Wednesday, 18 May 2022

পরিবেশ-প্রভাব মূল্যায়নের রিপোর্ট কই?

দেওচা-পাঁচামির প্রস্তাবিত কয়লাখনি কি আদৌ বাস্তবোচিত 

শশাঙ্ক দেব

 

রাজ্যের অর্থনীতিতে উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানের সম্প্রসারণ হোক, সবাই চায়। দায়িত্বশীল নাগরিক অবশ্যই চায় রাজ্যে নতুন নতুন শিল্প ও প্রকল্প গড়ে উঠুক এবং রাজ্যবাসীর জীবনমানের উন্নতি ঘটুক। আবার একই সঙ্গে আমাদের বোঝা উচিত, যে ধরনের প্রকল্প পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে, সেগুলি সম্পর্কে সতর্ক পদক্ষেপ নেবার দরকার আছে। ক্ষতির সম্ভাবনা মাত্রাধিক হলে, সেই শিল্প না করাই যুক্তিযুক্ত। কারণ, সেই ধরনের প্রকল্পগুলি কিছু মানুষ বা গোষ্ঠীর সুবিধা করে দিলেও অথবা তাৎক্ষণিক কিছু কর্মসংস্থান তৈরি করলেও, শেষ পর্যন্ত তা শুধু পরিবেশের ক্ষতি করে না, সাধারণ মানুষের সার্বিকভাবে আর্থিক ও জীবনমানের ক্ষতি হয়; এবং যার মূল্য নির্ধারণ করা যায় না সেই জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। বর্তমানে যাঁরা ক্ষমতায় রয়েছেন তাঁরাও এক সময়ে বেশ কিছু কর্মসংস্থান হবে জেনেও উপকূল অঞ্চলের জল, জমি এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতির কথা ভেবে নয়াচরে কেমিক্যাল হাব প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন।

বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা জেনেছি, বীরভূমের মহম্মদবাজার ব্লকের দেওচা-পাঁচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙ্গা কয়লা ব্লকে ১৩.৭ বর্গ কিলোমিটার (৩৪০০ একর) অঞ্চল জুড়ে এশিয়ার বৃহত্তম এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা ব্লকে খনি চালু হতে চলেছে। দেশের বিভিন্ন কয়লা খনি কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা কোল ইন্ডিয়ার সরাসরি মালিকানা এবং পরিচালনায় থাকলেও, এই বৃহত্তম কয়লা ব্লকের মালিকানা কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড (CIL) প্রথমে পাঁচটি রাজ্যের জন্য বরাদ্দ করেছিল কিন্তু বাকিদের উৎসাহ না থাকায় সম্পূর্ণ কোল ব্লকটি এখন পশ্চিমবঙ্গের জন্য বরাদ্দ হয়েছে। প্রাসঙ্গিক সমস্ত সংবাদে প্রকাশ যে, ভূতাত্ত্বিক প্রতিবন্ধকতার জন্যই কোল ইন্ডিয়া এবং যাদের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল সেই রাজ্যগুলি, এই খনির ভাগ নিতে রাজী হয়নি। এই অবস্থায় ওয়েস্ট বেঙ্গল পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (WBPDCL) এই কয়লাখনি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। জানা গেছে, এখানে মাটির নীচে রয়েছে প্রায় ২১০ কোটি টন কয়লা আর তার উপরে প্রায় সমান পরিমাণ ব্যাসাল্ট পাথর। এই এলাকায় রয়েছে সরকারি দফতরের জমি, খাস জমি, ব্যক্তিগত মালিকানা ও পাট্টায় দেওয়া জমি এবং বনাঞ্চল। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে যে প্রস্তাবিত খনি অঞ্চলের বেশির ভাগ জমি আদিবাসীদের। ১১,২২২ একর জমির মধ্যে ৯১০০ একর জমি আদিবাসীদের দখলে আছে। সরকারি সমীক্ষা অনুযায়ী, ৩০১০টি পরিবার এই খনি অঞ্চলে বাস করে যার মধ্যে ১০১৩টি আদিবাসী পরিবার। আরও ১০৩৮টি পরিবারের জমি এই খনি অঞ্চলের মধ্যে আছে। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা অনেক বেশি।

এরকম কিছু কিছু তথ্য বিভিন্ন সূত্রে জানা গেলেও প্রস্তাবিত খনি সম্পর্কে কিন্তু আরও বেশ কিছু তথ্য নির্দিষ্টভাবে জানা যাচ্ছে না। এই খনিতে কয়লা কত নীচে আছে, ব্যাসাল্ট পাথরের আচ্ছাদন ভেঙ্গে কয়লা তুলতে কত সময় লাগবে, কয়লার মান কেমন হবে, সেগুলি কতটা কাজে বা ব্যবসায়ে লাগবে, কী প্রযুক্তি হবে, প্রযুক্তি কারা দেবে, দেশিয় প্রযুক্তি উপযুক্ত ও লাভজনক হবে কিনা, না হলে বিদেশি প্রযুক্তি পাওয়া যাবে কিনা– এসব কিছুই জানা নেই।

