অ্যাপ নিছক অ্যাপ নয়!
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
জানা গেল, হোয়াটসঅ্যাপ’এর তথাকথিত মোকাবিলায় সম্প্রতি ভারত সরকার ‘সন্দেশ’ ও ‘সংবাদ’ নামে দুটি চ্যাট (মেসেঞ্জার) অ্যাপ’এর নির্মাণ করেছে যা খুব শীগগিরই বাজারে আসতে চলেছে। এর মধ্যে একটি হবে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে কাজের যোগাযোগ রাখার মাধ্যম অপরটি সাধারণ্যে হোয়াটসঅ্যাপ’এর বিকল্প। ভারত সরকারের ‘ন্যাশনাল ইনফরমেটিক্স সেন্টার’ এর নির্মাতা। আশ্চর্যের কথা, এই সরকার যখন প্রায় সমস্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের উদ্যোগ ও সম্পদকে বিক্রি করে দিতে উদ্যত এবং বেসরকারিকরণ তাদের মূলমন্ত্র, তখন সরকারি উদ্যোগে চ্যাট অ্যাপ’এর প্রবর্তন করে তারা ঠিক কী বার্তা দিতে চাইছে?
সকলেই জানেন, সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করা ও তাকে পূর্ণ মাত্রায় ‘ব্যবহার’ করতে দিল্লির অধীশ্বরদের জুড়ি মেলা ভার। এই কাজটি গত ৮-১০ বছর ধরে তারা অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে ও পেশাগত ভাবে পরিচালনা করে আসছে। আর তা করে তারা হাতেনাতে বেশ সরস ফলও পেয়েছে। ২০১৮ সালে অমিত শাহ রাজস্থানের একটি জনসভায় সগর্বে বলেছিলেন, আমরা চাইলে কয়েক মুহূর্তে সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করতে পারি। তার নজির গত কয়েক বছরে আমরা কম দেখিনি। নিঃসন্দেহে এ ক্ষেত্রে তাদের পারদর্শিতা তুলনাহীন।
কিন্তু ইদানীং ওদের সময় কি ভাল যাচ্ছে না? আগেই যেমন বললাম, এর আগে গোদি মিডিয়ার একতরফা সহায়তায় ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের সংগঠিত প্রবল উপস্থিতিতে দিনকাল ভালই চলছিল। হিন্দুত্বের রণহুঙ্কারে ও বিভাজনের রাজনীতির সুকৌশলী প্রয়োগে তারা দু’ দুবার দিল্লির সরকার দখল করেছে এবং একের পর এক বহু রাজ্যের মসনদে আসীন হয়েছে। মুজফফরনগর ও দিল্লির দাঙ্গায় গণহত্যা থেকে শুরু করে অসমে এনআরসি’র নামে ১৯ লক্ষ মানুষকে দেশহারা করে, সিএএ’র নামে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর মানুষকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বঞ্চিত করে, থেকে থেকে পাকিস্তানের জুজু দেখিয়ে, এমনকি হঠাৎ করে কয়েক ঘন্টার নোটিশে বিমুদ্রাকরণ ও লকডাউন জারি করে দেশ জুড়ে যে নৈরাজ্য ও বিপন্নতার আবহ তারা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে এবং প্রকারান্তরে একটা বড় অংশের মানুষকে মায়া ও মোহে মূক ও বধির করে রাখতে পেরেছে, তার পেছনে সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের সংগঠিত লাগাতার প্রচারের অশেষ ভূমিকা সর্বজনবিদিত। সে সবের পরে আপাতত সাধের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ জয়ের জন্য প্রায় নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে যে প্রবল পরাক্রমে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তার পিছনেও গোদি মিডিয়ার উদ্বাহু সমর্থন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় নির্লজ্জ ও নৃশংস মিথ্যাচারই তাদের পাথেয়। এরা কারা? কাদের হাতে আমরা বাঙালিরা পড়তে চলেছি? এই আশঙ্কা এখন বহু রাজ্যবাসীরই রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।
তবুও সময় যেন খানিক হলেও, অন্য স্বরে অন্য কথা বলতে চাইছে। একদিকে উত্তর ভারত জুড়ে প্রবল কৃষক আন্দোলনের স্থিতধী জোয়ারে বিভাজনকারী ও মিথ্যাচারীদের ঝুটা বসন খসে খসে পড়ছে, অন্যদিকে সোশ্যাল মিডিয়া’তেও এক বিপরীত ধারা জোরালো ভাবে বইতে শুরু করেছে। তার কিছু কিছু ফলাফল আমরা ঝাড়খন্ড, দিল্লি, হরিয়ানা ও বিহারের রাজ্য নির্বাচনে পেয়েছিলাম এবং অতি সম্প্রতি পাঞ্জাবের নগর পালিকার নির্বাচনে ওদের সলিল সমাধিতে আরও স্পষ্ট ভাবে তা টের পেলাম। যেন, তাদের সাধের সৌধগুলি জনতার আগুয়ান প্রতিরোধে নিমেষে ধুলায় মিশে যাচ্ছে। ‘মন কি বাত’এর ইউটিউব চ্যানেলে অপছন্দের সংখ্যা পছন্দকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। তারা তাই শঙ্কিত, আতঙ্কিত।
স্পষ্ট হচ্ছে যে, গোদি মিডিয়ার চিল-চীৎকারে আর কোনও কাজ হচ্ছে না। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে বিকল্প মিডিয়ার প্রসার হয়ে চলেছে যেখান থেকে খবরের সত্য-মিথ্যা তার আপন গরিমায় সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। পপস্টার রিহানা থেকে পরিবেশবিদ গ্রেটা থুনবার্গের পোস্ট থেকেও সারা বিশ্বে আন্দোলিত হচ্ছে এই কন্ঠস্বর। উপায়ন্তর না পেয়ে ট্যুইটার’এর ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে ডেকে হুমকি দিয়ে শাস্তির ভয় দেখিয়েও তেমন কোনও সুবিধা হচ্ছে না। শেষমেশ, ট্যুইটার’এর দেশি বিকল্প ‘কু’কে তোল্লা দিয়ে ভাবা গিয়েছিল খুব একটা কিছু করা যাবে। তাও মাঠে মারা গেল। ২১ বছরের তরুণী দিশা রবিকে জেলে পুড়ে, নিকিতা জেকব ও শান্তনু মুলুক’এর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেও এই উত্তাল হয়ে ওঠা জনমানসকে কোনওভাবেই আর রোখা যাচ্ছে না। অনড়, অটল কৃষকেরা ১৮ ফেব্রুয়ারি সারা দেশ জুড়ে চার ঘন্টার রেল রোকো করে জনতার এই মেজাজকে আরও উত্তুঙ্গে নিয়ে গেলেন। তাহলে এখন উপায়?
