Pages

Sunday, 28 February 2021

দেশ জুড়ে কিষাণ ঢেউ

সমস্ত ভেদাভেদ মুছে যাচ্ছে

সোমনাথ গুহ

 

এই কৃষক আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে, যখনই তা সংকটে পড়েছে, আরও নতুন উদ্যমে তেজীয়ান হয়ে বিস্তার লাভ করেছে। আইন প্রণয়নের পরেই পাঞ্জাবের চাষিরা প্রথমে এর বিরুদ্ধে সরব হন। তখন কৃষকরা অন্তত ৩৩টি সংগঠনে বিভক্ত। এর মধ্যে ধনী চাষির সংগঠন যেমন আছে তেমনি ক্ষুদ্র, প্রান্তিক চাষি এবং ক্ষেতমজুরদের সংগঠনও আছে। বিভিন্ন মতাদর্শের সংগঠন আছে। প্রথম দিকে এঁদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করাটাই একটা সমস্যা ছিল। কিন্তু প্রায় দু' মাস ধরে চেষ্টার ফলে সেই অসম্ভবটা সম্ভব হয়েছে। দ্বিতীয় সংকট এল যখন দিল্লির দিকে জাঠাগুলোর ওপর হরিয়ানা সরকার নৃশংস আক্রমণ নামিয়ে আনল। জলকামান, কাঁদানে গ্যাস, নানা ধরনের প্রায় অলঙ্ঘনীয় ব্যারিকেডের মাধ্যমে তাঁরা কৃষকদের দিল্লি যাত্রা দুষ্কর করে তুলল। হরিয়ানা সরকার বদ্ধপরিকর যে কৃষকদের কিছুতেই দিল্লি ঢুকতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু প্রবল জনমতের চাপে এবং আন্দোলনকারীদের অদম্য মনোবলের কাছে সরকার নতি স্বীকার করল। কাতারে কাতারে কৃষিজীবী মানুষ দিল্লির বিভিন্ন সীমান্তে ঘাঁটি গাড়ল। তৃতীয় সংকট এবং এ যাবৎ সবচেয়ে গভীর সংকট বলা যেতে পারে যখন কৃষকদের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ সরকারের গুপ্ত প্ররোচনা ও মদতে ২৬ জানুয়ারি হিংসাত্মক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ল। গোদি মিডিয়া তখন উল্লসিত। তাদের উচ্চকিত প্রচারে মানুষও বিভ্রান্ত। জনসমর্থনে ভাটা পড়ার আশঙ্কায় দু-চারজন নেতা নিরাশ হয়ে পড়লেন। একটি পেটোয়া সংগঠন আন্দোলন থেকে সরে গেল। চারিদিকে গেল গেল রব, মনে হল আন্দোলন বুঝি শেষ। সংঘ পরিবারের লোকজন গ্রামবাসী সেজে আন্দোলনকারীদের ইট পাটকেল ছুঁড়ে আক্রমণ করল। মধ্য রাতে বিশাল পুলিশ বাহিনী গাজিপুর সীমান্ত থেকে তাঁদের বলপূর্বক উচ্ছেদের চেষ্টা করল।

ঠিক তখনই হাজারও কৃষক ফিনিক্স পাখির মতো অভূতপূর্ব ভাবে উঠে দাঁড়ালেন। ক্রন্দনরত রাকেশ টিকায়েতের ছবি উল্কার মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তাঁর গ্রামে মধ্যরাতের মহাপঞ্চায়েত আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। সেই থেকে গত এক মাসে প্রায় দুশোটি মহাপঞ্চায়েত এবং খাপের মিটিং পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানে সংঘটিত হয়েছে। এই সভাগুলোতে জনসমাবেশ হয়েছে গড়ে দশ হাজার থেকে পাঁচ লাখ। দক্ষিণ ভারতেও আন্দোলন ছড়িয়েছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি কর্নাটকে বেঙ্গালুরু, মাইসুরু, রাইচুর, ধারওয়ারে রেল রোকো হয়েছে। কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ুতে বিভিন্ন জায়গায় ধর্ণা ও বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়েছে। আন্দোলনে সহমর্মিতা জানাতে দক্ষিণ ভারত থেকে সমাজকর্মীদের একটি বিরাট প্রতিনিধি দল দিল্লি পৌঁছে গেছে।

সবচেয়ে যেটা লক্ষণীয়, বিভিন্ন রাজ্যের এইসব সভা-সমাবেশ জাতপাত, ধর্ম, লিঙ্গের বিভাজন ভেঙে দিয়েছে। উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে খাপ নামক সংগঠনটির প্রবল দাপট। গ্রামের বরিষ্ঠ মানুষদের দ্বারা পরিচালিত এই সংগঠনগুলি নারী স্বাধীনতা এবং জাতপাতের প্রশ্নে গোঁড়া ও রক্ষণশীল। মনে রাখতে হবে, পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায় সমাজ প্রবল ভাবে পিতৃতান্ত্রিক এবং জনসংখ্যায় নারী পুরুষের অনুপাত দেশের অন্যান্য রাজ্যের থেকে খারাপ। অথচ আন্দোলনের জোয়ারে সেই সব প্রাচীর ভেঙে গেছে। দেখা যাচ্ছে, বহু জায়গায় মহিলারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পাঞ্জাবে অধিকাংশ পুরুষেরা দিল্লি সীমান্তে চলে গেছেন। তাঁদের ঘর এবং খামার দুটোই সামাল দিচ্ছেন মহিলারা। এছাড়া পাঞ্জাবে অন্তত একশোটি বিক্ষোভে মহিলারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বিপুল সংখ্যক মহিলা মহাপঞ্চায়েতগুলিতে অংশগ্রহণ করছেন। হরিয়ানার জাঠ অধ্যুষিত অঞ্চলে এবং রাজস্থানে এঁদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।

আন্দোলনের জেরে লিঙ্গ বৈষম্য যেমন কমছে তেমনি শ্রেণি ও জাতপাতের বিভাজনও মুছে যাচ্ছে। রাজস্থানের কারৌলি জেলার কারিরি গ্রামে সম্প্রতি একটি মহাপঞ্চায়েত অনুষ্ঠিত হয় যেখানে কয়েক হাজার মীনা সম্প্রদায়ের কৃষকরা সমাবেশিত হন। প্রসঙ্গত এই সম্প্রদায় তফসিলি জনজাতির অন্তর্ভুক্ত। এই রাজ্যে জাঠ, গুজ্জরদের পাশাপাশি মীনারাও কৃষি কানুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরবতাঁরা এককাট্টা যে কোনও বিজেপি বিধায়ককে তাঁদের গ্রামে ঢুকতে দেবেন না। শ্রমিক কৃষক ঐক্য সমাবেশও হচ্ছে, যেমন পাঞ্জাবের বার্ণালায়। এই সমাবেশে বিপুল সংখ্যক ক্ষেতমজুর এবং প্রায় ৮০ হাজার মহিলা অংশগ্রহণ করেন। ক্ষেতমজুররা মনে করছেন, এই কালা আইনের ফলে তাঁদের কর্মসংস্থান এবং মজুরিতে টান পড়বে। তাই ধনী কৃষকদের সাথে শ্রেণিগত দ্বন্দ্ব থাকলেও তাঁরা আন্দোলনে শামিল হচ্ছেন।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে গেছে মুজফরনগরে। ২০১৩ সালে এই অঞ্চল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় দীর্ণ হয়েছিল। সেই সময় হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি মুসলিম নিধনের জন্য জাঠদের ব্যবহার করেছিল। হিন্দু ও মুসলিম জাঠদের মধ্যে সেই বিবাদ এখনও দগদগে ঘা হয়ে আছে। আশি-নব্বইয়ের দশকে এই অঞ্চলে অবিংসবাদী নেতা ছিলেন মহেন্দ্র সিং টিকায়েত যিনি তামাম অঞ্চলে বাবা টিকায়েত নামে পরিচিতকৃষকদের যাবতীয় সমস্যা সমাধানে তাঁর সাথে কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়াই করতেন মুসলিম জাঠ নেতা গুলাম মহম্মদ জোলাদাঙ্গার পর মহম্মদ জোলা অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। এখন হিন্দু জাঠ নেতারা স্বীকার করছেন যে ২০১৩ সালে মুজাফরনগর দাঙ্গায় বিজেপি নেতাদের দ্বারা তাঁরা ব্যবহৃত হয়েছিলেন। তাঁরা অনুতাপ করেন যে মুসলমানদের আক্রমণ করা তাঁদের উচিত হয়নি। আশার কথা, হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্কে যে ফাটল ধরেছিল তা গত দু-তিন বছর ধরে মেরামত করার প্রচেষ্টা চলছে। এই কৃষক সংগ্রামে হিন্দু ও মুসলমান জাঠ ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়াই করছেন। মহম্মদ জোলাও আবার সক্রিয় ভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছেন। গাজিপুরে রাকেশ টিকায়েত স্বীকার করেন, বিধানসভা ও লোকসভায় তাঁরা বিজেপিকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছিলেন। সেটা তাঁদের মস্ত বড় ভুল ছিল।

মহিলা ও নিম্নবর্ণ শ্রেণির মানুষদের মতো বিপুল সংখ্যক মুসলমান আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করছেন। রাজস্থানের মেওয়াত অঞ্চলের মহাপঞ্চায়েতে বিপুল সংখ্যক মুসলমান উপস্থিত ছিলেন। এঁরা মায়ো মুসলমান হিসাবে খ্যাতখাপ ও ধর্মীয় নেতারা এখানে ভাষণ দেন। মহম্মদ জোলা ছিলেন অন্যতম প্রধান বক্তা। বৃটিশ-বিরোধী আন্দোলনের সাথে কৃষক আন্দোলনের এটা একটা বিরাট মিল। তখনও দেখা গিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন যখনই তীব্র হয়েছে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত ভেদাভেদ কমে গেছে।

জনসমাগমের দিক থেকে এখন আন্দোলনে একটু ভাটার টান মনে হবেএটা ফসল কাটার সময় তাই অনেককেই গ্রামে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু পালা করে যাওয়া-আসা চলবে। একদল যাবেন, আরেক দল আসবেন। এছাড়া আসন্ন গ্রীষ্মের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। কুলার, এসি, গ্রীষ্মের ভয়ানক দাবদাহ থেকে বাঁচতে যথাযথ ছাউনির ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু আবার তাঁরা ফিরে আসবেন। যেহেতু ফসল বিক্রি করতে তাঁদের মান্ডিতে যেতে হবে তাই এমএসপির দাবি আরও জোরদার হবে। দিল্লি সীমান্তে লাখো কিষাণের গগনভেদী আওয়াজ শাসকের ভিত কাঁপিয়ে দেবে।

      

