Pages

Tuesday, 16 February 2021

আন্দোলন তীব্র হচ্ছে

শাসক আরও হিংস্র হচ্ছে

সোমনাথ গুহ

 

যত দিন যাচ্ছে কৃষক আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তা ছড়িয়ে পড়ছে, মহাপঞ্চায়েতগুলিতে ব্যাপক ভিড় হচ্ছে। রাকেশ টিকায়েত বলেছেন, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবাংলাতেও তাঁরা কৃষক সমাবেশ করবেন। এতে সরকারের ঘুম ছুটে গেছে। তারা ভাবতেই পারেনি যে তিনটি কালা কানুনের বিরুদ্ধে জনমত এত প্রবল আকার ধারণ করবে। বিদেশেও দেশের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত। ভারতে যে আসলে নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ গেড়ে বসেছে এটা এখন দিনে আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। 

এই কটা কথা বলতে হল এই কারণে যে শাসক এতই বিপন্ন বোধ করছে যে নিছক একটি ‘টুলকিট’ ব্যবহারের জন্য পরিবেশকর্মী দিশা রবিকে ১৩ ফেব্রুয়ারি তারা গ্রেফতার করল। ২১ বছরের তরুণী দিশা গ্রেটা থুনবার্গ দ্বারা অনুপ্রাণিত ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’এর একজন সক্রিয় সংগঠক। 

টুলকিট'টা কী? এটি কৃষক আন্দোলন কী ভাবে আরও সংগঠিত করা যায়, ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তার কিছু দিকনির্দেশ। যেমন, টুইটারে ঝড় তোলা, বিদেশে ভারতের দূতাবাসগুলির সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা ইত্যাদি। মামুলি এই টুলকিট ব্যবহারের জন্য দিশাকে এতই বিপদজনক মনে করা হয় যে দিল্লি পুলিশ পৌঁছে যায় বেঙ্গালুরু'তে, দিশার পরিবারকে কিছু না জানিয়ে তারা তাঁকে নিয়ে সটান ফেরত চলে আসে রাজধানীতে। সেখানে তাঁকে আদালতে হাজির করা হয় এবং অভুতপূর্ব তৎপরতার সাথে পাঁচ দিনের জন্য পত্রপাঠ জেল হাজতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও  সমাজে বিদ্বেষ, বিভাজন ছড়ানোর ধারা প্রয়োগ করা হয়। দিশার আইনজীবীদের অভিযোগ, তাঁকে কোন আদালতে উপস্থিত করা হবে তা তাঁদের জানানো হয়নি, যাঁর ফলে দিশা কোনওরকম আইনি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। 

দিশা ছাড়া মুম্বাইয়ের আইনজীবী নিকিতা জেকব এবং পুনের ইঞ্জিনিয়ার শান্তনু'র বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে। নিকিতার আইনজীবীর অভিযোগ, তাঁর মক্কেলকে ১৩ ঘণ্টা ধরে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এই তিনজন মিলে নাকি গভীর আন্তর্জাতিক ভারত-বিরোধী ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত। কারণ, এই টুলকিট'টি নির্মাণের পেছনে আছে ‘পোয়েটিক জাস্টিস ফাউন্ডেশন’ নামক একটি সংগঠন যারা আবার নাকি খালিস্তানিদের একটি ফ্রন্ট। ঐ সংগঠন বিদেশে কোথাও নিষিদ্ধ নয়, খালিস্তানিদের সাথে তাদের যোগাযোগের কোনও প্রমাণও নেই। তাদের একটা হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ ছিল এবং তারা নাকি সম্প্রতি একটি জুম মিটিংও করেছে। এসবই নাকি প্রমাণ করে দেয় যে তারা রাষ্ট্রদ্রোহী। 

ছকটা চেনা! সেই দিল্লি দাঙ্গার ‘ষড়যন্ত্রে’র মতো গপ্পো! সেই বিদেশি যোগাযোগ, হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ, দেশকে টুকরো টুকরো করার চক্রান্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। লক্ষ্যণীয় যে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ভারতের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশিদের নাক গলানোকে তুলোধোনা করেছে। অথচ এরাই মায়ানমারে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ওপর রাষ্ট্রের আক্রমণের বিরুদ্ধে  সওয়াল করে, ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্পের সমর্থকদের কার্যকলাপের নিন্দা করে। কৃষক বিদ্রোহের সমর্থনে পপ গায়িকা রিহানা, গ্রেটাদের অবস্থান ভারতীয় গণতন্ত্রের স্বরূপকে বিদেশে নগ্ন করে দিয়েছে যার প্রতিক্রিয়ায় সরকার এতটাই ক্ষিপ্ত যে তারা দিশা ও তাঁর সাথীদের নিশানা করেছে। 

 

আন্দোলন যত তীব্র হচ্ছে বিজেপি তত হিংস্র ও আগ্রাসী হচ্ছে। বাংলায় যে ভাবে তারা সদলবলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার সাথে একমাত্র অষ্টাদশ শতাব্দীর বর্গী হানার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। পাঞ্জাবে মানুষ তাদের ওপর এখন এতই ক্ষিপ্ত যে পৌর নির্বাচনে বহু জায়গায় তারা প্রার্থী দিতে পারেনি। বিজেপি প্রার্থীদের বিশেষ পুলিশ প্রহরা দিতে হয়েছে। উত্তরপ্রদেশে সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। বিশেষ করে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে তাদের অবস্থা সঙ্গীন। ঘোষণা করা হয়েছে যে কৃষক আন্দোলন অক্টোবরের দু' তারিখ অবধি চলবে যার চার মাস বাদেই উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা। আইন যদি এর মধ্যে প্রত্যাহার না হয় তবে বিজেপির ভরাডুবি নিশ্চিত। 

