপ্ত। The Nature of Cancer প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। ক্যান্সার আক্রান্ত বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ইভান ইলিচ (বিশ্বচর্চিত Medical Nemesis'এর রচয়িতা)-এর পরামর্শে এই বইটির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ (The Other Face of Cancer) ১৯৭৯ সালে আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি এবং হল্যাণ্ড থেকে, ইলিচের ভূমিকা সহ প্রকাশিত হবার পর বিশ্বব্যাপী আলোড়ন ওঠে। ইতোমধ্যে বাংলা সহ ছয়টি ভাষায় এই সংক্ষিপ্ত সংস্করণটি প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান ব‌ইটিতে ২০১৮ পর্যন্ত প্রথাসিদ্ধ ক্যান্সার চিকিৎসা প্রগতির(!) বিস্তারিত পর্যালোচনা করে লেখকদ্বয় দেখিয়েছেন যে ১৯৭৩ সালে ক্যানসার এবং তার চিকিৎসা প্রসঙ্গে তাঁদের প্রায় প্রত্যেকটি সমালোচনা আজ স্বীকৃতি পাচ্ছে। আজ মেনে নেওয়া হচ্ছে যে :
● ক্যানসার আদৌ কোনও বাহ্য কারণের জন্য হয় না, তা আমাদের সহজাত, সময় নির্ধারিত, জীর্ণন প্রক্রিয়ার অভিব্যক্তি।
● আর্লি ডিটেকশন অফ ক্যানসার আসলে একটি মিথ, যাকে কবরস্থ করা অত্যধিক  জরুরি।
● যেহেতু এই রোগটির জন্য কোনও কারণের দরকার পড়ে না (অর্থাৎ, সেটি causeless), তাই তার নিরাময়ের প্রশ্নই ওঠে না (অর্থাৎ, তা cureless)।
● ক্যান্সার মুখ্যত যন্ত্রণাদায়ক নয়। কেমোথেরাপি, রেডিয়োথেরাপির মতো  প্রাণান্তকর চিকিৎসাই রোগটিকে যন্ত্রণাদায়ক করে তোলে।
● বাস্তবিকতা হল এই যে কেবলমাত্র উপশমকারী (প্যালিয়েটিভ) চিকিৎসাই  কাম্য, সমস্তরকম আগ্রাসী আরোগ্যকারী (ক্যুরেটিভ) চিকিৎসা যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুকে  তরান্বিত করে এবং আর্থিক ভাবে রুগীর পরিবারকে সর্বস্বান্ত করে।
● অচিকিৎসিত ক্যানসার রুগী অবশ্যই চিকিৎসিত রুগীর থেকে আরামে, বেশিদিন বাঁচেন।
স্থবির দাশগুপ্ত

আমন্ত্রিত বক্তা জয়ন্ত বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়কে নতুন করে 'একক মাত্রা'র পাঠকদের কাছে চেনানোর নেই। তিনি এই পত্রিকার নিয়মিত লেখক‌ই শুধু নন, সম্পাদকমণ্ডলীর অন‍্যতম সদস‍্য‌ও বটে। তবে তার বাইরে জয়ন্তবাবুর কাজের পরিসর বহুধাবিস্তৃত। আর সেসবের সাথে সংক্ষেপে পরিচয় করালেন তুষার চক্রবর্তী। পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্পর্কে সঠিক নীতি যে কী হতে পারে তা নিয়ে যে কজন বাঙালি আন্তর্জাতিক স্তরে কাজ করেছেন জয়ন্তবাবু তাঁদের অন‍্যতম। কানপুর আইআইটি থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এম‌আইটিতে যান। ফিরে এসে ব‍্যাঙ্গালোর ও কলকাতার আইআইএম'এ পড়ান। কলকাতার ম‍্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানটিতে তিনিই সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট এন্ড এনভায়রনমেন্ট পলিসি প্রতিষ্ঠা করেন। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং তাঁকে নদীবাঁধের কর্মক্ষেত্রে নিয়ে আসে। কিন্তু সেখান থেকে তাঁর কর্মজীবন বাঁক নেয় নদীবাঁধ নির্মাণের রাজনীতির মুখোশ উন্মোচনে। হিমালয় হতে উৎপন্ন নদীগুলির চরিত্র নির্ধারণে নিরন্তর চর্চা তাঁকে বর্তমানে কাঠমান্ডুর ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্ৰেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট এবং টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের জলদৌত‍্য কর্মসূচির অন‍্যতম সদস‍্যপদ এনে দিয়েছে। এইভাবে প্রাতিষ্ঠানিক প্রযুক্তিবিদ‍্যার পরিসর ছেড়ে নিজেকে ব‍্যস্ত রাখেন পরিবেশবিদ‍্যা তথা পরিবেশ আন্দোলনে। বর্তমানে তিনি জেনেভার ইন্টারন্যাশনাল আকাদেমি অফ এনভায়রনমেন্ট'এর সদস‍্য এবং আইইউসিএন'এর একজন উপদেষ্টা। বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেওয়ার পাশাপাশি ১৪টি বিশ্বসমাদৃত ব‌ই এবং একশটির‌ও বেশি প্রবন্ধ লিখেছেন।
জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়

দু ঘন্টার অনুষ্ঠানে মার্কস থেকে মনু কোঠারি, লোকাচার থেকে বিশ্ববাজার, ইত‍্যাদিকে ধরানো একমাত্র 'একক মাত্রা'র পক্ষেই সম্ভব। এমন সরস উক্তি দিয়ে মূল বক্তৃতা শুরু করেন জয়ন্ত বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়। প্রায় উনিশ বছরের পত্রিকার শতাধিক প্রচ্ছদ বিষয়ের বৈচিত্র্যকে উচ্চপ্রশংসিত করলেও উপস্থিত পাঠকবন্ধুদের তিনি সতর্ক করে দেন যে প্রবন্ধপাঠের অভ‍্যাসকে যেন পল্লবগ্ৰাহীতা গ্ৰাস না করে ; যা-ই পড়া হবে তা যেন মৌলিক এবং নিবিড় হয়। জয়ন্তবাবুর বক্তৃতার শীর্ষক ছিল 'বহুত্ববাদ বনাম বিশ্ববাজারের সংস্কৃতি'। 'একক মাত্রা'র প্রচ্ছদ বিষয়ে লোকাচার বা লোকধর্মের অন্তর্ভুক্তিকে তিনি বহুত্ববাদের চর্চা বলেই মনে করেন। তবে বর্তমানে একবিংশ শতাব্দীতে বহুত্ববাদবিনাশকারী শক্তির অভাব নেই, বিশ্ববাজার যাদের অন‍্যতম। এ প্রসঙ্গে তিনি রবীন্দ্রনাথের ১৯০৪ সালে লেখা 'স্বদেশী সমাজ' (আত্মশক্তি ) নামক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি পড়ে শোনান :