Saturday, 27 February 2021

পিএম কিষাণ নিধির জুমলা

কৃষিকথার আসর

প্রবুদ্ধ বাগচী


রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ অবশেষে প্রকাশ্যে এল। গত কয়েক মাস ধরে প্রচুর ইস্যু হুস হুস করে উঠে আসছিল জনপরিসরে, ঠিক যেমনভাবে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিমানঘাঁটি থেকে আকাশে উড়ে যায় বিমানগুলো। তার বেশিরভাগই অবশ্য জোলো। কোন দল থেকে কে অন্য দলে নাম লেখাল, কোন কোন টালিগঞ্জের চিত্রতারকা পতাকা হাতে নিয়ে সুবিধেমতো দলে ভিড়ছে ও ভোটপ্রার্থী হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করছে, কার বাড়িতে গোয়েন্দা দল অভিযান চালাল, কোন উঠতি ‘রামপন্থী’ সুন্দরী নেত্রী কোকেন নিয়ে বমাল ধরা পড়ল ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের নাম ফাঁস করে দিল ইত্যাদি ইত্যাদি। 

কিন্তু এর মধ্যে মাঝে মাঝে যে অন্য কথা নেই তা নয়। কিন্তু এইসব ইস্যু বেশিদিন স্থায়ী করে জনমানসের ডিভিডেন্ড নেওয়া মুশকিল। রাজ্যের সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনও অভিযোগ এখনও প্রমাণ করা যায়নি। গরু পাচার বা কয়লাকাণ্ডের কথা বলে যতই বাজার গরম করা হোক, গরু পাচার বিষয়ে বিএসএফ আধিকারিকদের নাম এসেছে, আর সীমান্তে পাচার বন্ধ করার দায় সরকারিভাবে তাদের ওপরেই ন্যস্ত, তাই কেন্দ্রের সরকার এর দায় ঝেড়ে ফেলতে পারে না। কয়লা কাণ্ডের তদন্তভার সিবিআই'এর হাতে, কেন্দ্রীয় প্রভুদের বরাভয় থাকলেও এমন কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য এখনও তারা বার করতে পারেনি যা নিয়ে শোরগোল হতে পারে। আমফানের ত্রাণ বরাদ্দ নিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশে সিএজি অডিট করছে, এখনও তেমন কিছু গুরুতর বেনিয়ম প্রকাশ্যে আসেনি। ফলে, সবটাই ভাসা ভাসা। বরং, যে দুটো ইস্যু ইদানিং পরিযায়ী নেতারা এসে এখানে ওখানে বলে বেড়াচ্ছেন তার একটা হল, প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি। এই প্রকল্প  রাজ্যে চালু না হওয়ায় এই রাজ্যের কৃষকরা বড় দুর্বিপাকে আছে, এমন ভাব করা হচ্ছে। আর তারা রাজ্যে ক্ষমতায় এলে প্রথম মন্ত্রীসভার বৈঠকেই সেটা চালু করে দেবেন, এমনকি রাজ্যের কৃষকদের বকেয়া টাকাও দেবেন এমন সব প্রতিশ্রুতির ফুলকি উড়ছে। পিএম কিষাণ নিধি কী এমন সাত রাজার ধন এক মানিক, যে ওইটা পেলেই রাজ্যের সব কৃষকদের মুখে চওড়া হাসি ফুটে উঠবে?

বছরে মাত্র ছ’ হাজার টাকা পেলে রাজ্যের কৃষকরা বর্তে যাবেন, ব্যাপারটা কি তাই? এতটাই সহজ সব? প্রথম কথা হল, কেন্দ্রের এই কৃষি কল্যাণ প্রকল্পের সূচনা হয়েছিল ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারি মাসে, মূলত আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে। এই রাজ্যে তার আগে থেকেই ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্প চালু হয়ে গিয়েছিল (ডিসেম্বর ২০১৮) এবং তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে অ্যাপের মাধ্যমে কৃষকদের নথিভুক্তির কাজ চলছিল। রাজ্যের প্রকল্পটির গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এই রাজ্যের জমির চরিত্র মাথায় রেখে মূল জমি মালিকদের পাশাপাশি ভাগে চাষ করা বর্গাদারদেরও এই প্রকল্পের মধ্যে আনা হয়। প্রাথমিকভাবে আর্থিক অনুদানের পরিমাণ ছিল বছরে পাঁচ হাজার টাকা যা দুটি ভাগে দেওয়া হয়- একটি রবিশস্যের সময় অন্যটি খরিফ শস্যের সময়। সাম্প্রতিক রাজ্য বাজেটে তা বাড়িয়ে কেন্দ্রের প্রকল্পের সমান অর্থাৎ বাৎসরিক ছ’ হাজার টাকা করা হয়েছে। আর রাজ্যের প্রকল্পটির আরও দুটো দরকারি দিক আছে। একদিকে সর্বাধিক একর পিছু কৃষিজমির জন্য পরিবার পিছু ছ’ হাজার টাকা বার্ষিক অনুদান ছাড়াও কারওর এর থেকে কম জমি থাকলেও তিনি আনুপাতিক হারে অনুদান পেতে পারেন কমপক্ষে বার্ষিক এক হাজার টাকা- একেবারে প্রান্তীয় চাষিদের পক্ষে এটা সুবিধে। অন্যদিকে, এই অনুদানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে একটা জীবনবীমা- অনুদান প্রাপকদের মৃত্যু হলে (এমনকি তিনি আত্মঘাতী হলেও ) তার পরিবার দু' লক্ষ টাকা বীমার অর্থ পাবেন। 

কেন্দ্রীয় প্রকল্পে এই দুটোর কোনওটাই নেই। ফলে, সুবিধের বিচারে রাজ্যের প্রকল্প কৃষকদের কাছে বেশি আকর্ষণীয়। কারণ, এই রাজ্যে ভাগচাষীর সংখ্যা বেশি, কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অর্থ তাদের পাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। এছাড়া এই রাজ্যে ফসল বীমার জন্য যে ‘বাংলা শস্যবীমা’ প্রকল্প আছে সেখানে বাণিজ্যিক ফসল ছাড়া (আলু, আখ) অন্য সব ক্ষেত্রে বীমার প্রিমিয়াম সরকার নিজেই বহন করছে। দেশ জুড়ে যে ‘প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনা’ চলে তাতে এই সুবিধে নেই। ফলে, বছরে মাত্র পাঁচ বা ছ’ হাজার টাকা পেলে একজন কৃষকের কতটা উপকার হতে পারে, এই প্রশ্নটাকে যদি আমরা সরিয়ে রাখি, তাহলে কিন্তু দেখা যাবে কৃষকের আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে ও তাঁকে কিছুটা সরকারি সুবিধে দানের ক্ষেত্রে রাজ্যের প্রকল্পটি বেশি ভাল আর তার আওতার মধ্যে অনেক বেশি কৃষক আসতে পারেন, আসছেনও। কেন্দ্রীয় প্রকল্পে অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাপকের নামে জমি মিউটেশনের নথি আবশ্যক; রাজ্য সরকার সম্প্রতি তাদের প্রকল্পের ক্ষেত্রে নিয়ম আরও সরল করে মিউটেশন আবশ্যিক না রেখে কৃষকের নিজের ঘোষণাপত্র থাকলেই অনুদান দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। সন্দেহ নেই, এতে রাজ্যের কৃষকদের হয়রানি কমবে। 

কিন্তু কথাটা হল, আর সব কিছু ছেড়ে এই বিশেষ পিএম কিষাণ নিধি প্রকল্প নিয়ে কেন্দ্রের শাসক দল যে রাজ্যে জোরদার প্রচার চালাচ্ছে তার যৌক্তিকতা ঠিক কতটা? তারা যে রাজ্যের কৃষকদের এই প্রকল্প থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগ তুলছে তাই বা কতদূর সত্যি? রাজ্যের সরকার কেন্দ্রের এই প্রকল্প মেনে নিলে ভাল হত বা খারাপ হত সেই বিতর্কে জড়িয়ে লাভ নেই কিন্তু একই দফতরের একই ধরনের সরকারি অনুদান দুই সরকারের থেকেই পাওয়া যায় কি না সেই বিষয়ে কিন্তু যথেষ্ট সংশয় আছে। সচরাচর অন্য সরকারি অনুদানের ক্ষেত্রে এই বিধিনিষেধ থাকে। তেলেঙ্গানা রাজ্যে ‘রায়ত বন্ধু’ ও ওড়িশায় ‘কালিয়া’ প্রকল্প কিন্তু পিএম কিষাণ নিধি চালু হওয়ার পরে তার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে, ফলে একই উপভোক্তা একসঙ্গে দুটো সুবিধে পাচ্ছেন না। তাহলে যদি এই রাজ্যের কৃষকদের দুটোর মধ্যে বেছে নিতে হয় তাহলে রাজ্যের প্রকল্পে স্পষ্টভাবে বাড়তি সুবিধে তারা পাচ্ছেন। 

এইবার দেখা যাক অন্য একটা বিষয়। এই রাজ্যের কৃষকদের আয় বৃদ্ধি নিয়ে যাদের খুব দুর্ভাবনা করতে দেখা যাচ্ছে, তাদের পরিচালিত সরকারের অধীন কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রকের হিসেব বলছে বর্তমান আর্থিক বছরে (২০২০-২১) তারা পিএম কিষাণ নিধির জন্য বরাদ্দ অর্থ পুরোটা খরচ করে উঠতেই পারেনি। খরচ না হওয়া অর্থের পরিমাণ দশ হাজার কোটি টাকা। আরও মজার কথা হল, আগামী আর্থিক বছরের (২০২১-২২) বাজেটে এই প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাত্র দু' বছর যে প্রকল্পের বয়স, তার তৃতীয় বছরেই এই বাজেট বরাদ্দ হ্রাস খুবই আশ্চর্যের। 

এর পরেও কথা আছে। এই রাজ্যের কৃষকদের জন্য যারা  ইদানিং বড্ড বেশি চোখের জল ফেলছেন তাদের কি জানা আছে যে তথ্যের অধিকার আইনে করা এক প্রশ্নের উত্তরে খোদ সরকার জানিয়েছে, প্রকল্পটির প্রায় ১৩৬৪ কোটি টাকা চলে গিয়েছে ভুল লোকের কাছে! কৃষি মন্ত্রকের তথ্য বলছে, যারা এই সুবিধা পেতে পারে না এমন ২০ লক্ষ ৪৮ হাজার কৃষিজীবী টাকা পেয়েছেন যাঁদের মধ্যে অধিকাংশই (৫৫.৫৮ শতাংশ) আয়কর দেন, আর বাকিরা প্রকল্পের অন্যান্য শর্ত পূরণ করেন না। প্রকল্পের নিয়মানুযায়ী প্রতি চার মাসে ২০০০ টাকা করে (বছরে ৬০০০ টাকা) সরাসরি সেই কৃষকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়ার কথা যাঁর জমির পরিমাণ ২ হেক্টরের থেকে কম; মাসে ১০,০০০ টাকার বেশি পেনশন পেলে বা আয়কর দিলে এই অনুদান পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু অনুদান তারা পেয়েছেন। সম্প্রতি শেষ হওয়া সংসদের অধিবেশনে কেন্দ্রের কৃষিমন্ত্রীও স্বীকার করে নিয়েছেন, পিএম কিষাণ নিধির প্রচুর অর্থ প্রকৃত প্রাপকদের বাইরে ভুল লোকের কাছে চলে গেছে। তামিলনাড়ুতে সাড়ে পাঁচ লক্ষ ভুয়ো প্রাপকদের কাছে চলে গেছে ১২৬ কোটি টাকা, অনুদান পাইয়ে দেওয়ার জন্য কাটমানি দেওয়া হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। ফলে, আমাদের রাজ্যকে ‘সোনার বাংলা’ করে তোলার জন্য যারা দু' বেলা মঞ্চে মঞ্চে ভাষণ দিয়ে বেড়াচ্ছেন, যাদের মুখে কেবলই পিএম কিষাণ নিধির গুণপনা, সেই বিশেষ প্রকল্পটির পারফরম্যান্স যে খুব বুক বাজিয়ে বলার মতো নয় এটা একরকম পরিষ্কার।