একই সময়ে আর একটি অল্প প্রচারিত কিন্তু নজরকাড়া সংবাদ আছে। তামিলনাড়ুর এক অভিনেত্রী ‘গোব্যাকমোদি’ টুইট করার কারণে রাজ্য বিজেপির আইনি শাখার সদস্য অ্যালেক্সিস সুধাকর তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনেছেন! কী হাস্যকর! এই দলটা মনে হচ্ছে দিশাহারা হয়ে পড়েছে। কেউ প্রতিবাদ করলেই সে দেশদ্রোহী! কৃষক বিদ্রোহ তো আছেই, এছাড়া গোদি মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা যে তলানিতে এসে ঠেকেছে এটাও তাদের একটা চিন্তার কারণ। কৃষক আন্দোলনের খবর জানতে কেউ আর মেইনস্ট্রিম চ্যানেল দেখে না, একমাত্র ব্যতিক্রম রবিশ কুমারের এনডিটিভি। এছাড়া বহু মানুষ ইউটিউবে 'ন্যাশনাল দস্তক', 'ধ্রুব রাঠি', 'দ্য লাইভ টিভি'র মতো ছোট চ্যানেল অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন। কৃষকদের সংবাদ জানার জন্য মানুষ ‘ট্রলি টাইমস’ পড়েন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সিঁদুরে মেঘ দেখছে। ইউটিউব এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া ক্রমশ একটা সমান্তরাল সংবাদ মাধ্যম হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দিশার মতো তরুণ-তরুণীরা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন এই নতুন মাধ্যমের জনপ্রিয় মুখ। তাঁরা সরকারি নীতি, দমনপীড়নের সমালোচনা করছেন, বিরোধিতা করছেন। সরকার উদ্বিগ্ন। তারা নিত্য নতুন সাইবার আইন প্রয়োগ করে এই উদ্যমকে অঙ্কুরে বিনাশ করতে চাইছে। একদিকে তারা শীর্ষ আদালতের মাধ্যমে হোয়াটস অ্যাপ কর্তৃপক্ষকে ব্যক্তি পরিসরের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে বলে নিদান দিচ্ছে, অন্যদিকে তাদের কুখ্যাত আইটি সেল ভুয়ো খবর ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত, বিপথগামী করছে। কিন্তু মানুষও আজ সেয়ানা হয়ে গেছে। দাঙ্গার কোনও ছবি দেখলেই তাঁরা জিজ্ঞাসা করছেন, এটা ফটোশপ করা না তো বা এটা গুজরাত দাঙ্গার কোনও ছবিকে বাংলার বলে চালাচ্ছে না তো! আবার এই ক্ষেত্রেও বিজেপি আর ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। আজকে কংগ্রেস সহ সব ছোট বড় বিরোধী দলের আইটি সেল আছে। কংগ্রেস তো এক লক্ষ আইটি কর্মী নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। 

তাই এবার তারা সমাজের মধ্যে চর প্রোথিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হিটলারের জার্মানি বা আজকের উত্তর কোরিয়ার মতো যেখানে পাশের বাড়ির লোক আমার ওপর নজর রাখবে- সম্পূর্ণ গোপনে, আমার অজান্তে- আমি কোনওদিন জানতেও পারব না যে আমাকে যে গ্রেফতার করা হয়েছিল তার কারণ হচ্ছে, সে আমার নামে ভুয়ো অভিযোগ করেছিল যে চার বছর আগে আমি এক মন্ত্রীর অনৈতিক কাজকর্মের বিরুদ্ধে ফেসবুকে একটা মন্তব্য করেছিলাম। সরকার এখন সাইবার ভলান্টিয়ার গঠনের ডাক দিয়েছে যারা রাষ্ট্র-বিরোধী খবরাখবর সরকারকে রিপোর্ট করবে। এই প্রকল্প পরীক্ষামূলক ভাবে প্রথমে জম্মু-কাশ্মীর ও ত্রিপুরায় চালু করা হবে। এটি নিয়ন্ত্রণ করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ‘ইন্ডিয়ান সাইবার ক্রাইম কোঅর্ডিনেশন সেন্টার’ যা I4C হিসাবে পরিচিত। যারা এই কাজ করতে ইচ্ছুক তাঁদের নাম নথিভুক্ত করতে বলা হয়েছে। ভলান্টিয়াররা চিহ্নিত করবে কোন কোন কথা, কাজ, মন্তব্য, ছবি, কার্টুন রাষ্ট্রবিরোধী এবং সেগুলি কর্তৃপক্ষকে জানাবে। সেই নির্ধারণ করবে কোনটা রাষ্ট্রবিরোধী এবং কোনটা নয়। অভুতপূর্ব ক্ষমতা থাকবে তার। সে কোনও ভুল খবর দিলে তার জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে কি না তা পরিষ্কার নয়। তার পরিচয় কেউ জানতে পারবে না, সে কোথাও জাহির করতে পারবে না যে সে এই কাজে যুক্ত আছে। 

রাষ্ট্রবিরোধী কে? কোন কাজটা রাষ্ট্রবিরোধী? এই কথাটির সংজ্ঞা কী? এই কথাটির তো কোনও আইনি ব্যাখ্যাই নেই, যদিও এর ওপরে ভিত্তি করেই ইউএপিএ'র মতো আইন চালু হয়ে গেছে। প্রতিবাদ আরও তীব্র হবে, সরকারের নখ দাঁত আরও উন্মুক্ত হবে। দিশার মতো আরও অনেকে জেলে যাবেন। আমাদের এখন ইন্দ্রজিৎ হতে হবে, মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করতে হবে। 


2 comments:

  1. বলিষ্ঠ লেখা! বাহ!!!

    ReplyDelete
  2. সাবলীল আর শক্তিশালী!

    ReplyDelete