আমাদের সমাজ এখন আর এরূপভাবে চলিবে না। কারণ , বাহির হ‌ইতে যে উদ‍্যত শক্তি প্রত‍্যহ সমাজকে আত্মসাৎ করিতেছে, তাহা ঐক‍্যবদ্ধ, তাহা দৃঢ় -- তাহা আমাদের বিদ‍্যালয় হ‌ইতে আরম্ভ করিয়া সর্বত্রই নিজের একাধিপত্য স্থুলসূক্ষ্ম সর্ব আকারেই প্রত‍্যক্ষগম‍্য করিয়াছে।

রবীন্দ্রনাথের এই অমোঘ সাবধানবাণীকে মাথায় রেখে জয়ন্তবাবু তাই সিদ্ধান্তে আসেন যে প্রাক-শিল্পযুগের কৃষি-অর্থনীতির ভিত্তিতে চলা লোকাচার লোকধর্ম বা লোকশিল্পের সাথে বিশ্বায়ন পরবর্তী যুগের বাজার অর্থনীতির সম্পর্কটি ব‍্যাস্তানুপাতী। সম্পর্কের এই সমীকরণটির বিস্তারিত ব‍্যাখ‍্যায় জয়ন্তবাবু না গেলেও প্রায় এক‌ই বিষয় নিয়ে তাঁর অন‍্য একটি লেখার অনুবাদকর্মের অভিজ্ঞতা থাকায় কিছু অতিরিক্ত লেখার স্বাধীনতা গ্ৰহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। 'আধুনিকতার জন‍্য উন্নয়ন' এই ধারণাকে প্রশ্ন করার ক্ষমতা হাতেগোনা ব‍্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ‍্যেই সীমায়িত থাকায় ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে নাগরিকদের ভালোমন্দের দায়ভার আরোপিত হয়েছে উন্নয়ন ও আধুনিকতার তথাকথিত কাণ্ডারী খোলা বাজারে হাতে, যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়ে ওঠে উন্নয়নের একমাত্র সূচক। ধনী উচ্চবিত্তের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা গণমাধ্যমের কল‍্যাণে এমন ভাবে প্রচারিত হতে থাকে যেন তা সকলের অভীষ্ট। মনন তথা জীবনদর্শনের এই অবনমন বাঞ্ছনীয় মানুষোচিত গুণাবলীর কোনও সর্বজনগ্ৰাহ‍্য সুসংহত প্রতিরূপ গড়তে বাধা দেয়। ফলে, জিডিপি'র জনপ্রিয়তা বাড়তেই থাকে আর স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা থেকে আন্তর্জাতিক মিডিয়া সকলের কাছেই উন্নয়নের একরৈখিক ভোগবাদী ধারণাটিই গ্ৰহণযোগ‍্য হয়ে ওঠে। প্রত‍্যাশিত ভাবেই এই সরলরৈখিক ধারণায় বহুত্ববাদের কোনও ঠাঁই নেই। সেখানে আছে শুধু জিডিপি নামক সীলমোহরকে হাতিয়ার করে উন্নয়নের ঢক্কানিনাদে প্রযুক্তিলব্ধ জ্ঞানকে পণ‍্যায়িত করার মুনাফাকামী অপপ্রয়াস। তাই সাজপোশাক, খাদ‍্যাভ‍্যাস, ক্রীড়াবিনোদন, জীবনযাপনের নিত‍্যপ্রয়োজনীয় যে কোনও কিছুতে কৃত্রিম চাহিদা এমনভাবে তৈরি হচ্ছে যাতে ভারতবর্ষের ঐতিহ‍্যগত সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ বিনষ্টির পথে গিয়ে পশ্চিমি ভোগবাদী আধুনিকতার অন্ধ অনুকরণের পথ সুগম হয়। অন‍্যদিকে দেশজ লোকাচার বা লোকধর্মকে যেহেতু কেবলমাত্র প্রান্তিক মানুষেরাই তাঁদের যাপনে বহন করে চলেন সেহেতু তা আজ পুঁজির আগ্ৰাসনে ভোগবাদী প‍্যাঁচপয়জারে বিলুপ্ত হ‌ওয়ার পথে চলেছে। এ বড় কঠিন সময়। জয়ন্তবাবুর মতে এর মোকাবিলায় 'dynamism in small scale' বজায় রাখতে হবে। আর এই ব‍্যাপারটা সম্ভবপর হবে তখনই যখন 'লোক' অনুষঙ্গে যে কোনও কিছুকে আমরা পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকব। অর্থাৎ, এখানে জয়ন্তবাবু macrocosmic capitalist-consumerist (যেমন MNC, বিগ মিডিয়া) আগ্ৰাসনের বিরুদ্ধে microcosmic level'এ লোকবিচারে প্রতিরোধ গড়ার কথা বলেছেন। এই প্রসঙ্গে জনৈক শ্রোতার প্রশ্নের উত্তরে জয়ন্তবাবু বলেন লোকাচার লোকধর্ম বা লোকশিল্পের সাথে বিশ্ববাজারের সমানুপাতি সম্পর্ক একেবারেই যে অসম্ভব তা নয়, তবে সে ক্ষেত্রে সম্পর্কের ভিত্তি হবে অসম সমন্বয়। যেমন ঘর সাজানোর শৌখিন জিনিস তৈরিতে একজন ডোকরা শিল্পী বা মধুবনি চিত্রকর হয়তো প্লাস্টিক বা রাবারে তৈরি চীনা আমদানির বা মূলধারার চিত্রশিল্পীদের সাথে পেরে উঠবেন না, কিন্তু টিঁকে থাকার জন‍্য বিপণনের কৌশল করায়ত্ত করতে তিনি অনলাইন সংস্থার সাহায‍্য নিতেই পারেন।
'একক মাত্রা'র মে সংখ্যার প্রকাশ (প্রচ্ছদ বিষয়ঃ লোকাচার লোকধর্ম)
বাঁদিক থেকেঃ অরুণাভ বিশ্বাস, অনিন্দ্য ভট্টাচার্য, অচিন চক্রবর্তী, সেখ আসাদ আলি,
কল্যাণ কুমার সরকার ও জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়