এই এলাকায় সরকারি হিসাবে ইতিমধ্যেই ৯-১০টি পাথর খাদান ও ২৮৫টি স্টোন ক্রাশার ইউনিট চালু আছে। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা প্রায় চার গুন এবং তার তিন ভাগের কোনও রেজিস্ট্রেশন নেই, বেআইনি ভাবে চলছে। পাথর খাদান ছাড়াও মহম্মদবাজার, দুবরাজপুর অঞ্চলে অনেকগুলি ইউনিট থেকে কয়লা উত্তোলন হয় যার অধিকাংশই বেআইনি। বার বার তদন্তে দেখা গেছে যে এই অঞ্চলের স্পঞ্জ আয়রন এবং ফেরো অ্যালয় কারখানাগুলির অধিকাংশই চলে এই সব বেআইনি কয়লা ব্যবহার করে। এই অঞ্চলের মানুষ, বিশেষত এই সব খনি, খাদান এবং ক্রাশার’এ কাজ করা কর্মীদের অনেকেই সিলিকোসিস, নিউমনোকোসিস ইত্যাদি অসুখে মৃতপ্রায়।         

পরিবেশপ্রেমী হিসাবে আমাদের বিশেষ ভাবে চিন্তা, এই খনি চালু হলে পরিবেশের উপর তার কী এবং কতটা প্রভাব পড়বে, কীভাবে তার ব্যবস্থাপনা হবে, তা নিয়ে জনসমক্ষে কোথাও কোনও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। কোনও বৃহৎ প্রকল্প, বিশেষ করে লাল ক্যাটেগরি প্রকল্প হলে প্রথমেই তার পরিবেশে প্রভাব নিয়ে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। এখানে তেমন কিছুর অস্তিত্ব আমরা জানতে পারিনি। এমনকি কোথাও সরকারি ঘোষণায়, ওয়েবসাইটে, বিবৃতিতে এই প্রকল্পের বিশদ বিবরণ এবং পরিবেশের ওপর প্রভাব নিয়ে মূল্যায়নের যে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে– এমন কোনও উল্লেখ পর্যন্ত নেই। অথচ ইতিমধ্যেই জমি সংগ্রহ শুরু হয়ে গেছে, ক্ষতিপূরণের রূপরেখা বেসরকারি ভাবে ঘোষিত হয়েছে, চাকরির ফর্ম বিলি হচ্ছে, সরকারি ভাবে তা নিয়ে প্রকল্পের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের বোঝানোর জন্য কমিটি তৈরি হয়েছে, কমিটির কাজ শুরু হয়ে গেছে।

মূলত পরিবেশ বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে, সবুজ মঞ্চ’র পক্ষ থেকে আমরা গত ২২ ফেব্রুয়ারি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম-

Ø  এই প্রকল্পের জন্য বিশদ প্রোজেক্ট রিপোর্ট (Detailed Project Report-DPR) তৈরি হয়েছে কী? যদি এই রিপোর্ট তৈরি হয়ে থাকে, কীভাবে তা জনসমক্ষে পাওয়া যাবে? যদি না হয়ে থাকে, কবে এই রিপোর্ট তৈরি হবে?

Ø  যদি বিশদ প্রোজেক্ট রিপোর্ট না হয়ে থাকে, প্রোজেক্টের মৌলিক কাজগুলি শুরু করা হচ্ছে কীভাবে?

Ø  পরিবেশের উপর এই প্রকল্পের কী প্রভাব পড়বে, তার মূল্যায়ন (Environmental Impact Assessment – EIA) যা এই ধরনের বৃহৎ প্রকল্পের পক্ষে বাধ্যতামূলক, তা করা হয়েছে কী? যদি হয়ে থাকে, কীভাবে তা জনসমক্ষে পাওয়া যাবে?

Ø  পরিবেশ মূল্যায়ন (Environmental Impact Assessment – EIA) করার জন্য কোনও নিরপেক্ষ সংস্থা নিয়োগ করা হবে কী?    

Ø  এই ধরনের প্রকল্পের জন্য বিশদ পরিকল্পনা জনসমক্ষে এনে, স্থানীয় মানুষের মতামত জানার জন্য কোনও জন শুনানির (Public Hearing) আয়োজন করা হয়েছে কী? 