পশ্চিমবাংলার মতো কৃষিভিত্তিক রাজ্যে কৃষকের সব সংকটের সমাধান হয়ে গেছে, এ কথা কেউই বলে না। তাছাড়া সারা দেশেই কৃষির সংকটের মূল কারণ চাষের খরচ বেড়ে যাওয়া, চাষের অন্য সরঞ্জামের ব্যয় বৃদ্ধি, উপযুক্ত কৃষি ঋণ না পাওয়া, ফসলের উপযুক্ত মূল্য না পাওয়া ইত্যাদি। এইসবের বেশির ভাগেরই কারণ কেন্দ্রীয় নীতি- সারের ওপর ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়া, নিয়মিত অনিয়ন্ত্রিতভাবে ডিজেলের দাম বাড়িয়ে সেচের খরচ বাড়িয়ে তোলা, এসব কৃষক বিরোধী পদক্ষেপ তারাই করে চলেছে। আর সমস্ত রাজ্যকে অন্ধকারে রেখে সংসদীয় রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে দানবীয় কৃষি বিল আনায় সারা দেশে যে অভূতপূর্ব চলমান কৃষক আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছে, ‘গদি মিডিয়া’র প্রবল চেষ্টা সত্ত্বেও তা ক্রমশ এক কিংবদন্তী গণআন্দোলনের জন্ম দিচ্ছে। সেখানে মূল চালিকাশক্তি দেশের শয়ে-শয়ে কৃষক সংগঠন যারা দেশের কেন্দ্রীয় সরকারকে আর বিশ্বাস করতে রাজি নন। এইরকম বিধি বাম অবস্থায় রাজ্যের কৃষকদের সামনে একটা মাত্র অনুদান-প্রকল্পকে সর্বরোগহর বটিকা হিসেবে ঝুলিয়ে রাখা  আসলে সেই মাটির মানুষগুলির প্রতি এক ধরনের নির্মম রসিকতা নয় কি? 

অবশ্য এই ধরনের মিথ্যাচার একমাত্র তাদেরই মানায় !


Tuesday, 23 February 2021

উন্নয়ন ও গণতন্ত্র

শিক্ষা বিনে কল্যাণমুখি অর্থনীতি হয় না!

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়


উন্নয়ন রাজনীতি ছাড়া হয় না। আবার রাজনীতির জন্য উন্নয়ন হয় না। এই দুইয়ের দু' মুখো টানের মধ্যে মানুষের প্রতিদিনের বেঁচে থাকা। তার মধ্যেই মানুষকে বেছে নিতে হয় গণতন্ত্রে তাঁর প্রতিনিধি। তাঁর বিশ্বাস, অভিজ্ঞতা ও বিচার বোধ থেকে তিনি ভোট দেন। এইখানেই পার্থক্য ঘটায় শিক্ষা। শিক্ষা তো বাঁচার জন্য এবং যাপনের জন্য। বাঁচার প্রশ্নে মানুষ যাঁকে চান, যাপনে তিনি তাঁর আশা পূর্ণ করতে পারেন না অনেক সময়েই। তাই দুই ধারার ভাবনায় দুই ধারার চিন্তা থেকে মানুষ বেছে নেন তাঁর চাওয়া। 

যে বেকার সে কাজ পেলেই ভোট দেবে। যে চাকরি করে সে কর্মস্থলে বেতন বৃদ্ধি ও সুযোগ সুবিধার প্রশ্নে তার আন্দোলনের প্রতিনিধি খুঁজে নেয়। তেমনই ব্যবসায়ী, কৃষক, শ্রমিক, শিল্পপতি নানা শ্রেণির জীবিকার মানুষ দেখেন তাঁর জীবিকার প্রয়োজন মেটাতে কাজে লাগে কে? কে তাঁর উন্নতির সহায়ক। এখানে সকলেই নিজ উন্নতির প্রয়োজন দেখে ঠিক করে নেয় প্রতিনিধি। প্রতিনিধি দেখেন তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠ অনুগামী কী চাইছেন। অনুগামীদের চাওয়া এবং দাবি প্রতিনিধিকে লড়াই এবং আন্দোলনের পথ ঠিক করে দেয়। একই সঙ্গে প্রতিনিধির ভাবনা চিন্তা অনুগামীকে টেনে নিয়ে আসে। প্রতিনিধি এবং অনুগামী উভয়েরই কাজ হয়ে পড়ে সামনের বাধাগুলিকে দূর করা। বেঁচে থাকা এবং বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে চলার এই প্রক্রিয়াটাই জন্ম দেয় রাজনীতির। যে সমীকরণের মধ্যে দিয়ে কতকগুলো মানুষ যূথবদ্ধ হয় এবং নিজেদের ভালোর জন্য এগিয়ে যাওয়ার পথ খোঁজে সেটাই রাজনীতি। যে কাঠামোর মধ্যে ভালো থাকার চিন্তাগুলোকে সাজানো যায় সেটাই রাজনৈতিক মত ও পথ ঠিক করে দেয়। 

এসব কিছুর মধ্যে যেহেতু প্রত্যেকেই বেঁচে থাকা এবং এগিয়ে যাওয়ার জন্য সমবেত হয়েছে তাই রাজনীতির মূল শর্ত হল উন্নতি সাধন। যে গোষ্ঠী উন্নতি করার জন্য যে মতে বিশ্বাস করে, সেই গোষ্ঠী রাজনীতির পথ হয় সেইরকম। বিশ্বাসের প্রকরণ। তাই মত নানা রকমের। নানা রকমের পথ। মত ও পথের দ্বন্দ্ব তাই অনিবার্য। যে শিক্ষা অনিবার্য দ্বন্দ্বের মধ্য থেকে আনতে পারে সমন্বিত ভাবনা সেই রাজনৈতিক শিক্ষা জন্ম দিয়েছে গণতন্ত্রের। এর আগে যতগুলি রাজনৈতিক কাঠামো ছিল সেখানে সব কিছুই কোনও একটি শ্রেণি দ্বারা তার মতো ভাবনায় যেটি তাঁর মতাদর্শে বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্য সেই পথে সমাজ গঠনের কথা ভাবা হয়েছে। কিন্তু একমাত্র গণতন্ত্র সর্বশ্রেণির প্রতিনিধির সমন্বয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অবকাশ রেখেছে। শাসক তার নিজের কোনও ভাবনা চাপিয়ে দিতে চাইলেও সেটি কার্যকর করতে বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনার মধ্যে দিয়ে রূপ দিতে বাধ্য হয়, নইলে বিরোধীদের আন্দোলনের মুখে পড়ে। সাধারণ মানুষের কাছে বহু মতের মধ্যে নিজের প্রয়োজন ও পছন্দে নিজের প্রতিনিধি খুঁজে নিয়ে রাজনীতির গতিমুখ নির্দিষ্ট করে দেয়। চাপিয়ে দেওয়া স্লোগান সর্বস্ব রাজনীতি থেকে ধীরে ধীরে মানুষ সরে যায়। তার উন্নতির ঠিকানা যেখানে সেখানেই সে নাম লেখায়।

সমাজের পরিস্থিতি একরকম থাকে না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম সংকট সামনে এসে দাঁড়ায় মানুষের সামনে। কখনও সেটা বেঁচে থাকার, কখনও উন্নতির, কখনও আরও উন্নতির, কখনও যাপনের প্রশ্নে মানুষ ঠিক করে নেয় কেমন সমাজ চাইছে। সেখানে জীবিকা অর্জন থেকে শুরু করে নানাবিধ নিত্য জীবনের ইস্যুগুলিতে কীভাবে সুযোগ-সুবিধা পেতে চায় তার ভিত্তিতে সে কোনও এক দলের অনুগামী হয়ে ওঠে। আবার কেউ কেউ তার স্থির নিরাপদ জীবনে কোন পথে উন্নতির জোয়ার আসতে পারে ভেবে মত-পথের পরিবর্তন পছন্দ করে। আবার কেউ কেউ তার নিজের জীবনাদর্শের দিক থেকে নিজের যাপনকে একসূত্রে বাঁধতে চায়। তাই যে স্বপ্ন সে এঁকেছে অন্তরে, তার উদ্গাহনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। এইসব প্রচেষ্টার উদযাপনের মধ্যেই মানুষের রাজনীতি। বুঝে হোক কিংবা না বুঝে হোক, মানুষ বেঁচে থাকার প্রশ্নে, উন্নতির আকাঙ্ক্ষায় কিংবা যাপনে তৃপ্তি পেতে যা চায় তার মধ্যেই থেকে যায় তার রাজনীতির সুপ্ত বীজ। ক্রমে চলার পথে আত্মবিকাশের হাত ধরে সেই বীজ তার চেতনায় তাকে একটি রাজনীতির অনুসারী করে তোলে। তার চেতনার উন্মেষ হয় শিক্ষার মধ্যে দিয়ে। সেখানেও বেঁচে থাকার জন্য জীবিকা অর্জনের শিক্ষা, উন্নতি করার জন্য জাগতিক সমস্ত বাধা উত্তরণের শিক্ষা এবং যাপনের জন্য নিজেকে দেখার এবং চেনার চেষ্টা করার শিক্ষা তার বিকাশের পথ বাছাই করতে সাহায্য করে। মতামত গঠনে প্রভাব ফেলে। এ থেকেই সে সিদ্ধান্ত নেয়। 

তাই জীবনে বেঁচে থাকা, উন্নতি এবং যাপনের প্রশ্ন-উত্তরগুলো মানুষ খুঁজে নেন শিক্ষার মধ্যে দিয়ে আর সেই উত্তরগুলো গড়ে তোলে সেই সমাজের রাজনীতি। যে সমাজের শিক্ষা যেমন তার রাজনীতি তেমন। কারণ, মানুষ যে বিষয়গুলিকে গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দেন এবং মৌলিক শর্ত হিসেবে বেঁচে থাকা, উন্নতি ও যাপনের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় তার থেকে মুক্তি দেয় যে মত ও পথ সেটাই রাজনীতির পথ তৈরি করে দেয়। আর এই মুক্তি খুঁজে দেয় শিক্ষা। শিক্ষা বেছে নিতে শেখায়। মানুষ সাম্প্রদায়িক হবে না অসাম্প্রদায়িক হবে, বামপন্থী হবে না ডানপন্থী হবে, পুঁজিবাদের অনুসারী হবে নাকি সাম্যবাদ চাইবে, ক্ষমতার তন্ত্রকে পছন্দ করবে নাকি গণতন্ত্রকে পছন্দ করবে, সব কিছু কিন্তু মানুষই ঠিক করেন তাঁর শিক্ষার ভিত্তিতে। যার যেমন শিক্ষা তাঁর তেমন বোধ, তাঁর তেমন চেতনা। তাঁর কাছে তেমন অগ্রাধিকার এবং পছন্দ যার ভিত্তিতে গড়ে উঠবে রাজনীতি। 