বিশ্ববাজারের সাথে লোকাচার লোকধর্মের মতো বহুত্ববাদী উপকরণের সম্পর্কের স্বরূপটি উন্মোচনের পাশাপাশি জয়ন্তবাবু সাবধান করে দেন 'লোক' অনুষঙ্গে আচার ধর্ম শিল্প সাহিত‍্য গান নাচ ইত‍্যাদির চর্চা জনপ্রিয় হলেও আসন্ন বিপদগুলি সম্পর্কে আমরা অবহিত ন‌ই। বহুত্ববাদবিনাশী পশ্চিমি সাংস্কৃতিক আগ্ৰাসন ছাড়াও অন্যান্য বিপদ বলতে তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং উন্নত জৈবপ্রযুক্তির চর্চাকে বুঝিয়েছেন। এর সাথে রয়েছে বিজ্ঞানের রাজনীতি ও কুক্ষিগত বিদ‍্যার অধিকার। শহরের রোয়াক বা গ্ৰামের চন্ডীমণ্ডপে বসে গল্পগুজব করার দিন শেষ। এখন সোশাল মিডিয়ার যুগ। লোকের হাতে হাতে স্মার্টফোন, তাতে যে computational skill ভরা আছে তা আমেরিকার নাসার প্রথম অ্যাপোলো অভিযান সমাধা করতে যতটুকু লেগেছিল তার প্রায় দ্বিগুণ। এর উপর আগামীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ আসন্নপ্রায়। তখন মানুষের প্রয়োজনে মানুষকে যাতে দরকার না হয় তার জন্য চেষ্টা চলছে human brain-computer link up গঠনে। পৃথিবীর উপর নির্ভরশীলতা কমাতে global space civilization স্থাপনের চেষ্টা চলছে। আর তার জন‍্য প্রয়োজন যে inter-planetary transport system সেটা গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। এইভাবে মানবপ্রজাতির মনন ও চর্যা, কর্ম ও যাপনে যে সামূহিক পরিবর্তন আসতে চলেছে তাতে বহুত্ববাদ আদৌ টিঁকে থাকবে কিনা তা ভবিষ‍্যত‌ই বলবে। অন‍্যদিকে বহুত্ববাদের সাপেক্ষে জৈবপ্রযুক্তি বা কৃষিপ্রযুক্তি আশীর্বাদ না অভিশাপ তা নিয়েও দ্বিধায় রয়েছেন জয়ন্তবাবু। বিস্তারিত না বোঝালেও ব্লগের পাঠকদের জন‍্য বলা যায় যে এককালে মায়ান-আজটেক-ইনকা সভ‍্যতায় জৈবপ্রযুক্তির প্রয়োগে ভুট্টা চাষে অভাবনীয় বৈচিত্র্য আনা হয়েছিল, ইউরোপ ও পার্শ্ববর্তী এশিয়ায় নানান গোলাপচারার পরিচর্যা হতো বা বাংলা-বিহার-ঢাকায় নবাবী আমলে আমের নানা প্রজাতির চাষ হত। কিন্তু বর্তমানে কৃষিপ্রযুক্তিকে শুধুই উচ্চফলনশীলতার কাজে ও সময়-শ্রম কমানোর কাজে ব‍্যবহার করায় বহুরকম ধানের প্রজাতি, আমগাছ, ফুলগাছ বিরল অথবা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বহুত্ববাদের এও এক বিপদ বৈকি।

সবশেষে জয়ন্তবাবুর প্রশ্ন, এরকমটা হতে চলেছে কেন। তাঁর মতে, বিজ্ঞানের রাজনীতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা বা উদাসীনতা এর জন‍্য দায়ী। ছাত্রছাত্রীদের পাঠক্রমে যেভাবে নিউটনের গতিসূত্র ইত‍্যাদি পড়ানো হয় তাতে বিজ্ঞান পড়াটাই শুধু হয়, পড়াটাকে সমাজের কাজে লাগানো যায় না। বিজ্ঞানের রাজনীতির প্রাথমিক পাঠে আমাদের বুঝে নিতে হবে, এই যে বলা হয় "Knowledge is power" সেটা আসলে আপেক্ষিক সত‍্য। বাস্তবিক সত‍্য হল "Knowledge is power when knowledge is western"। সেই কারণে Tibetan medicine গুরুত্ব পায় না। আবার নলেজকে শুধু ওয়েস্টার্ন হলেই চলবে তাকে প্রয়োজনমতো কুক্ষিগত করে রাখতে হবে। যেমন ১৯৬৩ সালে আবিষ্কার হ‌ওয়া ইন্টারনেটকে মার্কিন সামরিক বিভাগ ঠান্ডা লড়াইয়ের কারণে গোপন রেখেছিল নয়ের দশক পর্যন্ত এবং সোভিয়েত অবসানে তা খোলা বাজারে ছেড়ে বিশ্বায়নের সময়ে বিপুল আর্থসামাজিক বা রাজনৈতিক ফায়দা লোটা হয়। বহুত্ববাদকে বাঁচাতে বিজ্ঞানের রাজনীতির এই মুখোশ উন্মোচন প্রয়োজন। তার জন‍্য চাই বহুত্ববাদকে মাথায় রেখে বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের মেলবন্ধন।

Tuesday, 12 June 2018

কলিম খান (২ জানুয়ারি ১৯৫০ - ১১ জুন ২০১৮)

এক অনন্য তপস্বী
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য



২০০২ সালে ঢাকায় ‘একুশে’ গ্রন্থ বিপণিতে একজন হাতের সামনে একটি বই এগিয়ে দিলেনঃ পরমাভাষার বোধন উদবোধন। লেখক কলিম খান। বইটি নিয়ে খানিক নাড়াচাড়া করার পর মুদ্রাদোষেই জিগেস করি, লেখক কি ঢাকার?

সে বইটির ভূমিকা দোকানে দাঁড়িয়েই পড়ে ফেললাম। তারপর আর কালক্ষেপ নয়, কলকাতায়  ফিরেই ‘একুশে’ থেকে সংগ্রহ করে আনা দূরভাষের নং’এ তাঁর সঙ্গে আলাপ ও তাঁর বাসায় গমন। বইটি পড়ে যতটা না বুঝেছি, আলাপে আরও সাবলীল হল তাঁর ভাবনা। আরও দু-তিনটি বই তাঁর থেকেই সংগ্রহ করলাম। প্রথম যা আমাকে আকর্ষণ করল তা ভাষা। এত সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ বাংলায় তিনি এমন এক গভীর বিষয় নিয়ে লিখছেন, আমাকে মোহিত করল। ‘একক মাত্রা’র জন্য লেখা তো চাইলামই, আর ওঁর বইগুলোও বোঝার চেষ্টা করলাম প্রাণপণ। তিনি তখন গভীর অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করছেন। কিছুদিন অর্থের বিনিময়ে ‘একক মাত্রা’র কম্পোজিং’এরও কাজ করলেন নির্দ্বিধায়। বাড়িতে কম্পিউটার বসিয়ে তিনি তখন ডিটিপি’রও কাজ করেন। বাড়িতে স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে। সন্তানেরা সকলেই নাবালক। থাকেন এক পুরনোকালের ভাড়া বাড়িতে।

তিনি হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরাধিকার। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’এ হরিচরণ যেখানে শেষ করেছেন বর্ণের অর্থ ও একই শব্দের বিবিধ অর্থ উদ্ধারে, কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর যাত্রা শুরু সেইসব শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ নিষ্কাশনে। হরিচরণের রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, কলিম খানের কিছু চাকরিজীবী অনুরাগী। তীব্র দারিদ্র্যের মধ্যেও তিনি সে কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ইতিমধ্যে আরও অধোগামী, কলিম খানের ভাষায় ১৯৪৭’এর পর শারীরিক ভাবে স্বাধীন কিন্তু মানসিক ভাবে পরাধীন বাঙালি, তাঁর এই কাজকে বোঝার অবস্থাতেই আর রইল না। তবুও লালনের যেমন কাঙাল হরিনাথ ছিলেন, কলিমের ছিল কিছু লিটল ম্যাগাজিন আর পড়ুয়া বাঙালির একটি ছোট অংশ যারা তাঁকে প্রশ্রয় দিয়েছেন, তাঁর সংসারের অর্থকষ্টকে লাঘব করার চেষ্টা করেছেন সর্বতোভাবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত, যে কারণে তিনি এই দু’ মাস আগেও আস্থার সঙ্গে বলতে পেরেছেন তাঁর কাজ শেষ।


কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার পুরোধা রজার পেনরোজ তাঁর ‘দ্য এম্পেরার্স নিউ মাইন্ড’ গ্রন্থে বলেন, এ বিশ্বের সমস্ত প্রজাতিরই চৈতন্য আছে, মানুষের সঙ্গে তাদের ফারাক হল ভাষায়। অর্থাৎ, মানুষের ভাষা আছে যা অন্যদের নেই। কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী তাঁদের সমস্ত কাজের সার সংকলন করে তাঁদের শেষ বইটির নাম দিয়েছেন ‘ভাষাই পরম আলো’। পেনরোজের সঙ্গে যেন ভাবনাগুলি কোনও মৌলিক জায়গায় জুড়ে গেল। লোকে বলে, Great Men Think Alike

আদিম মানুষের যখন কোনও ভাষা ছিল না, তারা দৃশ্য জগতের বাইরে কিছু ভাবতেও পারত না। খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য তাদের লড়াই ছিল আর অন্য সব প্রজাতির মতোই। সেই লড়াইয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গকে কলিম খান বলছেন, ঝাঁক ম্যানেজমেন্ট। সমুদ্রের তলদেশে থাকা মাছেরা যেমন তাদের নির্দিষ্ট বাসস্থানের পরিধিতে থাকা খাদ্যসামগ্রী ফুরিয়ে এলে অন্যত্র নতুন বাসস্থান খোঁজে, যে জন্য ছোট দল করে এক ঝাঁক মাছ খুঁজতে যায় নতুন বাসস্থান ও ফিরে এসে খবর দেয় অন্যান্য মাছেদের, ঠিক সেভাবে মানুষও তাদের প্রয়োজনে একইভাবে একদল মানুষকে পাঠিয়ে দিত তাদের নতুন বাসস্থানের খোঁজে যারা ফিরে এসে খবর দিলে মানুষের গোটা ঝাঁকটাই চলে যেত সেখানে। এরজন্য ভাষার কোনও দরকার ছিল না। আকার ইঙ্গিত ও কিছু ধ্বনিই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মানুষ যখন অদৃশ্য জগতের কিছু কথাও বলতে চাইল, যেমন, যে নতুন বাসস্থানের হদিশ পাওয়া গেছে সেখানকার চিত্র বাকীদের যদি বুঝিয়ে বলতে হয় বা কারও আগের দিনের কোনও উল্লেখযোগ্য ঘটনা যা সে অন্যদের বলতে চাইছে, দরকার পড়ল ভাষার। সেই আদিপর্বে ভাষার উদ্ভব ঘটল ক্রিয়ার হাত ধরে। সে শুধু ঘটমানতাকেই  বলতে পারে। ধ্বনি, বর্ণ ও শব্দের উদ্ভব ঘটল এইভাবেই। তাই কলিম খানের মতে, সমস্ত ভাষার শিকড় একই। ইতিহাস সেই ক্রিয়াভিত্তিক ভাষার মধ্যেই বিধৃত হয়ে আছে।

ধীরে ধীরে সভ্যতার বিকাশে, শ্রেণি বিভাজনে, ক্ষমতার নানান আকারপ্রকারের উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে ভাষাকেও ক্ষমতাশালীরা কব্জা করে নিল। তারা ভাষাকে শিকড়চ্যুত করে তাকে প্রতীকী অবয়ব দেবার প্রচেষ্টায় মত্ত হয়ে উঠল। কারণ, শব্দকে প্রতীকী করে ফেললেই তার অর্থ সীমায়িত হয়ে আসে, সে ক্ষমতার ভাষা হয়ে ওঠে, তার অর্থ দাঁড়ায় একটি বা দুটি তাৎপর্যে। তাই ভাষা আজ বিপন্ন। অন্যদিকে যারা শ্রমজীবী গাঁয়ের মানুষ, সামাজিক পরম্পরায় দীর্ঘদিন বেঁচে আছেন, সেখানে ক্ষীণ হলেও ভাষার বৈচিত্র্য ও ব্যাপ্তি এখনও বহমান। সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটল, যে ভাষা আজ বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেই ইংরেজি, কঠিন, কঠোর কর্পোরেট শাসকের  হাতে পড়ে একেবারেই শিকড়চ্যুত হয়ে প্রতীকী ভাষায় অধঃপতিত হল। তাই কলিম খান বলেন, বাংলা ভাষাই সভ্যতাকে বাঁচাবে। তা কেন তা তিনি বিস্তারিত বলেছেন গত ৩ মার্চ ‘একক মাত্রা’র অনুষ্ঠানে ‘বাংলা ভাষার সম্পদ কোথায়’ শীর্ষক আলোচনায়।

তিনি যখন বলেন শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শোনেন। ৭০ দশকে কলেজের পড়াশোনা ছেড়ে মুক্তির দশক গড়ার স্বপ্নযুদ্ধে সামিল হয়েছিলেন। যখন আন্দোলন ছত্রভঙ্গ, পুলিশের দৃষ্টি এড়াতে হকারি করে বেড়িয়েছেন। কিন্তু জিজ্ঞাসু মনের অতন্দ্র তৃষ্ণাকে নিভতে দেননি। হকারদের বিচিত্র শব্দভাণ্ডার ও নিত্যনতুন শব্দের নির্মাণ তাঁকে মোহিত করেছিল। অনুসন্ধিৎসু ছাত্র হিসেবে তিনি শুরু করলেন ভারতীয় ইতিহাসের স্বপাঠ। তাঁর কাছে কৃত্তিবাসী রামায়ণ এক নতুন অর্থে ধরা দিল। তিনি হন্যে হয়ে খুঁজছেন সে মহাকাব্যের প্রতিটি শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থ। এদিক সেদিক পণ্ডিতদের কাছেও দৌড়চ্ছেন। উত্তর মিলছে না। একদিন পাগলের মতো চলে গেলেন এশিয়াটিক সোসাইটির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদকের কাছে। গেলেন অম্লান দত্তের কাছেও। এই দুজন মানুষই তাঁর কথা মন দিয়ে শুনলেন। দুজনেই প্রায় একই কথা বললেন যে আপনি নেমেছেন এক গভীর সমুদ্রের তলদেশে রত্নভাণ্ডারের খোঁজে , সে সন্ধান আমাদের কাছে নেই, আপনিই পারেন সে সব উদ্ধার করতে।