এখনও কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে বিভিন্ন পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং সমাজকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে আমাদের ধারণা হয়েছে- 

Ø  এই প্রকল্প চালু করতে হলে, বিপুল পরিমাণ বনাঞ্চল ধ্বংস করতে হবে। বিশাল এলাকায় পাথর ভাঙ্গা এবং কয়লা উত্তোলন চালু হলে এই বনাঞ্চলের ক্ষতিপূরণের কোনও সম্ভাবনা নেই।

Ø  এই এলাকায় ভূগর্ভের এবং ভূপৃষ্ঠের জলসম্পদের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হবে। এই এলাকা এমনিতেই খরাপ্রবণ। খনি চালু হলে জলসম্পদের যে ব্যবহার হবে তা পরিপূরণের সুযোগ নেই।

Ø  খনি চালু হলে এই এলাকা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের নদীগুলির নাব্যতা ও প্রাকৃতিক জলাশয়গুলির জলের উৎসগুলির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।

Ø  যতদূর জানা গেছে, এই অঞ্চলে খোলামুখ খনি থেকে কয়লা উত্তোলন হবে। এই পদ্ধতি ভয়াবহ দূষণ সৃষ্টি করবে।

Ø  যে বিপুল পরিমাণ ব্যাসাল্ট পাথরের আচ্ছাদন কয়লার উপরে রয়েছে, কয়লা পেতে হলে আগে তা তুলতে হবে। যে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ব্যবহার করা হবে, তার মারাত্মক প্রভাব তৈরি হবে। পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি, ঘরবাড়ি বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

Ø  জানা গেছে, সরকারি ভাবে স্বীকৃত ২৮৫টি ক্রাশার ইউনিটকে ব্যাসাল্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে বিনামূল্যে জায়গা দিয়ে স্থানান্তর করা হবে। অর্থাৎ, কয়লা খনি চালু হবার পরেও এই দূষণ সৃষ্টিকারী ক্রাশারগুলি শুধু চালু থাকবে না, এমন ধরনের সরকারি ক্ষতিপূরণ পাবে, যে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হলে বিপুল পরিমাণে অতিরিক্ত পাথর ভাঙ্গতে হবে এবং পরিবহন করতে হবে। এর ফলে স্বভাবতই অতিরিক্ত পরিবেশ দূষণ ঘটবে।  

Ø  যে বিপুল পরিমাণ সাধারণ এবং বিপজ্জনক আবর্জনা তৈরি হবে, তার ব্যবস্থাপনা তৈরির কোনও পরিকল্পনা করা হয়নি।

Ø  এই খনি চালু হলে, এই বিস্তীর্ণ এলাকার জীববৈচিত্রের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। পশু, পাখি, মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হবে।

Ø  এই খনি চালু হলে ঐ এলাকার সাধারণ মানুষ এবং বিশেষ ভাবে বয়স্ক এবং শিশুদের স্বাস্থ্যর উপরে খুবই ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলবে। 

Ø  প্রকল্পের জন্য যে ব্যাপক উচ্ছেদ হবে, তার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে।

আর একটি বিষয় আমাদের উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলছে। বিষয়টি শেষে উত্থাপন করলেও তার গুরুত্ব কোনও অংশে কম নয়। বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সারা পৃথিবীতে আজ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ক্রমশ কমানোর কথা হচ্ছে, প্রতিটি দেশ তাদের কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করছে, প্রতিটি সরকার কীভাবে এই জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা করা যায়, তার দীর্ঘ এবং স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করছে। সম্প্রতি গ্লাসগোর কনফারেন্স অব পার্টিজ-এর ২৬তম সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে ১০টি তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পর প্রস্তাব বাতিল হয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানির প্রকল্পে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ক্রমশ দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাচ্ছে।  

এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক আর একটি প্রশ্ন হল, পশ্চিমবঙ্গে পুনর্নবীকরণযোগ্য বিদ্যুৎ শক্তির প্রকল্প তৈরি এবং বাড়ানোর জন্য রাজ্যে পরিকল্পনা অস্পষ্ট। এক সময়ে পুনর্নবীকরণযোগ্য বিদ্যুৎ শক্তির উৎপাদনে ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের যে অগ্রণী স্থান ছিল তা এখন অনেক পিছিয়ে পড়েছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, দেওচা-পাঁচামির এই কয়লাখনির প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের পরিবর্তে পুনর্নবীকরণযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে ও পরিকল্পনা করে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করতে পারলে তা রাজ্যবাসীর পক্ষে অনেক ভাল হত, বিশ্ব উষ্ণায়ন রোধে সাহায্য করত এবং রাজ্যর ভাবমুর্তি অনেক উজ্জ্বল হত।


No comments:

Post a Comment