মানুষের এই শিক্ষা সমাজের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে। কে করবে নির্মাণ? নেতৃত্বের প্রশ্নে ক্ষমতা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে যায়। শিক্ষা চেতনা তৈরি করে বলেই শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করাটা রাজনীতির অঙ্গ হয়ে যায়। অর্থাৎ, যাকে নিয়ে উত্তরণের শক্তি অর্জন করা সেই শক্তিকেই করায়ত্ত করে ক্ষমতাকে পেতে চায় মানুষ। তখন রাজনীতি আর উন্নতির রাজনীতি থাকে না। রাজনীতি হয় দমনের। সেটা যে তন্ত্রই হোক। তখন নতুন আরেক প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায়। ক্ষমতার রাজনীতির হাত থেকে মুক্তি পাব কীভাবে? তখনই সকল মানুষের ক্ষমতা গড়ে তোলা খুব প্রয়োজন হয়। সহমতের ভিত্তিতে কাজ করতে গেলে সকলকে সহ-ক্ষমতার ভিত্তিতে এক আসনে উপনীত হতে হয়। নইলে একের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে অনিবার্যভাবে দমন তখন নিত্য বাস্তব এক সমাজ লক্ষণ হয়ে দাঁড়ায়। এই মানুষের সভ্যতার লক্ষ্যই হল সকলকে সক্ষম করে তোলা এবং আরও বেশি স্বাধীনতার ভিত্তিতে সকলকেই এক আসনে এনে রাখা। আদর্শ রাজনীতি সেটাই যা সকলকে সক্ষম এবং একাসনে আনার কথা বলে।

কিন্তু কীভাবে? কল্যাণবোধের মাধ্যমে। কল্যাণ কখনও শুধুমাত্র নিজের জন্য করা যায় না। অন্যের উন্নতির প্রশ্নে নিজেকে সংযুক্ত করতে পারলে তবেই কল্যাণ সাধন হয়। রাজনীতি যতই দমনমূলক হোক তাকে প্রশ্নের মুখে, চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তেই হবে। তাই পশ্চাতে ফেলেছ যারে পশ্চাতে টানে সে- রাজনীতিতে এটাও অবশ্যম্ভাবী। তাই ওঠানামা থাকবে। সেটা কেবলমাত্র ক্ষমতা দখল আর প্রস্থান নিয়ে নয়। ক্ষমতায় যিনি আছেন তার প্রতিদিনের কাজে তিনি কতটা দমনমূলক আর কতটা কল্যাণময় তার থেকেই ঠিক হয়ে যায় কতটা প্রতিরোধের সম্মুখীন হবে আর কতটা সমর্থন কুড়োবে। প্রতিরোধ করবে যে সমর্থন করবে সে। সেই একই মানুষ বদলে যায় যখন তার জীবিকা, উন্নতি বা যাপনের প্রশ্নে সে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলে। তাই সেই মানুষ যত ব্যক্তিকেন্দ্রিক হবে ততই সে তার উন্নতিকে চাইবে আর সেই মানুষটি যত ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ত্যাগ করে সমকেন্দ্রিক হবে, সমাজমুখি হবে, ততই সেই মানুষটি সকলের কল্যাণমুখি হবে। তাই সমাজে যত বেশি মানুষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক সেখানে ব্যক্তি কেন্দ্রিক রাজনীতি জন্ম এবং চর্চা হবে। আর যে সমাজে বেশি মানুষ সমকেন্দ্রিক সম্ভাবনায় সম ভাবনায় চলার চেষ্টা করবে সেখানে তত বেশি কল্যাণমুখী রাজনীতির জন্ম নেবে। এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি জন্মদায়ক উন্নতির পথ আর সমকেন্দ্রিক সম ভাবনায় কল্যাণমুখি রাজনীতি জন্ম দেয় উন্নয়নের পথ। উন্নতির মধ্যে দিয়ে উন্নয়নের পথ খোঁজা তাই খুব জরুরি। 

অর্থাৎ, এমন অর্থনীতি চাই যেখানে ব্যক্তির উন্নয়নের মধ্যে দিয়ে সমষ্টির বিকাশ ঘটবে। সেই লক্ষ্য নিয়ে যে সমাজ চলবে তার রাজনীতিই ঠিক করে দেবে ক্ষমতার কল্যাণমুখি বণ্টন, এক কথায় যাকে বলে সাধারণের ক্ষমতায়ন। সেটা সমানভাবে হতে চাই যে শিক্ষা, তার প্রয়োজন সবার আগে। তবেই সমাজে কল্যাণমুখি ভাবনার জন্ম নেবে, চর্চা হবে এবং বিকাশ হবে এক নতুন সমাজের।


Sunday, 21 February 2021

গণতন্ত্রের সলিল সমাধি

ভারতে ম্যাকার্থিবাদের পুনর্জন্ম

শোভনলাল চক্রবর্তী

 

টুলকিট শেয়ারের ঘটনায় পরিবেশকর্মী দিশা রবি, নিকিতা জেকব ও শান্তনু মুলুকের গ্রেফতারি দেশ জুড়ে আলোড়ন তুলেছে। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আমেরিকা তোলপাড় করা ম্যাকার্থিবাদ সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের রাজনীতিতে এবং সমাজ জীবনে ক্রমশ শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে চলেছে। কী ছিল ম্যাকার্থিবাদের মূল ভাবনা? বিরোধী যে কোনও ব্যক্তি বা সংগঠন বা দলকে হেনস্থা করতে দ্বিধাহীন কণ্ঠে মিথ্যা অভিযোগ করে যাও, কুৎসা প্রচার করো এবং কুৎসা প্রচারের জন্য কারও কাছে জবাবদিহি করার চিন্তা মনে স্থান দিও না। ১৯৫০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি 'লিঙ্কন দিবস'এ আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়ায় রিপাবলিকান পার্টির মহিলা সদস্যদের একটি সভায় সেনেটর জোসেফ ম্যাকার্থি ভাষণের মাঝপথে হঠাৎই পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে বললেন, 'আমার কাছে একটি নামের তালিকা আছে। যে তালিকায় কমিউনিস্ট পার্টি ও রুশ গুপ্তচরদের একটি নেটওয়ার্কের ২০৫ জনের নাম আছে যারা স্টেট ডিপার্টমেন্টে চাকরি করছে।'  ম্যাকার্থির এই কথা আগুনে ঘি দেওয়ার কাজ করল। প্রচারমাধ্যমের সাহায্যে গোটা আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ল ওই তালিকার খবর। 

সেই ঘটনার ৭১ বছর পর আজকের ভারত। এ এক অদ্ভুত অবস্থা দেশে। সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র আজ ভীত এবং সন্ত্রস্ত। আর এই ভীতি থেকেই জন্ম নিচ্ছে হঠকারিতা, গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে নস্যাৎ করার প্রবণতা। 

বলাই বাহুল্য, বিশ্বের বৃহত্তম সংসদীয় গণতন্ত্র এই ভারতে একটি সংবিধান আছে। এবং সেই সংবিধানে দেশের মানুষের জন্য কিছু মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ রয়েছে। ভীত, সন্ত্রস্ত রাষ্ট্র এখন মনে করছে দেশের সংবিধানে স্বীকৃত 'নাগরিক অধিকার' রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এক বিপদজনক ধারণা। এতদিন প্রকাশ্যে এ কথা বলেননি রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা, কারণ দেশের ১৩৮ কোটি মানুষ ও বিশ্ব দরবারে গণতন্ত্রের মুখোশটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর ওই মুখোশটাকেই ধ্রুব সত্য মনে করে দেশের একটা বড় অংশের মানুষ প্রকৃত গণতন্ত্রের মূল ধারণাটাই ভুলে যেতে বসেছেন। সেটা টের পেয়েই এখন মুখ আর মুখোশের ভেদাভেদ ভুলে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলছেন যে প্রতিবাদী কৃষকরা 'পরজীবী' এবং তাঁদের যাঁরা সমর্থন করছেন তাঁরা 'আন্দোলনজীবী'। এই আন্দোলনজীবীদের পেছনে বিদেশি শক্তির হাত আছে এ কথাও তিনি বলেছেন, একই নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করেছেন শহুরে নকশাল ও মাওবাদীদের কথা। যে প্রধানমন্ত্রী দাঙ্গা ব্যতীত আর কোনও কিছুর নেতৃত্ব দেননি, তিনি মসনদে বসে তাঁর মতো করে বুঝেছেন যে, যাঁরা নিপীড়িত মানুষের লড়াইয়ের সামনের সারিতে, তাঁদের মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করার সহজ উপায় তাঁদের গায়ে 'দেশদ্রোহী'র তকমা দিয়ে দেওয়া। আর এই কাজে তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ম্যাকার্থিবাদকে আঁকড়ে ধরবেন সেটাই স্বাভাবিক। 

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে দুটি রাজ্যে ঘোষণা করা হয়েছে যে, কে বা কেউ যদি দেশদ্রোহী কোনও পোস্ট করেন তবে তা নাগরিকদের মধ্যে নিয়োজিত ভলান্টিয়াররা যথাস্থানে জানিয়ে দেবেন। এই ঘোষণা এক কথায় মারাত্মক। নাগরিককে সহ-নাগরিকের বিরুদ্ধে হিংসায় প্ররোচনা দেওয়ার সামিল। সাত দশক গণতন্ত্রে বসবাসের পর যে বাস্তবে নাগরিকদের ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। এই একই কায়দায় ম্যাকার্থি মার্কিন জনগণের মধ্যে একটি খাড়া দেওয়াল তৈরি করেছিলেন। তবে ইতিহাস ম্যাকার্থিকে ক্ষমা করেনি। আসলে, প্রতিবাদ প্রতিরোধকে রাষ্ট্র সর্বকালে, সর্বক্ষণে ভয় পেয়ে এসেছে। আজ ভারতবর্ষে যাঁরা মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারীকে গুরু মানেন, তাঁরা দেশদ্রোহী নন। দেশদ্রোহী তাঁরা, যারা আদিবাসী, দলিত, নিপীড়িত মানুষের কাছের মানুষ, যারা সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষের অধিকার রক্ষায় সদা তৎপর। 