আদ্যন্ত এই সাবেকি মানুষটি, প্রত্যন্ত গ্রামবাংলার জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা, যিনি আধুনিক ভাষাচর্চার সমস্ত প্রয়াসকে গভীর ভাবে জেনেবুঝে তবেই সেগুলোর সমস্যা কোথায় তা অকপটে বলে তাঁর সাধনমার্গের উপান্তে এসে পৌঁছেছিলেন। তপস্বীরা তাই বেঁচে থাকেন কালকে পরোয়া না করেই। কালাতীত এই সাধককে আমার বিনম্র প্রণাম।

Wednesday, 6 June 2018

চিকিৎসা ও সমাজ

চিকিৎসা চিকিৎসক সমাজ
ডাঃ রেজাউল করিম
(সম্মাননীয় সভাপতি, ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম)

(দুষ্টু)ডাক্তারদের এই জবানবন্দি আজ একটা কাগজে ছাপার কথা ছিল। ওঁরা  ছাপবেন বা ছাপবেন না জানি না কিন্তু মনে হয় সবার জানা দরকার।

 অন্তত স্বাস্থ্যক্ষেত্রে, পশ্চিমবঙ্গ ভারতীয় অঙ্গরাজ্য গুলির মধ্যে এক বিরল উদাহরণ যেখানে রাজ্যের প্রায় প্রতিটি প্রান্তে কোনও না কোনও স্বাস্থ্য পরিকাঠামো আছে। প্রাথমিক (অর্থাৎ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ইত্যাদি), মধ্যমস্তরীয় (অর্থাৎ মহকুমা বা সদর হাসপাতাল ইত্যাদি) এবং উচ্চতর (সরকারি মেডিকেল কলেজ সমূহ) - এই ত্রিস্তরীয়  স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এই রাজ্য, অনন্য না হলেও, একটি উল্লেখযোগ্য ও প্রশংসনীয় নজির।

হ্যাঁ, উল্লেখযোগ্য এ কারণেই, যেহেতু, উত্তর ও পূর্ব ভারতীয় অন্য অঙ্গরাজ্য গুলি এ বিষয়ে অনেকখানি পিছিয়ে আছে। এমনকি পশ্চিম উপকূলের অনেক তুলনামূলক ভাবে সচ্ছল রাজ্যগুলির তুলনায়ও পশ্চিমবঙ্গ কৃতিত্ব দাবি করতে পারে। প্রসঙ্গত, উল্লেখ করা যেতে পারে, ইদানীং যে রাজ্য প্রায় সমগ্র জাতির কাছে আদর্শ হয়ে উঠেছে, সেইখানেও ত্রিস্তরীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা এতো সংগঠিত নয়। এর সাথে যদি এই কথাটি মাথায় রাখা যায়, যে, এই তিনটি স্তরেই চিকিৎসা হয় প্রায় বিনেপয়সায়, তাহলে উদ্যোগ প্রশংসনীয় তো বটেই।

সম্প্রতি বেশ কয়েকটা ক্ষেত্রে, এই রাজ্য, প্রতিবেশী রাজ্যগুলির তুলনায় অনেকটা এগিয়ে গেছে - যেমন, শিশু মৃত্যু (২৫/১০০০) ও প্রসবকালীন মৃত্যুহারের (১১৭/১০০০০০) নিরিখে এই রাজ্য যথেষ্ট অগ্রসর। প্রসঙ্গত, বলে রাখি, একটি সমাজের সার্বিক স্বাস্থ্যের কী হাল, তা বোঝার জন্যে, এই সূচক দুটি বিশেষ কার্যকরী। কাজেই, সাধারণ স্বাস্থ্যসূচকে, আমরা অন্যান্য রাজ্যের থেকে খুব একটা পিছিয়ে তো নেই-ই, বরং বেশ কিছুটা এগিয়ে। নারী শিক্ষার হার ও গ্রামীণ সড়কের সংস্কার ও নির্মান স্বাস্থ্য-সূচকের এই উন্নতিতে সাহায্য করেছে।

বর্তমান বছরে, এই রাজ্যে,বাজেটে, স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ, উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি, পূর্বতন সরকারের তুলনায় রোগী শয্যার অনুপাতও অনেকখানি বেড়েছে। আগে এই অনুপাত ছিল খুব কম (১.০৪:১০০০), যা বর্তমানে বেড়ে দাঁডিয়েছে ১.৪২/১০০০।

কিন্তু, সামগ্রিক ভাবে স্বাস্থ্য-বিনিয়োগ ও পরিকাঠামো উন্নতির সাথে মানুষের চাহিদা ও প্রত্যাশার বেশ খানিকটা ফারাক রয়েই যাচ্ছে। তাই, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, প্রাত্যহিক প্রচারমাধ্যমে, স্বাস্থ্য, সর্বদাই, ভ্রান্ত পরিপ্রেক্ষিতে শিরোনামে আসছে।

সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থা - আকাশচুম্বী প্রত্যাশা

যেমন বলেছি, আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনুন্নত রাজ্যসমূহ ও প্রতিবেশী অনুন্নত দেশের তুলনায় প্রাগ্রসর। তদসত্ত্বেও, এই অগ্রগতি জনগনের আকাশচুম্বী প্রত্যাশার নিরিখে অপ্রতুল।

প্রথমেই বলি, আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘাটতি আছে যা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুসারে, সঙ্কটের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ২০১৭-১৮ সালে টীকাকরনের যে হিসাব আমরা দেখতে পাচ্ছি সেখানে পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেক তথ্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জমা পড়ে নি। অতএব, বলা দুষ্কর যে, যেসব জীবানুবাহিত রোগ নতুন করে ফিরে আসছে তা প্রতিরোধে আমরা কতটা সক্ষম।  পশ্চিমবঙ্গে গত  বছরে প্রায় ৪২০০০ নতুন যক্ষ্মা রোগী পাওয়া গেছে। এই রোগীদের প্রায় শতকরা ৪০ ভাগই থুতুর সাথে যক্ষ্মার জীবানু নিষ্ক্রমন করেন। তাই, যক্ষ্মার প্রতিরোধে সামান্যতম অবহেলা মারাত্মক অবস্থা তৈরী করতে পারে। যক্ষ্মার সাম্প্রতিক প্রাদুর্ভাবের আরেকটি আশঙ্কা জনক দিক হল যে ৮৭০০০ রোগী এই বছর চিকিৎসা গ্রহন করছেন তাদের শতকরা প্রায় ১৫ ভাগই পুনরাক্রমনের শিকার। রাজ্য সরকারের সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টে মেনে নেওয়া হয়েছে, যে, এই রাজ্যে শিশুদের অপুষ্টির হার প্রায় ৩০শতাংশ। যক্ষ্মা ও অপুষ্টি পরস্পরের সহায়ক। তাই,প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় বিশেষ যত্নবান হওয়ার পাশাপাশি, অপুষ্টির দিকটাতেও তো নজর দিতে হবে। টীকাকরনের হার এ রাজ্যে বিগত পাঁচ বছরে উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে, সরকারী তরফে দাবী করা হয়েছে; অথচ, কেন্দ্রীয় রিপোর্টে প্রকাশ, গুরুত্বপূর্ণ পেন্টাভালেন্ট ভ্যাকসিন, যক্ষ্মা প্রতিরোধক ও হেপাটাইটিস টীকা সংক্রান্ত কোন তথ্য রাজ্য সরকার পাঠান নি। আরেকদিকে, গত বছর প্রায় ৫৫০০ পরিকল্পিত টীকাকরন কর্মসূচী বাতিল হয়েছে, যা কিনা টীকাকরণে যথেষ্ট গুরুত্বের সপক্ষে বার্তা দেয় না।