তেমনই একটি উপায় এবার সম্ভবত তারা বের করেছে বলে হয়তো ভাবছে। তা হল, হোয়াটসঅ্যাপ’এর বিকল্প একটি চ্যাট অ্যাপ নামানো। কেন? কী হতে পারে এর উদ্দেশ্য? অথবা, কীভাবে তা দিয়ে তারা মোকাবিলা করবে ধেয়ে আসা জনতার রোষকে? কোনও সন্দেহ নেই, ‘সন্দেশ’ বা ‘সংবাদ’ নামক অ্যাপ, যার একটি তারা সাধারণের জন্য বাজারে ছাড়তে চলেছে, তার পিছনে তাদের গুঢ় পরিকল্পনা আছে। আমরা জানি, ‘আত্মনির্ভরতা’ নামক একটি বেমালুম জুমলা তারা বেশ কিছুদিন বাজারে ছেড়ে রেখেছে। বিপদে পড়লেই তারা তার শরণাপন্ন হয়। অতএব, বোঝাই যাচ্ছে, সেই জুমলাটির ঘাড়ে চেপে তারা এবার এই অ্যাপ ব্যবহার করার জন্য চাপাচাপি করবে, সোরগোল তুলবে। এমনিতেই হোয়াটসঅ্যাপ’এর গোপনীয়তার বিধি নিয়ে নানারকম ওজর-আপত্তি আছে; অভয় দেওয়া হয়েছে ১৫ মে অবধি তার কোনও নড়চড় হবে না। বিপদ বুঝে অনেকেই ইতিমধ্যে ‘টেলিগ্রাম’ ও ‘সিগনাল’ অ্যাপ’এ পদার্পণও করে ফেলেছে। তাহলে কি এই বিভ্রান্তির সুযোগেই নতুন এই দুই অ্যাপ’এর ভাবনা? কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ‘সংবাদ’ ও ‘সন্দেশ’ অ্যাপ কতটা নিরাপদ? সবচেয়ে বড় কথা, যা বহু মানুষ ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন, বেকায়দায় পড়ে যাওয়া শাসকের এ কোনও বেপরোয়া চাল নয়তো? যে, ‘সন্দেশ’ বা ‘সংবাদ’ নামক অ্যাপ আসলে আপনার মোবাইলের সমস্ত তথ্য ও যাবতীয় কথাবার্তাকে তুলে আনার একটি প্রকৌশল? যা ডাউনলোড হওয়া মাত্রই স্পাইওয়ার’এর মতো কাজ করবে? খেয়াল করে দেখুন, দিশা রবিকে গ্রেফতার করার পর দিল্লির পুলিশ আদালতে জানিয়েছে যে তারা দীর্ঘদিন ধরেই ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ (এফএফএফ) সংগঠনের সমস্ত কার্যকলাপকে নজরদারিতে রেখেছিল। অথচ, এই এফএফএফ হল মুলত স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী ও কলেজ পড়ুয়াদের নিতান্তই পরিবেশ নিয়ে আন্দোলনের একটি অত্যন্ত নিরীহ আন্তর্জাতিক উদ্যোগ যার মূল উদ্যোক্তা গ্রেটা থুনবার্গ। গ্রেটা ১৮ বছরের এক সুইডিশ তরুণী যার নাম নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য বিবেচিত। এই যখন সার্বিক অবস্থা, যেখানে নোবেল শান্তি পুরস্কারের সম্ভাব্য প্রাপকও ঘোরতর অবিশ্বাসের তালিকায়, তখন একটি অ্যাপ’এর সাহায্যে আপনার সমস্ত কার্যাবলীকে নথিবদ্ধ করে ফেলতে তাদের দ্বিধা থাকবে কেন? তাই সাধু সাবধান!
মোদ্দা কথায়, যে সরকার’টা আজ দিল্লির কেন্দ্রীয় ক্ষমতায়, তার পিছনের রাজনৈতিক মতাদর্শ ও সংগঠনকে আর কেউ বিশ্বাস করতে চাইছে না। এমনতর পরিপ্রেক্ষিতে, তর্কের খাতিরে আর সব সন্দেহকে দূরে সরিয়ে দিয়েও এই প্রশ্নটি অতএব উত্থাপিত হওয়া খুব জরুরি যে, বেসরকারি হাতে দেশের যাবতীয় উদ্যোগকে তুলে দেওয়াই যখন দস্তুর, তখন এমন একটি সরকারি অ্যাপ’এর উদ্ভবের প্রয়োজন পড়ল কেন হঠাৎ করে তা ভাববার বিষয় নয় কী?
কেয়্যা বাত, কেয়্যা বাত
ReplyDeleteঠিক ঠিক
ReplyDelete