দেশদ্রোহী- এই শব্দটির কোনও আইনগত ভিত্তি নেই। এখনও পর্যন্ত কে যে ঠিক দেশদ্রোহী এটাই সংজ্ঞায়িত নয়। কেউ যদি মুলস্রোতের বাইরের রাজনীতি করেন তাহলেই কি তিনি দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত হবেন? এসবের কোনও ঠিক নেই। ভারতের সংবিধান যেহেতু এখনও মুক্তচিন্তার অধিকারের সঙ্গে বাকস্বাধীনতার কথাও বলে থাকে, তাই দেশের শীর্ষ আদালতের পক্ষেও দেশদ্রোহী কে, সেই বিচার করা সহজ হবে না। ইনফরমেশন টেকনোলজি আক্ট ২০০০-এর ৬৬(এ) ধারা বিলোপের সময় শীর্ষ আদালত নির্দেশ দিয়েছিল, যে কোনও আক্রমণাত্মক কিংবা বিরক্তি উৎপাদক মন্তব্যই হিংসায় ইন্ধনকারী মন্তব্য হিসেবে গ্রাহ্য হতে পারে না। স্পষ্টতই এটা একটা সূক্ষ্ম বিচারের প্রশ্ন, অর্বাচীন নাগরিকের পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার নয়। সাধারণ মানুষ সচেতন হোন বা না হোন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানে যে দেশ-বিরোধিতা কিংবা রাষ্ট্র-বিরোধিতাই বিবেচ্য বিষয় হলে তা কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মতাধীন হতে পারে না, তার ভিত্তি একান্ত ভাবেই আইনের উপর। সে ক্ষেত্রে নতুন নির্দেশিকার উদ্দেশ্য শুধু নাগরিককে নাগরিকদের পেছনে লেলিয়ে দেওয়া। 

ম্যাকার্থিবাদের পথে হেঁটে দেশের সরকার আজ এক গুরুতর অস্ত্র তুলে দিচ্ছে কিছু মানুষের হাতে, স্বনিযুক্ত সমাজপুলিশের হাতে- যাঁরা গরুর মাংস খাওয়া থেকে শুরু করে কৃষক আন্দোলনের প্রতি সমর্থন, যে কোনও কিছুকেই দেশদ্রোহিতা বলে দাগিয়ে দিতে প্রস্তুত। সমাজবিরোধী, অপরাধী কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণ ব্যক্তিও যে কোনও অপছন্দের লোককে অবলীলায় এই অছিলায় অভিযুক্ত করতে পারবেন, বিপদে ফেলতে পারবেন। এটা পরিষ্কার যে কেন্দ্রীয় সরকার যা চাইছে তা হল জঙ্গলরাজ। কোনও সুস্থ সমাজ এমন নির্দেশিকায় চলতে পারে না। ম্যাকার্থির ভারতীয় অনুগামীরা আসলে 'বিরোধী মুক্ত ভারতের' ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে রাষ্ট্র ও দেশবাসীকে দেশদ্রোহিতার ভূত দেখিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চাইছেন।

 

Saturday, 20 February 2021

'শিক্ষিত সন্ত্রাসবাদী'র খোঁজে

প্রধানমন্ত্রী উবাচ

নীলকন্ঠ আচার্য

 

'কিছু শিক্ষিত মানুষ সন্ত্রাস ছড়াচ্ছেন'- প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী/ বিশ্বভারতীর সমাবর্তন/ ১৯ ফেব্রু ২০২১

বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে দিল্লি থেকে ভার্চুয়াল ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এ কথা হঠাৎ বললেন কেন? এবং এও বললেন, যে যেমন কর্ম করবেন তাঁকে সেভাবে তার ফলও পেতে হবে। বাঃ! বেশ 'সুন্দর' শাসানি তো! কিন্তু প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, সমাবর্তনের মতো এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর এরকম ক্রূর মন্তব্য কি বিশেষ কোনও বার্তা দিতে চাইছে?

উল্লেখ্য যে, এই সমাবর্তন অনুষ্ঠান একদম হঠাৎ করেই মাত্র ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তড়িঘড়ি করে আয়োজিত হয়েছে যা বিশ্বভারতীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পরিপন্থী। এ নিয়ে বিশ্বভারতীর শিক্ষক ও ছাত্রসমাজ যারপরনাই ভীষণভাবে অসন্তুষ্ট এবং ক্ষুব্ধ। ফলস্বরূপ, এই সমাবর্তনে ছাত্র বা শিক্ষক সমাজের উপস্থিতি প্রায় ছিলই না। সাধারণত বিশ্বভারতীর সমাবর্তনের জন্য প্রায় ২/৩ মাস আগে থেকেই প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে। সে ক্ষেত্রে এই নির্বাচনী মুহূর্তে মাত্র ৪৮ ঘন্টার মধ্যে প্রশাসনিক বিজ্ঞপ্তি জারি করে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা এবং নরেন্দ্র মোদীর এই ধরনের ভাষণ দেওয়া নিশ্চয়ই এক অন্যতম তাৎপর্য বহন করে।

প্রশ্ন হল, নরেন্দ্র মোদী তাঁর এই ভাষণে ঠিক কী বলতে চাইলেন? কিছু শিক্ষিত মানুষ বলতে কাদের বোঝাতে চাইছেন?  তাঁদের দ্বারা ছড়ানো কোন সন্ত্রাসের (!) কথা উল্লেখ করলেন? তা কি দিল্লি সীমান্তে চলমান কৃষক আন্দোলনের প্রতি সক্রিয় সমর্থনে পাশে দাঁড়ানো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় ব্যক্তি ও অ্যাক্টিভিস্টদের (যেমন, নির্ভীক সাংবাদিক, ব্লগার, দেশি বিদেশি টুইটার হ্যান্ডলার, আইনজীবী, শিল্পী ইত্যাদি) নিশানা করে? যাদের মধ্যে একাংশ বহুদিন যাবৎ এবং সাম্প্রতিক কারারুদ্ধ হয়েছেন? অথবা, উনি কি তাঁদেরকেও বোঝাতে চাইছেন- সেইসব গণতান্ত্রিক মানবতাবাদী ও  প্রগতিশীল মানুষদের- যাঁরা এই রাজ্যের আসন্ন নির্বাচনে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে কলকাতা সহ গোটা রাজ্যে সমস্বরে এক ঐকতানে জনসমাজের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টির পথে এগিয়ে চলেছেন?

'আন্দোলনজীবী', 'পরজীবী' বা 'আরবান নকশাল'-  এইসব প্রতীকি শব্দের স্রষ্টার ট্র্যাক রেকর্ড থেকে মনে হয়, উভয় ক্ষেত্রকেই এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, উগ্র হিন্দুত্ববাদী এই ফ্যাসিবাদী শক্তিটি চলমান অভূতপূর্ব কৃষক আন্দোলন এবং তার সমর্থনে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষদের সমবেত হওয়ার সামনে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে অনেকটাই বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। গোটা পাঞ্জাব ও হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, দক্ষিণ রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক ও বিহারের বহুলাংশে বিজেপি ও আরএসএস'এর অস্তিত্ব আজ ভীষণভাবে বিপন্ন। সম্প্রতি এই বাংলাতেও এই শক্তিটির নির্বাচনী জনসভায় লোকসমাগম সেভাবে আর হচ্ছে না। তাই এরা আজ ভীত। সন্ত্রস্ত। 

মনে পড়ে যাচ্ছে প্রয়াত গৌরী লঙ্কেশের কথা, ওমর খালিদের কথা, জেএনইউ, জামিয়া, এএমইউ, ডিইউ'এর ছাত্রছাত্রীদের কথা; অরুন্ধতী রায়, হর্ষ মন্দর, প্রশান্ত ভূষণ, চন্দ্রশেখর রাবণ, কানহাইয়া কুমার সহ জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জে, এডওয়ার্ড স্নোডেন'এর কথা যাঁরা তাঁদের বাস্তবতায় এ কথা আমাদের বলেছেন যে নিষ্ঠুর শাসকেরা সবচেয়ে ভয় পায় তখনই যখন শাসিতরা তাদের আর ভয় পেতে চায় না। তাই এই চরম আগ্রাসী আরএসএস-বিজেপি'র অন্যতম প্রধান কান্ডারী আজ বিচলিত। শাহিনবাগ খ্যাত কালা নাগরিক আইন বিরোধী শান্তিপুর্ণ আন্দোলনকে চরম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে ও ঠান্ডা মাথায় দিল্লির বুকে মুসলমান সমাজে গণহত্যা সম্পন্ন করার মাধ্যমে সমসাময়িকভাবে থামিয়ে দিতে পারলেও এই ফ্যাসিবাদী কেন্দ্রীয় সরকার আজকের উত্তাল কৃষক আন্দোলন এবং পশ্চিমবাংলার জনসমাজের মধ্যে ক্রম সৃষ্টিরত প্রতিবাদী আন্দোলনের সামনে রাজনৈতিকভাবে স্পষ্টতই অনেকটা বেসামাল।

তাই কি এখন একমাত্র পন্থা প্রতিবাদীদের ঠান্ডা মাথায় ভয় দেখানো? শাসানো? ক্রুরতার পথে হাঁটা? রাষ্ট্রীয় হিংসার ভয় দেখানো? হতে পারে এগুলো হয়তো শাসকের ভয় দেখানোর 'ক্রোনোলজি'! ভবিষ্যৎ'ই বলবে শেষ কথা। তবে, বিগত শতাব্দীর সাম্প্রতিক ইতিহাস কিন্তু স্পষ্ট একটি বার্তা আমাদের জানিয়ে দিয়েছে: অত্যাচারীর পতন হয় আমজনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে। ভিয়েতনামের জনতার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম থেকে শুরু করে গণরোষের আগুনে পরিসমাপ্তি ঘটে যাওয়া মুসোলিনি ও হিটলারের শাসন এবং সেই সন্ধিক্ষণে এই বিশাল অবিভক্ত ভারতীয় ভূখন্ড থেকে সেই চরম শক্তিধর বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বাধ্যতামূলক ভারত ত্যাগ- এও এক ক্রোনোলজি! তবে ঐতিহাসিক ক্রোনোলজি! কি বলুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী?


Thursday, 18 February 2021

সাধু সাবধান!

অ্যাপ নিছক অ্যাপ নয়!

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

জানা গেল, হোয়াটসঅ্যাপ’এর তথাকথিত মোকাবিলায় সম্প্রতি ভারত সরকার ‘সন্দেশ’ ও ‘সংবাদ’ নামে দুটি চ্যাট (মেসেঞ্জার) অ্যাপ’এর নির্মাণ করেছে যা খুব শীগগিরই বাজারে আসতে চলেছে। এর মধ্যে একটি হবে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে কাজের যোগাযোগ রাখার মাধ্যম অপরটি সাধারণ্যে হোয়াটসঅ্যাপ’এর বিকল্প। ভারত সরকারের ‘ন্যাশনাল ইনফরমেটিক্স সেন্টার’ এর নির্মাতা। আশ্চর্যের কথা, এই সরকার যখন প্রায় সমস্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের উদ্যোগ ও সম্পদকে বিক্রি করে দিতে উদ্যত এবং বেসরকারিকরণ তাদের মূলমন্ত্র, তখন সরকারি উদ্যোগে চ্যাট অ্যাপ’এর প্রবর্তন করে তারা ঠিক কী বার্তা দিতে চাইছে?