সরকারী ক্ষেত্রে, হাসপাতালে গড়ে পায় ১১কোটি রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা পান, তাদের প্রায় শতকরা ৫ভাগ রোগীকে ভর্তি করে নেওয়া হয়, প্রায় ৩লক্ষ৫০হাজার বড় অপারেশন ও ৯ লক্ষ প্রসব হয়। হাসপাতাল গুলির পরিচ্ছন্নতা বেড়েছে। প্রতিটি শয্যায় পরিষ্কার বেডশীট সরবরাহও বেড়েছে। অনেক ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়, বেশির ভাগ পরিষেবাই, বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে রোগীরা পেয়ে থাকেন।

এসবের পরেও, পরিকাঠামোগত বেশ কিছু অসুবিধা থেকেই যাচ্ছে, যার ফলে  চিকিৎসাব্যবস্থার গ্রাহক যথেষ্ট সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। আর এই অসন্তুষ্টিই, সমগ্র স্বাস্থ্যব্যবস্থার বদনামে ইন্ধন যোগাচ্ছে।

আগেই বলা হয়েছে, বিগত কয়েক বছরে, রোগীপিছু শয্যার সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু, তারপরেও, আমাদের শয্যাসংখ্যা (১.৪২/১০০০) ন্যূনতম লক্ষ্যমাত্রা বা চাহিদার (২.৫/১০০০) তুলনায় অপ্রতুল। ফলে হাসপাতালগুলিতে রোগীদের দীর্ঘ অপেক্ষা একরকম স্বত:সিদ্ধ।

বহির্বিভাগে একজন চিকিৎসককে গড়ে যে পরিমান রোগী দেখতে হয় তা প্রথম বিশ্বে কেউ কল্পনাও করতে পারেন না। খুব সঙ্গত কারনে বহির্বিভাগে রোগী-চিকিৎসক আলোচনার উপযোগী পরিবেশ ও সময়ের একান্ত অভাব। আবার, যে রোগী তাঁর একদিনের কর্মদিবস ব্যয় করে হাসপাতালে এলেন, তিনি তাঁর শারীরিক-মানসিক সমস্যার চিকিৎসককে বলে ভয়-ভীতি-আশঙ্কার উপযুক্ত চিকিৎসা প্রার্থনা করবেন তো বটেই, সাথে তাঁর সঙ্গত প্রত্যাশা, চিকিৎসক ওষুধ লেখার পাশাপাশি কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে তাঁর দুশ্চিন্তার নিরসন করবেন। শত শত রুগীর চাপে পিষ্ট চিকিৎসকের সেই অবকাশ নেই, তাই রোগীকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব হয় না। আর, কে-ই বা না জানে, যে, অসন্তুষ্ট উপভোক্তা যেকোনো প্রতিষ্ঠানের সুনামের কতটা পরিপন্থী!!!

হাসপাতালেকে বৃহৎ যৌথ পরিবার ভাবলে, পরিবারের কর্তা হয়তো চিকিৎসক। কিন্তু, যেকোনো যৌথ পরিবারের মতোই, কর্তার কার্যকরিতা পরিবারের বাকি সদস্যদের উপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে, তাঁর সবচেয়ে শক্তিশালী বাহু, সেবিকাদের (নার্স) অপ্রতুলতা হাসপাতালে সন্তোষজনক পরিষেবার পরিপন্থী। টেকনিশিয়ান ও ল্যাবরেটরি পরীক্ষার সাথে জড়িত আনুষঙ্গিক কর্মচারীর অভাবও চিকিৎসকদের যথেষ্ট বিড়ম্বনার কারন। আর, প্রয়োজনের তুলনায় কম সংখ্যার চিকিৎসকের বিষয়টি তো আছেই।

অনেক অপ্রতুলতার মধ্যেই, কর্তা পরিবারটিকে নিয়ে তরী পার করছিলেন অনেকবছর ধরে, কিন্তু, ইদানিং, রোগী-চিকিৎসক বা রোগী-স্বাস্থ্যকর্মীর পারস্পরিক সম্পর্কের ক্রমাবনমন যেভাবে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দিয়েছে, তাইতে, এবার, তরী না ডোবা-ই আশ্চর্যের। সম্পর্কের অবনতির কারণ বহুবিধ। প্রায়শই, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের একাংশ যথেষ্ট সংযম ও উপযুক্ত সম্ভ্রমের সাথে রোগীদের সাথে কথাবার্তা বলেন না। অনেক সময় চিকিৎসক রোগীকে তাঁর সমস্যা খুলে বলেন না কিম্বা বললেও জটিল পরিভাষা ব্যবহার করেন, যা রোগীর বোধগম্য হয় না। আবার, অনেকসময়, রোগীর প্রাথমিক পছন্দ থাকে বেসরকারী চিকিৎসাক্ষেত্র। নেহাত নাচার হয়েই তাঁর সরকারীক্ষেত্রে পদচারণ। সেক্ষেত্রে, তাঁকে তুষ্ট করা তো অলীক স্বপ্ন। সবমিলিয়ে, একথা স্বীকার করতে বাধা নেই, যে, উপভোক্তার সন্তুষ্টিপ্রদানের ক্ষেত্রে, সরকারী চিকিৎসাক্ষেত্র, কিছুটা পিছিয়ে।

বেসরকারী পরিষেবা – কতোখানি নিয়ন্ত্রণ জরুরী

পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৪৩০০০ বেসরকারী শয্যা আছে। আর পাঁচটা ব্যবসার মত বিনিয়োগকারীর কাছে এই শয্যাগুলি অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার। এই শয্যার বেশির ভাগের মালিক কোন অচিকিৎসক বিনিয়োগকারী। তাছাড়া প্রায় ২০০০এর কাছাকাছি সংখ্যায় ছোট ছোট নার্সিংহোম আছে যেগুলির এক বা একাধিক অংশীদার চিকিৎসক।

বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলিতে দুধরনের খরচ আছে - মূল চিকিৎসা খরচ আর  শয্যা ও আনুষঙ্গিক বিবিধ খরচ।