সকলেই জানেন, সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করা ও তাকে পূর্ণ মাত্রায় ‘ব্যবহার’ করতে দিল্লির অধীশ্বরদের জুড়ি মেলা ভার। এই কাজটি গত ৮-১০ বছর ধরে তারা অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে ও পেশাগত ভাবে পরিচালনা করে আসছে। আর তা করে তারা হাতেনাতে বেশ সরস ফলও পেয়েছে। ২০১৮ সালে অমিত শাহ রাজস্থানের একটি জনসভায় সগর্বে বলেছিলেন, আমরা চাইলে কয়েক মুহূর্তে সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করতে পারি। তার নজির গত কয়েক বছরে আমরা কম দেখিনি। নিঃসন্দেহে এ ক্ষেত্রে তাদের পারদর্শিতা তুলনাহীন।

কিন্তু ইদানীং ওদের সময় কি ভাল যাচ্ছে না? আগেই যেমন বললাম, এর আগে গোদি মিডিয়ার একতরফা সহায়তায় ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের সংগঠিত প্রবল উপস্থিতিতে দিনকাল ভালই চলছিল। হিন্দুত্বের রণহুঙ্কারে ও বিভাজনের রাজনীতির সুকৌশলী প্রয়োগে তারা দু’ দুবার দিল্লির সরকার দখল করেছে এবং একের পর এক বহু রাজ্যের মসনদে আসীন হয়েছে। মুজফফরনগর ও দিল্লির দাঙ্গায় গণহত্যা থেকে শুরু করে অসমে এনআরসি’র নামে ১৯ লক্ষ মানুষকে দেশহারা করে, সিএএ’র নামে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর মানুষকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বঞ্চিত করে, থেকে থেকে পাকিস্তানের জুজু দেখিয়ে, এমনকি হঠাৎ করে কয়েক ঘন্টার নোটিশে বিমুদ্রাকরণ ও লকডাউন জারি করে দেশ জুড়ে যে নৈরাজ্য ও বিপন্নতার আবহ তারা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে এবং প্রকারান্তরে একটা বড় অংশের মানুষকে মায়া ও মোহে মূক ও বধির করে রাখতে পেরেছে, তার পেছনে সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের সংগঠিত লাগাতার প্রচারের অশেষ ভূমিকা সর্বজনবিদিত। সে সবের পরে আপাতত সাধের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ জয়ের জন্য প্রায় নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে যে প্রবল পরাক্রমে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তার পিছনেও গোদি মিডিয়ার উদ্বাহু সমর্থন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় নির্লজ্জ ও নৃশংস মিথ্যাচারই তাদের পাথেয়। এরা কারা? কাদের হাতে আমরা বাঙালিরা পড়তে চলেছি? এই আশঙ্কা এখন বহু রাজ্যবাসীরই রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।

তবুও সময় যেন খানিক হলেও, অন্য স্বরে অন্য কথা বলতে চাইছে। একদিকে উত্তর ভারত জুড়ে প্রবল কৃষক আন্দোলনের স্থিতধী জোয়ারে বিভাজনকারী ও মিথ্যাচারীদের ঝুটা বসন খসে খসে পড়ছে, অন্যদিকে সোশ্যাল মিডিয়া’তেও এক বিপরীত ধারা জোরালো ভাবে বইতে শুরু করেছে। তার কিছু কিছু ফলাফল আমরা ঝাড়খন্ড, দিল্লি, হরিয়ানা ও বিহারের রাজ্য নির্বাচনে পেয়েছিলাম এবং অতি সম্প্রতি পাঞ্জাবের নগর পালিকার নির্বাচনে ওদের সলিল সমাধিতে আরও স্পষ্ট ভাবে তা টের পেলাম। যেন, তাদের সাধের সৌধগুলি জনতার আগুয়ান প্রতিরোধে নিমেষে ধুলায় মিশে যাচ্ছে। ‘মন কি বাত’এর ইউটিউব চ্যানেলে অপছন্দের সংখ্যা পছন্দকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। তারা তাই শঙ্কিত, আতঙ্কিত।

স্পষ্ট হচ্ছে যে, গোদি মিডিয়ার চিল-চীৎকারে আর কোনও কাজ হচ্ছে না। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে বিকল্প মিডিয়ার প্রসার হয়ে চলেছে যেখান থেকে খবরের সত্য-মিথ্যা তার আপন গরিমায় সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। পপস্টার রিহানা থেকে পরিবেশবিদ গ্রেটা থুনবার্গের পোস্ট থেকেও সারা বিশ্বে আন্দোলিত হচ্ছে এই কন্ঠস্বর। উপায়ন্তর না পেয়ে ট্যুইটার’এর ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে ডেকে হুমকি দিয়ে শাস্তির ভয় দেখিয়েও তেমন কোনও সুবিধা হচ্ছে না। শেষমেশ, ট্যুইটার’এর দেশি বিকল্প ‘কু’কে তোল্লা দিয়ে ভাবা গিয়েছিল খুব একটা কিছু করা যাবে। তাও মাঠে মারা গেল। ২১ বছরের তরুণী দিশা রবিকে জেলে পুড়ে, নিকিতা জেকব ও শান্তনু মুলুক’এর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেও এই উত্তাল হয়ে ওঠা জনমানসকে কোনওভাবেই আর রোখা যাচ্ছে না। অনড়, অটল কৃষকেরা ১৮ ফেব্রুয়ারি সারা দেশ জুড়ে চার ঘন্টার রেল রোকো করে জনতার এই মেজাজকে আরও উত্তুঙ্গে নিয়ে গেলেন। তাহলে এখন উপায়?

তেমনই একটি উপায় এবার সম্ভবত তারা বের করেছে বলে হয়তো ভাবছে। তা হল, হোয়াটসঅ্যাপ’এর বিকল্প একটি চ্যাট অ্যাপ নামানো। কেন? কী হতে পারে এর উদ্দেশ্য? অথবা, কীভাবে তা দিয়ে তারা মোকাবিলা করবে ধেয়ে আসা জনতার রোষকে? কোনও সন্দেহ নেই, ‘সন্দেশ’ বা ‘সংবাদ’ নামক অ্যাপ, যার একটি তারা সাধারণের জন্য বাজারে ছাড়তে চলেছে, তার পিছনে তাদের গুঢ় পরিকল্পনা আছে। আমরা জানি, ‘আত্মনির্ভরতা’ নামক একটি বেমালুম জুমলা তারা বেশ কিছুদিন বাজারে ছেড়ে রেখেছে। বিপদে পড়লেই তারা তার শরণাপন্ন হয়। অতএব, বোঝাই যাচ্ছে, সেই জুমলাটির ঘাড়ে চেপে তারা এবার এই অ্যাপ ব্যবহার করার জন্য চাপাচাপি করবে, সোরগোল তুলবে। এমনিতেই হোয়াটসঅ্যাপ’এর গোপনীয়তার বিধি নিয়ে নানারকম ওজর-আপত্তি আছে; অভয় দেওয়া হয়েছে ১৫ মে অবধি তার কোনও নড়চড় হবে না। বিপদ বুঝে অনেকেই ইতিমধ্যে ‘টেলিগ্রাম’ ও ‘সিগনাল’ অ্যাপ’এ পদার্পণও করে ফেলেছে। তাহলে কি এই বিভ্রান্তির সুযোগেই নতুন এই দুই অ্যাপ’এর ভাবনা? কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ‘সংবাদ’ ও ‘সন্দেশ’ অ্যাপ কতটা নিরাপদ? সবচেয়ে বড় কথা, যা বহু মানুষ ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন, বেকায়দায় পড়ে যাওয়া শাসকের এ কোনও বেপরোয়া চাল নয়তো? যে, ‘সন্দেশ’ বা ‘সংবাদ’ নামক অ্যাপ আসলে আপনার মোবাইলের সমস্ত তথ্য ও যাবতীয় কথাবার্তাকে তুলে আনার একটি প্রকৌশল? যা ডাউনলোড হওয়া মাত্রই স্পাইওয়ার’এর মতো কাজ করবে? খেয়াল করে দেখুন, দিশা রবিকে গ্রেফতার করার পর দিল্লির পুলিশ আদালতে জানিয়েছে যে তারা দীর্ঘদিন ধরেই ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ (এফএফএফ) সংগঠনের সমস্ত কার্যকলাপকে নজরদারিতে রেখেছিল। অথচ, এই এফএফএফ হল মুলত স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী ও কলেজ পড়ুয়াদের নিতান্তই পরিবেশ নিয়ে আন্দোলনের একটি অত্যন্ত নিরীহ আন্তর্জাতিক উদ্যোগ যার মূল উদ্যোক্তা গ্রেটা থুনবার্গ। গ্রেটা ১৮ বছরের এক সুইডিশ তরুণী যার নাম নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য বিবেচিত। এই যখন সার্বিক অবস্থা, যেখানে নোবেল শান্তি পুরস্কারের সম্ভাব্য প্রাপকও ঘোরতর অবিশ্বাসের তালিকায়, তখন একটি অ্যাপ’এর সাহায্যে আপনার সমস্ত কার্যাবলীকে নথিবদ্ধ করে ফেলতে তাদের দ্বিধা থাকবে কেন? তাই সাধু সাবধান!

মোদ্দা কথায়, যে সরকার’টা আজ দিল্লির কেন্দ্রীয় ক্ষমতায়, তার পিছনের রাজনৈতিক মতাদর্শ ও সংগঠনকে আর কেউ বিশ্বাস করতে চাইছে না। এমনতর পরিপ্রেক্ষিতে, তর্কের খাতিরে আর সব সন্দেহকে দূরে সরিয়ে দিয়েও এই প্রশ্নটি অতএব উত্থাপিত হওয়া খুব জরুরি যে, বেসরকারি হাতে দেশের যাবতীয় উদ্যোগকে তুলে দেওয়াই যখন দস্তুর, তখন এমন একটি সরকারি অ্যাপ’এর উদ্ভবের প্রয়োজন পড়ল কেন হঠাৎ করে তা ভাববার বিষয় নয় কী? 

 

Tuesday, 16 February 2021

আন্দোলন তীব্র হচ্ছে

শাসক আরও হিংস্র হচ্ছে

সোমনাথ গুহ

 

যত দিন যাচ্ছে কৃষক আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তা ছড়িয়ে পড়ছে, মহাপঞ্চায়েতগুলিতে ব্যাপক ভিড় হচ্ছে। রাকেশ টিকায়েত বলেছেন, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবাংলাতেও তাঁরা কৃষক সমাবেশ করবেন। এতে সরকারের ঘুম ছুটে গেছে। তারা ভাবতেই পারেনি যে তিনটি কালা কানুনের বিরুদ্ধে জনমত এত প্রবল আকার ধারণ করবে। বিদেশেও দেশের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত। ভারতে যে আসলে নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ গেড়ে বসেছে এটা এখন দিনে আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। 

এই কটা কথা বলতে হল এই কারণে যে শাসক এতই বিপন্ন বোধ করছে যে নিছক একটি ‘টুলকিট’ ব্যবহারের জন্য পরিবেশকর্মী দিশা রবিকে ১৩ ফেব্রুয়ারি তারা গ্রেফতার করল। ২১ বছরের তরুণী দিশা গ্রেটা থুনবার্গ দ্বারা অনুপ্রাণিত ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’এর একজন সক্রিয় সংগঠক। 

টুলকিট'টা কী? এটি কৃষক আন্দোলন কী ভাবে আরও সংগঠিত করা যায়, ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তার কিছু দিকনির্দেশ। যেমন, টুইটারে ঝড় তোলা, বিদেশে ভারতের দূতাবাসগুলির সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা ইত্যাদি। মামুলি এই টুলকিট ব্যবহারের জন্য দিশাকে এতই বিপদজনক মনে করা হয় যে দিল্লি পুলিশ পৌঁছে যায় বেঙ্গালুরু'তে, দিশার পরিবারকে কিছু না জানিয়ে তারা তাঁকে নিয়ে সটান ফেরত চলে আসে রাজধানীতে। সেখানে তাঁকে আদালতে হাজির করা হয় এবং অভুতপূর্ব তৎপরতার সাথে পাঁচ দিনের জন্য পত্রপাঠ জেল হাজতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও  সমাজে বিদ্বেষ, বিভাজন ছড়ানোর ধারা প্রয়োগ করা হয়। দিশার আইনজীবীদের অভিযোগ, তাঁকে কোন আদালতে উপস্থিত করা হবে তা তাঁদের জানানো হয়নি, যাঁর ফলে দিশা কোনওরকম আইনি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। 

দিশা ছাড়া মুম্বাইয়ের আইনজীবী নিকিতা জেকব এবং পুনের ইঞ্জিনিয়ার শান্তনু'র বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে। নিকিতার আইনজীবীর অভিযোগ, তাঁর মক্কেলকে ১৩ ঘণ্টা ধরে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এই তিনজন মিলে নাকি গভীর আন্তর্জাতিক ভারত-বিরোধী ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত। কারণ, এই টুলকিট'টি নির্মাণের পেছনে আছে ‘পোয়েটিক জাস্টিস ফাউন্ডেশন’ নামক একটি সংগঠন যারা আবার নাকি খালিস্তানিদের একটি ফ্রন্ট। ঐ সংগঠন বিদেশে কোথাও নিষিদ্ধ নয়, খালিস্তানিদের সাথে তাদের যোগাযোগের কোনও প্রমাণও নেই। তাদের একটা হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ ছিল এবং তারা নাকি সম্প্রতি একটি জুম মিটিংও করেছে। এসবই নাকি প্রমাণ করে দেয় যে তারা রাষ্ট্রদ্রোহী। 

ছকটা চেনা! সেই দিল্লি দাঙ্গার ‘ষড়যন্ত্রে’র মতো গপ্পো! সেই বিদেশি যোগাযোগ, হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ, দেশকে টুকরো টুকরো করার চক্রান্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। লক্ষ্যণীয় যে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ভারতের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশিদের নাক গলানোকে তুলোধোনা করেছে। অথচ এরাই মায়ানমারে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ওপর রাষ্ট্রের আক্রমণের বিরুদ্ধে  সওয়াল করে, ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্পের সমর্থকদের কার্যকলাপের নিন্দা করে। কৃষক বিদ্রোহের সমর্থনে পপ গায়িকা রিহানা, গ্রেটাদের অবস্থান ভারতীয় গণতন্ত্রের স্বরূপকে বিদেশে নগ্ন করে দিয়েছে যার প্রতিক্রিয়ায় সরকার এতটাই ক্ষিপ্ত যে তারা দিশা ও তাঁর সাথীদের নিশানা করেছে। 

 

আন্দোলন যত তীব্র হচ্ছে বিজেপি তত হিংস্র ও আগ্রাসী হচ্ছে। বাংলায় যে ভাবে তারা সদলবলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার সাথে একমাত্র অষ্টাদশ শতাব্দীর বর্গী হানার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। পাঞ্জাবে মানুষ তাদের ওপর এখন এতই ক্ষিপ্ত যে পৌর নির্বাচনে বহু জায়গায় তারা প্রার্থী দিতে পারেনি। বিজেপি প্রার্থীদের বিশেষ পুলিশ প্রহরা দিতে হয়েছে। উত্তরপ্রদেশে সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। বিশেষ করে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে তাদের অবস্থা সঙ্গীন। ঘোষণা করা হয়েছে যে কৃষক আন্দোলন অক্টোবরের দু' তারিখ অবধি চলবে যার চার মাস বাদেই উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা। আইন যদি এর মধ্যে প্রত্যাহার না হয় তবে বিজেপির ভরাডুবি নিশ্চিত। 

একই সময়ে আর একটি অল্প প্রচারিত কিন্তু নজরকাড়া সংবাদ আছে। তামিলনাড়ুর এক অভিনেত্রী ‘গোব্যাকমোদি’ টুইট করার কারণে রাজ্য বিজেপির আইনি শাখার সদস্য অ্যালেক্সিস সুধাকর তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনেছেন! কী হাস্যকর! এই দলটা মনে হচ্ছে দিশাহারা হয়ে পড়েছে। কেউ প্রতিবাদ করলেই সে দেশদ্রোহী! কৃষক বিদ্রোহ তো আছেই, এছাড়া গোদি মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা যে তলানিতে এসে ঠেকেছে এটাও তাদের একটা চিন্তার কারণ। কৃষক আন্দোলনের খবর জানতে কেউ আর মেইনস্ট্রিম চ্যানেল দেখে না, একমাত্র ব্যতিক্রম রবিশ কুমারের এনডিটিভি। এছাড়া বহু মানুষ ইউটিউবে 'ন্যাশনাল দস্তক', 'ধ্রুব রাঠি', 'দ্য লাইভ টিভি'র মতো ছোট চ্যানেল অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন। কৃষকদের সংবাদ জানার জন্য মানুষ ‘ট্রলি টাইমস’ পড়েন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সিঁদুরে মেঘ দেখছে। ইউটিউব এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া ক্রমশ একটা সমান্তরাল সংবাদ মাধ্যম হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দিশার মতো তরুণ-তরুণীরা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন এই নতুন মাধ্যমের জনপ্রিয় মুখ। তাঁরা সরকারি নীতি, দমনপীড়নের সমালোচনা করছেন, বিরোধিতা করছেন। সরকার উদ্বিগ্ন। তারা নিত্য নতুন সাইবার আইন প্রয়োগ করে এই উদ্যমকে অঙ্কুরে বিনাশ করতে চাইছে। একদিকে তারা শীর্ষ আদালতের মাধ্যমে হোয়াটস অ্যাপ কর্তৃপক্ষকে ব্যক্তি পরিসরের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে বলে নিদান দিচ্ছে, অন্যদিকে তাদের কুখ্যাত আইটি সেল ভুয়ো খবর ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত, বিপথগামী করছে। কিন্তু মানুষও আজ সেয়ানা হয়ে গেছে। দাঙ্গার কোনও ছবি দেখলেই তাঁরা জিজ্ঞাসা করছেন, এটা ফটোশপ করা না তো বা এটা গুজরাত দাঙ্গার কোনও ছবিকে বাংলার বলে চালাচ্ছে না তো! আবার এই ক্ষেত্রেও বিজেপি আর ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। আজকে কংগ্রেস সহ সব ছোট বড় বিরোধী দলের আইটি সেল আছে। কংগ্রেস তো এক লক্ষ আইটি কর্মী নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। 

তাই এবার তারা সমাজের মধ্যে চর প্রোথিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হিটলারের জার্মানি বা আজকের উত্তর কোরিয়ার মতো যেখানে পাশের বাড়ির লোক আমার ওপর নজর রাখবে- সম্পূর্ণ গোপনে, আমার অজান্তে- আমি কোনওদিন জানতেও পারব না যে আমাকে যে গ্রেফতার করা হয়েছিল তার কারণ হচ্ছে, সে আমার নামে ভুয়ো অভিযোগ করেছিল যে চার বছর আগে আমি এক মন্ত্রীর অনৈতিক কাজকর্মের বিরুদ্ধে ফেসবুকে একটা মন্তব্য করেছিলাম। সরকার এখন সাইবার ভলান্টিয়ার গঠনের ডাক দিয়েছে যারা রাষ্ট্র-বিরোধী খবরাখবর সরকারকে রিপোর্ট করবে। এই প্রকল্প পরীক্ষামূলক ভাবে প্রথমে জম্মু-কাশ্মীর ও ত্রিপুরায় চালু করা হবে। এটি নিয়ন্ত্রণ করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ‘ইন্ডিয়ান সাইবার ক্রাইম কোঅর্ডিনেশন সেন্টার’ যা I4C হিসাবে পরিচিত। যারা এই কাজ করতে ইচ্ছুক তাঁদের নাম নথিভুক্ত করতে বলা হয়েছে। ভলান্টিয়াররা চিহ্নিত করবে কোন কোন কথা, কাজ, মন্তব্য, ছবি, কার্টুন রাষ্ট্রবিরোধী এবং সেগুলি কর্তৃপক্ষকে জানাবে। সেই নির্ধারণ করবে কোনটা রাষ্ট্রবিরোধী এবং কোনটা নয়। অভুতপূর্ব ক্ষমতা থাকবে তার। সে কোনও ভুল খবর দিলে তার জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে কি না তা পরিষ্কার নয়। তার পরিচয় কেউ জানতে পারবে না, সে কোথাও জাহির করতে পারবে না যে সে এই কাজে যুক্ত আছে। 

রাষ্ট্রবিরোধী কে? কোন কাজটা রাষ্ট্রবিরোধী? এই কথাটির সংজ্ঞা কী? এই কথাটির তো কোনও আইনি ব্যাখ্যাই নেই, যদিও এর ওপরে ভিত্তি করেই ইউএপিএ'র মতো আইন চালু হয়ে গেছে। প্রতিবাদ আরও তীব্র হবে, সরকারের নখ দাঁত আরও উন্মুক্ত হবে। দিশার মতো আরও অনেকে জেলে যাবেন। আমাদের এখন ইন্দ্রজিৎ হতে হবে, মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করতে হবে। 


Wednesday, 10 February 2021

একুশের ডাক

এ লড়াই গভীর ও প্রশস্ত

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

কিছুটা অভিনব তো বটেই। এ রাজ্যে আগত বিধানসভা নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে যখন টিআরপি লোভী গোদি মিডিয়া দল-বদলের অতি-নাটকীয় দৃশ্যপর্ব তৈরি করে এক রুদ্ধশ্বাস টি-২০ ম্যাচের আবহ নির্মাণে ব্যস্ত, যেন মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনও মূল্যই কোথাও নেই, তখন এইসব হুল্লোড় ছাপিয়ে উঠে জীবনের নানা ক্ষেত্রের বেশ কিছু নাগরিক এগিয়ে এলেন জনগণের দাবি সনদ নিয়ে। মানুষের জীবনযাপন, রুজি-রোজগার ও দাবিদাওয়া ব্যতিরেকে জননির্বাচনের যে কোনও মূল্যই নেই, সেই কথাটি গোদি মিডিয়ার লম্ফঝম্ফ পেরিয়ে বেশ জোরালো ভাবে শোনা গেল নাগরিকদের কন্ঠেও। কথায় কথায় এল, দেশকাল, সুখ-দুঃখ, বিপদ-আপদের অতি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ ও বিষয়আশয়। বলাই বাহুল্য, এমনতর কোনও উদ্যোগ আমাদের পাথেয় হয়ে উঠতে পারে নিঃসন্দেহে।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার মৌলালি যুব কেন্দ্রে যে নাগরিক কনভেনশন হয়ে গেল তা নিঃসন্দেহে এ রাজ্যের নির্বাচনী আবহে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কারণ, এই প্রথম রাজনৈতিক দল ব্যতিরেকে নাগরিকদের একটা অংশ জনসমাজের কাছে পেশ করলেন ২০২১’এর বিধানসভা নির্বাচনের দাবিসনদ। স্বার্থগন্ধ লালায়িত নেতাদের দল-বদল ভিত্তিক নয়, অথবা নেতা-নির্ভর, পার্টি-নির্ভর অসহায় মানুষের ভোটবাজি নয়, ধর্ম-বর্ণ-জাতপাতের বিভাজনের অঙ্কে নয়, বরং আজকের সময়ের অভীপ্সাকে বুঝে এমন দাবি সনদ নিয়ে নাগরিকদের সোচ্চার হওয়া উচিত যা তাদের জীবন-জীবিকা ও বেঁচে থাকার পরিসরে রসদ জোগাবে। হতে পারে, এই দাবি সনদ চূড়ান্ত নয়, তা কখনও হয়ও না, কিন্তু এ এমন এক প্রয়াস যা নির্বাচনের পরেও রাজনৈতিক দলগুলির চৌহদ্দির বাইরে থেকে উত্থাপিত করে যাবে জনতার দাবি। সে অর্থে এই প্রয়াসের শুরুয়াত অনেক আশার প্রতিশ্রুতি নিয়ে হাজির।