আনুষঙ্গিক স্বাচ্ছন্দ্যযুক্ত শয্যার ভাড়া অনুসারে, মূল চিকিতসাব্যয় ওঠানামা করার কোন যুক্তি নেই। সরকার নিশ্চয়ই মূল চিকিৎসা খরচ নিয়ন্ত্রন করে সর্বত্র একই দর ধার্য্য করতে পারেন। কিন্তু আনুষঙ্গিক স্বাচ্ছন্দ্যের মূল্যমান কোন হাসপাতাল কীরকম ধার্য্য করবেন, এমনকি শয্যার ভাড়া কতো থাকবে, এইসব নিয়ন্ত্রন করার দায় সরকারের নয়। উদাহারন স্বরূপ বলা যায়, পাইস হোটেলে খাবারের দাম ও পাঁচতারা হোটেলে খাবারের দাম কি সরকার নিয়ন্ত্রন করতে পারেন? করতে হয়তো পারেন, কিন্তু তার যুক্তি কতোটুকু? পুঁজি যেখানেই বিনিয়োগ হোক তা তার আপন ধর্মে কাজ করে যাবে - সেখানে কেবা আপন কে পর, কে ধনী কে নির্ধন, কে মুমূর্ষু কে স্বাস্থ্যবান তা হিসেব করে না – শোষন আর মুনাফা সেখানে মূল মন্ত্র।

আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার খরচের সমানুপাতিক হিসাব করলে দেখা যাবে যে খরচের সিংহভাগ (৬৪%) হল ওষুধ বা আনুষঙ্গিক সাজসরঞ্জামের দাম, যা সরকার ইচ্ছা করলেই নিয়ন্ত্রন করতে পারেন। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, ওষুধ ইত্যাদির দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রায় পুরোটাই কেন্দ্রের সরকারের হাতে, আর স্টেন্ট-প্রস্থেটিক্স ইত্যাদির ক্ষেত্রে আংশিক প্রয়োগের ফলে মানুষ সুফল পাওয়া সত্ত্বেও, এই ক্ষমতার সার্বিক প্রয়োগের উৎসাহ ততোটা দেখা যাচ্ছে না।

প্রতি বছর শতকরা ৭ভাগ রোগী নিজেদের সর্বস্ব বিক্রি করে চিকিৎসা খরচ মেটায়- সে খরচের মাত্র ১০-১৫% খরচ হয় পরিষেবাপ্রদানকারী অর্থাৎ চিকিৎসকের বেতন ও ফি বাবদ।

কিন্তু, একথা মেনে না নিলে ভাবের ঘরে চুরি করা হবে, যে, মূল্য নিয়ন্ত্রনে চিকিৎসকদের হাত না থাকলেও, সরকারী ও বেসরকারী পরিষেবার সাথে জড়িত একশ্রেনীর চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের অন্যায় অসদাচারণ মানুষের ভোগান্তির একটি বড় কারণ। নানারকম আইন থাকা সত্বেও অবাধে অপ্রয়োজনীয় ওষুধপ্রয়োগ ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করানো, সাথে ফি-স্প্লিটিং-কমিশন একাধারে রোগীর ভোগান্তি আর সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যয় দুইই বাড়ায়।  রোগী-চিকিৎসক পারস্পরিক অবিশ্বাস-বিদ্বেষ আরো বেড়ে ওঠার এও এক বড়ো কারণ।

আরেকদিকে, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের মূলস্তম্ভ, এভিডেন্স-বেসড মেডিসিন বা প্রমান-সাপেক্ষ চিকিৎসা পদ্ধতি যে সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যয়ের উর্ধগতির অন্যতম কারণ, তাই নিয়ে আজ আর বিশেষ দ্বিমত নেই। নিত্যনতুন ব্যয়বহুল, এমনকি ব্যয়সর্বস্ব, চিকিতসাপদ্ধতির সমর্থনে হাজির হওয়া চটজলদি (অনেকক্ষেত্রে ওষুধনির্মাতাদের দ্বারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রস্তুত) সেই প্রমাণ, কী অনিবার্যভাবে চিকিৎসার খরচ করে তুলছে লাগামছাড়া, বিশ্বের সর্বমান্য চিকিতসাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে, একথা আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁডিয়েছে।

স্বাস্থ্য রাজনীতি

আমাদের কথা, দাবীও বটে, স্বাস্থ্যের মূল চাবিকাঠি সরকারের হাতে থাকা উচিত। দেশের সরকার ডা: শ্রীনাথ রেড্ডীর নেতৃত্বে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটির সুপারিশ হল: স্বাস্থ্য বাজেট যদি জিডিপির ২.৫% হয় তাহলে সারা দেশের সমস্ত মানুষের  জন্য বিনামূল্যে সমমানের আধুনিক পরিষেবা দেওয়া সম্ভব। বর্তমানে চিকিৎসা ব্যয়ের শতকরা প্রায় ৭০শতাংশ রোগীকে খরচ করতে হয়, যদি সরকার স্বাস্থ্য বাজেট বৃদ্ধি করেন তাহলে সেই ব্যয় হবে শতকরা ৩৫ ভাগ।দেশের মানুষ স্বাস্থ্যবান হলে একদিকে যেমন অপ্রয়োজনীয় খরচ কমবে তেমনি দেশের গড় উৎপাদনশীলতার হারেও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হবে। এই ব্যবস্থায় বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলিও লাভবান হবে, কারণ তাদের অব্যবহৃত শয্যার সংখ্যা কমবে। সরকার এই শয্যার একটি বড় অংশ রোগীদের জন্য ভাড়া নেবেন। সরকারী হাসপাতালে যথেষ্ট পরিমান পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারলে তার পরিকাঠামোর মান বৃদ্ধি হবে ও সমমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।

উন্নত দেশগুলিতে, সরকারী আধিকারিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যারা দেশের মুখ্য নিয়ামক, তাঁরা নিজেদের অসুখবিসুখ হলে, তাঁর চিকিৎসা সরকারী প্রতিষ্ঠানে করান। ফলে একদিকে যেমন পরিকাঠামোর মান নিয়ে তাঁরা অবহিত থাকেন তেমনি তার আভ্যন্তরীন শক্তি ও ত্রুটি-দুর্বলতা নিয়েও তাঁরা সম্যক ওয়াকিবহাল থাকেন। এতে সরকারী ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা জন্মায়। সমাজ বিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদরাও সরকারী হাসপাতালে ক্ষমতাধর মানুষের চিকিৎসা করার পক্ষে জোরদার সওয়াল করেছেন।

আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ যেহেতু অর্থনৈতিক ভাবে নিষ্পেষিত, তাঁরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও নিজেদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করতে পারেন না, তাঁদের ক্ষোভের কেন্দ্র বিন্দু হল ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা। অন্তত সাধারণ মানুষের চোখে, চিকিৎসকেরা ক্ষমতাধর শ্রেণিরই অঙ্গ। আর পাঁচটা ক্ষমতার কেন্দ্রের তুলনায় হাসপাতালের নিরাপত্তাব্যবস্থা অনেক কম আটোসাটো। তাই, সেই অনাস্থা প্রায়শই হাসপাতালের উপর আছড়ে পড়ে। তারপর চলে ভাঙচুর, মারধোর। লাগামছাড়া স্বাস্থ্যবিজ্ঞাপন মানুষের মনে এই প্রত্যাশাও তৈরি করে দিচ্ছে, যে, অসুখমাত্রেই নিরাময়যোগ্য। যেকোনো মৃত্যুর পরেই পরিজনের শোক যে আছড়ে পড়ছে ক্ষোভ হয়ে, তার পেছনে এই অহেতুক ফাঁপানো প্রত্যাশা একটা বড়ো কারণ।

প্রথমেই প্রয়োজন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফেরানো। চিকিৎসক বিষয়ে সামাজিক মূল্যায়নের রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়। কিন্তু , প্রচেষ্টা শুরু করা আশু প্রয়োজন আর এই পরিবর্তনে রাজনৈতিক দল ও সমাজের মতামত সৃষ্টিকারী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংবাদপত্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

সাম্প্রতিক চিকিৎসক আন্দোলন ও আনুষঙ্গিক বিষয়

গত বছরে এই রাজ্যে একশো জনের বেশি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মী নিগ্রহ ও এমনকি গনধোলাইয়ের শিকার হয়েছেন। মহিলা চিকিৎসকরাও নির্যাতিত হয়েছেন।

বেশিরভাগ ঘটনার কোন বিচার হয় নি। অনেক ক্ষেত্রে নিগ্রহকারী রাজনৈতিক মদত ও আশ্রয় পেয়েছেন। পুলিশ এফআইআর গ্রহন করেন নি, এমনকি স্বত:প্রণোদিত হয়ে নিগৃহীতকে মিটমাট করে নেওয়ার চাপ দেওয়া হয়েছে। সরকারী কর্তাব্যক্তিরাও আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানো দূর অস্ত, তাদেরকে প্রকাশ্যে অপমান করেছেন, কোনরকম সহায়তা দেননি, শুধু তা-ই নয়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহন করেছেন।

এই অবস্থায় চিকিৎসকরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। সব চিকিৎসকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু মানুষের আস্থা আছে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি, তিনি জননেত্রী, রাজ্যের অভিভাবক। তিনি যদি চিকিৎসকদের অবাধে ও নির্ভয়ে কাজ করতে দেবার আবেদন করেন তাহলে চিকিৎসকদের মনোবল বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে ও নতুন উৎসাহ ও উদ্যম নিয়ে তাঁরা নিজের কাজ আরো ভালোভাবে করতে পারবেন ।

চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে হামলায় যে সংঘবদ্ধ হিংস্রতা দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেখানে রোগীর পরিবার পরিজন জড়িত থাকেন না। শোক থেকে, পরিজনকে বাঁচাতে না পারার হতাশা থেকে আছড়ে পড়া ক্ষোভ নয়, হিংস্রতা-ভাঙচুরের মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সামাজিক সুস্থিতি নষ্ট করাই সেখানে মূল উদ্দেশ্য।

এই হামলা ও প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার  বিরুদ্ধে চিকিৎসকেরা আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। এই আন্দোলনের কোন অর্থনৈতিক লক্ষ্য নেই। নেই কোনও দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য। নিজেদের মর্যাদা পুনরুদ্ধার, নিরাপদ পরিবেশে নিজের পেশার প্রতি দায়বদ্ধ থাকার সুযোগ ও সম্মানের সাথে কাজের দাবিতে চিকিৎসকরা সংগঠিত প্রতিবাদ আন্দোলনে সামিল হয়েছেন।

সাম্প্রতিক চিকিৎসা আন্দোলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবী হল- স্বাস্থ্যের অধিকার। চিকিৎসকরা মনে করেন, মানুষের ক্ষোভের ন্যায়সঙ্গত কারণ নিহিত আছে দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য বরাদ্দের অপ্রতুলতা ও কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার অভাবের মধ্যেই। তাই তুলনামূলক ভাবে পশ্চিমবঙ্গে বরাদ্দ বৃদ্ধি হলেও সামগ্রিক চিত্রের খুব বেশি পরিবর্তন হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় বরাদ্দ বাডিয়ে জিডিপির ২.৫ শতাংশ করার পাশাপাশি, সরকারী-বেসরকারী চিকিতসাব্যবস্থাকে পারস্পরিক সহযোগীর ভূমিকা পালন করতে হবে। এ দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিকাঠামো প্রতিবেশী অনেক অনুন্নত দেশের তুলনায় খারাপ। শয্যা ও চিকিৎসকের সংখ্যার নিরিখে আমরা শ্রীলঙ্কার চেয়েও পিছিয়ে আছি।

এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসকরা যে জনগনের স্বাস্থ্যের অধিকারের দাবীতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছেন, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইল ফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।ইতিপূর্বে ৮০ র দশকে আমরা এই আন্দোলন দেখেছি। কিন্তু, শুধুমাত্র গুটিকয়েক চিকিৎসক এই দাবী তুললে হবে না, সমাজের যারা বৃহত্তর নিয়ামক, দেশের মানুষের আবেগ ও চিন্তা চেতনা যাদের কথায় আন্দোলিত হয়, সেই তাঁরাই এই লড়াইয়ে সত্যিকারের অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারেন ।

জনসাধারণের রাজনৈতিক দাবী হিসেবে "স্বাস্থ্যের অধিকার" তার উপযুক্ত স্থান না পেলে তা স্বল্প সংখ্যক বুদ্ধিজীবির টকশো হিসেবেই সীমাবদ্ধ থাকবে আর সেই লক্ষ্য কখনো পূর্ণতা পেতে পারে না। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে কোনও রাজনৈতিক ইস্তাহারেই এই গুরুত্বপূর্ণ দাবী যথাযথ গুরুত্বের সাথে উচ্চারিত হয় নি।

সবার জন্যে স্বাস্থ্যের দাবী নিয়ে চিকিৎসক সংগঠনগুলি নিশ্চয় বিতর্ক উত্থাপন করতে পারেন, কিন্তু সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব জনগনের কাছে গ্রহনযোগ্য হতে হবে, আর সেই নেতৃত্বদানের পরীক্ষিত দক্ষতা আছে একমাত্র রাজনীতিকদেরই। তাই, প্রতিযোগী হিসেবে নয়, সাধারণের স্বাস্থ্যের দাবীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সেই কাজে, স্বাস্থ্যের দাবীকে রাজনৈতিক দাবী হিসেবে মান্যতা দেওয়ার প্রয়াসে, চিকিৎসকরা রাজনীতিকদের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে পারেন।

কিন্তু তারও আগে চাই চিকিৎসকদের সামাজিক সম্মান পুনরুদ্ধার,  চাই সম্মান ও নিরাপত্তার সঙ্গে অবাধে পেশাগত দায়িত্ব পালনের পরিবেশ। এই পরিবেশ ফেরানোর দায় সরকারের। দায়িত্ব সমাজের বাকি সবাইয়েরও।