শুরুর কথায় তাই দাবি সনদ স্পষ্টতই বলেছে, ‘... নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, ততই আমরা দেখতে পাচ্ছি, মানুষের দৈনন্দিন আলোচনার বিষয়গুলোকে দূরে সরিয়ে দিয়ে তাঁদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে সাম্প্রদায়িকতার বিষ, ছদ্ম জাতীয়তাবাদের নেশা ইত্যাদি। দলবদলের হিড়িক ও ক্ষমতা দখলের আগ্রাসী অভিযানের শোরগোল নির্বাচনকে আইপিএলের খেলায় পরিণত করে ফেলতে চাইছে। এমন এক পরিস্থিতিতে, যখন সাধারণ মানুষের কথা বলার পরিসর সংকুচিত করে তোলা হচ্ছে, তখন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির একটি অনুশীলন হিসেবে আমরা, নাগরিক সমাজের বিভিন্ন লোকেরা, অধিকার আন্দোলন ও প্রগতিশীল সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতির বিভিন্ন লোকেরা, সমাজের নানা সহনাগরিকদের সঙ্গে মতামত আদানপ্রদানের কাজটাকে একটা দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করি।’ বোঝাই যাচ্ছে, এই অনুভব ও অনুশীলন এক নির্বাচনে চলে যাওয়ার নয়। এ এমন এক নবতর উদ্যোগ যা আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির অনুষঙ্গে এক প্রাত্যহিক যোগ হিসেবে থেকে যাবে। নাগরিক কনভেনশনের মেজাজেও সে কথা উচ্চারিত হল।

অন্যতম বক্তা মৌসুমী ভৌমিক খুব তাৎপর্যপূর্ণ একটি কথা সেদিন বললেন- আমি এখানে কী আর বলব, কারণ, আপনারা তা জানেন। অর্থাৎ, এমন এক সমাবেশে তিনি বলছেন যেখানে একটি প্রাথমিক সহমত ইতিমধ্যেই বিরাজমান। এ কথার গুরুত্ব এখানেই- আরও বহু মানুষের কাছে যেতে হবে, যেখানে সহমত নেই, অথবা বহু প্রশ্নে সহমতগুলি ভেঙ্গে যাচ্ছে। ঘোরতর বিপদটা সেখানেই। মানুষের পুরনো বোঝাপড়াগুলি দ্রুত ভেঙ্গে যাচ্ছে, যেন নিমেষে পরিজন-প্রতিবেশীরা শত্রু বনে যাচ্ছেন। তা আরও স্পষ্ট হল সামিরুল ইসলামের বক্তব্যে। তিনি এক অসহায়তা প্রকাশ করলেন যেখানে গ্রামের মানুষেরা উদারচেতা, মানবিক মানুষদের যেন ভুলে যেতে চাইছেন; আপন করে নিতে চাইছেন বিভাজনকারী ও উস্কানিদাতাদের। এখানেই কঠিন-কঠোর লড়াইয়ের প্রাসঙ্গিকতা। যেভাবে উত্তাল কৃষক আন্দোলনের অভিঘাতে ২০১৩’এর মুজফফরপুরনগরের দাঙ্গার স্মৃতিকে পিছনে ঠেলে আজ আবার নতুন করে নির্মিত হচ্ছে জাঠ-মুসলমান ঐক্য, খসে পড়ছে সমস্ত বিভাজনের পোশাকগুলি, সেভাবেই আমাদেরও এ রাজ্যে ইতোমধ্যে চওড়া হওয়া বিভাজনের ফাটলগুলিকে জুড়ে দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যকে সুনিশ্চিত করতে হবে। আর সে কাজে সফলতা আসতে পারে যদি জীবন-জীবিকা ও স্বাধীন ভাবে বাঁচার মুদ্দাগুলিকে আঁকড়ে ধরে শ্রমজীবী মানুষ নিজেদের আত্ম-অধিকারের লড়াইকে সন্নিবদ্ধ করতে পারে। তা যে সম্ভব তা দেখা গেছে গত বিহার নির্বাচনের সময় যখন বিভাজন ও ধর্মের রাজনীতির বিপক্ষে জনতার দাবিদাওয়াকে নিয়ে এককাট্টা হয়ে একটা প্রবল লড়াই গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। সেই লড়াইয়ের সারমর্মকে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য নাগরিক কনভেনশনে খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপনা করলেন এই বলে যে, বিহারে হয়তো সাম্প্রদায়িক ও বিভাজনকারী শক্তিকে অল্পের জন্য গদিচ্যুত করা যায়নি, কিন্তু সেখানে তৈরি হয়েছে বিভাজনকারীদের একটি দুর্বল সরকার যার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান এক সবল বিরোধীপক্ষ। এও অত্যন্ত ইতিবাচক ঘটনা নিঃসন্দেহে।

কিন্তু এ রাজ্যে এখনও যেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ তা হল, গত কয়েক বছরে প্রবল ভাবে উঠে আসা বিভাজনকারী শক্তিকে কোন কার্যকরী উপায়ে রোখা যেতে পারে তা অনুধাবন করা। এই শক্তি উত্তর ভারতে ইতোমধ্যে কৃষক আন্দোলনের অভিঘাতে যথেষ্ট পর্যদুস্ত ও বিব্রত। সেখানে তাদের বিভাজনের রাজনীতিকে পরাস্ত করে জনতা নির্মাণ করেছেন এক নতুনতর ঐক্য। তা আগামী নির্বাচনগুলিতেই স্পষ্টত বোঝা যাবে। এ রাজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বুঝতে হবে, আপাতত উত্তাপ-সহায়ক মাত্র। কারণ, এখানের মাটিতে যতক্ষণ না বাস্তবত বিভাজনের পক্ষে ভেসে যাওয়া জনতার এক বড় অংশকে আবারও ঐক্যের শক্ত জমিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা যাচ্ছে ততক্ষণ উত্তর ভারতের এই কৃষক আন্দোলন আমাদের মনে আশার সঞ্চার করবে বটে কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এ রাজ্যের জমিকে উর্বরা করতে হবে এখানকার বাস্তব দাবিদাওয়া, আন্দোলন ও টানাপোড়েন থেকেই। সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি কীভাবে হবে ও কোন পথে, তা অবশ্যই চর্চা ও অনুশীলনের বিষয়।

বুঝতে হবে, উগ্র রক্ষণশীলতা ও বিভাজনের রাজনীতি সাম্প্রতিক সময়ে যে শক্তি সঞ্চয় করেছে তা এ রাজ্যের মাটি থেকেই। শুধুমাত্র মিথ্যা প্রচার করে তারা এই ভূমি প্রস্তুত করেছে, এ কথা বললে সত্যের অপলাপ হবে। এ মাটিতেই রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির নানা স্তরে হিংসা, বিপন্নতা ও রাজনৈতিক জোতদারির প্রখর বয়ান এমন ভাবে প্রোথিত হয়েছে যে তার বিপ্রতীপেই আরেক হিংসা-ভিত্তিক রাজনীতির উদয় হয়েছে। এ শুধু আমাদের রাজ্যে নয়, গোটা দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাই বাস্তবতার ময়দানে নেমে হোঁচট খেতে হচ্ছে- দেখা যাচ্ছে, ঘৃণা ও বিভাজনের ভাবনা ও অনুশীলনে জনতার একটা বড় অংশ সায় দিচ্ছে। এ বড় ভয়ঙ্কর দিক। এই কথাটিই সম্ভবত সামিরুল ইসলাম বলতে চেয়েছেন। বুদ্ধিজীবীসুলভ ঔদ্ধত্য ও বিশ্লেষণের আত্মগরিমা নিয়ে এই কঠিন বাস্তবতাকে মোকাবিলা করা অতএব দুষ্কর।

তাই, পুরনো চিন্তার ক্লেদকে অতিক্রম করে, উদারতার মুখোশে লুকনো রক্ষণশীলতা ও স্বার্থান্বেষী প্রয়াসকে ভেঙ্গে ফেলেই প্রকৃত অর্থে আজ ধর্মীয় উন্মাদনার আড়ালে ধেয়ে আসা হিংসাত্মক রাজনীতিকে সর্বাত্মক ভাবে মোকাবিলা করা যাবে। নাগরিক কনভেনশনে সুজাত ভদ্র খুব সঠিক ভাবেই বলেছেন যে আজ দেশের সংবিধান আক্রান্ত, বিপন্ন দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রাণভোমরাকেই মেরে ফেলতে উদ্যত আজকের আগ্রাসী দিল্লির শাসক। এরা যদি এ রাজ্যে সত্যি সত্যি ক্ষমতাসীন হয়ে যায় তবে তার থেকে ভয়ঙ্করতম আর কিছু হতে পারে না।

তাই সকলের আওয়াজ: রুখতে হবে। ধর্মের রথে আগুয়ান এই উগ্র রক্ষণশীল শক্তিকে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে পরাজিত করতে হবে। শুধুমাত্র সেটুকু নয়, তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষদাঁতকেই ভেঙ্গে দিতে হবে। সে এক গভীর ও প্রশস্ত লড়াই। সে লড়াইয়ে জনগণের দাবি সনদ এক অন্যতম হাতিয়ার। বিধানসভা নির্বাচন হোক এই দাবি সনদের ওপর, ধর্মের ভেদাভেদের ওপর নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজের অধিকার, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, নাগরিক নিরাপত্তা- এই হোক আগামী নির্বাচনের আসল মুদ্দা।

তাই, নাগরিক কনভেনশন আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় এক বিপুল গণ সমাবেশের ডাক দিয়েছে যেখান থেকে জনগণের দাবি সনদ ছড়িয়ে পড়বে রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তরে। লড়াই কঠিন কিন্তু জয় সম্ভবত নিশ্চিত।